Essence - Swami Saradananda

গীতাতত্ত্ব

(স্বামী সারদানন্দ)*


সূচীপত্র


1) পরিচয়
1.1) পণ্ডিত মানে কি ?
1.2) শ্ৰীকৃষ্ণের জীবনই গীতাশাস্ত্রের প্রধান টীকাস্বরূপ
1.3) গীতার অপর নাম গীতোপনিষৎ
1.4) মুমুক্ষুত্ব
1.5) মহাপুরুষসংশ্রয়
1.6) মনের শক্তি
1.7) অর্জুনের সঙ্গে আমাদের সাদৃশ্য
1.8) গীতা কি মহাভারতাঙ্গে প্ৰক্ষিপ্ত ?
1.9) উপনিষদের মন্ত্রের সাথে গীতার সাদৃশ্য
1.9.1) গীতার ঋষি
1.9.2) গীতার বীজ
1.9.3) গীতার শক্তি
1.10) মানবের স্বাধীন ইচ্ছা ও মনের সীমা
1.11) ভালবাসা ও মোহ
2) বিষাদযোগ
3) জ্ঞানযোগ ১
কর্মের বিভাগ
4) জ্ঞানযোগ ২
5) কর্মযোগ ১
6) কর্মযোগ ২
7) জ্ঞান ও ভক্তির সমন্বয়
8) বেদান্ত ও ভক্তি
8.1) বাঙ্গলাদেশে জ্ঞান ও ভক্তির ধারণা
8.2) ধর্মশাস্ত্ৰাদিতে জ্ঞান ও ভক্তির অদ্ভুত সামঞ্জস্য
8.3) জ্ঞান ও ভক্তির বিরোধ কোথায়
8.4) অনন্ত ঈশ্বরে ‘ইতি’ - অসম্ভব
8.5) ‘আমি’ ও ‘তুমি'
8.6) ‘তুমি’ ও ভক্তি
8.7) ‘আমি’ ও জ্ঞানী
8.8) ভক্ত ও জ্ঞানীর লক্ষ্য একই
8.9) জীবাত্মা ও পরামাত্মা - দুটি পক্ষী
8.10) অজ্ঞানবরণের মধ্যে ভগবনের প্রকাশ
8.11) মূল বিষয়ে সকল শাস্ত্ৰই অভেদ
8.12) পথের বিবাদ মিটবে কিসে ?
8.13) বিবাদ মিটাবার উপায় – স্বধর্ম ও ইষ্টনিষ্ঠা
8.14) ধর্মাধর্মের পরীক্ষা - নিঃস্বার্থতা
8.15) সমাজের আদর্শ
8.16) জ্ঞান ও ভক্তির লক্ষ্য এবং ইষ্টনিষ্ঠা
8.17) বেদান্ত কি ভগবান লাভের একটি পথমাত্র ?
8.18) জ্ঞান ছাড়লে ধর্মলাভ হয় না
8.19) উপসংহার - আচাৰ্যদেবের উপদেশ
9) সাধনা ও সিদ্ধি
10) বেদ-কথা
সাধন-চতুষ্টয়
11) সৃষ্টি-রহস্য
11.1) সৃষ্টির অনাদিত্ব
11.2) সৃষ্টি-প্রক্রিয়া-প্রাণ ও আকাশ
11.3) সৃষ্টি-প্রক্রিয়া-শাস্ত্র ও বিজ্ঞান
11.4) সৃষ্টিতত্ত্বে-সাংখ্য ও বেদান্ত
11.5) সাংখ্য ও বেদান্তের প্রভেদ-ঈশ্বরতত্ত্বে
11.6) বৈদান্তিক ঈশ্বরবাদের কার্যকারিতা নিঃস্বার্থপরতা
11.7) ঈশ্বরের প্রকাশ ব্যক্তিভেদে
11.8) বেদান্ত কি নাস্তিক ?
12) সাধন-নিষ্ঠা
13) কর্মের দ্বিবিধ রূপ
14) কর্ম-রহস্য
15) উপসংহার
16) আপ্তপুরুষ ও অবতারকুলের জীবনানুভব

1) পরিচয়


গীতার প্রথম ও দ্বিতীয় অধ্যায়ে যা আছে, আজ সেই বিষয়ে বলব । আমরা সকলেই জানি, আমাদের দেশে গীতার কত আদর, কারণ হিন্দুধর্মের সার কথা গীতায় আছে । গীতামাহাত্ম্যে এই বিষয়ে একটি সুন্দর শ্লোক আছে -
“সর্বোপনিষদো গাবো দোগ্ধা গোপালনন্দনঃ ৷
পার্থো বৎসঃ সুধীর্ভোক্তা"দুগ্ধং গীতামৃতং মহৎ ৷৷”
উপনিষদসকল যেন গাভীস্বরূপা । শ্ৰীকৃষ্ণ তার দুধ দুইছেন, অর্জুন সেই গাভীর বাছুরের মত হয়েছেন । বাছুর যেমন গাভীর কাছে না গেলে গাভী দুধ দেয় না, সেই রকম অর্জুনের প্রশ্নেই শ্ৰীকৃষ্ণের শাস্ত্রোপদেশ এবং গীতারূপ দুধের উৎপত্তি । এই দুধ পান করবে কে ? সুধী অর্থাৎ পণ্ডিত লোক ।


1.1) পণ্ডিত মানে কি ?


পণ্ডিত মানে বিবেকী লোক । আমাদের দেশে আজকাল যারা দু’চারখানা বই পড়েছেন, দু’চারটি কথা গুছিয়ে বলতে পারেন, তাঁদেরই পণ্ডিত বলা হয় । কিন্তু গীতা বলেন, যাঁরা মুখে কেবল লম্বা-চওড়া বলেন, তাঁরা পণ্ডিত নন । যাঁরা সত্য জীবনে প্ৰত্যক্ষ করেছেন, যাঁদের অপরোক্ষানুভূতি অর্থাৎ ইন্দ্ৰিয়ের অতীত পদার্থের জ্ঞান উপলব্ধি হয়েছে, অসৎ হতে সৎ যাঁরা বুঝে নিতে পারেন, তাঁরাই পণ্ডিত । শুনা যায়, এক শ্রেণীর হাঁস আছে, যারা দুধে জলে মিশে থাকলে শুধু দুধ টুকু খেতে পারে । তেমনি এই সত্য-মিথ্যা-মিশ্রিত সংসারে যিনি অসৎ বাদ দিয়ে সৎ নিতে পারেন, তিনিই পণ্ডিত । তিনিই গীতা বুঝতে ও বোঝাতে পারেন ।


1.2) শ্ৰীকৃষ্ণের জীবনই গীতাশাস্ত্রের প্রধান টীকাস্বরূপ


গীতার টীকা অনেকে অনেক রকম করেছেন । আমাদের দেশে তিন শ্রেণীর আচাৰ্য আপনাপন পক্ষ-সমর্থন করে গীতার অর্থ করেছেন । অদ্বৈতবাদী আচাৰ্য শঙ্কর অদ্বৈত মত সমর্থন করে গীতার টীকা করেছেন । বিশিষ্টাদ্বৈতবাদী রামানুজ এবং দ্বৈতবাদী মধ্বাচাৰ্যও সেইরূপ আপনাপন মতানুযায়ী টীকা করে গিয়েছেন । তোমাদের অত টীকা দেখবার দরকার নেই । তোমাদের মন এখনও কোন বিশেষ মতের দিকে না চলে এক ভাবেই আছে । আপনাপন সহজ জ্ঞানে যে অর্থ উপলব্ধি করবে, তা-ই যথেষ্ট । আর ঐ উপায়ে যে যে স্থলে অর্থবোধ না হবে, সেই সেই স্থল বুঝবার জন্যে আর একটি উপায় আছে । যাঁরা মহাভারত পড়েছেন, তাঁরা বুঝতে পারবেন যে, ভগবান শ্ৰীকৃষ্ণের জীবনই এই গীতাশাস্ত্রের প্রধান টীকাস্বরূপ । আপনি এবং অপর সকলে শরীরবান হলেও জন্মমৃত্যুবিরহিত অবিনাশী আত্মা ভিন্ন অন্য কিছু নয়, এই জ্ঞান সর্বদা মনে রাখা, আপনার লাভ-লোকসানের দিকে না চেয়ে সতত কর্তব্যপরায়ণ হওয়া, মনুষ্যজীবনের ক্ষণস্থায়ী সুখদুঃখে অবিচলিত থাকা প্ৰভৃতি যে সমুদয় শিক্ষা গীতায় নিবদ্ধ আছে, তৎসমুদয় ভগবান শ্ৰীকৃষ্ণের নিজ-জীবনের প্রত্যেক কাজে অনুষ্ঠিত দেখতে পাওয়া যায় । অতএব গীতার কোন কথা যদি বুঝতে না পার, ভগবান শ্ৰীকৃষ্ণের জীবন অনুসন্ধান কর; তা হলে যথার্থ অৰ্থ বুঝতে পারবে ।


1.3) গীতার অপর নাম গীতোপনিষৎ


আর এক কথা, - বেদের উপনিষদ্ভাগে আত্মা, ঈশ্বর, জীব, জগৎ-সম্বন্ধে যে সকল সত্য লিপিবদ্ধ আছে, এই অল্প পরিমাণ গীতার মধ্যে ঠিক সেই সব দেখতে পাওয়া যায় । স্থানে স্থানে উপনিষদের ভাষা পৰ্যন্ত দেখতে পাবে । সেই জন্যে গীতা উপনিষৎ মধ্যে গণ্য হয়ে থাকে এবং গীতার অপর নাম গীতোপনিষৎ । গীতামাহাত্ম্যে গীতাপাঠের বিশেষ ফল লিখিত আছে । একটি শ্লোকার্ধ বলছি -
“গীতাধ্যায়সমাযুক্তো মৃতো মানুষতাং ব্ৰজেৎ ৷”
-“যে নিয়ত গীতা পাঠ করে, সে পরজন্মে মনুষ্যত্ব প্ৰাপ্ত হয় ।” অন্য কোন হীনযোনিতে তার জন্ম হয় না ।

এটি বড় সহজ কথা নয় । মনুষ্যত্ব লাভ করা বড়ই কঠিন । যার মনুষ্যত্ব আছে, তার জ্ঞান বল, ভক্তি বল, অপর কোন বিষয় বল, লাভ করতে কতক্ষণ লাগে ? শঙ্করাচার্য বলেছেন -
“দুর্লভং ত্রয়মেবৈতৎ দেবানুগ্রহহেতুকম্ ৷
মনুষ্যত্বং মুমুক্ষুত্বং মহাপুরুষসংশ্রয়: ৷৷”
যথা - (i) মনুষ্যত্ব, (ii) মুমুক্ষুত্ব এবং (iii) মহাপুরুষসংশ্রয় - জগতে এই তিনটি জিনিস এক সঙ্গে পাওয়া দেবতার অনুগ্রহ না থাকলে হয় না ।


1.4) মুমুক্ষুত্ব


মুমুক্ষুত্ব অর্থাৎ মুক্ত হবার ইচ্ছা । শরীরের সুখ, মনের সুখ না চেয়ে একটা উচ্চ উদ্দেশ্য স্থিরভাবে জীবনে রাখা । স্থির, অবিচলিত একটা উদ্দেশ্য থাকলে ক্ৰমে তা ভগবানের দিকে নিশ্চিত নিয়ে যাবে । সাধারণ লোকে আত্মসুখ নিয়েই ব্যস্ত । একটা বিশেষ উদ্দেশ্য জীবনে রেখে চলে কে ?


1.5) মহাপুরুষসংশ্রয়


যে পুরুষ আপন জীবন সুমহৎ উদ্দেশ্যে গঠন করেছেন, এমন পুরুষের সঙ্গলাভ করা এবং তাঁর মুখ হতে মানবজীবনের উদ্দেশ্য শোনা । তা এত দুর্লভ কেন ? ধৰ্মকথা, সৎকথা তোমরাও বল্ছ, আমিও বল্ছি । কিন্তু তার দ্বারা কোন কাজ হয় না কেন ? আমাদের কথার জোর নেই; কারণ, তা প্ৰাণের কথা নয় । আমাদের মন মুখ এক নয় । আমরা সংসারের সুখের জন্য লালায়িত, অথচ মুখে ত্যাগের কথা বলি । আমাদের কথায় কাজ হবেই বা কেন ? যে পুরুষ আপনার জীবন মহৎ উদ্দেশ্যে গঠন করেছেন, মন মুখ এক করেছেন, তার প্রতি কথায় যেন ভিতরের একটা দোর খুলে দেয়, মোহের আবরণ কাটিয়ে দেয় । মহাপুরুষদের কথায় বিশেষ শক্তি নিহিত থাকে । পরমহংসদেবের কথায় কত শক্তি ! ক্রাইস্ট বা বুদ্ধদেবের সহস্ৰ সহস্ৰ বৎসরের পুরাতন কথা পড়, এখনও সেই কথার কত শক্তি ! কিন্তু তুমি আমি সেই কথা বললেও কারও প্ৰাণে তা লাগবে না ।


1.6) মনের শক্তি


আবার যেই তুমি একটা মহৎ উদ্দেশ্যে জীবন গঠন করবে, অমনি তোমারও কথার শক্তি বাড়বে । তখন একটা কথা বললে লোকের প্রাণে লাগবে । যে জিনিসেরই শক্তি বাড়াবার চেষ্টা করবে, সেইটেরই শক্তি বাড়বে । মনের ‘শক্তি বাড়াবার চেষ্টা কর, মানসিক শক্তি বাড়বে, সেইরূপ বাক্যের শক্তি বাড়াবার চেষ্টা কর, কোন বিষয় বিশেষরূপে বলবার ক্ষমতা বাড়বে । বেদান্ত বলেন, এই মনই জগতের সৃষ্টি করেছেন । মনের অদ্ভুত শক্তি । ইউরোপের জড়বাদীরাও এ কথা স্বীকার করেন । ইতিহাসপাঠেও মনের অদ্ভূত ক্ষমতার পরিচয় পাওয়া যায় । ফরাসী দেশের রাণী মেরী এণ্টইনেট অপূর্ব রূপসী ছিলেন । তাঁকে ও তাঁর স্বামীকে পারি নগরের লোকেরা একদিন ক্ষেপে উঠে জেলে পুরে দিলে । পরদিন প্ৰাণদণ্ড করবে স্থির করলে । প্ৰাতঃকালে দেখা গেল, রাণীর মাথার সমস্ত চুল সাদা হয়ে গেছে । একরাত্রের দারুণ ভাবনায় তিনি একেবারে বুড়ী হয়ে গেছেন । মনের এতদূর ক্ষমতা ! মন যদি তীব্রভাবে একটা জিনিস চায়, তা হলে তা নিশ্চয়ই পাবে । আমরা সম্পূর্ণ মনের সহিত কোন জিনিস চাইতে পারি না, তাই তা পাই না । আমাদের মন, পরমহংসদেব যেমন বলতেন, সরষের পুঁটুলির মত । সরষের পুঁটুলি খুলে গিয়ে দানাগুলি যদি একবার ছড়িয়ে পড়ে, তা হলে সেই সকলগুলিকে আবার একত্র করা অসম্ভব । ঘরের আসবাবের কোণে, দেয়ালের ফাটলে এমন গিয়ে পড়বে । যে, হাজার চেষ্টা করলেও আর সকল দানাগুলি পাওয়া যাবে না । মনও সেইরূপ একবার কতক রূপে, কতক রসে, কতক ধন মান ইত্যাদি সাংসারিক বিষয়ে ছড়িয়ে পড়লে আর তাকে সম্পূর্ণরূপে একত্র করা অসম্ভব । তাই পরমহংসদেব ছেলেদের এত ভালবাসতেন । কারণ, তাদের মন এক জায়গায় আছে । সত্যের বীজ ঐ সব মনে দিলে শীঘ্র শীঘ্ৰ অঙ্কুরিত হবে ।


1.7) অর্জুনের সঙ্গে আমাদের সাদৃশ্য


গীতার প্রত্যেক অধ্যায়কে এক একটি যোগ নাম দেওয়া হয়েছে । যোগ অর্থ এক করে দেওয়া - ভগবানের দিকে নিয়ে যাওয়া । যথা, ১ম অধ্যায়কে বিষাদযোগ বলে । বিষাদযোগ কেন বলা হল ? কারণ, অর্জুনের বিষাদই তাঁকে ভগবানে নিয়ে যাবার উপায় হল । তাই বিষাদযোগ । এইরূপ সাংখ্যযোগ, কর্মযোগ, সন্ন্যাসযোগ ইত্যাদি ।

আমরা বলতে পারি, গীতা কেবল অর্জুনের জন্যে বলা হয়েছিল । তাতে আমাদের কি হবে ? আমরা তো আর যুদ্ধে যাচ্ছি না, অথবা মহাবীর অর্জুনের জীবনের সঙ্গে আমাদের ন্যায় ক্ষুদ্র লোকের জীবনের কোন অংশে সাদৃশ্যও নেই । অতএব মহৎ অধিকারীর উদ্দেশ্যে উপদিষ্ট শাস্ত্ৰ আমাদের উপকারে কিরূপে লাগবে ? উত্তরে বলা যেতে পারে, অর্জুন আমাদের চাইতে শতগুণে বড় হলেও মানুষ ছিলেন । আমরাও মানুষ । তাঁর জীবনে যেমন মোহ কখনও কখনও হয়েছিল, আমাদেরও তেমনি মোহ প্রতিপদে হয়, আমাদেরও তার মত সত্যের জন্যে নানা বিঘ্নবাধার বিপক্ষে দাড়াতে হয় । আমাদেরও তাঁর মত ভেতরে বাইরে জীবনসংগ্রাম চলছে । তাই আমরাও গীতা পড়লে শিক্ষা পাই, শান্তি পাই, জীবন-সমস্যার এক অপূর্ব সমাধান পাই । দেখা গিয়েছে, কত পাপী তাপীর গীতা পাঠ করে অনুতাপের অশ্রু পড়েছে এবং উচ্চদিকে জীবনপ্রবাহ চালিত হয়েছে ।


1.8) গীতা কি মহাভারতাঙ্গে প্ৰক্ষিপ্ত ?


আর এক কথা । গীতা কি মহাভারতাঙ্গে প্ৰক্ষিপ্ত হয়েছে ? কোন কোন ইউরোপীয় পণ্ডিত বলেছেন, গীতা প্ৰক্ষিপ্ত । আমাদের দেশেও অনেক লোক তাই শুনছে । তারা বলেন, ভারতবর্ষের পুরাকালের কোন ইতিহাস নেই, কখন ছিলও না । অতএব কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পূর্বে যে, ঐরূপ একটা প্ৰকাণ্ড দর্শনসংগ্ৰহ বাস্তবিক উপদিষ্ট হয়েছিল, এ কথা একেবারে যুক্তিবিরুদ্ধ । একটা বিষয় বিশ্বাস করবার আগে তা সম্ভব বা অসম্ভব বুঝতে তো হবে ? তার উত্তর এই যে, আগে ভারতবর্ষের মত পুরাতন তাঁদের দেশ হোক, তখন দেখা যাবে তাঁদেরও কত ইতিহাস থাকে । ভারত কত দিনের ! কত বিপ্লব হয়ে গেছে ! কতবার সব ভেঙ্গে গেছে, আবার কতবা্র সব গড়েছে । ইউরোপ তার কি জানবে ? ইউরোপ তো সেদিনের । এখনও দেখতে পাওয়া যায়, কত যুগ পূর্বে ভারত হতে সময়ে সময়ে যে তত্ত্ব প্ৰকাশ হয়েছিল ইউরোপে এখন সেই সব প্ৰকাশ হচ্ছে ! এতেই বোঝা যায়, ভারতবর্ষ এক সময়ে কত উচ্চে উঠেছিল ! এই ভারতের ন্যায় উদারতা কোথায় ছিল ? আমাদের নীতিশাস্ত্ৰ বলেন, সত্য চণ্ডালের নিকটেও শিক্ষা করবে, কারণ জ্ঞানই ভগবান, অতএব পবিত্ৰ । যেখানেই জ্ঞান, সেখানেই ঋষিত্ব । সেখান থেকেই সেই জ্ঞান নেবে । গীতাও বলেন -
“জ্ঞানাগ্নিঃ সৰ্বকৰ্মাণি ভস্মসাৎ কুরুতে তথা ৷”
-"জ্ঞান সমুদয় কর্মকে ভস্মীভূত করে ।” একবার সেই জ্ঞান এলে আর কিছুই কু থাকে না । পরমহংসদেব বলতেন; একবার যে মিছরি খেয়েছে, তার কাছে কি আর চিটেগুড়ের আদর আছে ?

তারপর ধর্ম ও দর্শন ভারতের প্রাণস্বরূপ । আমাদের দেশের লোকের অস্থিতে মজ্জাতে, প্ৰতি কাৰ্যেতে এই প্ৰাণপ্ৰতিঘাত এখনও পাওয়া যায় । তখন যুদ্ধোদ্যোগের পূর্বে এরূপ শাস্ত্ৰ যে উপদিষ্ট হতে পারে না, এ বিষয়ের বিশেষ প্ৰমাণ যতক্ষণ না পাব ততক্ষণ কেন আমাদের বহু পুরাতন জাতীয় বিশ্বাস পরিত্যাগ করে তোমার কথা নেব ? আবার গীতাবক্তা স্বয়ং ঈশ্বরাবতার শ্ৰীকৃষ্ণ । তোমার আমার মত সাধারণ পুরুষের পক্ষে যে কাজ সম্ভবে না, তা তাঁর ন্যায় মহাপুরুষে নিশ্চিত সম্ভবে । এও বুঝতে হবে এবং মহাভারতের অন্যান্য অংশের ভাষার সঙ্গে গীতার ভাষার এমন কিছু বিষমতাও দেখতে পাই না, যাতে তোমার কথা নিতে পারি । যাঁরা সাধুসঙ্গ করেছেন, তাঁরা বুঝতে পারবেন সংসারে আমরা যাকে মহা মহা বিপদ বলি, সাধু তারই ভিতর অবিচলিত থেকে মহা তত্ত্বকথাসকল বলেন । এ আমাদের প্রত্যক্ষ পরমহংসদেব ভয়ানক রোগে ভুগছেন । ছ'মাস থেকে আহারাদি প্ৰায় বন্ধ । কিন্তু সমীপস্থ লোকের ভেতর মহা আনন্দের ব্যাপার চলেছে । অতি গূঢ়সাধন, জগতের কূট প্ৰশ্নসমূহের মীমাংসা এবং নিরবচ্ছিন্ন আনন্দদানে সকলকে তিনি মাতিয়ে রেখেছেন । রোগ, দুঃখ বা কষ্টের নামটি মাত্ৰও নেই। অর্জুন স্বয়ং ভগবানের কাছে রয়েছেন । জ্ঞানের কথা বোঝাতে তাঁর কতক্ষণই বা লেগেছিল ? অতএব ইহা প্ৰক্ষিপ্ত নয় । যদি বল, ওসব ছাড়া গীতার একটি আধ্যাত্মিক অর্থ আছে, সেটি হচ্ছে এই - সংসারক্ষেত্রে ইন্দ্ৰিয়ের সঙ্গে লড়াই, খাবার-সংগ্রহের লড়াই; এইরূপ কতই না সংগ্ৰাম মানুষকে দিনরাত করতে হচ্ছে; বিরাম নেই, শান্তি নেই । এই সংগ্রামে জয়ী হয়ে মানব কিরূপে জীবনের সার উদ্দেশ্য লাভ করবে, এই বিষয়ের বিশেষ সমাধান করাই গীতার ভাব । বেশ কথা, এরূপ বিশ্বাস করতে চাও, আপত্তি নেই ।


1.9) উপনিষদের মন্ত্রের সাথে গীতার সাদৃশ্য


পূর্বে বলেছি, গীতাকে উপনিষদ্মধ্যে স্থান দেওয়া হয় । অনেকে স্নান করে প্রতিদিন অন্ততঃ এক অধ্যায়ও গীতা পড়েন । তাঁরা গীতার প্রত্যেক শ্লোককে মন্ত্রস্বরূপ পবিত্ৰ মনে করেন । যেমন মন্ত্রের ঋষি, দেবতা, ছন্দাদি আছে, এরও সেই রকম আছে 


1.9.1) গীতার ঋষি

গীতার ঋষি বেদব্যাস, কারণ তিনিই মন্ত্র দর্শন করেছেন । (ঋষি শব্দের অর্থ অতীন্দ্ৰিয়দৰ্শী) । তিনি দেখেছেন, তার পর সাধারণের জন্যে সেই বিষয়টা শ্লোকে নিবদ্ধ করেছেন । তাঁর কাছেই মন্ত্র প্রথম প্ৰকাশিত হয়েছিল, অতএব ঋষি শব্দের অর্থ ইংরাজীতে যাকে author বলা হয়, তাই । প্ৰত্যেক মন্ত্রের যেমন ঋষি অর্থাৎ রচয়িতা, দেবতা অর্থাৎ যে বিশেষ বিষয় নিয়ে মন্ত্র রচিত হয়েছে (এখানে শ্রীকৃষ্ণ), ছন্দ অর্থাৎ যেরূপ পদবিন্যাসে মন্ত্রের ভাষা লিপিবদ্ধ হয়ে থাকে (এখানে অনুষ্টুপ), তেমনি বীজও থাকে, গীতারও আছে । 


1.9.2) গীতার বীজ

বীজ থেকে যেমন গাছ হয়, তেমনি গ্রন্থেরও মধ্যে এমন একটা বিষয় থাকে, যেটা অবলম্বনে বা যেটাকে ফলিয়ে বাকিটা লেখা হয় । গীতার বীজস্বরূপ সে বিষয়টি কি ?
“অশোচ্যানন্বশোচস্ত্বং প্রজ্ঞাবাদাংশ্চ ভাষসে ৷”
-অর্থাৎ "যার জন্যে শোক করা উচিত নয়, তার জন্যে শোক করছ আবার পণ্ডিতের মত কথা বলছ ।” এর অর্থ এই যে, তোমার মুখে এক, মনে আর এক এবং তুমি সরল নও । যার মুখে একখানা, মনে আর একখানা, তাকে ধাক্কা খেতে হবে । তার সত্য ভগবানলাভের ঢের দেরি । পরমহংসদেব বলতেন, মন মুখ এক করতে হবে, উহাই প্রধান সাধন । গীতাও সেই কথা বলছেন । ধৰ্মরূপ মহাবৃক্ষের বীজ সরলতা ভিন্ন আর কিছুই নয় । 


1.9.3) গীতার শক্তি

তারপর যেমন প্ৰত্যেক মন্ত্রের শক্তি আছে, তেমনি গীতার বিশেষ শক্তি এই শ্লোকে নিবদ্ধ ।
“সর্বধর্মান্ পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্ৰজ ৷
অহং ত্বাং সৰ্বপাপেভ্যো মোক্ষয়িষ্যামি মা শুচ: ৷৷”
- “সব ছেড়ে দিয়ে আমার শরণাপন্ন হতে পার, সব হয়ে যাবে ।” আমরা কত রকম Plan বা মতলব করে থাকি । এটা করব, ওটা করব । অনেক সময় কিন্তু সব যেন এক ঘায়ে ভেঙ্গে যায়, একটা মহাশক্তি যেন সব ভেঙ্গে দেয় । তার হাতের ভেতর যেন রয়েছি, তার অনুমতিতে নড়ছি চড়ছি । তা বলে কেউ যেন মনে না করেন যে, free will বা মানবের স্বাধীন ইচ্ছা নেই ।


1.10) মানবের স্বাধীন ইচ্ছা ও মনের সীমা


মানুষ স্বাধীন ইচ্ছা ও আদৃষ্টের মধ্যস্থলে পড়ে রয়েছে । যেন কেমন একটা আলো-আঁধার, একটা ঠিক করে বলবার জো নেই, আলো বল আলো, আঁধার বল আঁধার । সৃষ্টির প্রারম্ভ হতেই মানুষ এই অতীন্দ্ৰিয় জিনিসটা জানবার চেষ্টা করছে । ইউরোপে সক্রেটিস থেকে চিন্তাশীল ব্যক্তিমাত্ৰেই এই জগৎটা কি, কোন শক্তি-অবলম্বনেই বা প্ৰকাশিত হয়ে রয়েছে, স্বাধীন বা পরাধীন ইত্যাদি বিষয় জানবার চেষ্টা করছে, কিন্তুই কিছুই করে উঠতে পারেনি । কারণ, মনের দ্বারা ও বিষয়টা জানা যায় না; মনের সীমা আছে । অন্ত-বিশিষ্ট জিনিস অনন্তকে কি করে জানবে ? ইন্দ্ৰিয়াদির পারে না গেলে যে সকল প্রশ্নের মীমাংসা হয় না, সে সকল প্রশ্নের সমাধান মন কেমন করে করবে ? একটা গল্প আছে, একজন পণ্ডিত এই সকল তত্ত্ব বোঝবার ও বোঝাবার চেষ্টা অনেকদিন ধরে করেছিলেন । কিছুই না পেয়ে সমুদ্রে ডুবে মরতে যান । সেখানে দেখেন, এক বালক অদ্ভুত খেলা খেলছে । সমুদ্রের কিনারায় বালিতে একটা গর্ত খুঁড়েছে এবং ছোট ছোট হাতে সমুদ্র হতে অঞ্জলি অঞ্জলি জল এনে ঐ গর্তটা পোরাবার চেষ্টা করছে । অশেষ আয়াস এবং অনেকক্ষণ ছুটোছুটি চলতে লাগল । পণ্ডিতের দৃষ্টি সে দিকে আকৃষ্ট হল এবং বালক কি করছে, সেই বিষয় জানিবার কৌতুহল । নিকটে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, বালক, একি করছ ? বালক বললে, সমুদ্রের সব জলটা এই গর্তে আনছি । পণ্ডিত কথা শুনে না হেসে থাকতে পারলেন না, কিন্তু পরক্ষণেই ভাবতে লাগলেন, মনের দ্বারা মনাতীত বস্তু ধরবার প্রয়াস - আমারও কি এরূপ হচ্ছে না ? বিবেকানন্দ স্বামীজী বলতেন, “আমরা যেন সব গজ নিয়ে বেরিয়েছি । ভগবানকে ছেটে ছুটে মেপে বের করে বুঝে নেব ।’ তা হয় না । মন জড় । আমাদের ঋষিরা জানতেন - মনে সুক্ষ্ম জড় - এই স্থুল জড়টাকে চালাচ্ছেন, ইউরোপের অনেকের বিশ্বাস, মনই আত্মা । তা নয় । গীতা বলেন, এ সকল প্রশ্ন সমাধান করবার আগে উপযুক্ত অধিকারী হতে হবে । কিরূপে তা হওয়া যায় ? বিশ্ব-মনের বিশ্ব-ইচ্ছার সঙ্গে আপন ক্ষুদ্র মন ও ইচ্ছা একতানে যোগ করতে হবে । একটিতে যেমন ভাব, যেমন স্পন্দন হতে থাকবে, অপরটিতেও সেইরূপ ভাব ও স্পন্দন উত্থিত হবে । তবেই ক্ষুদ্র মনে বাসনাপ্রসূত জ্ঞানের বিঘ্নবাধাসকল দুরীভূত হয়ে বিশেষ শক্তি প্ৰকাশিত হবে । সেইজন্যই গীতোক্ত ধর্মের সমস্ত শক্তি এই শ্লোকে নিবদ্ধ -
“সর্বধর্মান্ পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্ৰজ ৷”


1.11) ভালবাসা ও মোহ


তিনি জগতের নিয়ন্তা । তার যা ইচ্ছা, আমারও সেই ইচ্ছা হোক, আমি আর কিছু চাই না । এই ভাবটা যিনি মনে দৃঢ় রাখেন, তিনি এই মহাশক্তির সঙ্গে সঙ্গে চলেন । তাঁরই অহঙ্কার দূর হয়, জ্ঞান আসে । কিন্তু অধিকাংশ সময় আমাদের ভেতর এর ঠিক বিপরীত ভাবই থাকে । বিশ্ব-ইচ্ছার সঙ্গে যুক্ত না হয়ে লড়ালড়ি করেই মরি কেবল বাসনার জন্যে । দেখ না, পরিবর্তন হচ্ছে জগতের নিয়ম, তা সকলেই জানে, কিন্তু তবু আমাদের প্রত্যেকের চেষ্টা হচ্ছে, যাতে অনিত্য শরীরটা চিরকাল থাকে । আমাদের ভালবাসাটাতেও কি এই ব্যাপার হয় না ? যাকে ভালবাসি, তার শরীর মনটাকে ধরে রাখবার চেষ্টা । আমরা ভালবাসার পাত্রের অনিত্য শরীর মনকে আপনার করে চিরকাল রাখতে চাই । সেইজন্যে আমাদের ভালবাসায় মোহ হয় । নতুবা ঠিক ভালবাসা ভগবানের অংশ, তাতে মোহ আসে না । প্রকৃত ভালবাসা হলে ভালবাসার পাত্রকে অনন্ত স্বাধীনতা দেয়, আমার করতে চায় না । এইরূপে মানুষ বাসনার বশীভূত হয়ে বিশ্ব-ইচ্ছার বিরুদ্ধে অনিত্য নিত্যকাল ধরে রাখতে চায় । ইহা মনে রেখো । ঈশপের একটি গল্প এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে । এক গরিব বৃদ্ধ একদিন একটা কাঠের বোঝা মাথায় করে অতি কষ্টে যাচ্ছিল । একে গরমিকাল, তাতে বোঝাটা অত্যন্ত ভারী, বৃদ্ধেরও অল্প শক্তি, বৃদ্ধ কিছুদূর গিয়ে ঘর্মাক্তদেহে শ্রান্ত হয়ে এক জায়গায় বসে পড়ল আর আপনার অদৃষ্টকে ধিক্কার দিয়ে বলতে লাগল – মৃত্যুও কি আমায় ভুলেছে ! বলতে বলতে বিকটাকার মৃত্যু এসে উপস্থিত, বৃদ্ধকে বললে – বৃদ্ধ, আমায় ডাকছিস্‌ কেন ? বৃদ্ধের বাঁচবার ইচ্ছা প্রাণে প্রাণে । আমতা আমতা করে সভয়ে বললে – মহাশয়, বোঝাটা বড় ভারী । একলা তুলতে পারছিলুম না । তাই তুলে দিতে আপনাকে ডেকেছি । আমাদেরও অনিত্য বিষয় ছাড়তে ঠিক এইরূপ হয় ।



2) বিষাদযোগ


গীতার আরম্ভটি বড় সুন্দর বলে বোধ হয় । দুই দল যুদ্ধার্থে প্রস্তুত, উভয় পক্ষে মহা মহা বীর রয়েছেন – সকলের এক এক শাঁখ ছিল, শাঁখের আওয়াজে তখন যোদ্ধা চেনা যেত । চারিদিকে শাঁখ বেজে উঠল । এমন সময় অর্জুন বললেন – দুই দলের মাঝখানে আমার রথ রাখ, দেখি, আমার সঙ্গে যুদ্ধ করবে কে ? তখনও তাঁহার মোহ আসে নি, সম্পূর্ণ সাহস ছিল । শ্রীকৃষ্ণ রথ রাখলেন । অর্জুন দেখলেন, বিপক্ষ দলে ইচ্ছামৃত্যু পিতামহ ভীষ্ম এসেছেন; যাঁর কাছ থেকে অস্ত্রবিদ্যা শিখেছেন সেই আচার্য দ্রোণ, অমর কৃপাচার্য, সমযোদ্ধা কর্ণ প্রভৃতি বীরগণ এসেছেন । কোন কোন টীকাকার বলেন, এই সব দেখে তাঁর একটু ভয় হয়েছিল । কারণ ভীষ্মের ইচ্ছামৃত্যু বর ও পরশুরামকে যুদ্ধে জয়ের কথা, সিন্ধু-রাজতনয় জয়দ্রথের উপর শিবের বিশেষ বরের কথা এবং কর্ণের পরাক্রমাদিও তাঁর অজ্ঞাত ছিল না । এইজন্যে বিচিত্র নয়, তাঁর ভয় হয়েছিল । তাঁরা এ কথার প্রমাণস্বরূপ আরও বলেন, গীতার একাদশ অধ্যায়ে অর্জুন যখন ভগবানের বিশ্বরূপ দেখেন, তখন বিশেষ করে দ্রোণ, ভীষ্ম, জয়দ্রথ ও কর্ণকে মৃত দেখেছিলেন । তাতেই অর্জুন সংগ্রামে নিজে জয়ী হবেন এবং জয়-পরাজয় প্রভৃতি সমস্ত ঘটনা ও কাজের পিছনে কার শক্তি বিদ্যমান, তা বুঝতে পারলেন । এখন একটা প্রশ্ন হতে পারে । সমস্ত গীতাশাস্ত্র শুনে অর্জুন কুরুক্ষেত্র সমরের ভীষণ হত্যা-কাণ্ড নিশ্চিন্তমনে করলেন ও দেখলেন । এতে তাঁর ধর্মভাব বা তদ্বিপরীত ভাব, কিসের পরিচয় পাওয়া গেল ? অতএব গীতাগ্রন্থ অর্জুনকে যুদ্ধে প্রবৃত্ত করবার জন্যে কতকপগুলি প্ররোচনাবাক্য-মাত্র এবং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে জ্ঞাতিবধস্বরূপ এই নৃশংস কার্যে প্রবৃত্ত করতে মিথ্যাকে সত্যরূপে প্রতিপন্ন করতেও কুণ্ঠিত হন নি । মানুষ খুন করা, বিশেষতঃ জ্ঞাতিবধ করা কি বড় একটা সৎকার্য ? উত্তরে বলা যেতে পারে, উদ্দেশ্য যদি মহৎ হয়, তবে এই মানুষ খুন করাতেই সত্য, ধর্ম ও যশোলাভ হয় । উদ্দেশ্য বুঝেই ভাল মন্দ । স্বদেশরক্ষার জন্যে যুদ্ধে নরহত্যা, স্ত্রীলোকের উপর অত্যাচার-নিবারণের জন্য অত্যাচারী পিশাচের প্রাণদণ্ড প্রভৃতি স্থলে নরহত্যাও মহৎ কাজ । চিতোর-অবরোধের সময় স্ত্রীলোকেরা চুল কেটে দিয়েছিল শক্ৰদের মারবার জন্যে ধনুকের গুণ হবে বলে । নরহত্যা উদ্দেশ্য হলেও এঁদের দেবী বলে পূজা করতে ইচ্ছা কি স্বতঃই হয় না ? কিন্তু নিজের সুখের জন্যে হত্যা করতে হত্যাকারীর মনই নীচু হয়ে নিষ্ঠুর পিশাচের ন্যায় হয় । অতএব ছোট-বড়, ভাল-মন্দ কর্মে বিদ্যমান নেই, কিন্তু কর্তার উদ্দেশ্য নিয়ে বিচারিত হয় ।

মনের আশ্চৰ্য গতি । একেবারে বিপরীত তিন-চারটে ভাবও এককালে মিলিত হয়ে মানবমনে উঠে থাকে, আমরা ধরতে পারি না । অৰ্জুনেরও তাই হয়েছিল । দ্রোণাচাৰ্য, ভীষ্ম, আত্মীয়স্বজনদিগকে যুদ্ধে হত্যা করতে হবে দেখে তার মোহ এসেছিল । ভালবাসা থেকেও বটে এবং পরাজয়ের ভয়েও বটে । হয়তো জয়টুকু তিনি ধরতে পারেন নি । ভালবাসায় মোহ এনে দেয় এবং মোহ অনেক সময় দুর্বলতা এনে মানুষকে কর্তব্য ও সত্যের পথ থেকে ভ্ৰষ্ট করে । যুদ্ধের পূর্বে অর্জুন সত্যের জন্য দাড়িয়েছিলেন, স্বার্থের জন্যে নয়, তিনি পাচখানা গ্রাম মাত্র নিয়ে সন্ধি করতে চেয়েছিলেন । যাতে যুদ্ধ না বাধে, তার জন্যে কত সচেষ্ট ছিলেন । যখন দেখলেন, যুদ্ধ না করলে অন্যায়, অবিচার ও অধর্মকে প্রশ্ৰয় দেওয়া হয়, তখনই তিনি সত্যের জন্য যুদ্ধ করতে দাঁড়িয়াছিলেন । অত্যাচার নিবারণ করা ক্ষত্রিয়ের ধর্ম । যেখানে অত্যাচার দেখবে, সেখানে তার প্রতিকার করবে । এ সংসারে সব এক সূত্রে বাঁধা । তোমাকে লাগলে আমাকে লাগবে । আমার উপর অত্যাচার দেখেও তুমি যদি চুপ করে থাক আর মনে কর, হয় হোক, আমার উপর তো হয়নি, আমার অপরের কথায় কাজ কি, তা হলে তুমি বিষম ভ্ৰমে পতিত । আমার সঙ্গে সঙ্গে তোমার উপরও অত্যাচার করা হল, বুঝতে হবে । তোমার মনের সদ্‌বৃত্তির উপর অত্যাচার করা হলো । আজ স্বার্থপরতায় অন্ধ হয়ে স্বেচ্ছায় অন্যায়ের প্রতিকার করলে না, কাল তোমার উপর যখন অত্যাচার হবে, তখন তোমার আর প্রতিকার করার সামর্থ্য থাকবে না । এইরূপে ধীরে ধীরে অবনতি এবং দাসত্বের পথে অগ্রসর হবে ।

যুদ্ধস্থলে অর্জুনের মোহ এল; বললেন, এ সুখের আর দরকার নেই । আত্মীয়স্বজনই যদি মরে গেল, তো রাজত্ব নিয়ে করব কি । শ্ৰীকৃষ্ণ দেখলেন, অর্জুন ভয়টুকু লুকুচ্ছেন আর আপনার জীবনের উদ্দেশ্য ভুলেছেন । মনে করেছেন, নিজের জন্যে লড়াই করতে দাড়িয়েছেন । তিনি যে সত্যের জন্যে দাড়িয়েছেন, অন্যের উপর অত্যাচার প্রতিবিধান করতে, কর্তব্য পালন করতে দাড়িয়েছেন, তা ভুলেছেন । পূর্বে পূর্বে বকরাক্ষস বধ ইত্যাদি স্থলে যেখানে যেখানে তাঁরা অন্যায় অবিচার দেখেছেন, সেখানেই ধৰ্মবোধে তার প্রতিবিধান করে এসেছেন । এখানে তা ভুলে গেছেন - মনে করেছেন, রাজ্য পাবার জন্যেই বুঝি যুদ্ধে দাড়িয়েছেন । সংসারে আমরা অনেক সময় এরূপ দেখতে পাই, রূপের মোহে, কাঞ্চনের মোহে ব্যস্ত হয়ে উদ্দেশ্য হারিয়ে বসে থাকি । যদি সাধনা থাকে, তবে সেই উদ্দেশ্য আবার ফিরে আসে বটে, তা না হলে কেবল ছুটোছুটিই সারা হয় । শ্ৰীকৃষ্ণ তাই দেখেই প্ৰথম দুটি শ্লোকে তঁকে বিশেষ শিক্ষা দিয়ে বলছেন -
“কুতস্ত্বা কশ্মলমিদং বিষমে সমুপস্থিতম ৷ অনার্যজুষ্টমস্বৰ্গ্যমকীৰ্তিকরমর্জুন ৷৷
ক্লৈব্যং মাস্ম গম: পাৰ্থ নৈতত্ত্বয্যুপপদ্যতে ৷ ক্ষুদ্ৰং হৃদয়দৌর্বল্যং ত্যত্ত্বোত্তিষ্ঠ পরস্তুপ ৷৷”
-“হে অর্জুন, এই সময়ে তোমার মোহ কোথা থেকে এল ? তোমার মত শ্ৰেষ্ঠ লোকের পথে বাঁধা দিতে এমন মোহ কেনই বা এল ? হে অর্জুন, এ ক্লীবতা ত্যাগ কর । এ হৃদয়ের দুর্বলতা তোমার মতন শক্তিমান পুরুষে শোভা পায় না । দূর করে দিয়ে ওঠ, লড়াই কর ।” ওই থেকে একটা বিশেষ উপদেশ আমরা পাই - যেটা মোহ আনে, দুর্বলতা আনে - সেইটাই মহাপাপ । মনের সম্বন্ধে যেমন, শরীরের সম্বন্ধেও তেমনি । শারীরিক দুর্বলতা যাতে আনে, সেটা করাও পাপ । আজকাল ছেলেদের পাশের পড়ার ঝোঁকে শরীরের দিকে কোন দৃষ্টি থাকে না । এটা যে একটা পাপ, সে ধারণা আমাদের নেই । বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছেলেরা বেরোবার পর আর তাদের শরীর বয় না । তার হাত-পা’র ব্যবহার একেবারে ভুলে যায় । ফল, অনেক কার্যে অক্ষমতা । শরীর-সম্বন্ধে দৃষ্টি রাখা বিশেষ দরকার । না রাখলে দুর্বলতা আনে । শরীর ও মনের সম্বন্ধে যা অত্যাচার করবে, তার ফল ভুগতে হবেই হবে ।

অর্জুন তারপর বলছেন, ভীষ্মের সঙ্গে যুদ্ধ করব কি করে ? গুরু দ্রোণকে মারব কি করে ? তারপরই দেখতে পেয়েছেন, মুখে যে ধর্মভানটা করছেন, মনে তা নেই (মন টের পায় কিনা ।) আর বলছেন
“কার্পণ্যদোষোপহতস্বভাবঃ পৃচ্ছামি ত্বাং ধর্মসংমূঢ়চেতাঃ ৷
যচ্ছ্রেয়ঃ স্যান্নিশ্চিতং ব্ৰুহি তন্মে শিষ্যস্তেহহং শাধি মাং ত্বাং প্ৰপন্নম্ ৷৷”
-“আমার কার্পণ্য-দোষ এসেছে, আমি দয়ার পাত্র হয়েছি । (কৃপণ-শব্দ দয়ার পাত্ৰ, এ অর্থে ব্যবহৃত হত ।) মনের আঁট গেছে । সব গুলিয়ে গিয়ে একটা দয়ার পাত্র হয়েছি । তাই প্রার্থনা করছি, অনুনয় করছি, আমি তোমার শিষ্য, শিক্ষা দাও ।” তখন শ্ৰীকৃষ্ণ অর্জুনের মনে গোলমাল কোথা হতে হয়েছে, তাই ধরে বলছেন -
“অশোচ্যানন্বশোচস্ত্বং প্রজ্ঞাবাদাংশ্চ ভাষসে ৷”
—“তুমি পণ্ডিতের মত কথা বলছ, কিন্তু পণ্ডিত যে জন্যে শোক করেন না, তুমি তারই জন্যে শোক করছ ।” এই দুই কথায় অৰ্জুনকে খুব ঘা দেওয়া হল । পণ্ডিতেরা কি বলেন ? কোনটা নিত্য ? শরীর তো পরিবর্তনশীল । পণ্ডিত লোক এই অনিত্য শরীরের জন্যে কখনই শোক করেন না । তুমি শোক করছ । অতএব তোমার মন-মুখ এক নয়, তুমি পণ্ডিত নও । আমরা ভগবান শ্ৰীকৃষ্ণের এই কয়টি কথায় ধৰ্মরাজ্যের আবশ্যকীয় প্রধান দুটো জিনিস দেখলুম । প্ৰথম, কোনরূপ দুর্বলতা আসতে দেওয়া হবে না । তা হলে উদ্দেশ্যলাভ বহুদূর । দ্বিতীয়, মন-মুখ এক করতে হবে । এই দুটো উপদেশ যদি জীবনে পালন করতে পারি, তা হলেই উন্নতির দ্বার মুক্ত হবে । যে যে পরিমাণে এই দুটো পালন করেছে, সে যেখানেই থাক্, সংসারে বা সংসারের বাইরে সেই পরিমাণে যথার্থ কাজ তার দ্বারাই হবে ।
[২০শে অগ্রহায়ণ, ১৩০৯ সালে কলিকাতা বিবেকানন্দ সমিতিতে প্ৰদত্ত বক্তৃতার সারাংশ]


3) জ্ঞানযোগ-১


গতবার আমরা দুটি কথা বিশেষরূপে শিখেছি । প্ৰথম দুর্বলতা, শারীরিকই হোক বা মানসিকই হোক; যা থেকে আসে, সে সমস্তই পাপ; অতএব তা একেবারে ত্যাগ করতে হবে, কারণ, সে সময়ে মানুষ মোহে আচ্ছন্ন হয়ে শাস্ত্ৰবাক্য, গুরুবাক্য প্রভৃতি সব ভুলে যায় । দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, মন-মুখ এক করতে হবে অর্থাৎ পণ্ডিতের মত কথা বলা অথচ কাজে অন্য রকম করা চলবে না । পরমহংসদেব বলতেন, মন-মুখ এক করাই প্ৰধান সাধন । সকল স্থানে সব বিষয়েই এ সত্য । কি ধর্ম-সম্বন্ধে, কি সাংসারিক বিষয়সম্বন্ধে, সব জায়গায় এর দরকার । অনেকে হয়ত বলবেন যে, মন-মুখ এক করে ধর্ম কর্ম হতে পারে, কিন্তু সংসার করা চলে না । কিন্তু সেটি ভুল । জগতের নানা বিষয়ের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে আজকাল মানুষ বেশ বুঝতে পারছে, বাণিজ্য ব্যবসায় প্রভৃতি ঘোর সাংসারিক বিষয়েও যে যত পরিমাণে উদ্যম আনতে পারবে, যত পরিমাণে মন-মুখ এক করে খাটতে পারবে, তত পরিমাণে তার উন্নতি ।

গীতা-সম্বন্ধে আর একটি কথা জানা আবশ্যক । যুদ্ধক্ষেত্রে ভগবান শ্ৰীকৃষ্ণ অর্জুনকে গীতা বলেছিলেন । সে কথা শুনলেই বা কে, লিখলেই বা কে ? যুদ্ধক্ষেত্রে তো ব্যাসও ছিলেন না, সঞ্জয়ও ছিলেন না, অথচ গীতাপাঠে দেখতে পাই, রাজা ধৃতরাষ্ট্রের অনুচর সঞ্জয় তাঁর প্রভুকে গীতা বলছেন আর মহর্ষি ব্যাস তা শ্লোকাকারে মহাভারতনিবদ্ধ করেছেন। তাঁরা জানলেন কি রকম করে ? গল্প আছে, ধৃতরাষ্ট্র অন্ধ ছিলেন । কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের বিবরণ জানবার জন্যে মহর্ষি বেদব্যাসের নিকট প্রার্থনা করায় ব্যাস তঁকে দিব্যদৃষ্টি দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তিনি তা নিলেন না । তখন মহর্ষি ব্যাস তাঁর বাসনা পূর্ণ করার জন্যে ঐ যোগদৃষ্টি সঞ্জয়কে দিয়েছিলেন । তাই সঞ্জয় যুদ্ধক্ষেত্রের সব ব্যাপার দেখছেন আর ধৃতরাষ্ট্রকে বলছেন ।

