Preamble - Dr. Sarvepalli Radhakrishnan

পরিচিতি

(ডাঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ)*


ভূমিকা-সূচী


1) পুস্তকটির গুরুত্ব
2) রচনাকাল ও পাঠভেদ
3) মুখ্য ভাষ্যকারগণ
3.1) শঙ্করের অদ্বৈতবাদ
3.2) রামানুজের বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ
3.3) মধ্বের দ্বৈতবাদ
3.4) নিম্বার্কের দ্বৈতাদ্বৈতবাদ
3.5) বল্লভের শুদ্ধাদ্বৈতবাদ
4) চরম সত্তা
5) উপদেষ্টা কৃষ্ণ
5.1) শ্রীকৃষ্ণই পরমেশ্বর 
5.2) ঈশ্বরের জন্মগ্রহণ
5.3) অবতারবাদ
6) জগতের স্বরূপ ও মায়াবাদ
6.1) জগৎ ও পরম সত্তা
6.2) সৎ ও অসৎ
6.3) মায়া, অবিদ্যা ও মোহ
7) জীবাত্মা
8) যোগশাস্ত্র
9) জ্ঞান বা মোক্ষদায়িনী প্রজ্ঞা
10) জ্ঞানমার্গ
11) ভক্তিমার্গ
12) কর্মমার্গ
13) সাধনার লক্ষ্য

1) পুস্তকটির গুরুত্ব

ভগবদ্গী‌তাকে দার্শনিক সন্দর্ভ না মনে করে ধর্মশাস্ত্র রূপে দেখাই সমীচীন । এটি বিশেষ অধিকারী লোকদের বোধগম্য গুহ্য রচনা নয়, বরং যারা "বিচিত্র ও পরিবর্তনশীল জগতে ঘুরে বেড়ায়" তাদেরও পথনির্দেশ করার জন্য জনপ্রিয় কাব্য । যারা ভগবদ্‌লোকে পৌঁছবার অন্তর্লীন রাস্তাটি খুঁজে বেড়াচ্ছে, এমন সকল সম্প্রদায়ের তীর্থযাত্রীদের অভিলাষই এর মধ্যে ভাষা পেয়েছে । উন্নতিকামী লোক যেখানে সংগ্রামান্তে জয়পরাজয়ের সম্মুখীন হয় সেখানেই আমরা বাস্তবকে গভীর ভাবে স্পর্শ করতে পাই । কোটি কোটি হিন্দু*a শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই মহান্‌ পুস্তকের মধ্যে সান্ত্বনা পেয়েছে । আধ্যাত্মিক ধর্মের যে মূল তত্ত্বগুলি কুপ্রমাণিত তথ্য, অবৈজ্ঞানিক মতবাদ বা বিধিবহির্ভূত খেয়ালের উপর প্রতিষ্ঠিত নয় তাই এই মহান্‌ পুস্তকে নির্ভুল ও মর্মভেদী ভাষায় প্রকাশ করা হয়েছে । যে প্রশস্ত ও গভীর জগৎকে যুদ্ধ ও বিপ্লব স্পর্শ করতে পারে না, বহুকালের পরাশক্তির ঐতিহ্যবাহিনী এই শাস্ত্র তার জ্ঞানের গভীরতায় এখনও পর্যন্ত সেই জগতের উপর আলোকসম্পাত করছে । আধ্যাত্মিক জীবনের নবীকরণের পক্ষে অতি শক্তিশালী উপাদান যোগায় বলে পৃথিবীর মহান্‌ ধর্মশাস্ত্রদের মধ্যে এর আসন সুপ্রতিষ্ঠিত ।

গীতার উপদেশ কোন বিশেষ চিন্তাশীল ব্যক্তি বা চিন্তাশীল গোষ্ঠির ধারণাপ্রসূত অধিবিদ্যার পদ্ধতির আকারে প্রচারিত নয় । মানবসমাজের ধর্মজীবন থেকে যে পরম্পরার উৎপত্তি হয়েছে তাকেই এতে রূপ দেওয়া হয়েছে । যে গভীর অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন ঋষি একে ভাষা দিয়েছেন তিনি সত্যকে নানা দিক দিয়ে দেখেছেন এবং সত্যের পাবন শক্তিতে প্রত্যয় রাখেন । হিন্দুদের কোন বিশেষ সম্প্রদায় নয়, সমগ্র হিন্দুত্বের সারমর্ম এতে প্রতিফলিত হয়েছে, শুধু হিন্দুত্বই কেন, দেশকালনিরপেক্ষ সর্বব্যাপী ধর্ম, যা বর্বরদের স্থূল বস্তুরতি থেকে আরম্ভ করে সাধুসন্তদের সৃষ্টিধর্মী অনুভূতির স্বীকৃতি পর্যন্ত ব্যাপ্ত, মানবাত্মা দ্বারা অধ্যুষিত সেই সমগ্র ক্ষেত্র, গীতার মধ্যে সুসমঞ্জস রূপে প্রকাশ পেয়েছে ।*b সভ্যতার বহিরঙ্গের সার্বিক স্বীকৃতি দ্বারা যে পৃথিবী বাস্তব দিক দিয়ে এক হয়ে উঠেছে তাকে রক্ষা করতে হলে মন ও আত্মার যে বোঝাপড়া যে একান্তভাবে প্রয়োজন - অস্তিত্বের অর্থ ও মূল্য, নিত্যবস্তু সম্বন্ধে বোধ এবং যে উপায়ে যুক্তি ও নৈতিক স্বজ্ঞা দ্বারা চরম রহস্যগুলির উপর আলোকপাত করা যায় সে সম্বন্ধে গীতায় যে সমস্ত ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে, তাদের উপরেই তার ভিত্তি স্থাপিত হতে পারে ।

অধ্যায়ের উপসংহার অনুযায়ী ভগবদ্‌গীতা একই সঙ্গে অধিবিদ্যা ও নীতিশাস্ত্র, "ব্রহ্মবিদ্যা ও যোগশাস্ত্র," সত্তা সম্বন্ধীয় বিজ্ঞান এবং সত্তার সহিত মিলনের কলাবিদ্যা । আধ্যাত্মিক সত্য তারাই উপলব্ধি করতে পারে যারা কঠোর সাধনা দ্বারা নিজেদের তার জন্য প্রস্তুত করেছে । পরাজ্ঞান লাভ করতে হলে মনকে সর্বপ্রকার বিক্ষেপমুক্ত করতে হবে এবং হৃদয়কে সম্পূর্ণ ভাবে নির্মল করতে হবে ।*c আবার সত্যকে প্রত্যক্ষ করলে নব জীবন লাভ করা যায় । জীবনের ক্ষেত্র আত্মার ক্ষেত্রের সঙ্গে সম্পর্করহিত নয় । মানুষকে বাহিরের বাসনা ও অন্তরের গুণ এই দুই ভাগে বিভক্ত করলে মানবজীবনের অখণ্ডতা ব্যাহত হয় । তত্ত্বজ্ঞানীরা ভগবানের রাজপুরুষ, তাঁরা সংসারকে স্পর্শ দ্বারা প্রভাবান্বিত করেন এবং অন্যকে উদ্ধার করেন । গীতার প্রারম্ভে মানুষের কর্মের সমস্যা উত্থাপন করা হয়েছে । পরমাত্মায় লীন থেকেও কিভাবে জগতে কাজ করে যেতে পারি ? এর যে উত্তর দেওয়া হয়েছে তা হিন্দুধর্মেরই ঐতিহ্যানুসারী, কিন্তু বলার মধ্যে তাকে আরও স্ফুটতর করা হয়েছে ।

রচয়িতা গীতাকে উপনিষদ আখ্যা দিয়েছেন, কেননা উপনিষদ নামে বিশিষ্ট ধর্মশাস্ত্রাবলী থেকেই এর মূলভাব গ্রহণ করা হয়েছে । গীতায় যদিও আমরা সত্যের এক গভীর ও মর্মস্পর্শী রূপ দেখতে পাই এবং যদিও তা মানব মনকে নূতন নূতন পথ দেখিয়েছে, তবু এতে যে সকল সিদ্ধান্ত স্বীকৃতি পেয়েছে, তা প্রাচীন ঐতিহ্যেরই অংশ এবং গীতায় ব্যবহৃত ভাষায় সেই ঐতিহ্য গ্রথিত । রচনারযুগের চিন্তাশীল ব্যক্তিদের মনে যে সকল চিন্তা ও অনুভূতি বিকশিত হচ্ছিল তারই সার এর মধ্যে দানা বেঁধেছে ও গাঢ় হয়েছে । ভ্রাতৃদ্বন্দ্বকে উপলক্ষ করে উপনিষদের "প্রজ্ঞা পুরাণী"র ভিত্তিতেই এক আধ্যাত্মিক বাণী বিকশিত হয়েছে ।

গীতার রচনাকালে হিন্দুধর্মতন্ত্রের মধ্যে যে সকল মূল সূত্রের দ্বন্দ্ব চলছিল, তাদের এর মধ্যে একত্র করে এক সার্বিক সমন্বয় করা হয়েছে । তার সম্পূর্ণ রূপ মুক্ত ও প্রশস্ত, গূঢ় ও গভীর । বৈদিক যজ্ঞকাণ্ড, উপনিষদের তুরীয় ব্রহ্মবাদ, ভাগবতের ঈশ্বরবাদ ও সুকুমার ভক্তি, সাংখ্যের দ্বৈতবাদ এবং যৌগিক ধ্যান, এই সমস্ত বিবিন্ন চিন্তাধারাকে গীতারচয়িতা মার্জিত করে সামঞ্জস্য বিধান করেছেন । তিনি হিন্দু জীবন ও মননের এই সমস্ত সজীব উপাদানের সুসন্বদ্ধ মিলন ঘটিয়েছেন । কোনটিকেই বর্জন না করে তাদের প্রত্যেকটির মর্মভেদ করে দেখিয়েছেন যে কিভাবে এই ভিন্ন ভিন্ন চিন্তাধারা একই লক্ষ্যে পৌঁছবার পথ ।



2) রচনাকাল ও পাঠভেদ

যে মহান্‌ আলোড়নের ফলে প্রথম দিকের উপনিষদগুলি রচিত হয়েছিল, ভগবদ্গী‌তার রচনাকাল তার পরের, কিন্তু ষড়দর্শনের বিকাশ ও তাদের সূত্রাকারে গ্রন্থন কালের আগে । অপ্রচলিত শব্দসংঘটন ও আভ্যন্তরীণ উল্লেখসমূহ থেকে ধরে নেওয়া যায় যে এর রচনা নিশ্চিত খৃষ্টপূর্ব যুগের । মোটামুটি খৃষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে লেখা বলা যায় । অবশ্য পরে গ্রন্থের মূল বচনে কিছু কিছু অদল বদল হয়ে থাকতে পারে ।

গীতা-রচয়িতার নাম আমরা জানি না । প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যের প্রায় সকল গ্রন্থের রচয়িতাই অনামা । প্রচলিত কাহিনীতে মহাভারতের গ্রন্থনা যিনি করেছেন, সেই ব্যাসদেবের উপরই গীতার রচনা আরোপ করা হয়ে থাকে । মহাভারতের ভীষ্মপর্বের ২৩ থেকে ৪০ সংখ্যক পরিচ্ছেদই গীতার অষ্টাদশ অধ্যায় ।

কৃষ্ণের পক্ষে যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে অর্জুনকে সাত শ' শ্লোক শোনানো সম্ভব নয় বলে অনেকে মনে করেন । তিনি হয়ত গুটিকতক বিশেষ নির্দেশ দিয়েছিলেন যেগুলিকে গ্রন্থনাকারী পরে বিস্তৃত করে এক প্রশস্ত রচনায় পর্যবসিত করেন । গার্বের মতে ভগবদ্‌গীতা গোড়ায় এক সাংখ্য যোগের গ্রন্থরূপে রচিত হয়েছিল, পরে কৃষ্ণ বাসুদেব ভক্তিতত্ত্ব তার সঙ্গে মিশে যায় এবং খৃষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে কৃষ্ণকে বিষ্ণুর সঙ্গে অভিন্ন করে বৈদিক ধর্মের সঙ্গে সামঞ্জস্য সাধন করা হয় । আদি রচনাকাল প্রায় খৃষ্টপূর্ব ২০০, এবং কোন বৈদান্তিক তার বর্তমান রূপ দেন খৃষ্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীতে । গার্বের মত সাধারণ ভাবে অগ্রাহ্য হয়েছে । হপ্‌কিন্‌সের মতে "এটি একটি পুরাতন বৈষ্ণব কাব্যের কৃষ্ণীয় রূপ, আবার বৈষ্ণব কাব্যটি পূর্বে একটি সম্প্রদায়নিরপেক্ষ রচনা ছিল, সম্ভবতঃ কোন অর্বাচীন উপনিষদ ।" হল্‌ৎস্‌মান গীতাকে সর্বেশ্বরবাদী কাব্যের বৈষ্ণব সংস্করণ বলে মনে করেন । কীথের ধারণা এটি প্রথমে শ্বেতাশ্বতর ধরণের একটি উপনিষদ ছিল পরে কৃষ্ণভক্তদের উপযোগী করে পরিবর্তিত করা হয়েছে । বারণেটের মতে রচয়িতার মনে ভিন্ন ভিন্ন ঐতিহ্যধারা এলোমেলো ভাবে মিশে গিয়েছিল । রুডল্‌ফ অটো বিশ্বাস করেন যে প্রাথমিক গীতা একটি চমৎকার মহাকাব্যাংশ ছিল এবং তাতে বিশিষ্ট তত্ত্বের স্থান ছিল না । মোক্ষদায়িনী কোন তুরীয় মতবাদের নির্দেশ দেওয়া কৃষ্ণের উদ্দেশ্য ছিল না, যে সর্বশক্তিমান্‌ ঈশ্বর যুদ্ধের ফলাফল নির্ধারণ করেন, অর্জুনকে তাঁর বিশেষ সেবায় নিয়োজিত হতে উৎসাহ দেওয়াই তাঁর ইচ্ছা ছিল । অটোর ধারণা সম্প্রদায়গত মতবাদগূলি প্রক্ষিপ্ত । এই ধারণায় জাকোবি তাঁর সঙ্গে একমত । তিনিও মনে করেন যে মূল রচনা পরবর্তী সাম্প্রদায়িক পণ্ডিতদের দ্বারা বর্তমান আকারে প্রসারিত হয়েছে ।

এই যে এতগুলি মতের উদ্ভব হয়েছে তার কারণ বোধ হয় এই যে গীতার মধ্যে বহু এবং বিচিত্র খাতে প্রবাহিত দার্শনিক তত্ত্ব ও ধর্মবাদের ধারা মিলিত হয়েছে । অনেক আপাতবিরোধী প্রত্যয়কে কালোপযোগী করে সরল ঐক্যসাধন করা হয়েছে । সমস্ত ধর্মীয় প্রত্যয়ের উপরই ঈশ্বরের প্রসাদ আছে, এই বিশুদ্ধ ধারণার উপর তার ভিত্তি । বিভিন্ন চিন্তাপ্রবণতাকে গীতা সত্যসত্যই সমন্বয়ে আনতে পেরেছে কি না, তা প্রত্যেক পাঠককে পুস্তকখানি সম্পূর্ণ অধ্যয়ন করে নিজেকেই স্থির করতে হবে । ভারতীয় সাধক পরম্পরা বরাবরই অনুভব করে এসেছেন যে রচয়িতার মনে আপাত অসমঞ্জস মতগুলি অতঃপ্রোতভাবে মিশে গেছে এবং তিনি যে চমৎকার সামঞ্জস্যের ইঙ্গিত দিয়েছেন এবং যার উপর উজ্জ্বল আলোকসম্পাত করেছেন তা সত্যকার পারমার্থিক জীবনের সহায়ক, যদিও তিনি ঐ সামঞ্জস্যের সমস্ত খুঁটিনাটি অঙ্গ যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন নি ।

শঙ্করভাষ্য এই কাব্যের প্রচলিত ভাষ্যসমূহের মধ্যে প্রাচীনতম, এবং তিনি ভাষ্য সংকলনে যে পাঠ অনুসরণ করেছেন, তাকেই গ্রহণ করলে আমাদের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে ।



3) মুখ্য ভাষ্যকারগণ

গীতা বহু প্রাচীনকাল থেকেই নিষ্ঠাবান হিন্দুদের কাছে উপনিষদ ও ব্রহ্মসূত্রের সঙ্গে সমান ভাবে প্রামাণ্য ধর্মশাস্ত্র বলে আদৃত হয়ে আসছে এবং এই তিন শাস্ত্রকে একত্রে প্রস্থান-ত্রয় বলা হয় । বেদান্তবাদীদের তাঁদের বিশেষ মতবাদকে প্রতিষ্ঠিত করতে এই তিন প্রামাণ্য শাস্ত্রের আশ্রয় নিতে হয়েছে, কাজেই ঐ সকল শাস্ত্রের উপর ভাষ্য রচনা করে ঐ সকল শাস্ত্রের ভাষা কিভাবে তাঁদের বিশেষ মতবাদকে প্রতিষ্ঠা করতে সহায়তা করে তাই দেখাতে চেয়েছেন । পরমব্রহ্মের প্রকৃতি ও জগতের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক সম্বন্ধে উপনিষদে নানাপ্রকার বিভিন্ন ইঙ্গিত আছে । ব্রহ্মসূত্র এত ভাবঘন ও অস্পষ্ট যে তাকে নানাভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব । সেদিক দিয়ে গীতার উপদেশ সুসঙ্গত, কাজেই ভাষ্যকারগণের পক্ষে তাকে নিজেদের বিশেষ মতবাদের সমর্থনে ব্যাখ্যা করতে যাওয়া কঠিনতর হয়েছে । ভারতবর্ষে বৌদ্ধধর্মের প্রভাব কমে যাওয়ার পরে, হিন্দুধর্মের নানা সম্প্রদায়ের অভ্যত্থান হয়, তার মধ্যে প্রধান অদ্বৈতবাদ, বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ, দ্বৈতবাদ এবং শুদ্ধাদ্বৈতবাদ । এই সকল সম্প্রদায়ের গুরুরা তাঁদের রচিত গীতার ভাষ্যে নিজ সম্প্রদায়ের মতবাদের সমর্থন করা যায় এবং অন্য সম্প্রদায়ের মতবাদকে খণ্ডন করা যায় এমন ভাবেই গীতার ব্যাখ্যা করেছেন । এই সকল লেখকরা গীতার মধ্যে তাঁদের নিজ সম্প্রদায়ের ধর্মীয় চিন্তা ও অধিবিদ্যার সমর্থনের প্রমাণ সংগ্রহ করতে পেরেছেন এই জন্য যে গীতার রচয়িতা নিজে এইরূপ আভাস দিয়েছেন যে নিত্যসত্যকে আমরা সবাই খুঁজি এবং যা থেকে বাকী সমস্ত সত্যের উৎপত্তি হয়েছে, তা কোন একমাত্র সূত্রে গ্রথিত করা যায় না । আবার ধর্মশাস্ত্রের অধ্যয়ন ও মনন দ্বারা আমরা ততখানিই সজীব সত্য ও আধ্যাত্মিক প্রভাব আয়ত্ত করতে পারি, পাওয়ার যতখানি যোগ্যতা আমাদের আছে ।

3.1) শঙ্করের অদ্বৈতবাদ (৭৮৮-৮২০ খৃঃ)

যতগুলি ভাষ্য বর্তমানে প্রচলিত আছে তার মধ্যে শঙ্কর প্রণীত ভাষ্যই প্রাচীনতম । এর থেকেও প্রাচীনতম ভাষ্য ছিল, যে কথা শঙ্কর তাঁর ভাষ্যের মুখবন্ধে উল্লেখ করেছেন, কিন্তু তারা আমাদের কালে লোপ পেয়েছে ।*a শঙ্কর জোর দিয়ে বলেছেন যে পরম সত্তা বা ব্রহ্মণ্‌ একমেবাদ্বিতীয়ং । সমগ্র প্রকট জগৎ ও তার বহুরূপতা, কোনটারই বাস্তব সত্তা নেই, অবিদ্যাগ্রস্ত লোকেদের কাছেই তা বাস্তব বলে মনে হয় । অবিদ্যার কবলে পড়েই আমাদের সকলের বন্ধন । সে দশা থেকে নিজের চেষ্টায় মুক্তি পাওয়া অসম্ভব । কর্ম বৃথা, তাতে আমাদের আরও বেশী করে অনন্ত কার্যকারণ সম্বন্ধিত অবাস্তব জগৎসংসারে জড়িয়ে ফেলে । জ্ঞান দ্বারা সার্বিক সত্তা ও প্রাতিস্বিক সত্তাকে অভিন্ন বলে বুঝতে পারলে তবেই পরিত্রাণ । এই জ্ঞানের উদয় হলে, অহম্‌ বিলুপ্ত হয়, বিক্ষেপের সমাপ্তি ঘটে এবং আমরা অবিমিশ্র আনন্দ দ্বারা ধন্য হই । সৎ (আছেন) শুধু এই ভাবেই ব্রহ্মের সংজ্ঞা দেওয়া যায় । আর তিনি যখন সকল বিধেয়ের ঊর্ধ্বে এবং কর্তা, কর্ম আদি সকলপ্রকার জ্ঞানক্রিয়ার বৈশিষ্ট বর্জিত তখন তাঁকে কোন সগুণ ব্যক্তিরূপে বিবেচনা করা যায় না, কাজেই তাঁর প্রতি প্রেম বা ভক্তির প্রশ্ন ওঠে না ।

শঙ্করের মতে মনঃশুদ্ধির উপায় হিসাবে কর্ম অপরিহার্য হলেও প্রজ্ঞা লাভের সঙ্গে সঙ্গেই কর্ম খসে পড়ে । জ্ঞান ও কর্ম আলোক ও অন্ধকারের মত পরস্পরবিরোধী । তিনি জ্ঞানকর্মসমুচ্চয় মতকে অস্বীকার করেন ।*b তাঁর বিশ্বাস যারা অবিদ্যা ও কামনাগ্রস্ত শুধু তাদের জন্যই বৈদিক ক্রিয়াকাণ্ডের বিধান । মোক্ষার্থীদের সকল প্রকার আনুষ্ঠানিক ক্রিয়া বর্জন করা উচিত । শঙ্করের কাছে গীতার লক্ষ্য হল কার্যকারণ সম্বন্ধ জড়িত সকল প্রকার কর্মের ক্ষেত্র সংসারকে বিলোপ করা । যদিও তাঁর নিজ জীবন প্রজ্ঞালাভের পরও কর্মতৎপরতার এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ ।

শঙ্করের মতের আরও বিস্তার করেন আনন্দগিরি (সম্ববতঃ ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে), শ্রীধর (১৪০০ খৃঃ) এবং মধুসূদন (ষোড়শ শতাব্দী) এবং আরও কয়েকজন । মারাঠী সন্ত তুকারামজ্ঞানেশ্বর নিজেরা ভক্তিমার্গ আশ্রয় করেও অধিবিদ্যায় শঙ্করের যুক্তি স্বীকার করেন ।


3.2) রামানুজের বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ (খৃঃ একাদশ শতাব্দী)

রামানুজ তাঁর ভাষ্যে জগতের অবাস্তবতাবাদ ও নিষ্কর্ম মার্গকে খণ্ডন করেছেন । গীতার্থসংগ্রহে যামুনাচার্য যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তাই তিনি গ্রহণ করেছেন । সর্বোচ্চ সত্তা ব্রহ্মভাব স্বরূপ কিন্তু সগুণ, তাঁর স্বজ্ঞান ও আত্মচেতনা আছে, জগৎ সৃষ্টি করায় এবং তাঁর সৃষ্ট জীবদের মোক্ষদানে সংজ্ঞাত সংকল্প আছে । তিনি সকল ভাবগত বিধেয়ের সমষ্টি, অনন্ত ও নিত্য, সমস্ত জগতের পূর্বে ও ঊর্ধ্বে, এবং অদ্বিতীয় । বৈদিক দেবতাদের তিনি তাঁর সেবকরূপে সৃষ্টি করেছেন এবং তাদের নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে কর্ম করতে নিয়োজিত করেছেন । জগৎ মায়াও নয়, প্রবঞ্চনাও নয়, পরন্তু যথার্থ ও বাস্তব । দেহ ও আত্মা যেমন এক, জগৎ ও ঈশ্বরও তেমনি অভিন্ন । উভয় মিলে তারা সমগ্র, যদিও তাদের ভেদ অপরিবর্তনীয় । সৃষ্টির আগে, জগৎ অস্ফুট আকারে ছিল, বর্তমান ও বিচিত্ররূপে বিকশিত হয় নি । সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে তারা নাম ও রূপ পরিগ্রহ করেছে । জগৎকে ঈশ্বরের দেহ রূপে প্রতিপন্ন করে এই আভাসই দেওয়া হয়েছে যে জগৎ কোন ভিন্ন প্রকৃতির অপর সত্তা নয়, ব্রহ্ম নিজের প্রকৃতিতেই তার সৃষ্টি করেছেন । ঈশ্বর একই সঙ্গে জগতের সমবায়ী কারণ ও করণিক দেহ ও আত্মার উপমা থেকে এই বোঝায় যে দেহ যেমন আত্মার উপর একান্তনির্ভর তেমনি ঈশ্বরেই জগতের একান্ত অবলম্বন । জগৎ যে শুধু ঈশ্বরের দেহ তাই নয়, এ তাঁর অবশেষ - "ঈশ্বরস্য শেষ্য" এবং এই বাক্যাংশ জগতের সম্পূর্ণ অধীনতা ও নির্ভরতারই দ্যোতক ।

সকল প্রকার চেতনা সম্বন্ধেই দুই পক্ষ অনুমান করতে হয়, এক যাঁর চেতনা তিনি এবং যে সম্বন্ধে চেতনা সেই বস্তু । কিন্তু রামানুজের চিৎ সংক্রান্ত ধারণা অন্যপ্রকার । তিনি তাকে নিঃসৃয়মাণ পরবশ বস্তু মনে করেন (ধর্মভূত দ্রব্য) । অহং (জীব) অবাস্তব নয় এবং তা মোক্ষলাভের সময় লয়প্রাপ্ত হয় না । উপনিষদের "তৎ ত্বম্‌ অসি" মানে "ঈশ্বর আমার নিজস্ব" যেমন আমার আত্মা আমার দেহে নিজস্ব । ঈশ্বর আত্মার ধারক ও নিয়ন্তাতত্ত্ব, যেমন আত্মা দেহের ধারকতত্ত্ব । ঈশ্বর ও আত্মা একই বস্তু, অভিন্নার্থে নয়, ঈশ্বর আত্মার (আত্মায় ?) অন্তর্বাসী ও অনুপ্রবিষ্ট বলে । তিনি অন্তর্যামীরূপে আত্মার গভীরে বাস করে তাকে পথ দেখান, তাই তিনি তার জীবনের সারসত্তা । কিন্তু অন্তর্লীনতা ও অভিন্নতা এক নয় । কালবশই হোক বা কালাতীতই হোক্‌, সৃষ্টি স্রষ্টা থেকে স্বতন্ত্র থাকবে ।

রামানুজের গীতাভাষ্যে এক ধরণের ব্যক্তিগত অতীন্দ্রিয়তার ক্রমবিকাশ দেখা যায় । মানবাত্মার গুহ্যঅংশে ঈশ্বরের বাস, কিন্তু সে অস্তিত্ব তার কাছে অজানা থেকে যায়, যতক্ষণ না জ্ঞানের আলোক তাকে চরম অজ্ঞতা থেকে উদ্ধার করে । সর্বান্তঃকরণে ঈশ্বরের সেবা করেই সে জ্ঞান আমরা অর্জন করতে পারি । দিব্যপ্রসাদ দ্বারা বিশিষ্ট ব্যক্তিদের পক্ষেই পরিপূর্ণ বিশ্বাস সম্ভব । রামানুজ স্বীকার করেন যে গীতাতে জ্ঞান, ভক্তি ও কর্ম সবগুলিরই উল্লেখ আছে, কিন্তু তাঁর মতে ভক্তির উপরই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে । রামানুজ পাপের অসারতা, তীব্র দিব্যানুরক্তি, ঈশ্বরের সর্বজয়ী প্রেমে প্রত্যয় ও নির্ভরতাবোধ এবং দিব্য প্রসাদ দ্বারা বৈশিষ্ট লাভের অনুভূতি প্রভৃতির উপর জোর দিয়েছেন ।

রামানুজের কাছে ব্রহ্মই বিষ্ণু । তিনিই একমাত্র পূজ্য, তাঁর দিব্য বিভূতির কোন অংশীদার নেই । বৈকুণ্ঠে ঈশ্বরের সঙ্গলাভ ও তাঁর সেবায় রত হওয়াই মোক্ষ ।


3.3) মধ্বের দ্বৈতবাদ (১১৯৯-১২৭৬ খৃঃ)

মধ্বের ভগবদ্‌গীতার উপর দুখানি রচনা আছে, গীতাভাষ্য ও গীতা-তাৎপর্য । তিনি গীতা থেকে দ্বৈতবাদদর্শন সমর্থক প্রমাণ সংগ্রহ করার চেষ্টা করেছেন । তিনি বলেন যে পরমাত্মাকে এক ভাবে আত্মার সঙ্গে অভিন্ন কল্পনা করা আর এক ভাবে পৃথক কল্পনা করা স্ববিরোধী । এই দুইকে চিরকালের জন্যই ভিন্ন বলে ভাবতে হবে এবং তাদের আংশিক বা পূর্ণ মিলন অসঙ্গত । "তৎ ত্বমসি" বাক্যাংশের তিনি এই ব্যাখ্যা দেন যে আমার ও তোমার এই পার্থক্য বোধ বর্জন করতে হবে এবং মনে করতে হবে সমস্তই ঈশ্বরাধীন । মধ্বের মতে গীতাতে ভক্তিতত্ত্বকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে ।

3.4) নিম্বার্কের দ্বৈতাদ্বৈতবাদ (১১৬২ খৃঃ)

তিনি ব্রহ্মসূত্র সম্বন্ধে লিখেছেন ও তাঁর শিষ্য কেশবকাশ্মিরী "তত্ত্বপ্রকাশিকা" নামে গীতার এক ভাষ্য রচনা করেছেন । নিম্বার্কের মতে জীব, জগৎ ও ঈশ্বর পরস্পর থেকে ভিন্ন অথচ জীব ও জগতের অস্তিত্ব ও ক্রিয়া ঈশ্বরের ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল । ব্রহ্মের উপর ভক্তি নিম্বার্কের রচনাবলীর প্রধান প্রতিপাদ্য ।

3.5) বল্লভের শুদ্ধাদ্বৈতবাদ (১৪৭৯ খৃঃ)

সম্পূর্ণ শুদ্ধ ও মায়ার প্রভাবমুক্ত জীব ও পরম ব্রহ্ম অভিন্ন । অগ্নির যেমন স্ফুলিঙ্গ আত্মাও তেমনি পরমাত্মারই অংশ এবং মোক্ষলাভের জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান ব্রহ্মকৃপা ছাড়া অর্জন করা যায় না । মোক্ষলাভের সর্বশ্রেষ্ঠ উপায় ঈশ্বর ভক্তি । ভক্তি প্রেম ও সত্যের সন্ধি ।

গীতার অন্যান্য ভাষ্য

গীতার আরও কয়েকটি ভাষ্য আছে এবং সাম্প্রতিককালের প্রধান ভাষ্যকার বালগঙ্গাধর তিলকশ্রীঅরবিন্দ । গীতা সম্বন্ধে গান্ধীর আবার নিজস্ব মতামত আছে ।