আজকার বিষয় জ্ঞানযোগ । মানুষের যখন মোহ আসে, তখন আত্মজ্ঞান ছাড়া আর কিছুই তাকে ঠিক পথে নিয়ে যেতে পারে না । যখন আত্মীয়-স্বজন কেউ মরে যায় বা জীবনপ্রবাহের একটা ভয়ানক পরিবর্তনরূপ আবর্ত এসে উপস্থিত হয় আর ক্ষুদ্র মানুষের যত কিছু মতলব একঘায়ে সব ভেঙ্গে দেয়, সেই শোকের সময় আত্মজ্ঞান যদি কারও থাকে, তবেই সে ঠিক থাকতে পারে । এইরূপ পরিবর্তন সকলেরই জীবনে কখন না কখন এসেছে বা আসবে । অর্জুনের জীবনে এই মহাসমর সেই পরিবর্তন এনেছিল । ভগবান শ্ৰীকৃষ্ণের উপদেশে আত্মজ্ঞানসহায়ে বীরাগ্রণী অর্জুন জীবনের এই মহাসন্ধিস্থল সহজে উত্তীর্ণ হয়ে উন্নতির দিকে ধাবিত হয়েছিলেন । কিন্তু কত লোকই না ঐরূপ স্থলে আশার আলোক না দেখতে পেয়ে পথহারা হয়ে অবনতি ও মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছে । সে জন্যে গীতার প্রথমেই আত্মজ্ঞানের উপদেশ । অর্জুনের প্ৰতিও বটে, আর সর্বদেশের, সৰ্বকালের, সকল মানবের প্রতিও বটে । এইজন্যে পরমহংসদেবও শিক্ষা দিতেন, “অদ্বৈতজ্ঞান আঁচলে বেঁধে যা ইচ্ছা তাই কর ।” সংসারের মধ্যে সব পরিবর্তনশীল । জড়রাজ্যের অন্তর্ভূত সকলেই এই নিয়মের অধীন । কোথায় যাচ্ছে কি উদ্দেশ্যে, কে বলতে পারে ? পরিণামবাদীরা (Evolutionists) বলেন, ক্রমোন্নতি হচ্ছে; হবার উদ্দেশ্য কি, তা বলতে পারেন না । বীজ থেকে গাছ, ফুল, ফল হচ্ছে; এর উদ্দেশ্য কি ? কিসের জন্য এ খেলা ? মানুষের মনে সর্বযুগে সর্বদাই এই প্রশ্ন উদিত হয়েছে ও হচ্ছে, কিন্তু এ পর্যন্ত কোন উত্তর পায় নাই । ইউরোপের পণ্ডিতেরা বলেন, এর উদ্দেশ্য এক অপূর্ব সর্বাঙ্গসুসম্পন্ন সমাজ শরীর গঠন করা । আমাদের শাস্ত্ৰে বলে, এই যে সৃষ্টি, স্থিতি ও লয়ের শৃঙ্খলরূপ বিচিত্র জগৎকার্য চলেছে, এ অনাদি । এই যে ব্যাপার, এ ভগবানের দিক থেকে দেখলে উদ্দেশ্যবিহীন লীলাবিলাস বা খেলামাত্ৰ বোধ হয়, কারণ বিশ্বসৃজনে ভগবানের কোন এক উদ্দেশ্য-সাধনের ইচ্ছা আছে বললে তাঁতে অপূর্ণতা-দোষ উপস্থিত হয় । তাই শাস্ত্রকারেরা বলেন, সৃষ্টি তাঁর খেলা মাত্র । তিনি যে সৃষ্টি করে বড় হলেন বা ছোট হলেন, তা নয় । কিন্তু আমাদের দিক থেকে দেখলে অর্থাৎ মানুষ এ জগতে এসে নানা চেষ্টা কেন করছে, এ কথা ভাবলে উদ্দেশ্য এই বোধ হয়, সংসারবন্ধন কেটে আত্মজ্ঞান লাভ করা, পূর্ণত্ব লাভ করে সমস্ত দুঃখকষ্টের হাত অতিক্রম করা । সঙ্গে সঙ্গে এও বলা যায় যে, ঐরূপ ইন্দ্ৰিয়জিৎ, আত্মজ্ঞানী, সর্ববিষয়ে সম্পূর্ণ জীবন্মুক্ত মনুষ্যসমাজ সর্বাঙ্গপূর্ণ হবে অর্থাৎ সে সমাজে সকল অঙ্গের মনের ভিতরের অভাব সম্পূর্ণরূপে দূর হওয়ায় সদা শান্তি ও আনন্দ বর্তমান থাকবে ।

শ্ৰীকৃষ্ণ যখন দেখলেন, অর্জুনের এ মোহ আত্মজ্ঞান ভিন্ন যাবার নয়, তখন তিনি বললেন -
“ন ত্বেবাহং জাতু নাসং ন ত্বং নেমে জনাধিপাঃ ৷”
- তুমি, আমি যে কখন ছিলাম না বা থাকব না, তা নয় । আত্মা অজর, অমর । এই শরীর জড় । যে জিনিস জড় হতে উৎপন্ন, তাকে জড়ের নিয়মে থাকতে হবে । যা সূক্ষ্ম, জড় অর্থাৎ মন হতে প্রসূত, তা সূক্ষ্মের নিয়মে চলবে । যা জড় হতে উদ্ভূত, তাকে নিত্যকাল ধরে রাখবার চেষ্টা বৃথা । জড়ের নিয়ম পরিবর্তনশীলতা । তাকে পরিবর্তিত হতে দেব না, একভাবে চিরকাল রাখব, এ চেষ্টা মূর্খের কাজ, অজ্ঞানের কাজ । সংসারে এ চেষ্টা প্ৰতিনিয়ত হচ্ছে । কোন সময়ে যুধিষ্টিরকে বকরূপী ধর্ম জিজ্ঞাসা করেছিলেন, জগতে আশ্চৰ্য কি ? যুধিষ্ঠির উত্তর দিলেন -
“অহন্যহনি ভূতানি গচ্ছন্তি যমমন্দিরং ৷
শেষাঃ স্থিরত্বমিচ্ছস্তি কিমাশ্চৰ্যমতঃপরম্ ৷”
- রোজ রোজ লোক মরছে, দেখতে পাচ্ছি । সংসারের মধ্যে এমন কেউ নেই যে একজনকে-না-একজনকে মরতে দেখেনি । তবু সকলেই এমনভাবে কাজ করছে যেন সে অমর । সকলের ভেতরেই এই জড় শরীরকে চিরকাল ধরে রাখবার বাঞ্ছা ।

জড়ের ষড়বিকার আছে । জন্ম, কিছুকাল অস্তিত্ব, বৃদ্ধি, পরিণতি বা সুপক্কাবস্থা, ক্ষয় বা হ্রাস ও বিনাশ - এই ছয় অবস্থাভেদ । শাস্ত্র বলেন, মনও সূক্ষ্ম জড় হতে তৈরি । অনেক ইউরোপীয় পণ্ডিত বলেন, Mind, Spirit, Soul – সব একই জিনিস । আমাদের দেশে চাৰ্বাকের মতও তাই ! মন বা আত্মা মস্তিষ্কের কার্য মাত্র । মস্তিষ্কের সঙ্গে সঙ্গে এর উৎপত্তি ও লয় হয়ে থাকে । কোন কোন পরিণামবাদী পণ্ডিত বলেন, মনটা মস্তিষ্কের কাৰ্যমাত্র নয়, ও এক স্বতন্ত্র পদার্থ - ঐ সর্বদা “আমি”, “আমি” করছে, এবং ঐ আত্মা । কিন্তু প্ৰত্যক্ষ দেখতে পাচ্ছি, মানসিক শক্তির হ্রাস-বৃদ্ধি আছে । মনও জড়ের ন্যায় পরিবর্তনশীল-এ কিরূপে আত্মা হবে ? অতএব শাস্ত্রকারেরা বলেন, আত্মা স্বতন্ত্র পদার্থ । শরীরের দ্বারা যেমন, মনের দ্বারাও তেমনি কাজ করাচ্ছেন বা চালাচ্ছেন । প্রশ্ন হতে পারে - মন খারাপ হলে পাগল হয়; - আত্মা যদি মন থেকে স্বতন্ত্র পদার্থই হবে, তবে শরীরের এবং মনের পরিবর্তন তাতে লাগে কেন ? তাকে অন্যরূপ করে দেয় কেন ? উত্তরে বলা যেতে পারে, আত্মা কিছুতেই পরিবতিত হন না; তবে যে পরিবর্তন দেখা যায়, তার অন্য কারণ আছে । ধর - একজন একটা বেহালা বাজাচ্ছে, হঠাৎ তার ছিঁড়ে গেল, আর বাজল না । এ স্থলে যে বাজাচ্ছে, তার দোষ, না, বেহালার দোষ ? সেইরূপ আত্মা রূপ-রস-গন্ধ প্ৰভৃতি ভোগ করবার জন্যে মন ও দেহরূপ যন্ত্র সৃষ্টি করেছে । এ বিকল হলে আর কাজ হয় না । কিন্তু যন্ত্র বিকল হয়ে পুর্বের ন্যায় আওয়াজ না বেরুলেও আত্মা যন্ত্রী যেমন তেমনি থাকে । আমাদের শাস্ত্র এইরূপে শরীর ও মন হতে আত্মার পার্থক্য দেখিয়েছেন । শরীর ও মন জড়, আত্মা চিৎ বা জ্ঞানস্বরূপ । শরীরের ন্যায় মনেরও উৎপত্তি, স্থিতি এবং বিনাশ । আত্মা নিত্য ও অবিনাশী ।
“নিত্যঃ সৰ্বগতঃ স্থাণুরচলোহয়ং সনাতনঃ ৷”
- ‘আত্মা নিত্য, পরিবর্তনরহিত এবং সকলের মধ্যে একভাবে রয়েছেন ।
“দেহিনোহস্মিন্ যথা দেহে কৌমারং যৌবনং জরা ৷
তথা দেহান্তরপ্রাপ্তির্ধীরস্তত্ৰ ন মুহ্যতি ৷৷”
— ‘এই দেহীর দেহে যেমন কৌমার, যৌবন, জরা আসছে, মরে গেলেও তেমনি একটি দেহ আসে অথবা পুনর্জন্ম হয় । আমাদের শরীরের যেমন বৃদ্ধি, পূর্ণতা এবং হ্রাস-রূপ নানা পরিবর্তন আছে, দেহান্তরপ্রাপ্ত হওয়াও তেমনি একটা ।’ শাস্ত্র আরও বলেন যে, একথা আমরা যোগের দ্বারা প্ৰত্যক্ষ জানতে পারি ।

আত্মা পরিবর্তিত হন না । জিজ্ঞাসা করা যেতে পারে, তবে ভোক্তা কাকে বলি ? কে ভোগ করছে ? কে সুখী, দুঃখী হচ্ছে ? বেদ বলেন, যতক্ষণ আত্মা আপনাকে ইন্দ্ৰিয় ও মন-যুক্ত বোধ করেন, ততক্ষণই তিনি ভোক্তা থাকেন; যখন ইন্দ্ৰিয় ও মনের সহিত সম্বন্ধ ঘুচে যায়, তখনই আত্মা আপনার যথার্থ পূর্ণস্বরূপ অনুভব করেন । শাস্ত্রে তাই বলে, আমরা যে আপনাদিগকে মন ও ইন্দ্ৰিয়-যুক্ত ভাবছি, এটাই আমাদের কারণ-শরীর । কেননা, যথার্থ আমরা কে, একথাটি ভুলে গিয়ে যদি আমরা আমাদিগকে শরীর ও মন-বিশিষ্ট বলে না ভাবতুম, তা হলে অজ্ঞান, দুঃখ ও মৃত্যু প্রভৃতি কিছুই আমাদিগকে স্পর্শ করত না । ঐ ভুলে যাওয়াটাই যত নষ্টের গোড়া, অতএব ঐটেই কারণ-শরীর । কেবলমাত্র জ্ঞানলাভেই এই শরীরের নাশ হতে পারে, অন্য কোন উপায়ে হয় না । কিন্তু আপনার স্বরূপ ভুলে গেলেও আত্মার বাস্তবিক ক্ষতি বৃদ্ধি নেই, আত্মা চিরকাল পূর্ণ । মনবিশিষ্ট, ইন্দ্ৰিয়বিশিষ্ট বলে ভাবলেই কি যথার্থ তাই হবে ? না, আত্মা যেমন তেমনি ঠিক আছে । পরমহংসদেব বলতেন, যেমন চকমকি পাথর চারশ’ বছর জলের ভেতর রাখ, তুলে এনে ঠুকলেই যে-কে সেই, আগুন বেরুচ্ছে, আত্মাও ঠিক তাই । শরীর মনকে যখনই দেখে বন্ধন, তখনই তা ফেলে দিয়ে আপনি কে, জেনে নেয় । আমরা সংসাররূপ স্বপ্ন দেখছি । স্বপ্নও তো নানারকম দেখি । যেন আমি মরে গেছি, যেন আমায় একজন কেটে ফেলেছে, রক্তের ধারা বয়ে যাচ্ছে আর কাটা মুণ্ড ও ধড়টা সামনে পড়ে রয়েছে, আবার জাগলেই কোথাও কিছু নেই । স্বপ্ন ভেঙ্গে যায় । সকলেই একদিন তেমনি জেগে উঠবে । সেইজন্যেই শাস্ত্রকার যাস্ক বলেন, আত্মজ্ঞানে আৰ্য, মেচ্ছ, ব্ৰাহ্মণ, শূদ্ৰ সকলের সমান অধিকার । সকলকে তা শিখাও । কে জানে, কার আত্মা কখন জাগরিত হবে ? পরমহংসদেব বলতেন, যদি তীব্ৰ বৈরাগ্যের উদয় হয় তো তিন বছরে, তিন মাসে বা তিনদিনেও আত্মজ্ঞান লাভ হতে পারে ।
গীতাও বলেন -
“স্থিত্বাস্যামন্তকালেহপি ব্ৰহ্মনিৰ্বাণমৃচ্ছতি ৷”
- মৃত্যুকালে যদি ক্ষণমাত্রও এই জ্ঞানের উদয় হয় তো সমস্ত অজ্ঞান নাশ হয়ে ব্ৰহ্মের সাহিত মিলিত হয় ।”

এই আত্মজ্ঞানই বেদের মূলভিত্তি, ভারতের একমাত্র জাতীয় ধন । ভারত হতেই অপরাপর দেশে এই জ্ঞানের প্রচার হয়েছে । যেদিন ভারত এই জ্ঞানের কথা ভুলবে, সেদিন জাতীয়ত্বের সঙ্গে সঙ্গে তারও নাশ হবে । অপরাপর দেশের লোকের এই জ্ঞান যথাযথ বুঝতে এবং অনুভব করতে এখনও ঢের দেরি । ধৰ্মরাজ্যে এখনও আমরা জগতের গুরুস্থানীয় রয়েছি । ইংরেজ প্ৰভৃতি অপরাপর জাতকে বাণিজ্য, রাজনীতি, যুদ্ধাদি অপর সমস্ত বিষয়ে গুরু স্বীকার করে শিক্ষা করো, কিন্তু ধর্মে এ স্থানটা অধিকার করবার এখনও তারা উপযুক্ত হয় নি । ধর্মের জীবন্ত মুর্তি পরমহংসদেব প্রমুখ সাধুদের ছেড়ে বিদেশী, বিধর্মীর নিকট আপন ধর্মের মহিমা শুনতে যাওয়ার চেয়ে মুর্খতা আর কি হতে পারে ? আজকাল কোন কোন সম্প্রদায় বৈদিক ধর্মের দুচারটে তত্ত্ব আপনাদের ভিতর উল্টো করে ঢুকিয়ে নিয়ে যথার্থ ধৰ্ম বলে শিক্ষা দিচ্ছে । কেউ বা বলছে, এককোটি জন্মের পর মানুষ চাক আর নাই চাক, মুক্ত হবেই হবে এবং তার আত্মজ্ঞান হবে । এরূপ কর্মবাদ, ঘোর অদৃষ্টবাদ ভিন্ন আর কিছুই নয় । বেদ কখনো এরূপ শিক্ষা দেন না । বেদ বলেন, মানুষ মনে করলে এখনি মুক্ত হতে পারে, অথবা না মনে করলে অনন্তকাল স্বপ্ন দেখতে পারে । মানুষের মুক্তি হবার একটা নির্দিষ্ট সময় কোথাও দেওয়া হয়নি । পুরাণাদিতেও বলা আছে মাত্র যে, চুরাশি লক্ষ যোনি ভ্ৰমণ করে জীব মনুষ্যজন্ম পায় । মুক্তির একটা নির্দিষ্ট সময় কেমন করেই বা হতে পারে ? জন্মমরণাদিতে আত্মার তো কোন দোষ বাস্তবিক লাগেনি । আত্মা যেন নিদ্রিত; যেদিন ঘুম ভাঙ্গবে, সেদিন মুক্ত হবে । আত্মা সর্বশক্তির আধার; যেদিন তা উপলব্ধি করবে, যেদিন জানবে আমি রাজার ছেলে, সেদিনই স্বস্থানে চলে যাবে, আপন মহিমায় বর্তমান থাকবে । কোন কোন সম্প্রদায় বলছেন, “চিরতুষারাবৃত গিরিশৃঙ্গনিবাসী মুক্তাত্মাদিগের সহিত তাঁহারা বিশেষ সম্বন্ধে অবস্থিত । নিত্য তাঁহাদের সহিত দর্শন, স্পর্শন এবং পত্রপ্রেরণাদি পর্যন্তও হইয়া থাকে।’ বেশ কথা; হয়ে থাকে হোক ! কিন্তু বেদপুরাণাদি ধর্মগ্রন্থে যখন তাঁদের কিছুমাত্র নামগন্ধ নেই, তখন তাঁদের পরিচয় নেবার জন্যে আমাদের ব্যগ্র হবার প্রয়োজন নেই । আয়ু অল্প; যে যা বলবে, তাই নিয়েই দুটোছুটি করে হয়রান হবার সময় কোথা ?

আত্মায় সুখদুঃখের লেশ লাগছে না; তিনি পূর্ণ । কিন্তু শরীর এই জড় রাজ্যের নিয়ম অনুযায়ী পরিবর্তিত হচ্ছে । এখন প্রশ্ন হতে পারে, মানুষের মরবার সময় কি হয় ? স্থুল শরীরটা, যেটা নিয়ে মন খেলছে, তখন একেবারে বিকল হয়ে যায়, — তখন লোকে ছেঁড়া কাপড় ছেড়ে ফেলে দিয়ে যেমন নূতন কাপড় পরে; আত্মা তেমনি জীর্ণ শরীর ত্যাগ করে নূতন শরীর ধারণ করে আর এই শরীরে যে সমস্ত চিন্তা, চেষ্টা ও কাৰ্য করা হল, তার সংস্কার মনের সঙ্গে থেকে যায় । মন, বুদ্ধি, দশ ইন্দ্ৰিয় এবং রূপরসাদির সংস্কার - এইগুলি আত্মার সূক্ষ্ম শরীর । সূক্ষ্ম শরীর সূক্ষ্ম জড়ে প্ৰস্তুত । মন ও ইন্দ্ৰিয়াদি-বিশিষ্ট সূক্ষ্ম শরীর স্থুল শরীরের মৃত্যুতে নষ্ট হয় না, মৃত্যুর পরেও আত্মার সহিত সংযুক্ত থাকে । অথবা স্থুল শরীরটা ফেলে দিলে আত্মার, আমি শরীর ও ইন্দ্ৰিয়বান, এ বোধ নাশ হয় না । তখন পূর্ব শরীরের সংস্কারানুযায়ী হয়ে আত্মার অন্য একটা স্থুল শরীর ধারণের বা গঠনের ইচ্ছা হয় এবং যে পিতা-মাতার ঔরসে জন্মিলে আপন সংস্কার-বিকাশের উপযোগী শরীর পাওয়া যাবে, তাঁদের নিকট আকৃষ্ট হয় । পূর্বানুষ্ঠিত কৰ্মই তাকে আকর্ষণ করে নিয়ে যায় । ঐ সূক্ষ্ম শরীরের দৈর্ঘ্য, বিস্তার বা গুরুত্বাদি নাই এবং গর্ভধানের দিন হতেই মাতৃগর্ভে অবস্থান করে । সুক্ষ্ম শরীর চক্ষু দিয়ে দেখা যায় না বটে, কিন্তু সেটাও জড় । বায়ু এবং আকাশের চেয়েও তা সূক্ষ্ম । মৃত্যুর পূর্বে স্থুল শরীরের সাহায্যে যতদূর শিখে গেছে, নূতন জন্মে নূতন স্থূল শরীর পেয়ে আত্মা তার পর থেকে কাজ আরম্ভ করে এবং জ্ঞানলাভ করতে থাকে ।

পুর্বে যা বলা হল, তা থেকেই বেশ বোঝা যায়, কেন আমরা সকলে সমান বিদ্যাবুদ্ধি সম্পদ নিয়ে সকল বিষয়ে সমান হয়ে সংসারে জন্মাই না, কেনই বা সংসারে একটি মানুষের শরীর মন আর একটির সঙ্গে সমান হয় না ? কেনই বা মানসিক, আধ্যাত্মিক, সকল বিষয়েই আমাদের ভিতর স্বাভাবিক প্রভেদ বর্তমান ? পুনর্জন্মবাদ হতেই এর বেশ মীমাংসা হয় । পিতার দোষগুণ সন্তানে আসে, এই কথা বলে আধুনিক ইউরোপীয় পণ্ডিত এই সর্ববাদিপ্রত্যক্ষ ভেদ বা বৈষম্যের মীমাংসা করেন, কারণ, শারীরিক নানা প্রকার রোগ, মানসিক অশেষবিধ দোষ বা গুণ পিতা হতে অনেক পরিমাণে সন্তানে আসে - এ বিষয়ে সন্দেহ নেই । যে সব স্থলে দেখা যায়, ছেলে বাপের মত আদৌ নয়, সেখানে তাঁরা শিক্ষার তারতম্য বলে বোঝাবার চেষ্টা করেন । এইরূপে দোষটা সব বাপের ও গুরুর উপর এসে পড়ে । তাঁরা উক্ত ব্যক্তিগত বৈষম্যের অন্য সমাধান দিতে পারেন না । আমাদের শাস্ত্ৰ বলেন, এ প্রভেদ কৰ্ম-অনুসারে হয় । মানুষ যখনি যে কাজ করে, তা কোন বিশেষ উদ্দেশ্যে করে এবং এ উদ্দেশ্য লাভ করতে তার নিজের ভেতরের এবং বাইরের কতকগুলি শক্তিকে এক বিশেষভাবে চালিত করে থাকে । ঐ সকল শক্তি যখন জাগরিত ও চালিত হল, তখন ফলস্বরূপ কতকগুলি পরিবর্তন এনে দেবেই দেবে । ঐ পরিবর্তনগুলিকে আবার তার মন ভাল বা মন্দ, সুখ বা দুঃখ বলে বোঝে বা অনুভব করে । যদি ভাল বা সুখ বলে বোঝে, তো মন সেগুলিকে চিরকাল ধরে নিজস্ব করে রাখতে চায় । আর যদি মন্দ বা দুঃখ বলে বোঝে বা ভবিষ্যতে সেগুলি নিশ্চিত দুঃখ এনে দেবে এমনও বোঝে, তা হলে মন সেগুলিকে যে-কোন উপায়ে হোক, তাড়াবার চেষ্টা করে । এইরূপে বীজ থেকে যেমন গাছ হয়, আবার সেই গাছে ফুল, ফল ও বীজ উৎপন্ন হয়, সেইরূপ এক কর্ম হতে সুখ বা দুঃখভোগ এবং অপর কর্মও এসে উপস্থিত হয় । অনেক কর্মের ফল বা সুখদুঃখভোগ হবার এ জন্মে সময় হল না, দেখতে পাওয়া যায় । কাজেই তা পরজন্মে হয়ে থাকে ।


কর্মের বিভাগ


বেদান্তে মনুষ্যকৃত সকল কর্মের পাঁচ ভাগে বিভাগ করা হয়েছে, যথা — (i)নিত্য, (ii)আগামী, (iii)সঞ্চিত, (iv)প্রারব্ধ ও (v)প্রতিষিদ্ধ । 
(i) নিত্য কর্ম শৌচসন্ধ্যাদি প্ৰত্যহ করতেই হয় । করলে বিশেষ ফল নেই, না করলে দোষ আছে ।
(ii) প্রতিষিদ্ধ কর্মগুলি করতে শাস্ত্ৰ নিষেধ করেন, যেমন - চুরি করো না, খুন করে না ইত্যাদি ।
(iii) সঞ্চিত কর্মগুলি মানুষ পূর্ব পূর্ব জন্মে করে ফেলেছে । কিন্তু এখনও তাদের ফলযোগ করতে বাকি রয়েছে ।
(iv) তাদেরই মধ্যে (অর্থাৎ পূর্ব জন্মের সঞ্চিত কর্মের) কতকগুলির ফলভোগ-স্বরূপ মানুষ এ জন্মে ভাল বা মন্দ শরীর, মন ও নানা চেষ্টা প্ৰাপ্ত হয়েছে । এইগুলির নামই প্রারব্ধ
(v) আর এই জন্মে অনুষ্ঠিত কর্মগুলিকে বা যে কৰ্মগুলির ফলে পরজন্ম হবে, তাদের আগামী কর্ম বলা হয়েছে ।
আগামী, সঞ্চিত ও প্রারব্ধ - এই তিন প্ৰকার কর্ম বোঝাবার জন্যে শ্ৰীমৎ শঙ্করাচার্য তাঁর রচিত গ্রন্থে একটি বেশ দৃষ্টান্ত দিয়েছেন । যথা - একজন লোক ধনুক ধরে তীর ছুঁড়ছে । একটা তীর ছুঁড়ে ফেলেছে । একটা ছুঁড়বে মনে করে ধনুকে লাগিয়েছে আর কতকগুলো তার পিঠে বাঁধা-তুণে রয়েছে । যেটা ছুঁড়ে ফেলেছে, সেটা যেখানে হয় লাগবে । ঐ তীরটার সঙ্গে প্রারব্ধ কর্মের তুলনা করা যেতে পারে । ঐ কর্মের উপর মানুষের কোন হাত নেই । ঐ কর্মের ফল তার শরীর মন ভোগ করবেই করবে । ইচ্ছা করলেও সে ঐ ফলভোগ রোধ করতে পারবে না । সেই জন্যে মুক্ত পুরুষেরা আত্মজ্ঞান লাভ করেও প্রারব্ধ কর্মের ফল শরীরে ভোগ করেন ।

যে তীরটা ছুঁড়বে বলে হাতে নিয়েছে সেটাকে আগামী কর্মের সঙ্গে তুলনা করা যায় । ঐ তীরটা যেমন সে ছুঁড়তেও পারে, না ছুঁড়তেও পারে সেইরূপ আগামী কর্ম মানুষ ইচ্ছা করলে রোধ করতে পারে । যে তীরগুলি পিঠে বাঁধা রয়েছে, সেইগুলোর সঙ্গে তার সঞ্চিত কর্মের তুলনা হতে পারে ।

শাস্ত্ৰকার বলেন, যে কৰ্ম করছ তার ফলভোগ করতেই হবে । একটা কৰ্ম আবার অন্য কর্ম প্ৰসব করে । এইরূপে কৰ্ম-বন্ধন দিনে দিনে, জন্মে জন্মে বাড়তে থাকে । এর শেষ কবে হবে ? যেদিন আত্মজ্ঞানলাভ হবে - মানুষ যেদিন দেখবে সে অখণ্ড, অবিনাশী, জরামরণরহিত পূৰ্ণানন্দময় আত্মা । সে কখনও ভোগ করেও নি, করবেও না । শরীর ও মনই এতকাল কাজ করেছে ও ভোগ করেছে । জবাফুলের পাশে থাকাতেই রংটা কাচের গায়ে লেগেছে, কাচটা লাল দেখিয়েছে, তা বাস্তবিক কাচের রঙ নয় । অথচ শুদ্ধরূপ আত্মা আছেন বলেই সব কাজকর্ম চলছে । অতএব জ্ঞানলাভ হলেই আর কোন কর্মের জোর চলে না, সমুদয় সেই কর্ম শেষ হয়ে যায়, জ্ঞানাগ্নির তেজে সমুদয় ভস্ম হয়ে যায় ।
“সৰ্বং কর্মাখিলং পার্থ জ্ঞানে পরিসমাপ্যতে ৷”
“জ্ঞানাগ্নিঃ সৰ্বকৰ্মাণি ভস্মসাৎ কুরুতে তথা ৷”
এই জ্ঞানলাভই আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য । সুখই ভোগ কর বা দুঃখই ভোগ কর, তোমার জীবনের উদ্দেশ্য ওদুটোর একটাও নয় । সংসারেই থাকুক বা সন্ন্যাসীই হোক, ছাত্র-জীবনের মধ্যে বা ব্যবসায়-বাণিজ্যের ছুটোছুটির ভেতর যেখানেই থাকুক না কেন, মানুষ সকল অবস্থায় এমন ভাবে কাজ করতে পারে, যাতে তার প্রত্যেক কাজই তাকে জ্ঞানের পথে এগিয়ে দেবে । লোকে মনে করে বটে, কিন্তু ধর্ম জিনিসটা সংসার থেকে আলাদা করে রাখবার জো নেই । এটা বোঝাবার জন্যেই যেন গীতার উপদেশ আরম্ভ হয়েছে রণভূমিতে, যেথায় হিংসা-দ্বেষের তরঙ্গ গর্জাচ্ছে । উদ্যমরহিত হয়ে থাকবার অবকাশ মাত্র নেই এবং মানব-মনের পৈশাচিক প্ৰবৃত্তিগুলোই নিঃসঙ্কোচে খেলতে দাড়িয়েছে । এখানে যদি ধর্মের সর্বোচ্চ উপদেশ ও অনুষ্ঠান চলে, তবে সংসারে আর এমন কোন স্থান আছে, যেখানে তা চলবে না ? যে ধর্ম সকলের জন্যে নয়, সে ধর্ম কে চায় ? তুমি সুখে থাক, শান্তি পাও আর আমি দুঃখ-কষ্টে মরি, এ শাস্ত্রকারের ইচ্ছা নয় । যথার্থ ধর্মের অনুষ্ঠান, গৃহস্থজীবনে বা সন্ন্যাস নিয়ে; সব জায়গায় চলবে । ধর্ম সকলকে এক জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে এবং বুঝিয়ে দিচ্ছে, ‘মানুষ তুমি যে পূর্ণস্বরূপ, তাই আছ, হাজারই কেন মনে কর না তুমি ক্ষুদ্র, তোমার শরীর আছে, তোমার সুখদুঃখ-ভোগ হচ্ছে, তুমি মরবে ইত্যাদি, তুমি যা তাই আছ ও থাকবে ।’ ধৰ্ম বলছেন -
“য এনং বেত্তি হন্তারং যশ্চৈনং মন্যতে হতম্‌ ৷
উভৌ তৌ ন বিজানীতো নায়ং হন্তি ন হন্যতে ৷৷”
- ‘যে কেউ আত্মাকে হস্তা বলে মনে করেন কিংবা মনে করেন আত্মা মরে, তাঁরা উভয়েই আত্মাকে জানেন না, আত্মা জন্মেনও না, মরেনও না ।’
- ‘(আত্মা) কখনও জন্মেন না, বা মরেনও না ।’
“বেদাবিনাশিনং নিতং য এনমজমব্যয়ম্‌ ৷
কথং স পুরুষঃ পাৰ্থ কং ঘাতয়তি হস্তি কম্‌ ৷৷”
— ‘যিনি নিত্যস্বরূপ আত্মাকে জানেন, তিনি কাকেই বা মারবেন, কার দ্বারাই বা হত হবেন ?’ তিনি কিছুই করেন না । তাঁর শরীর-মন আমরণ আপনা-আপনি কাজ করে চলে যায় । সৎকাজ, পরোপকার প্রভৃতি তাঁর স্বভাবসিদ্ধ হয়ে যায় ।

দেখা গেল, আত্মজ্ঞান মানুষকে সুখদুঃখের পারে নিয়ে যায় । সেইজন্য মানুষ যখন শোকে মোহে অবশ হয়ে পড়ে তখন আত্মজ্ঞান উপলব্ধি করিয়ে দেওয়া ছাড়া অন্য উপায় নেই । ঐ জ্ঞান উপলব্ধি না করে, অর্জুনেরও শোক মোহ যায়নি । বিশ্বরূপ দর্শন না করে, এক মহাশক্তির হাতে যন্ত্রস্বরূপ হয়ে রয়েছি, এ কথা অনুভব না করে কারও কোন দিন অজ্ঞান-প্ৰসূত শোক মোহ দুর্বলতাদির লোপ হয় না । অর্জুন যখন দেখলেন যে, সংসারে কারও কিছু করবার ক্ষমতা নেই, তখুনি তাঁর ভ্ৰম ঘুচলো, তখুনি তাঁর শোক মোহ দূরে গেল ।

দ্বিতীয় অধ্যায়ে ভগবান শ্ৰীকৃষ্ণ শুধু যে এই আত্মতত্ত্ব বলে গেছেন মাত্র, তা নয়, কিন্তু সাধারণভাবে অর্জুনকে আরও অনেক বুঝিয়েছেন । বলেছেন, তোমার যশ যাবে, তোমাকে লোকে কাপুরুষ ঠাউরে অবজ্ঞা করবে, তার চেয়ে তোমার মরণ ভাল ইত্যাদি ৷ একথাগুলি অনেক সময় লোকে না বুঝে দোষ দেয় । মনে করে, ভগবান শ্ৰীকৃষ্ণ এখানে কি ছাই কথা বলছেন ! তবে কি লোকে নিন্দা করবে বলে ভয়ে অসৎ কাজগুলোও করতে হবে ? না, তা নয় । একটু তলিয়ে দেখলে ভগবানের এ কথাগুলিরও গভীর ভাব আছে দেখা যায় । দেখতে পাই, লোকে যার যশ করে, বাস্তবিক তার কোন-না কোন বিশেষ গুণ আছে । যদি গুণ না থাকে, তবে সে যশ স্থায়ী হয় না । ভাল কাজ করলে সাধারণ লোকে তোমার সৎ উদ্দেশ্য বিশেষ করে না বুঝলেও গুণ কীৰ্ত্তন করে । কারও দোষ-গুণ বিচার করবার জন্যে সম্মুখে ধরলে অশিক্ষিত অজ্ঞ মানুষও বুঝতে পারে । কেন না, সকলের ভেতর ভগবান রয়েছেন, তাঁর শক্তিতেই ভাল-মন্দ বোঝবার ক্ষমতাও তাদের স্বভাবতঃ রয়েছে । যদি তোমায় লোকে নিন্দা করে, তবে তার দুটো কারণ হতে পারে । হয় লোকে তোমায় বুঝতে পারে না তুমি এত উন্নত অথবা তুমি যথার্থ নিন্দার পাত্র । সে স্থলে আপনাকে তোমার প্রথমতঃ বোঝা দরকার । স্থিরভাবে আপনাকে খুব তন্ন তন্ন করে দেখে তবে লোকের কথা তোমার উপেক্ষা করা উচিত । তাই ভগবান অর্জুনকে প্রথমেই দেখালেন যে মোহের জন্যেই তাঁর এই ভাবের উদয় হয়েছে - ভয় হয়েছে — তাই তিনি যুদ্ধ ছেড়ে পালাবার চেষ্টা করছেন । তাই অকারণ লোকে তাঁর অযশ করবে না, এ কথা তাঁর জানা উচিত এবং মোহ ছাড়া উচিত ।

ভগবান তার পর বলছেন -
“অথ চৈনং নিত্যজাতং নিত্যং বা মন্যসে মৃতম্ ৷
তথাপি ত্বং মহাবাহো নৈনং শোচিতুমৰ্হসি ৷৷”
- ‘আত্মা নিত্য জন্মাচ্ছেন ও নিত্য মরছেন, এ কথাও যদি স্বীকার কর, তা হলেও তোমার শোক করা উচিত নয় ।’ কারণ মরতে হবে, এটা সকলে জানে । যে দিন থেকে ছেলেটা জন্মাল, সে দিন থেকে সে মরবার দিকেই এগুতে লাগল । তাই বল্‌ছেন, এই অপরিহার্য বিষয়ের জন্যে ভাবলে কি হবে ? শরীর তো নিশ্চিত যাবেই । আবার জন্মাবে । তবে তার জন্যে আর শোক কেন ? এ বিষয়ে শোক করা মুর্খের কাজ ।
“অব্যক্তাদীনি ভূতানি ব্যক্তমধ্যানি ভারত ৷
অব্যক্ত নিধনান্যেব তত্ৰ কা পরিদেবনা ৷৷”
- ‘মানুষ কোথা হতে এখানে এসেছে কেউ জানে না, কোথা যাবে তাও জানে না । এই যে সব সম্বন্ধ রয়েছে, তাও দুদিনের জন্যে, একথাও জানে । তবে আবার মিছে শোক কেন ?’ আর যদি মানুষকে অবিনাশী আত্মা বলে জেনে থাক, তা হলে সে তো কখন মরবে না, এ কথা স্থির । তবে আবার শোক কিসের ?
“আশ্চর্যবৎ পশ্যতি কশ্চিদেনম্‌ আশ্চৰ্যবদ্বদতি তথৈব চান্যঃ ৷
আশ্চর্ষবচ্চৈনমন্যঃ শৃণোতি শ্রুত্বাপ্যেনং বেদ ন চৈব কশ্চিৎ ৷৷”
- ‘সেই আত্মাকে কেহ বা আশ্চর্য হয়ে দেখে, কেহ বা এর আশ্চৰ্য স্বরূপ বলে, কেহ বা তাই অবাক্‌ হয়ে শুনে, আবার মন্,ভাগ্য কেহ বা শুনেও এর বিষয় ধারণা করতে পারে না ।’
“হতো বা প্ৰাপ্স্যসি স্বৰ্গং জিত্বা বা ভোক্ষ্যসে মহীম ৷
তস্মাদুত্তিষ্ঠ কৌন্তেয় যুদ্ধায় কৃতনিশ্চয়ঃ ৷৷”
— ‘যদি এই যুদ্ধে হেরে যাও, ক্ষত্রিয় তুমি, কর্তব্য পালন করে সম্মুখযুদ্ধে মরে স্বৰ্গে যাবে, জিতলে রাজ্য পাবে, অতএব যুদ্ধ কর ।’ কিরূপে যুদ্ধ করবে ?
“সুখদুঃখে সমে কৃত্বা লাভালাভৌ জয়াজয়ৌ ৷”
-'সুখ দুঃখ, জয় পরাজয়, লাভ লোকসান সমান জ্ঞান করে যুদ্ধ কর ।’ তা হলে পাপ স্পৰ্শ করতে পারবে না । কিছু দেখো না । কেবল কর্তব্য ও সত্য পালন করতে যুদ্ধ করছ, এইটি দেখ । এই রকমে সংসারে যদি আমরা কাজ করতে পারি, সব সময়ে এই ভাব যদি মনে রাখতে পারি, সংসারে এসে লাভ-লোকসানের দিকে নজর না রেখে যদি ঈশ্বরের চাকর-চাকরানীর মত কাজ করে যেতে পারি, কিছুতেই আর বন্ধন আসবে না । ধীরে ধীরে মুক্তির দিকে অগ্রসর হব । এইটি জ্ঞানযোগের মূল কথা ।
[২৭শে অগ্ৰাহয়ণ, ১৩ই ডিসেম্বরে কলিকাতা বিবেকানন্দ সমিতিতে প্ৰদত্ত বক্তৃতার সারাংশ]


4) জ্ঞানযোগ-২


গীতা প্ৰক্ষিপ্ত নয়, একথা আমি প্রথম বারে বলেছি । প্ৰক্ষিপ্ত নয়, তার একটা কারণ আছে । শাস্ত্রপাঠে দেখতে পাই, আমাদের দেশের দার্শনিকদের একটা অসাধারণ গুণ ছিল । সেই গুণটার একটু আধটু এখানকার দেশীয় ও বিদেশীয় দার্শনিকদের জীবনে এলে তাঁদের নিজের এবং অপর সাধারণের পরম লাভ হয় । আমাদের দেশের দার্শনিকেরা শুধু বুদ্ধি দিয়ে কোন বিষয় প্রমাণ করে নিশ্চিন্ত থাকতেন না, কিন্তু যাতে সেটা জীবনে পরিণত করতে পারেন তার চেষ্টা করতেন এবং পরিণত হবার পর ঐ সত্য জনসাধারণে প্রচার করতেন । শ্ৰীকৃষ্ণের জীবন দেখলে বুঝতে পারবে, তিনি গীতাতে যা বলেছেন, তাঁর জীবনের প্রত্যেক ঘটনাতে তা অনুষ্ঠান করে তার সত্যতা দেখিয়ে গিয়েছেন অথবা গীতায় প্রচারিত সত্যসকল তাঁর জীবনেই প্ৰথম সম্যক্‌ অনুষ্ঠিত দেখতে পাই । অতএব তিনিই যে গীতাকার, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই ।

যোগের বিষয় পূর্বে কতক বলেছি । মনের শক্তি উদ্দিষ্ট বিষয়ের দিকে পূর্ণভাবে চালিত করার নাম যোগ । দেখতে পাই, কোন ছেলে চেষ্টা করেও লেখাপড়া শিখতে পারছে না, পাশ করতে পারছে না, এর কারণ কি ? তার মনের শক্তি এক জায়গায় জড় করতে পারে না, আর কতকগুলি বিষয়ের দিকে মনের কতকটা সর্বদা পড়ে থাকে; সে সমস্ত মন গুটিয়ে নিয়ে এক বিষয়ে দিতে পারে না । মনের শক্তি অন্যদিকে ব্যয় হয়ে যায়, সেজন্যে সে উদ্দিষ্ট বিষয় ঠিক আয়ত্ত করতে পারে না । যোগ মানে উদ্দেশ্য যাই হোক না কেন, তাতে পৌছুবার বা তা লাভ করবার সহজ উপায় । সহজ উপায়টি কি ? শরীর-মনের সমস্ত শক্তি গুটিয়ে এনে ঐ বিষয়ে লাগান । ধনলাভ হোক, অথবা ধর্মলাভ হোক, পরের কল্যাণের জন্যে অন্য কোন কাজ হোক, তাতে কৃতকাৰ্য হবার জন্যে অন্য কোন কাজ হোক, অথবা পরের কল্যাণের সহজ উপায়ের সাধারণ নামই “যোগ’ দেওয়া যেতে পারে: সমস্ত মন গুটিয়ে আনবার শক্তি কোথা থেকে আসবে ? সকল শক্তিই আমাদের ভেতর রয়েছে । কেন না, আত্মাই সকল শক্তির আকর । শরীর, মন-বুদ্ধি প্রভৃতি তাঁর হাতের যন্ত্ৰমাত্র । ঐ সকল যন্ত্র নিয়ে তিনি এই অদ্ভুত খেলা খেলছেন । যন্ত্র খারাপ হলে যেমন কোন বিষয় ভাল করে করা যায় না, সেইরূপ মন, বুদ্ধি মলিন হলে আত্মার খেলাও তদ্রুপ হয় । তাঁর অশেষ শক্তি-প্ৰকাশের সুবিধা হয় না । কিন্তু মন, বুদ্ধি যদি খুব শুদ্ধ হয়, সত্ত্বগুণবিশিষ্ট হয় তবে তাঁর ভেতরের শক্তির অদ্ভুত প্ৰকাশ হয়ে থাকে ।

যোগ-শব্দ সাধারণভাবে প্রয়োগ করতে পারলেও আমাদের শাস্ত্রে তা কেবল ধৰ্মসম্বন্ধেই ব্যবহৃত হয়েছে - এখন জ্ঞানযোগ কাকে বলে, দেখা যাক । পরমহংসদেব বলতেন, একজ্ঞানই জ্ঞান, বহুজ্ঞান অজ্ঞান । কোন বিষয়ে কারও বাস্তবিক জ্ঞান হয়েছে, কখন বলব ? যখন সেই জ্ঞানের প্রকাশ-সে সকল জায়গায়, সকল জিনিষের ভেতর দেখবে । যার সুর-জ্ঞান হয়েছে সে সকল শব্দের ভেতরই সুরের খেলা দেখতে পায় । একটা জিনিস পড়ল, একখানা গাড়ী দৌড়ুল, একজন লোক কথা কইল, সব ভিন্ন ভিন্ন আওয়াজ কোন সুরের কোন পরদায় হল সে তা বুঝতে ও বলতে পারে এমন কি, সে ভিন্ন ভিন্ন আওয়াজের ভিন্ন ভিন্ন রূপ দেখতে পায় । রঙের খেলাতে সে সুরের খেলা দেখতে পায় । সমগ্র জগৎ তার কাছে অপূর্ব স্বরলহরীমাত্র এবং নাদই জগৎকারণ ব্ৰহ্মরূপে প্ৰতীত হয় । পিথাগোরসের অনুভব হত, সূৰ্য-চন্দ্রের ঘোরার সঙ্গে সঙ্গে এক অপূর্ব সুর চলেছে । তিনি উহাকে Music of the Sphere বলতেন । পরমহংসদেবের অনুভব হত, সমুদয় জগৎমধ্যে এক অপূর্ব ওঙ্কার-ধ্বনি উঠছে পাখীর ডাকে, নদীর তরঙ্গে, সমুদ্রের কল্লোলে, সেই ওঁ ওঁ ধ্বনি । সকল স্থানের সকল শব্দের ভেতর দিয়ে সকল সময়ে সেই অনাহত নাদ প্ৰবাহিত হচ্ছে । 

সুরজ্ঞানের সম্বন্ধে যেমন, অন্যান্য বিষয়েও সেইরূপ । রূপ বা রস-জ্ঞান যার হয়েছে তার কাছে সমগ্র জগৎ রূপ ও রসের বিকারমাত্র বলে অনুভূত হয় । বহুজ্ঞান সকলের রয়েছে । সুখদুঃখের জ্ঞানও সকলের আছে । স্থুলচক্ষে যাদের জড় বলে মনে হয়, সকল পদার্থও আঘাতে প্ৰতিঘাত দিয়ে নিজ জীবন এবং কিছু-না-কিছু জ্ঞানের পরিচয় দিচ্ছে । আহার, নিদ্রা, ভয় ইত্যাদির জ্ঞান “জ্ঞানমেতন্মনুশ্যানাং যত্তেষাং মৃগপক্ষিণাম্‌” (চণ্ডী) – পশু, পক্ষী ও মানুষের সমানভাবেই রয়েছে, এ জ্ঞানকে আমরা জ্ঞান বলি না । কিন্তু কতকগুলি বিষয়ের ভেতর যদি আমরা এক শক্তির বিকাশ, এক নিয়মের খেলা দেখতে পাই, তবে তাকে জ্ঞান বলে থাকি । ফলটা পেকে গাছ থেকে মাটিতে পড়ল, ঢিলটা ছুঁড়লুম - মাটিতে এসে পড়ল, মানুষ লাফ দিয়ে আকাশে উঠতে পারে না, পৃথিবীটা সুর্যের চারদিকে ঘুরছে ইত্যাদি জ্ঞানগুলিকে যত দিন না আমরা শক্তির প্রসূত বলে দেখতে পেয়েছিলাম, ততদিন ঐ বহুজ্ঞানগুলি আমাদিগকে জ্ঞান পথে বড় বেশী অগ্রসর করেনি । আর যেই দেখলুম যে, ঐ সকলগুলি মাধ্যাকর্ষণ নামক এক শক্তির খেলায় হচ্ছে, অমনি আমাদের জ্ঞান কতদূর ব্যাপিল, কত বিষয়কে আমরা একসূত্ৰে গাঁথতে পারলাম, তা আর বলে বোঝাতে হবে না । এই পৃথক পৃথক পদার্থ ও অনুভবসকলকে ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণীবদ্ধ করার নামই জ্ঞান ৷ সকল অসংখ্য ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণী আবার কয়েকটি শ্রেণীর অন্তর্ভূক্ত দেখতে পাওয়া এবং শাস্ত্ৰ বলেন, প্ৰকৃত জ্ঞানী তিনিই, যিনি এই সমস্ত শ্রেণীকে একের অন্তর্ভূত দেখতে পান । এই একজ্ঞান একবার হলে আর কখনও অজ্ঞান আসতে পারে না; এইজন্যে গীতা বলেন, জ্ঞানী তিনিই, যিনি সদা সর্বত্র সেই একের প্রকাশ দেখেন । এই বহুজ্ঞানের ভেতর যিনি সেই এককে দেখতে পান, “একো বহূনাম্‌”, তিনিই মৃত্যুঞ্জয় হন, সুখদুঃখের পারে যান ।

শ্ৰীকৃষ্ণের উপদেশ ও জীবনের সর্বত্র এই শিক্ষাই দেখা যায় যে, জ্ঞানসহায়ে কিরূপে আমরা সেই একের কাছে পৌঁছুব । সে এক যাই হোক না কেন, তাতে কি এসে যায় ? যা হতে এই সব হয়েছে, সেই তাই, সেখানে যেতে হবে । তাকে যাই বল না কেন, ঈশ্বর, ভগবান, কালী, ব্ৰহ্ম - ঠিক বলতে গেলে সে স্ত্রীলিঙ্গও নয়, পুংলিঙ্গও নয়, ক্লীবলিঙ্গও নয় । এখন সেই একজ্ঞান-লাভের উপায় কি ? পরমহংসদেব বলতেন, একটা বিষয়ে যদি আপনার লাভ-লোকসান ভুলে ষোল আনা মন ঢেলে দিতে পার, তবে সেই একজ্ঞানে নিশ্চয় উপস্থিত হবে । সাধুই হও বা বিষয়ীই হও, যদি ষোল আনা হতে পার তো সেই একের প্রকাশ দেখতে পাবে । স্বদেশের জন্যে যদি ষোল আনা মন দিয়ে কেউ পাগল হতে পারে তো সেই দেশহিতৈষিতার ভেতর দিয়ে তার নিকট সেই একের প্রকাশ হবে । বিজ্ঞান, সংগীত, শিল্প প্ৰভৃতি যে বিষয়ের চর্চাই কর না কেন, যদি ষোল আনা মন দিয়ে কর তো তাই তোমাকে সেই জ্ঞানে নিয়ে যাবে । এ পরমহংসদেবের কথা । বড় নূতন কথা, বড় অদ্ভুত সত্য । শুনতে যেমন সোজা, করতে তেমনি শক্ত । সব বিষয়েই ঐরূপ দেখি । যেটা খুব সহজ, সেটাই আবার খুব শক্ত । যেটা খুব নিকটে, সেটাই আবার খুব দূরে । গলায় হার রয়েছে, চারদিকে খুঁজছি, এ ভ্ৰম প্রায় হয় । আত্মা অত্যন্ত নিকটে কি না, তাই বুঝতে পারি না । তিনি যে আমারই ভেতর, একথা বিশ্বাস করি না । তাঁর দেখা পাবার জন্যে পাহাড় পর্বত নানাদেশ ঘুরে উপোস করে খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়ে শেষে দেখি, আমারই ভেতর তিনি । পরমহংসদেব বলতেন, মানুষের মন যেন জাহাজের মাস্তুলের পাখী । কোন সময়ে একটা পাখী একখানা জাহাজের মাস্তুলের ওপর বসেছিল । জাহাজখানা চলতে চলতে ক্ৰমে সমুদ্রের মাঝখানে গিয়ে পড়ল । পাখীটা বসে বসে বিরক্ত হয়ে অন্যত্র যাবার চেষ্টায় উড়ল । কিন্তু চারদিকেই জল । উড়ে উড়ে কোথাও স্থল না পেয়ে ক্লান্ত হয়ে শেষে সেই মাস্তুলের ওপর এসে বসল । মানুষের মনও সেই রকম নানাদিকে নানাবিষয় অনুসন্ধান করে ক্লান্ত হয়ে, শেষে আপনার ভেতর সেই একের দেখা পেয়ে নিশ্চিন্ত হয় ।

সর্বদা সকলের ভেতরে থাকলেও শুদ্ধ বুদ্ধির নিকট সেই একের জ্ঞান খুব কাছে । বদ্ধ জীবের জড় বুদ্ধির অনেক দূরে জ্ঞানযোগ সাধন করা বা জীবনে পরিণত করা শক্ত । অতি শুদ্ধ বুদ্ধি যাদের, তারাই পারে । বিচার করে কোন বিষয় ঠিক দেখে যখন তা তৎক্ষণাৎ কাজে করতে পারবে, তখনই তুমি জ্ঞান-সাধন করবার উপযুক্ত অধিকারী । মনে উঠল-বড়লোক হবো, দেশজুড়ে গণ্যমান্য হবো । অথচ বিচার করে দেখলে, এই দুদিনের জীবনে নামযশের চেয়ে ভগবানলাভের চেষ্টাই ঠিক । কিন্তু মনকে ধরে রাখতে না পেরে যদি তুচ্ছ ধনমানের জন্যেই ছুট, তা হলে তোমার দ্বারা জ্ঞানযোগ হবে না, তোমার অন্য রাস্তা । যে জ্ঞানযোগের সাধক, মন তার মুঠোর ভেতর, আয়ত্তের ভেতর থাকেবে, যা হুকুম করবে, তাই করবে । ভগবান যীশু যখন নিজ অন্তর্নিহিত শক্তিবিকাশের জন্যে চল্লিশ দিন উপবাস করে তপস্যা করেন, তখন শয়তান প্রলোভন দেখাতে এসেছিল । ধন দেবে, মান দেবে, রাজ্যসম্পদ দেবে, সুন্দরী স্ত্রী দেবে ইত্যাদি বলেছিল । তাই শুনে তিনি অমনি বলে উঠলেন, Get the behind me, Satan ! বাসনা-শয়তান, দূর হও । আমাদের ভেতরও ঐ রকম অনবরত বাসনা উঠছে । নানান জন্মের বাসনা সব ফুটে উঠছে । আবার যখন সৎ উদ্দেশ্যে সাধারণ-কল্যাণের জন্যে কোন কাজ করতে যাচ্ছ, তক্ষুনি রক্তবীজের বংশের ন্যায় বাসনা-সন্তান শত শত এককালে জাগরিত হয়ে ব্যাকুল করে তুলছে । যিনি ইন্দ্ৰিয়জয়ী, তিনি ঐ সব বাসনাবীজ দেখতে এবং মন থেকে তাড়াতে পারেন । কিন্তু সংস্কার যদি বেশী দৃঢ় হয়, তবে আর শুধু বিচার করে তাড়াতে পারা যায় না । ঐ প্রকার লোকের অন্য পথ । সংস্কার অল্প হলে বিচার করে মন ঠিক রাখা যেতে পারে । জ্ঞানযোগ যিনি সাধন করেন, তাঁর বাসনা তত প্ৰবল নয়, মন সহজেই তাদের আয়ত্ত করতে পারে এবং স্থির থাকে ।