ব্যাখ্যার ভিন্ন ভিন্ন রূপ দ্রষ্টার দৃষ্টিভঙ্গির বিভিন্নতা থেকে উদ্ভূত । হিন্দু ঐতিহ্য এই যে বিভিন্ন মতগুলি পরস্পরের পরিপূরক । এমন কি ভারতীয় দর্শনের ভিন্ন ভিন্ন বিভাগ দর্শনেরই ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ এবং পরস্পরের পরিপূরক, পরস্পরবিরোধী নয় । ভাগবতে আছে যে ঋষিরা সার সত্যই বিভিন্ন রূপে প্রকাশ করেছেন । একটি প্রচলিত শ্লোক আছে দেহের দিক থেকে আমি তোমার দাস, জীব বুদ্ধি থেকে আমি তোমার অংশ, আত্মার দিক থেকে আমি ও তুমি অভিন্ন, এই আমার বিশ্বাস ঈশ্বরকে আমি বা তুমি রূপে দেখা চেতনার স্তরের উপর নির্ভর করে ।



4) চরম সত্তা

গীতায় অধিবিদ্যা সম্বন্ধে যে সিদ্ধান্ত আছে তার সমর্থনে কোন যুক্তি দেওয়া হয় নি । যে তর্কের ভাষা ও ভঙ্গী মানবজাতির বেশীর ভাগ লোকই বুঝতে অসমর্থ তার দ্বারা ব্রহ্মের অস্তিত্ব সংক্রান্ত মীমাংসা করা সম্ভব নয় । ব্যক্তিগত উপলব্ধি বাদ দিয়ে বিশুদ্ধ তর্কদ্বন্দ্ব দিয়ে মনে স্থির বিশ্বাস জন্মানো যায় না । পরমাত্মার অস্তিত্বের প্রমাণ আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা দ্বারাই সিদ্ধ হতে পারে ।

উপনিষদে এক ও অদ্বিতীয়, নির্গুণ ও নিরুপাধিক পরমব্রহ্মের অস্তিত্ব দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করা হয়েছে, সেই ব্রহ্ম মানুষের অন্তরতম আত্মার সঙ্গে অভিন্ন । জ্ঞাত ও জ্ঞাতার মধ্যে যে দ্বিত্ব, তাকে যে সর্বাত্মক ঐক্য অতিক্রম করতে পারে তাকে ঘিরেই আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতার স্থিতি । সেই অভিজ্ঞতাকে প্রচলিত ধারণাসমূহের ভাষায় বর্ণনা করার অক্ষমতার জন্যই শুদ্ধ ও সরল অভিন্নতা দিয়ে বর্ণনা দিতে হয় । সকল জটিলতাবর্জিত শুদ্ধ সারল্য ব্রহ্ম নিজেই স্বজ্ঞার বিষয় এবং সেই স্বজ্ঞায়ই তাঁর স্থিতি । তিনি শুদ্ধ প্রতিপাদ্য, তাঁর অস্তিত্ব বাহ্য বা বিষয়বস্তুর জগতে প্রক্ষেপ করা যায় না ।

যথার্থ ভাবে বলতে গেলে ব্রহ্ম অবর্ণনীয় । কঠোর বাক্‌সংযম দ্বারাই আমাদের অপরিস্ফুট বর্ণনা এবং ত্রুটিপূর্ণ মান সকলের অপ্রতুলতা ব্যক্ত করতে পারি ।*a বৃহদারণ্যক উপনিষদে আছে "সবই যখন পরমাত্মায় পর্যবসিত হয়েছে, তখন কার সম্বন্ধে আর কি দিয়েই বা চিন্তা করা যাবে ? সার্বিক জ্ঞাতাকে কি দিয়ে আমরা জানব ? বিতর্কমূলক চিন্তায় জ্ঞেয় ও জ্ঞানের মধ্যে যে দ্বিত্বের উদ্ভব হয় তাকে অতিক্রম করে যেতে হয় । যিনি শাশ্বত তিনি এমন অসীম ভাবে সত্য যে তাঁকে আমরা এক বলতেও সাহস করি না, কেননা একত্বের ধারণাটাই ত জাগতিক অভিজ্ঞতা (ব্যবহার) প্রসূত । সেই জন্যই তাঁকে আমরা অদ্বিতীয় বলি, অর্থাৎ অদ্বৈত, যাঁকে তখনই জানা যায় যখন সমস্ত দ্বিত্ব পরম অভিন্নতায় বিলুপ্ত হয় । উপনিষদকে তাই নঞর্থক ভাষার আশ্রয় নিতে হয়েছে । সত্য ইহা নয়, (নেতি নেতি) বিদেহী, অক্ষত, অপাপবিদ্ধ*b, তমঃহীন, ছায়াহীন, বহিরন্তর ভেদ বর্জিত*c - ভগবদ্‌গীতার বহু অংশে উপনিষদের এই মতের সমর্থন আছে । ব্রহ্মকে "অব‍্যক্ত, অচিন্ত্য, নির্বিকার" "সৎও নন অসৎও নন" - পরস্পর বিরোধী বিধেয়ের আরোপ করার অর্থই এই যে প্রায়োগিক উপাধি তাঁর ক্ষেত্রে খাটে না । "স্থাবর অথচ জঙ্গম । সুদূর অথচ নিকট" ব্রহ্মের দ্বৈত প্রকৃতি ভব ও ভবিষ্ণু, এই ধরণের বিধেয় দিয়ে বোঝানো হয় । তিনি পরা, অর্থাৎ তুরীয় আর অপরা অর্থাৎ অন্তর্লীন, জগতের বাহিরে ও অন্তরে বিদ্যমান ।"

পরমের নিরুপাধিকত্বই তাঁর সমগ্র ব্যঞ্জনা নয় । উপনিষদে ঐশী ক্রিয়ায় ও প্রকৃতিতে অংশ গ্রহণের সমর্থন আছে । উপনিষদের ঈশ্বর একান্ত অনন্ত ও কেবল মাত্র সান্তের ঊর্ধ্বে । যে ঔৎসুক্য দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে প্লেটো আকাদমীর জ্যোতিষিদের "আপাতকে বাঁচিয়ে রাখতে" উপদেশ দিয়েছিলেন তারই প্রভাবে উপনিষদের ঋষিরাও জগৎকে সদর্থক দেখেছিলেন । তৈত্তিরীয় উপনিষদের ভাষায় "ব্রহ্ম থেকেই ভূতেদের উৎপত্তি, ব্রহ্মেই তাদের স্থিতি, আর ব্রহ্মেই তাদের লয়" । বেদের মতে "তিনি অগ্নিতে আছেন, জলেও আছেন, সমগ্র বিশ্বে পরিব্যাপ্ত; তিনি ওষধিতে আছেন, বৃক্ষে আছেন, তাঁকে আমরা পুনঃ পুনঃ প্রণাম করি" । "এই পরম আনন্দ যদি স্বর্গে না থাকত, কেই বা প্রয়াসশীল হত, কেই বা বাঁচত" ? শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে ঈশ্বরবাদ পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে, "তিনি এক ও নিরাকার অথচ গূঢ় উদ্দেশ্যে তাঁর শক্তির নানা ব্যবহার দ্বারা বহু আকারের সৃষ্টি করেন । আদিতে ও অন্তরে তাঁর মধ্যেই বিশ্ব লয় হয় । তিনি ঈশ্বর । তিনি যেন আমাদের সৎ কর্মে মতি দেন ।" আবার "তুমিই নারী, তুমিই নর, তুমিই তরুণ, তুমিই তরুণী, তুমিই নবজাত আবার যষ্টি অবলম্বনকারী জড়দেহ বৃদ্ধ । তোমার বদন সর্ব দিকে ।" আবার "তাঁর আকার অপশ্য, চক্ষুঃ দ্বারা তাঁকে দেখা যায় না । তাঁকে অন্তর্যামী রূপে যে হৃদয় ও মন দিয়ে উপলব্ধি করে সেই অমর হয় ।" "তিনি সমগ্র বিশ্বের এক দেবতা, আবার তিনি নিজেই বিশ্ব, তাঁর নিজসত্তায় তিনি বিশ্বকে ধারণ করে আছেন । তিনিই আমাদের ভিতরের দ্যুতি, হৃদ্যন্তর্জ্যোতিঃ । তিনিই ব্রহ্ম, জীবন মৃত্যু যাঁর ছায়া ।"

উপনিষদে পাই যে ব্রহ্ম অচিন্ত্য ও অব্যয় আবার তিনিই বিশ্বপতি । তিনি যদিও সর্বভূতের উৎপত্তিস্থল তবু নিজে তিনি চিরস্থাবর । শাশ্বত সত্তা শুধু যে অস্তিত্বকে ধারণ করেন তাই নয় তিনিই জগতের সক্রিয় শক্তি । ঈশ্বর অনধিগম্য জ্যোতির্লোক নিবাসী পরা তবু অগস্টাইনের ভাষায় "আত্মার ঘনিষ্টতম নিজের থেকেও আপন" । উপনিষদে উদাহরণ স্বরূপ একটি গাছে দুটি পাখীর বসে থাকার কথা বলেছে । একটি ফল ভক্ষণ করছে আর একটি শুধু তার খাওয়া দেখছে, ভোগ থেকে সরে গিয়ে নীরব সাক্ষী হয়ে আছে । ব্যক্তিত্ব আরোপ বা নৈর্ব্যক্তিক রাখা মনের খেয়াল মত গড়া কল্পনা করা নয় । শাশ্বতকে দুই দিক থেকে দেখা যায় । সবার উপরে যিনি, পরম স্বাধিষ্ঠানে তিনি ব্রহ্ম, আর যখন তিনি সৃষ্টিকর্তা ও জগৎবল্লভ, তখন তিনি ঈশ্বর, নিজের মধ্যে জগৎকে ধারণ করেন ও নিয়ন্ত্রণ করেন । "ব্রহ্মকে সগুণই ভাবি বা নির্গুণই ভাবি, শিবকে সনাতন বলে জানতে হবে, সৃষ্টি থেকে যখন পৃথক করে দেখি তখন তিনি নির্গুণ আর যখন তাঁকে সর্বব্যাপী করে দেখি তখন তিনি সগুণ ।" সৃষ্টি যে অনিয়তাকার অনিশ্চয় না হয়ে ব্রহ্মাণ্ড আকার সে ঈশ্বরের বিভ্রম । ভাগবতের মতে অখণ্ড চৈতন্যরূপ অদ্বিতীয় সত্তাকেই পরমাত্মা বা ভগবান বলে । তিনি চরম তত্ত্ব, আমাদের আসল আত্মা আবার পূজ্য ভগবান । ব্রহ্ম একাধারে তুরীয়, জাগতিক ও প্রাতিস্বিক সত্তা । তুরীয় ভাবে তিনি শুদ্ধসত্ত, কোনপ্রকার ক্রিয়া বা অভিজ্ঞতার দ্বারা অনাহত, বিচ্ছিন্ন ও উদাসীন । আবার সচল জাগতিক ভাবে তিনি যে সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডলীলার ধারক তাই নয় তার চালকও, আবার যিনি সকলের মধ্যে অথচ সকলের ঊর্ধ্বে আছেন সেই পরমাত্মাই সকল ব্যক্তির মধ্যে বর্তমান ।

ঈশ্বর অশুভের জন্য প্রত্যক্ষভাবে দায়ী নন, কেননা তিনি স্বেচ্ছাচারী নন, এবং জগৎ যদি সক্রিয় স্বেচ্ছাধীন ব্যক্তি দ্বারা পূর্ণ হয়, যাদের প্রভাবান্বিত করা যায় কিন্তু চালনা করা যায় না তবে সংঘর্ষ অবশ্যম্ভাবী । পৃথিবীতে স্বাধীন আত্মা আছে বলে ধরলে, অকল্যাণ সম্ভাব্য ও সম্ভবপর । একেবারে যান্ত্রিক জগতের বিকল্প হল দুর্ঘটনা ও দুঃসাহসিকতাপূর্ণ জগৎ । যদি সকল প্রকার ভ্রান্তি, কুশ্রীতা ও অশুভপ্রবণতাকে বাদ দিতে হয়, তাহলে সত্য, শিব ও সুন্দরের সন্ধানও থাকে না । সত্য, শিব ও সুন্দরের দিকে যদি সক্রিয় ঔৎসুক্য থাকে তাহলে তার বিপরীত ভ্রান্তি, অশুভ ও কুশ্রীতাকে শুধু ভাবগত সম্ভাব্যতা বলে ধরলে চলবে না, তাদের প্রতিরোধ্য বাস্তব প্রবণতা বলে মনে করতে হবে । গীতাতে দেখা যায় জগৎ শুভাশুভের সক্রিয় সংঘর্ষ ক্ষেত্র এবং ভগবান এই সংঘর্ষ সম্বন্ধে গভীর ভাবে কৌতূহলী । তিনি মানুষকে ভ্রান্তি, অসুন্দর ও অকল্যাণ প্রতিরোধ করতে আপনার সমস্ত স্নেহের ঐশ্বর্য দিয়ে সাহায্য করেন । ঈশ্বর পরিপূর্ণ শিব ও তার প্রেম অসীম বলে তিনি জীবের ক্লেশ সম্বন্ধে উদ্বিগ্ন । ঈশ্বর সর্বশক্তিমান এই অর্থে যে তাঁর শক্তির সীমা বাইরে থেকে কেউ নির্দেশ করে না । লোকের সামাজিক প্রকৃতি ভগবানের উপর আরোপিত নয়, তাঁর ইচ্ছা দ্বারা উৎপন্ন । মানুষ কিভাবে আচরণ করবে, তাদের নির্বাচনের স্বাধীনতার সদ্‌ব্যবহার কিম্বা অসদ্‌ব্যবহার করবে, এসব কথা সর্বজ্ঞ ভগবান আগে থাকতে জানেন কিনা, এই প্রশ্নের উত্তরে আমরা শুধু বলতে পারি যে এমন ঘটনা ঘটে না যা তিনি জানেন না । প্রবণতা যখন অনির্দিষ্ট থাকে তখনও তিনি জানেন আবার যখন তা বাস্তবে পর্যবসিত তখনও জানেন । ঈশ্বরের সর্বব্যাপী ক্ষমতা কর্মতত্ত্ব দ্বারা সীমাবদ্ধ নয় । ঋগ্বেদ যখন রচিত হয়েছিল, তখন থেকে হিন্দু চিন্তাশীল ব্যক্তিরা প্রকৃতির যৌক্তিকতা ও নিয়মতান্ত্রিকতা সম্বন্ধে খবর রাখেন । ঋত বা শৃঙ্খলা সর্বব্যাপী । বিধি দ্বারা নিয়ন্ত্রণ ঈশ্বরের মন ও ইচ্ছা অনুযায়ী, তাকে তাঁর শক্তির সীমা বলে বিবেচনা করা যায় না । বিশ্বের সগুণ অধীশ্বর কালবশ, কাজেই পরিবর্তন সাপেক্ষ ।

যে সগুণ ভগবান নিজ প্রকৃতিবশে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎকে সৃষ্টি করেছেন, গীতায় ব্রহ্মের সেই ভাবের উপরই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে । তিনি সকলের অন্তরে বাস করেন । তিনি সকল যজ্ঞের ভোক্তা ও প্রভু । তিনি আমাদের হৃদয়ে ভক্তির উদ্রেক করেন এবং আমাদের প্রার্থনা মঞ্জুর করেন । যা কিছু মূল্যবান, তার তিনি উৎস ও ধারক । পূজা ও প্রার্থনার মধ্যে আমরা তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্কে আসি ।

এই সগুণ ঈশ্বরই বিশ্বের সৃষ্টি, স্থিতি, লয়ের জন্য দায়ী । ব্রহ্মের পরা ও অপরা দুই প্রকৃতিই আছে । জীবাত্মারা উচ্চতর পরা প্রকৃতি ও জড়দেহ নিম্নতর অপরা প্রকৃতি । ভাবগত পরিকল্পনাও ঈশ্বরের, আবার যে বস্তুগত মাধ্যমের মধ্য দিয়ে ভাব পরিস্ফুট হয়, ধারণাজাত বিষয় ব্রহ্মাণ্ডে রূপান্তরিত হয়, তাও তাঁর । ধারণার পরিকল্পনাকে মূর্ত করতে হলে অস্তিত্বের পরিপূর্ণতা প্রয়োজন, সম্ভাব্য বস্তুর মাধ্যমকে বাস্তব রূপ দেওয়া দরকার । ঈশ্বরের ভাব অস্তিত্ব খুঁজছে, আর অস্তিত্বের জগৎ পরোৎকর্ষ লাভের চেষ্টা করছে । দিব্য প্রকার ও সম্ভাব্য জড়বস্তু উভয়েরই উৎপত্তি ভগবানে, তিনিই আদি, মধ্য ও অন্ত - ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিব । সৃষ্টি ভাবগ্রস্ত ভগবান ব্রহ্মা, আর যখন তিনি সৃষ্টি রক্ষা করার জন্য অমেয় প্রীতি বর্ষণ করেন ও প্রীতির সমপরিমাণ ধৈর্য ধরে কর্ম করেন, তখন তিনি বিষ্ণু । যখন ধারণাজাত বিষয় ব্রহ্মাণ্ডের রূপ নেয়, যখন পৃথিবীতে স্বর্গরাজ্যের প্রতিষ্ঠা হয়, সেই পরিপূর্ণতাই শিব । ঈশ্বর একাধারে ধী, প্রীতি ও পরোৎকর্ষ । এই তিন বৃত্তিকে পৃথক করা যায় না । ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিবের ধারণা তিন প্রকারের হলেও মূলতঃ তারা এক । গীতার উদ্দেশ্য জগতের ত্রাণ তাই বিষ্ণুভাবের প্রাধান্য । ব্রহ্মের বিষ্ণুভাবের প্রতিমূর্তি কৃষ্ণ ।

ঋগ্‌বেদে বিষ্ণু সুপরিচিত দেবতা । বিশ্‌ ধাতু মানে ব্যাপ্ত হয়া, কাজেই তিনি সর্বব্যাপী । তিনি সমগ্র বিশ্বে পরিব্যাপ্ত হয়ে ভিতর থেকে নিয়ন্ত্রণ করছেন । তিনি ক্রমবর্ধমান পর্যায়ে সনাতন সর্বেশের পদ ও মর্যাদা নিজের মধ্যে সংগ্রহ করছেন । তৈত্তিরীয় আরণ্যকে আছে "নারায়ণকে আমরা পূজা করি, বাসুদেবকে ধ্যান করি, আর এতে বিষ্ণু আমাদের সহায় হোন ।"*d

গীতার উপদেষ্টা কৃষ্ণ প্রাচীন সূর্যদেবতা বিষ্ণুর এবং বিশ্বজাগতিক ভাবের এক প্রাচীন দেবতা ও নরের আশ্রয় বা লক্ষ্য নারায়ণের সঙ্গে অভিন্ন হয়ে পড়েছেন ।

এই মহাজাগতিক প্রকটতাকে দেশকালে যিনি ধারণ করে আছেন সেই জগৎ-অতীত, সনাতন দেশ-কালোত্তর ব্রহ্মই প্রকৃত সত্য । তিনি পরমাত্মা, সমস্ত ব্রহ্মাণ্ডের রূপ ও গতির আত্মা । সেই পরমেশ্বরই প্রাতিস্বিক আত্মা ও জঙ্গম প্রকৃতির অধীশ্বর ও জাগতিক পরিণতির বিষয় । তিনিই আবার পুরুষোত্তম, জগতের অভিব্যক্তির মধ্যে যাঁর দ্বৈত প্রকৃতি প্রকট রয়েছে । তিনি আমাদের অস্তিত্বকে পূর্ণ করেন, বোধকে প্রদীপ্ত করেন, আমাদের অন্তরের গোপন কলকাঠিকে সচল করেন ।*e

পুরুষোত্তম থেকে নীচে সকল বস্তুই অস্তি ও নাস্তির দ্বিত্বে জড়িত । ঈশ্বরের মধ্যেও নাস্তি বা মায়া আছে যদিও সেটা তার আয়ত্তাধীন । তিনি তাঁর সক্রিয় প্রকৃতিকে প্রক্ষেপ করেন এবং যে সকল আত্মা তাদের নিজ নিজ প্রকৃতি অনুযায়ী নিয়ত পাপ কর্ম করে যায় তাদের নিয়ন্ত্রণ করেন । ব্রহ্ম পরিবর্তনশীল জগতে স্বগত শক্তির মাধ্যমে এই সব কর্মের কারণ হন, কিন্তু তাঁর আর এক ভাব আছে যাকে এ সব স্পর্শ করতে পারে না । তিনি নির্গুণ পরম আবার অন্তর্লীন সংকল্প, সকলের কারণ অথচ কারণাতীত, সমস্তের চালক কিন্তু নিজে অবিচল । মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যে বাস করেও ব্রহ্ম উভয়ের ঊর্ধ্বে । অসীম বিশ্ব অনন্ত দেশকালে তাঁর মধ্যে স্থিত কিন্তু তিনি ওর মধ্যে নেই । গীতার ভগবান জাগতিক পদ্ধতির সঙ্গে অভিন্ন নন, কেননা তিনি তাদের অতিক্রম করে আছেন । আবার এর মধ্যেও তিনি বিশেষ কোন কোন ভাবে বেশী প্রকট । গীতার বিরুদ্ধে নিম্নশ্রেণীর বহু দেবতাবাদ আরোপ করা চলে না । যদিও চরম ভাবে সম্পূর্ণ এক সত্তা আছে, তবু সকল সাকার বস্তুই সমান ভাবে সম্পূর্ণ নয় ।



5) উপদেষ্টা কৃষ্ণ

ভগবদ্গী‌তা অধ্যয়নের পক্ষে, তার উপদেষ্টা কৃষ্ণের ঐতিহাসিক সত্তা ছিল কি ছিল না, সে তর্ক নিরর্থক । আসল কথা হল দিব্যশক্তির শাশ্বত প্রকাশ, বিশ্ব ও মানবাত্মার মধ্যে পূর্ণাঙ্গ ও দিব্য জীবনের চিরন্তন আবির্ভাব ।

তা হলেও কৃষ্ণের ঐতিহাসিকতা সম্বন্ধে যথেষ্ট প্রমাণ আছে । ছান্দোগ্য উপনিষদে দেবকীপুত্র কৃষ্ণের উল্লেখ আছে, তাঁকে ঘোর আঙ্গিরসের শিষ্য বলা হয়েছে । কৌষীতকি ব্রাহ্মণের মতে ঘোর আঙ্গিরস সূর্য উপাসক ঋষি ছিলেন । যজ্ঞের তাৎপর্য ব্যাখ্যা ও যাজকদের আসল দক্ষিণা যে তপ, দান, ঋজুতা, অহিংসা ও সত্যনিষ্ঠা প্রভৃতি গুণের আচরণ এই কথা বর্ণনার পর ঐ উপনিষদে বলা হয়েছে যে "যখন দেবকীপুত্র কৃষ্ণকে ঘোর আঙ্গিরস এই সব কথা ব্যাখ্যা করেন তখন তিনি আরও বলেন যে অন্তিম সময়ে এই তিনটি ভাবনার আশ্রয় নেওয়া উচিত "তুমি অক্ষিত, অচ্যুত ও প্রাণস্বরূপ" । উপনিষদে ঘোর আঙ্গিরসের উপদেশ ও গীতার কৃষ্ণের উপদেশের মধ্যে অনেক সাদৃশ্য আছে ।

মহাভারতের কাহিনীতে অর্জুনসখারূপে কৃষ্ণের গুরুভূমিকা আছে । পাণিনিতে বাসুদেব ও অর্জুন উভয়কেই পূজ্য বলা হয়েছে । কৃষ্ণ যদুবংশের প্রাচীন বৃষ্ণি বা সাত্বত শাখায় উদ্ভূত । যদুবংশের আদিনিবাস মথুরা নগরের আশেপাশে ছিল । কৃষ্ণের নামের সঙ্গে মথুরা নগরের নাম ইতিহাসে, কিম্বদন্তীতে ও লোককথায় জড়িত । কৃষ্ণ বেদের যাজ্ঞিক প্রথার বিরোধী ছিলেন ও ঘোর আঙ্গিরসের কাছে যে শিক্ষা পেয়েছিলেন সেই তত্ত্বই প্রচার করেছেন । পরাজিত ইন্দ্র কৃষ্ণের কাছে নতিস্বীকার করে যে উক্তি করেন তার মধ্যে বৈদিক ক্রিয়াকাণ্ডের বিরুদ্ধে কৃষ্ণের অভিমত স্পষ্ট হয় ।*a যে সকল লোকের কৃষ্ণের উপদেশে আপত্তি ছিল এবং যাদের তাঁর উপর বিশ্বাসের অভাব ছিল গীতায় তাদের উল্লেখ আছে । কৃষ্ণের প্রাধান্য যে অবিসম্বাদী রূপে গৃহীত হয় নি, মহাভারতে তার লক্ষণ দেখা যায় । মহাভারতে কৃষ্ণকে ঐতিহাসিক ব্যক্তি*b ও অবতার উভয় রূপেই বর্ণনা করা হয়েছে । কৃষ্ণ সাত্বতদের সূর্য উপাসনা শিখিয়েছিলেন এবং তারা হয়ত সূর্যোপাসনার গুরুকে সূর্যের সঙ্গে অভিন্ন রূপে দেখত ।*c খ্রীষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে বাসুদেব পূজা সুপ্রতিষ্ঠিত । পালি ধর্মশাস্ত্র অন্তর্গত বৌদ্ধ রচনা নিদ্দেশে (খ্রীষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দী) লেখক অন্যান্য সম্প্রদায় সকলের মধ্যে বাসুদেব ও বলদেবের উপাসকদের উল্লেখ করেছেন । মেগাস্থিনিস্‌ (খ্রীঃপূঃ ৩২০) বলেছেন সৌরসেনীদের মধ্যে হিরাক্লিস পূজা প্রচলিত ছিল, ওদের দেশে মথুরা ও কৃষ্ণপুর নামে দুটি বড় শহর ছিল । তক্ষশীলার গ্রীক ভাগবত হেলিওডোরাস বেসনগর উৎকীর্ণলিপিতে (খ্রীঃপূঃ ১৮০) বাসুদেবকে দেবদেব বলেছেন । খ্রীঃ পূঃ প্রথম শতাব্দীতে উৎকীর্ণ নানাঘাট প্রস্তরলিপিতে প্রারম্ভিক শ্লোকে অন্যান্য দেবতার মধ্যে বাসুদেবের উল্লেখ আছে । বৌদ্ধ লোককথায় রাধা, যশোদা এবং নন্দ প্রভৃতি প্রধান ব্যক্তিদের বর্ণনা আছে । পতঞ্জলি পাণিনির মহাভাষ্যে, চতুর্থ ৩, ৯৮ শ্লোকের টীকায় বাসুদেবকে ভগবত বলেছেন । ভাগবত ধর্মে কৃষ্ণ শ্রীভগবান রূপে পরিচিত বলে বইখানির নাম ভগবদ্‌গীতা । তিনি যে শিক্ষা দিয়েছেন তাই ভাগবত ধর্ম । গীতায় কৃষ্ণ বলছেন যে তিনি কোন নূতন মত প্রচার করছেন না, তিনি যে কথা বিবস্বান্‌কে শিখিয়ে ছিলেন, বিবস্বান্‌ যা মনুকে শিখিয়ে ছিলেন এবং পরে মনু যা ইক্ষ্বাকুকে শিখিয়েছেন তারই তিনি পুনরাবৃত্তি করছেন । মহাভারতেও আছে যে "ভাগবত ধর্ম বিবস্বান্‌ থেকে মনু এবং মনু থেকে ইক্ষ্বাকু এই পরম্পরায় চলে এসেছে" । অনুরূপ ভাবে প্রচারিত কিম্বদন্তী নিশ্চয়ই অভিন্ন । আরও প্রমাণ আছে । নারায়ণীয় বা ভাগবত ধর্মের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে যে এই ধর্ম ঈশ্বর পূর্বে ভগবদ্‌গীতাতে বর্ণনা করেছেন । আবার ঘোষণা করা হয়েছে যে "কৌরব ও পাণ্ডবদের যুদ্ধের সময় যখন উভয় বাহিনী যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ও অর্জুন বিষণ্ণ তখন ঈশ্বর এই ধর্মের উপদেশ দেন । এই ধর্ম একেশ্বরবাদের ("ঐকান্তিক") ।


5.1) শ্রীকৃষ্ণ পরমেশ্বর

গীতায় কৃষ্ণকে পরমেশ্বরের সঙ্গে অভিন্ন বলে ধরা হয়েছে । বহুধা বিশ্বজগতের অন্তরালে, সমস্ত প্রতীয়মান বস্তুর পশ্চাতের অবিচল সত্যে সকলের ঊর্ধ্বে ও সর্বব্যাপীরূপে এই ঐক্য বিরাজমান । তিনিই প্রকট ঈশ্বর, মরলোকের পক্ষে যাঁকে জানা সহজ । যারা অবিনশ্বর ব্রহ্মের সন্ধানী, তারাও তাঁকে পাবে কিন্তু অত্যন্ত কৃচ্ছ্রসাধনের ফলে । তাঁকে পরমাত্মা বলা হয়, এটা তাঁর তুরীয় অবস্থার দ্যোতক, তিনি জীবভূত অর্থাৎ সকলের জিবনসার ।

কিন্তু ঐতিহাসিক ব্যক্তিকে পরমেশ্বরের সঙ্গে অভিন্ন কল্পনা কিভাবে করা যায় ? জীবাত্মা ও বিশ্বাত্মাকে অভিন্ন ধরা হিন্দুচিন্তায় সুপরিচিত ধারা । উপনিষদে শুনি যে পূর্ণ জাগরিত আত্মা যখন পরমের সঙ্গে তার সত্যকার সম্পর্ক বুঝতে পারে তখন দেখে যে আসলে পরমেরই অংশ এবং সে কথা সে ঘোষণা করে । ঋগ্‌বেদের চতুর্থ মণ্ডলের ২৬ সংখ্যক শ্লোকে কামদেব বলছেন, "আমি মনু, আমি সূর্য, আমি বিজ্ঞ ঋষি কাক্ষিবান্‌ । আমি অর্জুনির পুত্র কুৎস ঋষিকে ভূষিত করেছি । আমিই প্রাজ্ঞ উষণা... আমাকে দেখ ।" কৌষীতকি উপনিষদে (তৃতীয়) ইন্দ্র প্রতর্দনকে বলছেন, "আমি প্রাণবায়ু, আমিই চিদাত্মা, আমাকে প্রাণের মত, নিশ্বাসের মত ভজনা কর । যে আমাকে প্রাণরূপে, অমৃতরূপে ভজনা করবে, সে এই সংসারে পূর্ণ জীবন লাভ করবে, স্বর্গলোকে অমরতা ও অবিনশ্বরতা লাভ করবে ।" গীতারচয়িতা বলছেন, "তীব্র আসক্তি, ভয় ও ক্রোধমুক্ত হয়ে আমাতে সমাহিত চিত্ত হয়ে ও আমাকে আশ্রয় করে যাঁরা জ্ঞানরূপ তপস্যা দ্বারা শুদ্ধ হয়েছেন তাঁরা আমার ভাবসত্তায় সিদ্ধ হয়েছেন", জীবের মধ্যে তার নিজ সত্ত্বা ছাড়া এমন কিছু আছে যার কাছে সে নিজেকে সমর্পণ করতে পারে ।*d এই সমর্পণের মধ্যেই তার রূপান্তর । মুক্ত আত্মা তার দেহকেই অনন্তের প্রকাশের বাহনরূপে ব্যবহার করে । কৃষ্ণের দেবত্ব পরমার্থের সকল অকপট সাধকেরই সাধারণ পুরস্কার । তিনি সে রকম নায়ক নন, যিনি পৃথিবীতে বাস করে, নিজের প্রিয় বান্ধব ও শিষ্যদের কাছে নিজ বক্তব্য শুনিয়ে এখন পৃথিবী ত্যাগ করেছেন । পরন্তু তিনি সর্বব্যাপী ও সকলের মধ্যে বাস করছেন এবং অন্যকে যখন যা বলেছেন তা আবার আমাদের প্রত্যেককে সব সময়ই বলতে প্রস্তুত । তিনি বিগত ব্যক্তি নন, অন্তর্যামী, আমাদের আধ্যাত্মিক চেতনার এক বিষয় ।