ভগবান শ্ৰীকৃষ্ণের নিজ জীবনে মহাজ্ঞানীর ভাব প্রতিপদে দেখতে পাওয়া যায় । জীবনের অতি সঙ্কটস্থলেও তাঁর কি অদ্ভুত সমুদ্রবৎ স্থিরত্ব ও গাম্ভীৰ্য । ফলফুলশোভিত মধুর বৃন্দারণ্যে, শক্রবেষ্টিত মথুরায়, রাজকুলসম্মানিত হস্তিনায়, রাগদ্বেষপূরিত রণস্থলে, পূর্বস্মৃতিমুখরিত প্ৰভাসে এবং স্ববংশ-ধ্বংসের সময়ও সেই স্থির, অচল, অটল ভাব । যদুকুলধ্বংস হবার পূর্বেই তিনি দেখলেন, কাৰ্য-কারণ-প্রবাহের ফলস্বরূপ তা ঘটবেই ঘটবে । এদের কর্মেই এই ভীষণ ফল প্ৰসব করে । অশেষ চেষ্টায়ও যখন তা ফিরল না, তখন মহাজ্ঞানী গীতাকার স্থির হৃদয়ে আপন বংশের নিধন দর্শন করলেন । নিজের সামনে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, অথচ মন অবিচলিত হয়ে চুপ করে আছে । স্বামিজী বলতেন, গীতার ভাব হচ্ছে intense activity-র ভেতর intense rest, অবিরাম কার্যের ভেতর অদ্ভুত বিশ্রাম, যোগীর অচল ভাব । গীতাসম্বন্ধে স্বামীজীর এইভাবে একখানি ছবি আঁকার ইচ্ছা ছিল । শ্ৰীকৃষ্ণ সারথিবেশে ঘোড়ার লাগাম ধরে সৈন্যদলের ভেতর রথ চালাচ্ছিলেন, এমন সময় বিষাদাভিভূত অর্জুন লড়াই করবে না বলতে এক হাতে তেজীয়ান ঘোড়াকে টেনে আয়ত্তে রেখেছেন আর অর্জুনের দিকে মুখ ফিরিয়েছেন । শরীরের দ্বারা ঘোটক-সংযমরূপ মহা আয়াস করলেও মনের অনন্ত প্ৰশান্তভাবের জন্যে মুখে যোগীর ছবি আঁকা রয়েছে । ভয়ঙ্কর কুরুক্ষেত্রের সংগ্রামের ভেতরও তাঁর মনের এই অপরূপ প্ৰশান্ত ভাব আঁকাবার তাঁর বড় ইচ্ছা ছিল । এই সময়ে কত রাজা মহারাজা মরবে, কোন পক্ষে জয় পরাজয় তার কিছুই ঠিক নেই, সকলেই অস্থির, আত্মহারা, পাগল, কিন্তু তিনি স্থির, অটল, অচল হয়ে অপরের কল্যাণের জন্যে, ধর্মসংস্থাপনের জন্যে সকল কাজ চালাচ্ছেন আবার সেই সময়েই যোগের অতি গূঢ় বিষয় শিক্ষা দিচ্ছেন । এই স্থিরতা প্ৰত্যেক মানবের শিক্ষা করা চাই । কাজ করতে করতে আমাদের ভেতর কাজের মত্ততা এসে যায় । সেইটেই খারাপ । তখন আমরা কাজ না চালিয়ে কাজ আমাদের চালায়, ইন্দ্ৰিয় আমাদের চালায় । প্ৰভু দাসপদে নত হয়, অহঙ্কৃত দাস প্রভুর প্রতি যা ইচ্ছা ব্যবহার করে । এই জীবনসংগ্রামে, কাৰ্যক্ষেত্রে সেইজন্যে সদাসর্বদা স্থির থাকতে হবে । এইজন্যেই গীতার শিক্ষা শুধু সন্ন্যাসীর জন্যে নয়, সংসারীর জন্যেও নয়, কিন্তু সকল দেশের, সকল কালের, সকল লোকের জন্যেই প্ৰযুক্ত । এইজন্যেই গীতার অপর নাম গীতোপনিষৎ । কেন না, উপনিষদের জ্ঞান ও শিক্ষার বিশেষত্বই-তাদের সর্বজনীন উদারতা; সকল প্রকার অধিকারীর জন্যে ভিন্ন ভিন্ন ব্যবস্থা দিয়ে উপনিষদের ঋষি আবার মুক্তকণ্ঠে প্রচার করছেন, “মানুষ, তুমি অমৃতের অধিকারী, অমৃতই তোমার স্বরূপ; তুমি ভ্ৰমে পড়ে আপনাকে আৰ্য, মেচ্ছ, ব্ৰাহ্মণ, শূদ্র প্রভৃতি যাই মনে কর না কেন, কিছুই তোমায় বাঁধতে পারে না । তুমি স্বাধীন, স্বাধীন, চিরস্বাধীন ।” এই অপূর্ব উদারতা গীতার মধ্যে দেখেই মাহাত্ম্যকার লিখেছেন, সমস্ত উপনিষৎ মন্থন করে গীতার উৎপত্তি হয়েছে ।

জীবন-সংগ্রামের এই মত্ততার ভেতর এই যোগীর স্থিরতা আমাদের আনা চাই । কাজ করতে গেলেই যে একটা reaction বা প্ৰতিক্রিয়া আসে, তার হাত থেকে বাঁচতে শেখা চাই । তবেই তোমার দ্বারা যথাৰ্থ বড় কাজ হবে, তবেই তুমি ঠিক মানুষ নামের যোগ্য হবে । ফলাকাঙ্ক্ষাপ্রসূত এই কর্মমত্ততা কত সময় কত যে বিষময় ফল প্রসব করে, তা আর দেখিয়ে দিতে হবে না । ব্যবসাবাণিজ্যে লোকসান দিয়ে কত লোক হতাশ-সাগরে ডোবে, আর উঠতে পারে না; পাস করার মত্ততায় পড়ে কত ছেলেই না একেবারে চিররোগী হয়ে পড়ে ! আবার অশেষ চেষ্টায়ও পাস না করতে পেরে ছাত্রদের মধ্যে সময়ে সময়ে আত্মহত্যার অভিনয়ও দেখতে পাওয়া যায় ।

এই মত্ততার ভেতর স্থিরতা আনতে শেখা সকলেরই প্রয়োজন, বিশেষতঃ সংসারী লোকের । কারণ, তার পক্ষে সাংসারিক ও পারমার্থিক সকল বিষয়ে উন্নতি লাভ করবার একমাত্র উপায়ই হচ্ছে কর্ম, কর্ম, কর্ম এবং কর্মের ভেতর এই স্থিরতা আনতে পারলে উদ্যমের কিছুমাত্র হ্রাস যে হবে তা নয়, এ কথা গীতাকারের নিজ জীবনেই সম্পূর্ণ প্রমাণিত হয়েছে ।

শ্ৰীকৃষ্ণের সমস্ত জীবনের সহিত গীতার শিক্ষা মিলিয়ে নাও, দেখবে এতেও এতটুকু অনৈক্য নেই । স্বার্থের জন্যে কর্ম না করলেও তাঁর একার কর্ম-উদ্যম অসংখ্য লোকের উদ্যমের চাইতে অধিক দেখতে পাওয়া যায় । বৃন্দাবনের খেলার ভেতর দেখ, মথুরার এবং দ্বারকার রাজসম্পদের ভেতর দেখ, যদুবংশধ্বংসের সময় দেখ, কুরুপাণ্ডবের যুদ্ধক্ষেত্রে দেখ, সব জায়গায় অপূর্ব কাজের মত্ততার ভেতর তার হৃদয়ে এই অদ্ভুত স্থিরতা ও শান্তি দেখতে পাবে । কথিত আছে, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ বাঁধবার পূর্বে দুৰ্যোধন রাজাকে তিনি একাদশ অক্ষৌহিণী নারায়ণী সেনা প্ৰদান করেন । দুৰ্যোধন ভাবলে, একা শ্রীকৃষ্ণকে দলে না পেলাম, তাতে কি ? তাঁর একার উদ্যম কিছু আর একাদশ অক্ষৌহিণী লোকের উদ্যমের সঙ্গে সমান হবে না ! কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল ঠিক তার বিপরীত । তাঁর উদ্যম ও অধ্যবসায়, বিপদ্‌কালে তার অনন্ত উপায়-উদ্ভাবনী-শক্তি, ঘোর নিরাশ-অন্ধকারে তাঁর প্রাণসঞ্চারিণী অগ্নিময়ী বাণী, আবার মৃত্যুর ছায়ার ভেতর স্বপক্ষের পরাজয়ের ভেতর তাঁর অপূর্ব অনবসাদ ও চিত্ত-প্ৰসন্নতা - এই সমস্ত গুণ তাঁকে একাদশ অক্ষৌহিণী কেন, ভারতসমরে সমাগত উভয় পক্ষীয় সমস্ত বীরের সহিত সমতুল্য করেছিল ।

জ্ঞানযোগের সারকথা এই । জ্ঞানযোগের সাধন হচ্ছে, ‘নেতি, নেতি’-বিচার অর্থাৎ যা একত্বে নিয়ে যাবার পথে অন্তরায়, তা বিচারপূর্বক এককালে পরিত্যাগ করা । জ্ঞানযোগ শুনে অর্জুন জিজ্ঞাসা করছেন, “জ্ঞানী হলে, স্থিতপ্ৰজ্ঞ হলে তাঁর লক্ষণ, চাল-চলন, আচার-ব্যবহার ইত্যাদি কিরূপ হয় ? এই খরস্রোত কর্ম-প্রবাহের ভেতর যিনি সর্বদা নিজ জীবনকে স্থিরভাবে রাখতে পেরেছেন, তাঁর expression অর্থাৎ ভাষা, চাল-চলন এবং অপরের সঙ্গে ব্যবহার কেমন হয় ? সিদ্ধপুরুষেরা যেমন ভাবে সংসারে কাজকর্ম করে গেছেন, সেই সকল আমাদের শিক্ষার জন্যে গীতা ও অন্যান্য শাস্ত্ৰে লিপিবদ্ধ আছে । প্রশ্ন হতে পারে, তাঁদের চাল-চলন দেখে আমরা শিখব কি করে ? আমরা জড়বুদ্ধি, কর্মফলপ্ৰত্যাশী, কামকাঞ্চনলুব্ধ জীব, আমাদের জীবনে তাঁদের ন্যায় মহৎ উদ্দেশ্য তো নেই ? নেই সত্য, কিন্তু সেই প্ৰকার মহৎ উদ্দেশ্য, সেই প্রকার বৈরাগ্য ও নিঃস্বাৰ্থ উদ্যম জীবনে না আনতে পারলে উন্নতির আশা কোথায় ? আবার আমাদের ভেতর যারা গুরুর উপদেশে বিশেষ উদ্দেশ্যে জীবন চালাতে চেষ্টা করছে, কৰ্মাবর্তে পড়ে অনেক সময় তারা কি করবে, কিছু ঠিক করতে পারে না । অথবা সেই পথে চলতে যে নব নব ভাব ও অনুভব জীবনে উপস্থিত হয়, সেগুলি ঠিক কি না, এ সন্দেহে তাদের মন ব্যাকুল হয়, তখন এই সকল জগদগুরুর পদপ্রান্তে দাড়িয়ে তাঁদের জীবনের অনুভবের সঙ্গে নিজ নিজ জীবনের উপলব্ধি মিলিয়ে পেলে সংশয়-সন্দেহের হাত থেকে মুক্ত হয়ে আবার চিত্তপ্ৰসাদ লাভ হয় । সেইজন্যে শাস্ত্ৰ বলেন, সিদ্ধ পুরুষের লক্ষণগুলি বিশেষভাবে লক্ষ্য করে সাধক নিজ জীবনে আনবার চেষ্টা করবে । এই-ই তার পক্ষে প্ৰধান সাধন ।

সাধকের নিজ জীবনের উপলব্ধির সঙ্গে গুরুবাক্য ও শাস্ত্ৰবাক্য মিললে সে অনুভবে আর ভুল নেই, একথাও ধারণা করতে শাস্ত্র বলেন।  শুকদেব আজন্ম জ্ঞানী হয়েও যতদিন না নিজের উপলব্ধ জ্ঞান-গুরু এবং শাস্ত্রবাক্যের সঙ্গে মিলিয়ে নিতে পেরেছিলেন, ততদিন তাঁর নিজের অনুভব ঠিক কি না, এইরূপ সন্দেহের হাতে মধ্যে মধ্যে পড়তেন এবং মহর্ষি ব্যাসকে এই সন্দেহ দূর করবার উপায় জিজ্ঞাসা করেন । ব্যাস দেখলেন, আমি শুকের বাপ, আমার কথা সে বাল্যাবধি শুনে আসছে, তাতেও যখন সন্দেহ যায় নি, তখন এর অন্য ব্যবস্থার প্রয়োজন । ভেবে চিন্তে তিনি শুককে রাজর্ষি জনকের নিকট গিয়ে তাঁকে গুরু স্বীকার করে উপদেশ নিতে বললেন । জনকের বাড়িতে গিয়ে শুককে সাতদিন দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিল, কেউ খোঁজখবর নেয়নি । এরূপ অবজ্ঞাতেও তাঁর চিত্তে রাগন্বেষাদির উদয় হল না । পরে বাড়ীর ভেতর নিয়ে গিয়ে রাজর্ষি জনক তাঁর অশেষ মান্য ও অদ্ভুত সেবা করতে লাগলেন । এরূপ সম্মানেও শুক তাঁর উদ্দেশ্য ভুললেন না । তখন জনক তাঁকে ব্ৰহ্মজ্ঞানের সমতা ও অবিচলিতা বুঝিয়ে দিলেন । জনকের কথাতে বাপের কাছে যেসব শাস্ত্র পড়েছেন, সেসব শিক্ষার আর নিজের উপলব্ধির একতা শুক যখন মিলিয়ে পেলেন, তখন তাঁর সকল সন্দেহ দূর হয়ে মনে শান্তির উদয় হল ।

জ্ঞানীর লক্ষণ-সম্বন্ধে গীতা এখন কি বলেন, তাই দেখা যাক্‌ ।
“প্ৰজহাতি যদা কামান্‌ সর্বান্‌ পাৰ্থ মনোগতান্‌ ৷
আত্মন্যেবাত্মনা তুষ্টঃ স্থিতপ্ৰজ্ঞস্তদোচ্যতে ৷৷”
- ‘সকল বাসনা ছেড়ে যিনি আপনাতে আপনি তুষ্ট হয়ে আছেন, যিনি কাম, ক্ৰোধ প্রভৃতিকে আয়ত্তাধীন করেছেন, যিনি ইন্দ্ৰিয়ের বশ না হয়ে ইন্দ্ৰিয়গণকে আপন উদ্দেশ্যলাভের জন্যে খাটিয়ে নেন, তিনি যথার্থ জ্ঞানী ।’ জ্ঞানী পুরুষ আমাদের মতনই ইন্দ্ৰিয়ের দ্বারা কাজ কর্ম করেন, কিন্তু কখনও আপনার উদ্দেশ্য ভোলেন না । ইন্দ্ৰিয়গণ যে তাঁর চাকর এবং তিনি তাদের প্রভু, এ কথা সর্বদা মনে রাখেন । আমরা ঐ কথাটা কেবল ভুলে যাই । তাই ইন্দ্ৰিয় যে দিকে চালায়, সেইদিকে ছুটি । উপনিষৎ বলেন, আত্মা যেন রথী, এই শরীররূপ রথে আরোহণ করে রয়েছেন, ইন্দ্ৰিয় সেই রথের ঘোড়া এবং মন সেই ঘোড়ার লাগাম । বুদ্ধি সারথি সেই লাগাম ধরে ঘোড়াগুলোকে রূপ-রসাদি বিষয়ের পথ দিয়ে জ্ঞান ও শান্তিরূপ লক্ষ্যস্থানের দিকে চালাচ্ছে । শিক্ষার গুণে সারথির নিজের মাথা ঠিক থাকলে ঐ সব পাগলা ঘোড়াদের ঐরূপ দুৰ্গম পথের ভেতর দিয়েও ঠিক চালিয়ে নিয়ে যান । আর তা না হলে ঘোড়াগুলো রাশ না মেনে কোন পথে যেতে কোন পথে নিয়ে যায়; কখন বা গাড়ীখানা উল্‌টেও দেয় । শুদ্ধ বুদ্ধি ঘোড়া চালিয়ে গন্তব্যস্থলে ঠিক উপস্থিত হয় । কিন্তু কামকাঞ্চন-বদ্ধদৃষ্টি মলিন্‌ বিষয়বুদ্ধি ঘোড়ার বশীভূত হয়ে পড়ে সর্বনাশের পথে অগ্রসর হয় ।

জ্ঞানীর অপর এক লক্ষণ হচ্ছে, তিনি সুখদুঃখ উভয় অবস্থাতেই স্থির থাকবেন । আমরা স্বার্থপর, নিজেদের সুখের জন্যে লালায়িত । এতটুকু দুঃখ উপস্থিত হলে একেবারে আত্মহারা হই; ইচ্ছায় নিজেকে বিপদগ্ৰস্ত করে পরের কাজে যাওয়া তো দূরের কথা, ঘরের পাশে প্লেগ হয়, কিন্তু আমি নিশ্চিন্ত থাকি । এই যে দেশে এত দুর্ভিক্ষ হচ্ছে, আমরা তার কি করছি ? এ যদি ইউরোপের কোন স্থানে হত তো দেশের সমস্ত লোক একেবারে ক্ষেপে উঠত । বলত, কেন দুর্ভিক্ষ হবে ? কেন আমার দেশে লক্ষ লক্ষ লোক অনাহারে মরবে ? তারা জীবন উৎসর্গ করতো তা দূর করবার জন্যে । আমরা এ বিষয়ে জড়, মহাতমোগুণীএ; কাজে একেবারে অলস । ডিগ্‌বি সাহেব লিখছেন, বিগত ১০৭ বৎসরের লড়াইয়ে পৃথিবীর ভেতর যত লোক মরেছে, এই ভারতবর্ষে তার ৭ গুণ অধিক লোক মরেছে গত ১৯ বৎসরের দুর্ভিক্ষে । কি ভীষণ ব্যাপার ! আমরা আবার চেঁচাই, বড়াই করি - আমাদের বাপ দাদা পৃথিবীতে ভারি বড়লোক ছিল । তারা বড়লোক থাকলেও তোমার কাজ দেখে তোমাকে তো সে বংশের সন্তান বলে বোধ হয় না; তুমি কি করছ, তা একবার ভেবে দেখ দেখি । তুমি, ‘আমি ব্ৰাহ্মণ, জগতের পূজ্য' বললে কি হবে ? যে সাত্ত্বিক ভাব নিয়ে ব্রাহ্মণের ব্রাহ্মণত্ব, সে ভাবের যে একেবারে লোপ হয়ে মহা জড়ত্ব আসতে বসেছে । আর এই মলিনমুখ, ছিন্নবস্ত্র ভারতের শ্রমজীবী, যাদের শূদ্র বলে চিরকাল পায়ে দলেছ, অথচ যাদের পরিশ্রম, যাদের অধ্যবসায়, যাদের শিল্পনৈপুণ্যের জোরে ভারত আজও বিখ্যাত, যাদের বংশধরদের নিকট হতে কর আদায় করে এখনও দেশে স্কুল, কলেজ এবং তোমাদের ছেলেদের শিক্ষার বন্দোবস্ত হচ্ছে, তাদের দিকে এখনও কি তোমরা ফিরে চাও, আপনার বলে দেখে তাদের দুঃখে একবারও কি দুঃখিত হও ? এই জাতীয় পাপের ফলেই আজ দেশের এই শোচনীয় অবনতি ! আমরা বুঝি আর নাই বুঝি, কর্মফলদাতা কর্মের ফল দেবেনই দেবেন । ভাবের ঘরে চুরি হলে এইরূপই হয়ে থাকে । আমরা মুখে বলি, সর্বঘটে নারায়ণ - আর সকল স্ত্রীতে দেবী জগদম্বার আবির্ভাব । কিন্তু কাৰ্যকালে ও বেটা চাষা, ও-বেটা চাঁড়াল, ওকে ছুঁলে নাইতে হবে, ওর দৃষ্টিতে আমার ভাত নষ্ট হবে, ওর ছায়া মাড়ালে আমি অপবিত্র হব । এই মুখে একখানা, পেটে একখানা, কখনও কারও চেষ্টায় যদি দেশ হতে দূর হয় তো তা ছাত্রদের দ্বারাই হবে । ছাত্রেরা এখন থেকে শাস্ত্ৰকথিত এই সকল সত্য হৃদয়ে দৃঢ় ধারণা করে যদি প্ৰাণপণে দেশের এই অজ্ঞান দূর করে, তবেই হবে ।

জ্ঞানীর লক্ষণে গীতা পুনরায় বলছেন - ‘বীতরাগভয়ক্ৰোধঃ’ । আমি একটা জিনিস লাভ করতে বিশেষ আগ্রহ ও চেষ্টা করছি । এমন সময় আর কেহ বা কিছু মাঝে এসে সেই পথের অন্তরায় বা বাধা হল । তখন তার প্রতি মনে যে ভাব ওঠে, সেইটেরই নাম ক্ৰোধ আর কোন কিছু লাভ করবার অতীব আগ্রহের নামই রাগ বা কাম । এই কাম ক্ৰোধ যার নেই, তার কোন বিষয়ে আসক্তি থাকে না । আমরা যে কাজই করি না কেন, যদি আসক্ত না হয়ে করি, তা হলে তাই আমাদের একজ্ঞানে নিয়ে যাবে । প্ৰত্যক্ষ দেখতে পাব, ধ্যানজপাদির ন্যায় প্রতিদিন করণীয় সাধারণ কাজ সকলও তখন যোগীর লক্ষ্য একজ্ঞানের দিকে নিয়ে যাচ্ছে । অতএব আসক্তি আসতে দেওয়া হবে না । উচ্চ উদ্দেশ্যে সব কাজ করতে হবে, অথচ স্থির থাকতে হবে । জ্ঞানী পুরুষ যেসব কাজ করেন, স্বার্থ-প্ৰসূত কাম-ক্ৰোধাদির বশে করেন না । অতএব ইন্দ্ৰিয়জয় করা, স্বার্থপর কামনা-বাসনা-ত্যাগ করা আর সুখ বা দুঃখে অবিচলিত থেকে উদ্দেশ্যে স্থির থাকাই জ্ঞানলাভের উপায় ।

তারপর গীতাকার জ্ঞানের মহিমায় বলছেন -
“এষা ব্ৰাহ্মী স্থিতিঃ পাৰ্থ নৈনাং প্রাপ্য বিমুহ্যতি ৷
স্থিত্বা হস্যামন্তকালেহপি ব্ৰহ্মনির্বাণমৃচ্ছতি ৷৷”
- 'হে পাৰ্থ, ইহারই নাম ব্রহ্মে বুদ্ধি স্থির রাখা । একবার এই ভাব জীবনে এলে আর শোকমোহাদি এসে কষ্ট দিতে পারে না । মৃত্যুর পূর্বক্ষণেও একবার এই ভাব ঠিক ঠিক এলে মৃত্যুঞ্জয়ত্ব লাভ হয় । অতএব যদি জ্ঞানী হও, নেতি নেতি করে সব ছেড়ে দাও । অদ্বৈত্বজ্ঞান লাভ করে কাজ করতে হয় – করো । যদি সত্যের উদ্দেশ্যে সব ছাড়তে না পার, তবে তোমার পথ কর্মযোগ । বলতে পার, কর্ম তো সকলে করছে । তা করে জ্ঞানলাভ কি করে হবে ? তা নয় । আপনার ভোগসুখাদির জন্য অনুষ্ঠিত কর্ম হাজার হাজার বৎসর করলেও তা কখনও আমাদের একজ্ঞানে নিয়ে যাবে না । যেমন শীত-উষ্ণ ও সুখ-দুঃখাদি সাধারণ জ্ঞান প্ৰকৃত জ্ঞান নহে, পশু ও নরে সমান ভাবে আছে, সেইরূপ আপনি সুখের জন্য কৃত কর্ম প্রকৃত কর্ম নহে । ঐ প্রকার কর্মও ‘সামান্যমেতৎ পশুৰ্ভিনরাণাম্‌ । ঐরূপ কর্মবন্ধনের ওপর বন্ধনই এনে দেয় । অতএব প্রকৃত কর্ম করবার কৌশল জানা চাই । নতুবা আমরা সকলেই তো কর্ম করছি । চুপ করে থাকবার তো জো নেই । জড়ের ভেতর, চেতনার ভেতর, সকলের ভেতরই কর্মকৃত এই অবিরাম গতি চলেছে । মনের ভেতর, বুদ্ধির ভেতরও সেই গতি সর্বদা ছুটছে ।
“ন হি কশ্চিৎ ক্ষণমপি জাতু তিষ্ঠত্যকৰ্মকৃৎ ।”
- সকলেই আপনার আপনার স্বভাবনিহিত গুণের বশে অবশ হয়ে কর্ম করছে । যায় কাম বেশী, সে কামের চেষ্টায় ফিরছে । যার ক্ৰোধ বেশী, সে তার দাস হয়ে ছুটোছুটি করছে । যার লোভ বেশী, সে নিত্য নূতন জিনিসের পেছনে ছুটোছুটি করে হয়রান হচ্ছে । আবার যার সাধুতায় হৃদয় পূর্ণ, সেও সৎকাজের অনুষ্ঠানে জীবন কাটাচ্ছে । এইরূপে কৰ্ম সমস্ত জগৎ ব্যাপে অধিকার-স্থাপন করে রয়েছে । প্ৰত্যেক অণুর ভেতরে, রাসায়নিক আকর্ষণ ও বিকর্ষণ অনুক্ষণ চলেছে । এও কর্মের রূপান্তর মাত্র । তোমার মনের ভেতর যেমন সর্বদা কাজ চলেছে, ওদের ভেতরেও তেমনি । অতএব কাজ করছ বলেই যে একত্ব লাভ করবে তা নয় । ‘কর্মযোগেন যোগিনাম্‌ ।” যোগের আশ্ৰয় নিয়ে সকল কর্মের অনুষ্ঠান করতে হবে, তবেই হয় ৷ এমন ভাবে সকল কাজ করতে হবে, যাতে সেই একজ্ঞানের দিকে নিয়ে যায় । গীতা বলছেন, কাজ কখনও ছেড়ো না । কিন্তু এমন কৌশলে কর, যাতে তোমায় কাম-কাঞ্চনে না বাঁধতে পারে ।

গীতাতে কর্ম করা উচিত কি না, এ সম্বন্ধে অনেক বার অনেক কথা বলা হয়েছে, দেখতে পাওয়া যায় । এমন কি, এক একবার মনে হয়, কর্ম করা যে উচিত এবং যতক্ষণ শরীর থাকবে, ততক্ষণ সকলকেই যে কোন না কোন ভাবে কর্ম করতে হবে, এ সকল তো স্বতঃসিদ্ধ সত্য, এর উপর গীতাকার এত কথা কেন বলছেন ? এ প্রশ্নের উত্তরে বলা যেতে পারে যে, গীতোপদেশের পূর্বাবধি ভারতে দর্শনের চর্চা অত্যধিক হয়েছিল । দর্শনের নানা মত নিয়ে নানা সম্প্রদায়েরও সৃষ্টি হয়েছিল । দশনচর্চার ফলে এও স্থির সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে, মন অন্তবিশিষ্ট, নামরূপ বা দেশকাল ও কার্যকারণ-শৃঙ্খলের গণ্ডির বাইরে মনের যাবার শক্তি নেই এবং কোন কালে যেতেও পারবে না । মনের এই সসীম স্বভাব-সম্বন্ধে সকল দর্শনকারই একমত ছিলেন । অতএব তাঁদের সকলের এই অনুসন্ধানের এই এক উদ্দেশ্যই হয়েছিল যে, মানুষ কি করে এই সসীম মনের পারে গিয়ে অনন্ত সত্যের অধিকারী হতে পারে । মন যখন সীমাবদ্ধ, কখনও অনন্তকে ধরতে পারবে না, তখন সম্পূর্ণরূপে মন স্থির করে বসে থাকা, সত্য লাভ করবার ইহাই একমাত্র উপায় বলে প্রচারও হয়েছিল । ঐ রূপ প্রচারের ফলে অপর সাধারণ লোকেরাও বুঝুক, আর নাই বুঝুক, সেই দিকে যেতে লাগল । ইন্দ্ৰিয়জয়ী পুরুষ মনকে যথাৰ্থ স্থির করে নিলেন, কিন্তু জড়-দর্শী অপর সাধারণ কেবল মাত্র বাইরে কাজ ছাড়ল, কেহ কেহ বা নামমাত্র সন্ন্যাসী হল । সাধারণের সেই বিপরীত বুদ্ধি ফিরিয়ে আনবার জন্যেই গীতাকারের কর্ম করা উচিত কিনা এই বিষয় নিয়ে এত তর্কের প্রয়োজন হয়েছিল ।

সেই জন্যেই তাঁর যথার্থ কর্মই বা কি, কেমন করেই বা করতে পারা যায় এবং যথার্থ কর্মরহিত হয়ে সকল বন্ধন হতে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত হওয়াই বা কি, তা বোঝাবার এত চেষ্টা । এই জন্যেই ভগবান শ্ৰীকৃষ্ণ গীতার তৃতীয় অধ্যায়ে এবং চতুর্থ ও পঞ্চম অধ্যায়ের অনেক স্থলে কর্মযোগ কাকে বলে, এ কথা সবিস্তার বুঝিয়েছেন ।
[১৯০২ খিষ্টাব্দের ২৭শে ডিসেম্বর, বিবেকানন্দ সমিতিতে প্রদত্ত বক্তৃতার সারাংশ]


5) কর্মযোগ ১


ইউরোপ ও আমেরিকার পণ্ডিতদের মতে ভারতবর্ষের ধর্মই বল, দর্শনই বল, কেবল বৈরাগ্যের কথাই বলছে - সংসারের কোন বিষয়ে মন দিও না, কেবল ত্যাগ কর, ত্যাগ কর, এই কথাই বলছে । তাঁরা বলেন, সেইজন্যেই হিন্দু জাতটার ভেতর একটা melancholy বা বিষাদের ছায়া, একটা কর্মে উদাসীনতা বা উদ্যমরাহিত্য, দুদিনের জীবনে এসব আর কেন, এইরকম একটা ভাব এবং তার ফলস্বরূপ আলস্য ও জড়তা এসে পড়েছে । কথাটা কতদূর সত্য, তা গীতা পড়লেই বুঝতে পারা যায় । ভগবান গীতাকার কেবল যে বার বার বলছেন, কর্ম ছেড়ে না, তা নয় । কিন্তু নিজ জীবনে প্রতিক্ষণে দেখাচ্ছেন, intense activity with intense rest – অপূর্ব কর্ম-উদ্যমের মধ্যে অপূর্ব বিরাম । সব কাজ করছেন, অথচ ভেতরে অনন্ত স্থিরতা । একেই গীতাকার নির্লিপ্ততা, অনাসক্তি ইত্যাদি নামে নির্দেশ করেছেন । অতএব ইউরোপীয় পণ্ডিতেরা যে বলেন, হিন্দুশাস্ত্ৰ মানুষকে অকৰ্মণ্য করেছে, এ কথা সত্য নয় । ওঁরা মনে করেন, ওঁদের ধর্ম ওঁদের জাতটাকে বড় লড়ায়ে করে তুলেছে এবং সে জন্যই ওঁদের ভেতর সাংসারিক উন্নতি এবং কর্মোদ্যম এত বেশী । সেটাও বাস্তবিক ঠিক কথা নহে। বাইবেলে প্রত্যেক জায়গায় বৈরাগ্যের উপদেশঃ "The foxes have holes, and the birds of the air have nests, but the son of man hath not where to lay his head.” - কালকের জন্যে কিছু ভেবো না, আকাশের পাখীরও বাসা আছে এবং বন্য পশুরও থাকবার গর্ত আছে, কিন্তু শিক্ষাদাতা যে আমি, আমার মাথা গুঁজে থাকবার একটুও স্থান নেই । ঈশার জীবনী আমাদের দেশের সন্ন্যাসী-জীবনের মতো - পড়লেই বুঝা যায় । ওঁরা এখন বাইবেলের মানে ঘুরিয়ে আপনাদের দরকার মতো মানে করে নিয়েছেন । তা বলে কি সেই মানে নিতে হবে ? গীতা বলেন, মানুষের ধর্মানুষ্ঠান তার প্রকৃতি-অনুযায়ী হয়ে থাকে । Anglo-Saxon জাত সকলকে দাবাবে, সকলের সঙ্গে লড়াই করবে, কেন না ওদের রজোগুণ ঠাসা রয়েছে । ওরা ধর্মের মৰ্মও যে ঐ রূপে আপনাদের মতো বুঝবে, এতে আর বিচিত্র কি ? নচেৎ সকল ধর্মের মৰ্মই এক, এবং সকল ধর্ম ত্যাগ, পূর্ণজ্ঞান ও অমৃতত্বলাভের একমাত্র পথ, এ কথা মানুষকে শিক্ষা দিচ্ছে ।

মহাভারত ও গীতা পাঠে বুঝা যায়, কোনটা কর্ম, কোনটা অকর্ম, কি কি কাজ করা উচিত এবং কি কি উচিত নয় এবং মনুষ্য-জীবনের উদ্দেশ্য - জ্ঞান কর্মের দ্বারা লাভ হয় কি না, এই বিষয় নিয়ে যে-কোন কারণেই হোক, সেই সময়ে একটা সন্দেহ উঠেছিল । সেইজন্য গীতাতে বারবার ইহা বুঝাইবার চেষ্টা যে, জ্ঞান ও কর্ম পৃথক নয় । কর্ম আশ্রয় করলে চিত্ত শুদ্ধ হবে এবং তা হলে জ্ঞান আপনিই আসবে । অর্জুন কিন্তু ওকথা সহজে বুঝতে পারছেন না, কেবল ভুলে যাচ্ছেন । সেইজন্যে শ্ৰীকৃষ্ণ ফের বলছেন, সকলের এক পথ নয় । নিজের লাভ-লোকসানের দিকে দৃষ্টি না রেখে কৰ্তব্যবোধে সংসারের যাবতীয় কাজই কর, অথবা কাম কাঞ্চন ত্যাগ করে সন্ন্যাসী হয়ে একটা বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে জীবন কাটাও, উভয় পথের ফল একই হবে । কারণ, উভয় পথই মানুষকে ত্যাগ শিক্ষা দিচ্ছে এবং সম্পূর্ণ আত্মত্যাগই ধৰ্মলাভের একমাত্র পথ ।

ভোগসুখের জন্যে অনুষ্ঠিত সাংসারিক কর্মও মানুষকে ধীরে ধীরে ত্যাগ শিক্ষা দেয় । সাংখ্যকার মহামুনি কপিল বলেন, পুরুষকে স্বমহিমা অনুভব করিয়ে দেবার জন্যই প্ৰকৃতির জগৎ-সৃষ্টিরূপ বিচিত্র উদ্যম । ভোগসুখের দ্বারা আপনার তৃপ্তিসাধন করতে গিয়ে ধাক্কার ওপর ধাক্কা খেয়ে মানুষ জীবনের প্রতিদিন কেমন ধীরে ধীরে অনিত্য সুখের ওপর বিরক্ত হয় ও ত্যাগ শিক্ষা করে, তা ভাবলে ওকথা ধ্রুব সত্য বলে বোধ হয় । আবার ছেলেকে ভুলিয়ে ঔষধ খাওয়ানোর মতো মানুষের চোখের ওপর নাম, রূপ, যশ, প্ৰভুত্ব বা অন্য কোন একটা অনিত্য পদার্থবিশেষকে অতিরঞ্জিত করে ধরে তাতেই সুখ-শান্তি, তল্লাভেই পুরুষাৰ্থ, এই বুঝিয়ে কেমন সহজ উপায়ে প্রকৃতি তাকে অন্যান্য অনিত্য পদার্থসকলের তুচ্ছতা অনুভব করিয়ে দেয় ।

মনে কর, একজন ভাবলে আমি বড়লোক হব । প্ৰথমে বুঝলে, বড়লোক মানে টাকা হবে, দশজন লোক বশে থাকবে ইত্যাদি । অনেক পরিশ্রমে ধনী হল, বুদ্ধিশুদ্ধিও একটুও মার্জিত হল, কিন্তু ধনী হবার পর দেখলে বিদ্বান্‌ হওয়া আরও বড় । তখন একটু এগিয়ে গিয়ে বুঝলে ঠিক বড় হতে গেলে আরও কিছু ত্যাগস্বীকার চাই । কেন না, বিদ্যাশেখা দরকার, নচেৎ লোকে বড়লোক বলে মানবে কেন ? বিদ্যা শিখতে গেলে কাজেই পাঁচজনকে নিয়ে বৃথা আমোদপ্রমোদ, আপাতমধুর নানাপ্রকার সুখসম্ভোগ ইত্যাদি হতে আপনাকে পৃথকৃ রাখতে হল । এইরূপে বড়লোক কথাটার মানে যত বুঝতে লাগল, তত ধীরে ধীরে তার ধারণা হতে লাগল যে, ত্যাগ-স্বীকার না করলে উচ্চ হওয়া যায় না । মানুষ এইরূপে সকল বিষয়ে বোঝে যে, ত্যাগ-স্বীকার না করলে কিছুই লাভ হয় না । শাস্ত্র বলেছেন, ছোট-খাট বিষয়গুলিতে এইরূপে অল্প অল্প ত্যাগ করতে শিখে অবশেষে মানুষ পূর্ণ ত্যাগ করে অমৃতত্ব পর্যন্ত লাভ করে ।

কর্মের দ্বারা মানুষ যতই অগ্রসর হয়, ততই উচ্চতর মহত্বের আদর্শ তার মন বুঝতে ও ধরতে পারে । তা লাভ করতে অন্যান্য সামান্য বিষয় ত্যাগ করা আবশ্যক দেখে সে সেগুলি ত্যাগ করে ফেলে । বিবেকানন্দ স্বামীজীর একটি উপমা এখানে বেশ খাটে-আমরা সূৰ্যকে এখান থেকে দেখছি একটি থালার মত । হাজার মাইল এগিয়ে যাও, সেই সূৰ্যই কত বড় দেখাবে । আরও হাজার মাইল যাও, আরও বড় দেখাবে । কিন্তু তোমার বোধ থাকবে, এ সূর্য নেই । তেমনি আদর্শ এগিয়ে এগিয়ে ভগবানে পৌঁছুবে অথচ আমাদের বোধ হবে, আমরা একটা আদৰ্শই চিরকাল ধরে আছি । পরমহংসদেব বলতেন, মানুষ যদি একটা বিষয় ঠিক ঠিক করে ধরে, তা হলে তাতেই শেষে ভগবানের পূর্ণ বিকাশ দেখতে পাবে ।

গীতায় বলছেন, যোগ ও ভোগ, কর্ম ও সন্ন্যাস, মানুষের নিজের অবস্থাভেদে সত্য ও অসত্য, লাভের বিষয় বা ত্যাগের বিষয় এইভাবে অনুভূত হয় । অর্থাৎ কারও মনে যোগই ঠিক, আবার করেও মনে ভোগই ঠিক বলে ধারণা হয় । দেখা যায়, কর্ম সকলের সমান নয় । সাধারণ মানবের কর্ম আপনার সুখ-বিলাস এবং স্ত্রী-পুত্র-প্রতিপালনে আবদ্ধ । তা হতে যে একটু উঁচু হয়েছে, সে নিজের দেশের জন্যে ভাবে । কিসে দেশের লোক খেতে পাবে, কেমন করে তাদের লেখাপড়া শেখাবার সুবিধা হবে, কেমন করে তারা পৃথিবীর অপর জাতের সঙ্গে সমান হয়ে চলতে পারবে, এইসব চিন্তায় ব্যাকুল হয়; তার চেয়ে যারা বড় হয়েছে, তারা ভাবে কেমন করে দেশের লোক সত্যপথে থাকবে, সংযমী হবে, অপরের ওপর বিনা কারণে অন্যায় অত্যাচার না করে দয়ায় চক্ষে দেখবে ইত্যাদি । কেন না, তারা দেখতে পায় ঐ সব দোষ এলে পরেই জাতটার পতন হবে । আবার তার চেয়ে যে বড়, তাঁর কর্ম জগদ্ব্যাপী । সকল কালের সকল দেশের সকল অবস্থাপন্ন মানবের কিসে প্রকৃত কল্যাণ হয়, তাঁরা সেই ধ্যানে মগ্ন; যেমন অবতারেরা ।

ভগবান শ্ৰীকৃষ্ণ বলছেন, সাংখ্য ও যোগ তফাত নয়, মূর্খেরাই আলাদা মনে করে । হে অর্জুন, যখন তুমি এখনও এত উচ্চ অধিকারী হওনি যে একেবারে কর্ম ছেড়ে দিতে পার, তখন কর্মের মধ্য দিয়ে তোমার উদ্দেশ্য লাভ করতে হবে, নিজের লাভ-লোকসানের দিকে দৃষ্টি না দিয়ে কর্তব্য কর্ম করতে করতে যার চিত্ত একেবারে স্বার্থগন্ধহীন হয়ে গেছে, তারই ধ্যানাদি দ্বারা সমাধিলাভ করা ছাড়া সাধারণ মানবের ন্যায় কাজ করায় কিছু লাভ নেই । সেই তখন নিজের মনকে সম্পূর্ণ বশীভূত করে ক্ৰমবিকাশের স্রোতে সাধারণ মানব-প্রকৃতির সীমা উল্লঙ্ঘন করেছে । অতএব তার পক্ষে তখন অন্যরূপ ব্যবস্থা, এই বুঝে কাজ করে যাও ।

ভগবান শ্ৰীকৃষ্ণের আবির্ভাবের পূর্বে এইরূপে কর্মের চরম পরিণাম অকর্ম বা কর্মরহিতাবস্থা, শাস্ত্রের এই কথা না বোঝায় এক বিষময় ফল হয়েছিল । যত ভণ্ড, ধূর্ত ও অজ্ঞ লোকেরা কর্তব্য-কৰ্ম ছেড়ে দিয়ে একেবারে বড়লোক হতে বসেছিল । অমুক কর্মী, এ কথা বললে লোকে নাক সেঁটকাত বা তাকে দয়ার চোক্ষে দেখে বলত, “এখনও বুঝতে পারেনি, ধীরে ধীরে বুঝতে পারবে, কর্ম না ছাড়লে কিছু হবে না’ ইত্যাদি ।

মানুষের এই রকম ভুল সকল দেশেই সকল সময়েই হয়ে থাকে । ভগবান শ্ৰীচৈতন্যদেব জ্ঞান মিশ্রা ভক্তির চেয়ে জ্ঞানশূন্যা ভক্তি বড় বলছেন । অথচ জানামিশ্রা ভক্তিই জ্ঞানশূন্যা বা অহেতুকী ভক্তিলাভের একমাত্র উপায়, একথাও বলেছেন । সে কথাটি ভুলে যাওয়ায় আজকালকার বৈষ্ণব বাবাজীদের দুর্দশা দেখ । সকলেই একেবারে জ্ঞানশূন্যা ভক্তিলাভ করবে । জ্ঞানমিশ্রা ভক্তি যে করে, সে যেন তাদের চোখে বড় কুকাজ করছে । সকলেই একেবারে বড়লোক হবে । বড় লোক হতে গেলে যে কত 'কাঠ খড় পোড়াতে হয়,’ কত স্বাৰ্থত্যাগ ও উদ্যম করতে হয়, তা কেউ করবে না । একটা গল্প মনে পড়ে — একজন লোক এক সন্ন্যাসীর মঠে গিয়ে এক সাধুকে বললে, “মহারাজ, আমায় চেলা বানিয়ে নিন।” মঠের লোকেরা জিজ্ঞাসা করলে, “তুমি পারবে ? চেলা হওয়া বড় শক্ত । মঠের ঠাকুরজীর ভোগ রাঁধতে হবে, হাণ্ডা মলতে (মাজতে) হবে, জল তুলতে হবে, সাধুদের ফাই ফরমাশ খাটতে হবে, গুরু যা বলে দেবেন, সে পড়া মুখস্থ করতে হবে, তাঁর সব কথা শুনতে হবে ও সন্ধ্যার পর তার পদসেবা করতে হবে।” সে দেখলে বিষম মুশকিল । ভেবে চিন্তে জিজ্ঞাসা করলে, “আচ্ছা, গুরু যিনি হবেন, তাঁকে কি করতে হবে ?” তারা বললে, “গুরু ? - জপধ্যানপূজাদি করবেন, চেলাদের শিক্ষা দেবেন ও তাদের দিয়ে কাজ করিয়ে নেবেন ।” তখন সে বললে, “তবে মহারাজ ! আমাকে একেবারে গুরুই বানিয়ে নিন ।” আমাদের দেশে এখন এই ভাবটা বড় বেশী । - ভক্তশ্রেষ্ঠ তুলসীদাসের কথাটি শ্ৰীরামকৃষ্ণদেব প্রায়ই আমাদের শোনাতেন, “গুরু মিলে লাখ লাখ, চেলা না মিলে এক ।” এ ভাবটা যে গৃহস্থের ভেতর বেশী আর সন্ন্যাসীর ভেতর কম, তাও নয় । লোকে মনে করে, সন্ন্যাসী হয়ে গেরুয়া কাপড় পরলেই আর কর্ম থাকে না, একেবারে জ্ঞানী হয়ে যায় । গীতাকার বলেন, - 
কর্মণ্যকর্ম যঃ পশ্যেদকৰ্মণি চ কর্ম যঃ ৷
স বুদ্ধিমান মনুষ্যেষু স যুক্তঃ কৃৎস্নকৰ্মকৃৎ ৷৷
সর্বদা কর্ম করলে আত্মাকে সাক্ষাৎ দেখার দরুন যাঁর সর্বদা সকল অবস্থায় এই জ্ঞান ঠিক ঠিক থাকে যে, আমি কিছুই করি না, আমি আত্মা, আর আত্মাকে না দেখে জ্ঞানীর ভান করে অলস হয়ে বসে থাকলে যিনি দেখেন যে, বিষয়চিন্তারূপ যত কৰ্ম সব করা হচ্ছে, মানুষের ভেতর তিনিই বুদ্ধিমান, তিনিই যোগী, তিনিই সকল কর্ম যেমন করে করা উচিত, ঠিক সেই রকম করে করতে পারেন । তাঁর ভেতরই গীতাকারের ন্যায় অনবচ্ছিন্ন কর্ম-উদ্যমের ভেতর যোগীর অবিরাম শান্তি দেখতে পাওয়া যায় । যিনি ঠিক ঠিক জ্ঞানী বা ঠিক ঠিক ভক্ত হয়েছেন, তাঁর ঐরূপ হয় । তিনিই কর্ম করবার সময়েও আপনাকে তা থেকে আলাদা দেখতে পান । তিনি যেন পাকা নারকেল, ভেতরে খোলা থেকে শাঁস আলাদা হয়ে গেছে; নাড়, খটখট করে আওয়াজ হবে, আর আমরা যেন ডাব – খোলাতে শাঁসেতে এক সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছি । খোলায় আঘাত লাগলে শাঁসেও গিয়ে লাগে । কর্মযোগ করতে করতে মানুষ পেকে যায় । পাকা নারকেলের ?ত তার ভেতরে খোলা ও শাঁস ছেড়ে যায় । মন, বুদ্ধি, অহঙ্কার, ইন্দ্ৰিয় ও শরীর প্রভৃতি হতে তার আত্মা আলাদা হয়ে গিয়ে আপনাতে আপনি থাকতে পারে ।

ঐ সব বাইরের জিনিসগুলো ছেড়ে দিয়ে তার আত্মা আলাদা হয়ে দাঁড়াতে পারে । জেগে থাকবার সময় তো কথাই নেই, ঘুমোবার সময়ও সে আপনার শরীরটাকে দেখে যেন আর একটা কার শরীর, যেন অপর একজন কেউ ঘুমোচ্ছে সাধক-শ্রেষ্ঠ শ্ৰীরামপ্রসাদ গেয়ে গেছেন -
“ঘুম ছুটেছে আর কি ঘুমাই, যোগে যাকে জেগে আছি ।এবার যার ঘুম তারে দিয়ে, ঘুমেরে ঘুম পাড়ায়েছি ।”
তার অবস্থাও তখন ঠিক ঐ রূপ হ য়। আর ঐ গানের মানেও সেই ঠিক ঠিক বুঝতে পারে । মানুষ যত নিঃস্বাৰ্থ ভাবে কর্ম করে, ততই ধীরে ধীরে তার শরীরেন্দ্রিয়াদি থেকে “আমি”-বুদ্ধি উঠে গিয়ে আত্মায় গিয়ে দাঁড়ায় ও ঐরূপ অবস্থালাভ হয় ।

আর এক কথা এখানে সংক্ষেপে বলা যেতে পারে । হিন্দু শাস্ত্রে সর্বত্র একটি বিষয় বোঝাবার বিশেষ চেষ্টা দেখতে পাওয়া যায় যে, মুক্তি জিনিসটা কর্মের দ্বার লাভ করবার নয় । উহা ‘কর্মসাধ্য’ নয় । গীতাকারেরও এ কথাটা ঐ ভাবে বোঝাবার চেষ্টা দেখা যায় । এর মানে কি ? এ কথাটার ঠিক ঠিক মানে বোঝা দরকার । না বুঝলে বিশেষ ক্ষতি । কেন না, তা হলে কর্মটাকে ছোট জিনিস মনে হবে । মনে হবে মুক্তির সঙ্গে ওটার কোন বিশেষ সম্বন্ধ নেই, অতএব কর্ম করতেও প্ৰবৃত্তি থাকবে না, কর্মে নিষ্ঠা আল্‌গা হয়ে যাবে । তবে এ সব বিচার শাস্ত্ৰে কিসের জন্য ? এইটি বোঝাবার জন্য যে, কর্মের দ্বারা আত্মার স্বরূপ বা স্বভাবের কিছুমাত্র পরিবর্তন হয় না, আত্মা ক্ষয়বৃদ্ধিরহিত, উৎপত্তি-বিনাশশূন্য, নিত্যানন্দস্বভাব । কর্ম-শরীর, মন ইন্দ্ৰিয়াদিকে বদলে দেয় । যে সব যন্ত্রের ভেতর দিয়ে আমরা আত্মা ও জগৎ দেখছি কর্ম সেইগুলোকে ঘসে মেজে পরিষ্কার করে দেয় । ফলস্বরূপ মনবুদ্ধির ভেতর দিয়ে এতদিন যে ঝাপসা ঝাপসা দেখছিলাম, কুয়াসার ভেতর দিয়ে দেখার মত এতদিন যে ছোট জিনিসটাকে বড় দেখাচ্ছিল বা জিনিসটার অস্তিত্বই বোধ হচ্ছিল না, সেই সব ভুলগুলো ঘুচে গিয়ে যে জিনিসটা যেমন সে জিনিসটাকে ঠিক তেমনি দেখতে পাওয় যায় । অতএব তাঁদের মতে কর্মের ফল হচ্ছে চিত্তশুদ্ধি । আত্মাটা যে ছোট ছিল কর্মের দ্বারা ধীরে ধীরে বাড়তে লাগল এবং অবশেষে এত বেড়ে উঠল যে, তার সব বাধনগুলো পটপট করে ছিড়ে গেল, তা নয়; কেন না, একরকম কর্মের দ্বারা আত্মাটা যদি বাড়তে পারে তা হলে আর একরকম কর্মের দ্বারা সেটা ছোট হয়ে হয়ে অবশেষে বিলকুল নাও থাকতে পারে - এইটা এসে পড়ে । এই জন্য তাঁরা বলেন যে, আত্মা মুক্তি যদি কর্মসাধ্য হয়, তবে তার অন্তও আছে । কারণ, কর্ম দ্বারা যে জিনিসে উৎপত্তি হয়, তার আদি বৃদ্ধি ও বিনাশ আছে । অতএব তাঁরা বলেন, মুক্তি আত্মাতে সর্বদা রয়েছে, ওটা হচ্ছে তার যথার্থ স্বভাব; সেইটে ভুলে গিয়েই তা আপনাকে দেহ মন ইত্যাদি বলে মনে হচ্ছে, আর তার ফলেই আপনাকে সুখী দুঃখ বলে মনে করছে ।

যদি জিজ্ঞাসা কর, এ রকম ভুল তার কেন হল ? তাতে তাঁরা বলেন, সেটা বোঝবার বা বোঝাবার কথা নয় হে বাপু - সে ভুলটা আগে গেলে তবে বোঝা বা বোঝান আসে । তোমার মনবুদ্ধির দৌড়টা ঐ ভুলের গণ্ডির ভেতর । সেজন্য সে ভুলটার কারণ মনবুদ্ধি কেমন করে জানবে হে ? তবে যদি জিজ্ঞাসা কর, কেমন করে সে ভুলটা হল, হলে তা তাঁরা বলেন ‘অজ্ঞানেনাবৃতং জ্ঞানং তেন মুহ্যন্তি জন্তব্যঃ ।” অজ্ঞানের দ্বারা জ্ঞানটা ঢাকা পড়েছে, সেইজন্য এই কষ্ট । আবার যদি জিজ্ঞাসা কর, তবে উপায় ? তা হলে তাঁরা বলেন, হাঁ, সেটার একটা উপায় ঠাউরিছি । সুখ-দুঃখ, লাভ-লোকসানের দিকে নজর না দিয়ে সৎকাজগুলো করে যাও দেখি । তা হলেই এই অজ্ঞানের জড় অহঙ্কারটা নষ্ট হয়ে যাবে; আর ‘তৎ স্বয়ং যোগসংসিদ্ধঃ কালেনাত্মনি বিন্দতি ।” এইরূপে কাজ করতে করতে পূর্ণভাবে নিষ্কাম হলেই সে জ্ঞান আপনা আপনি এসে পড়বে । তা হলেই ভ্ৰমটা ঘুচে যাবে । তখন শরীর মন যে আর কাজ করবে না তা নয়, ঈশ্বরেচ্ছায় আরও ভাল করে কাজ করবে । তখন বুঝবে, কখন বা কৰ্ম করা দরকার আবার কখন বা চুপ করে থাকা দরকার । আরও বুঝবে কর্মই বা কি, আর কর্ম থেকে বিরত হয়ে ঠিক ঠিক চুপ করে থাকাটাই বা কাকে বলে । তখনি মানুষের কাজ করা বা না করা এ দুটো ক্ষমতাই আসবে । সাধারণ মানুষের তা নেই। সে কেবল কাজ করতে জানে । এক দণ্ডও কাজ না করে চুপ করে থাকতে জানে না । কাজ যেন ভূতের মত তার ঘাড়ে চেপে রয়েছে আর ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে । এইরূপে কর্মের অধীন হয়ে সে এমন জড়িয়ে পড়ে যে, বিশ্রাম বা মুক্তির ভাবটা তার নজর থেকে একেবারে উড়ে যায় । মরবার অবসর পায় না । ইহাই বিপদ । যদি বলা কেন ? কোন কাজ না করে কি আমরা স্থির হয়ে কখন কখন বসে থাকি না, বা রাত্রিকালে ঘুমোই না ? তখন আর কি কাজ করে ঘুরে বেড়াই ? গীতাকার বলেন, হাঁ, ঘুরে বেড়াও না, সত্য, কিন্তু তা বলে কি কাজ করা একেবারে বন্ধ (করে) দাও ? চিন্তা, ভাবনা বা স্বপ্ন এগুলোও যে কৰ্ম । তারপর নিঃশ্বাস ফেলা, হৃদয়স্পন্দন, রক্তসঞ্চালন প্ৰভৃতি কাজগুলো তো হতেই থাকে । তবে আর একেবারে কাজ থেকে বিরত হলে কি করে ? ওকথা কোন কাজের কথা নয় হে বাপু । তুমি কর্মের দাস - একেবারে পরাধীন । ভুলে মনে করছ আমি স্বাধীন, আমি কাজ করলেও করতে পারি, না করলেও করতে পারি; বিরাম কাকে বলে, তার কিছুই বোঝা না এবং একটু-আধটু বুঝলেও তোমার তা করবার শক্তি নেই । যদি বিরাম কথাটার যথার্থ মানে বুঝতে চাও, তা হলে নিজের লাভ লোকসানটা আজ থেকে আর না খুঁজে - করতে হয় তাই করছ - বলে সব কাজগুলো করে যাও । তা হলেই কালে বুঝতে পারবে, এই রকমে কাজ করার নামই হচ্ছে কর্মযোগ । যে কাজগুলো করতে করতে লোকের নানাপ্রকার বন্ধন আসছে, সেইগুলোকে এমন ভাবে করা যে, যা কিছু শুনছ, যা কিছু বলছ, যা কিছু করছ - সেইসমুদয় কাজগুলো তোমায় আর জড়িয়ে না ফেলে কর্মের দাসত্ব থেকে মুক্ত করে দেবে ।

কর্মযোগ ব্যাপারটা কি ? না, কর্ম করবার এইরূপ কৌশল । ‘যোগঃ কর্মসু কৌশলম্‌’ — এমন কৌশলে কর্ম করা যায় যে, কাজ করে আর জড়িয়ে পড়তে না হয়; যাতে আমাদের ইচ্ছামত স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারি । কি করলে তেমন কাজ করা যায় ? নিজের লাভের দিকে দৃষ্টি না রাখলে । যেখানেই স্বাৰ্থ, সেইখানেই ফলের আশা আর সেইখানেই আসক্তি এসে পড়ে । তুমি কাজ কর, কিন্তু দেখো, কাজ যেন তোমায় না পেয়ে বসে । নতুবা কাজ তো করতেই হবে । পিতামাতার সেবা করতে হবে, যদি বিবাহিত হও তো স্ত্রীপুত্রদের পালন করতে হবে । যে সমাজে আছ তার প্রতি কর্তব্য আছে, যে দেশে জন্মেছ তার প্রতি কর্তব্য আছে, সমগ্র মনুষ্যজাতির প্রতি কর্তব্য আছে । শাস্ত্ৰ বলেন দেব-ঋণ, ঋষি-ঋণ ও পিতৃ-ঋণ নিয়ে মানুষ পৃথিবীতে জন্মায় ।

কাজ করতেই হবে । তবে পরমহংসদেব যেমন বলতেন, সেইভাবে কাজগুলো কর — মনে কর, যেন তুমি বড়লোকের বাড়ীর চাকরানী । সে কাজকর্ম করছে, ছেলেদের খাওয়াচ্ছে-দাওয়াচ্ছে, তাদের সুখে সুখী, দুঃখে দুঃখী হচ্ছে, কিন্তু মনে মনে জানে আমি এদের কেউ নই । মনিব যেদিন ইচ্ছে করবে, সেইদিনই তাড়িয়ে দেবে । তুমিও সংসারে এই ভাবে থেকো ।

অর্জুন যতদিন রাজত্বভোগ, লড়াই-দাঙ্গা প্ৰভৃতি তাঁর জীবনের সব কাজগুলো এইভাবে করে আসছিলেন, ততদিন তাঁর বুদ্ধি পরিষ্কার ছিল । ভালবাসার মোহে পড়ে ততদিন তার বুদ্ধিশুদ্ধি গুলিয়ে যায়নি । ক্ষত্ৰিয়জীবনের উচ্চ উদ্দেশ্য - সত্যনিষ্ঠা, অন্যায় অত্যাচারের দণ্ডবিধান করে ন্যায় বিচার-স্থাপন, ধর্মের উচ্চভাবে আপনার হৃদয়ে পোষণ করে অপরকে তাতে প্ৰবৃত্ত করান, শরণাগতকে শরণাদান, দুর্বল শত্রুর প্রতি ক্ষমা ও দয়াভাব, আপনার আত্মীয় কুটুম্ব বা ভালবাসার পাত্রও অন্যায় অধৰ্ম করলে তার বিরুদ্ধে দণ্ডায়মান হওয়া ইত্যাদি - এতদিন বজায় রেখে কাজ করে যাচ্ছিলেন । মনে করেছিলেন, এ তো খুব সোজা । এইভাবেই চিরদিন কাজ করে যাবেন । কিন্তু মায়ার বিষম প্ৰতাপ ! হঠাৎ একদিন কুরুক্ষেত্রের ভীষণ হত্যাভিনয়ের আড়ম্বর-উদ্যোগ, জীবনের পরিবর্তনসঙ্কুল পরীক্ষার দিন সামনে উপস্থিত । দেখলেন ঘটনাস্রোতে আপনি একদিকে এমন জড়িয়ে পড়েছেন যে, ছাড়বার পথ নেই । ধর্ম, সত্য, ন্যায়, বিচার সব তাঁর দিকে । অমিতপ্রজ্ঞ ধর্মবন্ধু ভগবান শ্ৰীকৃষ্ণ তাঁর দিকে, নেই কেবল তাঁরা যাদের জীবনের কিশোরকাল হতে শ্ৰদ্ধাভক্তি করে এসেছেন, ভালবেসেছেন, হৃদয়ের কোমল ভাবগুলো দিয়ে এসেছেন । নেই কেবল তাঁরা, যাদের হাত থেকে এমন অত্যাচার, অবিচার, অধৰ্ম, নৃশংসতা পাবার প্রত্যাশা মানুষ স্বপ্নেও করে না । আবার তাঁরা যে কেবল তাঁর দিকে নেই তাও নয়, তাঁর বিপক্ষে দাড়িয়েছেন । এত সাধের ক্ষত্ৰিয়ধর্ম, জীবনের উচ্চ আদর্শ যদি রক্ষা করতে হয় - তো তাঁদের হত্যা করা ভিন্ন অন্য উপায় নেই । দেখলেন - তাঁদের হৃদয়ের উষ্ণ শোণিতধারায় তৰ্পণ ভিন্ন ধর্মনিষ্ঠাদেবী প্ৰসন্না হচ্ছেন না । অর্জুনের বীর হৃদয় সে ছবি স্থির হয়ে দেখতে পারলে না । ভেতরে সহস্ৰ সহস্ৰ বিপরীত ভাবের প্রবল তরঙ্গসমূহ এককালে ছুটোছুটি করে আবর্ত-সঙ্কুল করে ফেললে । ভালবাসায় মোহ এল । মোহ ধৰ্মভাবের উচ্চ স্মৃতিস্তম্ভ ডুবিয়ে ফেললে । কাজেই বুদ্ধি আর দিঙনির্ণয়ে সমর্থ না হয়ে আবর্তের ভেতর নৌকা চালিয়ে অসহায় হয়ে পড়ল । তখন স্বাৰ্থ এল । মান-অপমানের চিন্তা, জয়-পরাজয়ের ভয় ও ভাবনা সব একে একে এসে বললে, “পালাও পালাও, এ তো ধৰ্ম নয়, এ যে অধৰ্ম করতে বসেছ । কাদের সঙ্গে লড়াই করতে কোমর বেঁধেছ ? এদের সঙ্গে পারবেই বা কেমন করে ? ঐ দেখ ইচ্ছামৃত্যু ভীষ্ম, ঐ দেখ গুরু দ্রোণ, ঐ দেখ বিচিত্ৰকবচকুণ্ডলধারী একঘাতি-অস্ত্রসহায় কর্ণ, ঐ দেখ অমর কৃপ ও অশ্বথামা, ঐ দেখ পিতৃবরদর্পী সিন্ধুরাজ জয়দ্রথ - এদের সঙ্গে পারবে ? এতটুকু জমির জন্যে এত বড় বিশ্বব্যাপী নামটা কি খোয়াবে ? পালাও পালাও, ভিক্ষা করে খাও, সেও ভাল । আর যদি জেতও তো এদের মেরে সে রাজ্যভোগ কি সুখের হবে ?” অর্জুন যে ধর্মের জন্যে, সত্যবিচারের জন্যে লড়াই করতে দাড়িয়েছেন, সে কথা ভুলে গেলেন । সব কালেই জীবনের এইরূপ স্থলে মানুষের এমনি হয় । উদ্দেশ্য ভুলে স্বার্থে জড়িয়ে পড়ে । গীতায় ভগবান শ্ৰীকৃষ্ণ এটি বেশ বুঝিয়ে দিয়েছেন -
ধ্যায়তো বিষয়ান্‌ পুংসঃ সঙ্গস্তেষ পজায়তে ৷
সঙ্গাৎ সঞ্জায়তে কামঃ কামাৎ ক্ৰোধোহভিজায়াতে ৷৷
ক্ৰোধাদ্ভবতি সম্মোহঃ সম্মোহাৎ স্মৃতিবিভ্ৰামঃ ৷
স্মৃতিভ্ৰংশাদ্ধু,দ্ধিনাশো বুদ্ধিনাশাৎ প্ৰণশ্যতি ৷৷
- রূপ-রসাদি ভাবতে ভাবতে কোন জিনিসটা প্ৰথমে মানুষের মনে ভাল লাগে ও মন সেই দিকে ঢলে পড়ে, biased হয় । আমনি কামের উদয় অর্থাৎ ঐটে আমার হোক, এইরূপ ইচ্ছা হয়ে সেইটে ধরতে এগিয়ে যায় । ওতে বাধা পেলেই বিরক্তি আসে । বিরক্তির পরিণাম ক্ৰোধ । তার বশীভূত হয়ে সে সেই বাধাটা দূর করতে চেষ্টা করে । তার পরিণামে মোহ আসে । মোহ এলে ‘সত্যপথে চলব, ধর্মপথে থাকব’, ইত্যাদি উচ্চ উদ্দেশ্য গুলি ভুলে যায় । এরই নাম স্মৃতির লোপ হওয়া । তখন ন্যায়ে হোক অন্যায়ে হোক সে জিনিসটা মানুষ লাভ করতে ছোটে । গুরু-উপদেশ প্রভৃতি এতদিন যা তাকে মন্দ কাজ, পাপ কাজ থেকে বিরত রেখেছিল, সে সব ভুলে যায় । ফলে বুদ্ধি গুলিয়ে যায় ও পাপ কাজ করে অশেষ প্রকারে কষ্ট পায় ।

মনে কর, কেউ অর্থ-উপার্জন করতে চায়, দেশের উপকার করবে বলে । প্ৰথম প্ৰথম ঐ ভাব বেশ প্ৰবল থাকে । কিন্তু টাকা হাতে এলে টাকার প্রতি মায়া হয়, এবং ক্ৰমে অর্থলালসায় উদ্দেশ্য ভুলে নিজের সুখবিলাস অথবা কাঞ্চনকেই জীবনের লক্ষ্য করে ফেলে । সেইজন্য উদ্দেশ্য ঠিক রাখতে হয়, ফলের দিকে দৃষ্টি রাখলে চলবে না; এই হচ্ছে কর্মযোগ । কর্মযোগী কে হতে পারে ? যে আপনাকে বশ করতে পেরেছে, আপনার ইন্দ্ৰিয়গুলোকে বশ করেছে; জীবনের উচ্চ উদ্দেশ্য যার অবিচলিত আছে, কাজ যাকে না চালিয়ে যে কাজকে চালায় সেই কৰ্মযোগী হতে পারে । উদ্দেশ্য পুর্ণ হলে সে বুঝতে পারে, তার কাজ ফুরিয়েছে এবং কাজ থেকে অবসর নেয় ।

গীতায় তাই শিক্ষা দিচ্ছেন, কাজ কর । কাজ না করার চেয়ে কাজ করা ভাল । কিন্তু কাজ করতে গিয়ে ফল কামনা করো না । ফলকামনা এলেই বাধা পড়তে হবে । দেখতে পাওয়া যায়, পৃথিবীতে যারা কোন বড় কাজ করেছে, তারা সকলেই সংযমী পুরুষ, আপনার উদ্দেশ্য ঠিক রাখে । ছাত্রজীবনে কে বড় হয় ? যে পাঁচটা আমোদে না মেতে উদ্দেশ্য ঠিক রাখে । সংসারে কে বড় হয় ? ধর্মে কে বড় হয় ? - যে উদ্দেশ্য ঠিক রাখতে পারে । উদ্দেশ্যহারা হলেই পড়তে হবে ও তোমার দ্বারা কাজের মত কাজ আর একটাও হবে না । কেন না, তোমার বুদ্ধি গুলিয়ে যাবে । কোন্‌টা করা উচিত, কোন্‌টা নয়, তা আর ধরতে পারবে না । ফলে কতকগুলো বাজে কাজে ছুটোছুটি করে মরাই সার হবে ।

প্রশ্ন হতে পারে, মন থেকে একেবারে ফলকামনা যদি যায়, তা হলে কাজ করব কেমন করে ? কোন উদ্দেশ্যবিশেষ কামনা করা ভিন্ন কাজ কি করা যায় ? ঠিক কথা; উদ্দেশ্য ছাড়া কাজ হতে পারে না । কিন্তু সেই উদ্দেশ্যের দিকে যাবার সময় নিজের লাভালাভ খতাব কেন ? আমরা কেবল নিজের লাভ-লোকসান খতাতে চাই । ওইটে আগে খতিয়ে তবে কাজে লাগি । লেখাপড়া শিখি রোজগার করতে পারব এবং নাম হবে বলে, জ্ঞানের জন্য নয় । স্ত্রী, পুত্র প্রভৃতিকে ভালবাসি নিজে সুখী হই বলে, তাদের জন্যে নয় । এইরূপে তলিয়ে দেখলে আমাদের সকল কাজেরই উদ্দেশ্য দেখতে পাই স্বাৰ্থসেবা - আপনার অহংঙ্কারের ষোড়শোপচারে পূজা ভিন্ন আর কিছু নয় । আমাদের মুখে একখানা থাকে আর মনে একখানা থাকে । এই ভাবের ঘরে চুরিটা প্ৰথমে না ঘুচালে কোন যথার্থ কাজই আমাদের দিয়ে হবে না । কোন সত্যের পথই আমাদের চোখের সামনে পড়বে না । সেইজন্য গীতাকার অর্জুনকে সামনে রেখে আমাদের সকলকে বলছেন, ফলকামনাই সর্বনাশের মূল । ফলকামনাই তোমায় অজ্ঞানে জড়িয়ে রেখেছে, কর্তব্য করতে দিচ্ছে না। চোখে ঠুলি বেঁধে সামনে সত্য থাকলেও দেখতে দিচ্ছে না । ফলকামনা ছাড়, ছাড় । ফলটার দিকে দৃষ্টি না রাখলেই অজ্ঞান অধর্মের মূল স্বার্থপরতার হাত থেকে এড়াবে । তখন ঠিক ঠিক সুখ কাকে বলে তা বুঝবে, ঠিক ঠিক ভালবাসা কাকে বলে তা দেখবে । ফলটার দিকে দৃষ্টি না রাখলেই তুমি যোগী হবে, জ্ঞানী হবে, ভক্ত হবে । তোমার সব দুঃখ দূরে যাবে ।

শাস্ত্র পড় বা বক্তৃতা শোন, শাস্ত্রের কথাগুলি যদি জীবনে পরিণত করে কাজ না করতে পার, শাস্ত্ৰ যদি জীবনে না খাটে, জীবনের প্রত্যেক ঘটনায় সহায় না হয়, তবে সে পড়াশুনো সব মিথ্যা । তার কোন প্রয়োজন নেই । ছাত্রজীবনেই বল, সংসারে ভোগের ভেতরেই বল, আর সন্ন্যাসের ত্যাগের মধ্যেই বল, এটি করতে শেখা আগে চাই । তা হলেই মানুষ যেখানে যেমন অবস্থায় থাকুক না কেন, শাস্ত্ৰজ্ঞান জীবনের উচ্চ লক্ষ্য তার সামনে ধরে তাকে সেখান হতেই তুলে দেবে ।

স্বামীজী বলতেন, আমাদের দেশে এখন আর শাস্ত্র কেউ বোঝে না, কেবল ব্ৰহ্ম, মায়া, প্রকৃতি প্ৰভৃতি কতকগুলো কথা শিখে মাথা গুলিয়ে মরে । শাস্ত্রের মূল উদ্দেশ্যটা ছেড়ে দিয়ে কেবল কথাগুলো নিয়ে মাঝামারি করে । শাস্ত্ৰ যদি মানুষকে সকল সময়ে সকল অবস্থায় সাহায্য করতে না পারেন, তা হলে সে শাস্ত্রের বড় একটা আবশ্যক নেই । শাস্ত্ৰ যদি সন্ন্যাসীকে পথ দেখান, আর গৃহীকে পথ দেখাতে না পারেন, তা হলে সে একদেশী শাস্ত্ৰে গৃহস্থের কি দরকার ? অথবা শাস্ত্ৰ যদি মানুষ অন্য কাজ-কর্ম সব ছেড়ে বনে গেলে তবে তাকে সাহায্য করতে পারেন, কিন্তু সংসারের কোলাহলের ভেতর, দিনরাত খাটুনির ভেতর, রোগ-শোক-দৈন্যের ভেতর, অনুতপ্তের নিরাশার ভেতর, অত্যাচারিতের ধিক্কারের ভেতর, রণক্ষেত্রের করালতার ভেতর, কামের ভেতর, ক্রোধের ভেতর, আনন্দের ভেতর, জয়ের উল্লাসের ভেতর, পরাজয়ের অন্ধকারের ভেতর এবং পরিশেষে মৃত্যুর কালরাত্রির ভেতর মানুষের হৃদয়ে আশার আলো জালিয়ে দিয়ে পথ দেখাতে না পারেন, তবে দুর্বল মানুষের সে শাস্ত্ৰে কিছুমাত্র প্রয়োজন নেই ।

মনে কর, ছাত্রজীবনে জ্ঞানলাভের জন্য বা অন্য কোন সৎ উদ্দেশ্যে আমায় বিলেত যেতে হবে । শাস্ত্ৰ যদি না আমায় সে সময় সে বিষয়ে সাহায্য করতে পারেন, তবে আমার দশা কি হবে ? কিন্তু তলিয়ে দেখলে বুঝতে পারা যায় যে, আমাদের শাস্ত্রের কোন দোষ নেই, দোষ আমাদের । আমরা শাস্ত্রোপদেশ কিরূপে জীবনের প্রত্যেক ঘটনায় লাগাতে হয় ও লাগাতে পারা যায়, তা একেবারে ভুলে গেছি । ভুলে গিয়ে মনে করছি, খাটি ধর্মকর্ম করতে হলে বনে যেতে হবে । গীতাকারের অন্য মত । তিনি একদিকে অর্জুনকে বলছেন, ন্যায়বিচারের জন্য লড়াই না করলে তোমার ধর্মলাভ কিছুতেই হবে না, আবার উদ্ধবাদি অন্য প্ৰকৃতির লোককে বলছেন, তোমাকে সব ছেড়ে ছুড়ে পাহাড়ে বদরিকাশ্ৰমে গিয়ে অনন্যমনে ধ্যানজাপাদি করতে হবে । তা না হলে তোমার ধর্মলাভ হবে না । অতএব শাস্ত্রের কথাই হচ্ছে এই, তুমি যেখানেই থাক, কর্মফল ছেড়ে ঠিক ঠিক নিঃস্বাৰ্থ হয়ে কর্ম করলে সেখান থেকেই তোমার মুক্তি হবে ।

পূর্ণভাবে নিঃস্বার্থ হয়ে মানুষ যে কাজ করতে পারে, আমাদের চোখের সামনে পরমহংসদেব ও বিবেকানন্দ স্বামী তাহা নিজ নিজ জীবনে দেখিয়ে গেছেন । তাঁরা আমাদের মত শাস্ত্রের ছোবড়া নিয়ে টানাটানি করেন নি । আমাদের জীবনের সহিত শাস্ত্রোপদেশের ঐক্য চাই । তা হলেই শাস্ত্রের উদ্দেশ্য ঠিক বুঝতে পারা যায়, তা দেখিয়ে গেছেন । কেমন করে শাস্ত্ৰজ্ঞান জীবনে প্রতিফলিত করতে হয়, তাই শিখিয়ে গেছেন । আমাদের সেটি যত্ন করে শেখা চাই । তোমাদের সমিতিরও তাই উদ্দেশ্য, সেটা যেন কখনও ভুলো না । দেশ, কাল ও পাত্র ভেদে ধর্ম নানাভাবে প্ৰকাশিত হবে, এইটি নিজে ভাল করে বুঝে জগতের সামনে জীবনে সেইটি দেখাতে হবে, এ কথাটা ভুলো না । শাস্ত্রের উপদেশগুলি একালেও যে জীবনে পরিণত করা যায়, আর করতে পারলে মানুষ যে-কোন অবস্থায় থাকুক না কেন, বিশেষ সাহায্য পায়, জীবন-সংগ্রামে বিশেষ জোর পায়, তা দেখাতে হবে, ভুলো না । শাস্ত্রের যদি দোষ থাকত বা উহা যদি একালের অনুপযোগী, সেকেলে, একঘেয়ে উপদেশে পূর্ণ থাকত, তা হলে ভগবান শ্ৰীরামকৃষ্ণদেব ও ধর্মবীর বিবেকানন্দের জীবনগঠনে কখনও সহায় হতে পারত না, এটা বেশ করে বুঝো, শাস্ত্রের দোষ দিও না । দোষো আপনার চোখকে, যেহেতু শাস্ত্রের যথার্থ অর্থ ও ঠিক ঠিক উদ্দেশ্য তার দেখবার শক্তি নেই। দোষো আপনার শিক্ষাকে, যাতে চোখ, কান, নাক, মুখের ব্যবহার কেমন করে করতে হয়, তাও লোককে শিখতে দেয় না ।

আমাদের ভেতর কটা লোক ইন্দ্ৰিয়ের ব্যবহার করতে জানে ? ইন্দ্ৰিয়াকে সূক্ষ্ম জিনিস ক্রমে ক্ৰমে ধরতে শেখালে তবে তো তারা ধরতে পারবে । আজকাল আমাদের শিক্ষার উদ্দেশ্যই হচ্ছে, কেমন করে আমরা ভাল কেরানীটি হতে পারব । নূতন নূতন ভাবে চিন্তা করতে, সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম বিষয় ধারণা করতে, মস্তিষ্ক ও ইন্দ্ৰিয়-চালনা করতে শেখান দূরে থাক্‌, চিন্তা করবার শক্তিটুকু পর্যন্ত কেড়ে নিয়ে হাত-পাগুলো পেটের ভেতর ঢুকিয়ে ছেলেগুলোকে একেবারে জড় করে তুলছে । ইন্দ্ৰিয়গুলো সবল, কর্মঠ হলে তবে তো সকল বিষয় উপলব্ধি করতে পারবে এবং তবেই তো জ্ঞান হবে । আমরা চাই-অশিক্ষিত ভাঙ্গাচোরা শরীরেন্দ্ৰিয় দিয়ে যোগীর বহুকালের শিক্ষিত সতেজ অথচ বশীভূত ইন্দ্ৰিয় মনের মত সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম বিষয় সব একদিনে অনুভব করব । আরে পাগল, তাও কি কখন হয় ? আগে ইন্দ্ৰিয়গুলোকে সতেজ কর, শিক্ষাসহায়ে বশীভূত কর, বহুকাল ধরে অভ্যাস কর, শ্ৰদ্ধার সহিত চেষ্টা কর, তবে তো পারবি । তা করবো না, আর বলব - আমাদের শাস্ত্রটা সব আজগুবী ও মিথ্যাতে ভরা । হিন্দুধর্মটা কিছু নয় । এর চেয়ে মূর্খতা আর কি হতে পারে ? ছেলেবেলায় একটা গল্প পড়েছিলুম । গল্পটির নাম - চোখ থাকা ও না থাকার কত প্রভেদ । গল্পটি এই-দুজন লোক এক মাঠের ওপর দিয়ে একদিন বেড়াতে গিয়েছিল । একজন সমস্ত দিন ঘুরে ঘুরে বিশেষ কিছু না দেখতে পেয়ে মহা বিরক্ত হয়ে ফিরে এল । আর তার সঙ্গী কত কি নূতন নূতন গাছ-গাছড়া সংগ্রহ করে জমিটার উর্বরতা পরীক্ষা করে নানারকমের নূতন পাথরে জামার পকেট পুরে মহা আনন্দে ফিরে এল । দুজনে এক মাঠেই বেড়াতে গিছলো । কিন্তু শেষের লোকটি চোখের ব্যবহার জানত, এই প্ৰভেদ । স্বামীজীর সহিত যারা বেড়িয়েছে, তারা জানে, তাঁর কিরূপ দৃষ্টি ও ধারণা ছিল । কতবার দেখেছি, একই দেশের ভেতর দিয়ে একই স্থানে বাস করে, এক সঙ্গে বেড়িয়ে এলাম । তিনি এসে তাদের বিচিত্র আচার ব্যবহার ইতিহাসাদির কত কথা বলতে লাগলেন । আমরা শুনে অবাক হয়ে ভাবতে লাগলুম, ইনি এত কখন দেখলেন বা শুনলেন ।

শাস্ত্ৰ বলেন দৃঢ় শরীর, সতেজ ইন্দ্ৰিয়গ্রাম, ধারণা-সমর্থমন-বিশিষ্ট পুরুষই বেদজ্ঞানের অধিকারী হতে পারেন । সে পুরুষ এখন কোথায় ? দেশের লোকের ভেতর এত যে অদৃষ্টের দোহাই দিয়ে চুপ করে পড়ে থাকা দেখতে পাও, সবটা কি মনে কর ঈশ্বরবিশ্বাস, ধর্মবিশ্বাস থেকে আসে ? তা নয় । দুর্বলতা ও তমোগুণই হচ্ছে তার প্রধান কারণ । অদৃষ্ট বা দৈব মানুষকে সহায়তা না করলে কার্যসিদ্ধি হয় না বটে, কিন্তু গীতাকার বলেন, কাৰ্যসিদ্ধি হবার পাঁচটা কারণের ভেতর দৈবটা একটা কারণ মাত্ৰ । দৈব সহায় না হলে যেমন কোন কাজ সফল হয় না, সেইরূপ তার সঙ্গে সঙ্গে সমানভাবে চাই 
“অধিষ্ঠানং তথা কর্তা করণং চ পৃথগ্বিধং !
- বিবিধাশ্চ পৃথকৃচেষ্টাঃ ... ৷৷”
— উপযুক্ত দেশ ও কাল, উদ্যমশীল কর্তা, সতেজ শিক্ষিত ইন্দ্ৰিয়গ্রাম ও তৎসহায়ে বার বার নূতন নূতন উপায়ে কর্তার উদ্যম করা । শাস্ত্ৰ বলেছেন, দৈবসহায় ভিন্ন কোন কাজ হয় না । সেটি আমরা বেশ করে ধরে বসে আছি, কিন্তু শাস্ত্ৰ যে তা ছাড়া আরও বলছেন-সবল হও, অনলস হও, ক্রমাগত চেষ্টা কর, কাৰ্য কর, সেগুলো আমরা শুনেও শুনব না, দেখেও দেখব না । কেননা তা যে আমাদের বিলকুল নেই, আমরা যে মহা তমোগুণে পড়ে রয়েছি ।

কাজের আগ্ৰহ চাই, তার ওপর দৈব চাই । দুটোরই দরকার, তবে ফলিসিদ্ধি হয় । তোমার হাতে আছে উদ্যমী হওয়া, অনলস হওয়া, ফলসিদ্ধি তোমার হাতে নেই, তোমার দেখবার দরকারও নেই । তোমায় দেখতে হবে, উদ্দেশ্যটা ঠিক রাখতে পেরেছি কিনা । কর্মযোগে গীতাকার এইটি হতে তোমায় শিক্ষা দিচ্ছেন ।

কর্মযোগের আর একটি উদ্দেশ্য আছে - শক্তিক্ষয় নিবারণ করা । যোগ হচ্ছে - কর্ম করবার কৌশল । কর্মবিশেষে যতটুকু শক্তিপ্রয়োগ করা দরকার, ততটুকু তাতে লাগান - অল্পও নয়, অধিকও নয় । ফলকামনা না করলে সেইটি হয় । মনে কর, ফলের দিকে মন দিয়ে যদি অকৃতকাৰ্য হল, তা হলে মনস্তাপে তোমার কত শক্তিক্ষয় হল । কৰ্মযোগ বলছে, শক্তিক্ষয় করো না । শক্তি সঞ্চয় কর এবং শারীরিক শক্তির সারভাগকে মানসিক ও আধ্যাত্মিক শক্তিতে পরিণত কর । সংযম ও কর্মযোগের এই শিক্ষা । যতটুকু শক্তিপ্রয়োগ দরকার, ততটুকু কাজে লাগাও । তোমার যতটুকু ক্ষমতা রয়েছে, ততটুকু করেছো কি না সর্বদা দেখো । কিন্তু যেটা তোমার হাতে নেই, সেটার জন্য মাথা খুঁড়ে হা-হুতাশ করে শক্তিক্ষয় করে না । ভোগী, ফলকামী পুরুষের শক্তি সর্বদাই ঐরূপে ক্ষয় হয় । কাজেই কর্ম করবার শক্তিও তার দিন দিন কমে যায় । সেইজন্য কেবল উদ্দেশ্যের দিকে তাকিয়ে কাজ করে চলে যাও ।

ঐরূপে কাজ করবার উপযুক্ত কে ? - যে আপনার মনটাকে বশ করতে পেরেছে । ঐরূপে কাজ করে গেলে কি হয় ? - কর্মবন্ধন কেটে গিয়ে ধীরে ধীরে পূর্ণজ্ঞান লাভ হয় । ভগবান শ্ৰীকৃষ্ণের জীবনে এই কৰ্মযোগের অনুষ্ঠান বিশেষরূপে দেখা যায় । দেখা যায়, তাঁর ইন্দ্ৰিয় মন সর্বদা অশেষ কাজ করলেও তিনি অল্পমাত্ৰও ফলাকাঙ্ক্ষী নন । তাঁর ন্যায় অবতারেরাই জগতের যথার্থ গুরু । তাঁদের জীবনই জ্ঞানের বিস্তারের জন্য, লোকের শিক্ষার জন্য । তাঁদের জীবন দেখে ঐ ভাবে কাজ করতে শেখ । নতুবা সংযম করতে না শিখলে, ফলাকাঙ্ক্ষায় কাজে প্ৰবৃত্ত হলে, মন ক্ৰমে ক্ৰমে ইন্দ্ৰিয়ের দাস হয়ে পড়বে এবং ঐ ইন্দ্ৰিয়ই আমাদের মাটি করবে । ইন্দ্ৰিয়ের দাস হলে চলবে না, কাজ হবে না, উদ্দেশ্য হারাতে হবে । ইন্দ্ৰিয় ও মন বশে রাখতে হবে । মহান উদ্দেশ্য সামনে রেখে নিষ্কাম হয়ে কাজ করে যাও । দেখবে জ্ঞানযোগী তীব্র বৈরাগ্যসহায়ে যে অবস্থা লাভ করেন, কর্মযোগী কর্মের দ্বারা ঠিক সেই অবস্থায় পৌঁছুবেন । দুজনেরই উদ্দেশ্য এক, কিন্তু পথ আলাদা । পথে যতক্ষণ, ততক্ষণ উভয়ের মিল না থাকলেও উদ্দেশ্যে পৌঁছুলে আর বিরোধ থাকে না ।
[১৯০৩ খিষ্টাব্দের ১৮ই জানুয়ারি, কলিকাতা বিবেকানন্দ সমিতিতে প্রদত্ত বক্তৃতার সারাংশ]


6) কর্মযোগ ২


কর্মযোগ বলে, মানুষকে কৰ্ম করতেই হবে । কৰ্ম ছেড়ে কখনই থাকতে পারবে না । যতদিন শরীর থাকবে, মৃত্যু না হবে, ততদিন কোন না কোন, কিছু না কিছু কাজ করতেই হবে । মানুষের পক্ষে কাজ ছাড়া অসম্ভব ।

আবার অন্যদিকে শাস্ত্র বলছেন, “সমস্ত কাজ যতদিন না ত্যাগ করতে পারবে, ততদিন মানুষের জ্ঞানলাভ ও মুক্তি অনেক দূরে ।”

সাধারণভাবে দেখলে দুটি কথা বড়ই বিপরীত । সামঞ্জস্য করা বড়ই কঠিন । তাই গীতায় ভগবান শ্ৰীকৃষ্ণ কৰ্মযোগ উপদেশ করে ঐ দুই বিরুদ্ধ বিষয়ের মীমাংসা করে দিচ্ছেন; বলছেন-সম্পূর্ণ কর্মরহিত অবস্থায় না পৌছুলে জ্ঞানও হবে না, শান্তিও পাবে না, সেটা ঠিক; কিন্তু সে অবস্থাটা হাত পা গুটিয়ে বসে থাকলেই যে হল, তা নয় । তাতে বরং তোমায় কপটাচারী করে তুলবে । সে অবস্থাটা লাভ হলে শরীরেন্দ্ৰিয়ের দ্বারা কাজ করলেও তোমার ভেতরে ‘আমি কর্মরহিত-শরীরেন্দ্ৰিয় থেকে সম্পূর্ণ পৃথক ’- এই ভাবটি সর্বদা বর্তমান থাকবে । এমন কৌশলে কাজ করা যায়, যাতে কাজ করতে করতে ধীরে ধীরে মানুষ ঐ অবস্থায় পৌছায় । অতএব কর্মযোগের মূলমন্ত্রই হচ্ছে - কর্মের ভেতরে থেকেও আপনাকে কর্মরহিত করে রাখতে শেখা ।

শরীর-মনের দ্বারা নিয়ত কাজ চলবে অথচ নিজে কর্মরহিত হয়ে থাকতে হবে - এইটাই হচ্ছে ঠিক অকৰ্ম বা কর্মরহিতাবস্থা । হাত পা গুটিয়ে বসে আছি অথচ মনে মনে নানারকমে 'লঙ্কা-ভাগ’ কচ্ছি - সেটা কর্মরহিত হয়ে থাকা নয় । ঠিক ঠিক কর্মরহিত হয়ে যিনি থাকতে পারেন, ভগবান শ্ৰীকৃষ্ণ বলেন, “তিনি মানুষের ভেতর বুদ্ধিমান, তিনিই যোগী, তাঁর দ্বারাই সব কাজ ঠিক ঠিক সম্পন্ন হয় ।” যথা—
কৰ্মণ্যকর্ম যঃ পশ্যেদকৰ্মণি চ কৰ্ম যঃ ৷
স বুদ্ধিমান্‌ মনুষ্যেষু স যুক্তঃ কৃৎস্নকৰ্মকৃৎ ৷৷
- কর্মের ভেতর থেকে যিনি আপনাকে কর্মরহিত দেখতে পান আর অলস হয়ে কর্ম ছেড়ে থাকলে কর্মরহিত হওয়া অনেক দূর, একথাও যিনি বোঝেন, মানুষের ভেতর তিনিই বুদ্ধিমান, তিনিই যোগী, তিনিই সকল কাজ যথাযথ করতে পারেন ।

অতএব শরীর মন প্রভৃতি কর্মে নিযুক্ত রাখতে হবে; আবার সেই সঙ্গে নিজেকে সম্পূর্ণ কর্মরহিত জেনে ভেতরে যোগীর অবিরাম শান্তি নিয়ত প্রবাহিত রাখতে হবে । এইরূপে কৰ্ম ও জ্ঞানের সামঞ্জস্য আমাদের প্রত্যেকের ভেতরে স্থাপিত হবে । মুক্ত পুরুষের এই ভাবটা নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের ন্যায় সহজ হলেও সাধককে অনেক যত্নে অনেক উদ্যমে সুখদুঃখজড়িত অনেক কর্মের ভেতর দিয়ে ধীরে ধীরে এই অবস্থা লাভ করতে হয় ।

কর্ম ও জ্ঞান উভয়ের সম্বন্ধ ও সামঞ্জস্য-স্থাপনই গীতার প্রথম পাঁচ অধ্যায়ের বিশেষ লক্ষ্য । পূর্বে বলেছি, গীতাকারের সময়ে জ্ঞান ও কর্মের সম্বন্ধ সাধারণে ঠিক বুঝতে না পেরে শাস্ত্রের উদ্দেশ্য গুলিয়ে ফেলেছিল । কর্ম ও জ্ঞান পরস্পর-বিরুদ্ধ - একটা করতে গেলে অন্যটা কখনই করতে পারা যাবে না, এইরূপ লোকে বুঝত । এখনও যে আমাদের দেশে অনেক বিষয়ে ঐ প্রকার ভুল ধারণা নেই, এ কথা কে বলবে ? মনে কর ধর্ম করতে গেলে বনে যেতে হবে, জগতের কোন জীবের জন্য কোন কাজ করলে আর ধর্ম হবে না - আমাদের ভেতর পুরানো লোকদের এই যে ‘অন্ধ বিশ্বাস; অথবা সংসারে স্ত্রী-পুত্র নিয়ে সুখে স্বচ্ছন্দে থাকাটাই জীবনের উদ্দেশ্য - সংসার ছেড়ে, কর্ম ছেড়ে জ্ঞানী হওয়া, সে আবার কি রকম জ্ঞান রে বাপ, সে একটা কোন রকম অস্বাভাবিক উপায়ে, মাথা বিগড়ে, জড়বৎ হয়ে যাওয়া - আমাদের সুশিক্ষিত ( ? ) নবীন ছোকরাদের ইংরেজ গুরুর পদতলে বসে এই যে অদ্ভূত ‘চক্ষুষ্মান্‌’ বিশ্বাস হয়েছে, সেগুলিকে “পরের মুখে ঝাল না খেয়ে' নিজে নিজে শাস্ত্ৰ পড়ে দেখলে কি মনে হয় ? শাস্ত্রের এই কথাটি একদল একেবারে ভুলে গেছেন যে, কর্মের দ্বারা প্ৰথমে মন-বুদ্ধি পরিষ্কার না হলে জ্ঞান হওয়া অসম্ভব । অন্যদল একেবারে “না পড়েই পণ্ডিত' - পরমহংসদেব যেমন বলতেন, ‘ও-কথা খবরের কাগজে তো লেখেনি' বা ইংরেজের মানে না’ - তবে শাস্ত্ৰকথিত জ্ঞানটাকে মানুষের উন্নতির চরম সীমা বলে তাঁরা কেমন করে মানেন ।

শাস্ত্ৰ বলেন, মানুষ প্ৰথমে বেদাভ্যাস করবে । তবে তার ধর্মে নিষ্ঠা হবে । ধর্ম হচ্ছে ক্রিয়ামূল । অতএব ধর্মলাভ করবে বলে সে নানা কাজ করবে । নানা কাজ করতে করতে তার নানা প্রকারের সুখদুঃখ-অনুভব হয়ে ধীরে ধীরে ‘জগৎ অনিত্য’ এই জ্ঞান হবে । তখন সে আর নিজে সুখী হব, বড় হব বলে প্রত্যেক কাজ না করে নিষ্কাম হয়ে কর্তব্য বলে কাজ করতে চেষ্টা করবে । উহাতে ক্ৰমশঃ মন-বুদ্ধি পরিষ্কার হয়ে সে নিজের লাভ-লোকসান-খতানটা একেবারে ছেড়ে দেবে । ইহারই নাম যথার্থ ত্যাগ । বিবেকবুদ্ধি-প্রেরিত এই ত্যাগ একবার জীবনে এলে সঙ্গে সঙ্গে নিত্য বস্তুলাভের বিশেষ আগ্রহ প্ৰাণে উদিত হয় এবং সেই বিষয়ের জ্ঞানও তৎক্ষণাৎ উপস্থিত হয় । তখন সকল বিষয়ে সর্বপ্রকারে একত্বের অনুভব হয় । ভেতরে বাহিরে সে দেখে কেবল এক-এক-এক । একবার এই একজ্ঞান হলে আর তার লোপ হয় না । মরীচিকাকে একবার বালির ওপর আলোর খেলা বলে জানলে আর জল বলে বোধ হয় না ।
তবে এই একজ্ঞান জীবনে অনুভব করেও কতকটা দ্বৈতবুদ্ধি, লোকশিক্ষার জন্য বা উচ্চ উদ্দেশ্যবিশেষের জন্য ফের এনে কাজ করা যেতে পারে । পরমহংসদেব বলতেন, “যেমন সুরজ্ঞ গায়ক - অনুলোম ধরে ওপর গ্রামে উঠলো, আবার বিলোম ধরে নীচের গ্রামে নামলো । যখন সে সুর ইচ্ছে গলা দিয়ে বার করলে ।” একজ্ঞানীর কাজ করা না করা ঠিক ঐ রকম মুঠোর ভেতর থাকে । তবে হাজার চেষ্টা করেও তিনি আর কখনও সাধারণ লোকের মত, কাম-কাঞ্চন-যশ নানাদিকে ‘চিজ, বস্তু, মাল’ বা জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য বলে দেখতে পারেন না । যেমন মরীচিকাটা একবার জল নয় বলে বোধ হলে আবার তুমি যেখানে ঐ রকম ভুল বুদ্ধি হয়, সেখানে যেতে ও সেই ভুলটা বার বার দেখতে দেখাতে পার, কিন্তু আর কখন ঐ জলপান করে তৃষ্ণা মেটাতে যাবে না - সেইরূপ ।

কর্ম যে জ্ঞানলাভের একমাত্র উপায়, এই কথাটা মনে না রাখতে পারলে বিষম গোল লাগবে । ‘জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ’ পর্যন্ত সকল কর্মই এই জ্ঞানলাভরূপ উদ্দেশ্যের দিকে মানুষকে এগিয়ে দেয়, যদি নিজের লাভ-লোকসানটা খতিয়ে সে উহা না করে । ভারতে গৃহী ও সন্ন্যাসীর লক্ষ লক্ষ লোক জ্ঞানলাভের চেষ্টা করছেন — সেটা খুবই ভাল কথা । কিন্তু তাঁদের ভেতর পনর আনা লোকই নিজের লাভ-লোকসান-খতানটা আগে না ছেড়ে আগেই কর্মটাকে মায়া বলে যতটা পারেন ছাড়বার চেষ্টায় থাকেন । তাতে হয় এই যে, খাওয়া-পরা ইত্যাদি স্বার্থের জন্য অনুষ্ঠিত কর্মগুলি ঠিক বজায় থাকে; কেবল দান, দীনসেবা, দেশানুরাগ প্রভৃতি পরহিতের জন্য অনুষ্ঠিত কাজগুলিই আগে ত্যাগ হয়ে যায় - কেননা সেগুলি করায় ঢের ‘বখেড়া’, ‘হাঙ্গাম” । কে ‘ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ায় ?’ ফলে যা দেখছি, স্বার্থপরতায় দেশ পূর্ণ হয়ে সকলেই অধঃপাতে যেতে বসেছি । বিবেকানন্দ স্বামীজী যেমন বলতেন, “দেশের লোকগুলোর যোগ তো হলই না, ভোগও হল না, কেবল পরের জুতোলাথি খেয়ে কায়ক্লেশে কোনরূপে দুটো উদরান্নের সংস্থান - তা কারুর হল, কারুর হল না ।” ঐ সকল লোক যদি গীতাকার যেমন বলেছেন, এবং প্রতি ঘটনায় নিজের জীবনে দেখিয়েছেন, পরহিতের জন্য, দেশের কল্যাণের জন্য, গরীব-দুঃখীর সেবা ও শিক্ষার জন্য, যার যতটুকু সাধ্য নিষ্কাম হয়ে কাজ করে যান, তাহলে জপ-ধ্যানের ন্যায় ঐ সকল কাজই তাঁদের প্রত্যেককে জ্ঞানলাভের দিকে এগিয়ে দেয়, দেশেরও এমন দুরবস্থা থাকে না । দেখা যায় একজনের স্বাৰ্থত্যাগে যখন কত লোকের কল্যাণ হয়, তখন যে দেশে লক্ষ লক্ষ লোক স্বার্থবিলি দিতে কোমর বেঁধেছে, সে দেশের কখনও দুরবস্থা থাকে ? অপর দিকে ইংরেজী শিক্ষিতদের ভেতর, ইংরেজ গুরুর দৃষ্টান্তে সকাম কর্মে একটু আস্থা হলেও, নিষ্কাম হয়ে কাজ করা তাঁরা একেবারে বোঝেন না এবং সেই সঙ্গে কর্মের উদ্দেশ্যই ব৷ কি, তাও তাঁদের প্রাণে ঢোকে না । অতএব শাস্ত্রোক্ত জ্ঞানলাভের দিকে তাঁদের আদৌ ঝোঁক নেই - উহা লাভ করতে উদ্যম করা যে দরকার এটাও তাঁরা বোঝেন না । বোঝেন না যে, এই জ্ঞান আমাদের ঋষিকুল হতে প্রাপ্ত বহুমূল্য জাতীয় সম্পত্তি । যুগযুগান্তরের পরাধীনতার পেষণে ভারতের বিদ্যা, ধন, মান সব গিয়েছে - আছে বাকি যেতে কেবল ঐ জ্ঞান, একজ্ঞান, অদ্বৈত জ্ঞান, যা লাভ হলে মানুষ সকল অভাবের হাত থেকে মুক্ত হয়ে মৃত্যুঞ্জয় হয় । প্রত্যেক হিন্দুর এই জাতীয় সম্পত্তি অতি-সাবধানে রক্ষা করতে হবে । ঐ জ্ঞানের যেদিন লোপ হবে, সেদিন হিন্দুর হিন্দুত্ব যাবে, ভারতের নিজের অস্তিত্ব লোপ হবে এবং কুলধৰ্ম, জাতিধর্ম, সব খুইয়ে জাতটা উৎসন্ন হয়ে যাবে ।

গীতোক্ত এই জ্ঞান উপলব্ধির জিনিস । আমাদের ওঠা, বসা, নাওয়া, খাওয়া, শোয়া প্রভৃতি সকল অবস্থার ভেতর, সকল রকম কাজের ভেতর এর অনুভব চাই । তর্ক, যুক্তি বা কল্পনাসহায়ে ঐ জ্ঞানের একটু আভাস পেয়ে বসে থাকলে চলবে না । অবিদ্যাপ্ৰসূত কামকাঞ্চনকে জীবনের উদ্দেশ্য করলে চলবে না । জ্ঞানের জন্য জ্ঞানের চর্চা করতে হবে । জ্ঞানে তন্ময় হতে হবে, উন্মাদ হতে হবে, ‘মত্ত’ হয়ে যেতে হবে ।

কর্মযোগের দ্বারা সূক্ষ্ম হলে, মার্জিত হলে তবেই সে বুদ্ধিতে জ্ঞানের উপলব্দধি হবে । পরমহংসদেব বলতেন, “ভগবান বিষয়বুদ্ধির বাইরে, কিন্তু শুদ্ধ বুদ্ধির গোচর ।“ অতএব ফলকামনা ছেড়ে কর্ম করাই হচ্ছে জ্ঞানলাভের একমাত্র উপায়; আর নিজের লাভালাভটা যদি আমাদের কর্মের উদ্দেশ্য না হয়, তাহলে যে কাজই করি না কেন, তাহা দ্বারা ক্রমে জ্ঞানের বিকাশ হবেই হবে । কর্মে দোষ নেই – কখনই নেই; কিন্তু দোষ রয়েছে আমাদের ভেতরে । নিজের লাভটাকে কর্মের উদ্দেশ্য করেই আমরা দোষী হয়েছি, আপনার জালে আপনি বাঁধা পড়েছি এবং মুক্ত হবার খেই জনমের মত হারিয়েছি । নতুবা নিজের লাভের আশাটাকে যদি চিরকালের জন্য বিসর্জন দিয়ে স্বার্থগন্ধহীন কোন মহান উদ্দেশ্য সামনে রেখে কাজ করে যাই, তাহলে গীতাকার বলেন –
“হত্বাপি স ইমাঁল্লোকান্ন হন্তি ন নিবধ্যতে ৷”
- নরহত্যার স্রোত বহালেও আমরা খুনে হব না বা অপরে আমাদের খুন করলেও আমরা মরব না – এই প্রকার অনুভব হবে । পতিব্রতা-উপাখ্যান, ধর্মব্যাধের কথা আমরা সকলেই মহাভারতে পড়েছি বা শুনেছি । কিন্তু সেই সকল আদর্শ চরিত্রের ন্যায় কাজ করতে একেবারে ভুলে গেছি । তাই এ দুর্দশা । গীতাকার সেজন্যই বলছেন – “নিষ্কাম হয়ে কাজ কর, অবিরাম কাজ কর – কিন্তু কর্ম করতে করতে ভেতরে কর্মরহিত হয়ে থাক ও যোগীর অচল শান্তি অনুভব কর ।”