5.2) ঈশ্বরের জন্মগ্রহণ

সাধারণ অর্থে ঈশ্বর কখনও জন্মগ্রহণ করেন না । জন্মগ্রহণ ও দেহধারণ মানেই সীমাবদ্ধ হওয়া, ঈশ্বরের সম্বন্ধে সে কথা খাটে না । যখন কোন বিশেষ অবস্থায় ও বিশেষ কালে ঈশ্বর আপনাকে প্রকট করেছেন এ কথা বলা হয়, তখনই তা কোন সান্ত সত্তার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত, এই অর্থই হয় । একাদশ অধ্যয়ে সমস্ত বিশ্বকে ঈশ্বরের মধ্যে প্রত্যক্ষ করা হয়েছে । জগতের অধ্যাত্মীয় ও বিষয়গত প্রক্রিয়াগুলি পরমেশ্বরের প্রকৃষ্ট ও নিকৃষ্ট ভাবের প্রকাশ তবু যা কিছু মহিমময়, সুন্দর ও প্রবল তার মধ্যেই ঈশ্বরের উপস্থিতি বেশী মাত্রায় প্রকট হয়ে ওঠে । যখনই কোন প্রাতিস্বিক তাঁর সীমিত শক্তি সত্ত্বেও আধ্যাত্মিক গুণের বিকাশজনিত গভীর অন্তর্দৃষ্টি ও করুণার অধিকারী হন তখনই তিনি জগতের সমসাময়িক অবস্থা বিচার করে পারমার্থিক ও সামাজিক আলোড়নের সূত্রপাত করেন এবং আমরা তখন বলে উঠি যে সাধু লোকেদের রক্ষার জন্য, অসাধুদের বিনাশের জন্য ও ন্যায়ভিত্তিক সংসারের প্রতিষ্ঠার জন্য ভগবান জন্মগ্রহণ করেছেন । বিশ্বাত্মা যে কোটি কোটি আকারে নিজেকে প্রকট করেন, প্রাতিস্বিকরূপে কৃষ্ণ তাদেরই অন্যতম । গীতারচয়িতাও ঐতিহাসিক কৃষ্ণকে ও তাঁর শিষ্য অর্জুনকে ঐ সমস্ত প্রকট আকারের অন্যতম বলে বর্ণনা করেছেন । অবতাররাই মানুষের আধ্যাত্মিক সম্বল ও অন্তর্নিহিত দিব্য বিভূতির প্রমাণ । একে মানুষের সীমাবদ্ধ আকারের মধ্যে দিব্য মহিমার সংক্ষেপিত অবস্থিতি বলে ধরা ঠিক নয়, এ বরং দৈব মহিমার সহযোগে মনুষ্যপ্রকৃতির ঐশী স্তরে উন্নয়ন ।

ঈশ্বরবাদীরা কিন্তু কৃষ্ণের মধ্যে মনুষ্য আকারে ঈশ্বরের অবতরণ*e বা আবির্ভাব দেখতে পান । যদিও ঈশ্বরের জন্মও নাই, পরিবর্তনও নাই তবু তিনি বহুবার জন্মগ্রহণ করেছেন । কৃষ্ণ নরাকারে বিষ্ণু । তিনিই ব্রহ্ম, পৃথিবীতে দেহী ও জাত রূপে আপাত প্রতীয়মান । জগৎ সৃষ্টির মতই দিব্য সত্ত্বের মনুষ্যপ্রকৃতি গ্রহণ দ্বারা দিব্য অখণ্ডতার ক্ষয়বৃদ্ধি হয় না । সৃষ্টি ও অবতরণ দুইই অভিব্যক্ত জগতের ব্যাপার, পরমাত্মাকে তা স্পর্শ করে না ।
 

5.3) অবতারবাদ

অনন্ত ভগবান যখন সর্বকালেই সান্তরূপে প্রকট হচ্ছেন, তখন এক বিশেষ সময়ে এক বিশেষ মনুষ্য প্রকৃতি অবলম্বন করে যে বিশিষ্ট প্রকাশ, তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছুই নেই, বরং যেভাবে দিব্য প্রাচুর্য সীমিত জগতের দিকে ঝুঁকে উদারভাবে নিজেকে সম্পূর্ণ করেন, সেই ভাবেরই এক অবাধ পরিণতি বলে ধরা যেতে পারে । সেরকম ধরলে এক সৃষ্টি ছাড়া আর কোনও নূতন সমস্যার উৎপত্তি হয় না । মনুষ্যাকৃতি জীব যদি ভগবানের সাদৃশ্যে তীরী হয়ে থাকে, পুনরাবৃত্ত শক্তিধারায় যদি নূতন নূতন ছাঁদকে গ্রন্থন করা সম্ভব হয়, এইসকল ভাবে যদি সনাতনকে অনুগামিতায় মূর্ত করা সম্ভব হয়, তাহলে দিব্য সত্ত্বা তাঁর অস্তিত্বের পরম ভাবকে সম্পূর্ণ এক মানবীয় জীবের মধ্যে ও মাধ্যমে প্রকট করতে পারেন । ইঊরোপে ও মধ্যযুগের সম্প্রদায়গত ধর্মতাত্ত্বিকরা স্বীকার করেছেন যে ঈশ্বর তাঁর সৃষ্ট জীবদের মধ্যে বিরাজমান "মর্ম দ্বারা, অবস্থিতি দ্বারা ও ক্ষমতা দ্বারা (By essence, presence, power)" । ঐহিক শৃঙ্খলা জড়িত সান্ত মানবীয় প্রাতিস্বিকের সঙ্গে অসীম, স্বয়ম্ভর এবং অব্যয় পরমের সম্বন্ধ কল্পনাতীতভাবে নিবিড় কিন্তু যে নিবিড়তায় সংজ্ঞার্থ দেওয়া বা ব্যাখ্যা করে বোঝানো কঠিন । যে সকল মহাত্মাকে আমরা অবতার বলে থাকি, তাঁদের মধ্যে মানবের ঈশ্বরদত্ত অস্তিত্ব ও মর্যাদাকে ভগবান অত্যাশ্চর্যভাবে পুনরুজ্জীবিত করেন । বিশজগতের সমস্ত ঘটনায়, পরম্পরার মধ্যে সনাতনের যে অনুপ্রবেশ দেখতে পাই, অবতারদের মধ্যে সেই ব্যাপারেরই গভীরতর বিকাশ হয় । ভগবান একবার আমাদের ইচ্ছাস্বাতন্ত্র্য দিয়েছেন বলে, আমরা নিজেদের বিনাশের ব্যবস্থা করলেও, তিনি উদাসীনভাবে সরে দাঁড়ান না । স্বাতন্ত্র্যের অপব্যবহার দ্বারা যখনই অন্যায়ের বৃদ্ধি হয় ও সংসারের গতিপথ সঙ্কটে স্তব্ধ হয়ে আসে তখনই তিনি কলেবর গ্রহণ করে সংসারকে সঙ্কট থেকে উদ্ধার করে তাকে নূতন পথের সন্ধান দেন । তিনি নিজ প্রীত্যার্থে পুনঃ পুনঃ জন্মগ্রহণ করে সৃষ্টিলীলাকে উচ্চতর পর্যায়ে উন্নত করেন । মহাভারতের এক জায়গায় আছে যে বিশ্বজগতের পালক ব্রহ্মের চার রূপ আছে । প্রথম রূপে পৃথিবীতে বাস করে তপস্যায় রত হন, দ্বিতীয় রূপে বিপথগামী মানুষদের ক্রিয়াকর্মের উপর নজর রাখেন, তৃতীয় রূপে মনুষ্য সংসারের কর্মে নিজেকে ব্যাপৃত রাখেন, আর চতুর্থ রূপে সহস্র বর্ষব্যপী যোগনিদ্রায় আচ্ছন্ন থাকেন । পরম নিষ্ক্রিয়তা দিব্য প্রকৃতির একমাত্র ভাব নয় । হিন্দু চিন্তাধারায় অবতার মাত্র মানব পর্যায়ে সীমাবদ্ধ নয় । জগতে দুঃখ কষ্ট ও ত্রুটি-বিচ্যুতি আছে, তার জন্য মানুষের স্বেচ্ছাপ্রণোদিত অবাধ্যতা দায়ী নয় । সৃষ্টির ঐশী উদ্দেশ্য ও বাস্তব জগতের অসামঞ্জস্যই তার কারণ । মানুষের "অধঃপতন" ইত্যাদি দুঃখকষ্টের হেতু হয় তবে নির্দোষ প্রকৃতিতেও যে ত্রুটি থাকে, সমস্ত জীব যে জরা ও রোগের অধীন, তার কারণ খুঁজে পাই না । "মৎসের শরীরে কর্কট রোগ হয় কেন ?" এই ধরণের প্রশ্নকেও এড়ানো যায় না । গীতার বক্তব্য যে একজন সৃষ্টিকর্তা ভগবান আছেন, তিনি অতল পুণ্যের উপর নিজস্ব আকৃতি সকল আরোপ করেছেন । যে অনাসৃষ্টির মধ্যে শৃঙ্খলা আনা প্রয়োজন, যে রাত্রির অন্ধকারকে উদ্ভাসিত করা দরকার, প্রকৃতি সেই অনাহত উপকরণ । এই দুই বৈপরীত্যের সংঘর্ষে যখন অচলাবস্থার সৃষ্টি হয় তখন সেই অবস্থার অবসান ঘটানোর জন্য ঈশ্বরের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন হয় । তাছাড়া বিশ্বজগৎ সম্বন্ধে আমাদের বর্তমান জ্ঞান ও ধারণা এককালীন সৃষ্টি উন্মোচন রূপ ধারণার অনুকূল নয় । কৌলিক ঈশ্বর জগদীশ্বরে পরিণত হলেন, জগদীশ্বর আবার এখন বিশ্বেশ্বর হয়েছেন, আবার এখন মনে হচ্ছে যে ব্রহ্মাণ্ডে এরকম বিশ্বজগৎ বোধ হয় আরও অনেক অনেক আছে । পরমেশ্বর ক্ষুদ্রতম গ্রহগণের অন্যতমের একাংশকে নিয়েই লিপ্ত আছেন এ রকম কথা ধারণায় আসে না ।

অবতারবাদ অধ্যাত্মজগতের বিধানের সুস্পষ্ট অভিব্যক্তি । ঈশ্বরকে যদি মানুষের ত্রাণকর্তারূপে স্বীকার করতে হয় তাহলে যখনই মানুষের আদর্শ অকল্যাণের আক্রমণে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেবে, তখনই ঈশ্বরের আবির্ভাব অনিবার্য । মানুষের মধ্যে ঈশ্বরের আবির্ভাবই অবতার, সিদ্ধ হলে মানুষ ঈশ্বরত্ব লাভ করে, সে স্বতন্ত্র বস্তু । অবশ্য প্রত্যেক চিন্ময় জীবের মধ্যেই ঈশ্বরের অবতরণ আছে, কিন্তু সে হল আচ্ছন্ন প্রকাশ । নিজ ঈশ্বরত্ব সম্বন্ধে আত্মসচেতন ব্যক্তির সঙ্গে মায়াবৃত চেতনাবিশিষ্ট ব্যক্তির তফাৎ আছে ।

অবতারত্ব থেকেই বোঝা যায় যে ঈশ্বর পূর্ণ সজীব ও ভৌত আবির্ভাবের বিরোধী নন । আমরা জড়দেহ ধারণ করেই পরিপূর্ণ চিন্ময় সত্যের অধিকারী হতে পারি । মানব-প্রকৃতিকে শৃঙ্খল মনে করার প্রয়োজন নেই, তাকে দিব্যজীবনের যন্ত্ররূপেও কল্পনা করা যায় । আমাদের সাধারণ মানুষদের জীবন ও শরীর প্রকাশের পক্ষে অজ্ঞান, অসম্পূর্ণ ও অক্ষমযন্ত্র কিন্তু সেরকম সব সময়ই থাকতে হবে তার কোন মানে নেই । দিব্যচেতনা এই যন্ত্র দিয়েই তাঁর উদ্দেশ্য সিদ্ধ করে নেয়, কিন্তু মানবের বদ্ধ সংবিৎ বাস্তব, জৈব ও মানসিক শক্তিসমূহের উপর সেরকম পূর্ণ আধিপত্য লাভ করতে পারে না ।

বিশেষ পার্থিব উদ্দেশ্য সাধনের জন্য জ্ঞান বজায় রেখেও ঈশ্বর অবতার-রূপ সীমাবদ্ধ আকার গ্রহণ করেন একথা গীতায় স্বীকৃত হলেও, মানুষের মধ্যেই যে ভগবান আছেন, মানুষ যে চিরন্তন অবতার, মানুষের মধ্যে যে দিব্য চেতনা সর্বদা বর্তমান সে কথাও বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে । এই দুই ধারণা পরস্পর অসঙ্গত নয়, একটি দিব্যের লোকত্তর ভাব আরেকটি লোকব্যাপী ভাব । মানবজাতিকে পারমার্থিক জ্ঞানালোকে উদ্ভাসন প্রয়াসী গীতার উপদেষ্টা নিজের দিব্য মূল্যের উপরই তাঁর বক্তব্য প্রতিষ্ঠিত করেছেন । আমাদের মধ্যে যে দিব্যভাব অন্ধকারাচ্ছান্ন হয়ে আছে, কৃষ্ণাবতারে তার পূর্ণ উন্মীলনের নিদর্শন পাওয়া যায় । ভাগবতে আছে*f "মধ্যরাত্রে গভীর অন্ধকারে আমাদের প্রত্যেকের অন্তর্যামী দিব্য দেবকীর মধ্যে নিজেকে উন্মোচিত করলেন কেননা, প্রত্যেকের অন্তরেই ভগবান প্রচ্ছন্ন হয়ে আছেন" । গভীরতম তমসাচ্ছন্ন রাত্রির মধ্য থেকেই ভাস্বর জ্যোতির প্রকাশ হয় । রাত্রি রহস্যে ও উন্মীলনে ঐশ্বর্যময়ী । রাত্রি আছে বলে আলোর অস্তিত্ব কম বাস্তব নয় । বরং রাত্রি না থাকলে মানুষে আলোর ধারণাই করতে পারত না । অন্ধকার রাত্রিতে পরিত্রাণই কৃষ্ণজন্মের মর্মার্থ । দুর্দৈব ও বন্ধনের ক্ষণে জগতের পরিত্রাতা জন্মগ্রহণ করলেন ।

জনশ্রুতি কৃষ্ণ বসুদেব ও দেবকীর সন্তান । আমাদের সাত্ত্বিক প্রকৃতি যখন বিশুদ্ধ হয়, আমাদের বুদ্ধির দর্পণ যখন বাসনার ধূলিমুক্ত হয়, তখনই তার মধ্যে শুদ্ধ সংবিৎ প্রতিফলিত হয় । সর্বনাশের সময় স্বর্গীয় জ্যোতি প্রকট হয়, তাতে মানুষের জীবনে যে ঐশ্বর্যলাভ হয়, তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না । অন্তরের আলোক হঠাৎ বিচ্ছুরিত হয়, সে আলোতে জীবন আবার সতেজ ও নূতন বলে প্রতিভাত হয় । আমাদের মধ্যে যখন দিব্যজীবনের উৎপত্তি হয়, তখন আমাদের চক্ষু থেকে বন্ধন খসে পড়ে, কারাগারের অর্গল খুলে যায় । প্রত্যেক জীবের অন্তরেই ঈশ্বরের নিবাস এবং যখন তাঁর গুহ্য আলয়ের পর্দা সরে যায় তখনই আমরা দৈববাণী শুনতে পাই, আমাদের উপর দিব্য আলোকসম্পাত হয়; আমরা দিব্যশক্তিতে বলীয়ান হয়ে করতে পারি । মূর্ত মানবচেতনা অজ সনাতনের মধ্যে উন্নীত হয় ।*g কৃষ্ণের শরীরগ্রহণ ঈশ্বরকে রক্তমাংসে নিয়ে আসা ততটা নয়, যতটা মনুষ্যত্বকে দেবত্বে উন্নয়ন ।

গুরু শিষ্যকে ধীরে ধীরে তার নিজ অবস্থা লাভ করার দিকে নিয়ে যাচ্ছেন (মম সাধর্ম্যম্‌) । শিষ্য অর্জুন সাধক আত্মার প্রতীক, যে এখনও সত্যদৃষ্টিতে সিদ্ধ হয়নি । অন্ধকার, অসত্য, সসীমতা ও মরত্ব প্রভৃতি যে সকল শক্তি তার উচ্চতর জগতে যাওয়ার পথরোধ করে দাঁড়িয়ে আছে, সে তার সঙ্গে সংগ্রাম করে চলেছে । যখন তার সমগ্র সত্তা মোহগ্রস্ত, সার্থক কর্মবিধি যখন তার নজরে পড়ছে না, তখন সে জগদ্‌গুরু*h কৃষ্ণ রূপ তার আত্মার প্রকৃষ্ট ভাবের মধ্যেই আশ্রয় গ্রহণ করে জ্ঞানালোকের প্রসাদ পাবার আবেদন জানাচ্ছে । "আমি তোমার শিষ্য । আমার চেতনার উপর আলোকসম্পাত কর । আমার মধ্যে যা অন্ধকার তা দূর কর । আমি স্বচ্ছ কর্মপদ্ধতি হারিয়ে ফেলেছি, আমাকে তা ফিরিয়ে দাও ।" দেহরথের রথী অর্জুন কিন্তু সারথি কৃষ্ণ, তিনিই পথ দেখিয়ে রথকে চালনা করবেন । প্রত্যেক প্রাতিস্বিকই শিষ্য, পরিপূর্ণতার সাধক, ভগবৎ-সন্ধানী । সে যদি আন্তরিক ও সশ্রদ্ধভাবে তাঁকে চায় তো তার লক্ষ্যে ঈশ্বরই তার পথপ্রদর্শক হন । উপদেশ সার্থক কিনা সে বিচারে, উপদেষ্টা কোন ঐতিহাসিক মানব বা সাক্ষাৎ ঈশ্বর কিনা এ তথ্যের বিশেষ মূল্য নেই, কেননা ভাবরাজ্যের সত্য হাজার হাজার বছর আগেও যা ছিল এখনও তাই আছে, এবং জাতি ধর্ম ভেদে তাতে তফাৎ হয় না । আসল কথা হক সত্য বা তাৎপর্য; ঐতিহাসিক ঘটনা তার প্রতিফলন মাত্র ।*i



6) জগতের স্বরূপ ও মায়াবাদ

6.1) জগৎ ও পরম সত্তা

যদি মূলতঃ পরমেশ্বর নির্গুণ ও অচিন্ত্য হন, তা'হলে জগতের আবির্ভাবের সঙ্গে পরমের যুক্তিযুক্ত সম্পর্ক বার করা যায় না । সকল জঙ্গম ও বিবর্তমানেরই মূল অব্যয়, অনন্ত ব্রহ্মে । ব্রহ্মেই তাদের স্থিতি, ব্রহ্ম ছাড়া তাদের অস্তিত্ব থাকে না, যদিও তিনি কিছুর কারণ নয়, কিছুই করেন না এবং কিছুই নির্ধারণ করেন না । জগৎ ব্রহ্মের অধীন কিন্তু ব্রহ্ম জগতের অধীন নন । এই একান্ত একপেশে নির্ভরশীলতা ও চরম সত্তার সঙ্গে জগতের যুক্তির দিক দিয়ে ধারণার অতীত সম্পর্ককেই "মায়া" শব্দ দ্বারা প্রকাশ করা হয় । জগৎ ব্রহ্মের মত আসল সৎ বস্তু নয় আবার শুধু অসৎও নয় । সৎ বা অসৎ কোনভাবেই এর সংঙ্গার্থ নির্দেশ করা যায় না । ধর্মোপলব্ধির মাধ্যমে ভাবগত চরম সত্তা সম্বন্ধে যখন হঠাৎ আমরা সচেতন হই, তখন জগৎকে ঠিক বুঝতে পারিনি ব্যাখ্যা করতে পারিনি বলে মনে হয় না, মনে হয় সমস্তটাই অধ্যাস । মায়ার মানে এ নয় যে জগৎ সংসার অধ্যাস এবং একান্ত অস্তিত্ববিহীন । এটা অপরিমিত ও অপরিমেয় থেকে একটা স্বাতন্ত্রীকরণ । কিন্তু এই স্বাতন্ত্র্যের অর্থ কি ? প্রায়োগিক স্তর থেকে এর কোন উত্তর নেই ।

প্রত্যেক ধর্মেই পরম সত্তাকে আমাদের আদি অন্ত বিশিষ্ট, অস্থির ও পরিবর্তনশীল কালবশ সংসারের অসীম ঊর্ধ্বে বিরাজমান রূপে ধারণা করা হয় । খ্রীষ্টধর্মে ঈশ্বরকে অব্যয় ও একমুখী বলে বর্ণনা দেওয়া হয় । তিনি অনন্তকালে বাস করে আদি-অন্ত সবই দেখছেন । এইটুকু যদি পর্যাপ্ত হত তাহলে দিব্যজীবন ও বহুধা জগৎ একেবারে পৃথক সত্তা হত, তাদের মধ্যে কোন সংস্পর্শ অসম্ভব হত । পরম সত্তা যদি অদ্বিতীয় নিষ্ক্রিয় ও অনড় হন তাহলে কাল, বিচলন বা ইতিহাসের কোন স্থানই থাকে না । পরিবর্তন ও পরম্পরাবিশিষ্ট কাল শুধু আপাত প্রতীয়মান যন্ত্র হত । কিন্তু ঈশ্বর এক সজীব ভাব, এক দহনকারী পাবক । আপাতবৈচিত্রের অন্তরালে অদ্বিতীয় পরম বা বহুধা জগতের মাঝে সক্রিয় ভগবান, এর কোন্‌টি সত্য এ প্রশ্ন তোলার প্রয়োজন নেই । পরমেশ্বর একাধারে দুই-ই । অনন্তকালের ধারণা কালকে বা ইতিহাসকে অস্বীকার করে না । অনন্ত, কালেরই রূপান্তর । কাল অনন্ত থেকেই উদ্ভূত এবং অনন্তের মাঝেই তার পরিপূর্ণতা । ভগবদ্‌গীতায় কাল ও চিরকালের মধ্যে কোন বিরোধিতা নেই । কৃষ্ণরূপের মধ্যে সনাতন ও ঐতিহাসিকের ঐক্য দেখানো হয়েছে । অনন্তের অন্তরতম গভীরতার সঙ্গে কালবশ সচলতার সম্পর্ক দেখানো হয়েছে ।

সমস্ত দ্বৈতভাবের ঊর্ধ্বে যিনি তাঁকেই জাগতিক দৃষ্টিভঙ্গী থেকে দেখলে মনে হবে যে লোকোত্তর বিষয়ী লোকোত্তর বিষয়ের মুখোমুখি হয়ে দ্বৈত ভাবে বিরাজ করছেন । বিষয় ও বিষয়ী একই সত্তার দুই মেরু । তারা সম্পর্করহিত নয় । বৈষয়িক তত্ত্ব, মূল প্রকৃতি, সফল অস্তিত্বের অব্যক্ত সম্ভাবনা সৃজনকারী চিন্ময় ঈশ্বরেরই আসল প্রকৃতি । নিত্য "আত্ম" আধা নিত্য অনাত্মের সম্মুখীন । নারায়ণ অসীম জলের উপর চিন্তামগ্ন । "অনাত্ম" রূপ প্রকৃতি "আত্মে"রই প্রতিফলন, কাজেই আত্মের অধীন । পরমের মধ্যে যখন নঙর্থক উপাদানের সংক্রমণ হয়, তখনই তার অন্তর্মুখিতা ভবিষ্ণু পদ্ধতিতে উন্মোচিত হয় । আদি ঐক্যই সমগ্র বিশ্বের সম্ভাবনার ফলাফল হয়ে ওঠে ।




6.2) সৎ ও অসৎ

সৎ ও অসৎ, এই দুই সারতত্ত্বের পারস্পরিক প্রতিক্রিয়াই ব্রহ্মাণ্ডীয় আবির্ভাব । ঈশ্বরই ঊর্ধ্ব সীমা, তিনি অসৎকে সম্পূর্ণ আয়ত্তে রেখেছেন ও তার দ্বারা সব চেয়ে কম প্রভাবিত আর নিম্নসীমায় জড় বা প্রকৃতি সৎ দ্বারা সব চেয়ে কম প্রভাবিত । সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডই প্রকৃতির উপর পরমেশ্বরের লীলা । প্রকৃতি সদর্থক সত্তা কেননা তার প্রতিরোধের ক্ষমতা আছে । প্রতিরোধী আকারে সে অশুভ । মাত্র ঈশ্বরের মধ্যেই সে সম্পূর্ণভাবে প্রবিষ্ট ও পরাজিত । বাকী সৃষ্ট জগতে তার কোন না কোন অংশ আলোককে আড়াল করে ।

গীতা দার্শনিক দ্বৈতবাদকে সমর্থন করে না; কেননা অসতের ভাব সতের ভাবসাপেক্ষ । পরমের উন্মোচনে অসৎ, বাস্তবতার এক প্রয়োজনীয় ঋণ । জগৎ সংসারকে যে আকারে আমরা দেখছি তা বিসংবাদের ফল । কালবশ বিকারী জগৎ সর্বদা পরোৎকর্ষ লাভে প্রয়াসী । অসৎ ত্রুটি-বিচ্যুতির জন্য দায়ী বলেই জগতের অপরিহার্য উপাদান, কেননা তারই উপর ঐশী ভাব সক্রিয় হয় । পুরুষ ও প্রকৃতি একই পারমার্থিক সমগ্রতার অংশ । যখন সমগ্র জগৎ বন্ধনমুক্ত হবে, বিকারহীন হবে, সম্পূর্ণরূপে বিভাসিত হবে, তখনই পরমেশ্বরের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে এবং জগৎ সকল পার্থক্যের উপরে উঠে বিশুদ্ধ সতের উৎসে পুনঃস্থাপিত হবে ।

অসৎ থাকে কেন ? পরম স্থিতি থেকে হওয়ার মধ্যে অধঃপতন কেন ? অন্যভাবে এ প্রশ্ন দাঁড়ায় সৎ ও অসতের চিরন্তন দ্বন্দ্ব নিয়ে জগতের অস্তিত্ব কেন ? পরম সত্তা অদ্বিতীয় ঈশ্বর জগতের পিছনে আছেন, তার ওপারে আছেন এবং মধ্যেও আছেন, তিনিই সজীব পরমেশ্বর, জগতে তাঁর প্রীতি, তাঁর প্রসাদ দিয়ে জগৎকে ত্রাণ করেন । তবে নানা পর্যায়ের বহুতান্ত্রিক যে সংসারকে আমরা জানি তার প্রয়োজন কি ? এর উত্তরে শুধু এই বলতে পারি যে পরমেশ্বরের স্বভাবই এইভাবে নিজেকে প্রকাশ করা । জগতের অস্তিত্বের কারণ আমরা বুঝতে পারি না, শুধু তার প্রকৃতির একটা ধারণা দিতে পারি । তা হল ভবিষ্ণু অবস্থায় সৎ ও অসতের দ্বন্দ্ব । শুদ্ধ সৎ জগদীত আর শুদ্ধ অসৎ নিম্নতম সত্তারও নীচে । তার নীচে গেলে একেবারে শূন্য, চরম নাস্তি । আসল ভবিষ্ণু জগতে বা সংসারে সৎ ও অসৎ ভাবের বিরোধ আছে ।

সৎ ও অসতের প্রতিক্রিয়ার প্রথম ফল ব্রহ্মাণ্ড, যার মধ্যে সমগ্র প্রকট অস্তিত্ব বিদ্যমান । সমস্ত ভবিষ্যৎ বিকাশ তার মধ্যে অঙ্কুরাবস্থায় বর্তমান । তার মধ্যেই চরম এক্ষণের মধ্যে ভূত, ভবিষ্যৎ ও বর্তমান গ্রথিত । অর্জুন সমস্ত বিশ্বরূপ এক বিরাট আকারে দেখেন । তিনি ঈশ্বরকে দেখলেন অস্তিত্বের সীমামাত্রকেই বিদীর্ণকারী রূপে, সমগ্র আকাশ ও বিশ্বকে পরিপূর্ণ করে বিদ্যমান রূপে, যার মধ্যে বহু জগৎ জলপ্রপাতের মত ইতস্ততঃ প্রবাহিত ।


6.3) মায়া, অবিদ্যা ও মোহ

যারা ব্রহ্মকে নির্গুণ ও সম্পর্করহিত মনে করেন, তাঁরা স্বপ্রকাশ শক্তিবিশিষ্ট ঈশ্বরের ধারণাকে অবিদ্যাপ্রসূত মনে করেন । যে ভাবনা থেকে অনিত্য আকারের বোধ জন্মায়, যা নিত্য সত্তার তুলনায় অবাস্তব, সেই আপাত প্রতীয়মানকে মূর্ত করার ক্ষমতাকে অবিদ্যা বলে । কিন্তু অবিদ্যা কোন এক বা একাধিক ব্যক্তিবিশেষের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নয় । ব্রহ্মের নিজেকে নানারূপে প্রকট করার ক্ষমতাকেই অবিদ্যা বলে । ভগবান বলছেন, তিনি যদিও আসলে অজ বা জন্মরহিত তবু তিনি আত্মমায়ারূপ শক্তি*a দ্বারা জন্মগ্রহণ করেন । মায়া শব্দটি মা ধাতু (আকার দেওয়া, গঠন করা) হইতে সিদ্ধ এবং পূর্বে কথাটির অর্থ ছিল রূপ দেওয়ার ক্ষমতা । যে সৃজনী শক্তিবলে ভগবান বিশ্বজগৎ গঠন করেন তাকে যোগমায়া বলে । যে সকল আকার বা বস্তু মায়া বা মায়ী ঈশ্বরের রূপদান শক্তিপ্রসূত, তারা নিজেরা অবাস্তব এমন কোন কথা নেই ।