কথায় বলে, মানুষ হচ্ছে ক্ষুদ্র ব্রহ্মাণ্ড । বৃহৎ ব্রহ্মাণ্ডে যা আছে, তার সমস্তই এই ক্ষুদ্র ব্রহ্মাণ্ডে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভাবে আছে – কিন্তু সমস্তই আছে । অন্য দিকে ক্ষুদ্র ব্রহ্মাণ্ডে যা কিছু আছে, তার বৃহৎ প্রতিকৃতি আবার এই বহির্জগতে বর্তমান । মানুষের ভেতর যেমন এই কর্মের ভেতরে কর্মরহিতাবস্থা রয়েছে – কেবল অনুভবের অপেক্ষা মাত্র, সেইরূপ বহির্জগতের অনবরত পরিবর্তন এবং গতির মধ্যেও অচল ক্রিয়ারহিত শান্তভাব সর্বদা বর্তমান । স্থুলভাবে দেখে মনে হয়, এ আবার কি কথা ! নানাভাবে অনুক্ষণ স্পন্দনশীল জগতে আবার কোথায় কখন গতিরহিত ক্রিয়ারহিত অবস্থা দেখতে পাওয়া যায় ? প্রজ্ঞাচক্ষু দার্শনিক বলেন, সুখ-দুঃখ, আলো-আঁধার প্রভৃতি বিপরীত দ্বন্দ্বের ন্যায় ক্রিয়া ও ক্রিয়ারাহিত্য, গতি এবং বিশ্রামও জগতে সদা যুগপৎ বর্তমান । ক্রিয়া গতি প্রভৃতি তদ্বিপরীত ক্রিয়ারাহিত্য; গতিরাহিত্য প্রভৃতি অবস্থার সঙ্গে তুলনা করেই আমরা বুঝে থাকি । যেখানে ঐরূপ তুলনা করবার উপায় নেই, সেখানে ক্রিয়া এবং গতিও আমাদের অনুভবের সাধ্য নেই । শুধু আমাদের অনুভব হয় না তা নয়, কিন্তু আমরা যাকে ক্রিয়া, গতি ইত্যাদি বলি, তা সেখানে বাস্তবিক নেই । জগতের ভেতরে নানা জিনিসের নানাভাবে অবস্থান দেখে, তুলনা করে আমাদের অনবরত গতি ও ক্রিয়ার প্রত্যক্ষ হচ্ছে; কিন্তু সমুদয় জগৎটাকে একটা পদার্থ বলে একবার ভেবে নিয়ে তার পর তাতে গতি রয়েছে ভাব দেখি । তার জো নেই । ঐখানেই শান্ত নিস্পন্দ ক্রিয়ারহিত অবস্থা । শুনে বলবে হয়তো ‘ওঃ, ও তো কল্পনা !’ দার্শনিক হেসে বলেন, না হে, কল্পনা-টল্পনা নয় – ওটাই ঠিক ঠিক সত্য । তোমার বিজ্ঞান ধর্ম প্রভৃতি সব শাস্ত্ৰই তো বলে, জগৎটা একটা জিনিস; এক বই দুই পদার্থ নেই - এক বই দুই শক্তি নেই । আবার ঐ পদার্থ ও শক্তিটাও একেরি বিকাশ । তবে তুমি আমি সর্বদা নানা জিনিসে মন রেখে রেখে আর জগৎটাকে নানা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ-নখ-কেশাদি-সমন্বিত মনুষ্যশরীরের ন্যায় একত্র সম্বন্ধ একটা জীবন্ত জিনিস বলে ভাবতে পারি না । ওখানে আমাদের ‘একঘেঁয়ে’ প্রত্যক্ষটাই গোল করে, গণ্ডির বাইরে যেতে পারে না, আর ভাবে ক্রিয়ারহিত জগৎ আবার কোথায় ? মানুষের আত্মাতে দ্বন্দ্বপ্ৰসুত ক্রিয়ারাহিত্য অনুক্ষণ বর্তমান । প্ৰত্যেক পদার্থের শেষ স্তরেও ঐ ব্ৰহ্মভাব, বর্তমান । আবার জীবজড়াদির সমষ্টিভূত জগৎটাতেও ঐ । অতএব ঐ একভাবটা কবিকল্পনা বা আকাশকুসুমের ন্যায় অলীক নয় । মূলে ঐটাকে ধরেই জগৎটা দাড়িয়ে আছে । আমাদের ভেতরের সদা বর্তমান ঐ অবস্থাটা একবার ঠিক ঠিক প্রত্যক্ষ করতে পারলে আর অনিত্য জন্ম, জরাদি-পরিবর্তন এবং তার চরম ফল মৃত্যুও আর আমাদের ভয় দেখাতে পারবে না । সেইজন্য ভগবান গীতাকার বার বার অর্জুনকে সামনে রেখে সমস্ত জগৎকে শিক্ষা দিচ্ছেন - ইন্দ্ৰিয়-মন-বুদ্ধ্যাদি সর্বদা কাজ করুক; কিন্তু তুমি ঐ অকৰ্ম ভাবটা প্রত্যক্ষ করে সব কাজ থেকে তফাত থাকতে শেখ । হে মানুষ ! তুমি মানহুঁশ হও, আপনার মহিমায় হুঁশ রাখ, জাগ - অজর অমর আত্মার উপলব্ধি করে অচল অটল শাস্তিতে অবস্থান কর । কোনরূপ দুর্বলতায় গা ঢেলে দিয়ে অনিত্য জিনিসগুলিকে নিত্য ধরে রাখবার চেষ্টা করে দুঃখ পেও না । কৰ্মফলটা ত্যাগ করে কাজ করে যাও । উহারই নাম যথার্থ সন্ন্যাস এবং কর্মযোগও তাই । দুই পথই এক জায়গায় পৌছে দেয় ।
‘যং সন্ন্যাসমিতি প্ৰাহুৰ্যোগং তং বিদ্ধি পাণ্ডব ৷’
সন্ন্যাসঃ কর্মযোগশ্চ নিঃশ্ৰেয়সকরাবুভৌ ৷৷’
অর্জুনের মন থেকে কিন্তু কর্মের চেয়ে জ্ঞান বড়, একথা কিছুতেই যাচ্ছে না । তিনি ভাবছেন - জ্ঞান হলে যখন কর্ম থাকে না, তখন জ্ঞানটাই আসল জিনিস বা লক্ষ্য, অতএব কর্মের চাইতে নিশ্চয় বড় । তিনি ভুলে গেছেন যে, গীতাকার যে জ্ঞানটা মনুষ্যজীবনের লক্ষ্য বলে তার সামনে খাড়া করছেন, সেটা দেশকালাতীত অসীম অপরিচ্ছিন্ন জ্ঞান । অর্জুন যেটাকে জ্ঞান মনে করেন, সেটা নয় । সেটা দেশকালের গণ্ডির ভেতর, কার্যকরণের শৃঙ্খলের ভেতর চির আবদ্ধ । গীতার চতুর্থ অধ্যায়ে দেখতে পাই, ফের অর্জুনের ঐ প্রশ্ন এবং ভগবান শ্ৰীকৃষ্ণের ফের ঐ বিষয় বোঝাবার চেষ্টা, এবার কিন্তু ভগবান আর একপথ দিয়ে অর্জুনকে বোঝাতে চেষ্টা করছেন ।

ভগবান বলছেন, হে অর্জুন ! ভেবো না যে, কর্মযোগটা একটা নূতন পথ । জ্ঞান ভক্তি ইত্যাদি পথসমূহের ন্যায় ইহাও বহু পূর্বকাল থেকে মানবকে চরম লক্ষ্যে পৌছে দিচ্ছে এবং জনকাদি বহু খ্যাতনামা রাজর্ষিগণ ঐ পথ আশ্ৰয় করে সিদ্ধিলাভ করেছেন । বিশেষতঃ, ক্ষত্রিয় রাজারা । এই কৰ্মযোগের কথা আমি প্রথমতঃ সুৰ্যকে উপদেশ দিয়েছিলাম । সূৰ্য তাঁর পুত্র মনুকে বলেন । মনু আবার ইক্ষাকুকে উপদেশ দেন । এইরূপে উহা বহুকাল পর্যন্ত ‘বহুজনহিতায় বহুজনসুখায়’ নিত্যকর্মানুষ্ঠায়ী, পুরুষকারপ্রধান, তেজম্বী ক্ষত্ৰিয়রাজকুলের ভেতরই জীবন্ত ছিল । সে কর্মযোগের আজ লোপ হয়েছে । নিজের সুখটুকু ছেড়ে কেউ আর বহুজনকল্যাণের দিকে তাকিয়ে কর্ম করতে চায় না । ধর্মের ভেতরও ব্যবসাদারী পাটোয়ারী বুদ্ধি ঢুকেছে; অন্য কর্মাদির তো কথাই নেই । তাই তোমাকে আজ আবার সেই পুরাতন কর্মযোগের কথা বলছি । হীনবুদ্ধি, কাপুরুষ, ইন্দ্ৰিয়দাস, রুগ্নশরীর, ভগ্নোৎসাহ লোকের পক্ষে ঐ পথ-অবলম্বনে সিদ্ধিলাভ করা সুকঠিন । কিন্তু তোমার ন্যায় বহুজনকল্যাণে চিরনিবদ্ধদৃষ্টি, শ্ৰদ্ধাবান, বুদ্ধিমান, তেজস্বী, বীরহৃদয়ই ঐ উদার ভাব বুঝতে পেরে দৃঢ়ভাবে ধরতে ও অনুষ্ঠান করতে পারবে । তাই তোমাকে বলা । আপনার শরীরটিতে পাছে কোন আঁচড় লাগে, আপনার ধন, মান, যশ, প্ৰভুত্ব প্রভৃতি পাছে না লাভ হয়, এমন কি আপনার মুক্তিলাভ পাছে না হয়, এইরূপ ভাব যার হৃদয়ে সদা বর্তমান, সে কখনও কর্মযোগী হতে পারবে না । কর্মযোগী হবে তেজস্বী উদারমনা বীর, যে সত্যের জন্য বা অপরের কিছুমাত্র কষ্ট দূর করবার জন্য, স্বদেশপ্রেমের জন্য, মহাপুরুষের গৌরবের জন্য আপনাকে এককালে ভুলতে পারবে - আপনার সুখ ঐশ্বর্যাদির নাশ হলেও ভ্ৰক্ষেপ করবে না ।

পুরাতন জিনিসের আদর করা মনুষ্যমনের স্বভাব । পরিবর্তনের স্রোত অতিক্রম করে বহুকাল যা একভাবে থাকে, তারই মানুষের কাছে কদর । অনিত্যের ভেতর নিত্য পদার্থের অনুসন্ধান মানবের প্রাণে প্ৰাণে সর্বদা আছে বলেই বোধ হয় ঐরূপ হয় । সাধারণ মানবের চেয়ে গুণী মহাপুরুষদের হৃদয়ে আবার ঐ ভাবটা বিশেষ প্ৰবল দেখা যায় । অর্জুনের ন্যায় বীরাগ্রণীর হৃদয়ে ঐভাব প্রবল দেখেই ভগবান কর্মযোগের ইতিহাস কীর্তন করে তাঁকে ঐ দিকে নেওয়াচ্ছেন ।

আর এক কথা – ক্ষত্ৰিয়েরাই, বিশেষতঃ ক্ষত্রিয় রাজারাই এই কৰ্মযোগ অনুষ্ঠান করে ব্ৰহ্মজ্ঞান লাভ করতেন এবং তাঁদের নিকট থেকেই ব্ৰাহ্মণাদি অন্য বর্ণের ভেতর ঐ কর্মযোগের প্রচার হয়েছিল । এ কথাটায় অনেকের আশ্চর্য বোধ হতে পারে, বিশেষতঃ আজকালকার ব্ৰাহ্মণদের তো পারেই । কারণ তাঁদের বিশ্বাস, ভারতের যত কিছু শাস্ত্ৰজ্ঞান ব্ৰাহ্মণবর্ণেরই একচেটে অধিকারে ছিল, আর তাঁরাই দয়া করে অন্য বর্ণকেও দিয়েছিলেন । এ কথা কোন কোন বিষয়ে সত্য হলেও সকল বিষয়ে যে নয়, তার ঢের প্রমাণ আছে । আমরা এইমাত্র দেখলাম, গীতাকার বলছেন, কর্মযোগ প্রথম ক্ষত্রিয় রাজাদের ভেতরেই ছিল । এইরূপে ছন্দোগ্য উপনিষদ্‌-পাঠে দেখা যায়, আরুণি ও শ্বেতকেতু-ব্রাহ্মণ পিতা-পুত্রে প্রবাহণ-জৈবলি রাজার এবং প্রাচীনশালাদি পঞ্চব্রাহ্মণ কৈকেয় অশ্বাপতি রাজার শিষ্যত্ব স্বীকার করে ব্ৰহ্মজ্ঞানের উপদেশ নিচ্ছেন । এইরূপে কর্মযোগ এবং ব্ৰহ্মজ্ঞানের প্রথম উদয় যে ক্ষত্রিয় রাজকুলের ভেতর হয়েছিল, একথা শাস্ত্রপাঠে খুব সম্ভবপর বলে বোধ হয় ।

কর্মযোগের ইতিহাস-কীৰ্তন হতে অর্জুনের মনে আর এক প্রশ্নের উদয় হল । ভগবান শ্ৰীকৃষ্ণ বললেন, সূর্যকে তিনি প্ৰথমে কর্মযোগ উপদেশ করেছিলেন । অর্জুন ভাবলেন, এ কেমন কথা ? শ্ৰীকৃষ্ণের জন্ম তো সেদিন হল, আর সূর্যের উৎপত্তি কতকাল পূর্বে হয়েছে । তাঁকে ইনি উপদেশ দিলেন কি করে ? এই সন্দেহের প্রসঙ্গেই ঈশ্বর, ঈশ্বরাবতার ও তাঁদের স্বরূপসম্বন্ধীয় কথার অবতারণা ।

ভগবান শ্ৰীকৃষ্ণ বলছেন, সূর্যকে আমি বহু পূর্বকালে অন্য মূর্তিতে ঐ উপদেশ করেছিলাম । কিন্তু আমিই যে সেই মূর্তিতে ঐ উপদেশ দিয়েছিলাম, এ বিষয় আমার বেশ মনে আছে। কেননা আমি ঈশ্বরাবতার, আমার জ্ঞানের কখন লোপ হয় না । তুমি এবং আমি উভয়ে বহু বার বহুস্থানে জন্মগ্রহণ করে 'বহু-জনহিতায়’ বহু কর্মের অনুষ্ঠান করেছি ও করব । তোমার সে সব মনে নেই । আমার কিন্তু পূব পূর্ব বারের সকল কথাই মনে আছে । অবতার-সম্বন্ধে ভগবান গীতাকার কি শিক্ষা দেন, তা আমরা পরবারে আলোচনা করব ।
[১৯০৩ খিষ্টাব্দের ৩১শে জানুয়ারি কলিকাতা বিবেকানন্দ সমিতিতে প্রদত্ত বক্তৃতার সারাংশ]


7) জ্ঞান ও ভক্তির সমন্বয়


ভগবান শ্ৰীকৃষ্ণ গীতায় বলেছেন -
“যদা যদা হি ধৰ্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত ৷ ...
ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে ৷৷”


অর্থাৎ, যখনই ধর্মের গ্লানি ও অধর্মের প্রাদুর্ভাব হয়, … তখনই আমি প্রকৃত ধর্মসংস্থাপনের জন্য অবতীর্ণ হই । যখনই ভক্তি ও জ্ঞান-শিক্ষার জন্য আচার্যের প্রয়োজন হয়, তখনই তিনি আচাৰ্যরূপে অবতীর্ণ হন । তিনিই যথার্থ গুরু এবং জগৎ ও তাঁকেই অনুসরণ করে অগ্রসর হয় । তিনিই মায়ান্ধ ও বিষয়াসক্ত জীবের চোখ ফুটিয়ে দেন । একভাবে তিনিই সমস্ত জগদরূপে বিরাজিত, স্থাবর জঙ্গম যা কিছু দেখতে পাই সকলই তাঁর প্রতিকৃতি; অন্যভাবে তিনিই সমস্ত জীবজন্তুতে চৈতন্যস্বরূপে বর্তমান আছেন । আবার প্রকৃত ধর্ম ও শান্তিস্থাপন করবার জন্য তিনি জগদগুরুরূপে অবতীর্ণ হন । তিনি মনুষ্যশরীরে মায়ার অধীশ্বররূপে অবতীর্ণ হয়ে মায়াবশ জীবকে মুক্তির প্রকৃত পন্থা প্রদর্শন করেন । যুগে যুগে শরীর বিভিন্ন হলেও অবতার ভিন্ন ভিন্ন নন, একই । তিনিই প্ৰয়োজনানুসারে নানারূপে অবতীর্ণ হন । যখন যেরূপ ভাবের দরকার, তখন সেরূপ ভাবে অবতীর্ণ হয়ে তিনি লোকশিক্ষা দিয়ে থাকেন । আমাদের এই ভারতবর্ষে তিনি বহুবার অবতীর্ণ হয়ে বহু ভাব শিক্ষা দিয়ে গেছেন । এইজন্যই ভারতবর্ষ সকল জ্ঞানের আকর-স্বরূপ ছিল । যখনই আবশ্যক হয়েছে, তখনই তিনি হাত ধরে এই ভারতবর্ষকে তুলেছেন । সেইজন্যই এখনও পদদলিত, অত্যাচারিত ও দুৰ্ভিক্ষপীড়িত ভারতে কত কত ধৰ্মবীর ও কর্মবীর আবির্ভূত হয়ে আমাদিগকে পথ দেখিয়ে দিচ্ছেন । সেইজন্য আমাদের দেশে এখনও পর্যন্ত ধর্মক্ষেত্রে অন্যান্য দেশাপেক্ষা প্রকৃত জ্ঞান ও ভক্তির আদর্শ দেখতে পাওয়া যায় । ধর্মেতেই আমাদের উন্নতি । আমাদের দেশ ধৰ্মগতপ্ৰাণ, ধর্মেতেই যেন বেঁচে আছে । এখানে নিত্যক্রিয়া শৌচাদি হতে বিবাহ-পদ্ধতি প্রভৃতি গুরুতর সামাজিক নিয়মসকলও ধর্মের অঙ্গস্বরূপে গণ্য হয়ে থাকে ।

সমস্ত আমরা ঠিক ঠিক করতে পারি আর নাই পারি, আমাদের সমস্ত আচারব্যবহার, চালচলন সমস্তই যে ধর্মলাভের জন্য, তাতে অণুমাত্ৰও সন্দেহ নেই । অবশ্য অন্যান্য দেশ অন্যান্য বিষয়ে খুব বড় হয়েছে । অন্যান্য দেশ রাজনীতি, সমাজনীতি ও যুদ্ধবিগ্ৰহ প্রভৃতি ঐহিক উন্নতিতে জগতের শীর্ষস্থানীয় হয়েছে । ভারতের প্রাণ ধর্মের উপর স্থাপিত, ধর্মবলেই ভারত একদিন জগতের শীর্ষস্থানীয় ছিল, আবার ধর্মকে অবলম্বন করেই যে ভবিষ্যতে ইহার উন্নতি হবে, সে বিষয়ে অণুমাত্র সন্দেহ নেই । তারই সূচনাস্বরূপ আজকাল চতুর্দিকে নামে রুচি, সাধন-ভজনে শ্ৰদ্ধা ও ভগবানলাভের আকাঙ্ক্ষা দেখতে পাচ্ছি এবং চতুর্দিকেই জ্ঞান ও ভক্তির সমন্বয়ের আলোচনা শুনতে পাওয়া যাচ্ছে । পূর্বে জ্ঞান বললেই লোকে কিম্ভূতকিমাকার ভাবত, জ্ঞানী বললেই নাস্তিক ভেবে ঘৃণার চক্ষে চাইত । ‘অহং-ব্ৰহ্মাস্মি’ বললে ভক্ত কানে হাত দিত । আবার জ্ঞানীও ভক্তকে কুসংস্কারাপন্ন বলে উড়িয়ে দিত । এইরূপে বহুকাল ধরে ভক্তি ও জ্ঞানপথের সাধকদিগের ভেতর এইরূপ বিরোধ চলে আসছে । কিন্তু যাঁরা জ্ঞান ও ভক্তির আচাৰ্য ও প্রচারক, তাদের মধ্যে এ ভাবের বিরোধ কোনও কালে ছিল না । একটা গল্প আছে, শিব ও রামের বিরোধ হয়েছিল, তাতে শিবের চেলা ভূত ও রামের চেলা বানরের ক্রমাগত যুদ্ধ চলতে লাগল । তারপরে শিব ও রামের মিলন হল, উভয়ে একপ্ৰাণ, এক আত্মা হলেন, কিন্তু বানর ও ভূতের যুদ্ধ আর থামল না । আচাৰ্যগণের কোন বিরোধ ছিল না বটে, কিন্তু তাঁদের অনুবর্তিগণ চিরকালই বিবাদ করে মরছে । আজকাল বোধ হয়, সে বিরোধের ভাব যেন ক্রমেই কমছে । সে হাওয়া যেন ক্ৰমেই মন্দীভূত হচ্ছে । যোগ, কর্ম, জ্ঞান, ভক্তি প্ৰভৃতি সমস্ত ভাবই এক ভগবান হতে প্ৰসুত । এই চারটি পথ অবলম্বন করেই মানবের ধর্মলাভ হতে পারে - সর্বত্রই যেন লোকের এই ভাব, এই ধারণা হতে আরম্ভ হয়েছে ।

পূর্বে বলেছি, প্রকৃত জ্ঞানী ও ভক্তে বাস্তবিক বিরোধ নেই । শাস্ত্রপাঠে দেখতে পাই, পূর্বে যাঁরা প্রকৃত জ্ঞানী বলে প্ৰসিদ্ধ ছিলেন, তাঁদেরই মধ্য হতে নিৰ্মল ভক্তিস্রোত প্রবাহিত হয়ে জগৎকে পবিত্র ও কৃতাৰ্থ করেছে । আবার যাঁরা প্ৰকৃত ভক্ত বলে প্ৰসিদ্ধ ছিলেন, তাঁরাই জ্ঞানের আলোক-বিস্তারে মানবকে সমৃদৃষ্টির পথে অগ্রসর করেছেন । এই জ্ঞান ও ভক্তির মধ্যে সামঞ্জস্য আছে কিনা এবং যদি থাকে তবে কোথায় আছে, ইহাই আজকের আলোচ্য বিষয় । শিবাবতার জ্ঞানাচাৰ্য গুরু শঙ্করপ্রণীত গ্রন্থপাঠে আমরা কি দেখতে পাই ? তৎপ্রণীত গঙ্গা, শিব, অন্নপূর্ণা ও বিষ্ণুর স্তব পাঠ করে কেমন করে বলব যে, তিনি ভক্তিশূন্য কঠোর জ্ঞানী নাস্তিক ছিলেন ? শারীরক ভাষ্য ও তৎপ্রণীত অশেষ দেবদেবীর স্তবাদি পাঠ করলে দেখতে পাওয়া যায় যে, তাঁর মধ্যে ভক্তি ও জ্ঞানের অপূর্ব সামঞ্জস্য রয়েছে । সেইরূপ ভক্তাবতার আচার্য শ্ৰীগৌরাঙ্গের মধ্যেও আবার অদ্বৈতজ্ঞানের বিশেষ প্ৰকাশ দেখতে পাওয়া যায় । যদি তিনি জ্ঞানের বিদ্বেষী হবেন, তবে কেন তিনি পূজ্যপাদ কেশব ভারতীর নিকটে স্বয়ং সন্ন্যাসধর্মে দীক্ষিত হলেন ? উভয় পথের আচাৰ্যদের জীবনে ও শিক্ষায় তো কোন বিরোধ দেখতে পাই না । তবে বিরোধ কোথায় ? বিরোধ কথায় ও বাক্যবিন্যাসে । বিরোধ অনুবতীদের স্বাৰ্থ-পরিচালনে । ভক্তি ও জ্ঞানের চরম লক্ষ্য একই । একই লক্ষ্যে উপনীত হবার ভিন্ন দুইটি পন্থামাত্র । ভক্ত ও জ্ঞানী উভয়েরই উদ্দেশ্য কাঁচা ‘আমিত্বের’ বিনাশ করা । যে ‘আমি’ সংসার ও বিষয়বাসনায় জীবকে বদ্ধ করে রেখেছে, সেই তুচ্ছ মিথ্যা আমিত্বের স্থানে শ্ৰীভগবানের দাস বা তাঁর অংশ আমি - এই মহান আমিত্বের বিকাশ করা । ভক্তি ও জ্ঞান এই কাঁচা আমি বিনাশ করবার দুইটি উপায়মাত্র । ভক্ত চান তাঁর সমস্ত ভগবৎপাদপদ্মে অৰ্পণ করতে । সমস্ত কার্য ও চিন্তা, অর্থ স্ত্রী বা পুত্র, আপনার বলতে তাঁর যা কিছু আছে, সমস্তই তাঁর নয়, ভগবানের — এই ভাবটি সর্বাবস্থায় সর্বতোভাবে প্ৰাণে রাখা এবং তদনুযায়ী কাৰ্য করাই তাঁর জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য । শরীর-ধারণোপযোগী আহারাদি ব্যাপারও ভক্ত নিজের জন্য না করে ভগবানের সেবার জন্য করেন । জীবনধারণও তাঁর প্রিয়তমের সেবা ভিন্ন অন্য কোন কারণে নয় । ভক্ত চান, আমিত্বকে তুমিত্বরূপ সমুদ্রে ডুবিয়ে দিতে; আমি অমুকের ছেলে, আমি বিদ্বান, আমি ধনী মানী জ্ঞানী প্ৰভৃতি অভিমানপ্ৰসুত আমিত্বকে ঠাকুরের পাদপদ্মে চিরকালের মতো ফেলে দিয়ে বিশ্বতোমুখ ভগবানের সেবা করতে । ভক্তের চক্ষে তাঁর প্ৰিয়তমই জড় চেতন নানারূপে খেলা করছেন, তিনিই পুরুষ, তিনিই প্রকৃতি, তিনিই কুমার, তিনিই কুমারী, তিনিই দাসদাসী, সর্বত্রই তাঁর হস্ত পদ চক্ষু । এ সংসার তাঁরই মূর্তি - এই জ্ঞানে যথাৰ্থ ভক্ত স্ত্রী পুত্র প্রভৃতিরূপে বিরাজিত তাঁর আরাধ্য প্রভুর সেবায় নিযুক্ত থাকেন । ভক্তের বেঁচে থাকা সেবার জন্য, কিছুতেই আসক্তি নেই । স্বার্থপরতা চিরদিনের জন্য বিদায় নিয়েছে । মরণেও আপত্তি বা কষ্ট নেই । ইচ্ছাময়ের ইচ্ছায় স্বীয় ইচ্ছা মিলিয়ে দিয়ে ভক্ত ইহজীবনেই সাক্ষাৎ জীবন্মুক্তি লাভ করেছেন । ভক্তির আচাৰ্য নারদ ঋষি ভক্তিসূত্ৰে ভক্তির লক্ষণ করেছেন, ‘সা কস্মৈ পরমপ্রেমরূপা' - ভগবানে যে ঐকান্তিক প্ৰেমভাব, তারই নাম ভক্তি । ভগবান শ্ৰীকৃষ্ণও গীতায় ঐ রকম ভক্তের কথা বলেছেন, যথা - ‘আর্তো জিজ্ঞাসুয়ৰ্থার্থী জ্ঞানী চ ভরতর্ষভ ৷’ –


ভক্ত চার প্রকার :-

(i) যে রোগে বিপদে নিতান্ত অভিভূত হয়েছে, নিতান্ত নিরাশ্রয়, সে নিতান্ত ব্যাকুলভাবে ভগবানের শরণাপন্ন হয় । এরই নাম আর্তভক্তি
(ii) মনে নানাপ্রকার সন্দেহ এসেছে । এই জগতের কেহ কর্তা আছেন কিনা, এই জগতের সর্বত্র সর্বদা পরিবর্তন হচ্ছে, কে করছে, এর কারণ কি - এইসকল জানিবার জন্য প্ৰাণে বিশেষ আগ্রহ; বিষয়সুখ, ইন্দ্ৰিয়সুখ আর ভাল লাগে না; কোন সংপুরুষ বা জ্ঞানীপুরুষ দেখলেই জিজ্ঞাসার জন্য ছুটে তাঁর কাছে যায়; এই সব তত্ত্ব জানবার জন্য ব্যাকুলভাবে নির্জনে চিন্তা করে; এই সব লক্ষণ হলে তাকে জিজ্ঞাসু ভক্ত বলা যায় ।
(iii) তৃতীয় অর্থার্থী । বিশেষ কোন কামনায় প্রাণ ব্যাকুল, আবার তৎকামনাপূরণে নিজের শক্তিও নেই, এজন্য যে ভগবানকে উপাসনা করে, সে অর্থার্থী ভক্ত ।
(iv) চতুর্থ জ্ঞানী । জ্ঞানীই শ্ৰেষ্ঠ । ভগবান বলেছেন, “তেষাং জ্ঞানী নিত্যযুক্ত একভক্তিবিশিষ্যতে ৷ প্রিয়ো হি জ্ঞানিনোহিত্যৰ্থমহং স চ মম প্ৰিয়ঃ” - সর্বদা তাঁর মন ভগবানে যুক্ত হয়ে রয়েছে, সেই একভক্তি জ্ঞানীই শ্রেষ্ঠ ভক্ত। জ্ঞানীর মন সর্বদাই কাম-কাঞ্চন, বিষয়ানুরাগ, শরীরানুরাগ প্রভৃতির পারে বর্তমান । জ্ঞানীর সম্বন্ধে একভক্তি বিশেষণ এই নিমিত্তই প্ৰযুক্ত হয়েছে । অবিশ্ৰান্ত নদীর স্রোতের ন্যায় একভক্তির বিরাম নেই, সর্বদা ভগবৎপাদপদ্মে প্রবাহিত । এক ভক্তির বিশেষ লক্ষণ দেবীগীতায় সুন্দরীরূপে প্রদত্ত হয়েছে । পাত্ৰ হ’তে পাত্ৰান্তরে তৈল ঢাললে যেমন অখণ্ডিত ঘনধারে পড়ে থাকে, সেইরূপ একপ্রকার ভক্তিধারা বিষয়বায়ুতাড়িত হয়ে কখন খণ্ডিত বা তরলায়িত হয় না । জ্ঞানীর লক্ষ্য ভগবান শ্ৰীকৃষ্ণ গীতায় বলেছেন, “বাসুদেবঃ সৰ্বমিতি স মহাত্মা সুদুৰ্লভঃ” - সমস্তই ভগবানময় এইরূপ যাঁর জ্ঞান হইয়াছে, সেই মহাত্মা জ্ঞানী; এই প্রকার লোক অতি দুর্লভ । এই প্রকার জ্ঞানীর দেহাত্ম-বুদ্ধিরূপ ক্ষুদ্র আমিত্ব চিরকালের মত বিদায় গ্ৰহণ করেছে । তখন তিনি বুঝতে পারেন “আমি সকলের অন্তরে-বাহিরে, আমি সকলের সাক্ষিস্বরূপ, আমারই শক্তিতে মন-বুদ্ধি ক্রিয়াশীল, আমিই জাগ্ৰৎ, স্বপ্ন, সুষুপ্তি এই অবস্থাত্রয়ের সাক্ষিস্বরূপ, আমি সর্বভূতে আছি ও সর্বভূত আমাতে আছে।”

এইরূপ জ্ঞান অনেক সাধনা ও চেষ্টার ফলে উপস্থিত হয় । এইরূপ জ্ঞান হওয়ার পূর্বে ভগবানে টান হওয়া দরকার; যেমন বিষয়ীর বিষয়ে, সতীর পতিতে, কৃপণের ধনেতে টান, সেই রকম টান হওয়া চাই । যেমন মাতাল মদে আকৃষ্ট হয়, সেইরূপ ভগবানের প্রতি আকৃষ্ট হওয়া চাই । গীতায় ভগবান বলেছেন, “ধ্যায়তো বিষয়ান্‌ পুংসঃ সঙ্গস্তেষুপূজায়তে” - বিষয়ের ধ্যান করতে করতে যেমন তাতে অত্যাসক্তি এসে জীবকে ধীরে ধীরে বিনাশের পথে নিয়ে যায়, ধর্মসম্বন্ধে ঐরূপ আসক্তির দরকার, ভগবানের ধ্যান করতে করতে ঐরূপ আসক্তি উপস্থিত হলে মানব বিনষ্ট না হয়ে মুক্তির দিকে সত্বর অগ্রসর হয় ।

প্রথমতঃ যাঁরা ভক্ত, ভগবৎপ্রেম যাঁদের জীবনকে পবিত্র করেছে, তাঁদের অপূর্ব ভাব দেখে সাধারণ মানবের মন আকৃষ্ট হয়ে সেইরূপ হওয়ার জন্য ইচ্ছা হয় । বিষয়ে যেমন আসক্তি হয়, এও সেই প্ৰকার আসক্তি ৷ প্ৰভেদ এই, ইহা উচ্চ বিষয়-অবলম্বন হওয়াতে ভগবানের দিকে নিয়ে যায় । সেই হেতু দেবর্ষি নারদ প্রভৃতি আচার্যেরা বলেছেন যে, কামাদি রিপু তত দিন, যতদিন উহার রূপ-রসাদি-বিষয়াবলম্বনে মনে উদিত হয়, কিন্তু একবার উহাদের মোড় ফিরিয়ে দিতে পারলে উহারাই ভগবানলাভের সহায় হয় । কোন কামনা পূরণ করার জন্য লোকে প্রথমতঃ ভগবানকে ডাকে, কেননা তাঁতেই সর্ব কামনা পূর্ণ করবার শক্তি বর্তমান । সকাম মনে ডাকতে ডাকতে মানব যখন একবার তাঁকে ভালবেসে ফেলে, তখন আর তার পালাবার পথ থাকে না । সকাম ভালবাসা হতেই ক্ৰমে ক্ৰমে নিষ্কাম প্ৰেম এসে উপস্থিত হয় । এই নিষ্কাম প্রেম হলে আর পতনের আশঙ্কা থাকে না । শাণ্ডিল্য ঋষি, এই প্রেমের লক্ষণ ধরে বলেন, “সা পরানুরক্তিরীশ্বরে” - ঈশ্বরে যে পরম অনুরাগ তাই প্ৰেম, তাই পরাভক্তি । ভক্তরাজ প্ৰহ্লাদও একস্থলে বলেছেন, “যা প্রীতিরবিবেকানাং বিষয়েষনপায়িনী ৷ ত্বমনুস্মরতঃ সা মে হৃদয়ান্মাপসর্পিতু ৷৷” -হে ভগবান, বিষয়ীর বিষয়ে যেমন টান, তোমাতে আমার যেন তদ্রূপ টান হয় । মনে হয় যেন প্ৰহ্লাদ অতি সামান্য কথা বলেছেন, কিন্তু তলিয়ে দেখলে এর সার্থকতা উপলব্ধি হয় । সাংসারিক ভাব হতে উচ্চ কল্পনা সাধারণ মানবের আসে না । সংসারে পিতা-মাতাকে, বন্ধুকে ও স্বামী প্রভৃতিকে যেমন ভালবাসা যায়, তেমন ভালবাসা বা মনের টান ভগবানে হলে ভগবানলাভ অতি সন্নিকট হয় ।

বৈষ্ণবগণ এইজন্য ভক্তির পাঁচ ভাগ করেছেন । তাঁরা দেখেছেন যে, প্রত্যেক লোকের প্রবৃত্তি-অনুসারে এক একটি পার্থিব সম্বন্ধ অতি মধুর বলে উপলব্ধ হয় । মহাভারতে দেখতে পাই - ভীষ্ম, উদ্ধব, বিদুর, অর্জুন, যুধিষ্ঠির প্রভৃতি নানা লোকে এক শ্ৰীকৃষ্ণকেই স্ব স্ব প্ৰাণাপেক্ষাও অধিক ভালবাসছেন । কিন্তু সকলে তাঁর সহিত একই সম্বন্ধস্থাপন করতে পারছেন না । বিদুরের দাস্যভাব, অর্জুনের সখ্যভাব । ভাব ও প্ৰবৃত্তি অনুসারে এক একজন আবার এক এক কর্মে নিযুক্ত । উদ্ধব শ্ৰীকৃষ্ণের নিকট গীতা শ্ৰবণ করে ও তাঁর পাদুকা নিয়ে বদরিকাশ্ৰমে তপস্যা করতে চললেন । বিদুর নানারূপে সেবা ও নানা তীর্থ পৰ্যটন করে পরে পরমহংস-পদবীলব্ধ অদ্বৈতজ্ঞানে শরীরত্যাগ করলেন, অর্জুন আবার সেই গীতোক্ত জ্ঞানলাভ করে অলৌকিক উদ্যামের সহিত যুদ্ধে প্ৰবৃত্ত হলেন । গোপীদের আবার অন্য ভাব । শ্ৰীকৃষ্ণকে চিন্তা করতে করতে তাঁরা গৃহকর্ম, স্বামী, পুত্ৰ, কন্যা, এমন কি তাঁদের দেহ পৰ্যন্ত ভুলে শ্ৰীকৃষ্ণে তন্ময় হয়ে গিয়েছিলেন । একজন গোপিকা তাঁর স্বামিকর্তৃক গৃহে অবরুদ্ধা হয়েছিলেন । ফল এই হল যে, তিনি ভগবান শ্ৰীকৃষ্ণের ধ্যান করতে করতে তন্ময় হয়ে সমাধিতে শরীর পরিত্যাগ করলেন । একথা ভাগবতে লিপিবদ্ধ । আবার রাসলীলার কথা মনে হলে এই তন্ময়ত্বের ভাব আরও স্পষ্ট বোঝা যায় । রাসলীলার সময় শ্ৰীকৃষ্ণ হঠাৎ অন্তর্হিত হন, তখন গোপীগণ শ্ৰীকৃষ্ণের চিন্তা করতে করতে এমন তন্ময় হন যে, আপনাদের পৃথক্‌ অস্তিত্ব সম্পূর্ণ ভুলে গিয়ে ‘আমিই শ্ৰীকৃষ্ণ' এইভাবে ভগবানের লীলানুকরণ করেছিলেন । ভক্তির চরমে এমন তন্ময় হয় যে, উপাস্য-উপাসক এক হয়ে যায় । শ্ৰীমতী রাধাকে এক সময়ে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, “তুমি শ্ৰীকৃষ্ণকে কি ভাবে দেখ ?” তাতে তিনি উত্তর করেন, “নাসৌ রমণো নাহং রমণী,” অৰ্থাৎ আমি একেবারে ভুলেছি যে, আমি রমণী এবং তিনি পুরুষ ও আমার স্বামী - এইজন্য আমি তাঁকে ভালবাসি । শ্ৰীকৃষ্ণের প্রতি আমার প্ৰেম সাধারণ স্ত্রীর প্রেমের ন্যায় শরীরানুরাগ বা গুণানুরাগ-অবলম্বনে প্রবাহিত নয়, কিন্তু হেতুশূন্য হয়ে স্বতঃই সর্বদা প্রবাহিত থাকে । আমরা দেখলাম যে, ভক্তির চরমে দেহাত্মবুদ্ধি ও ক্ষুদ্র আমিত্ব একেবারে চলে যায় । এখন জ্ঞানীর সম্বন্ধে ইহা কতদূর সত্য, দেখা যাক । জ্ঞানী বলেন, এই ‘আমি’ ঠিক নয়, মায়া; তবে কোন্‌টি প্ৰকৃত ‘আমি’ ? প্রকৃত ‘আমি’ শরীর, মন প্ৰভৃতি সকলের অতীত ও এদের সাক্ষিস্বরূপ; সকল অবস্থারই একরূপে বর্তমান, হ্রাস-বৃদ্ধি নেই । এই ‘আমি’ সকলেতে । আমাদের এই ক্ষুদ্র ‘আমি’ সেই মহান্‌ 'আমিত্বের’ অংশমাত্র । সেই মহান্‌ আমিত্ব হতে এই ক্ষুদ্র আমিত্বের উদ্ভব । জ্ঞানীর উদ্দেশ্য, এই মহান আমিত্বের সর্বদা উপলব্ধি করা, এই ক্ষুদ্র ‘আমি’কে সেই মহান্‌ আমিত্বে ডুবিয়ে দেওয়া ।

অতএব দেখা গেল, ভক্তের তন্ময়ত্ব ও জ্ঞানীর মহান আমিত্ব একই । ভক্ত ও জ্ঞানী উভয়েই ক্ষুদ্র আমিত্বকে ডুবাতে চাইছেন । হনুমানকে একবার জিজ্ঞাসা করা হয়, “তুমি কি ভাবে রামচন্দ্ৰকে উপাসনা কর ? তাতে তিনি উত্তর করেন, “যখন আমার মন শরীর ও ইন্দ্ৰিয়াদিতে নিবদ্ধ থাকে তখন দেখি - তিনি প্ৰভু ও আমি তাঁর দাস । যখন আপনাকে জীবাত্মা বলে অনুভব করি, তখন দেখি - তিনি পূর্ণ ও আমি তাঁহার অংশ । তিনি সুৰ্য স্বরূপ এবং আমি সেই সূর্যের বহু কিরণের একটিমাত্র । আবার যখন আমার মন সমাধি-অবলম্বনে সকল উপাধির বাইরে যায়, তখন দেখি - তিনি ও আমি এক ।” অতএব বোঝা যাচ্ছে যে, স্থুল শরীরে ও স্বার্থপরতার মধ্যে মন থাকলে ‘সোহহং’ বলা নিরর্থক । জীবাত্মা বলে আপনাকে উপলব্ধি করলে মানব আপনাকে ভগবানের অংশমাত্র বলে বোধ করবে, তখনই তার উপাস্যের সহিত অভিন্ন ভাব আসবে ।

মনের অবস্থাভেদে দ্বৈতবাদ, বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ ও অদ্বৈতবাদ এসে উপস্থিত হয় । এই জন্য ভিন্ন ভিন্ন অধিকারীর উপযোগী এই তিন প্রকার মতই শাস্ত্ৰে লিপিবদ্ধ দেখতে পাই । আমরা দেখলাম, ভক্ত চায় সব ভগবানের পাদপদ্মে সমৰ্পণ করে ক্ষুদ্র আমিত্বের বিনাশ করতে । আর জ্ঞানীও বলেন, “মুক্তি হবে কবে, ‘আমি’ যাবে যবে ।” আমিত্বই জঞ্জাল । অতএব উভয়েরই উদ্দেশ্য এক, কেবল কথার প্রভেদ, লোকে বুঝতে পারে না । কিন্তু ঠিক ভক্ত ও জ্ঞানী কথায় ভোলে না । তার চায় যথার্থ সত্য অনুভব করতে । উত্তরগীতায় আছে, “মথিত্বা চতুরো বেদান সর্বশাস্ত্ৰাণি চৈব হি । সারং তু যোগিনঃ পিতাস্তক্ৰং পিবন্তি পণ্ডিতাঃ ॥” - সারবস্তু অর্থাৎ শাস্ত্রের প্রকৃত উদ্দেশ্য ভগবানকে ছেড়ে পণ্ডিতগণ কেবলমাত্র বাগাড়ম্বররূপ ঘোল খেয়ে থাকেন । জ্ঞানী পুরুষই দুগ্ধের সারবস্তু মাখনের ন্যায় সার গ্ৰহণ করে থাকেন । উত্তরগীতায় এ সম্বন্ধে আর এক শ্লোক আছে -
"যথা খরশ্চন্দনভারবাহী ভারস্য বেত্তা ন ত চন্দনন্ত ৷”
অর্থাৎ চন্দনকাষ্ঠের ভারবাহী গদর্ভ ভার বয়েই মরে, চন্দনের গন্ধ অনুভব করতে পারে না । পাণ্ডত্যাভিমানীর এই দশা ।

কার্যে পরিণত না করলে শাস্ত্রব্যাখ্যা শোনা আর না-শোনা উভয়ই সমান । সত্য অনুভব করতে হবে, জ্ঞান ও ভক্তি জীবনে পরিণত করতে হবে । উন্নত হলে জ্ঞান, ভক্তি ও যোগ তিনটির প্রয়োজন । দুটি পাখা ও একটি পুচ্ছ না হলে পাখী উড়তে পারে না । এইরূপ জ্ঞান, ভক্তি ও যোগ - এ তিনটি না থাকলে যথার্থ উন্নতির পক্ষে বিঘ্ন ঘটে । জ্ঞানবিচারবিরহিত ভক্তের মন কীর্তনের সময় যেমন উচ্চে উঠে থাকে, কীর্তনান্তে তেমনি আবার বিষয়ের প্রলোভনে পড়ে যায় । বিচার বিবেকবিরহিত মনকে তখন ধরে রাখা অসম্ভব । জ্ঞান-বিচার ও যোগ সে সময়ে সমতা-রক্ষার সহায়ক । মনকে আয়ত্ত করতে হবে । সে শক্তিও আমাদের ভেতরেই আছে ।

মন-মুখ এক করাই এই বিষয়ের প্রধান সাধন । পরমহংসদেব বলতেন, মন-মুখ এক করার নামই প্ৰকৃত সাধন । যদি কেহ মন-মুখ এক করে তাঁর নিকট প্রার্থনা করে, তিনি কি তাহা পূর্ণ করবেন না ? ধ্রুবের গল্প স্মরণ কর । সে মন-মুখ এক করে বনে ভগবানকে ডাকছিল । কোন সহায় ছিল না, এমন কি গুরুর সহায়তা পৰ্যন্ত ছিল না । মন-মুখ এক করেছিল বলেই ভগবান গুরু দিলেন ও তাকে দর্শন দিলেন । মন-মুখ এক হলে যা কিছু দরকার, তিনি জুটিয়ে এনে দেবেন । গীতাতেও আমাদিগকে বলছেন, “মন-মুখ এক কর।” যুদ্ধক্ষেত্রে অর্জুনের মনে মোহ ও ভয় এসেছিল । মোহ - আত্মীয় স্বজনের জন্য, যাঁরা যুদ্ধার্থী হয়ে কুরুক্ষেত্রে দণ্ডায়মান । ভয় - ইচ্ছামৃত্যু ভীষ্ম, সমকক্ষ কৰ্ণ, শস্ত্ৰাচাৰ্য দ্রোণ, শিবপ্রদবরদর্পী জয়দ্রথকে বিপক্ষে প্রতিদ্বন্দ্বী দেখে । ইঁহাদের সঙ্গে যুদ্ধ সোজা নয় । মায়ার অপূর্ব প্রভাব ! অর্জুনের স্থায় মহাপুরুষেরও সাময়িক মোহ ও ভয় এসেছিল । এরূপ মোহ ও ভয় মানবের স্বাভাবিক । তিনি তাঁর কর্তব্য ভুলে গিয়েছিলেন । ভেতরে শোক, ভয় ও মোহের নিমিত্ত যুদ্ধত্যাগের সংকল্প ও মুখে ধর্মের ভানে যুদ্ধোদ্যম ত্যাগ করে ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করবার কথা বলেছিলেন । ভগবান অন্তৰ্যামী, তিনি বলেছেন -
“অশোচ্যানন্বশোচস্ত্বং প্রজ্ঞাবাদাংশ্চ ভাষসে ৷”
অর্থাৎ তুমি পণ্ডিতদের মতো, ব্ৰহ্মজ্ঞানীর মতো কথা বলছ, আবার আত্মীয়-স্বজনের জন্য শোক করছ । যথার্থ জ্ঞানী নিজের বা অপরের শরীরনাশেও শোক করেন না । তোমার কথায় ও কাজে মিল নেই । পরমহংসদেবও আমাদের ঐ কথা বলতেন, "মন-মুখ এক কর ।” মন-মুখ এক হলে উন্নতি কে রোধ করে ? এক সাধনপ্রভাবে যা কিছু দরকার, আপনি এসে উপস্থিত হয় ।

পূর্বোক্ত প্ৰথম শ্লোকটি এবং নিম্নোক্ত শ্লোকটি মনে রেখে জীবনে পরিণত করতে পারলেই ধর্মলাভের বাকি থাকে না ।
“সর্বধর্মান্‌ পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্ৰজ ৷”
অর্থাৎ মন-মুখ এক করে আমার শরণ গ্ৰহণ কর । আর একটি কথা আমরা সকলে ভুলে গেছি । - সর্বভূতে নারায়ণ-জ্ঞান । পরমহংসদেব বলতেন, “সংসারে ধনী লোকের বাড়ীর চাকরানীর মতো থাকবি ।” চাকরানী নিজের সন্তানের মতো প্রভুর ছেলেকে মানুষ করে, কিন্তু জানে যে, যখন তাকে বিদায় দেবে, তখনই যেতে হবে । এই প্রকারে সংসারে থাক । স্ত্রী-পুত্র তিনিই ন্যস্তস্বরূপ তোমার কাছে রেখেছেন । ন্যস্তস্বরূপই বা কেন, তিনিই স্ত্রী-পুত্র নানা মূর্তিতে তোমার সেবা গ্ৰহণ করছেন । যা কিছু করছ তাঁরই সেবা করছ । কাঙ্গালীকে খাওয়াচ্ছ, কি ভিক্ষুককে একটি পয়সা দিচ্ছ - তিনিই ভিক্ষুক ও কাঙ্গালী রূপে তোমার সেবা নিচ্ছেন । এই ভাব মনে রেখে কাজ করো, অহংকার ত্যাগ করো । অহঙ্কারেই সর্বনাশ । এই ভাব পেলে আর ভয় নেই, কিছুতেই আর বাঁধতে পারবে না । ভগবানের শ্ৰীপাদপদ্মে এই প্রার্থনা, যেন এই ভাব সর্বতোভাবে আমাদের সকলের মনে আজ হতে উদিত থাকে ।
ওঁ হরিঃ ওঁ । শান্তিঃ ! শান্তিঃ ! শান্তিঃ !!!
[২৯শে পৌষ, ১৩১০, বালি হরিসভায় প্রদত্ত বক্তৃতার সারাংশ]


8) বেদান্ত ও ভক্তি



8.1) বাঙ্গলাদেশে জ্ঞান ও ভক্তির ধারণা


এদেশে ভক্তির প্রাধান্য । কোমলাঙ্গ, কোমলস্বভাব বাঙালী - ভক্তির ধর্মই বোঝে । - ভক্তিশাস্ত্রের শব্দাবলী-(যথা - দর্শন, ভাব, প্ৰেম, সাত্ত্বিকবিকার ইত্যাদি) প্রয়োগে সুচতুর । বাঙ্গলার কবি জয়দেব, বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস প্রভৃতি ভক্তির, ভালবাসার কথাই গেয়েছেন । আধুনিক কবিরাও “মহাজনো যেন গতঃ” বলে প্রধানতঃ সেই পথেই নৌকা চালিয়েছেন । ৪০০ বৎসর পূর্বে যে মহাপুরুষ বঙ্গদেশ ধন্য করেছিলেন - অপূৰ্ব প্রেম ও অলৌকিক ত্যাগের মিলনভূমি যাঁর জীবন, ভগবান শ্ৰীকৃষ্ণের বৃন্দাবনলীলার পবিত্ৰতা বুঝবার "প্রধান সহায় - তিনিও ভেতরে যাই থাক, বাইরে ভক্তির কথাই জনসমাজে প্রচার করেছিলেন এবং ভক্তির প্রভাবেই বাঙ্গালীর হৃদয়ে রাজত্ব বিস্তার করেছিলেন । বাঙ্গালীর দেশ, শরীর, স্বভাব, ভাষা, কবিতা ও পূৰ্বেতিহাস ভক্তির বিশেষ উপযোগী না হলে কখনই আমাদের ভেতর ভক্তাবতার ভগবান শ্ৰীকৃষ্ণচৈতন্য ভারতীর আবির্ভাব হত না ।

বাঙ্গলায় ভক্তি-ধৰ্ম যেমন প্ৰবল, জ্ঞান ও জ্ঞানের চর্চাও আবার তেমনি বিরল । “ইনি বড় জ্ঞানী ও বিচারবান” - একথা বললে দেশের অধিকাংশ লোকে ভাবে - সে আবার কি ? ইনি তো কীর্তনে নাচেন না । কই ভগবৎপ্রেমে তো এঁর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বিকৃতি উপস্থিত হয় না ! আবার যদি কেহ জ্ঞানশাস্ত্র-পরিচিত সমাধি, অস্তি-ভাতি-প্রিয়, পঞ্চকোষ, সপ্তভূমিকা, তত্ত্বমসি শ্বেতকেতো ইত্যাদি শব্দ প্রয়োগ করেন, তা হলেই চক্ষুস্থির ! অধিকাংশ শ্রোতা এদিক-ওদিক দেখে পাশ কাটাতে ব্যস্ত হন । কেহবা বলেন 'শুষ্ক মাৰ্গ’ ! কেহ বা গোঁড়ামির স্রোতে গা ঢেলে, আর একটু অগ্রসর হয়ে ‘বেদান্ত’, ‘অদ্বৈতবাদ”, “নাস্তিকতা,’ ‘ঈশ্বরাবমাননা’, ‘নরকে যাবার পথ’ - সব একই কথা স্থির সিদ্ধান্ত করে নাসিকা উত্তোলন ও ঘৃণার চক্ষে দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন ।

বাস্তবিক কি তবে ভক্তি ও জ্ঞান-পথের সামঞ্জস্য নেই ? জ্ঞান ও ভক্তির মিলনভূমি কি কেহই স্পর্শ করতে পারেন না ?


8.2) ধর্মশাস্ত্ৰাদিতে জ্ঞান ও ভক্তির অদ্ভুত সামঞ্জস্য


শাস্ত্রপাঠে অবগত হই, ভক্তিশাস্ত্রের ভেতরেই কত জ্ঞানের কথা ! ভক্তিপ্রধান শাস্ত্ৰ বিষ্ণু-ভাগবতে পদে পদে জ্ঞান ও অদ্বৈতবাদের অবতারণা । নারদাদি ভগবদভক্তেরা ব্ৰহ্মজ্ঞানের নিন্দা করা দূরে থাকুক, তার জন্য কত যত্ন, কত তপস্যাই করেছেন । পুর্ণাবতার ভগবান শ্ৰীকৃষ্ণ ব্ৰহ্মজ্ঞানে অবস্থানের জন্য স্বয়ং প্ৰয়াসী; ভক্তাগ্রণী উদ্ধবকে তিনি একান্ত, তুষার ধবলিত, সৌন্দৰ্য ও গাভীর্যের উদ্বাহভূমি বদরিকাশ্ৰমে জ্ঞানসাধনার্থ পাঠাচ্ছেন; ভক্তি ও প্রেমের মূর্তিরূপিণী ব্ৰজাঙ্গনাদের ধ্যান ও জ্ঞান-বুদ্ধি করবার জন্য ‘কোকিলকূজিত কুঞ্জ'-মধ্য হতে অন্তর্ধান হচ্ছেন । আবার; অনন্তচিন্ত তন্মনস্ক গোপিকাগণ কিশোর ভগবানের কমনীয় মূর্তি ধ্যান করতে করতে ‘আমি বাসুদেব’ ইত্যাকার একতাজ্ঞানের আভাস অনুভব করছেন । এমন কি, প্রেমের উজ্জলভূমি ভগবান শ্ৰীকৃষ্ণচৈতন্যও স্বয়ং কেশব ভারতীর নিকট হতে ‘তুমিই সেই অখণ্ড সচ্চিদানন্দ ও পূর্ণস্বরূপ’ - এই মহামন্ত্রের দীক্ষা গ্ৰহণ করছেন ।

অন্যদিকে আবার কুমার-সন্ন্যাসী, ত্যাগ ও জ্ঞানের জ্বলন্তমূতি, ভগবান শঙ্করাচাৰ্য - বৌদ্ধ বিপ্লবের পর যিনি সমগ্ৰ ভারতে বেদ ধর্মের সনাতন ধ্বজা পুনরুত্তোলন করেন - শিবাবতার সেই মহাবীরের, ভক্তিসুধাপ্লুত হরি-হর-গিরিজা ও গঙ্গাস্তোত্রাদির পাঠে কে না বিমোহিত হয়ে থাকেন ? মায়াগন্ধহীন পরমহংসাগ্ৰণী মহাতেজা ভগবান শুক স্বয়ং ভাগবত-বক্তা । সনক-সনাতনাদি আত্মারাম মুনিগণ ভগবানে অহৈতুকী ভক্তি করছেন । বেদমূর্তি মহাজ্ঞানী ভগবান কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ভগবদ্ভক্তির উচ্ছ্বাস লিপিবদ্ধ করে শান্তিলাভ করেছেন । এমন কি ‘জ্ঞানসিন্ধু’ ‘জগদগুরু’ মহাদেব যিনি স্বয়ং ভক্তিতত্ত্বের প্রধানাচাৰ্য - হরিভক্তি প্ৰদান করে মহামুনি নারদের জীবন চিরকালের জন্য ধন্য করছেন ।

অতএব আমাদের পূর্ব প্রশ্নের সামঞ্জস্য নিশ্চিত আছে । স্থির মনে শ্রদ্ধার সহিত পূর্ব পূর্ব আচার্যগণের পদপ্রান্তে জিজ্ঞাসু হয়ে বসলেই বুঝতে পারব ।

জ্যোতির্ময় আত্মা-পক্ষী অনন্ত চিদাকাশে উড়বার প্রয়াস পাচ্ছে । জ্ঞান ও ভক্তি তার বিস্তারিত পক্ষদ্বয় এবং যোগ গতিনিয়ামক পুচ্ছ । তিনটি অঙ্গ সরল ও সমানভাবে পরিবর্ধিত না হলে উড়বার চেষ্টা বৃথা । পক্ষদ্বয় না থাকলে গতি-শক্তিই সম্ভবে না । আবার সংযমপুচ্ছ না থাকলে লক্ষ্যভ্ৰষ্ট হয়ে শক্তি অন্যদিকে ব্যয়িত হয়, অভীষ্ট ফল প্ৰদান করে না; বেদমূর্তি তপোধন ব্যাস এই মহাসত্যের উপদেশ করেছেন । যে কোন যুগে, যে কোন দেশে, যে কোন ধর্মে যত ধৰ্মবীর, অবতার, আচাৰ্য মহাপুরুষ জন্মগ্রহণ করে ধরা ধন্য করেছেন, কামকাঞ্চন-স্বার্থপরতার উন্মত্ততা ও কোলাহলের মধ্যে যাঁদের অলৌকিক জীবন ‘সূর্যকোটি প্রতীকাশং চন্দ্রকোটিসুশীতলং’ ধর্মালোক বিস্তার করে হতাশ মানবের নয়ন মন স্তম্ভিত ও প্ৰবুদ্ধ করেছে, বসন্তাগমে বৃক্ষলতিকার ন্যায় যাদের আগমনে মৃত মনে নূতন প্রাণ সঞ্চারিত হয়ে মরুভূমির ধূসরতা হরিৎ-পুঞ্জে পরিণত করেছে — তাদের জীবনবেদ পাঠ করে জ্ঞান ও ভক্তির কি বিচিত্ৰ সম্মিলন দেখতে পাওয়া যায় ! জ্ঞান ও ভক্তির অপূর্ব পরিণয় তাঁদের জীবনে যে কি মহান্‌ উদারতা প্রসব করেছিল, তা জগতের ধর্মেতিহাস-পর্যালোচনায় সম্যক্‌ বুঝতে পারা যায় । এই উদারতার বলেই শ্ৰীচৈতন্য যবন-হরিদাসকে শিষ্য করতে এবং আচণ্ডালে প্রেম দিতে কুণ্ঠিত হন নাই; এই উদারতার বলেই ভগবান ঈশা সামারিটান্‌-কন্যার জলপান, বেশ্যা-মেরীর সেবাগ্রহণ এবং য়াহুদী ও অন্য জাতিকে সমানভাবে ঈশ্বরতত্ত্ব উপদেশ করেছিলেন; ইহার প্রভাবে ভগবান শাক্যসিংহ জ্ঞানের সুদৃঢ়স্তম্ভস্বরূপ হয়েও বিম্বিসারযজ্ঞে, একটি ক্ষুদ্র নগণ্য ছাগশিশুর জন্য নিজ জীবন উৎসর্গ করতে প্ৰসন্নচিত্তে উদ্যত হয়েছিলেন । গাৰ্হস্থ্য ও সন্ন্যাসের অপূর্ব সম্মিলন, তেজ ও মাধুর্যের বিচিত্র সমাবেশ, ভারতের পূর্ণাবতার ভগবান শ্ৰীকৃষ্ণ পুণ্যভূমি কুরুক্ষেত্রে অর্জুনকে বলেছিলেন, “মানুষ কেহই আমায় এককালে ছেড়ে অবস্থিত নয় ; সকলেই ভিন্ন ভিন্ন পথে আমার দিকে আসছে । যেদিক দিয়েই যাক না কেন, আমি তাকে সেই দিক দিয়েই ধরি ।”

হৃদয় ও মস্তিষ্ক সমানভাবে বর্ধিত এমন লোক জগতে অতীব বিরল । একটি অপরটির ব্যয়ে বর্ধিত হচ্ছে, একটি বেড়ে অপরটিকে আওতায় ঘিরেছে - ইহাই সচরাচর দেখতে পাওয়া যায় । কিন্তু হৃদয় ও মস্তিষ্ক সমভাবে পুষ্টি প্রাপ্ত হয়ে সমভাবে কাৰ্য করছে - হৃদয় একদিকে ভাবের সাগর হয়ে সমস্ত জগৎকে আপনার করে নিয়ে অত্যল্পমাত্ৰ ভাবস্পন্দে নেচে উঠছে এবং মস্তিষ্ক অপরদিকে কূট জটিল প্ৰশ্নসমুদয় ছিন্ন ভিন্ন করে ভেতরের সারবস্তু-গ্ৰহণে সমান পারদর্শী হয়ে উঠেছে - ইহাই আদর্শ এবং দেব ও গুরুর বিশেষ প্রসাদ ভিন্ন পাওয়া অসম্ভব । জ্ঞান ও ভক্তির আবহমানকাল ধরে যে বিবাদ, তার প্রধান কারণ ঠিক এইখানে পাওয়া যায় । গোঁড়ামি, সঙ্কীর্ণতা, হীনবুদ্ধি, একদেশী ভাব - এ সকলই হৃদয়-মস্তিষ্কের অযথা সংস্থাপনের ফল এবং ধৈৰ্য, বীৰ্য, শ্রদ্ধা, উদারতা, এমনকি জীবন্মুক্তিও ইহাদেরই যথাযথ সংস্থানের ফল । মুক্ত হওয়া আর কিছুই নয় - নীতি, চরিত্র প্রভৃতি তখন আর প্রয়াস করে রক্ষা করতে হয় না, নিঃশ্বাস-প্ৰশ্বাস ও রক্তসঞ্চালনাদির ন্যায় স্বাভাবিক ও সহজ হয়ে আসে । তখনই মানুষের আপন মন গুরু হয়ে দাঁড়ায়, যাহা ভাল বলে গ্ৰহণ করে তাহা নিঃসংশয়ে ভাল হয় এবং যাহা মন্দ বলে, তাহা তেমনি নিশ্চিত মন্দ হয় । তখন “মা আর তার পা বে-তালে পড়তে দেন না ।”


8.3) জ্ঞান ও ভক্তির বিরোধ কোথায়


তবে জ্ঞান-ভক্তির বিরোধ কোথায় ? - পথে ও কথায় । কথার বিবাদ মিটে গেলে বোধ হয় জগতের চার ভাগের তিন ভাগ ঝগড়া মিটে যায়, এক শব্দে ভিন্ন ভিন্ন বস্তু লক্ষ্য করে, অথবা এক শব্দে একই বস্তুর ভিন্ন ভিন্ন ভাব লক্ষ্য করে আমাদের মধ্যে যত বিবাদ উপস্থিত হয় । আমেরিকার সুবিখ্যাত ক্ৰমবিকাশবাদী পণ্ডিত জন ভিস্ক বলেন, বিরুদ্ধ পক্ষের ভাব ও দৃষ্টি নিয়ে দেখবার শক্তিহীনতাই যত বিবাদ-বিসংবাদের কারণ । হারবার্ট স্পেন্সর আর একটু অগ্রসর হয়ে এই রোগের কারণ ও ঔষধ নির্দেশ করেছেন - “জয়ের আদর কমে আমাদের হৃদয়ে যত সত্যের আদর বাড়বে, আমাদের বিরুদ্ধ পক্ষ এত দৃঢ়তার সহিত কেন স্বমত পোষণ করে তার কারণ-অন্বেষণের চেষ্টাও আমাদের ভেতর তত বলবতী হবে এবং ‘লক্ষ্য-বিষয়ে তারা এমন কিছু দেখেছে যা আমরা এখনও দেখতে পাচ্ছি না’ - এই ধারণার সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের তারা যতটুকু সত্য পেয়েছে, তার সহিত আমরা যতটুকু পেয়েছি, তার সংযোগের চেষ্টা হবে ।” পরমহংসদেব এ বিষয়ে তাঁর সেই সুমিষ্ট গ্রাম্য ভাষায় বলতেন, “ওরে, কোনও জিনিসের ‘ইতি' করিস্‌নি - ভগবান তো দূরের কথা । ‘ইতি’ করা, ‘এটা এই - এছাড়া আর কিছু হতেই পারে না’ মনে করা, হীনবুদ্ধির কাজ ।”


8.4) অনন্ত ঈশ্বরে ‘ইতি’ - অসম্ভব



অনন্ত ঈশ্বরের অনন্ত ভাবের খেলা - এই ব্ৰহ্মাণ্ড । ক্ষুদ্ৰাৎ ক্ষুদ্রতম-এর এক-একটি অংশও অনন্তত্বের পরিচয় দেয় । একগাছি তৃণ, একটি বালুকণা বা বিশেষ শক্তিশালী অণুবীক্ষণ গ্রাহ্য একটি প্রাণিবীজের শরীরগঠন ও গুণ ইত্যাদির ইয়ত্তা কে করতে পারে ? সেইজন্যই বেদ বলেছেন, “পূর্ণমদঃ পূৰ্ণমিদং পূর্ণাৎ পূর্ণমুদচ্যতে । পূর্ণস্য পূর্ণমাদায় পূর্ণমেবাবশিষ্যতে ।” পূর্ণ তিনি, পূর্ণ তাঁর জগৎ; সেই পূর্ণানন্ত-স্বরূপ হতেই এই অসীম জগৎ প্ৰসূত, কিন্তু তাতে তাঁর হানি বা হ্রাস হয়নি । কারণ অনন্ত-পদার্থ হতে অনন্ত পদার্থ নিৰ্গত হোক না কেন - যে অনন্ত সেই অনন্তই থাকে ।

বাস্তবিক মানব নিজেও অনন্ত এবং অনন্তের সহিতই চিরকাল খেলছে । ‘করতলামলকবৎ’ অনন্তকেই সে ধরছে, ছুঁইছে, দেখছে, শুনছে । কেবল তার ভেতর কি একটু কোথায় গোলমাল হয়েছে যার জন্য সে তাতে সান্ত বুদ্ধি করছে । পিতা-মাতা, স্ত্রী-পুত্ৰ, বন্ধু-বান্ধব, জড়-চেতন, উচ্চ-নীচ, ক্ষুদ্ৰ-মহান্‌ - সকল স্থানে একবার সেই অনন্ত বুদ্ধি আন দেখি - ধরা স্বৰ্গ হবে; শোক, মোহ, জরা, মৃত্যু কোথায় লুকাবে ; ধর্ম, ভক্তি, মুক্তি আর কাল্পনিক ধোঁয়া ধোঁয়া শব্দমাত্র থাকবে না; আর সর্বত্ৰ সকলের মধ্যে দেখবে - সেই জীবন্ত বিশ্বরূপী বিরাট, সেই ‘সর্বতঃ পাণিপাদন্তৎ সর্বতোহক্ষিশিরোমুখং', সেই ভীষণ হতেও ভীষণ এবং শোভন হতেও শোভন, নিবিড় আঁধার ও অনন্ত জ্যোতিহিল্লোলের বিচিত্র সমাবেশ, করালবদনা শবশিবা ! এই দেবদুর্লভ পূর্ণদৰ্শনের প্রথম সোপানই হচ্ছে – ‘ইতি না করা’ ।


8.5) ‘আমি’ ও ‘তুমি'



‘আমি’ ও ‘তুমি' - এ দুটি অতি সহজ কথা । জন্মাবধি মানুষ বোধ হয় এ দুইটি যতবার উচ্চারণ করে, ততবার আর কোনটির করে না । এ দুটি পৃথক ভাব জীবনে প্ৰথমেই শিক্ষা হয়; আবার এই দুই বস্তু এতই বিরুদ্ধ-ভাবাপন্ন যে এ দুটিতে গোল হবার আদৌ সম্ভাবনা নেই । কিন্তু জ্ঞান ও ভক্তির বিরোধ বোধ হয় ঐ দুটি শব্দ হতে যত হয়েছে, এত আর কিছুতে হয়নি ।


8.6) ‘তুমি’ ও ভক্তি


ভক্ত বলেন - “ঠাকুর । আমি কিছু নই, তুমিই সব । রোগে-শোকে জর্জরীভূত, কাম-ক্ৰোধে উন্মত্তপ্রায়, যশ-মানের কাঙ্গালী, বায়ুর ন্যায় অস্থির-মতি - এ ‘আমি’র আবার শক্তি আছে ? এ ‘আমি’র দ্বারা আবার সাধন হবে, ভজন হবে-তোমায় পাব ? জলে শিলা ভাসা, বানরের সঙ্গীত, আকাশ-কুসুমও কোন কালে সত্য হতে পারে; কিন্তু এই নগণ্য ‘আমার’ শক্তি আছে এবং সেই শক্তিতে তোমায় ধরব - ইহা কখনও সম্ভব না । তুমি আমার প্রাণের প্রাণ, সর্বস্ব ধন; তোমার যা ইচ্ছা তাই পূর্ণ হোক । নাহং নাহং - তুহু তুহু তুহু তুঁছ ।” ভক্ত দেখেন এক মহান্‌ ‘তুমি’ – যাঁর নিয়মে সূৰ্য-তারকা ফিরছে, অগ্নি জ্যোতি দিচ্ছে, মৃত্যু সমুদয় গ্রাস করছে । ভক্ত দেখেন, সেই ‘তুমি’ আবার প্রাণের প্রাণ, নয়নের জ্যোতি, বাহুর শক্তি; প্রেমই তাঁর স্বরূপ, তিনি পরম সুন্দর !! সে সৌন্দর্যের কাছে আর সকল সৌন্দৰ্য অন্ধকারে পরিণত, সে বীর্যের কাছে অন্য সকলের বীর্য পরাহত । এই মহান তুমি - নিকট হতেও নিকটে, আপনার হতেও আপনার । মোহিত স্তম্ভিত হয়ে ভক্ত এঁকেই ইষ্টদেব বলে বরণ করেন এবং ‘তুমি’-নাম-মহামন্ত্রে মহোৎসাহে দীক্ষিত হন ।


8.7) ‘আমি’ ও জ্ঞানী



জ্ঞানী দেখেন, শরীর প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল, মনও তদ্রুপ - ফিরছে, ঘুরছে, বাড়ছে, কমছে । চন্দ্ৰোদয়ে সমুদ্রবারির ন্যায় ভাবরাশি কখন উত্তাল তরঙ্গ তুলে গভীর গৰ্জনে ছুটছে, আবার কখনও বা অস্তমিত শক্তি - ফল্গুর ন্যায় ক্ষুদ্র ধারা - বালুকা ভেদ করতে না করতে শুকিয়ে যাচ্ছে । কিন্তু এই বাল্য, যৌবন, বার্ধক্যের ভেতর জাগ্ৰৎ, স্বপ্ন, সুষুপ্তির ভেতর - শরীর, মন, বুদ্ধির ভেতর - ভূত, ভবিষ্যৎ, বর্তমানের ভেতর - এক অনন্ত, অপরিবর্তনীয় নির্মল নিত্যস্রোত বইছে, যার আঘাত অন্তরে লাগায় অবিরত ‘অহং’ ‘অহং’ ধ্বনি উঠছে; বুদ্ধি দোলায়মান চিত্তবৃত্তিকে বিশেষ বিশেষ রূপসম্পন্ন করে নিশ্চয়াকৃতি করছে; প্ৰাণচক্ৰ পরিবর্তিত হয়ে ইন্দ্ৰিয়সকলকে স্ব স্ব কাৰ্যে নিযুক্ত রেখেছে । জ্ঞানী এই অনিত্যের ভেতর সেই নিত্যের, অচেতনের ভেতর সেই সচেতনের, অশক্তিকের ভেতর সেই পরিপূর্ণশক্তিকের দর্শন পেয়ে স্তম্ভিত ও বিস্মিত হলেন । আবার দেখলেন, সেই নিত্যের ছবি, স্ত্রী-পুরুষ, জীব-জন্তু, গ্ৰহ-নক্ষত্র, জড়চেতন-সমুদয় জগতে বর্তমান । দেখলেন, এই ক্ষুদ্র ‘আমি’-র যথার্থ স্বরূপ মহান্‌ ও নিত্য । মহোল্লাসে বলে উঠলেন, “আমাতেই এই জগৎ উঠছে, ভাসছে, লীন হচ্ছে । আমিই জ্ঞান ও শক্তির একমাত্র আকর ! আমিই নারায়ণ ! আমিই পুরান্তক মহেশ ! মৃত্যু ও শঙ্কা কি আমায় স্পর্শ করতে পারে ? জন্ম-জরা-বন্ধনই বা আমার কোথায় ?”—
“ন মৃত্যুর্ন শঙ্কা ন মে জাতিভেদঃপিতা নৈব মে নৈব মাতা ন জন্ম ৷
ন বন্ধুর্ন মিত্ৰং গুরুর্নৈব শিস্যঃচিদানন্দরূপঃ শিবোহহং শিবোহহম্‌ ৷৷”


8.8) ভক্ত ও জ্ঞানীর লক্ষ্য একই



তবে ভক্তের ‘মহান্‌ তুমি’ ও জ্ঞানীর ‘মহান্‌ আমি’র মধ্যে আর প্রভেদ কোথায় ? - কেবলমাত্র বাক্যে । দুজনেই এক বস্তুকে লক্ষ্য করে ভিন্ন ভিন্ন শব্দ প্রয়োগ করেন মাত্র । উভয়েই বলেন, ইন্দ্ৰিয়সকল সংযত কর, নিত্য পদার্থে বিশ্বাস কর এবং এই ‘ক্ষুদ্র আমি’, কাঁচা আমি’ ছেড়ে দাও - উহাই যত দুঃখ ও বন্ধনের কারণ । কাঁচা ‘আমি’কে ভক্তি বা বিবেক-বৈরাগ্যের জলন্ত আগুনে পোড় খাইয়ে মহান্‌ আমি বা তুমির সহিত সম্বন্ধ পাতিয়ে 'পাকা’ করে লও । আবার, জোর করে সম্বন্ধ পাতাতেও হবে না; পরস্পর আকর্ষণ ও সখ্য উভয়ের নিত্যকাল বর্তমান দেখতে পাবে ।

দ্বা সুপর্ণা সযুজা সখায়া সমানং বৃক্ষং পরিষস্বজাতে ৷
তয়োরন্যঃ পিপ্ললং স্বাদ্বত্ত্যনশ্নন্নন্যো অভিচাকশীতি ৷৷ ১
সমানে বৃক্ষে পুরুষো নিমগ্নোহনীশয়া শোচতি মুহ্যমানঃ ৷
জুষ্টং যদা পশ্যত্যন্যমীশমস্য মহিমানমিতি বীতশোকঃ ৷৷ ২
যদা পশ্যঃ পশ্যতে রুকনবর্ণং কর্তারমীশং পুরুষং ব্রহ্ম-যোনিম্‌ ৷
তদা বিদ্বান্‌ পুণ্যপাপে বিধূয় নিরঞ্জনঃ পরমং সাম্যমুপৈতি ৷৷ ৩


8.9) জীবাত্মা ও পরামাত্মা - দুটি পক্ষী



ঊর্ধ্বমূল অবাক্‌শাখ এই সংসার-অশ্বখের দুই শাখায় দুটি পক্ষী বসে রয়েছে । দুটিই সুন্দর এবং চিরপ্রেমে পরস্পর আবদ্ধ । তাদের একটি সুখদুঃখময় ফলভোগে ব্যস্ত, ‘আমি আমার’-জ্ঞানে নিরন্তর মোহিত ও ব্যথিত; অপরটি আপনার মহিমায় দীপ্তিমান, ভোগে আদৌ দৃষ্টি নেই । সংসারের জ্বালা-যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে যখনই প্রথমটি ফলভোগের বাঞ্ছা ছেড়ে দেয়, অমনি অপরটির হিরন্ময় রূপ এবং কোটি ব্ৰহ্মাণ্ডব্যাপী মহিমা তার নিকট প্রকাশিত হয় । আর তাকে সুখদুঃখ, পুণ্যপাপ স্পর্শ করতে পারে না । কামকাঞ্চনের আবরণে তার অঞ্জনরহিত চক্ষু আর কখনও আবৃত হয় না । অনিত্যের মধ্যে সেই একমাত্ৰ নিত্যপদার্থের, বহুর মধ্যে সেই একের উপলব্ধি করে সে আপনাকে ও সকলকে সেই এক বলেই ধারণা করে এবং পরম সমতা ও শক্তি লাভ করে ।


8.10) অজ্ঞানবরণের মধ্যে ভগবনের প্রকাশ



বাস্তবিক মনুষ্য কখনও ভগবান হতে দূরে অবস্থিত নয় । নীচ সঙ্গে, নীচ কর্মে সে যতই নীচগামী হোক না কেন, তার দৃষ্টি সেই হিরন্ময় পুরুষের ‘সূর্যকোটি-প্রতীকাশ' রূপ হতে কখনই একেবারে বঞ্চিত নয় । সংসারের দুঃখ-যন্ত্রণায় অস্থির হলেই সে দেখতে পায়, রোগ-শোকে অভিভূত হলেই তাঁকে কিছু-না-কিছু উপলব্ধি করে । নতুবা শিক্ষাবিহীন, হিংসাজীবন ঘোর স্বার্থপর বন্যের ভেতর কোথা হতে ধর্মভাব অঙ্কুরিত হয় ? অন্ধতমসাবৃত তার জীবনে কোথা হতে শ্রদ্ধার আলোক উপস্থিত হয়ে ধীরে ধীরে স্বার্থপরতার রজনী অপসৃত করে ? ধূমকেতু হতেও অনিয়তগতি তার চরিত্রে কোথা হতে সমাজবন্ধন, বিবাহবন্ধন, স্বজনস্নেহ, দেশহিতৈষিতা ইত্যাদি উপস্থিত হয়ে পরিশেষে জগতের মঙ্গলকামনায় তাকে নিযুক্ত করে ? কেনই বা সে উদয়োন্মুখ সূর্যের, শৃঙ্গবিদারী বজ্রের, বিশেষ শক্তিমৎ পদার্থের বা পরলোকগত আত্মার সম্মুখে অবনতজানু, অবনতমস্তক হয় ? বলবে অজ্ঞতা, বলবে কুসংস্কার, বলবে কুহকিনী কল্পনার মায়ামন্ত্রে মুগ্ধ হয়ে মানুষ ভৌতিক জড়পদার্থ ও শক্তিতে চেতনে ইচ্ছাময়ী লীলার তরঙ্গভঙ্গ আরোপিত করে, বলবে ভয়ে বা ভালবাসায় অথবা অদ্ভুত স্বপ্নরাজ্যে - যেখানে দৃষ্ট, অদৃষ্ট কত লোকের সহিত মেশামোশি আলোক ও আঁধারের বিচিত্র মিলনে অস্পষ্ট, ঈষদ্‌ব্যক্ত, অপরিস্ফুট ও অব্যক্ত ছায়াময়ী মূৰ্তিসকল ছায়ার জগতে ছায়ার নাম ধাম ও সম্বন্ধ পাতিয়ে জীবন্তরূপে প্ৰকাশিত হয় অথচ প্রখর জ্ঞানসূর্যের কিরণবিস্তারে কোথায় সরে দাঁড়ায় - সেই স্বপ্নরাজ্যে প্ৰথম মানবের মনে শ্রদ্ধা ও ধর্মের বীজ অঙ্কুরিত হয় । সত্য, ধ্রুবসত্য হলেও একথা ‘ধর্মের মূল কোথায়’ - এ প্রশ্নের সম্যক্‌ তলস্পর্শ করতে পারে না । অজ্ঞতা ও কুসংস্কার কি কখনও উন্নতির দ্বার খুলে দেয় ? কল্পনা কি কখনও যথার্থ সত্য প্রসব করে ? তবে এর নিঃসংশয় উত্তর কোথায় ? মানুষের ভেতর অদম্য অনন্ত শক্তি কুণ্ডলী-আকারে নিবদ্ধ । জন্ম-জরা-মৃত্যুও সে শক্তির নিকট পরাহত । অনন্ত বাধা-বিঘ্ন ভেদ করে দেশকালের সীমা অতিক্রম করে ‘অবাঙ্‌মনসোগোচর’ রাজ্যে সে শক্তির প্রখর দৃষ্টি ছুটতে সমর্থ । তজ্জন্যই সে সেই নিত্য পদার্থের কিছু না কিছু রূপের ছায়া সকল বস্তুতে দেখতে পায় । তজ্জন্যই সে সেই অনিত্য বস্তুকে নিত্য বলে ধারণা করে এবং যে-মুহুর্তে মানব সেই মহাশক্তির সঞ্চালনে, পূর্ণ সত্যের দর্শনে ঠিক ঠিক বাঞ্ছা করবে সেই মুহুর্তেই সে সংসারবৃক্ষের উচ্চ শাখায় অবস্থিত, হিরণ্ময়বপু, আদি কবির সত্য ও পরিপূর্ণ স্বরূপের অবাধ দর্শন লাভ করবে ।


8.11) মূল বিষয়ে সকল শাস্ত্ৰই অভেদ



জগতের যাবতীয় ধর্মশাস্ত্ৰ ঐ কথাই একবাক্যে ঘোষণা করছে । হিন্দুর বেদ, মুসলমানের কোরান, বৌদ্ধের ত্রিপিটক এবং খ্ৰীষ্টানের বাইবেলে এখানে মতভেদ নেই । কিন্তু কোন্‌ পথে অগ্রসর হলে এই চরমোন্নতি লাভ করা যায়, সে বিষয়ে মতভেদ আছে । স্বৰ্গ ও সৃষ্টির বর্ণনায় মুক্তি ও মানবাত্মার তৎকালীন অবস্থাবিষয়ে মতভেদ বিস্তর, কিন্তু মানব যে পূর্ণানন্ত স্বরূপ হতে কিছুকালের জন্য এই আপাত অপূৰ্ণ স্বরূপে প্ৰতীয়মান হচ্ছে এবং ধীরে ধীরে পুনরায় সেই পূৰ্ণানন্তের দিকে অগ্রসর হচ্ছে, এ বিষয়ে সকলেই একবাক্য । ভক্তি বল, জ্ঞান বল, কর্ম বা নীতি বল, এ বিষয়ে সকলের এক কথা । জগতের যাবতীয় পুরাণসকলও রূপকের পল্লবিত ভাষায় মানবকে এই কথাই উপদেশ করছে । দেশীয় পুরাণসমূহের কথা তো ছেড়েই দি, বিদেশী য়াহুদি পুরাণ বাইবেলেও আগেই বলছে – প্ৰথম মানব নিষ্পাপ, পরিপূর্ণস্বরূপ হয়ে জন্মেছিল; ভগবানের আজ্ঞা-অবহেলায় সেই স্বরূপ হতে চ্যুত হয়; আবার তাঁর কৃপায় সেই স্বরূপ লাভ করবে । এখনও যাবতীয় য়াহুদি নরনারী রামধনুর বিচিত্র আবরণে এই আশাপ্ৰদ কৃপাবাক্য ভক্তিগদগদ হয়ে পাঠ করে । “নিষ্পাপ হও, ভগবদ্ভক্তি বা জ্ঞানলাভে নিরঞ্জনত্ব লাভ কর” – একথা ভক্তি বা জ্ঞান-শাস্ত্র উভয়েই একবাক্যে বলছে । “কাঁচা ‘আমি’কে পাকা করে লও; ইন্দ্ৰিয়-সংযম ও স্বাৰ্থত্যাগ করে পরার্থ চেষ্টা কর; ভগবানে অচল অটল বিশ্বাস ও নির্ভর রাখ” - একথা ভক্তি ও বেদান্ত উভয়েই একতানে ঘোষণা করছে । তবে আর মূল বিয়য়ে বিরোধ কোথায় ?


8.12) পথের বিবাদ মিটবে কিসে ?



বলবে, কথার বিবাদ মিটলেও মিটতে পারে; ভালবাসা ও সহানুভূতিতে পরকে আপনার করে নিয়ে তার চক্ষে, তার ভাবে তার ধর্ম ও ভাষার অনুশীলনে কথার বিবাদ একদিন মেটা সম্ভব । কিন্তু পথের বিবাদ যে অতি বিষম । উহা মিটাবার উপায় কি ? কেউ তো কারও পথ ছাড়বে না । আবার পথ ছাড়লেই বা তার ধর্মের উপায় কি ? তার ধর্ম তো এককালে মিথ্যাই প্ৰতিপন্ন হয় । আবার এক ধর্ম মিথ্যা হলে অপর ধর্ম-সমূহ যে সত্য, তারই বা প্রমাণ কোথায় ? পরিশেষে ধৰ্ম বৃদ্ধাস্ত্রী-জল্পনা মাত্র এবং নাস্তিকতাই শ্রেয়, এই ধারণা অনিবাৰ্য হবে ।

না, পথের বিবাদ মিটবারও উপায় আছে । ভারতের পূর্বতন ঋষি ও আচার্যপাদেরা এ বিষয়ের সুন্দর মীমাংসা করে গেছেন । ধর্মজগতে তাঁদের দৃষ্টি যে নানারূপের বিঘ্নবাধা ভেদ করে যথার্থ সত্যের পরিপূর্ণ স্বরূপ-দর্শনে সমর্থ হয়েছিল, এতেই তা প্ৰতীয়মান হয় । ইহাই তাঁদের প্রাতঃস্মরণীয় উজ্জ্বল গরিমা । ইহাই ধৰ্মবীর প্রসবিনী অবতারবহুল পুণ্যভূমি ভারতের জাতীয় গৌরবের একমাত্র অত্যুচ্চ ধ্বজা । স্বদেশপ্ৰাণতা, সমাজবন্ধন, রাজনীতি, ব্যবহারব্যবস্থা, স্বাস্থ্যবিধান, গৃহরক্ষা, বাণিজ্য এবং যুদ্ধবিগ্ৰহাদি শিক্ষাসম্বন্ধে আমাদিগকে অবনতমস্তকে ইউরোপ, আমেরিকা প্ৰভৃতি পাশ্চাত্ত্য দেশসমূহকে গুরুস্থানীয় স্বীকার করতে হবে । কিন্তু আত্মা, পরলোকবাদ, ধৰ্মসমন্বয়, ধর্মপ্ৰাণতা, গুরু ও ইষ্টনিষ্ঠা - এবিষয়ে আমাদের ঋষি ও আচার্যগণ এখন এবং নিত্যকাল জগতের পূজ্য ও গুরুস্থানীয় থাকবেন;, এখন এবং চিরকাল তাঁদের আশাপ্ৰদ অমৃতময়ী ঔপনিষদিক বাণী সর্বদেশের নরনারীর চক্ষুপ্রান্ত হতে কামকাঞ্চনের যবনিকা উত্তোলন করে অভয় আনন্দস্বরূপকে দেখিয়ে দেবে, এখন এবং নিত্যকাল তাঁদের সেই ‘পূর্ণমিদঃ পূৰ্ণমিদং’ গম্ভীর নিনাদ বিষয়ের কোলাহল স্তম্ভিত করে নরনারীর প্ৰাণমন মহাবেগে অনন্ত আনন্দের দ্বারে উত্তেলিত করবে এবং ‘একং সদ্ বিপ্ৰা বহুধা বদন্তি’রূপ তাঁদের ঘোষণা বহু নাম ও বহু পথ যে সৰ্বকাল সেই এক নিত্য বস্তুর দিকেই প্রবাহিত হচ্ছে, চিরকাল এই শিক্ষা নরনারীকে প্ৰদান করবে ।


8.13) বিবাদ মিটাবার উপায় – স্বধর্ম ও ইষ্টনিষ্ঠা



একই গঙ্গা হিমাচলের নীহাররাশি ভেদ করে শৃঙ্গ হতে শৃঙ্গান্তরে, তথা হতে শস্যশ্যামল সমতল ক্ষেত্রে ‘বহুজনহিতায় বহুজনসুখায়’ সাগর-সঙ্গমে প্রবাহিত । শত শত লোক শত শত তীর্থে সেই জলে স্নান-পান সমাধা করছে । সকলে নিজ নিজ সন্নিকট তীর্থেই যাচ্ছে । এইরূপে বহুতীর্থ হলেও সকলে সেই একই “গাঙ্গ্যং বারি মনোহারি’ স্পর্শে পবিত্র হচ্ছে । বহু-তীৰ্থ বলে তো বিবাদ হচ্ছে না । তবে ধৰ্মজগতে পথ নিয়েই বা এত বিবাদ কেন ? পথসকল ‘যথা নদ্যঃ স্যন্দমানাঃ সমুদ্রে’ - সেই এক অখণ্ডচিদানন্দসাগরে মিশছে । এজন্যই ঋষিরা স্বধর্ম ও ইষ্টনিষ্ঠার উপদেশ করেছেন ।

মানুষের প্রকৃতি ও মন ভিন্ন ভিন্ন । গাছের একটি পাতা যেমন অপরটির সহিত মেলে না, হাতের একটি অঙ্গুলীর যেমন অপরটির সহিত বিশেষ দৃষ্টিতে সাদৃশ্য পাওয়া যায় না, সেইরূপ একটি মনের সহিত অপর একটি মনের সর্ববিষয়ে সমতা নেই । প্রত্যেকটির জন্মজন্মান্তরীণ কর্মজনিত সংস্কারোপযোগী বিভিন্ন গঠন ও আকার । কোন শরীর ও মনে পশুভাব, আবার কোনটিতে বা দেবভাব প্রবল । কোনটি বা ভ্রষ্ট তারকার ন্যায় লক্ষ্যচ্যুত, কামকাঞ্চনের আকাশে ছুটোছুটি করছে; আবার কোনটি বা সমুদ্রগর্ভবিদারী পর্বতপুঞ্জের ন্যায় বিষয়ের উত্তাল তরঙ্গকুলের ঘন ঘন ঘাত অচল অটল ভাবে অকাতরে সহনে সমর্থ । এই অদ্ভুত বিচিত্ৰতাভূষণ ভিন্ন ভিন্ন মানবের কখনও কি এক ধর্ম উপযোগী হতে পারে ? রুগ্ন ও সবলকায় সকল বালক-বালিকার জন্য মাতা কি কখনও একই খাদ্যের ব্যবস্থা করতে পারেন ? শিশু ও যুবার জন্য কখনও কি সমপরিমাণ বস্ত্রাবরণ সম্ভব ? অথচ ধৰ্মজগতে কি এতদিন ঠিক তদ্রুপ চেষ্টাই আসছে না ? খ্ৰীষ্টান পাদরি বলছেন, আমার ঈশাহি ধৰ্ম তোমার মনের উপযোগী হোক আর নাই হোক, গ্ৰহণ না করলেই তোমার অনন্ত নরক । মুসলমান বলছেন, আল্লা নামের উপাসনা ও নিরাকার ঈশ্বরে দাসভাবে ভক্তি-ভজনা না করলে তোমার এ পৃথিবীতেই বেঁচে থাকবার প্রয়োজন নেই, দেহান্তে স্বৰ্গলাভ তো বহু দূরের কথা । জৈন, বৌদ্ধ, শৈব, শাক্ত সকলেরই এই এক কথা । সকলেই বলছেন, আমার ধর্মে সকলকে দীক্ষিত হতে হবে । আমার ধর্ম আমার মনের উপযোগী, অতএব সকল মনের উপযোগী হতেই হবে । এই তুমুল কোলাহলের ভেতর দিয়ে আৰ্য-ঋষির গম্ভীর অন্তঃসারপূর্ণ বাণী আকাশপথে উত্থিত হয়ে শৃঙ্গ হতে শৃঙ্গান্তরে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল - “স্বধৰ্ম পরিত্যাগ করো না । আপন আপন প্ৰকৃতি উপযোগী ধর্মদোষযুক্ত হলেও ছেড়ো না, জগতে সকল গুণ দোষমিশ্রিত । ‘মন মুখ এক করে’ চেষ্টা করলে, সকল মতেই আনন্দস্বরূপকে ধরা যায় । সকলেই সমভাবে সেই অমৃতের অধিকারী ।” সসাগরা ধরা স্তম্ভিত হয়ে সে আনন্দধ্বনি শুনতে লাগল । কিন্তু সে মুহুর্তমাত্ৰ । পরক্ষণেই আবার সেই অসার পথ নিয়ে সকলে বিবাদে নিবিষ্ট হল ।


8.14) ধর্মাধর্মের পরীক্ষা - নিঃস্বার্থতা



বাস্তবিক স্বধর্ম ও ইষ্টনিষ্ঠা ঠিক ঠিক ধর্মলাভের ও ধর্ম-জগতে বিবাদ মেটাবার একমাত্র সেতু । অখণ্ডস্বরূপের অনন্ত ভাব অনন্তকোটির মানবমনের উপযোগী হয়ে রয়েছে । মানব কটা ভাবই বা তাঁর গ্রহণ করতে পেরেছে ? নাস্তিকতা, অবিশ্বাস প্রভৃতি কেন মানবমনে শ্রেয় বলে বোধ হয় ? জগতে যত প্ৰকার ধর্ম অদ্যাবধি প্রচলিত হয়েছে, যত প্রকার ভাবে মানুষ ভগবানের উপাসনা করেছে, তার কোনটিও সম্পূর্ণভাবে প্রাণের পিপাসা মেটাতে না পারলেই লোকে নাস্তিক, সংশয়াত্মা হয়ে থাকে । আরও লক্ষ লক্ষ নূতন ধর্ম জগতে উপস্থিত হোক না কেন, মঙ্গল বই অমঙ্গল হবে না । আজ যারা সংশয় সন্দেহ নিয়ে মৃত্যুমুখে অগ্রসর হচ্ছে, তাদের শত শত লোক সেই সকল নূতন পথে তাদের মনের উপযোগী ধর্ম ও শান্তিলাভ করে কৃতাৰ্থ হবে । তোমার প্রকৃতি-উপযোগী ধর্ম তুমি গ্ৰহণ কর, আমাকেও আমার প্রকৃতি-উপযোগী ধৰ্ম নিতে দাও । বলবে, তবে তো লম্পট চোরও বলতে পারে, ‘আমাদের প্রকৃতি-উপযোগী ধৰ্ম আমাদের করতে দাও ।’ তা হলে সমাজের স্বাস্থ্য ও শান্তি থাকে কোথায় ? তারও উপায় আছে । ধর্ম ও অধৰ্ম পরীক্ষা করবার একমাত্র কষ্টিপাথর আছে - তাহা নিঃস্বার্থতা ।

যেখানে যত স্বার্থ, যত আপন শরীর-মন অপরের ব্যয়ে সুখে রাখবার চেষ্টা, সেখানে তত আঁধার, তত অধৰ্ম । আর যেখানে যত পরার্থ চেষ্টা, আপন শরীর-মনের ব্যয়ে অপর কাউকে সুখী করবার উদ্যম, সেখানে তত আলোক ও ধর্ম । অতঃপর স্বার্থজীবন দুষ্কৃতকারীদের আর ওকথা বলবার পথ কোথায় ? এই নিঃস্বার্থতাই যে সমস্ত নীতিস্বার্থের ভিত্তি, একটু ভেবে দেখলেই সে কথা বুঝতে পারা যায় । এই নিঃস্বার্থতার ধীর বিকাশেই মানব উচ্ছৃঙ্খলতা হতে নিয়মবন্ধনে এবং তার পূর্ণতায় নিয়মাতীত পরমহংসআ-অবস্থায় উপনীত হচ্ছে । আবার প্রত্যেক ব্যক্তির ন্যায় ব্যক্তিসমষ্টি সমাজ ও সমাজ-সমষ্টি ব্ৰহ্মাণ্ডও এই নিয়মে উন্নতির পরাকাষ্ঠার দিকে ছুটেছে ।


8.15) সমাজের আদর্শ



নিয়মের সম্পূর্ণ অভাব হতে নিয়ম এসে ব্যক্তি ও সমাজ-মন অধিকার করছে এবং নিয়মের পূর্ণত্ব আবার নিয়মাতীত অবস্থায় তাদের উত্তোলন করে শৈশবের বিবেকরহিত মূঢ়তাকে বার্ধক্যের বহুদৰ্শিতা এবং পরিশেষে যোগীর সংযমসহজাবস্থায় পরিণত করছে । সেইরূপ অনীতি, নীতি ও নীতির অতীতাবস্থা-রূপ সোপানআপরম্পরায় ব্যক্তি ও সমাজমন ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছে । বলতে পার, যুগারম্ভ হতে পৃথিবীতে কিয়ৎসংখ্যক ব্যক্তি ভিন্ন এখনও এমন কোনও একটি সমাজ দেখা যায়নি, যাতে সমাজাঙ্গ সমস্ত ব্যক্তিই এই আদর্শ অবস্থায় উপনীত হয়েছে । উত্তরে বলা যেতে পারে - মস্তক, হস্ত-পদাদির সমষ্টিতে যেমন এক অপূর্ণ ব্যক্তি, সেইরূপ ব্যক্তিসমূহের সমষ্টি সমাজকেও এক সুমহান্‌ শরীর ও মন-বিশিষ্ট ব্যক্তিবিশেষ বিবেচনা করা যেতে পারে । একটি যে নিয়মে চালিত ও পুষ্ট হয়ে উন্নত হতে থাকে, অপরটিও ঠিক সেই নিয়মে পুষ্ট ও বর্ধিত হয় । একটিকে যদি এই পরিপূর্ণ আদর্শ অবস্থায় উপনীত হতে দেখে থাক, অপরটিও কালে এই অবস্থায় এসে দাঁড়াবে, একথা কি এতই অসম্ভব বলে বোধ হয় ? সমাজের এই আদর্শ অবস্থা সকল কালেই চিন্তাশীল মনীষিগণ কল্পনায় চিত্রিত করেছেন । একেই সত্যকাল, সুবর্ণযুগ প্রভৃতি শব্দে অভিহিত করেছেন । পাশ্চাত্ত্য ক্রমবিকাশবাদী পণ্ডিত হারবার্ট স্পেন্সর, লে কন্ট, ফিষ্ক প্রমুখেরাও এটা বিজ্ঞানবিরোধী বা অযুক্তিকর বলে স্বীকার করেন ।


8.16) জ্ঞান ও ভক্তির লক্ষ্য এবং ইষ্টনিষ্ঠা



জ্ঞান ও ভক্তির দুটি পথমাত্র । একটি ‘সোহহং, সোহহং’ এবং অপরটি ‘নাহং, নাহং’ করে মানবকে সত্যস্বরূপে পৌঁছিয়ে দিচ্ছে । লক্ষ্য বস্তু যতদিন না লাভ হয়, ততদিন সাধকের নিকট উভয় পথ এবং পথের লক্ষ্যও ভিন্ন ভিন্ন বলে প্রতীত হয়ে থাকে । কিন্তু উদ্দেশ্য সিদ্ধ হলেই আর সাধকের নিকটে সে ভিন্নতা প্ৰতীত হয় না । তার বিশদ সাক্ষ্য বেদের ‘তত্ত্বমসি’, সুফীর ‘আনলহক্‌’, ও খ্ৰীষ্টের ‘আমি ও আমার পিতা এক’ । তার উজ্জ্বল প্ৰমাণ - ভক্তিপ্ৰাণা ব্ৰজগোপিকাদের ভক্তির উন্মত্ততায় শারদোৎফুল্লমল্লিকারজনীতে গহনকুঞ্জে শ্ৰীকৃষ্ণের লীলাভিনয় । তবে পথিক সাধকের আপন পথে নিষ্ঠা রাখা আবশ্যক । বাতাত্মজ, বীরাগ্রণী শ্ৰীরামদূতের ন্যায় তাঁর প্রাণ যেন নিরন্তর বলে
“শ্ৰীনাথে জানকীনাথে অভেদঃ পরমাত্মনি ৷
তথাপি মম সর্বস্বো রামঃ কমললোচনঃ ৷৷
অর্থাৎ জানি আমি, সেই এক পরমাত্মাই শ্ৰীনাথ ও জানকীনাথ উভয় রূপে প্ৰকাশিত, তথাপি কমললোচন রামই আমার সর্বস্ব ধন । পরমহংসদেব তাঁর সেই মধুর ভাষায় বলতেন, “ইষ্টনিষ্ঠা যেন গাছের গোড়ায় বেড়া দেওয়ার মতো । ছোট গাছের গোড়ায় বেড়া না দিলে লোকে মাড়িয়ে ফেলে; ছাগল-গরুতে মুড়িয়ে খায় । সেইজন্য বেড়াব বিশেষ প্রয়োজন । কিন্তু গাছ বড় হয়ে গুঁড়ি বাঁধলে আর বেড়ার দরকার নেই । তখন সে গাছের গুঁড়িতে হাতী বেঁধে রাখলেও আর তার কিছুই অপকার হয় না ।”


8.17) বেদান্ত কি ভগবান লাভের একটি পথমাত্র ?