মায়াকে কখনও কখনও মোহের উৎস বলা হয় । "ত্রিগুণ দ্বারা মোহগ্রস্থ হয়ে এই সমগ্র সংসার আমাকে চিনতে পারে না যে আমি তাদের অতীত ও অক্ষয়" ।*b মায়াবলে আমাদের এক বিভ্রান্তিকর আংশিক চেতনা হয়, যা বাস্তবকে ভুলে প্রপঞ্চময় জগৎ অবলম্বন করে থাকে । প্রকৃতি ও তার গুণসমূহ দ্বারা ঈশ্বরের আসল সত্তা ঢাকা পড়ে যায় । সংসারকেই প্রবঞ্চনাময় বলা হয়, কেননা ঈশ্বর নিজেকে তাঁর সৃষ্টির আড়ালে লুকিয়ে ফেলেন । জগৎ প্রবঞ্চনা নয়, প্রবঞ্চনার উপলক্ষ মাত্র । সকল আকারকে চূর্ণ করে যবনিকার অন্তরালে যেতে পারলে আসল বস্তুর সন্ধান পাই । জগৎ ও তার নানা বিকারের ফলে ঈশ্বরের আত্মগুপ্তি বা তিরোধান, অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তাকে তাঁর সৃষ্টি দ্বারা আবরণ । সৃষ্টিকর্তার দিকে মনসংযোগ না করে মানুষ বস্তুময় জগতের দিকে আকৃষ্ট হয় । ঈশ্বরকে মহৎ প্রবঞ্চক বলে মনে হয়, কেননা তিনি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুবস্তুময় জগৎ সৃষ্টি করে আমাদের বোধকে বহির্মুখী করেন । ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুসমূহের বাসনাতেই আত্মপ্রবঞ্চনার প্রবণতা, ঐগুলিই মানুষকে ভগবানের দিক থেকে বিমুখ করে । জগতের জাঁকজমক আমাদের মোহমুগ্ধ করে আর আমরা তার ঐশ্বর্যের দাস হয়ে পড়ি । জগৎ বা বিষয়ীভূত প্রকৃতি বা সংসার পতিত, দাসত্বাবদ্ধ ও বিচ্ছিন্ন, এবং তা ক্লেশপূর্ণ কেননা অন্তর্যামী থেকে বিচ্ছিনতাই ক্লেশ । "এই মদীয় ঐশী মায়াকে জয় করা কঠিন" বলে যখন বলা হয়, তার অর্থ এই যে আমরা বিশ্বজগৎ ও তার নানা প্রক্রিয়ার আবরণ সহজে ছিন্ন করতে পারি না ।

কত বিভিন্ন অর্থে "মায়া" কথাটা ব্যবহার করা হয় এবং গীতায় তার কি স্থান, এখানে তার একটি হিসাব দেওয়া যাক্‌ ।
১) পরম সত্তা যদি সংসারের ঘটনাবলী দ্বারা প্রভাবান্বিত না হন, তা হলে এসব ঘটনা কি করে ঘটে সে রহস্যের ব্যাখ্যা করা যায় না । গীতা রচয়িতা সে অর্থে "মায়া" কথাটা ব্যবহার করেন নি যতই তাঁর ব্যাখ্যায় এ ধরণের কথা অনেক স্থলে অন্তর্নিহিত আছে বলে ধরা যায় । জগৎসংসার প্রতীয়মান হওয়ার কারণ হিসাবে অনাদি অথচ অবাস্তব এক অবিদ্যার ধারণা, গীতা রচয়িতার মনে ছিল না ।
২) কথিত আছে সগুণ ঈশ্বরের নিজের মধ্যেই সৎ ও অসৎ, ব্রহ্মের অচ্যুতি আবার ভবিষ্ণুর বিকারের মিলন । মায়া সেই শক্তি যার দ্বারা তিনি বিকারী প্রকৃতিকে সৃষ্টি করেন । সেই ঈশ্বরের শক্তি অর্থাৎ আত্মবিভূতি বা স্বভবমানতার ক্ষমতা । এই অর্থে ঈশ্বর ও মায়া পরস্পর সাপেক্ষ এবং অনাদি । ব্রহ্মের এই শক্তিকেই গীতাতে মায়া আখ্যা দেওয়া হয়েছে ।
৩) যেহেতু ঈশ্বর বিশ্বজগৎকে তাঁর সত্তার দুই উপাদান, প্রকৃতি ও পুরুষ, জড় ও চেতনা, দিয়ে সৃষ্টি করেছেন, তাদের ঈশ্বরের মায়া (প্রকৃষ্ট ও নিকৃষ্ট) বলা হয় ।
৪) ক্রমশঃ মায়া কথাটা নিকৃষ্ট প্রকৃতিকেই বোঝাতে লাগল, কেননা বলা হল যে ঈশ্বর প্রকৃতির গর্ভে পুরুষ রূপ বীজ নিক্ষেপ করে বিশ্ব উৎপাদন করলেন ।
৫) যেহেতু প্রকট জগৎ সত্যকে মর্ত্য ব্যক্তিগণের দৃষ্টিপথ থেকে প্রচ্ছন্ন করে রাখে, সেই হেতু তাকে ভ্রান্তি বলা যায় ।

জগৎসংসার মিথ্যা কল্পনা নয়, যদিও তাকে ঐশী সম্পর্ক-রহিত যান্ত্রিক প্রকৃতিচালিত বলে মনে করে তার দিব্য সারাংশ ধরতে পারি না । তখন সে মোহের উৎস হয়ে পড়ে । দিব্যমায়া অবিদ্যামায়া হয়ে যায় । অবশ্য তা শুধু সত্যভ্রষ্ট মর্ত্যব্যক্তিদের পক্ষেই, যে ঈশ্বর সমস্ত জানেন ও নিয়ন্ত্রণ করেন, তাঁর কাছে তাই বিদ্যামায়া । মনে হয় ভগবান মায়ারূপ বিরাট আচ্ছাদনে আবৃত হয়েছেন ।*c যেহেতু ঈশ্বরই কারণ এবং জগৎসংসার তার ফল এবং যেহেতু সর্বত্রই ফলের অপেক্ষা কারণই বেশি বাস্তব, সেহেতু কারণ স্বরূপ ঈশ্বরকে ফলস্বরূপ জগতের অপেক্ষা বেশী সত্য বলা হয় । ভবিষ্ণুতার স্ববিরোধী প্রকৃতি দ্বারাই জগতের এই অপেক্ষাকৃত অবাস্তবতা সমর্থিত হয় । অভিজ্ঞতার জগতে বৈপরীত্যের দ্বন্দ্ব আছে এবং সত্য সকল বৈপরীত্যের ঊর্ধ্বে ।



7) জীবাত্মা

সত্য স্বভাবতঃই অসীম, পরম ও সর্বপ্রকার বন্ধনমুক্ত, তার নিজস্ব সমগ্রতা ও আনন্দ থেকে তাকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না । জাগতিক প্রক্রিয়ায় দ্বিত্ব ও বৈপরীত্যের উৎপত্তি হয়, তারা অবিভক্ত অসীম সত্যকে অস্পষ্ট করে তোলে । তৈত্তিরীয় উপনিষদের ভাষায় জাগতিক প্রক্রিয়া পাঁচটি স্তরের পদার্থ অবলম্বন করে ঘটে - ১)অন্ন (অর্থাৎ জড় পদার্থ), ২)প্রাণ, ৩)মন, ৪)বিজ্ঞান এবং ৫)আনন্দ । জীবনের সৃজনী উচ্ছ্বাসে অংশগ্রহণ করে বস্তুসকল ভিতর থেকে (মানুষ) একটা প্রেরণা পায় । চতুর্থ স্তরে, বিজ্ঞান বা বুদ্ধি পর্যায়ে - সমস্ত কর্ম মানুষের স্বায়ত্ত নয়, সমগ্র পরিকল্পনাটির অন্তরালে যে সার্বিক সত্য বিদ্যমান, সে সম্বন্ধে সে সচেতন । সে জড়, প্রাণ ও মনের বৈশিষ্ট জানে । জড়জগৎকে সে অনেকখানি বশ করেছে, প্রাণময় অস্তিত্ব ও মনের অস্পষ্ট ক্রিয়াও তার অনেকখানি আয়ত্তে এনেছে, কিন্তু সে এখনও সম্পূর্ণ প্রবুদ্ধ চেতনার অধিকারী হয় নি । জড় থেকে যেমন জীব, জীবন থেকে মন, মন থেকে বুদ্ধি, তেমনই বুদ্ধিমান মানব উচ্চতর ও দিব্যজীবনে উন্নীত হবে । প্রকৃতির ঝোঁকই হচ্ছে ক্রমাগত স্বতঃ প্রসারণের দিকে । ঈশ্বরের জগৎসৃষ্টির উদ্দেশ্য বা মানবের বিশ্বজনীন নিয়তি হল এই মরদেহের মাধ্যমে অমরত্বের প্রয়াসের সাধনা, এই ভৌত কাঠামোর ও বুদ্ধিগত চেতনার মধ্যে ও মাধ্যমে দিব্য জীবনলাভ ।

মানুষের অন্তরতম প্রদেশে দিব্যভাবের বাসা এবং তাকে লোপ করা যায় না । সেই অন্তর্জ্যোতি গুপ্তদ্রষ্টা, স্থায়ী এবং জন্মজন্মান্তরেও অবিনশ্বর; মৃত্যু, জরা ও অশুদ্ধি তাকে স্পর্শ করতে পারে না । জীবের সারতত্ত্ব, মানসিক ব্যক্তিত্বই জন্মজন্মান্তরে পরিবর্তিত হয় ও বর্ধিত হয় এবং অহং যখন দিব্যের সঙ্গে সম্পূর্ণ সমঞ্জস হয় তখন তা সেই অতীন্দ্রিয় সত্তায় উন্নীত হয়, যা তার নিয়তি এবং যতক্ষণ তা না হয় ততক্ষণ তাকে জন্মমৃত্যুর পর্যায়ক্রমিক চক্রে ঘুরতে হয় ।

প্রত্যেকের মধ্যে সকল ভৌত আকারই দেখা যায়, কেননা মানবদেহের সুসন্বদ্ধ আকৃতির মধ্যেও জড়ত্ব, সংগঠন ও পশুত্বের রূপরেখা দেখা যায় । জগৎ যে জড় জীবন ও মন নিয়ে পূর্ণ তা আমাদের মধ্যেও আছে । বহির্জগতে যে সকল শক্তি সক্রিয় আমরাও তার অংশীদার । আমাদের ধীমান স্বভাব থেকে আত্মচেতনার উৎপত্তি হয়, পরে প্রকৃতির সঙ্গে মৌলিক সংহতি থেকে মানবিক ব্যক্তিত্বের উদয় হয় । গোষ্ঠীর প্রতি সহজাত অনুগামিতা থেকে যে নিরাপত্তা বোধ আসে, তা স্থায়ী হয় না এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে তা আবার উচ্চস্তরে পুনরর্জন করতে হয় । নিজস্ব সমগ্রতা দ্বারা স্বতঃপ্রণোদিত প্রীতি ও নিঃস্বার্থ কর্মদ্বারা জগতের সঙ্গে ঐক্য সাধন করতে হয় । প্রারম্ভিক দৃশ্যে অর্জুন প্রাকৃতিক ও সামাজিক সংসারের সম্মুখীন হয়ে নিজেকে একান্ত নিঃসঙ্গ মনে করলেন । সামাজিক মানের কাছে বশ্যতা দ্বারা তিনি মানসিক নিরাপত্তা সিদ্ধ করতে চাইলেন না । যতদিন পর্যন্ত তিনি মনে করেছেন যে ক্ষত্রিয় হিসাবে যুদ্ধ করা তাঁর ধর্ম, যতক্ষণ পর্যন্ত তিনি তাঁর পদমর্যাদা ও তৎসংক্রান্ত কর্তব্যবোধ দ্বারা আবদ্ধ, ততদিন তিনি তাঁর নিজস্ব কর্মের পূর্ণ সম্ভাবনা সম্বন্ধে অচেতন । আমাদের অধিকাংশই সমাজে নির্দিষ্ট স্থানটি খুঁজে পেয়ে যেন জীবনের অর্থ বুঝতে পারে এবং একটা নিরাপত্তাবোধ অর্জন করে সমাজে একটা নিজস্ব স্থান লাভ করে । নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে আমরা সাধারণতঃ জীবনোন্মেষের ক্ষেত্র পেয়ে যাই এবং সামাজিক বিধিগুলিকে শৃঙ্খল বলে মনে হয় না । ব্যক্তিবৈশিষ্ট্য দেখা যায় না । সামাজিক মাধ্যমের মধ্যে ছাড়া নিজের অস্তিত্বের আর কোন ধারণা মনে ওঠে না । সামাজিক বিধির কাছে সম্পূর্ণ বশ্যতা স্বীকার করে অর্জুন তাঁর অসহায়তা বোধ ও উদ্বেগ থেকে নিষ্কৃতি পেতে পারতেন, কিন্তু তাতে তাঁর উন্নতি ব্যাহত হত । বাহিরের কর্তৃত্বের কাছে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করে যে সন্তোষ ও নিরাপত্তা অর্জন করা যায় তা নিজস্ব সমগ্রতা লাভের সম্ভাবনাকে ত্যাগ করে অর্জন করতে হয় । বর্তমান যুগের সর্বতান্ত্রিকতার ন্যায় কয়েকটি মতবাদ বলে যে ব্যক্তি সমাজের মধ্যে মিশে গিয়েই নিজেকে রক্ষা করে, তারা ভুলে যায় যে মানবব্যক্তিত্বের সম্পূর্ণ উন্মেষের জন্যই গোষ্ঠীর অস্তিত্ব প্রয়োজন । সামাজিক অনুবৃত্তি থেকে নিজেকে মুক্ত করেছিলেন বলেই অর্জুন নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছিলেন এবং জগতের যে আকৃতি বিপজ্জনক ও লোককে অভিভূত করে, তারই সম্মুখীন হয়েছিলেন । নিঃসঙ্গতা ও উদ্বেগ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার মানবিক উপায় বশ্যতা নয় । আমাদের অন্তর্লীন আধ্যাত্মিক প্রকৃতির উন্মেষ দ্বারা সংসারের সঙ্গে যে নূতন প্রকারের সম্পর্ক গড়ে ওঠে তার মধ্যেই আমাদের মুক্তি, সেখানে আমাদের অখণ্ডতা ক্ষুণ্ণ হয় না । তখন আমরা নিজেদের সক্রিয় সৃজনকারী ব্যক্তি বলে বুঝতে পারি, সে জীবন বাহিরের কর্তৃত্বের অনুগামিত্বে নয়, সত্যের প্রতি স্বাধীন অনুরাগ রূপ অন্তরের বিধি পালনই তার লক্ষণ ।

জীবাত্মা বিভুরই অংশ, যিনি ব্রহ্মের আসল রূপ, কাল্পনিক আকার নয় । জীব ঈশ্বরের সীমিত প্রকাশ । পরমেশ্বর থেকে উদ্ভূত জীবাত্মা পরমেরই অঙ্গ, তা থেকে নির্গত কোন বস্তু নয় । জীব যে প্রকৃষ্ট ভাবকে আদর্শ বলে মনে করে, তা যেন তার জন্মদাতা পিতা । আত্মার সারসত্তা দিব্যধী থেকে উদ্ভূত এবং যে দিব্য সত্তা তার জনক ও সদাসাথী তাকে দর্শনের কল্যাণেই জীবনে তার প্রকাশ । তদ্বারা আকর্ষিত ইন্দ্রিয় ও মনের অনুবৃত্তি ও দৈবী ধাঁচ দ্বারা তার স্বাতন্ত্র্য নির্ধারিত । মানসিক-জৈব-ভৌতিক খোলসের সীমিত অনুবৃত্তির মধ্যে সার্বিক সত্তা আকার গ্রহণ করেন । কোন ব্যক্তি সর্বতঃ আর এক ব্যক্তির সঙ্গে অভিন্ন হয় না, কোন জীবনই আর এক্টির পুনরাবৃত্তি নয়, অথচ সকলের মধ্যেই একই ধাঁচ । মানব ব্যক্তিত্বের বিশেষ লক্ষণ যে অহং, তার সারমর্ম একটা সৃজনী ঐক্য, আন্তরিক সংকল্প, একটা পরিকল্পনা যা ক্রমশঃ আঙ্গিক ঐক্যের আকার গ্রহণ করে । আমাদের লক্ষ্য যা, জীবনও তাই । প্রাতিস্বিক যে আকারই গ্রহণ করুক তা স্থায়ী নয় কেননা সে সর্বদা নিজেকে অতিক্রম করতে চায় এবং সেই প্রক্রিয়া চলতে থাকবে যত দিন না হতে থাকা হওয়াতে পর্যবসিত হয় । জীবেরা ঈশ্বরের সত্তার বিশিষ্ট জঙ্গমতা । অনাত্ম ও তার বিভিন্ন রূপের সঙ্গে মিথ্যা অভিন্নতা বোধে অহং যখন বিলুপ্ত, তখন জীব বদ্ধ কিন্তু যখন যথাযুক্ত বোধোন্মেষ দ্বারা, সে আত্ম ও অনাত্মের আসল প্রকৃতি বুঝতে পারে এবং অনাত্মীয় যন্ত্রগুলির উপর সম্পূর্ণ আত্মিক আলোকসম্পাতে সক্ষম হয়, তখন সে মুক্তিলাভ করে । বুদ্ধি বা বিজ্ঞানের উপযুক্ত ব্যবহারেই সেই উপলব্ধি সম্ভব হয় ।

মানুষের সমস্যা নিজ ব্যক্তিত্বের অখণ্ডতায় সিদ্ধ হওয়া, দেহ ও আত্মার সমস্ত শক্তি যাতে অধ্যাত্ম তত্ত্ব দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় সেই প্রকার দিব্য অস্তিত্বের বিকাশ সাধন করা । আত্মাই এই অখণ্ড জীবনের সৃষ্টি করতে পারে । যে দেহ মানুষকে প্রাকৃতিক জীবনের সঙ্গে এক সূত্রে গ্রথিত করে, তার সঙ্গে আত্মার চূড়ান্ত কোন পার্থক্য নেই । দেকার্তে যে মৌলিক অর্থে এই পার্থক্যের ধারণা করেছেন, তা ঠিক নয় । আত্মিক জীবন দৈহিক জীবনে অনুপ্রবিষ্ট ও ব্যাপ্ত, যেমন আত্মা দৈহিক জীবন দ্বারা প্রভাবিত । মানুষের দেহ ও আত্মার মধ্যে একটা সজীব ঐক্য আছে । আসল দ্বিত্ব আত্মা ও প্রকৃতিকে জয় করতে পেরেছে, স্বাধীনতা প্রয়োজনকে দমন করেছে । গীতা ব্রহ্মের এই দুই দিকের বিচার করে বলেছেন যে আমরা প্রকৃতির মধ্যে পরমার্থের সঞ্চরণ করতে পারি, তার মধ্যে আর এক গুণ অর্পণ করতে পারি । প্রকৃতিকে চূর্ণ বা ধ্বংস করার প্রয়োজন নেই ।

ইচ্ছাস্বাতন্ত্র্য বনাম নিয়তিবাদের সমস্যা প্রাতিস্বিক মানবের সম্বন্ধেই উঠতে পারে । পরমের সম্বন্ধে প্রশ্নটি ওঠে না, কেননা তিনি সকল বৈপরীত্যের ঊর্ধ্বে, আর মানবেতর জীব ও উদ্ভিদের সম্বন্ধেও ঐ প্রশ্নের অর্থ নেই । মানুষ যদি সহজাত প্রবৃত্তি দ্বারা সম্পূর্ণ ভাবে চালিত হত, তার বাসনা ও মীমাংসা যদি বংশগতি ও প্রতিবেশের ফল হত, তা হলে তার কর্ম সম্বন্ধে নৈতিক বিচার সকলও অপ্রাসঙ্গিক হত । সিংহের হিংস্রতার জন্য আমরা তার নিন্দা করি না, আর মেষশাবকের মৃদু স্বভাবের জন্য তার প্রশংসা করি না । স্বাধীন ভাবে কর্ম করার ক্ষমতা মানুষের আছে [স্বতন্ত্রঃ কর্তা - পাণিনি] । তাই আচার্য সমস্ত জীবন দর্শন ব্যাখ্যা করে অর্জুনকে নিজ ইছামত কর্ম করতে নির্দেশ দিয়েছেন । গীতার সমস্ত শিক্ষা মানুষকে কল্যাণের পথ বেছে নিতে বলছে এবং সচেতন প্রকাশ দ্বারা অভীষ্ট লাভ করতে বলছে । কিন্তু এই বেছে নেবার স্বাধীনতার পথে অনেক বাধা আছে ।

মানবসত্তা জটিল ও বহুমাত্রিক । তার মধ্যে জড়, জীবন, চেতনা, বুদ্ধি ও দিব্য স্ফুলিঙ্গ রূপ বিভিন্ন উপাদান আছে । সে স্বাধীন যখন সে উচ্চতম স্তর থেকে কাজ করতে পারে, এবং উদ্দেশ্যসিদ্ধির জন্য অন্য উপাদানগুলিকে ব্যবহার করতে পারে । যখন সে বিষয়গত প্রকৃতির স্তর থেকে কাজ করে যখন সে অনাত্মের সঙ্গে নিজের প্রভেদ বুঝতে পারে না, তখন সে প্রকৃতির যান্ত্রিকতার দাস হয়ে পড়ে । তবু, এমন কি যখন সে ভুল করে নিজেকে বস্তুময় জগতের সঙ্গে অভিন্ন বলে মনে করে, যখন সে নিজেকে প্রাকৃতিক প্রয়োজনের অধীন বলে বিবেচনা করে, তখনও তার আশা আছে কেননা একেশ্বর সত্তার সকল স্তরেই সক্রিয় । জড়বস্তুও ব্রহ্মেরই এক অভিব্যক্তি । প্রকৃতির নিম্নতম স্তরেও একটা স্বতঃস্ফূর্তি ও সৃজনশক্তি আছে, যার শুধু যান্ত্রিক শক্তি দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায় না ।

আমাদের সত্তার প্রত্যেক স্তরের নিজস্ব চেতনা আছে, বহির্স্তরের চিন্তা আছে, অনুভূতি, চিন্তা ও ক্রিয়ার অভ্যস্ত পন্থা আছে । অহং যেন তার অস্পষ্ট ও সীমাবদ্ধ চেতনা বজায় রাখার চেষ্টা না করে, কেননা সে চেতনা তার প্রকৃত স্বভাবের বিকৃতি । যখন আমরা ইন্দ্রিয়সমূহকে জয় করে তাদের নিয়ন্ত্রণে আনি তখন আত্মার শিখা উজ্জ্বল ও স্পষ্টভাবে জ্বলতে থাকে "নির্বাত স্থানে প্রদীপের মত" । চেতনার আলোক তার নিজ প্রকৃতিতে বিদ্যমান এবং যে বুদ্ধির মধ্যে সেই আলোক প্রতিফলিত হয়, তার দ্বারা নানা পরিবর্তনশীল অভিজ্ঞতার স্রোত চালিত প্রায়োগজ সত্তা নিয়ন্ত্রিত হয় । তখন আমরা প্রাকৃতিক লীলার ঊর্ধ্বে উঠি এবং সৃজনীশক্তির উৎস আসল আত্মাকে দেখতে পাই; ইতস্ততঃ তাড়িত বস্তুর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ঘুচে যায় এবং আমরা আর প্রকৃতির অসহায় যন্ত্র থাকি না ।

আমরা নীচের জগতে থেকেও স্বাধীনভাবে উচ্চতর জগতের অংশীদার হতে পারি । প্রকৃতি নিয়তি চালিত সংস্থা বটে কিন্তু একেবারে বহির্প্রভাবমুক্ত নয় । আত্মিকশক্তি তার প্রাচীর অতিক্রম করে তার গতি পরিবর্তিত করতে পারে । আত্মের প্রত্যেক ক্রিয়া সৃজনধর্মী আর অনাত্মের প্রত্যেক কর্মই আসলে নিষ্ক্রিয় । আমাদের অন্তর্লোকে আমরা আমাদের গভীরতম সত্তায়, মৌলিক সত্যের সম্মুখীন হই । যে অনাত্মিক ক্ষেত্রে জৈবিক ও সামাজিক বংশগতি খাটে সেখানেই কর্মফলের বিধি প্রচলিত কিন্তু বিষয়ী আত্মের মধ্যে মুক্তির, প্রকৃতির নিয়তিবাদের উপর জয়ের, সংসারের বাধ্যতা অতিক্রম করার সম্ভাবনা রয়েছে । বিষয়ী মানুষের বিষয়রূপ মানুষকে আয়ত্তে আনা উচিত । বিষয় বাহিরের নিয়তির দ্যোতক, বিষয়ী মানে মুক্তি ও নিয়তি-নিরপেক্ষতা । স্বয়ংবদ্ধ এবং মানসিক ও সামাজিকভাবে স্বয়ংক্রিয় অহং আসল বিষয়ীর বিকৃতি । আত্মার স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত করে কর্মফলকে অতিক্রম করা যায় । গীতায় অনেক স্থলে বলা হয়েছে অতিপ্রাকৃত ও প্রাকৃত বস্তুর মধ্যে মৌলিক দ্বিত্ব নেই । মানুষ যে সব জাগতিক শক্তির অধীন, সেগুলি নিকৃষ্ট প্রকৃতির অঙ্গ । কিন্তু তার আত্মা প্রকৃতির নিগড় ভেঙ্গে ফেলে দিব্য সম্পর্ক উপলব্ধি করতে পারে । অপরা প্রকৃতির উপর নির্ভরশীলতাই আমাদের বন্ধন । তার ঊর্ধ্বে উঠতে পারলেই আমাদের স্বভাবকে আধ্যাত্মিক অবতরণের ক্ষেত্র করে তুলতে পারি । কষ্ট সহ্য করে এবং বিশেষ প্রয়াস দ্বারা কল্যাণ কল্যাণের মধ্যে বেছে নেবার মানুষের যে স্বাধীনতা আছে, তা থেকে আরও প্রকৃষ্ট স্বাধীনতায় সে পৌঁছতে পারে, যার দ্বারা কল্যাণকে অবিচলিত ভাবে অবলম্বন করে থাকা যায় । আত্মমুখী আন্তরিক সত্তায় প্রত্যাবর্তনই মুক্তি, আর বিষয়গত জগৎ, প্রয়োজন ও নির্ভরশীলতার দাসত্বই বন্ধন ।

প্রকৃতি বা সমাজ কেউই আমাদের সম্মতি ছাড়া আমাদের অন্তর্লোকে প্রবেশ করতে পারে না । ভগবানও মানুষের সম্বন্ধে সমীহ করে কর্মে প্রবৃত্ত হন । তিনি আমাদের সম্মতি আদায় করার চেষ্টা করেন, কখনও জবরদস্তি করেন না । মানবিক ব্যক্তিত্বের নিজস্ব বৈশিষ্ট আছে, যার দ্বারা তার উন্মেষের সম্বন্ধে ঈশ্বরের হস্তক্ষেপের ক্ষেত্র সীমিত । জগৎ কোন একটা পূর্ববিহিত পরিকল্পনা যান্ত্রিকভাবে সাধন করছে না । সৃষ্টির লক্ষ্য হল এমন জীবাত্মার সৃষ্টি, যারা ঈশ্বরের ইচ্ছা স্বেচ্ছায় পালন করবে । আমাদের মনোবেগকে নিয়ন্ত্রিত করতে হবে, বিভ্রান্তি ও বিচলনকে ঝেড়ে ফেলতে হবে, প্রাকৃতিক স্রোতের ঊর্ধ্বে উঠতে হবে, আমাদের আচরণকে বুদ্ধি দ্বারা চালিত করতে হবে, নচেৎ আমরা "পৃথিবীতে মানবের শত্রু কামনা"র দাস হয়ে পড়ব । প্রাতিস্বিকের নির্বাচনের স্বাধীনতা এবং যেভাবে সেই স্বাধীনতা আচরণে প্রকাশ পায়, গীতায় তার উপর জোর দেওয়া হয়েছে । মানুষের প্রয়াস, তার ব্যর্থতাবোধ ও আত্মাভিযোগকে মর্ত্য মনের ভ্রান্তি বা দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়ার দশা সমূহমাত্র বলে উড়িয়ে দেওয়া ঠিক নয় । তা হলে জীবনের নৈতিক প্রয়োজনীয়তাই অস্বীকার করা হয় । অনন্তের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে অর্জুন যখন ভয় ও ভয়মিশ্রিত শ্রদ্ধা প্রকাশ করেন এবং যখন তিনি ক্ষমা চান, তখন তিনি নাটক করছিলেন না, সত্যই তাঁর পক্ষে সে একটা সঙ্কটময় মুহূর্ত ।

ভবিষ্যৎ নিয়তি প্রকৃতি দ্বারা সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় না । কর্ম নিয়তি নয়, একটা শর্ত মাত্র । কোন কার্যসাধনে যে পাঁচটি উৎপাদক প্রয়োজন তার অন্যতম । সে পাঁচটি হল -
১) অবস্থান অর্থাৎ যে ভিত্তির উপর বা কেন্দ্র থেকে আমরা কাজ করি,
২) কর্তৃ বা যিনি কাজ করেন,
৩) কারণ অর্থাৎ প্রকৃতির যন্ত্রাবলী বা সহায়,
৪) চেষ্টা,
৫) দৈব অর্থাৎ ভাগ্য - সেই শক্তি বা শক্তিগণ, যা মানবীয় নয়, বিশ্বজাগতিক, যা অন্তরালে থেকে কার্যকে পরিবর্তিত করে এবং ক্রিয়া ও তার পুরস্কার রূপে কর্মফল বিতরণ করে ।

প্রাকৃতিক গঠনে যে অংশ একেবারে অবশ্যম্ভাবী, সংযম দ্বারা যাকে নিরস্ত করা যায় না, আর যে অংশকে আয়ত্তে এনে আমাদের উদ্দেশ্যসিদ্ধির সহায় করা যায়, এই দুইয়ের মধ্যে যে পার্থক্য আছে, তা আমাদের বুঝতে হবে । আমাদের জীবনে এমন উপাদান আছে যার নিয়ন্ত্রক শক্তিগুলি আমাদের আয়ত্তে আনার কোন উপায় নেই । কেমন করে, কখন, কোথায় ও জীবনের কি স্তরে আমরা জন্মগ্রহণ করব, তার উপর আমাদের হাত নেই । অবশ্য পুনর্জন্মবাদ স্বীকার করলে, জন্মকেও আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি । পূর্বেকার কর্ম দ্বারাই আমাদের কুল, বংশগতি ও প্রতিবেশ নির্ধারিত হয় । কিন্তু ইহজন্মের দিক থেকে যদি দেখি তো বুঝি যে আমাদের জাতি, কুল, পিতামাতা বা সামাজিক মর্যাদা আমাদের সঙ্গে পরামর্শ করে স্থির করা হয় না । কিন্তু পরিসীমার মধ্যে আমাদের বেছে নেবার স্বাধীনতা আছে ।

জীবন তাসের ব্রিজ খেলার মত । খেলাটা আমরা উদ্ভাবনও করি নি আর তাসের আকারপ্রকারও আমরা স্থির করি নি । নিয়মকানুনও অন্যে বেঁধে দিয়েছে, আর কার ভাগ্যে কি কি তাস পড়বে তাও খেলোয়াড়রা স্থির করতে পারে না । অথচ যে তাস আমাদের বণ্টন করে দেওয়া হয়, ভাল হোক বা মন্দ হোক তাই নিয়েই খেলতে হবে । এ পর্যন্ত খেলোয়াড়রা সম্পূর্ণ নিয়তির অধীন । তা সত্ত্বেও খেলার ভাল মন্দ আছে । দক্ষ খেলোয়াড় খারাপ হা পেয়েও খেলা জিততে পারে আর খারাপ খেলোয়াড় ভাল হাত পেয়েও সব গোলমাল করে ফেলে ।

আমাদের জীবনও বাধ্যতা ও স্বাধীনতা, দৈব ও নির্বাচনের মিশ্রণ । যথোপযুক্ত নির্বাচন দ্বারা আমরা সমস্ত উপাদানগুলিকে স্থিরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে, প্রাকৃতিক নিয়তিকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করতে পারি । জড়পদার্থের বিচলন, উদ্ভিদসমূহের বৃদ্ধি, জীবজন্তুর আচরণ প্রায় সম্পূর্ণ পরবশ, কিন্তু মানুষের বুদ্ধি আছে বলে সে জাগতিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে সচেতন সহযোগিতা করতে পারে । কোন কোন কাজকে সে পছন্দ বা অপছন্দ করতে পারে, সম্মতি দিতেও পারে, নাও দিতে পারে । সে যদি নিজ বুদ্ধির প্রয়োগ না করে তা হলে বুঝতে হবে যে সে তার মানবতার বিরোধী আচরণ করছে । সে যদি অন্ধের মত নিজ প্রবৃত্তি ও আবেগচালিত হয়, তাহলে তার মানুষের থেকে পশুর সঙ্গে বেশী সাদৃশ্য । মানুষ হলে তাকে ন্যায়সঙ্গত কার্য করতে হবে ।

আমাদের কতকগুলি কাজ নামমাত্র আমাদের নিজস্ব । স্বতঃস্ফূর্তি শুধু আপাতদৃষ্টিতে । সংবেশিত অবস্থায় আমাদের যে সমস্ত নির্দেশ দেওয়া হয়, সেগুলি আমরা অনেক সময় পালন করে থাকি । আমাদের বিশ্বাস থাকে যে আমরা স্বেচ্ছায় চিন্তা করছি, অনুভব করছি ও সংকল্প করছি কিন্তু আসলে আমরা সংবিষ্ট অবস্থায় যে ইঙ্গিত পেয়েছি সেগুলিকেই ব্যক্ত করছি । আমাদের অনেক ক্রিয়াই সংবিষ্ট অবস্থানির্দিষ্ট ক্রিয়ার মত, সেগুলি স্বতঃস্ফূর্ত বলে মনে হয়, কিন্তু আসলে তা নয় । সবচেয়ে সাম্প্রতিক মতামতের পুনরাবৃত্তি করে ভাবি যে সেগুলি বুঝি আমাদের নিজ চিন্তাপ্রসূত । নিজ নিঃসঙ্গতা ও অসহায়তার দ্বারা বাধ্য হয়ে যেসব কাজ আমরা করি তাকে স্বতঃস্ফূর্ত বলা চলে না । সে হবে সামগ্রিক আত্মার মুক্ত প্রকাশ । কর্তাকে নিজের কাছে স্বচ্ছ হতে হবে, স্বতঃস্ফূর্ত ও সৃজনধর্মী ক্রিয়া তখনই সম্ভব, যখন ব্যক্তির বিভিন্ন উপাদানে মৌলিক অখণ্ডতা লাভ করে । যে সাত্ত্বিক প্রকৃতি বস্তুর মধ্যে সত্যের সন্ধান করে এবং ন্যায্য কার্যবিধি পালন করার চেষ্টা করে, মানুষের উচিত তাই দিয়ে তার রজঃ ও তমঃ গুণকে নিয়ন্ত্রণ করা । কিন্তু সত্ত্বগুণ দ্বারা পরিচালিত হলেও আমরা সম্পূর্ণ মুক্ত নই । রজঃ ও তমের ন্যায় সত্ত্বও বন্ধন । সত্য ও সাধুতার বাসনা মহত্তর । অহং বোধ তখনও সক্রিয় । অহং-এর ঊর্ধ্বে উঠে, অহং যে পরমাত্মার অন্যতম প্রকাশ মাত্র, সেই পরমাত্মায় উন্নীত হতে হবে । যখন আমাদের ব্যক্তিসত্তাকে পরমসত্তার সঙ্গে এক করে নিতে পারি তখনই সত্ত্ব, রজ, তম গুণ-বিশিষ্ট প্রকৃতির ঊর্ধ্বে উঠে ত্রিগুণাতীত অবস্থায় পৌছে জগতের বন্ধন থেকে মোক্ষলাভ করি ।



8) যোগশাস্ত্র

ভারতীয় দর্শনের প্রত্যেক পদ্ধতির চিন্তাধারাই চরম আদর্শে পৌঁছবার ব্যবহারিক রীতির নির্দেশ দিয়েছে । চিন্তা দিয়ে আমরা শুরু করি কিন্তু লক্ষ্য থাকে চিন্তার ঊর্ধ্বে উঠে এমন অভিজ্ঞতা লাভ করা যাতে পথনির্দেশ স্পষ্ট হয় । দর্শনের বিভিন্ন পদ্ধতিতে শুধু যে আমরা অধিবিদ্যার সিদ্ধান্তগুলিই পাই তা নয়, পারমার্থিক মার্গে অগ্রসর হবার উপায়ও পাই । তর্ক উঠতে পারে যে মানুষ যদি ঈশ্বরের অংশই তা'হলে তার পরিত্রাণের ত কোন দরকার নাই, শুধু তার স্বরূপ সম্বন্ধে সচেতন হলেই ত চলবে । কেউ যদি মনে করে যে পাপ করার জন্য ঈশ্বরের সঙ্গে তার বিচ্ছেদ হয়েছে তাহলে তার এমন একটা কৌশল জানা দরকার যাতে তার মনে পড়ে যে আসলে সে ভগবানেরই অংশ, এর বিপরীত কোন অনুভূতি ভ্রান্ত মাত্র । কিন্তু এ চেতনা শুধু বুদ্ধির ক্ষেত্রে হলে চলবে না, মানুষের সমগ্র ও অখণ্ড প্রকৃতির সংস্কার প্রয়োজন । ভগবদ্‌গীতা শুধু অধিবিদ্যা (ব্রহ্মবিদ্যা) নয়, পাঠ বিনয়ও (যোগশাস্ত্র) বটে । যোগ শব্দটি যুজ ধাতু থেকে নিষ্পন্ন, তার মানে যোজনা করা । যোগ আমাদের মানসিক শক্তিগুলিকে সংহত করে, সামঞ্জস্য বিধান করে, তাকে ইন্নত করে । আমাদের অস্মিতাকে তীব্রতম ভাবে গাঢ় করে, আমাদের শক্তিকে যুক্ত ও সংহত করতে পারলে আমরা অগং-এর সঙ্কীর্ণ গণ্ডি ভেদ করে লোকোত্তর অস্মিতায় পৌঁছবার পথ প্রশস্ত করতে সক্ষম হই । আত্মা কারাবন্ধন ছিন্ন করে, তা থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে, নিজের অন্তরতম প্রদেশে পৌঁছয় ।

গীতায় আমরা বৃহৎ, সহজগম্য ও বহুমুখী এক ব্যাপক যোগশাস্ত্র পাই, তাতে আত্মোন্মেষের নানা দশা ও দিব্যাবস্থায় উন্নয়নের পন্থা পাওয়া যায় । যে আন্তরিক বিনয়ের প্রয়োগে আত্মার মুক্তি ঘটে ও মানবজাতির লক্ষ্য ও ঐক্যের একটা নূতন ধারণা জন্মায়, তারই বিশেষ প্রয়োগ বিভিন্ন যোগের মধ্যে পাওয়া যায় । এই সবের জন্য যা কিছু অভ্যাস প্রয়োজন তাকেই যোগ বলে, যেমন জ্ঞানযোগ, ভক্তিযোগ ও কর্মযোগ ।

মানবীয় স্তরে পরোৎকর্ষ লাভ করতে হলে সচেতন প্রয়াস দ্বারাই তা হতে পারে । আমাদের মধ্যে ভগবানের যে প্রতিকৃতি আছে তার ক্রিয়ায় আমাদের মধ্যে একটা অপ্রাচুর্যের বোধ জন্মায় । যে সব জিনিষ পেলে মানুষ সুখী হয় তার সত্যতা সম্বন্ধে সন্দেহ, তার ক্ষণিকতা ও ব্যর্থতা সম্বন্ধে একটা আসঙ্কা বোধ মানুষের মনে থেকেই যায় । যারা ভাসা-ভাসা জীবন যাপন করে তারা হয়ত আত্মপীড়া বা কষ্ট অনুভব করে না এবং নিজের সত্যকার কল্যাণের জন্য প্রয়াসের কোন প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে না । তারা মানবাকারে পশু ("পুরুষ পশু") এবং জন্তুদের মতই তারা জন্মায়, বড় হয়, সঙ্গম করে, সন্তানের জন্ম দেয়, তার পর বিলুপ্ত হয়ে যায় । কিন্তু যারা মানবিক মর্যাদা উপলব্ধি করতে পারে তারা বিসংবাদ সম্বন্ধে অত্যন্ত সচেতন এবং শান্তি ও সামঞ্জস্যের তত্ত্বানুসন্ধান করে ।

পরোৎকর্ষ ও শান্তিকামী এই ধরণের মানবতার নিদর্শন অর্জুনের মধ্যে পাই কিন্তু গীতার প্রারম্ভিক ভাগে আমরা দেখি যে তাঁর মন অন্ধকারাচ্ছন্ন, তাঁর প্রত্যয়ে অস্থিরতা এবং তাঁর সমগ্র চেতনা মোহগ্রস্থ । জীবনের উদ্বেগ-সকল তাঁকে অত্যন্ত পীড়া দিচ্ছে । প্রত্যেক ব্যক্তির একটা সময় আসে (প্রকৃতির কোন তাড়া নেই) যখন তার নিজের সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ হয়, যখন সে নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে ডুবে যায়, যখন আলোকের একটি শিখার, দিব্যের একটি আভাসের জন্য সে সর্বস্ব ত্যাগ করতে পারে । যখন অবিশ্বাস, অভক্তি, জীবনের প্রতি ঘৃণা এবং অন্ধ হতাশা দ্বারা সে আক্রান্ত হয়, তখন ঈশ্বরের কৃপা ছাড়া তার পরিত্রাণের পথ নেই । যে দিব্য সত্যে সকল মানুষের অবাধ অধিকার, তা যদি অল্প কয়জনেই আয়ত্ত করতে পেরে থাকে তবে বুঝতে হবে যে রহস্য লুকিয়ে আছে, সেই পরোৎকর্ষের ক্রিয়াতেই অপ্রাচুর্য, অনুর্বরতা এবং আবর্জনার বোধ আসে । ভগবদ্দর্শনের আবেগ থেকে যে ব্যাকুলতার উৎপত্তি তাই থেকেই মহান ভাবতান্ত্রিকতার এবং মানবিক পরিপূর্ণতা লাভের প্রয়াসের উদ্ভব হয় । নিজেকে অতিক্রম করার যে অনন্ত শক্তি আমাদের আছে তাতেই আমাদের মধ্যে ঈশ্বরের প্রতিকৃতি প্রকট হয় ।*a



9) জ্ঞান বা মোক্ষদায়িনী প্রজ্ঞা

পরোৎকর্ষের লক্ষ্যে কি করে পৌঁছনো যায় ? সংসার ঐতিহাসিক পরিণামিতা । এক অবস্থা থেকে পরবর্তী অবস্থায় পরিবর্তনের ঐহিক শোভাযাত্রা । কর্মদ্বারাই সংসার গতিশীল । পৃথিবী যে শুধুই জোয়ার ভাঁটা, ক্রমাগত হওয়া, সে কর্মের ফল । মনুষ্যস্তরে কর্মের উৎস বাসনা বা কাম । কামনার মূল কারণ অবিদ্যা, অর্থাৎ বস্তুদের আসল প্রকৃতি সম্বন্ধে অজ্ঞতা । নিজের স্বয়ংসম্পূর্ণতার উপর বিশ্বাস, তাকে নিত্য ও সত্য বলে ভ্রান্ত ধারণার মধ্যেই বাসনার মূল । যতদিন অজ্ঞতা থাকবে ততদিন ভবিষ্ণুতার দুষ্ট চক্র থেকে পরিত্রাণ নেই । কামনাকে নূতনতর কামনা দিয়ে নিরস্ত করা যায় না, কর্মকে আরও বেশী কর্ম দ্বারা শোধন করা যায় না । নিত্যকে অনিত্য উপায়ে অর্জন করা যায় না । আমাদের বাসনা ভালই হোক বা মন্দই হোক, বন্ধনের প্রশ্ন থেকেই যায় । শেকল সোনার তৈরী কি লোহার তৈরী তাতে কিছু আসে যায় না । যে অজ্ঞতা থেকে মূঢ় বাসনার উদ্ভব, যে অজ্ঞতা থেকে আমাদের বিমোহিত কর্মের উৎপত্তি, তাকে না দূর করলে আমাদের বন্ধন ঘুচবে না । অবিদ্যা-কাম-কর্ম রূপ শৃঙ্খল থেকে মুক্তির উপায় বিদ্যা বা প্রজ্ঞা ।

তত্ত্বজ্ঞান বা অভ্রান্ত বিশ্বাস আর প্রজ্ঞা এক নয়, কেননা বোঝবার ভুল থেকে অজ্ঞতা আসে না । অজ্ঞতা পারমার্থিক অন্ধত্ব । তাকে দূর করতে হলে আমাদের আত্মার ময়লা সাফ করতে হবে এবং পারমার্থিক দৃষ্টি উন্মোচিত করতে হবে । প্রবৃত্তির অগ্নি ও বাসনার ঝঞ্ঝাকে দমন করতে হবে । অনিশ্চিত ও অনির্ভরযোগ্য মনকে স্থির করতে হবে যাতে পরাজ্ঞান তাতে প্রতিফলিত হতে পারে । আমাদের ইন্দ্রিয়কে সংযত করতে হবে, বুদ্ধিজাত সন্দেহ দ্বারা অবিচলিত এমন দৃঢ় শ্রদ্ধার অধিকারী হতে হবে এবং বুদ্ধিকে উপযুক্ত রূপে প্রয়োগের শিক্ষা দিতে হবে ।

প্রজ্ঞা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে আসে । তাকে আরব্ধ করার প্রতিবন্ধক যখনই দূর হয় তখনই সে অভিজ্ঞতা আপনি ঘটে । সাধকের প্রয়াস হবে সেই সব প্রতিবন্ধক, অবিদ্যাজনিত অস্পষ্টতাকে দূর করা । অদ্বৈত বেদান্ত মতে এই প্রজ্ঞা সর্বদাই আছে, তাকে আহরণ করতে হয় না শুধু উন্মোচন করতে হয় । আমাদের ইচ্ছা ও কুসংস্কার সমর্থিত আকস্মিক মর্মভেদ দ্বারা সত্যকে উদ্‌ঘাটিত করা যায় না । মন ও সঙ্কল্পকে সম্পূর্ণ নিস্তব্ধ ও অহংকে বহিষ্কৃত করলে তবেই জ্ঞানালোকের সম্পাত হয়, যাতে আমরা সত্যকার অস্তিত্বে উপনীত হতে পারি । সেই হল অনন্ত জীবন, আমাদের জ্ঞান ও প্রেমশক্তির সম্পূর্ণ সিদ্ধি, বোয়েটিউসের (Boethius) ভাষায় "এক মুহূর্তে অসীম জীবনকে এক সঙ্গে ও সম্পূর্ণভাবে আয়ত্তে আনা ।"

জ্ঞান ও অজ্ঞান, আলোক ও অন্ধকারের মতই পরস্পরবিরোধী ।*a জ্ঞানের উদয় হলেই অজ্ঞতার বিনাশ আর অকল্যাণের মূলোৎপাটন । মুক্ত আত্মা জগৎকে বশ করে । জয় করার বা সৃজন করার কিছু থাকে না । কর্ম আর বাঁধতে পারে না । এই জ্ঞান লাভ করলে আমরা ব্রহ্মে লীন হই । এ সংবিৎ ভাবাত্মক নয় । এ তাই "যা দিয়ে তুমি সমস্ত সত্তাকে নিজের মধ্যে, পরে আমার মধ্যে দেখতে পাবে ।" খাঁটি মানুষ প্রিয়া রমণীকে যে অনুরাগ করে সেই রূপ অনুরাগের সঙ্গেই পরোৎকর্ষের আদর্শের অনুসরণ করে ।



10) জ্ঞানমার্গ

পরোৎকর্ষের লক্ষ্য মোক্ষদায়ী সত্যে পৌঁছবার তিন বিভিন্ন পথ আছে । সত্যকে জেনে (জ্ঞান) বা পরমপুরুষের উপর অনুরাগ ও প্রেম (ভক্তি) দ্বারা অথবা দিব্যোদ্দেশ্যে নিজের সংকল্পকে নিয়োজিত করে (কর্ম) । তাত্ত্বিক, ভাবাবেগযুক্ত ও ব্যবহারিক দিকের উপর প্রাধান্য এই তিনটির নিজ নিজ বৈশিষ্ট্য । মানুষ ভিন্ন ভিন্ন প্রকৃতির হয়, কেউ চিন্তাশীল, কেউ হৃদয়াবেগে বশীভূত, কেউ কর্মচঞ্চল, কিন্তু কোন মানুষের মধ্যে একটির প্রাধান্য থাকলে, অন্য দুটি একেবারেই থাকবে না, এমন নয় । অন্তিম জ্ঞান, ভক্তি ও কর্ম মিশে যায় । ঈশ্বর নিজে সৎ, চিৎ ও আনন্দ । জ্ঞানান্বেষীর কাছে তিনি শাশ্বত জ্যোতি, মধ্যদিনের সূর্যের মত নির্মল ও ভাস্বর, ছায়ালেশহীন, সদ্‌গুণাভিলাষীর কাছে তিনি সনাতন ন্যায়নিষ্ঠা, অবিচল ও অপক্ষপাত, ভাববিলাসীর কাছে তিনি অনন্ত প্রেম এবং পবিত্রসুন্দর । ঈশ্বরের মধ্যে যেমন এই বিভিন্ন গুণের সম্মেলন, তেমনি মানুষও নানামুখী আত্মিক জীবনে অখণ্ডতা চায় । জ্ঞান, সংকল্প ও অনুভূতিকে যুক্তি দ্বারা পৃথকভাবে ধারণা করা যায় কিন্তু বাস্তব জীবনে ও মনের ঐক্যে তাদের আলাদা করা যায় না । তারা আত্মার একই প্রেরণার বিভিন্ন দৃশ্য ।*a

পরোৎকর্ষলাভের বুদ্ধিচালিত পথরূপ যে জ্ঞান তার সঙ্গে আধ্যাত্মিক প্রজ্ঞাসংক্রান্ত জ্ঞানের পার্থক্য আছে । সত্যের আত্মিক মর্মগ্রহণ সেবাও নয়, ভক্তিও নয়, এমন কি জ্ঞানও নয়, যদিও অগুলি অগ্রসর হওয়াতে আমাদের সহায়তা করে । জ্ঞান কথাটা উৎকর্ষের লক্ষ্য ও তার পথ, সত্যের উপলব্ধি এবং আত্মার আধ্যাত্মিক প্রজ্ঞালাভের পরিকল্পনা, উভয় অর্থেই ব্যবহৃত হয় বলে কেউ কেউ মনে করেন অন্য পথের চেয়ে বুদ্ধির পথ উৎকৃষ্ট ।

শুদ্ধ ও লোকাতীত জ্ঞান এবং বৈজ্ঞানিক বিদ্যা পৃথক পদার্থ যদিও পরস্পরবিচ্ছিন্ন নয় । যে উচ্চতর অব্যয় সত্যের প্রত্যেক বাস্তব সত্তা অংশীদার তারই প্রতিফলন বিজ্ঞানের প্রত্যেক শাখায় তার নিজস্ব ভঙ্গীতে বিশেষ বস্তুশৃঙ্খলার মধ্যে প্রকাশিত হয় । বৈজ্ঞানিক বা বিশ্লেষণী জ্ঞান আমাদের গভীরতম জ্ঞানের জন্য প্রস্তুত করে । বিজ্ঞানের আংশিক সত্য পারমার্থিক সমগ্র সত্য থেকে পৃথক । বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের প্রয়োজন আছে, সে মনের পীড়াদায়ক অন্ধকার দূর করে, তার নিজস্ব জগতের অসম্পূর্ণতা ব্যক্ত করে এবং মনকে ইন্দ্রিয়াতীত জগতের অস্তিত্বের জন্য প্রস্তুত করে । সত্যকে জানতে হলে আত্মার পরিবর্তন প্রয়োজন, পারমার্থিক দৃষ্টিভঙ্গীর উন্মেষ দরকার । অর্জুন খালি চোখে সত্যের সন্ধান পাচ্ছিলেন না বলে, তাঁকে দিব্যদৃষ্টি দিতে হল ।

জিজ্ঞাসা বা নিঃস্বার্থ জ্ঞানানুসন্ধিৎসা দ্বারা উচ্চতর আত্মার খোঁজে নিজেকে উৎসর্গ করে, সত্তার প্রকৃষ্ট স্তরে ওঠা যায় । তার দ্বারা মানুষ তার সঙ্কীর্ণ গণ্ডী অতিক্রম করে অস্তিত্বের সার্বিক তত্ত্বগুলি অনুধাবন করতে করতে নিজের কথা ভুলে যায় । শক্তি বা যশোলোভে জ্ঞানচর্চায় বেশীদূর অগ্রসর হওয়া যায় না । সত্যের সন্ধানই তার আসল লক্ষ্য হওয়া উচিত ।

গীতায় যে পরাতাত্ত্বিক সূত্র স্বীকৃতি পেয়েছে তা সাংখ্যদর্শনই, যদিও কিছু মৌলিক পরিবর্তন করা হয়েছে । ঈশ্বরের ইপর গভীর শ্রদ্ধা এবং মোক্ষলাভের উপর বিশ্বাস রাখতে হলে তিনটি সত্তার অস্তিত্ব মেনে নিতে হয়, যে আত্মা মুক্তি চায়, যে নিগড়ে সে বদ্ধ আছে এবং যার উন্মোচন প্রয়োজন, ও ঈশ্বর, যিনি আমাদের বন্ধন উন্মোচন করতে পারেন । সাংখ্য দর্শোনে পুরুষ (আত্ম) ও প্রকৃতি (অনাত্ম) সম্বন্ধে বিশদ ব্যাখ্যা আছে, কিন্তু গীতাতে উভয়কেই ঈশ্বরের অধীন বলে দেখানো হয়েছে । আত্মা বহু এবং চিরকালই স্বতন্ত্র থাকবে । সচেতন জীবনের নানা বিকারের অন্তরালে যে শাশ্বত সত্তা তাই আত্ম । এ প্রচলিত অর্থে আত্মা নয়, এ হল শুদ্ধ নিষ্ক্রিয়, স্বতঃউদ্ভাসিত ভাব যা জগৎ থেকে উদ্ভূতও নয়, জগতের সাপেক্ষও নয়, জগৎ দ্বারা নির্ণিতও নয় । সে অদ্বিতীয় ও অখণ্ড । মানুষ আত্ম নয়, তার আত্ম আছে এবং যে আত্ম হতে পারে । প্রকৃতি বা অনাত্ম আর একটি চরম তত্ত্ব । তাকে ধারণা করা হয়েছে আদি বিভেদহীন জড়বস্তুরূপে, যার সমস্ত উপাদানের মধ্যে সাম্য আছে । অতএব সে অব্যক্ত বা অপ্রকট । প্রকৃতির অভিব্যক্তি থেকেই যাবতীয় মানসিক ও বাস্তব প্রপঞ্চের উৎপত্তি । রজ্জুর তিনটি তারের মত এর তিন গুণ আছে । এর নানা অনুপাতে মিশ্রণ থেকেই বাস্তব জগতের বৈচিত্র্যের উদ্ভব । জড়বস্তু সম্বন্ধে তার সত্ত্ব (লঘু), রজঃ (গতি) ও তমঃ (স্থূল) এই তিনরূপে ক্রিয়া । মানসিক জগতে সাধুতা, আবেগ ও নির্বুদ্ধিরূপে দেখা যায় । আত্ম বা পুরুষ যখন বুঝতে পারে যে প্রকৃতি থেকে সে সকল সংস্পর্শরহিত হয়েছে তখনই সে মোক্ষলাভ করে । গীতা এই ব্যাখ্যা গ্রহণ করেছে, কিন্তু একটি মৌলিক পরিবর্তন করে, তার মতে সাংখ্যের দ্বিত্ব, পুরুষ ও প্রকৃতি পরমতত্ত্ব ঈশ্বরেরই একান্ত স্বভাব ।

গুণের বশ্যতা থেকেই অশুভের উৎপত্তি, জীবনের বীজ বা ভাব জড়ে নিক্ষিপ্ত হয়ে গুণদ্বারা বদ্ধ হয়ে পড়ে । আত্মা উঠবে কি পড়বে নির্ভর করে, কোন্‌ গুণের প্রাধান্য আছে । সগুণ প্রকৃতি থেকে নিজেকে যখন পৃথক বলে ধরতে পারি তখনই আমাদের মুক্তি । যোগ বা তপশ্চর্যা দ্বারা পরাজ্ঞান (পরোক্ষজ্ঞান) পরম উপলব্ধি (অপরোক্ষ ব্রহ্ম সাক্ষাৎকার) -তে রূপান্তরিত হয় । অতি প্রাচীনকাল থেকেই কতগুলি বিশেষ আচরণ ও অভিজ্ঞতাকে যোগ বলা হয় । এইগুলি পরে জ্ঞান, ভক্তি ও কর্মের চর্চায় ব্যবহৃত বিভিন্ন ভাবের উপযোগী করে নেওয়া হয় । প্রত্যেকটির মধ্যেই ধ্যানযোগের ব্যবহার আছে । পাণিনির মতে যোগ মানে মানসিকক্রিয়া রুদ্ধ করা ("যোগশ্চিত্তবৃত্তিনিরোধঃ") । মৈত্রী উপনিষদে বলে, "অগ্নিকূণ্ডে যেমন দাহ্যের অভাবে অগ্নি নির্বাপিত হয়, তেমনি মানসিক ক্রিয়া রোধ করলে চিত্ত তার নিজ আসনে থেকেই বিলুপ্ত হয় ।" সংকল্পকে সুদৃঢ়ভাবে প্রয়োগ করেই আমরা নানা ভাবের কোলাহল ও বাসনার অসংবৃত আক্রমণকে দমন করতে পারি । অবিরাম কর্ম দ্বারাই যোগীরা তাদের বশে আনেন ।

মানুষ তার সত্তার অংশমাত্র, তার মানসতার উপরতলের খবরটুকুই রাখে । তার নীচের তলায় অনেক বস্তু আছে যার খবর সে না জানলেও, তার আচরণের উপর তাদের প্রভাব পড়ে । অনেক সময় আমরা অনৈতিক ও সহজ প্রবৃত্তিসঞ্জাত আবেগদ্বারা সম্পূর্ণভাবে অভিভূত হয়ে পড়ি, যখন সজ্ঞান যুক্তির বিধিগুলি আর খাটানো যায় না । উন্মাদেরা সম্পূর্ণ অভিভূত অবস্থায়ই থেকে যায়, কিন্তু আমাদের অনেকেই এইরূপ অবস্থায় পড়তে পারে, যদিও সাধারণ মানুষের পক্ষে সেই প্রভাব স্থায়ী নয় । অনুরাগ বা ঘৃণায় প্রবৃত্ত আবেগের বশে আমরা এমন কথা বলি বা এমন কাজ করে ফেলি, নিজেকে আয়ত্তে আনার পর যার জন্য অনুতাপ হয় । আমরা যে বলি "তিনি আত্মহারা হয়ে পড়লেন", "তিনি আত্মবিস্মৃত হলেন", "তার জ্ঞান ছিল না", তা থেকেই এই সত্যের আভাস পাওয়া যায়, যে মানুষ যখন তীব্র ভাবাবেগে অভিভূত হয়ে পড়ে, তখন তাকে ভূতে পায় ।*b প্রবল ভাবাবেগগ্রস্ত মন ক্রমশঃ অধিকমাত্রায় পরমতগ্রাহী হয়ে পড়ে ও যত রকম আজগুবী ধারণা মনে বাসা বাঁধে ।

সাধারণতঃ আমাদের অবচেতনা (subconsciousness) আমাদের চেতনার সঙ্গে সহযোগিতা করে, এবং অবচেতন মনের অস্তিত্ব সন্দেহ করার কারণ থাকে না, কিন্তু যখন আমরা আদিম সহজাত ধাঁচের পথ থেকে ভ্রষ্ট হই, তখন আমরা অবচেতনের পূর্ণ শক্তি উপলব্ধি করি । আত্মসচেতনতা (self-consciousness) পূর্ণ না হলে কোন মানুষ তার জীবনকে আয়ত্তে আনতে পারে না । তা ছাড়া, দেহ জীবন ও মনেরও সংহতি প্রয়োজন । আত্মসচেতন সত্তা হিসাবে মানুষ তার আভ্যন্তরীণ বিসঙ্গতি সম্বন্ধে সজাগ । সে সাধারণতঃ গোঁজামিল দেওয়ার চেষ্টা করে এবং অনিশ্চিত জীবনযাপন করে । কিন্তু যতক্ষণ না সম্পূর্ণ সামঞ্জস্য হয়, তার বহুমুখী সম্ভাবনায় যতক্ষণ না আঙ্গিক সাম্য সাধিত হয়, ততক্ষণ তার আত্মজয় সম্পূর্ণ নয় । অর্জুনের মত প্রলোভনের পাত্র হলে, অখণ্ডতা লাভের পদ্ধতি সম্পূর্ণ হয় না । উন্মেষশালী অস্মিতার জন্য অবিরাম সতর্কতা ও পোষণ প্রয়োজন । সাধু সংকল্প প্রবল হলে, পার্থিব বস্তুর উপর অন্ধ অনুরাগ নষ্ট হয়, তাতে মন শান্ত হয়, তা থেকে আবার যে আন্তরিক স্তব্ধতার উৎপত্তি হয়, তার মধ্যে আত্মা যে নিত্য বস্তু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে তার সঙ্গে সংস্পর্শ স্থাপন করতে শুরু করে । এবং অন্তর্যামী ভগবানের অস্তিত্ব উপলব্ধি করে । পার্থিব সংঘর্ষ থেকে আত্মার বিশ্রাম নিস্তব্ধতার মধ্যে, তাতেই অন্তর্দৃষ্টি জন্মায়, মানুষ নিজেকে ফিরে পায় ।