তবে কি 'বেদান্ত’ ভগবানলাভের ভিন্ন ভিন্ন পথের একটি পথমাত্র ? ‘হাঁ’  এবং ‘না’ উভয়েই বটে । জনসমাজে, এমন কি পণ্ডিতসমাজেও একটা ধারণা হয়েছে, বেদান্ত ও অদ্বৈতবাদ একই কথা । ‘সোহহং সোহহং’ করে সেই দ্বৈতাদ্বৈতের অতীত সত্যলাভ করবার পথমাত্র বেদান্ত । একথা কিয়ৎ পরিমাণে সত্য হলেও সম্পূর্ণ সত্য নয় । ‘বেদান্ত’-অর্থে যদি বেদের শেষ উপনিষদভাগই বোঝা যায়, তা হলেও তো সেই ভাগে দ্বৈত, বিশিষ্টাদ্বৈত এবং অদ্বৈত - এ তিন মতের উপযোগী বচন পরম্পরা দেখতে পাওয়া যায় । অধিকারিভেদে উপদেশ করে বিশেষ বিশেষ স্থানে বেদ তো এ তিন মতেরই প্ৰাধান্য স্থাপন করেছেন বোঝা যায় । আবার 'বেদান্ত’-অর্থে যদি বেদের সার কথা বুঝতে হয়, তা হলে অদ্বৈতজ্ঞানেরও পারে অবস্থিত বস্তুকে লক্ষ্য করে বেদ অদ্বৈতমতই কেবল প্রচার করেছেন, একথা বলায় বেদে অসম্পূর্ণতা-দোষ উপস্থিত হয় । তবে এর মীমাংসা কোথায় ? মীমাংসা ঠিক এইখানে । বেদ বাক্যমনের অতীত বস্তুই উপদেশ করেছেন । কিন্তু আধ্যাত্মিক উন্নতির তারতম্যে মানুষের দ্বৈত, বিশিষ্টাদ্বৈত ও অদ্বৈত মত ক্ৰমশঃ এসে উপস্থিত হয় এবং সেই সোপানপরম্পরা অবলম্বন করে মানব কালে সেই পরিপূর্ণ আনন্দ-স্বরূপের উপলব্ধি করে । সোপানের প্রত্যেক অঙ্গটিই আবশ্যক । একটি না থাকলে অপরটিতে উঠা যায় না । সেইরূপ এ তিনটি মতই পরস্পরের সহায়-অবস্থাভেদে মানবের স্বয়ং এসে উপস্থিত হয় । দেশকালের সীমার মধ্যে নাম-রূপের রাজত্বে প্ৰাপ্ত যত কিছু সত্যের ন্যায় এই মতত্ৰয়ও অবস্থাভেদে সমান সত্য বলে প্ৰতীত হয় । এ তিন মতই বেদান্তের অন্তভূর্ত । জগতের যাবতীয় ধর্ম কি প্ৰণালীতে মানুষকে ধীরে ধীরে নামরূপের পারে নিয়ে উন্নতির চরম সোপানে পরম সত্য দর্শন ও উপলব্ধি করাচ্ছে - সেই প্ৰণালীনির্দেশই বেদের সার কথা এবং তা-ই বেদান্ত । এজন্যই বেদ ও বেদান্ত-জ্ঞান কোন বিশেষ পথ বা বিশেষ মত নয়, কিন্তু সমস্ত মতের—সমস্ত ধর্মের সারভূত বস্তু । এইজন্যই বেদান্ত সার্বভৌম দৰ্শন বলে সকলের শীর্ষস্থানীয় হয়েছে এবং ধর্মের প্রথম অঙ্কুর হতে শেষ পর্যন্ত উন্নতি-প্ৰণালী নির্দিষ্ট থাকায় বেদ ‘পুরুষনিঃশ্বসিতম্‌-ভগবানের সহিত নিত্যকাল বর্তমান ইত্যাদি হয়ে হিন্দুর চক্ষে নিত্যকাল মাননীয় হয়ে রয়েছে ।


8.18) জ্ঞান ছাড়লে ধর্মলাভ হয় না



বেদান্তের আর একটি কথা - জ্ঞান ছাড়লে ধর্মলাভ হবে না । ভক্তিশাস্ত্ৰে অহেতুকী ভক্তিই প্ৰধান ও উদ্দেশ্য বলে বর্ণিত থাকলেও জ্ঞান-মিশ্ৰা ভক্তিই যে তা লাভের উপায়, একথা পুনঃ পুনঃ বলা হয়েছে । ভক্তির প্রধানাচাৰ্য প্রমুখেরাও একথা বুঝিয়ে গিয়েছেন । চৈতন্যদেবও গোদাবরী-তীরে রায় রামানন্দের সহিত কথোপকথনের সময় একথা স্বীকার করেছেন । কিন্তু আজকাল অনেকেই জ্ঞানকে উপেক্ষা করে একেবারে অহেতুক ভক্তিলাভ করতে প্রয়াসী হন । বলা বাহুল্য যে, ইহা তাঁদের বাতুলের চেষ্টার ন্যায় কখনই অভীষ্ট ফল প্রদান করবে না ।


8.19) উপসংহার - আচাৰ্যদেবের উপদেশ



পরিশেষে সেই গঙ্গাবারিবিধৌত বিশাল উদ্যানে ‘সৌম্যাৎ সৌম্যতরা’ ‘শবশিবারূঢ়া’ মূর্তির তন্ময় সেবক, সেই মাধবীহার গ্রথিত চিরপরিণীত অশ্বত্থবটের নিবিড় আলিঙ্গননিবদ্ধ পঞ্চবটীতলস্থ তপস্যাজাগ্ৰত সাধনকুটীরে ধ্যানশীল বাল-স্বভাব, সরলতা, মাধুর্য ও তেজের অপূর্ব সম্মিলন আচাৰ্যদেব — যাঁর উপদেশের প্রতিপঙক্তিতে বেদ, বেদান্ত, দর্শনের নিগূঢ় ও জটিল সত্যসকল জীবন্ত ও জ্বলন্ত হয়ে হৃদয়ের সংশয় ছিন্ন করে সুকুমারমতি বালকেরও মর্মস্থল স্পর্শ করত - তাঁরই দু’চারটি কথা স্মরণ করে আমরা আজ উপসংহার করি ।
“ভক্ত হবি, কিন্তু তা হলে বোকা হবি কেন ? বোকা হলেই কি ভগবানে বেশী ভক্তি হবে ?”
“ভক্ত হোস, কিন্তু গোঁড়া বা একঘেয়ে হোস্‌নি । একঘেয়ে হওয়া অতি হীনবুদ্ধির কাজ ।”
“যত মত তত পথ । আপনার মতে নিষ্ঠা রাখিস, কিন্তু অপরের মতের দ্বেষ বা নিন্দা করিস্‌ না ।”


9) সাধনা ও সিদ্ধি



আমরা একটু স্থিরচিত্তে আলোচনা করলে দেখতে পাই যে, সমস্ত শাস্ত্ৰই এক কথা ও একই লক্ষ্য বলেছে । সব শাস্ত্রে একই কথা বটে, তবু একটু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বললে লোকের রুচিকর হয় । সাধনা ও সিদ্ধি সম্বন্ধে সেই শাস্ত্রেরই দু-চারটি কথা আজ আমরা একটু অন্যভাবে আলোচনা করব । সাধারণতঃ লোকে বলে, “যেমন সাধন, তেমনি সিদ্ধি” । শাস্ত্ৰেও আছে, “যাদৃশী ভাবনা যস্য সিদ্ধিৰ্ভবতি তাদৃশী” । যার যেমন ভাবনা, তার তেমনি সিদ্ধি হয় । সাধনা ও সিদ্ধির মধ্যে কার্যকারণগত নিত্য সম্বন্ধ সর্বদা বর্তমান । যিনি যে বিষয়ে চেষ্টা করবেন, তিনি তাতেই সিদ্ধ হবেন । আমাদের ধর্ম বক্তৃতা, অধ্যয়ন ও অধ্যাপনার জিনিস নয় - অনুভূতির জিনিস । অধিকারিভেদে ও মনের অবস্থানুসারে সাধনপ্রণালী অনেক হতে পারে এবং এইটিই ধর্মরাজ্যে নানা সম্প্রদায় হওয়ার কারণ ।

আমাদের দেশে যত ধৰ্মসম্প্রদায় আছে, তাদের বিশ্লেষণ করে দেখলে চার ভাগে বিভক্ত করা যেতে পারে । যথা – (i)জ্ঞানী, (ii)কর্মী, (iii)ভক্ত ও (iv)যোগী । যাঁরা সমস্ত বিষয় ও বিষয়-বাসনা পরিত্যাগ করে কেবল আত্মাতেই সন্তুষ্ট থাকেন, তাঁরা জ্ঞানপথ অবলম্বন করেন । আর যাঁরা সংসারে বিষয় ও বৈষয়িক কর্মের মধ্যে থেকে নিজেদের অল্প শক্তি প্ৰত্যক্ষ করে সর্বশক্তিমান ভগবানের শরণাপন্ন হন, তাঁরা ভক্ত । যাঁরা কর্ম করেন, তাঁরা কর্মী । আর এক দল লোক আছেন, যাঁরা একাগ্ৰতা সহায়ে মনের অন্তস্তল পর্যন্ত তন্ন তন্ন অনুসন্ধান করে সমস্ত বাসনাবীজ দূর করে দিতে চেষ্টা করেন, তাঁরা যোগী ।

আমাদের বাংলাদেশে ভক্তির চর্চাই অধিক । অন্যগুলি আমরা বুঝি না । আমরা নিজেদের অত্যন্ত দুর্বল বলে মনে করে থাকি, এটি আমাদের মহাদোষ । নিজেকে যতই দুর্বল ও পাপী মনে করব, ততই আমরা দুর্বল হয়ে থাকব । অহঙ্কার যেমন লোকের পতনের কারণ হয়, সেরূপ “আমি দুৰ্বল, আমি পাপী” - এ বিশ্বাসও মানবকে ধীরে ধীরে উত্থানশক্তিরহিত করে উন্নতিপথের অন্তরায় হয়; অতএব দুটিই পরিত্যাজ্য, একথা পরমহংসদেব বলতেন । কোন সময়ে তাঁকে একখানা বাইবেল পড়ে শুনান হয়েছিল । তাতে প্ৰথম হতেই কেবল পাপবাদের কথা । কতকটা শুনে ওতে কেবল পাপের কথা দেখে আর শুনতে অস্বীকার করলেন; তিনি বলতেন, “যেমন সাপে কামড়ালে বার বার বিষ নেই, বিষ নেই বলে রোগীর বিশ্বাস জন্মাতে পারলে সত্যই বিষ থাকে না, সেই রকম আমি ভগবানের নাম নিইছি, আমার পাপ নেই, বার বার একথা আপনাকে বলতে বলতে সত্যই পাপ থাকে না ।” আমি পাপী, আমি দুর্বল - এরূপ ভাব আমাদের ভেতর থেকে যত যাবে, ততই ভাল । সকল মানুষের মধ্যে সর্বশক্তিমান ভগবান বিদ্যমান । আমরা ভগবানের অংশ, ভগবানের ছেলে; আমরা আবার দুর্বল ? সেই অনন্ত শক্তিমান ভগবান থেকে আমাদের শক্তি আসছে; আমরা আবার পাপী ? অতএব সর্বাপেক্ষা অধিক পাপ হচ্ছে - নিজেকে পাপী ও দুর্বল মনে করা । এ অবিশ্বাসী নাস্তিকের কাজ । যদি কিছু বিশ্বাস করতে হয়, তবে এই বিশ্বাস করা যে, তোমরা তাঁর ছেলে, তাঁর অংশ, তাঁর অনন্ত শক্তি ও অপার আনন্দের অধিকারী । বিশ্বাস কর যে, তোমার শরীর ও মন হচ্ছে পবিত্র দেবমন্দির, যেখানে শুদ্ধ-বুদ্ধ-মুক্ত-স্বভাব ভগবান চিরপ্রতিষ্ঠিত । বিশ্বাস কর যে, প্ৰত্যেক নরনারীর মধ্যে তিনি, বৃক্ষলতায় তিনি, জড়চেতনে তিনি, সমগ্ৰ ব্ৰহ্মাণ্ডে তিনি ভিন্ন আর কেউ নেই । আকাশের নীলিমায়, সমুদ্রের তরঙ্গভঙ্গে, নারীর মুখচ্ছায়ায়, বালকের সরলতায়, শ্মশানের করালতায় এবং যোগীর নিস্পন্দতায় তাঁরই প্ৰকাশ দেখতে চেষ্টা কর । এই চেষ্টাই যে একপ্রকার সাধন ।

গীতার ১০ম অধ্যায়ে আমরা এই ভাবটি স্পষ্ট দেখতে পাই । অর্জুন ভগবানকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে, ইন্দ্ৰিয়াদি কামকাঞ্চনমোহিত, তাদের আকর্ষণে মানুষ রূপরসাদির পশ্চাৎ গমন করছে, অথচ আমরণ মানবকে জগতের ব্যাপার নিয়েই থাকতে হবে; অতএব তার বাঁচবার উপায় কি ? ভগবান উত্তর করেন -
যদ্‌ যদ্বিভূতিমৎ সত্ত্বং শ্ৰীমদূর্জিতমেব বা ৷
তত্তদেবাবগচ্ছ ত্বং মম তেজাহাংশসম্ভবম্ ৷৷
অর্থাৎ যা কিছু শ্রেষ্ঠ ও সুন্দর, তা আমারই তেজের অংশ । চন্দ্ৰ, সূৰ্য, পশু, পক্ষী ও জগদ্‌বিমোহিনী স্ত্রীমূর্তিতে যা কিছু সৌন্দৰ্য দেখতে পাও, সমস্তই তাঁর তেজের অংশ । তাঁর জ্যোতি এই সকল মূর্তির মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে । মানুষ বাস্তবিক এদের প্রকৃত স্বরূপ অবধারণ করতে পারে না বলেই বিষয়ে আকৃষ্ট হচ্ছে । ভগবান গীতায় আবার বলেছেন -
অথবা বহুনৈতেন কিং জ্ঞাতেন তবার্জুন ৷
বিষ্টভ্যাহমিদং কৃৎস্নমেকাংশেন স্থিতো জগৎ ॥
অর্থাৎ হে অর্জুন, আমার বিভূতির বিষয় আর কত বলব, আমিই একাংশে এই ব্ৰহ্মাণ্ড হয়ে রয়েছি । ভগবান শ্ৰীকৃষ্ণের এই অমৃতময়ী বাণীই কি আমাদের বলছে না যে, আপনাকে এবং অপরকে পাপী বলে ধারণা করতে নেই ? এতেই কি আমাদের শেখাচ্ছে না যে, মানুষকে দেবতা বলে, ভগবানের সাক্ষাৎ মূর্তি বলে ধারণা করা ? নিজেরা এইটি শেখ এবং সন্তানসন্ততি ও প্রতিবেশী সকলকে শেখাও । আমরা মুখে বলছি এক, কাজে করছি আর এক । মন মুখ এক না করতে পারলে সমস্ত রাত্রি হরি হরিই কর অথবা সমিতিই কর, কিছুতেই কিছু হবে না । এই তো দেখছি, ঘরে ঘরে হরিসভার ধুম অথচ কিছুদিন পরে আর কেউ আসতে চায় না ।

এর কারণ কি ? কারণ এই - আমাদের মন মুখ এক নেই । ধর্মের প্রথম সাধন হচ্ছে, মন মুখ এক করা । পরমহংসদেব বলতেন, “মন মুখ এক করাই প্রধান সাধন ।” মন মুখ এক করেছে, এরূপ লোক কোথায় ? হাজারটা খুঁজলে কটা পাওয়া যায় ? প্রত্যেক কাজেই দেখছি মনে এক, মুখে আর । অতি সামান্য একটি কাজ করতে পারিনি, বড় কাজ করতে দৌড়ুই । সম্মুখে পিপাসার্তকে একটু জল দিতে পারিনি, অথচ সমিতি করে সকলকে হরিপ্রেমে মাতোয়ারা অথবা সমস্ত অভাব দূর করে দেশোদ্ধার করতে যাই । মন ও মুখের বিপরীত গতির দৃষ্টান্ত দেখুন । চণ্ডীতে আছে - “বিদ্যাঃ সমস্তাস্তব দেবি ভেদাঃ ৷ স্ক্রিয়ঃ সমস্তাঃ সকলা জগৎসু ॥” - হে দেবি, যত কিছু বিদ্যা আছে, তা তোমারই শক্তির প্রকাশমাত্র, আর জগতের যত স্ত্রীমূর্তি আছে, তোমারই মূর্তি ।” আমরা সকলেই চণ্ডীপাঠ করছি, কিন্তু আমাদের মধ্যে কজন আছেন যিনি স্ত্রীলোককে দেবীর প্রতিমা বলে দেখছেন ? কত লোক একদিকে চণ্ডীপাঠ করেন, আবার পাঠান্তে সামান্য কারণে স্ত্রীকে প্ৰহার পর্যন্ত করতে সঙ্কুচিত হন না । স্ত্রীলোককে দেবীর মূর্তি বলে সম্মান ও পূজা করার পরিবর্তে তাদের সন্তানপ্রসব ও রন্ধনাদি করবার যন্ত্রবিশেষমাত্র ধারণা করে রেখেছেন ।

বৈদিক যুগে কত স্ত্রীলোক ঋষি ছিলেন । বৃহদারণ্যক উপনিষদে দেখতে পাই, জনক রাজার সভায় গার্গী নাম্নী জনৈকা সন্ন্যাসিনী মহর্ষি ষাজ্ঞবল্ক্যকে ধৰ্মসম্বন্ধীয় কত গভীর প্রশ্ন করছেন । লীলা, খনা প্রভৃতি আরও কত বিদুষী স্ত্রীর কথা আমাদের সকলেরই জানা আছে ।

অল্পদিনের কথা, অহল্যাবাঈ-এর অদ্ভুত জীবন অনেকেই জানেন । তিনি নিজেই রাজ্যশাসন করতেন । প্ৰত্যেক বড় বড় তীর্থে তাঁর কীর্তি অদ্যাপি বর্তমান । এমন কি পাহাড়ের বিজন প্রদেশে পর্যন্ত তীর্থযাত্রীদের সুবিধার জন্য তাঁর নির্মিত রাস্তা অদ্যাপি তাঁর পরিচয় দিচ্ছে । যাদের মধ্যে জগজ্জননীর অপূর্ব শক্তি নিহিত, তাদের আমরা দাসী মাত্র করে রেখেছি ! কেবল পূজাদির সময় দুই একবার বলে থাকি মাত্র যে, সমস্ত স্ত্রীলোকই মা ভগবতীর মূর্তি ।

আরও দেখুন, আমাদের শাস্ত্ৰে আছে এবং আমরা বলেও থাকি যে, সকল মানুষই নারায়ণের মূর্তি । কিন্তু কার্যতঃ কি করি ? একজন মেথর বা নীচজাতীয় ব্যক্তিকে দেখলে অমনি তাকে ছাগল-গরু অপেক্ষাও বেশী ঘৃণা করতে সঙ্কুচিত হই না । মানুষের চেয়ে গরুর সম্মান যারা অধিক করে থাকে, তাদের বুদ্ধি-ধারণা আর কত দূর অগ্রসর হবে ? শাস্ত্রে বিশ্বাস করলে, আমাদের কর্তব্য - নিজেকে কখনও দুর্বল মনে না করা এবং অপরকে নারায়ণ জ্ঞানে পূজা করা । আমাদের ভাবা উচিত যে, আমরা তাঁর অংশ, তাঁর ছেলে; আমাদের এই শরীর এবং সমস্ত শরীরই তাঁর মন্দির । যেমন হিমালয় থেকে গঙ্গার সমস্ত জলরাশি আসছে, তেমনি সর্বশক্তিমান ভগবান থেকে আমাদের সমস্ত শক্তি আসছে । এই দৃঢ় বিশ্বাস থাকলে ক্ৰমে উঠতে পারব । জগতে যেখানেই জ্ঞানের চর্চা হয়েছে, সেখানেই লোকে বুঝেছে যে, মানুষের মধ্যে অনন্ত শক্তি রয়েছে। অনেক সময় সৎকার্যের উদ্যম করতে বা পরোপকারের কোনরূপ চেষ্টা করতে বললে উত্তর পাওয়া যায় - আমাদের টাকা কোথায় ? টাকা না থাকলে কি কোন কাজ হয় ? আরে নির্বোধ ! বল যে আমাদের মনুষ্যত্ব নেই, মানুষ হলে টাকা যে তার পায়ের কাছে আপনি এসে পড়বে । টাকায় কখনও মানুষ করে না, কিন্তু মানুষই টাকা উপার্জন করে । আজ থেকে সমস্ত দুর্বলতা ফেলে দিয়ে মানুষ হতে চেষ্টা কর । নিজেকে দুর্বল ভাবলে অন্তর্নিহিত ভগবৎশক্তি বিকাশ না হয়ে সঙ্কুচিত হয়ে যাবে । বিশ্বাস কর যে, তোমাদের মধ্যে অনন্ত শক্তি রয়েছে, সুকর্ম ও সুচিন্তা দ্বারা সেই শক্তির বিকাশ কর ।

অতএব আমাদের প্রথম সাধন - নিজেকে দুর্বল না ভাবা এবং সর্বপ্রকার দুর্বলতার হাত থেকে আপনাকে সর্বতোভাবে রক্ষা করা । দ্বিতীয় সাধন - মন মুখ এক করা । গীতায়ও বিশেষ বিশেষ অধিকারীর জন্য বিশেষ বিশেষ সাধনার উপদেশ করবার পূর্বে সর্বাবস্থায় সকলেরই প্রয়োজনীয় এই দুই সাধনার উপদেশ দেখতে পাই ।

যুদ্ধক্ষেত্রে বিপক্ষ সৈন্যদলে আত্মীয়-স্বজন ও ভীষ্ম, দ্ৰোণ প্ৰভৃতি প্ৰতিদ্বন্দ্বী দেখে অর্জুনের মনে যুগপৎ শোক, দুঃখ, মোহ ও ভয় উপস্থিত হয়েছিল । কিন্তু ভয়, মোহ প্রভৃতি ভাব লুকিয়ে শ্ৰীকৃষ্ণকে বলছেন যে, সামান্য রাজ্যের জন্য আত্মীয়-স্বজনদিগকে হিংসা করা অপেক্ষা ভিক্ষান্নে জীবনধারণও শ্ৰেয়ঃ । পূর্বে ক্ষত্রীয়ধর্মানুসারে অন্যায়অত্যাচারের বিরুদ্ধে কর্তব্যবোধে যুদ্ধ করতে এসেছিলেন; কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে আত্মীয়-স্বজন ও মহাবীরগণকে প্ৰতিদ্বন্দ্বী দেখে মোহ ও ভয়বশতঃ সেই কর্তব্য ভুলে গিয়ে মুখে ধর্মভানে নানাপ্রকার অসম্বন্ধ বাক্য বলছেন । কিন্তু কার কাছে মনের ভাব লুকুবেন ? ভগবান অন্তর্যামী । তিনি বললেন -
ক্লৈব্যং মাস্ম গমঃ পাৰ্থ নৈতত্ত্বয্যুপপদ্যতে ৷
ক্ষুদ্রং হৃদয়দৌর্বল্যং ত্যক্ত্বোত্তিষ্ঠ পরন্তপ ৷৷
অর্থাৎ হে অর্জুন, তোমার মত লোকের তো এরূপ দুর্বলতা সাজে না । তুমি হৃদয়ের দুর্বলতা ত্যাগ করে ওঠ । দুর্বলতা হতে যত নীচতা আসে; ইহাই পাপের খনি । কেবল অর্থকরী বিদ্যা দ্বারা কি হবে ? যাতে আবালবৃদ্ধবনিতার শরীর ও মন সবল হয়, তার যত্ন করাই প্ৰকৃত শিক্ষা ।

পূর্বেই বলেছি যে, ধর্মলাভ করবার চারটি পন্থা । বিচার করে দেখলে দেখা যায় যে, এই চারটি মানবকে এক স্থানেই নিয়ে যায় । বেদ, পুরাণ, তন্ত্র প্রভৃতি পড়লে ইহাই দেখা যায় যে, উদ্দেশ্য এক, কিন্তু উহা লাভ করবার নানা পথ এবং যত পথ, তত মত । আমাদের প্রতিদিন-পাঠ্য মহিম্নঃস্তবে এই ভাব শ্লোকে নিবদ্ধ আছে -
ত্ৰিয়ী সাংখ্যং যোগঃ পশুপতিমতং বৈষ্ণবমিতি
প্ৰভিন্নে প্ৰস্থানে পরমিদমদঃ পথ্যমিতি চ ৷
রুচীনাং বৈচিত্র্যাদৃজুকুটিলনানাপথজুষাং
নৃণামেকো গম্যস্ত্বমসি পয়সামর্ণব ইব ॥
অর্থাৎ হে ভগবান । বেদ, সাংখ্য, যোগ, শৈব, বৈষ্ণব প্রভৃতি মতগুলি বিভিন্ন হলেও তোমাতে যাবার এক একটি পথমাত্র । লোকের রুচি-অনুসারে সরল ও জটিল যে পথই অবলম্বন করুক না কেন, তুমিই সকলের গম্যস্থান । পরমহংসদেব বলতেন, “যেমন কালীঘাট যাওয়ার বহু পথ, সেইরূপ নানা মত ভগবানে যাওয়ায় এক একটি পথমাত্র ।” ভিন্ন ভিন্ন সংস্কারাপন্ন লোকের জন্য ভিন্ন ভিন্ন মত ও সাধনপ্রণালী শাস্ত্রে নিবদ্ধ আছে । সেইজন্য ভিন্ন ভিন্ন মত আপাতবিরোধী হলেও বাস্তবিক তাদের মধ্যে কোন বিরোধ নেই । কারণ গম্যস্থান বা লক্ষ্য একই ।

সাধনা-শব্দের অর্থ ভগবৎপাদপদ্ম-দৰ্শনে পূর্ণমনস্কাম মহাপুরুষগণের যে প্রকার অবস্থা বা অনুভূতি হয়, তাই আপনাতে আনবার বা তাদের মত হবার জন্য চেষ্টা করা । সিদ্ধ পুরুষের লক্ষণ ভগবান গীতায় বলেছেন -
প্ৰজহাতি যদা কামান্‌ সর্বান্‌ পার্থ মনোগতান্‌ ৷
আত্মন্যেবাত্মনা তুষ্টঃ স্থিতপ্ৰজ্ঞস্তদোচ্যতে ৷৷
অর্থাৎ মনোগত সমস্ত কামনা ত্যাগ করে যিনি আত্মা বা ভগবানমাত্র নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে পারেন, সুখ-দুঃখ বা শরীরমনের নানাপ্রকার নিত্য পরিবর্তন যাঁকে বিচলিত করতে পারে না, তিনিই স্থিরবুদ্ধি ও মুক্ত । যেমন নিঃশ্বাস-প্ৰশ্বাস ফেলতে আমাদের কোন কষ্ট হয় না, সেইরূপ তাঁদের কামকাঞ্চন-ত্যাগ স্বতঃই হয়ে থাকে । তাঁদের শরীর ও ইন্দ্ৰিয়াদি এমন ভাবে গঠিত হয়ে গেছে যে, তাঁহাদিগকে আর বিপথে চলতে দেয় না । সিদ্ধপুরুষের লক্ষণ বা সিদ্ধিসম্বন্ধে আমাদের অধিক বলবার দরকার নেই, কারণ এখনও আমরা সিদ্ধিলাভের অনেক দূরে রয়েছি । আমাদের প্রয়োজন এখন, যত প্রকার সাধনা দ্বারা বা উপায়ে ভগবান লাভ করা যায়, তা জানা এবং তার মধ্যে বিশেষ একটি নিয়ে নিজ জীবন গঠন করা ।

পূর্বে শাস্ত্রীয় সত্য যাতে সাধারণে না পড়তে পায়, এই ভাবে লুকিয়ে রাখা হতো । এতে পুরোহিতের আধিপত্য অটুট রাইল, কিন্তু জাতীয় জীবন বিদ্যাহীন হয়ে অনেক নীচে পড়ে গেল । পুরোহিত তাঁর ঈদৃশ কার্যের কারণ দেখালেন যে, অধিকারী হবার পূর্বে মানুষকে সকল সত্য বললে অনেক সময় না বুঝে উল্টো উৎপত্তি হয়ে থাকে, যেমন বেদান্ত ঠিক না বুঝলে অনেক সময় নাস্তিক্য এসে মানুষকে অধিক বিষপরায়ণ করে থাকে । এ কথার উত্তরে বলা যেতে পারে, তোমার যখন অধিকারী চেনবার শক্তি নেই, তখন সকলকেই পড়বার ও আলোচনা করবার ক্ষমতা দাও । সে নিজেই তার উপযোগী পথ বেছে নেবে । আজকাল সমস্ত শাস্ত্র মুদ্রিত হচ্ছে, এ সময় লুকোবার চেষ্টাই বৃথা ।

আমরা এখন দেখবো জ্ঞানী, ভক্ত, যোগী ও কর্মী - এই চার প্রকার সাধকেরা কোন্‌ কোন্‌ প্রধান সাধনসহায়ে চরমে একই স্থানে উপস্থিত হন । জ্ঞানী সদসদ্‌বিচার করে অনিত্য বিষয়বাসনা পরিত্যাগপূর্বক আপনার ভেতর নিত্য বস্তু কোনটি, তার অন্বেষণে নিযুক্ত থাকেন এবং সেই বস্তুকেই প্ৰকৃত, ‘আমি’ বলে নির্দেশ করেন । শরীরমনে আবদ্ধ, বিষয়বাসনাযুক্ত ক্ষুদ্র আমিত্বের বিনাশ করে এই মহান আমি হয়ে যাওয়াই তাঁর লক্ষ্য । জ্ঞানীর সাধনা ‘নেতি নেতি’-বিচার এবং স্ব-স্বরূপের ধ্যান । জ্ঞানী বলেন, বিচারে অনিত্য বলে যা কিছু সিদ্ধান্ত হবে, তা তৎক্ষণাৎ পরিত্যাগ কর । এইরূপে দেখবে, শরীর মন প্রভৃতি কোনটিই নিত্য নয়, এই সকলের চিন্তাবাসনা দূর করে দিতে পারলে নিত্যবস্তু আত্মার সাক্ষাৎকার এবং তাঁতে অবস্থান । আবার একবার তাঁতে অবস্থান করতে পারলেই দেখবে, সুর্যের সহিত সূর্যরশ্মির ন্যায় লীলা নিত্যের সহিত চিরসম্বন্ধে গ্রথিত । সেইজন্যই জ্ঞানী বলেন, জগতে যা কিছু দেখতে পাই, সমস্তই আত্মার বিকাশ, আত্মা-মাত্র এবং ‘আমি’ সেই আত্মা ! এইটি সর্বদা মনে জাগরুক রাখাই জ্ঞানীর প্রধান সাধন ।

যোগী বলেন যে, মনুষ্য জন্মে জন্মে বিষয়ের সহিত আপনাকে একীভূত করে কতকগুলি সংস্কারের বশীভূত হয়ে পড়ে এবং সেজন্য কতই না কষ্ট পেয়ে থাকে । কিছুতেই আর আপনাকে তাদের হাত থেকে ছাড়াতে পারে না । যোগী ছাড়াবাব উপায়-সম্বন্ধে বলেন - স্থির হয়ে বস, আপনাকে ভুলে কোন চিন্তার পশ্চাৎ যেও না, মনকে চিন্তা করতে দাও এবং তুমি সাক্ষিস্বরূপ হয়ে স্থিরভাবে মনের তরঙ্গভঙ্গ দেখতে থাক । পরে মনকে কোন এক বস্তুবিশেষে নিবদ্ধ করে তাতেই একাগ্র কর । এই একাগ্রতাই সংস্কারবীজ দগ্ধ করে সত্য প্ৰকাশ করে দেবে । যথার্থ একাগ্ৰতা আসলেই তৎক্ষণাৎ আত্মদর্শন । অতএব দেখা গেল, যোগীর প্রধান সাধন-সর্বাবস্থায় আপনাকে সাক্ষিস্বরূপ ধারণা করা এবং মনকে কোন এক বিষয়ে সম্পূর্ণ একাগ্র করা ।

ভক্ত বলেন, ভগবানে আপনাকে সম্পূর্ণ ফেলে দাও, তাঁর সঙ্গে কোনও এক বিশেষ সম্বন্ধ স্থাপন কর । পিতা, মাতা, সখা, প্ৰভু, স্বামী প্রভৃতি যে-কোন সম্বন্ধ তোমার ভাল লাগে, সেই সম্বন্ধ স্থাপন কর । শরীর, মন, স্ত্রী, পুত্র যা-কিছু তোমার আছে, সমস্ত তাঁকে অৰ্পণ কর । এখন প্রশ্ন হতে পারে যে, যাঁকে দেখতে পাই না, তাঁর সঙ্গে কিরূপে সম্বন্ধ স্থাপন করব ? উত্তরে বলা যেতে পারে যে, যাঁর কাছে গেলে তুমি প্ৰাণে শান্তি পাও, তাঁকেই মানুষবোধ না করে ভগবানবোধে পূজা কর । তা হলেই ভগবানের সঙ্গে সেই সম্বন্ধ ক্ৰমে ক্ৰমে স্থাপিত হবে ।

পরমহংসদেবকে একদিন জনৈক স্ত্রীলোক জিজ্ঞাসা করেন যে, মন কিছুতেই স্থির হয় না, কেবল ভ্রাতুষ্পুত্রের চিন্তা মনে আসে । তিনি উত্তরে বলেন, “তাকেই ভগবানবোধে চিন্তা ও সেবা কর ।” কিছুদিন এইরূপ করাতে স্ত্রীলোকটির মন সমাধিস্থ হয় । তাঁর সঙ্গে যতদিন না কোন বিশেষ সম্বন্ধ হবে, ততদিন তাঁকে আপনার বলে বোধ হবে না এবং ভালবাসা জমবে না; রামপ্রসাদ বলেছেন -
সে যে ভাবের বিষয় ভাব ব্যতীত অভাবে কি ধরতে পারে ।
হলে ভাবের উদয়, লয় সে যেমন, লোহাকে চুম্বকে ধরে ।।
তাঁর উপর সম্পূর্ণ নির্ভর করলে, একেবারে তাঁর হয়ে গেলে স্বাৰ্থপূর্ণ আমিত্ব বিনষ্ট হয়ে তৎক্ষণাৎ আত্মদর্শন আসবে ।

কর্মী বলেন, ভগবানের জন্য কর্ম কর, ফল তাতেই অৰ্পণ কর । স্বার্থের জন্য কর্ম করো না; স্বাৰ্থই মৃত্যু । সর্বদা কর্ম কর, কিন্তু কৰ্মফলে আসক্ত হয়ে না । পূজা ও সাধনাস্বরূপ কৰ্ম কর । ধন, মান, যশের জন্য করো না । সেই বিরাট পুরুষের সেবার জন্য কর্ম কর । তিনিই নানারূপে জগতে খেলা করছেন । তোমাদ্বারা তাঁর একটু সেবা হলে আপনাকে ধন্য মনে কর । এই প্রকারে কর্ম করলে যে ক্ৰমে স্বার্থনাশ ও আত্মপ্ৰকাশ উপস্থিত হবে, একথা আর বলতে হবে না ।

চার শ্রেণীর লোকের জন্য চার রকম সাধনা নির্দেশ করা হয়েছে; কিন্তু উদ্দেশ্য একই - স্বার্থপর আমিত্বের বিনাশ করা । ভেবে দেখলে এদের মধ্যে বিবাদ কেবল কথার মাত্র । বাস্তবিক কোন বিবাদ নেই, স্বার্থপর আমিত্ব গেলেই মুক্তি । পরমহংসদেব বলতেন, “মুক্তি হবে কবে, আমি যাবে যবে;” “পাশবদ্ধ জীব, পাশমুক্ত শিব ।” যখন অবিদ্যার ‘আমি’ যাবে, তখনই শিবত্বপ্রাপ্তি ও মুক্তি । পরমহংসদেব বলতেন, “যেমন জলকে নানা লোকে নানা নামে বলে, সেই রকম এক ভগবানকেই নানা নামে লোকে ডাকে ।”

এইগুলিই প্রধান প্ৰধান সাধনার কথা । জীবনগঠনে এবং লক্ষ্যে পৌঁছবার জন্য এদের বিশেষ প্রয়োজন । মন-মুখ এক করে যার যেটি ইচ্ছা গ্ৰহণ করা এবং আজ থেকে নিজ জীবনগঠনে কৃতসঙ্কল্প হও । আর যা কিছু দরকার তিনিই সব এনে দেবেন ।
সর্বধর্মান্‌ পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্ৰজ ৷
অহং ত্বাং সর্বপাপেভ্যো মোক্ষয়িষ্যামি মা শুচঃ ৷৷
- মন-মুখ এক করে তাঁর শরণাপন্ন হলে দুর্বলতা পাপ কিছুই থাকতে পারে না । তিনি সব থেকে রক্ষা করেন । ভগবানের নিকট এই প্রার্থনা যে, তাঁর নামের জোরে আমাদের সকল দুর্বলতা ও পাপ চিরকালের মত দূর হয়েছে, এই বিশ্বাসটি যেন আজ থেকে আমাদের সকলের হয় ।
ওঁ শান্তিঃ ! শান্তিঃ !! শান্তিঃ !!!
[কোন্নগর হরিসভায় প্রদত্ত বক্তৃতার সারাংশ]


10) বেদ-কথা


এই সভাতে বেদাদি-সম্বন্ধে যে-সকল কথা বলা হবে, তা কথাবার্তাচ্ছলে বলব, বক্তৃতার ভাষায় বললে বক্তা ও শ্রোতার মধ্যে দূরত্ব-অনুভব হবে । আমরা ভাবব, আমরা সকলে একসঙ্গে ধর্মশিক্ষা করতে এখানে একত্র হয়েছি এবং পরস্পরের সন্দেহসকল প্রশ্নদ্বারা বিচারপূর্বক মীমাংসা করে সত্যলাভ করব । মহাপুরুষের ধর্মজীবন আলোচনা করে দেখলে বেদোক্ত ধর্মাদির সহজে উপলব্ধি হয়, সেইজন্য উহাও আমাদের আলোচ্য হবে । আবার অন্যান্য মহাপুরুষদিগের অস্তিত্ব অথবা পুরাণনিবদ্ধ চরিত্রসম্বন্ধে সন্দেহ থাকলেও শ্ৰীরামকৃষ্ণ-জীবন ঐ রূপ হতে পারে নাদ; কারণ আমরা তাঁকে প্ৰত্যক্ষ দেখেছি । অতএব তাঁর চরিত্রে বেদান্তোক্ত ধর্ম কিরূপে কিভাবে প্ৰকাশিত ছিল, তাও সঙ্গে সঙ্গে আলোচনা করব । প্ৰথমে বৃহদারণ্যক উপনিষদ হতে কিছু পাঠ করি -

এক সময়ে মিথিলার রাজা জনকবিদেহ এক যজ্ঞ করেছিলেন; এই মিথিলা-রাজবংশের কোন রাজা ব্ৰহ্মজ্ঞান লাভ করাতে, তাঁদের বংশের উপাধি 'বিদেহ’ হয়েছিল । এই যজ্ঞে অনেক বেদজ্ঞ ব্ৰাহ্মণ উপস্থিত ছিলেন । রাজা জনক এক সহস্ৰ গাভী দক্ষিণা দেবেন মনস্থ করে তাদের শৃঙ্গ স্বর্ণদ্বারা মুড়িয়ে দিয়ে বললেন, “আপনাদিগের মধ্যে যিনি শ্রেষ্ঠ, তিনিই এই গাভী গ্ৰহণ করুন ।” কেহই অগ্রসর হলেন না । কাকেও অগ্রসর হতে না দেখে অবশেষে যাজ্ঞবল্ক্য ঋষি স্বীয় শিষ্যদিগকে বললেন, “তোমরা এই গাভীসকল আমার নিমিত্ত গ্ৰহণ কর ।” একথা শুনে অন্যান্য ব্ৰাহ্মণেরা বললেন, “ইনি আমাদের অপেক্ষা কিসে শ্রেষ্ঠ, তা বিচার করা যাক, আমাদের অপেক্ষা যদি ইনি কিছু অধিক জানেন, তা হলে এঁকে গাভী দেওয়া যাবে ।” এইরূপ স্থির হলে গার্গীনাম্নী একটি স্ত্রীলোক সভায় দণ্ডায়মানা হয়ে যাজ্ঞবল্ক্যকে প্রশ্ন করতে লাগলেন । নানা বিষয়ের যথাযথ উত্তর করে যাজ্ঞবল্ক্য তাকে নিরস্ত হতে বললেন ও অন্যান্য ব্ৰাহ্মণগণের সহিত বিচার আরম্ভ করলেন । অবশেষে গাৰ্গী আবার বললেন, “আমি আর দুটি প্রশ্ন করতে চাই। যদি যাজ্ঞবল্ক্য তার উত্তর দিতে পারেন,তাহলে বুঝব এঁকে কেউ পরাস্ত করতে পারবেন না । প্ৰথম, কার দ্বারা এই সমস্ত বস্তু ব্যাপ্ত হয়ে আছে এবং দ্বিতীয়, তিনি কে ?” যাজ্ঞবল্ক্য ঐ দুই প্রশ্নের উত্তর করলে গাৰ্গী বললেন, “হে ব্ৰাহ্মণগণ, আপনারা এঁকে পরাস্ত করতে পারবেন না; কারণ ইনি ব্ৰহ্মকে জেনেছেন এবং এঁর জানিবার আর কিছুই অবশিষ্ট নেই ।”

দেখা গেল, বেদোক্ত ব্ৰহ্মকে জানলে লোকে সর্বজ্ঞ হয় । এখন দেখা যাক, বেদ কাকে বলে । বেদ অর্থে জ্ঞান; যে জ্ঞান লাভ হলে জগতের সমস্ত বিষয় জানতে পারা যায়; যেমন মৃত্তিকা কি, জানলে মৃত্তিকার বিকারপ্রসূত সরা, খুরি ইত্যাদি সমস্ত পদার্থকেই জানতে পারা যায়, সেইরূপ যে বস্তুকে জানতে পারলে সৃষ্টির অন্তর্গত সমস্ত পদার্থকে জানতে পারা যায়, আর কিছুই জানিবার বাকি থাকে না, সেই জ্ঞানই বেদ । এই জ্ঞানলাভের অধিকারী কে ? বেদের অধিকারী কে ? শাস্ত্রে কেবল দ্বিজমাত্ৰকেই অধিকারী বলে নির্দেশ করেছেন । গীতা ও মহাভারতাদি শাস্ত্ৰে এই দ্বিজত্ব গুণগত এবং জাতিগত উভয় প্রকারেই প্ৰকাশিত হয় বলে বর্ণনা করা হয়েছে । শঙ্করাচাৰ্য প্রভৃতি এইরূপই নির্দেশ করেছেন; কারণ পিতার গুণ সহজে পুত্রে সংক্রমিত হয়, এইজন্য গুণ ক্রমে জাতিগত হয়ে পড়ে, কিন্তু বহু প্ৰাচীনকালে দ্বিজত্ব কেবল গুণগত ছিল বলে বোধ হয় । সত্যকাম জাবালির উপাখ্যান উহার প্রমাণ । সত্যকাম বেদপাঠের নিমিত্ত উপস্থিত হলে তাঁর গুরু তাঁর পিতার নাম জিজ্ঞাসা করেন, সত্যকাম পিতার নাম বলতে পারলেন না । তিনি মাতার নিকট এসে জিজ্ঞাসা করাতে মাতা বললেন, তিনি যৌবনে একে একে অনেককে পতিরূপে বরণ করেছিলেন; অতএব সত্যকাম কার ঔরসজাত, তা তিনি জানেন না । সত্যকাম গুরুকে এসে তাই বললেন । গুরু বললেন, “ঘৃণিত ও নিন্দিত হবার সম্ভাবনা দেখেও আপনার ঐরূপ জন্মবৃত্তান্ত যে জিজ্ঞাসিত হয়ে সর্বসমক্ষে এরূপ অকপটে বলতে পারে, সে মহা সত্যনিষ্ঠ এবং সত্যনিষ্ঠাই ব্ৰাহ্মণের প্রধান গুণ, অতএব তোমাতে ব্ৰাহ্মণের লক্ষণ দেখছি, তোমাকে আমি বেদপাঠ করাব ।” এই কথা বলে তাঁকে উপবীত প্ৰদান করে বেদাভ্যাস করালেন । এই সত্যকামই পরে একজন প্ৰবীন আচাৰ্য হয়েছিলেন ।

ব্ৰাহ্মণত্ব কেবল জাতিগত হয়ে পড়েছে । গুণ থাক আর নাই থাক, ব্ৰাহ্মণের ছেলে ব্ৰাহ্মণ হবে, কিন্তু বৈদিক সময়ে গুণের দ্বারাই ব্ৰাহ্মণত্বের নির্দেশ হত । এই শাস্ত্রদৃষ্টি দ্বারা আমরা বেদের অধিকারী বলে ব্ৰাহ্মণত্বগুণসম্পন্ন ব্যক্তিকে স্থির করব । যাঁতে ব্ৰাহ্মণের গুণ আছে, তিনিই বেদপাঠের অধিকারী । আবার বেদমধ্যে দেখা যে, সকলকেই বেদোক্ত ধর্মের উপদেশ দিতে ব্যবস্থা আছে । শাস্ত্ৰমতে এই বেদ অনাদি, ইহা জ্ঞানরূপে ব্ৰহ্মের সহিত অনাদিকাল স্থিত । যখন এই বেদোক্ত, বিশেষতঃ উপনিষদুক্ত জ্ঞান কারও অন্তরে প্রকাশিত হয়, তখন তিনি ইহার আবিষ্কারক ঋষিমাত্র বলে বর্ণিত হন । সকল বেদ-মন্ত্রের ঋষি ও দেবতা আছেন । যে বিষয়ের জ্ঞান আবিভূর্ত হয় তাকে দেবতা বলা হয় এবং যাঁকে আশ্রয় করে ঐ জ্ঞান আবির্ভূত হয়, তাঁকে ঋষি বলে ।

বেদ দুই ভাগে বিভক্ত - কর্মকাণ্ড ও জ্ঞানকাণ্ড । দর্শনকার জৈমিনি কর্মকাণ্ডমীমাংসায় বলেছেন, - ‘অথাতো ধৰ্ম-জিজ্ঞাসা’ অর্থাৎ এর পর ধর্ম-জিজ্ঞাসা করতে হবে । কার পর ? নিয়মপূর্বক বেদাধ্যয়নাদি করে তারপর ধর্ম-জিজ্ঞাসা করবে । ইহাতেও পরোপকার, সত্যবাদিতা প্ৰভৃতি নিতান্ত আবশ্যক, কিন্তু ইহাতে সত্যের জন্য সত্যকথন না হয়ে স্বৰ্গাদি বা অন্য কোন বাসনায় ঐ সকল কৃত হয়ে থাকে । বৈদিক কর্মকাণ্ডের সকল কাৰ্যই সকাম । অতএব বৈদিক কর্মকাণ্ড ও জৈমিনি-প্ৰণীত পূর্বমীমাংসা-পাঠকালে বর্তমান শিক্ষানুযায়ী হয়ে কর্ম-কথাটি, যাহা কিছু করা যায় তাই কর্ম (anything done) - এইরূপ বুঝলে ভুল হবে । বেদের দ্বিতীয় বিভাগ - জ্ঞানকাণ্ড । পাশ্চাত্ত্য দার্শনিকেরা স্থির করেছেন যে, আমাদের আপেক্ষিক জ্ঞানের বাইরে এক অপরোক্ষ জ্ঞান আছে, জ্ঞাতের বাইরে এক অজ্ঞাত দেশকালপরিচ্ছিন্ন পদাৰ্থ আছে, কিন্তু ইহা আমাদের বুঝবার বা জানিবার জো নেই । বেদান্তও বলেন, এই জ্ঞান আমাদের বাক্যমনের অগোচর, কিন্তু ইহা অপরিজ্ঞেয় হলেও আমরা ইহা লাভ করতে পারি, ইহার সহিত একীভূত হতে পারি । ব্যাসসুত্র বা উত্তরমীমাংসায় জ্ঞানকাণ্ডের বা উপনিষদের শ্লোকসকলের তাৎপৰ্য সুত্রাকারে গ্রথিত হয়েছে এবং উপনিষদের মধ্যে যে বিরুদ্ধ ভাব নেই ও সমগ্ৰ উপনিষদ যে একই ভাব প্রকাশ করছে, ইহাই মীমাংসা করেছেন । জৈমিনি-দর্শনের ন্যায় উহাও ‘অথাতো’ বলে আরম্ভ করেছেন । উহাতে প্ৰযুক্ত এই ‘অথ’-শব্দ দুই অর্থে ব্যবহৃত হতে পারে । এক - মঙ্গল-বাচক শব্দ বলে কিংবা অনন্তর অর্থে । কার অন্তর ? কৰ্মকাণ্ডের অনন্তর হতে পারে না, কারণ কর্ম হতে কখনও জ্ঞান উৎপন্ন হতে পারে না, কৰ্ম কর্মেরই উৎপাদক । অতএব আচাৰ্য শঙ্কর ইহার অর্থ - সাধন-চতুষ্টয়ের অনন্তর বলে ব্যাখ্যা করেছেন ।


এই সাধন-চতুষ্টয় কি ?