আমাদের চেতনা দেহের সঙ্গে মিলিত হয়ে বহির্মুখী হয় কেননা ইন্দ্রিয় দ্বারা বহির্জগৎ নিয়ন্ত্রণের কাজে তাকে সিদ্ধ হতে হবে । তার বাহ্য ক্রিয়ায় ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুসমূহকে বোঝবার জন্য কতকগুলি ধারণার আশ্রয় নিতে হয় । যে সব কার্য সাক্ষাৎ ভাবে বোধগম্য এই অর্থে যে বোধায়াত্ত বস্তুগুলির বোধের জন্য অন্য কোন মাধ্যমের প্রয়োজন হয় না, তারই দ্বারা মানুষ অন্তর্মুখী হয়ে সাধারণতঃ অনুমানের সাহায্যে আত্মবোধে সক্ষম হয় । এসব থেকে অবশ্য আত্ম আসলে কি তা বোঝা যায় না । তার ব্যাপারটা বুঝি কিন্তু তাকে জানতে পারি না । আত্মের আবস্থানিক অভিজ্ঞতা লাভ করতে হলে যে সমস্ত ভিতরের ও বাহিরের বহু বিচিত্র বস্তু আত্মের সারাংশের প্রত্যক্ষ দৃষ্টিলাভে বাধা দিয়ে বিরোধিতা করছে সেগুলি থেকে মুক্ত হতে হবে । সাধারণতঃ বাহিরের ও ভিতরের প্রপঞ্চের আধেয় দিয়ে মঞ্চ অধিকৃত থাকে, আত্মের আসল স্বরূপ নজরে আসে না । চিন্তা বা অন্তর্মুখীতা দ্বারা মানসিক ভাবে যতই আমরা নিজেদের অস্পষ্ট করে তুলি, ততই আমরা আত্মের প্রাপঞ্চিক প্রকাশের সঙ্গে সংস্পর্শে আসি । অন্তর্যামী পরমাত্মার সাক্ষাৎ পেতে হলে আমাদের ভিন্ন প্রকারের বিনয় অভ্যাস করতে হবে । প্রপঞ্চ পরম্পরাকে সরিয়ে দিয়ে, আমাদের স্বভাবের অভ্যস্ত গতির প্রতিকূলে গিয়ে, নিজেদের নগ্ন করে প্রতীয়মান অহং থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে বিশুদ্ধ আত্মমুখিতার অতলে গিয়ে পরমাত্মাকে পেতে হবে ।

ভগবদ্গীতা বর্ণনা করছে কিভাবে সাধক সর্বপ্রকার দৈহিক প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তির আতিশয্য বর্জন করেন । কিভাবে বহির্জগতের বিক্ষেপ বর্জিত স্থানে সুখাসনে স্থাপন করেন, শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রিত করেন, মনকে একাগ্র করেন ও এইভাবে সুসমঞ্জস (যুক্ত) ও ফলাসক্তি বিহীন হন । এই প্রকার আন্তরিক ঐক্য সাধিত হলে, তিনি স্বতঃই সকল প্রাণীকে সহমর্মিতা ও প্রীতির দ্বারা সম্পূর্ণভাবে বুঝতে পারেন, সেটা তখন আর কর্তব্যের বোঝা হয় না । পৃথিবীর মহত্তম জ্ঞানী গৌতম বুদ্ধ মানবপ্রীতিবশে চল্লিশ বৎসর ধরে মানবের সেবা করেছিলেন । সত্যকে জানা মানেই আমাদের অন্তরকে সর্বেশ্বরের দিকে তুলে ধরা ও তাঁর উপাসনা করা । প্রাজ্ঞও একজন ভক্ত ও সর্বোত্তম ভক্ত ।

রীতিমত যোগাভ্যাস দ্বারা অতিপ্রাকৃত ক্ষমতার অধিকারী হওয়া যায় কিন্তু মাত্র ঐ প্রকার ক্ষমতালাভের জন্য যোগাভ্যাস বৃথা ও নিরর্থক । অনেক সময় তার ফল হয় ব্যররথতা ও উদ্বায়ু রোগ । আধ্যাত্মিক জীবনাভিলাষীকে অতিপ্রাকৃত ক্ষমতার আকর্ষণের বিরুদ্ধে সাবধান করে দেওয়া হয় । তাদের দ্বারা হয়ত ঐহিক উন্নতি হয় কিন্তু সাধুত্ব লাভের দিকে অগ্রসর হওয়া যায় না । ভাবতত্ত্বে তারা অপ্রাসঙ্গিক ও অর্থহীন । প্রেত নিয়ে যাঁরা চর্চা করেন, অতিভৌত জগতের কিছু নজরে আসে বলে তাঁদের কতকগুলি অগোচর ক্ষমতার উন্মেষ হয়, যেমন আদিম কৃষিজীবিদের থেকে যারা বর্তমান প্রয়োগকৌশল জানে তারা ক্ষমতায় বেশী সমৃদ্ধ । কিন্তু এ অগ্রগতি বহির্মুখী, আত্মার অন্তরায়নের দিকে নয় । একমাত্র বাস্তব সত্তার সংস্পর্শে আসার জন্য, সত্যকে জানার জন্য যোগাভ্যাস করতে হয় । কৃষ্ণকে যোগেশ্বর বলা হয়, তিনি আমাদের পরিত্রাণ পেতে সাহায্য করেন । তিনি আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতায় পরম গুরু, যখন মানুষ দেহের যবনিকা অতিক্রম করে, তখন তিনিই স্বর্গীয় মহিমময় মুহূর্তগুলি অর্পণ করেন এবং আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে তাদের সত্যকার সম্বন্ধ নির্দেশ করেন ।
 


11) ভক্তিমার্গ

এক সগুণ ভগবানের সঙ্গে প্রেম ও বিশ্বাসের সম্পর্কই ভক্তি । সাধারণ মানুষের পক্ষে বিমূর্ত বস্তুর উপাসনা (অব্যক্তোপাসনা) কঠিন, যদিও কোনও কোনও মহান্‌ অদ্বৈতবাদী নির্গুণ সত্তাকে ভাবাবেগ দ্বারা ভূষিত করতে পেরেছিলেন ।*a সগুণ ভগবানের অর্চনা, কি দুর্বল, কি অনুন্নত, কি নিরক্ষর, কি মূর্খ, সকলের পক্ষেই সহজ পন্থা বলে বিধান দেওয়া হয় ।*b [গী|৯|৩২] নিজের সংকল্পকে সম্পূর্ণরূপে দিব্য লক্ষ্যের অনুগামী করা বা কঠোর কৃচ্ছ্রসাধন বা চিন্তার গভীর প্রয়াস যত কঠিন প্রেমার্পণ তত কঠিন নয় ।

ভক্তিমার্গের উৎপত্তি সুদুর অতীতের কুজ্‌ঝটিকায় আচ্ছন্ন । ঋগ্‌বেদের প্রশংসা ও প্রার্থনা, উপনিষদের উপাসনা, ভাগবত ধর্মের ঐকান্তিক ধর্মপরায়ণতার প্রভাব গীতা রচয়িতার উপর পড়েছে । উপনিষদে যে দিকগুলি অবাধে ও দ্বিধাহীনভাবে ব্যক্ত হয় নি, উপনিষদের সেই ধর্মীয় ধারণাগুলির মধ্যে একটা শৃঙ্খলা আনার জন্য তিনি অত্যন্ত প্রয়াস করেছেন । প্রপীড়িত আত্মা যখন অবলম্বনের জন্য অসহায় ক্রন্দন করে, তখন পরমেশ্বর প্রশান্ত ঔদাসীন্যে নিদ্রাচ্ছন্ন থাকেন না, তিনি পরিত্রাতা, প্রেমের ভগবান, ভক্তদের বিশ্বাস ও অভিজ্ঞতার মধ্যে তাঁর উপলব্ধি হয় । যারা তাঁর ভক্ত তাদের তিনি মোক্ষ দেন, তিনি ঘোষণা করছেন, "আমি পণ করছি, যে আমাতে রত, সে বিনষ্ট হবে না ।"[গী|৯|৩]

ভক্তি শব্দটি ভজ ধাতু (অর্থাৎ সেবা) থেকে নিষ্পন্ন । এখানে সেবা মানে ঈশ্বরের সেবা । ঈশ্বরের প্রতি অনুরাগপূর্ণ আসক্তি । নারদ এর সংজ্ঞার্থ দিয়েছেন ঈশ্বরের প্রতি তীব্র প্রেম । শাণ্ডিল্যের ভাষায়, ঈশ্বরের জন্য প্রবল বাসনা; অহেতুক*c ঈশ্বরের প্রসাদলাভের জন্য সনির্ভর আত্মসমর্পণ । যোগসূত্রে একে "ঈশ্বর প্রণিধান" বলা হয়েছে । ভোজের মতে "এ প্রেমে ইন্দ্রিয়সুখাদি ফলের বাসনা থাকে না, সমস্ত কর্ম গুরুর গুরুকে সমর্পণ করা হয় ।" ভক্তি এক গভীর অভিজ্ঞতা, যা সমস্ত কামনাকে প্রত্যাখ্যান করে ও অন্তরকে ঈশ্বরানুরাগে পরিপূর্ণ করে ।*d ভক্তিমার্গ যাঁরা অবলম্বন করেন তাঁরা অতিপার্থিব মোক্ষে ততটা আগ্রহী নন, যতটা ঈশ্বরের শাশ্বত ইচ্ছার কাছে চরম সমর্পণে । ভগবানের শক্তি, জ্ঞান ও শুভেচ্ছার ধ্যান দ্বারা, ভক্তিপূর্ণ অন্তরে সর্বদা স্মরণ দ্বারা, অপরের সঙ্গে তাঁর গুণকীর্তন দ্বারা, সহচরদের সঙ্গে তাঁর প্রশংসা সঙ্গীতে প্রকাশ দ্বারা, সমস্ত কর্ম তাঁর সেবায় নিয়োগ দ্বারা মানবাত্মা দিব্যাত্মার সান্নিধ্যলাভ করতে পারে ।*e ভক্ত তার সমস্ত অস্তিত্ব ঈশ্বরোদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট করেন । সভক্তি উপাসনা ধর্মের সারবস্তু । উপাসক ও উপাসিতের দ্বিত্ব এর অঙ্গ । কোন ব্যাপিতামার্গী দর্শনের যদি এমন ব্যাখ্যা করা যায় যাতে মানুষ যে সৃষ্ট জীব সে বোধ বা ঈশ্বর যে সর্বাতীত এ ধারণা নষ্ট হয়ে যায় তা হলে তাতে ভক্তি ও অর্চনার কোন স্থান থাকে না । ভক্তিমার্গীয় ধর্মমাত্রের তত্ত্বীয় ভিত্তি সৃষ্ট ও স্রষ্টার পার্থক্যের মধ্যে । ভগবদ্‌গীতায় শাশ্বত পুরুষকে দার্শনিক তর্কের বিষয় রূপে ঈশ্বরকে ততটা দেখানো হয় নি যতটা প্রসন্ন ভগবান রূপে কল্পনা করা হয়েছে, অন্তরাত্মা যাঁকে চায় ও যাঁর প্রয়োজন অনুভব করে, যিনি ব্যক্তিগত বিশ্বাস, প্রেম, শ্রদ্ধার পাত্র ও যাঁর কাছে সানুগত্য আত্মসমর্পণ করা চলে । "জ্ঞানোদয়ের আগে দ্বৈতবোধ ভ্রান্তির কারণ কিন্তু প্রবুদ্ধ হলে আমরা দেখতে পাই, দ্বৈত এমন কি অদ্বৈতের অপেক্ষাও সুন্দর এবং পূজার্চনার জন্য কল্পিত ।" আবার "অদ্বৈত সত্য; কিন্তু উপাসনার জন্য দ্বৈত, এই উপাসনা মোক্ষের অপেক্ষা শতগুণে শ্রেয় ।"

গীতার ভক্তি ধ্যান ও চিন্তাসঞ্জাত মস্তিষ্কপ্রধান ভালবাসা নয় । এ জ্ঞানাশ্রয়ী, কিন্তু জ্ঞান নয় । এর জন্য যৌগিক প্রক্রিয়াও প্রয়োজন নেই, দিব্য সম্বন্ধে দূরকল্পী জ্ঞানের অভিলাষও দরকার নেই । শাণদিল্যের যুক্তি যে গোপীদের মত এর দ্বারা পারমার্থিক শান্তি পাওয়া যায়, জ্ঞান ব্যতিরেকেই । ভক্তের চরম দৈন্যবোধ থাকে । ভক্তির পাত্রের কাছে সে বোধ করে যে সে কিছুই নয় । ঈশ্বর দৈন্য বা একান্ত আত্মসমর্পণ পছন্দ করেন ।

যেসব গুণের সঙ্গে ভক্তির সম্পর্ক ঘনিষ্ট যেমন, প্রেম ও অনুরাগ, করুণা ও স্নেহ, সেগুলি পুরুষদের অপেক্ষা নারীদের মধ্যে সাধারণতঃ বেশী থাকে । ভক্তিতত্ত্বে দীনতা, বাধ্যতা, সেবাপরায়ণতা, করুণা ও শান্ত অনুরাগের প্রাধান্য, কেননা ভক্ত নিজেকে সমর্পণ করতে চায়, নিজস্ব ইচ্ছা বিসর্জন দিয়ে ভোগবৃত্তি উপলব্ধি করতে চায়, এই জন্য ভক্তিকে স্ত্রীধর্মী বলা হয় । নারীরা প্রত্যাশা রাখে, কষ্ট সহ্য করে, আশা করে ও গ্রহণ করে । তার কৃপা, করুণা, ও শান্তির অভিলাষী । সকলের মধ্যেই নারীত্ব ভাব আছে । ভাগবতে আছে যে মেয়েরা কাত্যায়নী দেবীর কাছে কৃষ্ণকে পতিরূপে পাওয়ার জন্য প্রার্থনা করেছিল । নারীত্বের পরাকাষ্ঠায় নারী সর্বস্ব দিতে পারে, ফিরে কিছুই চায় না । শুধু ভালবাসা পেতে ও দিতে চায় । রাধা সেই প্রেমময়ীর নিদর্শন । ঈশ্বর সম্পর্কে ভক্তেরা নারীর ন্যায় । "পরমেশ্বরই এক মাত্র পুরুষ, ব্রহ্মাদি আর সকলে নারীর ন্যায় (যারা তাঁর মিলনাভিলাষী) ।"

আত্মা যখন ঈশ্বরের কাছে নিজেকে সমর্পণ করে, তখন তিনি আমাদের সমস্ত জ্ঞান ও ভ্রান্তি গ্রহণ করেন, আমাদের সকল প্রকার অভাব দূর করে তাঁর অনন্ত জ্যোতি ও সর্বাঙ্গীণ কল্যাণের পবিত্রতায় সকলকে রূপান্তরিত করেন । "ভক্তি শুধু একের কাছে আর একের পলায়ন" নয় । ভক্তি হল ভগবানের উপর সক্রিয় প্রেম, যে ভগবান এক্ষেত্রে জগৎকে ত্রাণ করার জন্য জগতে প্রবিষ্ট হয়েছেন ।
ঈশ্বরের প্রসন্নতা আমরা নিজেদের চেষ্টায় অর্জন করতে পারিনা এই রকম ধারণা থেকেই তীব্র ভাবাবেগবিশিষ্ট ধর্মাচরণের উৎপত্তি । ভক্তির জন্য শ্রদ্ধা ও প্রেম মাত্র প্রয়োজন কিন্তু প্রপত্তিতে আমরা শুধু নিজেকে ঈশ্বরের কাছে নিবেদন করি, তিনি তাঁর ইচ্ছামত আমাদের নিয়ে যা খুশী করবেন বলে । এতে প্রত্যয়ের প্রত্যক্ষ ও দীন ভঙ্গী দ্বারা সমর্পণ সম্বন্ধে সরল ও নিরলঙ্কার বিশুদ্ধতাই বিশেষভাবে প্রকাশ পায় । ভক্তিযোগের তীব্রতা থেকে সমর্পণের সম্পূর্ণতাই আসল ধার্মিকতার মূল, প্রপত্তিতে এই ধারণা জন্মায় । নিজেকে সম্পূর্ণরূপে আত্মবোধশূন্য করলেই ঈশ্বর আমাদের অধিকার করবেন । এই প্রকার ঈশ্বরাধিকারের বাধা হল, আমাদের নিজ সদ্‌গুণ, অহঙ্কার, বিদ্যা, আমাদের সূক্ষ দাবীসকল ও আমাদের অজ্ঞানজাত অনুমান ও কুসংস্কার । আমাদের সমস্ত বাসনা বর্জন করে পরম সত্তার উপর বিশ্বাস রেখে অপেক্ষা করতে হবে । ঈশ্বরের উদ্দেশ্যের সম্পূর্ণ অনুগামী হতে হলে আমাদের সমস্ত দাবীদাওয়া বিসর্জন দিতে হবে । ভক্তি ও প্রপত্তির তফাৎ বোঝাবার জন্য পশুদের আচরণের দৃষ্টান্ত দেওয়া হয় । একটি বানরোপম (মর্কট কিশোর ন্যায়) অপরটি বিড়ালোপম (মার্জার কিশোর ন্যায়) । বানরশিশু মাকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরে নিজেকে বাঁচায় । শিশুর অতি সামান্য প্রয়াসই প্রয়োজন হয় । বিড়ালশিশুকে মা মুখে করে ধরে নিয়ে যায়, বিড়ালশিশু সম্পূর্ণ নিশ্চেষ্ট থাকে, নিজের নিরাপত্তার জন্য কোন চেষ্টাই করে না । ভক্তিতে ঈশ্বরের প্রসাদের জন্য সামান্য প্রয়াস করতে হয়, প্রপত্তিতে তা উদারভাবে বর্ষিত হয় । শেষোক্তের মধ্যে আমাদের নিজেদের যোগ্যতা বা সেবার পরিমাণের কোন প্রশ্নই নেই ।*f এই মতের সমর্থন প্রাচীন শাস্ত্রেও পাওয়া যায়, "এই আত্ম যখন নিজে চায় তখনই তাঁর কাছে পৌঁছনো যায়, তার কাছেই পরমাত্মা তাঁর স্বরূপ প্রকাশ করেন ।"[কঠোপনিষদ | দ্বিতীয় |২৩] অর্জুনকে বলা হয়েছে যে ঈশ্বরপ্রসাদে তার কাছে দিব্যমূর্তি প্রকট হয়েছে ।[গী|১১|৪৭] আবার বলা হয়েছে "আমা হতেই স্মৃতিশক্তি ও বিদ্যার উৎপত্তি এবং আমাতেই তার বিলয় ।"[গী|১৫|১] এমন কি শঙ্করও স্বীকার করেছেন ব্রহ্মই মোক্ষদায়িনী জ্ঞান দিতে পারেন । প্রপত্তি ও ভক্তির পার্থক্য খ্রীষ্টীয় চিন্তাধারা এক সমস্যার সঙ্গে সম্পর্কিত, সেই অগস্টাইন ও পেলাজিউসের আমল থেকেই এই তর্ক চলে আসছে যে পতিত জীব হিসাবে মানুষ ভগবানের প্রসাদেই মুক্তি পেতে পারে অথবা সে নিজেকে প্রস্তুত করে নিজের প্রয়াসেই পরিত্রাণ অর্জন করতে পারে ।

পেলাজিউস ইচ্ছাস্বাতন্ত্র্যে বিশ্বাসী ছিলেন ও তার আদি পাপের তত্ত্বে সন্দেহ ছিল । তিনি বলতেন যে মানুষ তার নিজস্ব নৈতিক প্রয়াসে কর্ম করে যায় । অগস্টাইন পেলাজিউসের মতের বিরোধিতা করেন, তাঁর মতে পতনের পূর্বে আদমের ইচ্ছাস্বাতন্ত্র্য থাকলেও, তিনি ও ইভ আপেল খাওয়ার পর তাদের মধ্যে দোষ ঢুকল, এবং তাদের বংশধরদের মধ্যে তা সংক্রামিত হল । নিজ চেষ্টায় আমাদের পাপাচরণ থেকে বিরত থাকার উপায়ই নেই । মাত্র ঈশ্বরানুগ্রহেই আমরা সদ্‌গুণের অধিকারী হতে পারি । আমরা সকলেই যখন আদমের পাপের ভাগী, তখন আমরা সকলেই তাঁর প্রতি অভিশাপের অংশীদার । তবু ঈশ্বর উদার প্রসাদে আমাদের কেউ কেউ স্বর্গের জন্য নির্বাচিত হই, আমরা তার যোগ্য বলে নয় বা আমরা সৎ বলে নয়, শুধু ঈশ্বরপ্রসাদ আমাদের উপর বর্ষিত হয়েছে বলে । কী পরিত্রাণ পেল আর কেউ অভিশপ্ত রয়ে গেল, ঈশ্বরের উদ্দেশ্যবিহীন নির্বাচন ছাড়া এর আর কোন কারণ দেখানো যায় না । আমরা সকলেই দুষ্ট, কাজেই এ অভিশাপ ঈশ্বরের সুবিচারেরই নিদর্শন । সর্বজনীন অপরাধের তত্ত্ব, রোমকদের প্রতি পত্রাবলীতে সেণ্ট পল, সেণ্ট অগস্টাইন এবং ক্যালভিন গ্রহণ করেছেন । এ সত্ত্বেও আমরা যে কেউ কেউ পরিত্রাণ পাই, তাতে শুধু ঈশ্বরের করুণা সূচিত হয় । পাপ ও মুক্তি দুই থেকেই ঈশ্বরের সৎপ্রকৃতি, করুণা ও সুবিচার বোঝা যায় । গীতা পেলাজিউসের অনুরূপ মতের পক্ষপাতী ।

ব্রহ্মের কাছে সম্পূর্ণ সমর্পণের মধ্যে মানুষের প্রয়াসের প্রয়োজন আছে । বিনা চেষ্টায় বা বিনা সংকল্পে তা হওয়ার উপায় নেই । ঈশ্বরের প্রসন্নতাকে একটা বিশেষ নির্ধারণ রূপে ব্যাখ্যা করা চলবে না, কেননা গীতার সাধারণ মতবাদ যে পরমেশ্বরের "চোখে সকলেই সমান" এই ধারণার বিরোধী ।

ভক্তির ভিত্তি শ্রদ্ধা । যে সব দেবতার উপর লোকের শ্রদ্ধা আছে, তাকেই তারা মানে । একেবারে কোন অনুরাগ না থাকার চেয়ে কিছু অনুরাগ থাকা ভাল, কেননা অনুরাগ বিনা আমরা সম্পূর্ণ নিজেদের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে থাকি । তা ছাড়া, অপর দেবতাদেরও এক ব্রহ্মের বিভিন্ন আকার বলে ধরা হয় । এ কথা জোর করেই বলা হয় যে অন্য দেবতাদের ভক্তরা তাদের অভীষ্ট লক্ষ্যেও পৌঁছায়, কিন্তু ব্রহ্মভক্তরাই অনন্ত আনন্দের স্বাদ পায় । নিষ্ঠার সঙ্গে উপাসনা করলে অন্তর পবিত্র হয় ও উচ্চতর সংজ্ঞানের জন্য প্রস্তুত হয় । প্রত্যেকেই ভগবানকে আপনার বাসনার আলোকে আকৃতি দেয় । মুমূর্ষুর কাছে তিনি শাশ্বত জীবন, অন্ধকারে যারা হাতড়াচ্ছে তাদের কাছে তিনি আলোক । আমরা যতই কেন না উঁচুতে উঠি, দিক্‌চক্রবাল যেমন আমাদের চোখের সমতলেই থেকে যায় তেমনি ঈশ্বরের প্রকৃতিও আমাদের চেতনার স্তরের ওপরে উঠতে পারে না । নিম্নস্তরে আমরা আয়ু ও ধন কামনা করি, ভগবানকেও আমরা ঐহিক অভাব নিরসনের যন্ত্র বলে মনে করি । পরে আমরা মনন দ্বারা ঈশ্বরের সদুদ্দেশ্যের সঙ্গে নিজেদের উদ্দেশ্যকে সংযুক্ত করতে পারি । উৎকৃষ্ট স্তরে ঈশ্বরই চরম তৃপ্তি, সেই অপর যা দিয়ে মানবাত্মা সম্পূর্ণ ও পরিপূর্ণ হয় । মধুসূদন ভক্তির সংজ্ঞার নির্দেশ করেছেন যে মানসিক অবস্থাতে প্রেমের দিব্যোন্মাদ দ্বারা চালিত মন ঈশ্বরের স্বরূপ হয় । ঈশ্বরভক্তি যখন ভাবোন্মত্ততায় পরিণত হয় তখন ভক্ত নিজেকে ভুলে ঈশ্বরে বিলীন হয় । প্রহ্লাদের মধ্যে ঈশ্বরের দিকে সম্পূর্ণ একাগ্রতায় আধ্যাত্মিক অবস্থা দেখতে পাই । তিনি পরমপুরুষের সঙ্গে নিজের অভিন্নতা ব্যক্ত করে দেন । এই আত্মবিস্মৃত দিব্যোন্মাদময় অভিজ্ঞতাকে অদ্বৈত অধিবিদ্যায় সমর্থন বলে ধরা যায় না । অপরোক্ষানুভবে অর্থাৎ যে চরম অবস্থায় প্রাতিস্বিক পরমে বিলীন হয়, যেখানে প্রাতিস্বিকের স্বতন্ত্র্য অস্তিত্ব অবশিষ্ট থাকে না ।

ভক্তি থেকে জ্ঞানের উদয় হয় । রামানুজের কাছে, ভক্তি স্মৃতিসন্তান । এমন কি প্রপত্তিও এক প্রকার জ্ঞান । ভক্তি যখন উদ্ভাসিত হয়, তখন অন্তর্যামী প্রভু নিজ প্রসাদে ভক্তকে জ্ঞানালোক অর্পণ করেন । ভক্ত পরমেশ্বরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিলিত হবার অভিজ্ঞতা অনুভব করে, সে অনুভূতিতে পরমেশ্বরের মধ্যে সকল বিরোধের অবসান এই বোধ হয় । সে নিজেকে ভগবানের মধ্যে এবং ভগবানকে নিজের মধ্যে দেখে । প্রহ্লাদ বলেছেন, মানুষের চরম লক্ষ্য ভগবানে পরমা ভক্তি এবং সর্বত্র তাঁর উপস্থিতি অনুভব করা । "প্রেমিকার পক্ষে, প্রেমোন্মত্ত অবস্থায় সে প্রিয়ের হৃদয়লগ্ন  হয়ে বিহার করছে বা তার পদসেবা করছে এ দুই-ই সমান । সেইরূপ জ্ঞানীর কাছে নির্বিকল্প সমাধিগ্রস্ত অবস্থায় থাকুক বা উপাসনা দ্বারা ঈশ্বরের সেবারত থাকুক দুই-ই এক বস্তু ।" ভক্তের পক্ষে ঈশ্বরের কাছে সমর্পণের মধ্যে প্রকৃষ্ট মুক্তি । জগতে ঈশ্বরের কাজে নিযুক্ত (হওয়া) সকল ভক্তের কর্তব্য । "যারা সমস্ত কর্তব্য বিসর্জন দিয়ে শুধু ভগবানের নাম কৃষ্ণ, কৃষ্ণ, জপ করে তারা ঈশ্বরের শত্রু এবং পাপী কেননা ঈশ্বর নিজে সাধুদের পরিত্রাণের জন্য জন্মগ্রহণ করেছেন ।"*g [বিষ্ণুপুরাণ] ভক্ত যখন সম্পূর্ণরূপে নিজেকে উৎসর্গ করে, তখন ভগবানই মনের তীব্রতম আবেগের পাত্র হন এবং ভক্ত যা করে ভগবানের মহিমার জন্যই করে । ভগবদ্‌গীতায় ভক্তি সর্বাতীতের কাছে একান্ত আত্মোৎসর্গ । ঈশ্বরে বিশ্বাস, অনুরাগ, আনুগত্য ও তাতে বিলীন হওয়াই ভক্তি । ভক্তি নিজেই নিজের পুরস্কার । এই রকম ভক্ত নিজের মধ্যে সর্বোত্তম জ্ঞানের আধেয় ও পরিপূর্ণ মানবতার শক্তি লাভ করেন ।


12) কর্মমার্গ

কোন রচনা কি উদ্দেশ্যে লেখা হয়েছে, তা বুঝতে হলে তার শুরুতে কি প্রশ্ন তোলা হয়েছে (উপক্রম) আর কি মীমাংসায় শেষে উপনীত হয়েছে (উপসংহার) এই দুইটি দেখতে হবে । গীতার আরম্ভেই এক সমস্যা দেখতে পাই । অর্জুন যুদ্ধ করতে চাইছেন না ও নানা অসুবিধার কথা বলছেন । তিনি কর্মনিবৃত্তি এবং সংসার পরিত্যাগ করার সপক্ষে এক রকম যুক্তি দেখাচ্ছেন । গীতা যখন রচিত হয় সেই যুগে এই সংসার পরিত্যাগ অনেক সম্প্রদায়ের আদর্শ ছিল । গীতার উদ্দেশ্য অর্জুনের এই বৈরাগ্যের নিরসন করা । কাজেই গীতার কর্ম বা কর্মবর্জন কোনটা ভাল এই প্রশ্ন তোলা হয়েছে এবং উপসংহার করা হয়েছে এই বলে যে কর্মই শ্রেয়তর । অর্জুন সমস্ত শুনে বললেন যে তাঁর মোহ দূর হয়েছে এবং তিনি যুদ্ধ করার আদেশ পালন করতে প্রস্তুত । গীতায় আগাগোড়াই কর্মপ্রবৃত্তিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে । গীতার উপদেষ্টা সমস্যার যে সমাধানে জগৎকে মায়া বলে উড়িয়ে দেওয়া চলে বা কর্মকে ফাঁদ বলে ধরা হয়, সে সমাধান গ্রহণ করেন নি । তাঁর উপদেশ এই যে মানুষ সংসারে সম্পূর্ণ সক্রিয় জীবন কাটাক, কিন্তু অন্তর্জীবন শাশ্বত পুরুষে লগ্ন থাক । অতএব গীতা কর্মপ্রবৃত্তির নির্দেশ । মানুষের সামাজিক জীবনে কি করা কর্তব্য তাই যে শুধু এতে ব্যাখ্যা করা হয়েছে তাই নয়, পারমার্থিক নিয়তিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব হিসাবেও মানুষকে চিত্রিত করা হয়েছে । সংসার-ত্যাগের প্রবৃত্তি ও আনুষ্ঠানিক ধর্মাচরণের কথা গীতায় উভয়েই ন্যায্য আলোচনা করা হয়েছে, এবং তার নীতি সূত্রের মধ্যে গ্রথিত করা হয়েছে । সাংখ্যে (গীতায় জ্ঞানের যা অপর নাম) আমাদের কর্ম থেকে নিবৃত্ত হবার উপদেশ দিয়েছে । এক সুপ্রচলিত মতবাদ আছে, যাতে বলে যে জীবের কর্মই নিগড় আর জ্ঞান দ্বারা তার মোচন হয় । ভালই হোক বা মন্দই হোক, প্রত্যেক কর্মের ফল আছে, এবং সেই ফল ভোগের জন্য পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করতে হয়, অতএব মোক্ষলাভের পথে বাধার সৃষ্টি হয় । প্রত্যেক কর্মেই কর্তার অহংজ্ঞান ও স্বাতন্ত্র্যবোধ সমর্থন লাভ করে, এবং কর্মফলের এক নূতন পর্যায়ের উদ্ভব হয় । অতএব যুক্তি হল যে সকল কর্ম পরিত্যাগ করে সন্ন্যাসী হও । শঙ্কর জ্ঞানকেই মোক্ষলাভের উপায় বলে মনে করতেন, তাই তাঁর মতে অর্জুন মধ্যমাধিকারী কাজেই তাঁর পক্ষে নিবৃত্তিমার্গ বিপজ্জনক, অতএব তাঁকে কর্মে প্রবৃত্ত করা হল । কিন্তু গীতায় ভাগবত ধর্মের তত্ত্ব স্বীকৃত হয়েছে । এর দ্বারা আমরা কর্মে প্রবৃত্ত থেকেও সম্পূর্ণ মোক্ষলাভ করতে পারি । ব্যাস শুককে দুবার বলেছেন যে ব্রাহ্মণদের প্রাচীনতম প্রথা ছিল জ্ঞানদ্বারা মোক্ষলাভ করা ও সংসারে কর্মে প্রবৃত্ত থাকা । ঈশ উপনিষদেও অনুরূপ মত সমর্থিত । হিন্দু চিন্তাধারায় শুধু অলভ্যের উপরই অতিমাত্রায় ঝোঁক দেওয়া হয়েছে এবং জগতের সমস্যা সম্বন্ধে ঔদাসীন্য রূপ অপরাধে সে অপরাধী এরকম ভাবা ভুল । যখন নগ্ন ও ক্ষুধার্থ দরিদ্রেরা আমাদের দোরের সামনে মরছে তখন আমরা নিশ্চিন্ত অন্তরে ধর্মাচরণ কররে পারি না । গীতা আমাদের পৃথিবীর জীবনে অংশগ্রহণ করে তাকে বাঁচাতে উপদেশ দেয় ।

কর্মকাণ্ডে যে সূক্ষ জটিলতা আছে গীতার উপদেষ্টা তার আলোচনা করেছেন, "গহনা কর্মণো গতিঃ" কর্ম থেকে নিবৃত্ত থাকা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয় । প্রকৃতি সর্বদা ক্রিয়ামগ্ন এবং আমরা যদি ভাবি তাকে স্তব্ধ করা যায় তাহলে সে মোহ ছাড়া আর কিছু নয় । তাছাড়া কর্মত্যাগ বাঞ্ছনীয়ও নয় । জাড্য স্বাধীনতা নয় । আবার কর্মের বন্ধনধর্ম শুধু ক্রিয়া থেকে জন্মায় না, কর্মের উদ্দেশ্য ও বাসনা কিরূপ, তাই থেকে তার উৎপত্তি । ত্যাগের কথা ক্রিয়াকে নিয়ে নয়, ক্রিয়ার পশ্চাতে যে মানসিক প্রেরণা আছে তার সম্বন্ধেই সে কথা ওঠে । বাসনারাহিত্যই আসল ত্যাগ । ভ্রান্ত ধারণা উদ্ভূত যে কর্ম তাই জীবাত্মাকে বন্ধন করে । অজ্ঞ জীবের আচরণ যতই পরার্থে অনুপ্রাণিত হোক, তা বন্ধনের কারণ হয় । তাই গীতার উপদেশ আসক্তি বর্জন করা, কর্ম ত্যাগ নয় ।

কৃষ্ণ অর্জুনকে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হতে বলেছেন বলে তিনি যুদ্ধের সার্থকতা স্বীকার করছেন এরকম যুক্তি ঠিক নয় । যুদ্ধকে উপলক্ষ মাত্র করে যুদ্ধ সমেত আমাদের সমস্ত কর্তব্য কিভাবে নির্বাহ করতে হবে তারই উপদেশ দেওয়া হয়েছে । অর্জুন শান্তিবাদীদের ভঙ্গী গ্রহণ করে সত্য ও ন্যায়ের জন্যও যুদ্ধ করতে অস্বীকার করলেন । তিনি ব্যাপারটাকে মানব দৃষ্টিতে দেখে চরম অহিংসাবাদ অবলম্বন করেছিলেন । বললেন যে আমার আত্মীয়রা যদি আমাকে আঘাত করতে চান ত আমি নিরস্ত্র হয়ে আমার বুক পেতে দেব, আঘাতের উত্তর আঘাত দিয়ে দেব না । যুদ্ধ ন্যায় কি অন্যায় সে প্রশ্ন অর্জুন তোলেন নি । তিনি অনেক যুদ্ধ করেছেন, অনেক শত্রুর সম্মুখীন হয়েছেন । বান্ধব ও স্বজনদের বিনাশ করতে হবে বলেই তিনি যুদ্ধ ও তৎসংশ্লিষ্ট বিভীষিকার বিরোধী । হিংসা বা অহিংসার প্রশ্ন এখানে ছিল না, যে বন্ধুরা এখন শত্রু হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে হিংসা করার কথা । আর রণবিমুখতা আধ্যাত্মিক অভিব্যক্তি বা সত্ত্বগুণাধিক্য সঞ্জাত নয়, অজ্ঞতা ও প্রবৃত্তি উদ্ভূত । অর্জুন স্বীকার করেছেন যে তিনি মোহ ও দুর্বলতা দ্বারা অভিভূত । আদর্শ হিসাবে গীতা যে অহিংসারই নির্দেশ দিয়েছে তা সপ্তম অধ্যায়ে পূর্ণাঙ্গ মন দেহ ও বাক্যের লক্ষণগুলির যে বর্ণনা আছে এবং দ্বাদশ অধ্যায়ে ভক্তের চিত্তের যে লক্ষণ বর্ণনা করা হয়েছে তা থেকেই বোঝা যায় । কৃষ্ণ অর্জুনকে যুদ্ধের সময় প্রবৃত্তি, অসদিচ্ছা, ক্রোধ ও আসক্তি বর্জন করতে উপদেশ দিয়েছেন, আমাদের মনকে যদি এই ভাবে তৈরী করতে পারি ত হিংসা অসম্ভব হয়ে ওঠে । অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রাম করতেই হবে কিন্তু তাতে যদি মনে ঘৃণা প্রশ্রয় পায় ত আমাদের আধ্যাত্মিক পরাজয় ঘটবে । সম্পূর্ণ সমাহিত চিত্তে বা ভগবৎপদে একান্ত সমর্পিত চিত্তে মানুষকে হত্যা করা সম্ভব নয় । যুদ্ধকে দৃষ্টান্ত স্বরূপ নেওয়া হয়েছে । পীড়াদায়ক কাজ করতে আমরা বাধ্য হতে পারি কিন্তু তা এমন ভাবে করতে হবে যে স্বতন্ত্র্য অহংবোধ না জাগ্রত থাকে । কৃষ্ণ অর্জুনকে বুছেন যে নিজ নিজ কর্তব্য পালন করতে করতেও পরোৎকর্ষ লাভ করা যায় । নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে ও ফল সম্বন্ধে নিরাসক্ত থেকে কাজ করলেই পরোৎকর্ষের দিকে এগুনো যায় । আমাদের কর্ম আমাদের প্রকৃতি অনুযায়ী হওয়া চাই । অর্জুন ক্ষত্রিয় গৃহস্থ হয়ে সন্ন্যাসীর মত কথা বলছিলেন, সম্পূর্ণ বৈরাগ্যে সিদ্ধ হয়েছেন বা মানব প্রেমের দৃষ্টিভঙ্গী থেকে বলছেন বলে নয়, বরং মিথ্যা করুণার দ্বারা অভিভূত হয়েছেন বলে । প্রত্যেককেই যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন, সেখান থেকেই উঁচুতে ওঠবার চেষ্টা করতে হবে । গীতায় লোকসংগ্রহের (বিশ্বসংহতি) দিকে জোর দেওয়া হয়েছে তা থেকে আমাদের সমগ্র জীবন দর্শনের পরিবর্তনের প্রয়োজন বোঝা যায় । আমরা হয়ত দয়ালু, শিষ্ট মানুষ, একটা কুকুর আহত হলে আমরা ক্ষুব্ধ ও অভিভূত হই, ক্রন্দনরত শিশু বা নিপীড়িত স্ত্রীলোকের রক্ষার্থে ছুটে যাই, কিন্তু বৃহৎ মাত্রায় কোটি কোটি শিশু ও নারীর উপর অন্যায়ে লিপ্ত হয়ে থাকি এই নিশ্চিন্ত প্রত্যয়ে যে তা করে আমরা পরিবার, নগর বা রাষ্ট্রের প্রতি কর্তব্য পালন করছি । গীতা আমাদের মানব-সৌভ্রাত্রের দিকে দৃষ্টি দিতে বলেছে । শঙ্কর দেখিয়ে দিয়েছেন যে যেখানেই যুদ্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সেখানে তা বিধি হিসাবে দেওয়া হয় নি, প্রচলিত প্রথা হিসাবেই উল্লেখ করা হয়েছে । গীতা যে যুগে লেখা তখন মানবসমাজে এক আলোড়নের যুগ । মানবসমাজে এরকম আলোড়ন মধ্যে মধ্যেই ঘটে যখন মানুষের বৌদ্ধিক, নৈতিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রনৈতিক সত্তার মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়, এবং সেগুলির যথোপযুক্ত সমন্বয় সাধন না করলে হিংস্র বিপ্লবের সৃষ্টি হয় । কল্যাণের স্বয়ংস্বীকৃত বিধি ও তার প্রতিদ্বন্দ্বী ব্যবস্থার সংঘর্ষে শক্তিপ্রয়োগ অনিবার্য হয়ে ওঠে, না হলে কল্যানমূলক বিধিগুলি মনস্তাত্ত্বিক তথ্য ও ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া হবার সুযোগই পায় না । জগৎ যে অবস্থায় আছে তাই নিয়েই আমাদের কাজ করতে হয়, সঙ্গে সঙ্গে তাকে উন্নত করার প্রাণপণ চেষ্টা করতে হয় । জীবনের কাছে যখন আমরা সর্ব-নিকৃষ্ট ব্যবহার পাই, যখন আমরা সর্বপ্রকার ক্ষতি, শোক ও অপমান দ্বারা জর্জরিত হই, তখনও যেন জীবনের উপর আমাদের বিতৃষ্ণা না আসে । আমরা যদি গীতা-প্রদর্শিত পথে নিরাসক্ত ও উৎসর্গীকৃত ভাবে কর্মে রত হই এবং শত্রুর প্রতিও প্রীতি বজায় রাখি তা হলে পৃথিবীতে যুদ্ধ থাকবে না ।*a

আমরা যদি ফলে নিরাসক্তি ও ভগবানের উদ্দেশ্যে নিবেদনের ভাব মনে আনতে পারি, ত কর্মে প্রবৃত্ত হতে পারি । এইভাবে যে কাজ করে সে চির সন্ন্যাসী । যা পাওয়া যায় তাকেই সে গ্রহণ করে, এবং প্রয়োজন হলে বিনা খেদে তাকে পরিত্যাগ করে ।

কর্মবাদ সম্বন্ধে বিরোধিতা আছে, তা ঠিক কর্ম সম্বন্ধে নয়, কর্মই মোক্ষের পথ এই প্রকার মতবাদের বিরুদ্ধে । অবিদ্যাই যদি অশুভের মূল হয়, তবে জ্ঞানই তার সর্বোত্তম প্রতিকার । প্রজ্ঞালাভ কালবশ বস্তু নয় । প্রজ্ঞা সর্বদা শুদ্ধ ও পূর্ণাঙ্গ এবং সে কোন কর্মের ফল হতে পারে না । ক্ষণস্থায়ী কালবশ কার্যদ্বারা চিরস্থায়ী অব্যয় ফললাভ করা যায় না । কিন্তু কর্ম প্রজ্ঞালাভের জন্য লোককে প্রস্তুত করে । "সনৎসুজাতীয়"র উপর ভাষ্যে শঙ্করাচার্য বলেছেন, "জ্ঞান দ্বারা মোক্ষলাভ হয়, কিন্তু অন্তর পবিত্র না হলে জ্ঞানোদয় হয় না । অতএব, অন্তর শুদ্ধ করার জন্য শ্রুতি ও স্মৃতি বিহিত সমস্ত কর্ম কায়মনোবাক্যে পরমেশ্বরে নিবেদন করা উচিত ।" এইভাবে কর্মে প্রবৃত্ত হলে, তা যজ্ঞের সমান হয় । যজ্ঞ মানে ঈশ্বরের কাছে পবিত্র হওয়া । সে ত্যাগও নয়, আত্মবলিদানও নয়, স্বতঃস্ফূর্ত আত্মসমর্পণ; যে মহত্তর চেতনার আমরা সীমায়িত অংশ তার কাছে সমর্পণ । এই প্রকার আত্মসমর্পণ দ্বারা মনের মালিন্য দূর হয়, এবং সমর্পণকারী ঈশ্বরের শক্তি ও জ্ঞানের অংশ লাভ করে । যজ্ঞের ভাব নিয়ে যে কর্ম করা যায়, তা বন্ধনের কারণ হয় না ।

ভগবদ্‌গীতাতে যে কর্ম আমরা পাই, তাতে স্বাভাবিক কার্যকারণবিশিষ্ট কর্মবিধিকে অতিক্রম করতে পারি । প্রাকৃতিক বিধি-শৃঙ্খলার মধ্যে খেয়াল-খুশী বা লোকোত্তর উদ্দেশ্যে বিধি-বহির্ভূত হস্তক্ষেপের স্থান নেই । গীতার উপদেষ্টা একটা বাস্তব ক্ষেত্রের অস্তিত্ব স্বীকার করেন যেখানে কর্মপদ্ধতি খাটে না, এবং তার সঙ্গে যদি আমরা সম্পর্ক স্থাপন করতে পারি তাহলে আমাদের অন্তরতম প্রদেশে আমরা মুক্ত হই । প্রায়োগিক জগতের মধ্যে থেকেও এখনই কর্মবন্ধন ছিন্ন করা যায় । ঈশ্বরে বিশ্বাস ও নিরাসক্তি অভ্যাস দ্বারা আমরা কর্মকে জয় করতে পারি ।

পরমে লীন তত্ত্বজ্ঞানী ঋষিদের সম্বন্ধে বলা হয় যে তাঁদের কিছু করার থাকে না, তস্য কার্যং ন বিদ্যতে । সত্যদ্রষ্টার কিছু করার বা করে সফল হবার অভিলাষ থাকে না । সকল বাসনায় নিবৃত্তি হলে, কর্ম সম্ভব নয় । উত্তর গীতায় এই আপত্তির কথা এই ভাবে বলা হয়েছে, "যে যোগী জ্ঞানামৃত পান করে সিদ্ধ হয়েছেন, তাঁর আর কোন কর্তব্য অবশিষ্ট থাকে না, যদি কিছু থাকে ত বুঝতে হবে তিনি আসল সত্যের সন্ধান পান নি ।" সকল বিদ্যা সকল সাধনা এই রকম জ্ঞান, এই অন্তিম সারল্য লাভের উপায় মাত্র । সমস্ত কর্ম, সমস্ত সিদ্ধিই এই অবস্থার থেকে নিকৃষ্ট । সকল কর্মই ত্রুটিপূর্ণ ।

শঙ্কর স্বীকার করেছেন, ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করার পরও আমরণ কার্য করায় কোন আপত্তি নেই ।*b এরকম সাধককে শুধু তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গী থেকেই সকল কর্মের ঊর্ধ্বে বলা হয় । এর অর্থ এই যে তত্ত্বগতভাবে আধ্যাত্মিক মোক্ষ ও ব্যবহারিক কর্মে কোন বিরোধ নেই । যদিও সঠিকভাবে বলতে গেলে ঈশ্বরেরও যেমন কোন কর্তব্য থাকতে পারে না, তেমনি ব্রহ্মবিদ ঋষিদেরও কিছু করার থাকে না, অথচ উভয়েই লোকসংগ্রহ অর্থাৎ সংসারের রক্ষণ ও উন্নয়নের জন্য কাজ করে থাকেন । এমন কি এও বলা যায় যে ঈশ্বরই কর্তা, কেননা সাধক ত সমস্ত বাসনামুক্ত হয়েছেন ।*c কিছুই করেন না, ন কিঞ্চিৎ করোতি । তাঁর যখন কোন অন্তিম লক্ষ্য নেই, তিনি কিছুই দাবী করেন না এবং স্বতঃস্ফূর্তির কাছে সদা সমর্পিত । তখন ঈশ্বরই তাঁর মাধ্যমে কাজ করেন এবং সেক্ষেত্রে ন্যায়ান্যায়ের প্রশ্ন ওঠে না । যদিও এরকম লোকের পক্ষে অন্যায় করা অসম্ভব । আত্মপ্রশান্তিতে সমাহিত হয়ে, তিনি সকল কার্য করেন, কর্মকৃৎ । তিনি জানেন যে তিনি ঈশ্বরের কার্যের যন্ত্র মাত্র, নিমিত্ত মাত্রম্‌ । অর্জুনের দীর্ঘ মনঃপীড়া যখন সার্থক হল, তখন তিনি বুঝলেন যে ঈশ্বরের ইচ্ছা পালনেই তাঁর শান্তি । ঈশ্বরের নিয়ন্ত্রণাধীনে প্রকৃতি তার কাজ করে যায় । প্রাতিস্বিক বুদ্ধি, মন ও ইন্দ্রিয় বৃহৎ বিশ্বজাগতিক উদ্দেশ্যে ও তারই বিধানে ক্রিয়াশীল হয় । জয়-পরাজয়ে কিছু এসে যায় না, কেন না বিশ্বাত্মার তাই ইচ্ছা । যা ঘটে, তাকেই আসক্তি বা বিরক্তি ব্যতিরেকেই সে স্বীকার করে নেয় । সে বিরোধের ঊর্ধ্বে (দ্বন্দ্বাতীত) । সে বিনা আয়াসে, স্বাধীন ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজের কর্তব্যকর্ম করে যায় । 

সংসারোক্ত লোক সংসারের নানা ক্রিয়ায় হারিয়ে যায় । সে পরিবর্তনশীল (ক্ষয়) জগতে ঝাঁপ দেয় । প্রশান্ত ব্যক্তি পরমের (অক্ষয়) স্তব্ধতায় নিজেকে সংবরণ করেন কিন্তু গীতার আদর্শ পুরুষ এই দুই প্রকার প্রদেশ অতিক্রম করেন, এবং পুরুষোত্তম যেমন নির্লিপ্ত থেকে পৃথিবীর সকল সম্ভাব্যতায়ই অংশগ্রহণ করেন, সেই ভাবে কর্মে প্রবৃত্ত হন । তিনি কাজ করেন কিন্তু কর্তা নন, কর্তারং অকর্তারম্‌ । অক্লান্ত ও সক্রিয় কর্মীর ঈশ্বরই আদর্শ । ঈশ্বর তাঁর কর্ম দ্বারা নিজের ভাবের অখণ্ডতা কোন রকমেই ক্ষুণ্ণ হতে দেন না । মুক্ত আত্মা কৃষ্ণ ও জনকের মত সর্বদা বাধাহীন । জনক তাঁর কর্তব্য করে যেতেন, সংসারের ঘটনাবলী দ্বারা বিচলিত হতেন না । যে সব লোক চিন্তাশীল ব্যক্তিদের নির্দিষ্ট পথে চলতে চান, মুক্তাত্মারা তাদের পথ নির্দেশ করেন ।*d মুক্তাত্মারা জগতে আগন্তুক লোকের মত বাস করেন । দেহধারণের সমস্ত কষ্ট সহ্য করেও তাঁরা দেহসর্বস্ব নন ।*e "অশিক্ষিত ব্যক্তি কর্মে আসক্তিবশতঃ যেমন কার্য করে, শিক্ষাপ্রাপ্তদেরও তেমনি কার্য করা উচিত কিন্তু আসক্তি বর্জন করে, সাংসারিক শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য ।"

বৌদ্ধ আদর্শে ধ্যানের জীবনকে উচ্চস্থান দেওয়া হয়, কিন্তু যে সমস্ত লোক কাজ ও দুঃসাহসিকতা ভালবাসেন গীতা তাঁদের ভাল লাগবে । আত্মসম্পূর্ণতা লাভের জন্যই কার্য । আমাদের অন্তরতম ও মহত্তম অস্তিত্বের সত্য আমাদেরই খুঁজে বার করতে হবে, এবং তারই নির্দেশে জীবনযাপন করতে হবে, বাহিরের কোন আদর্শ অনুসরণের প্রয়োজন নেই । আমাদের স্বধর্ম অর্থাৎ বহির্জীবন ও স্বভাব অর্থাৎ অন্তর্জীবন পরস্পর উপযোগী হওয়া চাই । তখনই আমাদের কর্ম স্বাধীন, সহজ ও স্বতঃস্ফূর্ত হবে । ভগবানের রাজত্বে ভগবান আমাদের যেমনভাবে থাকতে বলেন সেই রকম ভাবে থাকতে পারি, শুধু অদ্বৈতের বহুমূল্য অপার্থিব শিখাকে জ্বলন্ত রেখেই । ভগবানের উদ্দেশ্যে নিজেদের নিবেদন করে, আমাদের সম্পূর্ণভাবে তাঁর ব্যবহারোপযোগী যন্ত্রে পরিণত করেই, শ্রেষ্ঠ তত্ত্বজ্ঞান আহরণ করতে পারি ।

গীতানুসারে কর্মযোগ জীবনের লক্ষ্যে পৌঁছবার এক বিকল্প পথ, এবং সে পথে তত্ত্বজ্ঞানও লাভ করা যায় । এই অর্থে শঙ্কর ঠিকই বলেছেন যে কর্ম ও ভক্তি উভয়ই মোক্ষলাভের পন্থা । কিন্তু পারমার্থিক মুক্তির সঙ্গে কর্মের কোন অসঙ্গতি নেই । কর্তব্য হিসাবে যা করতে হয়, তা খসে যায়, কিন্তু সমস্ত ক্রিয়া বন্ধ হয় না । মুক্ত পুরুষের কর্ম স্বাধীন, স্বতঃস্ফূর্ত এবং তার মধ্যে কোন বাধ্যবাধকতা নেই । প্রজ্ঞালাভ করার পরও এঁরা জগতের মঙ্গলের জন্য কর্মলিপ্ত হন । এক্ষেত্রে কর্ম সাধনা নয়, লক্ষণ মাত্র । সন্ন্যাস আশ্রম গ্রহণ করলেও অন্য আশ্রমের কর্তব্য থাকে না বটে, কিন্তু সন্ন্যাস আশ্রমের কর্তব্য আছে । দয়াধর্মের ন্যায় সাধারণ ধর্ম সকলেরই আচরণীয় । অতএব কর্ম ও মোক্ষ পরস্পরবিরোধী নয় ।

সে সময় যতগুলি বিভিন্ন ধর্মসূত্র ও আচরণবিধি প্রচলিত ছিল এবং জনগণের বিশ্বাসভাজন হবার জন্য প্রতিযোগিতা করছিল, গীতা সেগুলির সমন্বয় করে এক অন্তর্মুখী ধর্মের আকারে পরিবর্তিত করেছে যা একাধারে মুক্ত, সূক্ষ ও গভীর । যদি বিভিন্ন জনপ্রিয় দেবতার অর্চনা করা হয়, ত বুঝতে হবে, তারা অদ্বিতীয় সর্বেশ্বরেরই বিভিন্ন রূপ । যজ্ঞে বলিদান যদি দিতে হয়, সে আত্মিকভাবের, পার্থিব বস্তুর দ্বারা নয় । জিতেন্দ্রিয় জীবন বা অনাসক্ত কর্মই যজ্ঞ । বেদেরও ব্যবহার আছে । কিন্তু গীতার উপদেশের সঙ্গে তুলনা করলে সে প্রসরমান তীব্র নদীস্রোতের কাছে পুষ্করণীর ন্যায় । উপনিষদ অনুগামীরা যে ব্রহ্মাত্মার অন্বেষণ করেন ও যার কথা ঘোষণা করেন, গীতায় তাঁর সংক্রান্ত তত্ত্বই শিক্ষা দেয় । ইন্দ্রিয় নিরোধ ও মনকে সমাহিত করে যে যোগাভ্যাস করা যায়, তার প্রয়োজন আছে, কিন্তু ব্রহ্মই যোগেশ্বর । সাংখ্যের দ্বৈতবাদকে অদ্বৈতবাদে রূপান্তরিত করা হয়েছে, পুরুষ ও প্রকৃতিকে পুরুষোত্তমের দুই ভাব বলে বর্ণনা করে । একমাত্র তিনিই প্রসাদ দিতে পারেন । তিনিই একমাত্র ভক্তির পাত্র । সমস্ত কর্ম তাঁকেই উৎসর্গ করতে হবে । মহাজ্ঞান তাঁরই । ধর্মের প্রচলিত বিধিগুলি পালন করতে হবে কেননা তিনি সেগুলির প্রবর্তন করেছেন এবং তিনিই নৈতিক শৃঙ্খলা রক্ষা করেন । কিন্তু বিধিনিয়ম পালন করাই একমাত্র লক্ষ্য নয়, ব্রহ্মের সঙ্গে মিলনই চরম লক্ষ্যগীতার উপদেষ্টা প্রচলিত বিভিন্ন মতবাদের সমন্বয় করে এমন একটা সর্বাত্মক দ্বন্দ্ব নিরসনকারী মীমাংসা দিয়েছেন যা কোন বিশেষ দেশ বা কালোপযোগী নয়, সকল লোকের পক্ষে এবং সর্বকালে অনুসরণযোগ্য । তিনি বাহিরের আকারের উপর বা মতবাদের গোঁড়ামিকে প্রাধান্য দেন নি । মূল তত্ত্ব এবং মানবসত্তা ও মানবপ্রকৃতির মহৎ তথ্যগুলিই তাঁর উপদেশের বিষয় ।


13) সাধনার লক্ষ্য*a

আধ্যাত্মিক জীবনের ঐক্য সম্বন্ধে গীতার মত খুব দৃঢ় । তাকে দার্শনিক জ্ঞান, অচলা ভক্তি বা নিরলস কর্ম প্রভৃতিতে বিচ্ছিন্ন করা যায় না । লক্ষ্যে পৌঁছবার পথ রূপে, বা লক্ষ্যে পৌঁছবার পরও জ্ঞান, ভক্তি ও কর্ম পরস্পরের পরিপূরক । পথ ভিন্ন হলেও লক্ষ্য একই । ভিন্ন ভিন্ন পথে পর্বতশৃঙ্গে আরোহণ করা যায়, কিন্তু চূড়ায় পৌঁছলে সকলের পক্ষে একই দৃশ্য প্রতীয়মান হবে । প্রজ্ঞাকে মূর্তভাবে বর্ণনা করলে বলা হয় যে জ্ঞান তার দেহ, কিন্তু প্রেম তার অন্তর । অন্ধকার থেকে আলোয় যাবার, মৃত্যু থেকে অমরত্বে পৌঁছবার যোগই পুরানো পথ । জ্ঞান ও ধ্যান, প্রেম ও সেবা যোগেরই ভিন্ন ভিন্ন দশা ।

লোকত্তর সাধনার পরিণতিকে ব্রহ্মলোক, বা ব্রহ্মভাব বা ব্রহ্মস্থিতি প্রাপ্তি বলে বর্ণনা করা হয় । এর এক দিক হল সংসার থেকে বিচ্ছেদ (কৈবল্য) । গীতায় এর সব কটিরই ইল্লেখ আছে । অনেক শ্লোক এমন আছে, যা পড়লে মনে হয় যে মোক্ষপ্রাপ্তির পর দ্বৈতভাব ঘুচে যায়, মুক্ত আত্মা শাশ্বত আত্মার সঙ্গে এক হয়ে যায় । সে অবস্থা সর্বপ্রকার রীতি ও গুণের অতীত, নিষ্ক্রিয়, অবাধ ও শান্ত । তখনও যদি দেহ আমাদের লগ্ন হয়ে থাকে, তো প্রকৃতি তার উপর আপনার কাজ করে যাবে যতক্ষণ না বর্জিত খোলসের মত দেহ খসে পড়ে । জীবন্মুক্ত দেহী বহির্জগতের ঘটনায় সাড়া দেয় কিন্তু জড়িত হয়ে পড়ে না । এই দিক দিয়ে দেখলে দেহ ও আত্মা অসমন্বিত দ্বৈত এবং আমরা মুক্ত আত্মার কোন ক্রিয়ার কথা ভাবতে পারি না ।

এই দৃষ্টিভঙ্গীর উপর কিন্তু গীতা প্রাধান্য দেয় নি । গীতার মতে আধ্যাত্মিক মোক্ষ হয় তখনই, যখন আমাদের সমস্ত স্বভাবকে ঈশ্বরের অমর বিধি ও শক্তিতে রূপান্তরিত করতে পারি । ঈশ্বরের সহিত সমভাবকে (সাধর্ম্য) প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে, ঈশ্বরের সঙ্গে অভিন্নতাকে (সাযুজ্য) নয় । মুক্ত আত্মা দিব্যজ্ঞান দ্বারা অনুপ্রাণিত ও দিব্য ইচ্ছা দ্বারা চালিত । তিনি ঐশী ভাবের অধিকারী । তাঁর শোধিত প্রকৃতি ঐশী সত্তায় বিলীন । যিনি এই তুরীয় অবস্থা প্রাপ্ত হয়েছেন তাঁকে যোগী, সিদ্ধপুরুষ, জিতাত্মা, যুক্তচেতসঃ ইত্যাদি বিবিধ নামে অভিহিত করা হয় । তিনি সর্বদা সুসংহত ও সুষম, তাঁর পক্ষে শাশ্বত নিত্য উপস্থিত । বিভিন্ন প্রকারের আনুগত্য ও ক্রিয়া থেকে তিনি মুক্ত । তাঁর দেহ, মন ও আত্মা, ফ্রয়েডের ভাষায় বলতে গেলে তাঁর সংজ্ঞান, আসংজ্ঞান ও নির্জ্ঞান, ত্রুটিশূন্যভাবে একসঙ্গে কাজ করে এবং তার দ্বারা যে ছন্দ স্পন্দিত হয় তা থেকে আনন্দের উন্মাদনা, জ্ঞানের জ্যোতি ও শক্তির তীব্রতা বিচ্ছুরিত হতে থাকে । মর মানবজীবন থেকে অমর আত্মাকে বিচ্ছিন্ন করা মোক্ষ নয়, সমগ্র মানবের রূপান্তরণই আসল মোক্ষ । এবং মানবজীবনের সন্তাপগুলিকে বিনষ্ট করেই যে সেই অবস্থা পাওয়া যায় তা নয়, তাদের নবকলেবর দিয়েই পেতে হয় । বিশ্বজগতের ধারণা দ্বারা তার সমস্ত প্রকৃতি অভিভূত হয়, আধ্যাত্মিক আলোকে উদ্ভাসিত ও জ্যোতির্ময় হয়ে ওঠে । তার দেহ, প্রাণ ও মন বিলুপ্ত হয় না, পরিশোধিত হয়ে দিব্যজ্যোতির বাহন ও প্রতিকৃতি হয়, এবং নিজেই নিজের সর্বোত্তম রচনা হয় । তার ব্যক্তিত্ব পূর্ণত্ব লাভ করে, এবং তার গরিষ্ঠ প্রকাশ হয় মুক্ত ও পবিত্র, প্রফুল্ল ও ভারহীন অবস্থায় । তার সমস্ত কর্ম জগতের সংহতির জন্য "বিকীর্ষুলোকসংগ্রহম্‌" 

মুক্ত আত্মা/পুরু

মুক্তপুরুষরা সমগ্র জগতের পরিত্রাণের ভার নিজেরাই গ্রহণ করেন । আত্মার গতি যদি স্তব্ধ হয়ে যায় এবং তা নিত্যনূতন বিসংবাদ দ্বারা অভিভূত হয়, তাহলেই জগতের শেষ । সমগ্র জগৎ অজ্ঞতা ও অশুভ থেকে নিষ্কৃতি না পেলে দ্বান্দ্বিক অভিব্যক্তি শেষ হতে পারে না । সাংখ্যের মতে যেসব লোক পরাজ্ঞান ও মোক্ষের অধিকারী হয়েছেন তাঁরাও অপরের মঙ্গলেচ্ছায় জগৎ পরিত্যাগ করেন না । প্রকৃতির দেহতে নিজেদের লগ্ন করে ও তার গুণের ব্যবহার করে, এই প্রকার "প্রকৃতিলীন" পুরুষেরা জগতের সেবা করেন । সংসারকে আদর্শের দিকে অগ্রসর হতে হবে এবং যারা অজ্ঞতা ও বিভ্রান্তিতে নিমজ্জিত হয়ে আছে তাদের মুক্তপুরুষদের শক্তি ও জ্ঞান, প্রয়াস ও দৃষ্টান্ত দ্বারা উদ্ধার হতে হবে । এইরূপ যোগ্য ব্যক্তিরাই মানবসমাজের স্বাভাবিক নেতা । আমাদের আধ্যাত্মিক অস্তিত্বের চিরন্তন ভিত্তিতে দৃঢ়বদ্ধ এই সব মুক্তাত্মা, নিত্যপুরুষরা জীবলোকের জন্য কর্ম করেন । নিজের দেহ প্রাণ মনের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেও বিশ্বজনীন ভাব দ্বারা তাঁরা অনুপ্রাণিত হন । তিনি যাই করুন ব্রহ্মের সঙ্গে নিত্য সংযোগ বিচলিত হয় না । যদি এবং যখন বিশ্বজাগতিক লীলা তার পূর্ণতা লাভ করবে, যখন সকলেই মোক্ষলাভ করবে, তখন কি ঘটবে তা আমাদের পক্ষে বলা কঠিন । পরমের অনন্ত সম্ভাব্যতা, তিনি হয়ত অন্য এক সম্ভাবনার মধ্যে নিজেকে প্রকট করবেন ।

গীতা স্বীকার করে যে পরম ব্রহ্মই একমাত্র সত্তা কিন্তু বিশ্বজাগতিক দৃষ্টিভঙ্গী থেকে তিনি পরমেশ্বর । মানুষের সীমিত ধারণা, সর্বোচ্চ সত্যকে এইভাবেই মাত্র উপলব্ধি করতে পারে । যুক্তির দিক দিয়ে এই দুইয়ের সম্পর্ক আমাদের ধারণার অতীত, কিন্তু সত্যকে প্রত্যক্ষ করলে এ অসুবিধা আর থাকে না । এই ভাবেই চরম মোক্ষের যে দুই প্রকার বর্ণনা পাওয়া যায়, তা একই অবস্থার স্বজ্ঞামূলক ও বুদ্ধিজাত ব্যাখ্যা । মুক্ত আত্মার স্বাতন্ত্র্যের প্রয়োজন নেই কিন্তু তবু নিজেকে সীমায়িত করে সে স্বতন্ত্র রূপ গ্রহণ করে । তবে উভয় ব্যাখ্যাই এ বিষয়ে একমত যে মুক্ত আত্মারা যদি পৃথিবীতে বাস করতে থাকেন, তাহলে তাঁরা কোন না কোন কর্মে লিপ্ত থাকেন । তাঁদের কর্মে যে স্বাধীনচিত্ততা, আন্তরিক আনন্দ ও শান্তি দেখা যায় তার সংরক্ষণের জন্য বহির্জগতের কিছুর উপর নির্ভর করতে হয় না ।

গীতার ব্রহ্মলোক স্বভাব নিত্য নয়, সে হল প্রকাশের চরম সীমা । আনন্দ আমাদের উন্মেষের প্রান্ত আর আমরা সে-স্তরে বিজ্ঞানস্তর থেকে উন্নীত হই । সে ব্রহ্মাণ্ডলীলার অংশ । আনন্দময় আত্মা, আত্মার দৈব সংস্করণ পরমাত্মা নয় ।*b শুদ্ধ আত্মা পঞ্চকোষ থেকে ভিন্ন । ব্রহ্মাণ্ডলীলায় লক্ষ্য সিদ্ধ হলে, ভগবানের রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হলে, যখন স্বর্গ-মর্ত্য উভয় স্থানেই তার প্রতিষ্ঠা হয়, যখন সকলেই পারমার্থিক প্রজ্ঞার অধিকারী হবে এবং জন্মমৃত্যুকে অতিক্রম করে যাবে, তখন জগৎলীলা সেই পর্যায়ে পৌঁছবে যা সর্বপ্রকার অভিব্যক্তির অতীত । 

____________________________
1a) গীতার প্রভাব প্রাচীনকালে চীন জাপান পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল, পরে পাশ্চাত্য দেশেও ছড়িয়ে পড়েছে । মহাযান বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের প্রধান দুই পুস্তক, "মহাযান শ্রদ্ধোৎপত্তি""সদ্ধর্মপুণ্ডরীক" গীতার উপদেশের কাছে গভীর ভাবে ঋণী । গীতার নির্দেশ জীবনের অর্থ আগে জেনে পরে কর্মে প্রবৃত্ত হওয়া । চিন্তার মর্যাদাকে ক্ষুণ্ণ করে ব্যবহারিক ব্যাপারে অন্ধ আনুগত্য গীতা কোথাও শেখায় নি । আধ্যাত্মিক দর্শন থেকেই এর কর্মপ্রবৃত্তি মার্গের উৎপত্তি, "ব্রহ্মবিদ্যান্তর্গত কর্মযোগ শাস্ত্র" । নীতিসঙ্গত কর্ম অধিবিদ্যক অনুভূতি থেকেই উদ্ভূত । শঙ্করাচার্য বার বার বলেছেন যে গীতার আসল উদ্দেশ্য আমাদের মুক্তির পথ দেখানো, শুধু কর্মে প্রবৃত্ত করা নয় ।

1b) "সনাতন দর্শনের যে সকল সার সংগ্রহ প্রণীত হয়েছে গীতা তার মধ্যে সব থেকে প্রাঞ্জল ও সার্বিক । এই জন্যই এর মূল্য শুধু হিন্দুদের কাছে বা ভারতীয়দের কাছেই নয়, সমগ্র মানবসমাজের কাছেই স্থায়ী । ভগবদ্‌গীতা বোধ হয় সনাতন দর্শনের সবচেয়ে সুসমঞ্জস আধ্যাত্মিক বিবৃতি ।" - [অলডুস্‌ হাক্‌স্‌লী | স্বামী প্রভবানন্দ ও ক্রিস্টোফার ইসারউড কর্তৃক ভগবদ্‌গীতার মুখবন্ধে (১৯৪৫)]

1c) ঈশ্বরের জ্যোতি আত্মায়ই বাস করে, অন্য কোথাও নয় । সকল প্রাণীর মধ্যেই তা সমভাবে বিতরিত, নিজের মনকে সমাহিত করলেই তা গোচর হয় ।

3a) ভগবদ্‌গীতার শঙ্করভাষ্যের টীকায় আনন্দগিরি (দ্বিতীয় সর্গ, ১০ম শ্লোক) বলেছেন, যে বৃত্তিকার ব্রহ্মসূত্রের এক বিরাট ভাষ্য রচনা করেছিলেন, তিনি গীতারও একটি বৃত্তি বা দীপ্তি লিখেছিলেন, তার সারমর্ম হল যে শুধু জ্ঞান বা শুধু কর্ম দ্বারা মোক্ষলাভ করা যায় না, তাদের সম্মিলিত সাধনাতেই অভীষ্টলাভ হয় ।

3b) যদিও কর্ম মোক্ষলাভের প্রত্যক্ষ কারণ নয়, তবু মোক্ষদায়ী জ্ঞানপ্রাপ্তির প্রয়োজনীয় উপায় কর্ম - [ভগবদ্‌গীতা | শঙ্করভাষ্য | দ্বিতীয় সর্গ | ১১ শ্লোক] । শঙ্কর স্বীকার করেছেন "কর্মনিষ্ঠয়া জ্ঞাননিষ্ঠাপ্রাপ্তিহেতুত্বেন পুরুষার্থহেতুত্বং ন স্বাতন্ত্র্যেন ।"

4a) "যে তাও এর সংজ্ঞা দেওয়া যায় সে সত্যকার তাও নয় ।" "নিরাকারের বাস্তবতা এবং যার আকার আছে তার অবাস্তবতা সকলেই জানে । যারা সিদ্ধির পথে অগ্রসর তারা এসব তর্ক গ্রাহ্যের মধ্যে আনে না, কিন্তু সাধারণ লোকে এই নিয়ে তর্কে রত হয় । সিদ্ধির অর্থই হল তর্কের অবসান, তর্ক মানেই অসিদ্ধি । প্রকট তাওয়ের বিষয়গত মূল্য কিছুই নেই, অতএব তর্কের থেকে নীরবতা ভাল । তাকে যখন ভাষায় প্রকাশ করা যায় না, তখন কিছু না বলাই ভাল । একেই বলে মহাসিদ্ধি ।" - [লাওৎসে | "চীনের তিন ধর্ম" দ্বিতীয় সংস্করণ (১৯২৩) by Soothile |৫৬-৫৭পৃঃ]
বুদ্ধকে সত্তার প্রকৃতি ও নির্বাণ সম্বন্ধে প্রশ্ন করা হলে, তিনি শান্ত নীরবতাকে আশ্রয় করেন । যিশুকে যখন পন্টিয়াস পাইলেট সত্যের প্রকৃতি সম্বন্ধে প্রশ্ন করে, তিনিও অনুরূপভাবে নীরব থাকেন । প্লটিনাস বলেন, "কেউ যদি প্রকৃতির কাছে কৈফিয়ৎ চায় সে কেন উৎপাদন করে, তা হলে তার শোনার ও কথা বলার ইচ্ছা থাকলে তারই উত্তর দেবে । আমার বকা অভ্যাস নয় কাজেই আমি চুপ করে থাকি । সেই নীরবতার অর্থ যদি তুমি বুঝতে পেরে থাক ত তোমারও প্রশ্ন করা উচিত নয় ।"

4b) "সৎও নয়, অসৎও নয়" - ঋগ্বেদ, দশম, ১২৯ । মাধ্যমিক বৌদ্ধেরা চরম সত্তাকে শূন্য আখ্যা দেন, পাছে কোন সংজ্ঞা দিয়ে তাকে অনবধানতাবশতঃ সীমিত করে ফেলা হয় । তাঁদের কাছে তাঁকে তখনই জানা যাবে যখন সমস্ত দ্বন্দ্ব চরম অভিন্নতায় বিলুপ্ত হবে ।

4c) মহাভারতে নারদকে উপদেশ দেবার সময় ভগবান বলছেন তিনি "অদৃশ্য, অঘ্রান্য, অস্পৃশ্য, নির্গুণ, অখণ্ড, অজ, নিত্য, অবিনশ্বর ও নিষ্ক্রিয়", [শান্তিপর্ব |৩৩৯|২১-৩৮] । এক্‌হার্টের ভাষায় তিনি "নিঃশব্দ দৈবী মরুভূমি, ... আসলে অস্তিত্ববিহীন" ।

4d) নারায়ণ বলেছেন, সূর্যের মত আমি সমস্ত জগতে রশ্মিপ্রপাত করি এবং আমি সকল বস্তুর ধারক, এই জন্য আমি বাসুদেব বলে আখ্যাত । - [মহাভারত | দ্বাদশ | ৩৪১|৪১]

4e) তিনি অজ্ঞানকে জ্ঞানালোক দেন, দুর্বলকে শক্তি দেন, পাপীকে ক্ষমারূপ মুক্তি দেন, ক্লিষ্টকে করুণাময় শান্তি প্রদান করেন ও অতৃপ্তকে তৃপ্তি দেন । তুমি দুর্বলের আশ্রয়, পাপীদের ত্রাণকর্তা । তুমি জ্যোতির্ময়, আমাকে জ্যোতি দাও, তুমি বীর, আমাকে বীর্য দাও, তুমি বল(বান), আমাকে বল দাও, তুমি ওজস্বী আমাকে ওজ দাও, তুমি ক্রোধী (অন্যায়ের উপর) আমাকে ক্রোধ দাও, তুমি সহনশীল, আমাকে সহ্যগুণ দাও । - [শুক্লযজুর্বেদ | উনবিংশ |৯]


5a) আমি দেবেন্দ্র কিন্তু তুমি গোদের উপর ইন্দ্রের শক্তি অর্জন করেছ, তাই তুমি লোকে গোবিন্দ নামে কীর্তিত হবে । - [হরিবংশ |৪০০৪]
 

5b) তাঁর প্রথম জীবনের লোককথা ও উপকথা ভাগবত ও হরিবংশে বর্ণিত হয়েছে ।
 

5c) ভাগবতের মতে সাত্বতরা পরমেশ্বরকে ভগবান্‌ ও বাসুদেব রূপে পূজা করত (নবম, ৯, ৫০) । যামুনাচার্য তাঁর আগমপ্রামাণ্যে বলেছেন যে যারা ঈশ্বরকে শুদ্ধভাবে উপাসনা করে তাদেরই ভাগবত ও সাত্বত বলে । সত্ত্বাদ ভগবান ভজ্যতে যৈঃ পরঃ পুমান্‌ তে সাত্বতা ভাগবতা ইতি উচ্যন্তে দ্বিজোত্তমৈঃ ।

5d) যিশু তাঁর জীবন নিঃসঙ্গ প্রার্থনায় ধ্যানে ও সেবায় কাটান, আমাদের প্রত্যেকের মত প্রলোভিত হন, মহান্‌ সাধকদের মত অতীন্দ্রিয় অভিজ্ঞতা লাভ করেন এবং আধ্যাত্মিক ভাবের এক সঙ্কতময় মুহূর্তে ঈশ্বরের উপস্থিতির জ্ঞান হারিয়ে বলে ওঠেন, "হে ভগবান, হে ঈশ্বর আমাকে ত্যাগ করলে কেন ?" - [মার্ক | পঞ্চদশ
 |৩৫]  "পিতঃ, তোমার কাছে আমার আত্মাকে সমর্পণ করছি" - [লিউক | ত্রয়োবিংশত |৪৬] "আমি ও পিতা অভিন্ন" - [জন | দশম |৩০]

5e) ঈশ্বরের রক্তমাংসের শরীর গ্রহণকেই "অবতরণ" বলে ।

5f) নিশীথে তমোদ্ভূতে জায়মানে জনার্দনে দেবক্যাং দেবরূপিণ্যাং বিষ্ণুঃ সর্বগুহাশয়ঃ... বসুদেবগৃহে সাক্ষাৎ ভগবান্‌ পুরুষঃ পয়ঃ জনিস্যতে - [ভাগবত |একাদশ |২৩]
যীশুখ্রীষ্টের দেহধারণের সম্বন্ধে যা বলা হয়েছে তার তুলনা করা যাক্‌ "যখন সর্ববস্তু গভীর নিস্তব্ধতায় আচ্ছন্ন ছিল এবং রাত্রি দ্রুত যাত্রার মধ্যপথে তখন তোমার সর্বশক্তিমান বাণী তোমার স্বর্গস্থ রাজাসন থেকে লাফিয়ে পড়ল । আলেলুয়া (Alleluia)" । অবতরণবাদ খ্রীষ্টীয় সম্প্রদায়ে যথেষ্ট আলোড়নের সৃষ্টি করেছিল । আরিউস বলেছেন যে পুত্র পিতার সমকক্ষ নন, তার সৃষ্ট জীব মাত্র । সাবেলিয়াস বলেন যে তাঁরা পৃথক নন, একেরই বিভিন্ন ভাব । প্রথম মতে পিতা ও পুত্রের স্বাতন্ত্র্যের উপর, দ্বিতীয় মতে তাদের অভিন্নতার উপর জোর । শেষ পর্যন্ত মীমাংসা হল যে পিতা ও পুত্র সমকক্ষ এবং উপাদানে অভিন্ন, তবে তাদের ব্যক্তিত্ব স্বতন্ত্র ।

5g) আমার মতে, এই হল খ্রীষ্টীয় পুনরুত্থান (Resurrection) বাদের সারমর্ম । যীশুর শরীরে পুনরায় প্রাণসঞ্চার হল কিনা সেটা বড় কথা নয়, আসল কথা হল দৈবশক্তির পুনরুজ্জীবন । মানুষের পুনর্জন্ম তার আত্মার মধ্যেই ঘটতে পারে, তাতেই বাস্তব সম্বন্ধে গভীরতম বোধ জন্মায়; মহত্তর ঈশ্বরভক্তি ও মানবপ্রীতিই আসল পুনরুত্থান, তা থেকেই মানবজীবন তার স্বকীয় দিব্য আধেয় ও উদ্দেশ্য সম্বন্ধে সচেতনতায় উন্নীত হয় । ভগবান চিরন্তন সৃষ্টিতৎপরতা, অবিরাম কর্ম । তিনি মানবপুত্র, কেননা মানবের মধ্যেই ঈশ্বর পুনর্জন্ম নেন । নিত্য ও অনিত্যের মধ্যে আচ্ছাদন যখন সরে যায় তখনই মানুষ ঈশ্বরের প্রদর্শিত পথে তাঁর অনুগামী হয় । তাই আঞ্জেলাস সিলেসিয়াস (Angelus Silesius) বলেছেন, খ্রীষ্ট যদি হাজারবারও বেথলেহেমে জন্মগ্রহণ করেন, তিনি যদি তোমার মধ্যে না জন্মান, তবে তোমার আত্মা নিরাশ্রয়ই থেকে যাবে ।

5h) "অজ্ঞান তিমিরান্ধস্য জ্ঞানাঞ্জনশলাকয়া চক্ষুরুন্মীলিতং যেন তস্মৈ শ্রীগুরবে নমঃ ।" অজ্ঞান তিমির দ্বারা অন্ধ চক্ষুকে যিনি জ্ঞানাঞ্জনশলাকা দ্বারা উন্মোচিত করেছেন, সেই দিব্য গুরুকে প্রণাম করি ।

5i) স্পিনোজা বলেছেন, "সশরীর খ্রীষ্টকে জানা মুক্তির পক্ষে আদৌ প্রয়োজন নেই, কিন্তু তথাকথিত ঈশ্বরের নিত্য পুত্রের কথা অর্থাৎ ঈশ্বরের শাশ্বত জ্ঞান, যা সকলের মধ্যে এবং প্রধানতঃ মানবমনের মধ্যে প্রকট, বিশেষ করে যীশুখ্রিষ্টের মধ্যে যা দীপ্যমান, সে ব্যাপার সম্পূর্ণ আলাদা । কেননা সে ছাড়া মানবজীবন ধন্য হতে পারে না, যেহেতু ও বস্তু লাভ না করলে সত্য ও মিথ্যা, শুভ ও অশুভের প্রভেদ বোঝা যায় না ।" কাজেই দেখা যাচ্ছে স্পিনোজা ঐতিহাসিক খ্রীষ্ট ও ভাবগত খ্রীষ্টের মধ্যে পার্থক্য দেখিয়েছেন ।
লয়সি বলেন, "খ্রীষ্টের পুনরুত্থান তাঁর পার্থিব জীবনের শেষ পাদক্ষেপ নয়, মানুষের সেবায় তাঁর শেষ নিয়োগ নয়, বরং তাঁর শিষ্যদের বিশ্বাসের প্রথম সূত্র এবং খ্রীষ্টীয় ধর্মের আধ্যাত্মিক বনিয়াদ ।" - [Maude Petre | Loisy (1944) |পৃঃ ৬৫-৬৬]


6a) "পরমেশ্বর যোগশক্তিবশে লীলা করতে ইচ্ছা করলেন ।" - [ভাগবত দশম |২৯|১]
ঐশী লীলা কোন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নয়, কেননা ঈশ্বর নিত্যতৃপ্ত । লীলা শব্দটি এই উদ্দেশ্যহীনতার দ্যোতক ।

6b) নারদ পঞ্চরাত্র দ্রষ্টব্য "ঈশ্বর সর্বদা একক, সকলের মধ্যে ও প্রত্যেকের মধ্যে । সর্বভূত তাঁর ক্রিয়াসঞ্জাত কিন্তু তারা তাঁর মায়া দ্বারা বিভ্রান্ত" - [দ্বিতীয় |১|২২]
"হে নারদ, যা তুমি দেখছ, সে আমার সৃষ্ট মায়া । সৃষ্ট জগতে যে সব গুণ দেখা যায়, আমাতে সেই সব গুণ বিদ্যমান এ কথা ভেবো না ।" - [মহাভারত | শান্তিপর্ব |৩৩৯|৪৪]

6c) যে মায়া অবিদ্যা উৎপাদন করে না, তাকে সাত্ত্বিকী মায়া বলে । যখন তা অশুদ্ধ হয়, তখনই অজ্ঞতা বা অবিদ্যার উৎপত্তি হয় । প্রথমটিতে ব্রহ্মের প্রতিফলনই ঈশ্বর, এবং দ্বিতীয়টিতে প্রতিফলন জীব বা আত্মা । এ মত পরবর্তী বেদান্তের (পঞ্চদশী, প্রথম, ১৫-১৭), গীতায় এ মতবাদ দেখা যায় না ।

8a) "মানুষের মনে এক পবিত্র ভাব আছে, যার ভিন্ন ভিন্ন দেশে ও ভিন্ন ভিন্ন কালে বিভিন্ন নাম, কিন্তু সেটি ঈশ্বর থেকেই প্রসূত এবং পবিত্র । সে গভীর ও অন্তর্মুখী, সে ধর্মের কোন বিশেষ আকারে আবদ্ধ নয়, এবং কোন ধর্মেই তার অভাব নেই, তার মধ্যে অন্তর সম্পূর্ণ অকপট । যাদের মধ্যেই সেই ভাব অঙ্কুরিত হয়, এবং বাড়ে, তারা যে জাতেরই হোক, তারা সর্বোত্তম অর্থে, পরস্পরের ভ্রাতা ।" - [জন উলম্যান, আমেরিকান কোয়েকার সাধু]


9a) স্বরূপজ্ঞান বা সত্য সম্বন্ধে চেতনা সর্বদাই আছে । অদ্বৈত বেদান্তমতে তার নিত্য উপস্থিতি দ্বারা অজ্ঞান দূর হয় না । বরং তা প্রকট হয়ে পড়ে । সাক্ষাৎকার রূপ প্রজ্ঞা একটা বৃত্তি এবং অন্য অন্য জ্ঞানের ন্যায়ই এক পরিণতি ।


10a) "ভিন্ন ভিন্ন পথে একই লক্ষ্যে (আধ্যাত্মিক মর্মগ্রহণ) পৌছানো যায়; সৌন্দর্যপ্রীতি যা কবিদের অনুপ্রাণিত করে, একের প্রতি অনুরাগ এবং বিজ্ঞানের ঊর্ধ্বগতি যা দার্শনিকদের উচ্চাকাঙ্ক্ষার বিষয়; সেই ভক্তি ও প্রার্থনা যার দ্বারা কোন ভক্ত ও উৎসাহী আত্মা আত্মোৎকর্ষের উদ্দেশ্যে নৈতিক পবিত্রতা রক্ষা করে । বাস্তবতা ও তুচ্ছতার ঊর্দ্ধে, যেখানে আমরা অসীমের সাক্ষাৎ ভাবে সম্মুখীন হই, যে অসীম আত্মার গভীর প্রদেশ থেকে আলোকসম্পাত করে, সেখানে পৌঁছবার এইগুলি মহাপথ ।" - [প্লটিনাস | Letter to Flaccus]
মধুসূদনের মতে সৎ, চিৎ ও আনন্দ স্বরূপ ঈশ্বরকাভের জন্য বেদের তিন কাণ্ড আছে, তাদের বিষয় যথাক্রমে কর্ম, উপাসনা ও জ্ঞান; গীতার অষ্টাদশ অধ্যায়েও এই তিন বিভাগ আছে ।

10b) "সম্মোহন, যাদু করা, আত্মবিক্রয়, ভূতে পাওয়া ইত্যাদি স্পষ্টই সজ্ঞানকে নির্জ্ঞান বস্তুদ্বারা বিচ্ছিন্নতা, নিরোধ ও অবদমন থেকে আসে" - [Jung | The Integration of Personality, 1940, p.12]


11a) অদ্বৈতবাদীদের জ্ঞানের উপর নির্ভরতাকে ভক্তেরা নিন্দনীয় ধর্মদ্রোহিতা বা আত্মার বিনাশকারী ভ্রম বলে মনে করে, যদিও শঙ্কর ক্রমবিহিত মোক্ষের প্রস্তুতি হিসাবে ভক্তির মূল্য স্বীকার করেছেন ।

11b) "ব্যাধের সদাচরণ কি কি ছিল ? ধ্রুবর কত বয়স ? গিজেন্দ্র কি বিদ্যালাভ করেছিল ? বিদুরের কি জাতি ছিল ? উগ্রসেনের কি ক্ষমতা ছিল ? কুব্জার কি রূপ ছিল ? সুদামের কি ঐশ্বর্য ছিল ? ভগবানের ভক্তই প্রিয়, তিনি ভক্তিদ্বারাই তুষ্ট, অন্য গুণ নিয়ে মাথা ঘামান না ।"
"জন্মে মানুষই হোক, দেবদূত হোক বা পাহাড় পর্বতের পশু হোক, মশক, গোমহিষ বা পতঙ্গ, পক্ষী ইত্যাদি প্রাণী হোক, অন্তর যদি ইহজীবনে পরমানন্দ লহরীর উৎস তোমার পাদপদ্মধ্যানে সর্বদা মগ্ন থাকে তাহলে কোন্‌ যোনিতে জন্ম, তাতে কি এসে যায় ?" - শঙ্কর রচিত বলে কথিত ।

11c) "হে ঈশ্বর, আমি ধন, জন, সুন্দরী নারী, কবিপ্রতিভা কিছুই চাই না, জন্মে জন্মে পরমেশ্বরে স্বতঃস্ফূর্ত ভক্তিই আমার কাম্য ।" - [শ্রীচৈতন্য | শিক্ষাষ্টক |৪]

11d) গুণরহিতং, কামনারহিতং, প্রতিক্ষণবর্দমানং, অবিচ্ছিন্নং, সূকচতরং, অনুভবরূপম্‌ - [নারদ | ভক্তিসূত্র |৫৪]

11e) ভাগবতে ভক্তির নয়টি স্তরের বর্ণনা আছে - [নারদসূত্র | ১৬-১৮]
শ্রবনং কীর্তনং বিষ্ণোঃ, স্মরণং পাদসেবনম্‌অর্চনং, বন্দনং, দাস্যং, সখ্যং, আত্মনিবেদনম্‌ ।
আবার "আমি স্বর্গেও বাস করি না, যোগীদের অন্তরেও বাস করি না; যেখানে আমার ভক্তেরা আমার মহিমা কীর্তন করে সেইখানেই আমার নিবাস ।"

11f) প্রপত্তির ছয়টি প্রকরণ আছে যার সঙ্গে "ষড়বিধা শরণাগতিঃ" কথাটি তুলনীয় ।

  • সকলের প্রতি শুভেচ্ছা (আনুকূল্যস্য সংকল্পঃ)
  • অনিষ্ট ইচ্ছা বর্জন (প্রতিকূল্যস্য বর্জনম্‌)
  • ঈশ্বর রক্ষা করবেন এই বিশ্বাস (রক্ষিষ্যতীতি বিশ্বাসঃ)
  • ত্রাণকর্তা রূপে তাঁর আশ্রয় পাওয়া (গোপ্তৃত্ববরণম্‌)
  • সম্পূর্ণ অসহায়তা বোধ (কার্পণ্যম্‌)
  • সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ (আত্মনিক্ষেপঃ)

শেষেরটিই প্রপত্তির পরিণতি ও লক্ষ্য যদিও লোকপরম্পরায় ওকেই প্রপত্তির সঙ্গে একার্থক বলে ধরা হয় । ওকে অঙ্গী বলা হয়, বাকী পাঁচটিকে অঙ্গ বলা হয় । অষ্টাঙ্গযোগের উপমা দিয়ে ওর ব্যাখ্যা করা হয়, যেখানে সমাধি আসল লক্ষ্য, অন্য সাত প্রকরণ তার সহায় মাত্র । 

11g) "যারাই খ্রীষ্টকে প্রভু বলে ডাকে তারা নয়, তাদের মধ্যে মাত্র যে ঈশ্বরের ইচ্ছা পালন করে সেই স্বর্গরাজ্যে প্রবেশাধিকার পাবে ।" - [বাইবেলের প্রথম জন | দ্বিতীয় ৯-১১ | চতুর্থ ১৮-২০]

12a) বৈদিক প্রার্থনা : যা কিছু নিন্দনীয়, নিষ্ঠুর ও পাপ, তা শান্ত হোক, শিব হোক, শুভ ও শান্তিপূর্ণ হোক ।

12b) নিরন্তর ঈশরচিন্তায় ছেদ পড়ার ভয়ে বাহ্যিক কার্যের উপর একটা স্বাভাবিক বিতৃষ্ণা থাকে । - [ব্রহ্মসূত্রের শঙ্করভাষ্য | তৃতীয় |৩|৩২], [ভগবদ্‌গীতার শঙ্করভাষ্য | দ্বিতীয় |১১, তৃতীয় |৮|২০]

12c) "তুমিই কর্তা" - [জৈমিনীয় উপনিষদ]
"যে লোক পবিত্র আত্মা দ্বারা চালিত তার সকল কর্ম পবিত্র আত্মারই কর্ম, তার নিজের নয় ।" - [St. Thomas Aquinas | Summa Theol.II | 1, 93, 6]

12d) "যে সাধু মহাত্মারা শান্তিতে বাস করেন । বসন্তের মত তাঁরা জগতের কল্যাণ করেন । নিজেরা সংসার সমুদ্র পার হবার পর তাঁরা আপাতদৃষ্টিতে উদ্দেশ্যবিহীনভাবে অন্যকে পার হতে সহায়তা করেন ।" - [শঙ্কর]

12e) "সৎ লোক সংসারে দুঃখে কষ্ট পান । তাঁরা নিজেদের জ্বালিয়ে জগতে আলোকসম্পাত করেন " - [ভাগবৎ]

13a) সাধনার চরম লক্ষ্যকে গীতায় ভিন্ন ভিন্ন স্থানে ভিন্ন ভিন্ন রূপে বর্ণনা করা হয়েছে -
  • পরম পদপ্রাপ্তি [গী|৩|১৯]
  • মোক্ষ [গী|৩|৩১], [গী||১]
  • অব্যয় শাশ্বত অবস্থা [গী|১৮|৫৬]
  • যেখান থেকে প্রত্যাবর্তন নেই অর্থাৎ পুনর্জন্ম না হওয়া [গী||১]
  • সিদ্ধি [গী|১২|১]
  • পরম শান্তি [গী||৯]
  • ঈশ্বর স্বারূপ্য [গী||৯, ১০ ও ২৪]
  • ব্রহ্মসংস্পর্শ [গী||]
  • ব্রহ্মনির্বাণ [গী||৭২]
  • ব্রহ্মত্বলাভ [গী|১৪|২৬]
  • ব্রহ্মভূত হওয়া [গী||২৪] 

13b) আনন্দময় আত্মা পরমাত্মা নয়, কেননা সে অবস্থার বশীভূত এবং প্রকৃতির রূপান্তর, সর্বপ্রকার সৎকর্মের যোগফল । - [বিবেক চূড়ামণি |২১২]

 ____________________________
*Hard Copy Source:
"Srimadvagabadgeeta" by Dr.Sarvepalli Radhakrishnan, First Edition, 1971. Published by Mitra & Ghosh, 10 Shyamacharan Dey Street, Kolkata-12.

Contents added by uploader.


Disclaimer:
This is a personal, non-commercial, research-oriented effort of a novice religious wanderer.
এটি আধ্যাত্মিক পথের এক অর্বাচীন পথিকের ব্যক্তিগত, অবাণিজ্যিক, গবেষণা-ধর্মী প্রয়াস মাত্র ।

[Digitised by scanning (if required) and then by typing mostly in Notepad using Unicode Bengali "Siyam Rupali" font and Avro Phonetic Keyboard for transliteration. Uploaded by rk]


<Contents>

No comments:

Post a Comment