প্রথম - নিত্যানিত্য-বস্তু-বিবেক; জ্ঞান-বিচারদ্বারা কি নিত্য, কি অনিত্য স্থির করতে হবে । অনেকে জ্ঞানকে অতি হেয় বলে গণ্য করে থাকেন । সত্য বটে, জ্ঞান-বিচার সেই নিত্য বস্তুকে সাক্ষাৎ প্রত্যক্ষ করাতে পারে না, তা বলে ইহার যে কোন কাৰ্যকারিতা নেই, তা বলা মহাভ্ৰম । এই জ্ঞান-বিচার দ্বারাই তো পাশ্চাত্ত্য পণ্ডিতেরা জেনেছেন এক অজ্ঞেয় দেশকালাপরিচ্ছিন্ন বস্তু (Unknown) আছেন । তিনি নিশ্চিত আছেন - একথাও তো তাঁরা ইহার সাহায্যে জানতে পেরেছেন । তিনি আছেন বলে যে নিশ্চয় বিশ্বাস করেছে, তার তাঁকে প্ৰাপ্ত হতে আর অধিক বিলম্ব নেই ।

দ্বিতীয় - ইহামূত্রফলভোগবিরাগ; অৰ্থ - ইহলোকের সুখ, কি পরলোকে প্রাপ্য স্বৰ্গাদি-সুখ উভয়েতেই বৈরাগ্যবান হওয়া আবশ্যক ।

তৃতীয় – শমদমাদিষট্‌সম্পত্তি : শম, দম, তিতিক্ষা, উপরতি, শ্রদ্ধা ও সমাধান এই ছয় পদার্থ ।
(১) শম - অন্তরিন্দ্ৰিয়ের দমন মনে কতরূপ কামনার উদয় হচ্ছে, কতরূপ চাঞ্চল্য আসছে, এই সমস্ত দমন করা । সর্বাগ্রে ব্ৰহ্মচৰ্যই প্রধান সাধন, যার উহা নেই, তার সমস্তশক্তির ব্যয় হয়ে যায় । মন অনন্তশক্তির আধার, সংযমের দ্বারা এই শক্তি ক্ৰমে বিকাশিত হতে থাকে । আমাদের ভিতর অনন্তশক্তি রয়েছে, এই শক্তি বিকশিত করলে আমরা প্রায় সর্বশক্তিমান হতে পারি । অবতারাদি পূর্ব পূর্ব মহাপুরুষেরা ইহাই দেখিয়ে গিয়েছেন যে, আমরাও ইচ্ছা ও চেষ্টা করলে তাঁহাদিগের প্রদর্শিত পথ অনুসরণ করে তাঁহাদের ন্যায় শক্তি ও জ্ঞানসম্পন্ন হতে পারি । যদি তাই না হয়, তবে অবতারের আসবার প্রয়োজন কি ? অবতারাদি মহাপুরুষেরা আমাদের কি করতে হবে এবং কিরূপে করতে হবে ইহাই নিজ নিজ জীবনে দেখিয়ে যান । তাঁরা আমাদিগকে এক নূতন আদর্শ দেখিয়ে যান, যাতে আমরা সকলে সেই আদর্শের অনুরূপ হতে পারি । অনেকে মনে করেন বিবাহাদি হলে, গৃহস্থ হলে ইন্দ্ৰিয়সংযম করা অসম্ভব । ইহা অত্যক্ষ ভুল । ইচ্ছা থাকলে গৃহস্থও ইন্দ্ৰিয়সংযম করতে পারেন । শ্ৰীরামকৃষ্ণ বলতেন, মন-মুখ এক করলে সব হয় । মন-মুখ এক কর দেখি, ইন্দ্ৰিয়সংযমাদি সকল বিষয় তোমার নিশ্চয়ই করায়ত্ত হবে । আমার একজন পাশ্চাত্য বন্ধু আছেন, তিনি ইঞ্জিনিয়ার । তিনি পূর্বে কোনরূপ নূতন কলকারখানার উদ্ভাবনা করতে পারতেন না । যা পড়েছেন, তাই কার্যে পরিণত করতেন মাত্র । তিনি বিগত চার বৎসর স্ত্রীর সহিত শারীরিক সম্বন্ধ পরিত্যাগ করেছেন এবং তার ফলে সম্প্রতি একজন বিখ্যাত যন্ত্রাবিষ্কারক হয়েছেন । তিনি আমাকে বলেছেন যে, এখন কোন বিষয়ের চিন্তা করতে গেলে সেই বিষয়ের একখানি ছবি যেন তাঁর মনের সম্মুখে বিস্তারিত হয়, তিনি তাতে সমস্তই দেখতে পান । ব্ৰহ্মচর্যানুষ্ঠানের এমনই ফল ! ব্রহ্মচর্য না থাকার জন্যই আমাদের এত দুর্দশা হয়েছে ।
(২) দম - বহিরিন্দ্ৰিয়ের দমন, হস্তাদি ও চক্ষু প্রভৃতিকে মনের বশে আনয়ন করতে হবে ।
(৩) তিতিক্ষা, অর্থ - সহ্য করা । সুখ-দুঃখ, শীত-উষ্ণ ইত্যাদি যার যে পরিমাণে সহ্য হয়, সেই পরিমাণে সহ্য করা ।
(৪) উপরতি, অর্থাৎ রূপরসাদিবিশিষ্ট বাইরের বস্তুসকল হতে ইচ্ছাশক্তির দ্বারা মনকে ভেতরে আনয়ন করা ।
(৫) শ্রদ্ধা, অর্থ - বেদশাস্ত্র ও গুরুবাক্যে দৃঢ় বিশ্বাস ।
(৬) সমাধান - ঈশ্বর বিষয়ে মনের একাগ্রতা ।

চতুর্থ – মুমুক্ষ্মতা

এই সাধন-চতুষ্টয় সম্পন্ন হলে জ্ঞানকাণ্ডে অধিকার জন্মে ।

আমরা ইতঃপূর্বে বলেছি, কর্মকাণ্ডেও পরোপকার, সত্য-কথন প্রভৃতির অত্যন্ত আবশ্যকতা আছে । বেদের কর্মকাণ্ড দুইভাগে বিভক্ত । প্রথম মন্ত্র ভাগ - ইহাতে ইন্দ্ৰাদি নানা দেবতা-সম্বন্ধে স্তবাদি আছে এবং দ্বিতীয় ব্ৰাহ্মণ ভাগে যাগযজ্ঞাদি করবার নিয়মাদি লিপিবদ্ধ আছে ।
[রামকৃষ্ণ মিশন সভা-রবিবার, ৭ই আগস্ট, ১৮৯৮ খষ্টাব্দ]


11) সৃষ্টি-রহস্য



11.1) সৃষ্টির অনাদিত্ব


আজ ছান্দোগ্য উপনিষদ হতে একটি গল্প পাঠ করব - শ্বেতকেতু নামে একটি ব্রাহ্মণপুত্র ছিলেন; তাঁর পিতার নাম আরুণি বলে তাঁকে আরুণি শ্বেতকেতু বলত । একদিন তাঁর পিতা তাঁকে বললেন, “শ্বেতকেতো, তুমি ব্ৰহ্মচৰ্য আচরণপূর্বক গুরুগৃহে বেদাধ্যয়ন কর ।" শ্বেতকেতু ব্ৰহ্মচর্য গ্রহণপূর্বক দ্বাদশ বর্ষ গুরুগৃহে বেদাধ্যয়ন করে গৃহে প্ৰত্যাগমন করলেন । শাস্ত্ৰাদি পাঠ করে, নিজের পাণ্ডিত্য চিন্তা করে কিছু অহঙ্কারী হয়েছেন দেখে তাঁর পিতা তাকে বললেন, “শ্বেতকেতো, তুমি বহু শাস্ত্ৰ অধ্যয়ন করেছ সত্য, কিন্তু এরূপ কিছু জেনেছ, যা জানলে জগতের সমস্ত পদার্থই জানা যায় ? মাটিকে জানলে যেরূপ মাটির বিকার - সরা, খুরি প্রভৃতি সমস্তই জানতে পারা যায়, সেইরূপ এমন এক বস্তু আছে, যাকে জানলে জগতে জানবার আর কিছু বাকি থাকে না । এরূপ কোন বস্তু কি জানতে পেরেছ ?” শ্বেতকেতু বললেন, “না, আমি এরূপ বস্তু জানি না, আমার গুরুও ইহা জানেন না, জানলে অবশ্যই সে বস্তুর কথা আমাকে বলতেন । অতএব আপনি, যদি তা জানেন, অনুগ্রহ করে আমাকে বলুন ।” আরুণি বললেন, “শ্বেতকেতো, অগ্ৰে কেবল এক সৎ বস্তুই বিদ্যমান ছিলেন, আ্র কিছুই ছিল না । তিনিই এই সমস্ত সৃষ্টি করেছেন; তিনি ঈক্ষণ করলেন - ইচ্ছা করলেন - আমি বহু হব এবং তিনি বহু হলেন ।” এইরূপে সৃষ্টি-প্রক্রিয়া বর্ণনা করে শিক্ষা দিলেন; এক্ষণে আমাদের বুঝা আবশ্যক, এই যে সৃষ্টিতত্ত্ব-বৰ্ণনায় বলা হয়েছে - অগ্ৰে কিছুই ছিল না, কেবল এক সৎ ছিলেন । এর অর্থ কি ? সৃষ্টি আদৌ ছিল না, বা হয় নাই - এই কি অৰ্থ ? না, আমাদের শাস্ত্রের কোথাও এরূপ উল্লেখ নেই । এর অর্থ - সৃষ্টি বীজরিপে সেই সদ্‌বস্তুতে বর্তমান ছিল, সৃষ্টি সেই সদ্‌বস্তু হতে পৃথক নয়, তিনিই বহু হয়েছেন; যখন এই সৃষ্টি তাঁর অংশ হল তখন ইহা ছিল না, এরূপ কিরূপে হবে ? প্রকাশভাবে সৃষ্টি না থাকুক, বীজভাবে ছিল । বৃক্ষ যেমন বীজ হতে উৎপন্ন হয়ে ক্রমে শাখাপত্ৰাদির আকারে প্রকাশিত হয় ও পরে আবার বীজে পরিণত হয়ে নষ্ট হয়, সেইরূপে সৃষ্টির বারংবার প্রকাশ ও লয় হয়ে থাকে, ব্যক্তাবস্থা হতে আবার অব্যক্ত অবস্থায় লুক্কায়িত হয় । এইরূপে প্ৰকাশ ও প্ৰলয় - এই দুই অবস্থায় প্রবাহরূপে সৃষ্টি অনাদিকাল বর্তমান আছে । সদ্‌বস্তু যেরূপ অনাদি, এই সৃষ্টিও সেইরূপ অনাদি । সৃষ্টির আদি আছে বললে দুটি দোষ উপস্থিত হয়, ইহা আমরা গত বারে দেখেছি । প্ৰথম বৈষম্যদোষ - আমরা জগতে বৈষম্য দেখতে পাই -কেহ রুগ্ন, কেহ সুস্থাকায়; কেহ ধনী, কেহ দরিদ্র; কেহ পণ্ডিত, কেহ মূর্খ ইত্যাদি; এইরূপ বৈষম্য কেন ও কোথা হতেই বা হয় ? সৃষ্টিকর্তা-কৃত বললে তাঁতে পক্ষপাতিত্ব-দোষ পড়ে এবং দ্বিতীয়, তাঁতে নৈঘৃণ্য-দোষ হয়, তাঁর নিষ্ঠুরের ন্যায় আচরণ হয়, কারণ-অকারণে তিনি কাকেও সুখী এবং কাকেও মহাদুঃখী করছেন । বেদাদি শাস্ত্ৰে সৃষ্টি অনাদি বলে বর্ণিত । উহা প্রবাহরূপে অনাদি, উহা তাঁরই রূপ, তাঁরই অংশ তিনিই । সৃষ্টির আদি আছে বললে আর এক দোষ উপস্থিত হয়, উহা এই - যখন সৃষ্টি ছিল না, তখন ভগবানের সৃষ্টিকর্তৃত্ব না-থাকার জন্য তাঁর পূর্ণত্ব ছিল না, তিনি অপূর্ণ ছিলেন । সৃষ্টিকর্তা হয়ে তাঁর অধিক গুণপ্রাপ্তি হয়েছে অথবা গুণের হ্রাস হয়েছে, বলতে হয় । এজন্য কি বেদ, কি পুরাণ কি মহাভারত, কি স্মৃতি - সকল শাস্ত্ৰেই সৃষ্টি অনাদি বলে কথিত হয়েছে ।


11.2) সৃষ্টি-প্রক্রিয়া-প্রাণ ও আকাশ


মহাভারতাদিতে এই সৃষ্টিতত্ত্ব পাঠ করে সাধারণতঃ আমরা অনেক ভুল বুঝে থাকি । সৃষ্টি-প্রক্রিয়ার প্রথমেই আছে যে, প্রথমতঃ, প্রাণ ও আকাশ প্ৰকাশিত হল; এখন প্রাণ মানে আমরা নানারূপ বুঝে থাকি । কেহ নিঃশ্বাস অর্থ বুঝলেন, কেহ জীবাত্মা বুঝেন ইত্যাদি, কিন্তু এরূপ অর্থে ইহা ব্যবহৃত হয়নি । সেইরূপ আকাশ-অর্থে আমরা অবকাশ বুঝি, এই আকাশের তিনরূপ অৰ্থ আছে । প্রথম মহাকাশ - বাহ্য জগতের সকল বস্তু এই মহাকাশে বর্তমান । সম্মুখের এই আলো, টেবিল প্রভৃতি, চন্দ্ৰ, সুৰ্য, গ্রহ, নক্ষত্র, মনুষ্য, বৃক্ষাদি সমস্তই এই অবকাশে রয়েছে; দ্বিতীয়, চিত্তাকাশ - আমরা যে সমস্ত চিন্তা করি, বিচার করি বা যে সমস্ত সিদ্ধান্তে উপস্থিত হই, সেই সমস্তই পৃথক পৃথক ভাবে আমাদের মনে বর্তমান রয়েছে । এইজন্য মনকে আকাশরূপে বর্ণনা করা হয়েছে । তৃতীয় - চিদাকাশ অর্থাৎ জ্ঞানময় আকাশ; আমাদের যে জ্ঞান, তাহা সামান্য জ্ঞান, কিন্তু চিদাকাশ পূর্ণজ্ঞানের আকাশ । আমাদের জ্ঞান অজ্ঞানে জড়িত; কিন্তু এই জ্ঞানে অজ্ঞান নেই - পূর্ণজ্ঞানস্বরূপ; এই আকাশে বাহ্যিক মহাকাশ ও আন্তরিক চিত্তাকাশ উভয়ই রয়েছে । কিন্তু সৃষ্টিতত্ত্ব-বৰ্ণনায় আকাশ আর এক অর্থে প্ৰযুক্ত হয়েছে । ইহা পদার্থের সূক্ষ্ম অংশ, ইংরেজীতে যাকে matter বলে; ইহা জড়ের সূক্ষ্ম অংশ এবং প্রাণ অর্থে সমস্ত শক্তির মূল শক্তি । জড় জগতের যত কিছু শক্তি, যেমন গতিশক্তি, শারীরিক শক্তি, অন্ন-পরিপাক-শক্তি, চিন্তাশক্তি, আধ্যাত্মিক শক্তি - সমস্তই সেই এক প্ৰাণেরই বিকার, সেইরূপ আমাদের নিঃশ্বাস-প্ৰশ্বাস শক্তিও সেই প্ৰাণের বিকার এবং এই নিঃশ্বাস-শক্তি বর্তমান থাকাতেই মানুষ জীবিত থাকে বলে একে বিশেষরূপে প্ৰাণ বলা হয়ে থাকে । কিন্তু শাস্ত্রের সৃষ্টিবৰ্ণনস্থলে 'প্ৰাণ' বলতে এক মূল শক্তিকে বুঝতে হবে, অন্য সকল শক্তিই যার বিকার-প্ৰসূত; এবং ‘আকাশ’ বলতে বুঝতে হবে, মূল জড় বস্তু - আর সমস্ত জড় বস্তুই বিকারমাত্র ।


11.3) সৃষ্টি-প্রক্রিয়া-শাস্ত্র ও বিজ্ঞান


শাস্ত্রের সৃষ্টিবিষয়ক মত আমরা না বুঝেই অনেক সময় ভ্রান্ত বলে অগ্রাহ্য করি, কিন্তু বর্তমান বিজ্ঞান শাস্ত্রীয় সৃষ্টিতত্ত্ব অনেক স্থলে সত্য বলে প্ৰমাণ করে দেয় । শাস্ত্ৰ বলেন, সৃষ্টির প্রারম্ভে পূর্বোক্ত আকাশের উপর শক্তির অর্থাৎ প্ৰাণের কার্য হতে আরম্ভ হয় । ইহার প্রথম ফল বায়ু বা কম্পন, অর্থাৎ আকাশের পরমাণুসকলের কম্পন আরম্ভ হয় । বায়ু = বা ধাতু-কম্পন-অৰ্থ । আকাশ হতে এই বায়ুর বা কম্পনের উৎপত্তি হয় । কম্পন হতে তেজঃ জন্মায় । বিজ্ঞানও আজকাল ইহা প্ৰমাণ করছে । কোন বস্তুর গতিরোধ করলে তা উত্তপ্ত হয়ে উঠে । বাতাস অত্যন্ত জোরে বইলে উত্তাপ উৎপাদন করে। বিজ্ঞান বলেন, গ্ৰহনক্ষত্ৰাদি ও সমুদয় পৃথিবী প্ৰথমে অত্যন্ত উত্তপ্তাবস্থায় ছিল, ক্ৰমে শীতল হয়ে বাসোপযোগী হয়েছে । এখনো সুৰ্য্যলোক অত্যন্ত উত্তপ্ত, তথায় পৃথিবীর যাবতীয় কঠিন বস্তু বাষ্পরূপে বর্তমান রয়েছে । এই তেজ শীতল হয়ে অপ্‌ বা জল হয় ও ক্রমে কঠিন হয়ে পৃথিবী বা কঠিন মৃত্তিকাদিরূপে পরিণত হয় । সৃষ্টির প্রারম্ভে এই পঞ্চমহাভূত পূর্বোক্তাদিরূপে উৎপন্ন হয়ে প্ৰথমে সূক্ষ্ম অবস্থায় থাকে, ক্ৰমে ইহাদের পরস্পরের মিশ্রণে এই স্থুল জগৎ নির্মিত হয় ।


11.4) সৃষ্টিতত্ত্বে-সাংখ্য ও বেদান্ত


বেদান্তমতে এই স্থুল জগৎ এক সত্যেরই রূপান্তরমাত্র । এক সদ্‌বস্তুকেই অবলম্বন করে এই জগৎ রয়েছ; তিনিই এই জগৎ হয়েছেন । সাধারণতঃ বেদান্তের অর্থ লোকে এইরূপ করে যে, জগৎ মিথ্যা, জগৎ নেই; কিন্তু বেদান্তের এরূপ অর্থ নয় । যখন সদ্‌বস্তু হতে এই জগৎ সৃষ্টি হয়েছে, তখন ইহা একেবারে মিথ্যা কি করে বলব ? যখন তিনিই সকল জীবজন্তুর প্রাণরূপে বর্তমান রয়েছেন, তখন ইহা কিরূপে মিথ্যা হতে পারে ? আমাদের এইস্থলে ‘মিথ্যা’ এই কথা “কম সত্য, সেই পূর্ণ সত্য অপেক্ষা কম সত্য” এরূপ বুঝলে আর কোন গোল হবার সম্ভাবনা নেই । সাংখ্যের সৃষ্টিতত্ত্ব এরূপ - পুরুষ ও প্রকৃতি দুই অনাদি বস্তু । পুরুষের সান্নিধ্যবশতঃ প্রকৃতি ক্রিয়াশীল হন, যেরূপ চুম্বকলৌহের সান্নিধ্যবশতঃ লৌহ আকৃষ্ট হয় । এই প্রকৃতি হতে মহান্‌ অর্থাৎ বুদ্ধি, বুদ্ধি হতে অহংজ্ঞান, অহঙ্কার হতে পঞ্চসূক্ষভূত ইত্যাদির ক্ৰমে সৃষ্টি হয় ।


11.5) সাংখ্য ও বেদান্তের প্রভেদ-ঈশ্বরতত্ত্বে


এখন সাংখ্য ও বেদান্তের মধ্যে প্ৰভেদ এই, সাংখ্য ঈশ্বর স্বীকার করেন না, বেদান্ত করেন । বেদান্ত বলেন, যেমন মানুষের এই দেহ, সেইরূপ সমগ্র সৃষ্ট জগৎ একটি মহান্‌ বিরাট দেহ । আমাদের দেহসকল সেই সমষ্টি দেহের অংশমাত্র । প্রত্যেকের যেরূপ মন আছে, সেইরূপ এই স্থুল জগতের ভেতর এক অনন্ত মন আছে, আমাদের প্রত্যেকের মন সেই মহান্‌ মনের অংশমাত্র । সমস্ত দেহ পরস্পর সম্বন্ধ, কারণ তারা এক বিরাট দেহের অংশ । সমস্ত মন পরস্পর সম্বন্ধ, কারণ তারা এক বিরাট মনের অংশ ।


11.6) বৈদান্তিক ঈশ্বরবাদের কার্যকারিতা নিঃস্বার্থপরতা


যখন একটি দেহ ক্লেশ পায় বা একটি মনে দুঃখ উপস্থিত হয়, তখন আর আর দেহ ও মনেও সেই তরঙ্গের প্রতিঘাত হবে । কারণ, তারা পরস্পরসংলগ্ন ও সেই একেরই অংশ হয়ে রয়েছে । অতএব তোমার মঙ্গলে আমারও মঙ্গল ও তোমার অমঙ্গলে আমার অমঙ্গল । তোমার উন্নতি ও অবনতি তোমাতেই অবসিত হচ্ছে না, তার প্ৰতিঘাত আমাতে ও সর্বজগতে গিয়ে লাগছে । সেইরূপ একজাতির উন্নতি অবনতি অপর জাতিসমূহকে স্পর্শ করে । আমরা বেদান্তের এই মহান্‌ সত্য যে দিন হতে ভুলেছি, সেই দিন হতেই আমাদের অবনতির দ্বার উদঘাটিত হয়েছে । স্বার্থের বশীভূত হয়ে আমরা যে স্ত্রী ও শূদ্র জাতির প্রতি অত্যাচার করেছি, এখন তারই ফলভোগ করছি । সমাজ-শরীরের এক অংশ রোগগ্ৰস্ত হলে অপর অংশও রুগ্ন হয় – পাশ্চাত্ত্যগণ বেদান্ত না পড়েও বহুদৰ্শিতায় ইহা বুঝেছে ও এখন সেই সত্যটি কার্যে পরিণত করতে চেষ্টা পাচ্ছে; একদেশে মহামারী হলে অপর দেশে হবার সম্ভাবনা, অতএব পরের দেশের মহামারী নিবারণের চেষ্টা করছে; স্ত্রীজাতির অবনতিতে সমাজের অপর অঙ্গ পুরুষ জাতিরও অবনতি হয়ে থাকে এবং অপর দেশের অমঙ্গলে নিজেদেরও অমঙ্গল, ইহা বুঝেছে । জগতস্থ সকল ব্যক্তি ও বস্তুই সেই বিরাট মূর্তির অঙ্গ, এই মহান্‌ ভাব বেদান্ত প্রচার করেছেন । গীতায় ভগবান বলেছেন, “হে অর্জুন, যা কিছু শক্তিমান, যা কিছু শ্রেষ্ঠ দেখবে, তা আম,; নদীর মধ্যে আমি গঙ্গা, বৃক্ষের মধ্যে আমি অশ্বত্থ” ইত্যাদি বলে অবশেষে বলছেন, “ঐরূপে এক একটি আমার বিভূতির কথা আর আমি কত বলব, আমিই একাংশে সমস্ত জগৎ হয়ে রয়েছি ।” এই বিরাটের পূজাই শ্রেষ্ঠ পূজা । ‘সাধন ভজন' শব্দের অর্থ এক কথায় বলতে হলে বলতে হয় যে, উহা সম্পূর্ণ স্বাৰ্থত্যাগ । কি জ্ঞানপথ, কি ভক্তি পথ স্বাৰ্থত্যাগ ভিন্ন কোন পথে অগ্রসর হবার সম্ভাবনা নেই । আপনাকে ভুলে যাওয়া - যে আপনাকে ভুলতে পেরেছে, স্বাৰ্থত্যাগ করতে পেরেছে, তার সাধন ভজন সব হয়েছে । ঈশ্বর কি খোসামোদের বশ যে, যে তাঁকে স্তবস্তুতি করল, তার প্রতি প্ৰসন্ন হবেন, আর যে করল না, তার প্রতি বিমুখ হবেন ? না, তিনি এরূপ নন । একজন ভগবান মানে না । কিন্তু সে স্বাৰ্থ শূন্য, পরের সেবা তার ব্ৰত, জেনো তার ঈশ্বর লাভের বিলম্ব নেই । আর যে দিবারাত্র ঈশ্বরপূজায় ব্যস্ত কিন্তু মহা স্বার্থপর, তার সাধন-ভজন পণ্ডশ্রমমাত্ৰ । সর্বভূতে ভগবানকে দেখতে হবে, সকলকেই তাঁর মূর্তি জেনে সেবা করতে হবে । বেদান্ত ইহাই বলেন, আমরা সকলেই বিরাটের অংশ । সেই বিরাট মনের এক ক্ষুদ্র অংশ অধিকার করে আমি বলছি, আমার মন - তুমি একটু নিয়ে বলছ, তোমার মন । যেমন গঙ্গার স্থানে স্থানে বেড়া দিয়ে আমরা এক একটা নাম দিচ্ছি - ঘোষ গঙ্গা, বোস গঙ্গা ইত্যাদি । সকলেই জানেন কিন্তু গঙ্গা বাস্তবিক এক !  - এক জল, এক তরঙ্গ কেবল নামরূপে আমরা প্রভেদ করছি মাত্র । সমুদ্রের একাংশকে এক নাম দিলাম, অন্য অংশকে আর এক নাম দিলাম, কিন্তু উহা একই সমুদ্র । সেইরূপ মন এক, কেবল উপাধিভেদে ভিন্ন ভিন্ন বলছি । যখন দু’জনের মন পরস্পরের প্রতি স্বাৰ্থশূন্য ভালবাসায় সংযুক্ত হয়, তখন ঐ দু'জন একভাবে ভাবিত হয়, তখন তাদের শরীর পৃথিবীর দুই প্রান্তে থাকলেও মনের কথা জানতে পারে; আমরা ইহার অনেক দৃষ্টান্ত দেখতে পাই । এইরূপে আমাদের মন ও শরীর যে পরস্পর সংলগ্ন রয়েছে, ইহা এক মহাসত্য । অতএব একথাও সত্য যে, যখন আমাদের মনে পাপচিন্তার উদয় হয়, তখন অন্যান্য মনের পাপচিন্তাসকলও প্রবাহিত হয়ে উহাকে আরও পাপে নিমগ্ন করে । আবার কোন সৎ বা ধর্মচিন্তার উদয় হলে, যত সাধু মহাপুরুষদিগের চিন্তা আমাদের মনের উপর কার্য করে, উহাকে আরও উন্নত করতে থাকে । এইরূপে আমাদের সমস্ত সাধন-ভজন আমাদের স্বাৰ্থশূন্য করে বিরাটের উপলব্ধির দিকে ক্ৰমশঃ অগ্রসর করে ।


11.7) ঈশ্বরের প্রকাশ ব্যক্তিভেদে


যার যেরূপ মন, সে বিরাটকে সেইরূপে ভেবে থাকে; যে নিষ্ঠুরস্বভাব, ভগবানকে সে নিষ্ঠুরভাববিশিষ্ট দেখে; যে পুণ্যবান, সে ভগবানকে অনন্ত পুণ্যময় দেখতে পায় । এইরূপে আমাদের নিজের স্বভাব-অনুযায়ী আমরা ভগবান কল্পনা করি । ইহা স্বাভাবিক এবং ইহা সত্য, কারণ মনের উন্নতি-অনুযায়ী আমরা প্ৰত্যেকে ভগবানকে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে ধারণা করি । ঐ ধারণাই সেই সময়ে ভগবানের স্বরূপ বলে আমাদের নিকট প্ৰতীয়মান হয় । ঈশ্বর-সম্বন্ধে আমাদের ঐসকল ধারণা আবার একভাবে সত্য এবং অন্যভাবে মিথ্যা বলে বুঝতে পারা যায় । যেমন সূর্যকে আমরা পৃথিবী হতে যেরূপ দেখি, তা সূর্যের প্রকৃত রূপ নহে, কিন্তু আমারা যা দেখি তাও মিথ্যা নয় । সূর্যের দিকে যতই অগ্ৰসর হ’ব, সুৰ্যকে আমরা ততই ভিন্নরূপে অবলোকন করতে থাকব এবং ঐরূপে সুধিলোকে যদি কখন উপস্থিত হতে পারি, তখন সূর্যের প্রকৃত স্বরূপ আমাদের নয়নগোচর হবে । আর একটি দৃষ্টান্ত দেখ - দূর হতে পর্বত দেখলে বোধ হয়, একখানি কাল মেঘ উঠেছে, যতই অগ্রসর হওয়া যায়, ততই ঐ পর্বতস্থ বৃক্ষমন্দিরাদি দেখতে পাওয়া যায় । ক্ৰমে আরও অগ্রসর হলে জীবজন্তু প্ৰভৃতি দেখা যায় । ঐরূপ যতই সেই বিরাট পুরুষের নিকটে যাওয়া যায়, ততই আমরা তাঁর নূতন নূতন ভাবসকল দেখতে ও বুঝতে থাকি এবং ক্রমে পূর্ণজ্ঞানে তাঁর সহিত সন্মিলিত হয়ে যাই । পরমহংসদেব ঐ বিষয়ে দৃষ্টান্ত দিতেন -“যেমন ঘরের ভেতর একটু আলো ছাদের ফাঁক দিয়ে আসছে । যে ভেতরে আছে তার আলোজ্ঞান সেইটুকু, যার ঘরে অনেক ছিদ্র, সে অধিক আলো দেখতে পায়ও; দরজা জান্‌লা কর তো আরও আলো হয়; আবার ঘর ছেড়ে মাঠে গিয়ে যে বসেছে, তার কাছে আলোয় আলো । ভগবান এই-রূপে লোকের মানসিক অবস্থা-অনুযায়ী আপনার স্বরূপ প্ৰকাশ করেন ।”


11.8) বেদান্ত কি নাস্তিক ?


লোকে ভুল বুঝে বেদান্তশাস্ত্রকে নাস্তিকশাস্ত্র বলে, যে বেদান্ত সকলেরই ভেতর অনন্তকে দেখিয়ে দেয়, সকলকেই ব্ৰহ্মের অংশ বলে পূজা করতে বলে, তা কখনো কি নাস্তিকশাস্ত্র হতে পারে ? আমরা অতি হীন হয়েছি, নিজেরা শাস্ত্ৰ পড়ি না, বুঝি না, তাই আমাদের এই দুর্দশা । আবার শাস্ত্রের মর্ম বুঝতে হবে । সকলের ভেতর আনন্দময় ব্ৰহ্মকে দেখতে হবে, সমস্ত জগতে তাঁকে উপলব্ধি করতে হবে । তবেই উন্নতির সময় আসবে ।
[রামকৃষ্ণ মিশন সভা, রবিবার, ২৮শে আগস্ট, ১৮৯৮]


12) সাধন-নিষ্ঠা


গীতায় ভগবান বলছেন, “ঈশ্বরোপাসনা করতে অগ্রসর হয়ে ইহলোকে মানবের নিষ্ঠা দ্বিবিধ হতে দেখা যায় । প্রথম জ্ঞাননিষ্ঠা, দ্বিতীয় কর্মনিষ্ঠা । পুরুষ কর্মানুষ্ঠান না করলে জ্ঞানপ্রাপ্ত না হলেও কেবল সন্ন্যাস দ্বারা সিদ্ধিলাভ হয় না । কর্মত্যাগ করে ক্ষণমাত্ৰ বাঁচবার উপায় নেই । ইচ্ছা না থাকলেও প্ৰাকৃতিক গুণ মানুষকে কর্মে প্রবৃত্ত করে । তুমি নিয়ত কর্ম অনুষ্ঠান কর - কর্মত্যাগ অপেক্ষা কর্ম করাই শ্রেষ্ঠ । সব কর্মশূন্য হলে তোমার শরীরযাত্রা নির্বাহ হবে না” ইত্যাদি । আমরা পূর্বে দেখেছি বেদের প্রতিজ্ঞা কি । বেদ ব্ৰহ্মজ্ঞানলাভের উপায় কি, তাই শিক্ষা দেন । আত্মজ্ঞান কাকে বলে এবং কি উপায়েই বা উহা লাভ হতে পারে, বেদ সেই বিষয়েই সকলকে বলে থাকেন । বেদ বলেন, সকলের ভেতরেই পরমাত্মা রয়েছেন । জীবজন্তু কীটপতঙ্গের ভেতর তিনি, সূৰ্য চন্দ্ৰ গ্ৰহ নক্ষত্রের ভেতরেও তিনি । তিনি এই সমস্ত সৃষ্টিকার্যের ভেতরে ও বাইরে ওতপ্রোতভাবে বিদ্যমান রয়েছেন ।

তাকে কে লাভ করতে পারে ? যার দৃঢ়তা আছে, যে সাহসী, সে-ই তাঁকে লাভ করতে সমৰ্থ । যে দুর্বল-দেহ, যার মন নিস্তেজ, আত্মজ্ঞান তার পক্ষে লাভ হওয়া কঠিন । তেজীয়ান হতে হবে; তা হলেই ভগবানকে লাভ করতে পারা যাবে । বেদ বিশেষ করে সনাতনধর্মের বিষয়ই বলেন । সনাতনধর্মের অর্থ এই - যে ধর্ম কি দেবতা, কি মনুষ্য, সকলেরই নিত্য সমভাবে অনুষ্ঠেয়; যা সকল সময়ে এক এবং অপরিবর্তনীয় রূপে বিদ্যমান । আর স্মৃতি, পুরাণ, বাইবেল, কোরানাদি দেশকাল ও পাত্ৰভেদে যুগ ধর্মের বিষয় বর্ণনা করেন । দেশকালপাত্ৰ-বিবেচনায় নানাপ্রকার যুগ ধর্ম কালে কালে জগতে প্রচলিত হয়েছে এবং হচ্ছে । আমাদের বিশ্বাস বর্তমান যুগধর্ম কি হওয়া উচিত তা শ্ৰীশ্রীরামকৃষ্ণদেব নিজ জীবনে দেখিয়ে গিয়েছেন । উহা সংক্ষেপে এইরূপে নির্দেশ করা যেতে পারে - নিজধৰ্মমতে নিষ্ঠা রাখবে কিন্তু অপরের ধর্মকেও ভালবাসবে, ঘৃণা করবে না । উহা তিনি যে শুধু বলে গিয়েছেন তা নয়, কিন্তু নিজ জীবনে উহার অনুষ্ঠান করে আমাদের দেখিয়েও গিয়েছেন । তিনি সাধন দ্বারা উপলব্ধি ও প্রত্যক্ষ করেছিলেন - “যত মত, তত পথ ।” সকল ধর্মই সত্য; যে যেরূপ অধিকারী, সে আপনার অনুরূপ পথ বেছে নেয় ।

শাস্ত্রে বলে সৃষ্টি অনাদি । সৃষ্টির আদি স্বীকার করলে ভগবানে অপুর্ণতাদোষ হয় । যদি বলা যায়, তিনি সৃষ্টির পূর্বে পূর্ণ ছিলেন, তবে সৃষ্টির পর তিনি পূর্ণতর হলেন, বলতে হয় । আর যদি বলা যায়, সৃষ্টির পর তিনি পূর্ণ হলেন, তবে সৃষ্টির পূবে তিনি অপূর্ণ ছিলেন, বলতে হয় । এ উভয় পক্ষেই দোষ রয়েছে । ‘পূর্ণতর’ কথাটি স্ববিরোধী; কারণ যা পূর্ণ হতে পূর্ণতর হল, তা বাস্তবিক অপূর্ণই ছিল বলতে হয় । পূর্ণের আবার নবীন বিকাশ কি ? সৃষ্টির আদি স্বীকার করলে আবার তাকে নিষ্ঠুরতা-দোষে দোষী করা হয় । দেখা যায়, জগতে কেহ বা দরিদ্র, রুগ্ন ও মূর্খ; কেহ বা ধনী, সুস্থাকায় ও বিদ্বান । ভগবান যদি বিভিন্ন ব্যক্তিকে এইরূপ বিভিন্ন-অবস্থাপন্ন করে সৃষ্টি করে থাকেন, তবে তাতে পক্ষপাতিত্ব ও নিষ্ঠুরতা-দোষ অনিবাৰ্যরূপে এসে পড়ে । এই হেতু শাস্ত্র বলেন, সৃষ্টি অনাদি । যখন ইহা সুক্ষ্মভাবে বীজরূপে থাকে, তখন ইহার প্রলয়াবস্থা; যখন স্থুলভাবে প্ৰকাশ, তখন সৃষ্টি । এক সৃষ্টি ও এক প্ৰলয় নিয়ে এক কল্প হয় । এইরূপে সৃষ্টি ও প্ৰলয় প্ৰবাহরূপে অনাদিকাল বর্তমান । ইহা ভগবান ছাড়া অন্য কিছু নয়, তিনিই ইহা হয়েছেন; শাস্ত্র বলেন, তিনি ঈক্ষণ করলেন (আলোচনা করলেন) যে, আমি প্রজারূপে বহু হব এবং তৎক্ষণাৎ এই সৃষ্টিরূপে প্ৰকাশিত ও বহু হলেন । সৃষ্টিকাৰ্যে ভগবানের কোন উদ্দেশ্য থাকতে পারে না, কারণ তিনি পূর্ণ । কার্যের উদ্দেশ্য কার থাকে ? যার কোনরূপ অভাব আছে । সেই  অভাবমোচনের জন্য সে নানাভাবে কার্য করে এবং নানা বিষয়ের সাহায্য নেয় । ভগবানের কোন অভাব নেই। তাঁর কিছু পাবার আবশ্যক নেই, কারণ তিনি পূর্ণ । অতএব তাঁর এই সৃষ্টি করবার কোন উদ্দেশ্যও নেই । পাশ্চাত্ত্যেরা এ কথা বুঝতে পারে না । সৃষ্টির কোন উদ্দেশ্য নেই বললে তারা ভেবে বসে, তবে বুঝি সৃষ্টিতে কোন নিয়ম-বন্ধন নেই, এটা একটা পাগলামিমাত্র । উদ্দেশ্যহীন কোন কাৰ্য যে হতে পারে, ইহা তারা মনে করতে পারে না । কারণ, তারা নিজেদের এবং অপর সাধারণের অপূর্ণত্ব দেখে স্থির নিশ্চয় করে, উদ্দেশ্যহীন কাৰ্য সাধারণ মানুষের দ্বারা কোন কালে হয় না; দেখে, তাদের অভাব আছে বলেই তারা কাৰ্য করে, সুতরাং অনুমান করে, সৃষ্টিকাৰ্যও এরূপ হয়েছে । ভগবান কোন এক মহৎ উদ্দেশ্য দ্বারা চালিত হয়েই সৃষ্টি করেছেন । কিন্তু অনুধাবন করে দেখলে এই যুক্তি ভ্ৰমপূৰ্ণ বলে বোধ হয় । কারণ এতে ভগবান মনুষ্যতুল্য এই সিদ্ধান্ত অনিবাৰ্য হয়ে পড়ে । সৃষ্টিকার্যে ভগবানের কোন উদ্দেশ্য নেই, ইহা তাঁর খেলা, ইহা তাঁর লীলামাত্র । এখন প্রশ্ন হতে পারে, সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যহীন হলে কখনও কি কাৰ্য হতে পারে ? শাস্ত্রকারেরা বলেন, অবশ্য হতে পারে । দৃষ্টান্ত দেন - যেমন বালকের কার্য; বালক পথে যেতে যেতে পতঙ্গ দেখে, তাই ধরতে যায়, উদ্দেশ্যহীন নানা কাৰ্য করে, ভগবানের সৃষ্টিকাৰ্যও তদ্রুপ । সৃষ্টিতে তিনিই নানারূপে এই প্রকারে সেজেছেন - ইহা তাঁহার খেলা বা লীলামাত্র ।

দেখতে পাই, সংসারে কেহ ধনী, কেহ দরিদ্র; কেহ সুখী, কেহ দুঃখী; কেহ মূর্খ, কেহ পণ্ডিত । এই বৈষম্যের কারণ কি ? শাস্ত্র বলেন, ইহার কারণ কর্ম । ‘কর্ম’-শব্দ শাস্ত্ৰে অতি বিস্তৃত অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে । শাস্ত্র বলেন, পৃথিবী ও নক্ষত্রাদিও কর্ম-সম্ভূত । এ কথার অর্থ কি ? এখানে কর্মের অর্থ কারণ বা বীজভাব হতে কার্য বা প্ৰকাশিত অবস্থায় পরিণত হওয়া, ঐরূপ পরিণতিকেই কর্ম বলে । সৃষ্টি যখন অনাদি হল, তখন সৃষ্টি-বৈষম্যের কারণ ‘কর্ম’ ও যে অনাদি, ইহা আর বলা বাহুল্য ।

কর্মের ফল অবশ্যম্ভাবী । যে কৰ্ম কর না কেন, তাহার ফলভোগ করতে হবেই হবে । কেউই এর অন্যথা করতে পারে না । চিন্তার উদয়রূপ মানসিক কর্মেরও ফল আছে । কোন পাপচিন্তার উদয় হলে তৎক্ষণাৎ ফলস্বরূপ মন কলুষিত হয় এবং যখন ঐ পাপ চিন্তুা প্ৰবল হয়, তখন উহা শারীরিক কাৰ্যরূপে বাইরে প্রকাশিত হয় । আমরা অনেক সময় কর্মের ফল দেখতে না পেলেও কোনো-না-কোনো রূপে তা বর্তমান থাকে ইহা নিশ্চিত । শরীর-সম্বন্ধীয় অনিয়ত রোগরূপে আমাদের কষ্ট দেয় । ঔষধ দিয়ে রোগের উপশম হয় । ইহাতে শারীরিক অনিয়মের ফল, ঔষধসেবনরূপ অন্য এক কৰ্মফল দ্বারা রূপান্তরধারণ করল মাত্র । দুটি ভিন্ন কর্মের ফলই আমাদের উপভোগ করতে হল । কোনটির বিনাশ হল না, উভয় কর্মফল মিলে একটি কর্মফলরূপে প্ৰতীয়মান হল, এইমাত্ৰ প্ৰভেদ । যেরূপ নৌকার মাস্তুলে দড়ি বেঁধে উভয় তীর হতে গুণ টানলে নৌকা কোনো তীরে না গিয়ে নদীর মধ্য দিয়ে যেতে থাকে, সেইরূপ দুই ভিন্ন ভিন্ন কর্মের সংযোগে এক বিভিন্ন ফল উৎপন্ন হয়, এইমাত্র । কিন্তু কৰ্মফলের নাশ কখনও নেই ।

অনেকের বিশ্বাস, কোন এক অবতারে বিশ্বাসস্থাপন করলেই আমাদের সমুদয় পাপমোচন হয়ে যায় । বেদান্ত বলেন, তা নয় । 
হরিস্তে উপদেষ্টারঃ হরঃ কমলজোহপি বা ৷
তথাপি তব ন স্বাস্থ্যং সর্ববিস্মরণাদৃতে ৷৷
অর্থাৎ - স্বয়ং হরি, হর বা ব্ৰহ্মা তোমার উপদেষ্টা হলেও তোমার মোক্ষ তোমার নিজের চেষ্টার উপর নির্ভর করছে । তবে অবতারাদি কি করেন ? তাঁরা নিজ ধৰ্মপরিণত জীবন আমাদের সম্মুখে ধরে আমাদের কি করতে হবে, তাই দেখান । আমাদের সম্মুখে একটি আদর্শ জীবন রেখে দেন, যা দেখে আমরা তদনুরূপ হতে পারি । তাঁরা আদর্শ দেখিয়ে যান এবং উহা মনুষ্যজীবনে পরিণত করবার সহজ উপায়ও বলে যান, যার প্রভাবে লক্ষ জন্মের কার্য শত জন্মে, এমন কি, এক জন্মে শেষ করতে সমর্থ হয়ে মানুষ ধর্মের চরম সীমায় উপনীত হয় । অতএব শাস্ত্র বলেন, কর্ম ও তার ফল নিত্যসম্বন্ধ - কাৰ্য-কারণসূত্রে আবদ্ধ । প্ৰলয়কালে ইহা বীজভাবে ও সৃষ্টিকালে বিকাশভাবে থাকে; এইমাত্র প্রভেদ ।

সচরাচর চারপ্রকৃতির মানুষ দেখতে পাওয়া যায় । কেউ জ্ঞানপ্ৰধান প্ৰকৃতির লোক । এঁরা বিচার ভিন্ন কোন তত্ত্বই গ্রহণ করতে চান না । লোকের কথার উপর বিশ্বাস করে কোন কাৰ্য করতে চান না । দ্বিতীয়, ভক্তিপ্রধান প্রকৃতির লোক । এরা কারও উপর অটল বিশ্বাস স্থাপন করে তদাবলম্বনে অল্পস্বল্প বিচার করে থাকেন । তৃতীয়, কর্মপ্ৰধান প্রকৃতির লোক - এর পরোপকারাদি ধর্মই একমাত্র কর্তব্যবোধে সর্বদা কর্মেরই অনুষ্ঠান করে থাকেন । চতুর্থ যোগপ্রধান প্রকৃতির লোক । এরা মানসিক শক্তিসমূহের তন্ন তন্ন বিচার করে উন্নতির চরম সীমায় উপস্থিত হন । মানুষ এই চারটি ভাবের কোন একটিমাত্ৰ লয়ে অবস্থান করে, এরূপ বলা ভ্ৰম । তবে উহার মধ্যে একটি ভাব প্রত্যেকের মনে অধিক প্ৰবল থাকে, এইমাত্র । যার যে ভাব প্ৰবল থাকুক না কেন এবং যে যে-পথ অবলম্বন করে চলুক না কেন, উন্নতির চরম সীমায় সকলেই ভগবানের সহিত একতা উপলব্ধি করে থাকে এবং শাস্ত্র ঐ একতা উপলব্ধির চারটি বিশেষ পথ উপদেশ করে থাকেন । উহাদের নাম জ্ঞানযোগ, ভক্তিযোগ, কর্মযোগরাজযোগ । ভগবানের সহিত আমাদের যুক্ত করে বলেই এই চার মার্গ ‘যোগ’-শব্দে অভিহিত হয় । তন্মধ্যে সংক্ষেপে কৰ্মযোগের বিষয় বলছি । অহংভাব পরিত্যাগ করে বাসনাশূন্য হয়ে ভগবানের জন্য কর্ম করার নাম নিষ্কাম কর্ম । আহার-বিহার প্রভৃতি যে কোন কর্ম করবে, ভগবানের জন্য করছি এই ভাব মনে করবে । আমি কিংবা আমার জন্য ইহা করছি, ইহা না ভেবে ভগবানের জন্য করছি, এই ভাববে ।
[রামকৃষ্ণ মিশন সভা, ৪ঠা সেপ্টেম্বর, ১৮৯৮]


13) কর্মের দ্বিবিধ রূপ


শাস্ত্ৰে কৰ্মশব্দ দুই অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে । সাধারণতঃ মানুষ যা কিছু করে, তাকেই কর্ম বলা হয়েছে, কিন্তু শাস্ত্র যেখানে বলছেন, কর্ম হতে পৃথিবী উৎপন্ন হয়েছে - কর্ম হতে সূৰ্য চন্দ্র হয়েছে, সেখানে কর্মশব্দ, যে অচিন্তনীয় কাৰ্যকারণপ্রবাহ সমগ্র জগৎকে বীজাবস্থা হতে বিশিষ্ট নামরূপদ্বারা প্ৰকাশিত করছে, সেই কার্যকারণ-প্রবাহকে লক্ষ্য করে ব্যবহৃত হয়েছে । অদৃষ্ট অবস্থা হতে বস্তুর দৃষ্ট অবস্থান্তরে পরিনমণকেই কর্ম বলা হয়েছে, অতএব পরিবর্তন ও পরিনমণ-শক্তিই কর্মের প্রধান লক্ষণ । গীতা সেজন্যই বলেন - “ভূতভাবোদ্ভব করো বিসর্গঃ কৰ্মসংজ্ঞিতঃ” - অৰ্থাৎ যে ত্যাগ বা বর্জনের দ্বারা ভূতান্তরের উৎপত্তি হয়, তাহাই কর্ম ।

কর্ম দ্বিবিধ - সকাম ও নিষ্কাম । শাস্ত্ৰ কোন কর্মকেই মিথ্যা বলেননি; অনেকে বলেন, ‘সংসারে থেকে ভগবানকে পাওয়া যায় না । সংসারে মানুষ যা কিছু কর্ম করছে, সব মিথ্যা । তা দিয়ে কখনও ভগবদ্দর্শন হতে পারে না । সৰ্বকৰ্মসন্ন্যাসই ভগবৎপ্ৰাপ্তির একমাত্র উপায় ।” ইহা সম্পূর্ণ ভুল । শাস্ত্র অবস্থাবিশেষে কর্তব্যনির্দেশ করেছেন মাত্র । সংসারকে ছোট, সন্ন্যাসকে বড় করেননি । অবস্থাবিশেষে সংসার কারও পক্ষে ঠিক, আবার সন্ন্যাস কারও পক্ষে ঠিক - এই কথা বলেছেন । সকল কর্মই আমাদিগকে ভগবানের দিকে নিয়ে যাচ্ছে । কোন কৰ্মই মিথ্যা নয় । যাহা অত্যন্ত স্বার্থপর কর্ম, তাহা করতে করতেও লোকে নানারূপে ভুগে বহুদৰ্শিতা লাভ করে এবং ক্রমে নিষ্কাম কর্মের দিকে অগ্রসর হয় । ঐ নিষ্কাম ভাব আবার কালে পূর্ণতাপ্ৰাপ্ত হলে স্বভাবতঃ সন্ন্যাস এসে উপস্থিত হয় । ইহাই যথার্থ সন্ন্যাস । ইহা ভোগ ও ত্যাগ - এই দুই লক্ষণের অধিকারভুক্ত নয় । ইহা ঐ দুয়ের বাইরে । প্ৰথম হতে একেবারে কর্মত্যাগ করে সন্ন্যাসগ্রহণ করলে মানুষ অগ্রসর হতেই পারবে না । পরমহংসদেব এজন্যই বলতেন, “চর্মরোগ-আরোগ্য হলে শুষ্ক চৰ্ম শরীর হতে আপনিই খসে পড়ে । কিন্তু আরোগ্যলাভ হবার পূর্বেই ঐ চর্ম উঠাতে প্ৰয়াস পেলে যন্ত্রণা, রক্তপাত ও ক্ষতিবৃদ্ধিই হয়ে থাকে ।”

তিনি ঐ কথা আরও বিশদভাবে বুঝিয়ে বলতেন, “সংসার, সন্ন্যাস, কর্ম, জ্ঞান প্রভৃতি সকলই মানুষ্যের উন্নতির মাত্রায় আপনা-আপনি এসে উপস্থিত হয়, সেজন্য যার যেরূপ শরীর ও মনের অবস্থা, তার পক্ষে সেরূপ কর্মের ব্যবস্থা করা হয়েছে । যে ছেলের যেরূপ স্বাস্থ্য, তা বুঝে মা তার জন্য উপযোগী পথ্য ব্যবস্থা করেন । আধ্যাত্মিক জগতেও সেরূপ । কোন কৰ্মই ধর্ম ছাড়া নয়, তবে যার যেরূপ অধিকার, তার পক্ষে সেরূপ ধর্মের ব্যবস্থা আছে । একরূপ ধৰ্মাচরণ সকলের পক্ষে উপযোগী হতে পারে না ।

শাস্ত্রে দুটি মার্গের বর্ণনা আছে - প্ৰবৃত্তি ও নিবৃত্তি । যার সুখভোগের ইচ্ছা প্ৰবল, সে ধর্মানুষ্ঠান করতে গেলে স্বভাবত; যাগযজ্ঞাদিলক্ষণ সকাম কৰ্মে প্ৰবৃত্ত হবে । সুখাদিভোগের পর কালে যখন সে দেখবে তার প্রাণ অন্য কিছু উচ্চ বস্তু চাইছে, তখন সে আপনিই উহা ছেড়ে নিবৃত্তিমাৰ্গ আশ্রয় করবে । রাজা যযাতি পুরুর নিকট হতে তাঁর যৌবন গ্ৰহণ করে সহস্ৰ বৎসর ভোগ করে যখন আবার তাঁকে ঐ যৌবন ফিরিয়ে দিলেন, তখন বললেন, “কাম্যবস্তুসকলের উপভোগে কামনা কখনও পরিতৃপ্ত হয় না, বরং অগ্নিতে ঘৃতাহুতি-দানের ন্যায় উহা বৃদ্ধিই পেতে থাকে ।” যযাতির এই জ্ঞান ও বৈরাগ্য সহস্ৰ বৎসর বিষয়োপভোগ ও সকাম কর্মের দ্বারাই উৎপন্ন হয়েছিল ।

প্ৰবৃত্তিমাৰ্গ যেন ছাতের সিঁড়িস্বরূপ; ইহা অবলম্বন করে নিবৃত্তিমার্গে ছাতের উপরে উঠতে হয় । এক্ষণে প্রশ্ন হতে পারে, কার কিরূপ কৰ্ম করা উচিত, তা কে নির্ধারণ করবে ? ইহা নির্ধারণ করতে একমাত্ৰ সদগুরুই সমর্থ । যার যেরূপ মানসিক অবস্থা গুরু তার জন্য সেরূপ ধৰ্ম ব্যবস্থা করেন ।

গুরুকরণ করতে হলে গুরুকে বিশেষ পরীক্ষা করে নিতে হয় । ইহাই শাস্ত্রের মত । গুরুর পুত্ৰকেই গুরু করতে হবে, ইহা সৎশাস্ত্রানুমোদিত নয় । শাস্ত্ৰ বলেন, গুরুকে বিশেষরূপে দেখে তবে তাঁতে বিশ্বাসস্থাপন করবে । কিন্তু একবার বিশ্বাস করলে আর কোনরূপ সন্দেহ করবে না । পরমহংসদেব তাঁর নিজের সম্বন্ধে বলতেন, “খুব বাজিয়ে নে ।” বিশেষ পৰ্যালোচনা করে দেখলে আমরা দেখতে পাই যে, তিনি শাস্ত্র ছাড়া কোন কাজ করতেন না । তাঁর জীবন বেদবেদান্তের টীকাস্বরূপ । তাঁর ইষ্ঠায় ধৰ্মবীর মহাপুরুষগণ ধর্মরক্ষা করতেই আসেন । হিন্দু, খ্ৰীষ্টান প্ৰভৃতি সকল ধর্মের মহাপুরুষগণই একবাক্যে বলে গেছেন যে, তাঁরা পূর্ব পূর্ব শাস্ত্র ও ধর্ম-রক্ষণের জন্যই এসেছেন, কোন শাস্ত্ৰ বা ধর্ম-ধ্বংসের জন্য তাঁদের শরীর পরিগ্রহ হয়নি ।

নিষ্কাম কর্মের অর্থ - স্বাৰ্থশূন্য হয়ে কর্ম করা, আপনাকে ভুলে নিজের সুখের দিকে দৃষ্টি না করে ভগবানের জন্য কাজ করা । সকল অবস্থাতেই স্বাৰ্থশূন্য হয়ে কাজ করতে পারা যায় । স্বাৰ্থশূন্য হয়ে কাজ করার নামই কৰ্মযোগ । এখানে প্রশ্ন হতে পারে স্বার্থপরতা কখনো কাহারও কি নিঃশেষে ত্যাগ হতে পারে ? আমরা দেখতে পাই কারও স্বাৰ্থ নিজের শরীয়-মনের উপরেই আবদ্ধ, কারও নিজের পরিবারের উপর, কারও দেশের উপর, আবার কারও বা সমুদয় জগতে বিস্তৃত । বুদ্ধদেব একটা ছাগলের জন্য প্ৰাণ দিতে গিয়েছিলেন । কেউ কেউ বলেন, তাতেও কি স্বার্থপরতা নেই ? "অপরের জন্য ঐ রূপে প্ৰাণ-বিসর্জনে যে আনন্দলাভ হয়, উহাই তাঁর স্বার্থ । উত্তরে বলা যেতে পারে, স্বার্থের ঐরূপ বিস্তৃতি ও নিঃস্বার্থতা একই বস্তু । যার মন-বুদ্ধি নিজের শরীর-মনের উপর আবদ্ধ, সে-ই যথার্থ স্বার্থপর ও কৃপাপাত্র । নিজের শরীরমন ছেড়ে অপরের সুখে সুখী ও দুঃখে দুঃখী হওয়া-রূপ স্বাৰ্থই নিঃস্বার্থতা নামে নির্দিষ্ট হয়ে থাকে। কারণ সে স্বাৰ্থ বন্ধনের কারণ না হয়ে মনুষ্যকে মনুষ্যনামের উপযুক্ত করে ও ভগবানের দিকে অগ্রসর করে দেয় । মনুষ্য যে পরিমাণে উন্নত হতে থাকে, তার স্বার্থদৃষ্টিও সেই পরিমাণে নিজ শরীর-মন প্রভৃতির ক্ষুদ্র সীমা অতিক্রম করে উচ্চ উচ্চতর স্তরে উন্নীত হতে থাকে । পরিশেষে তার ক্ষুদ্র আমিত্ব এককালে চলে গিয়ে তার স্থলে এক বিরাট মহান্‌ আমিত্বের সমাবেশ হয়, যার ঘাত-প্ৰতিঘাত সমগ্র জগৎ জুড়ে হতে থাকে । একেই ব্ৰহ্মজ্ঞানাবস্থা বা মুক্তি বলে ।

আমরা তিন প্রকারে অপরের উপকার করতে পারি । কেউ ক্ষুধার্ত হলে অন্ন দিয়ে তার ক্ষুধানিবৃত্তি করতে পারি । ঐ উপকার স্থূলশারীর সম্বন্ধীয় ও ক্ষণস্থায়ী, ছয় ঘণ্টা পরে আবার তার ক্ষুধার উদ্রেক ও অভাববোধ হবে । দ্বিতীয়তঃ, তাকে এরূপ শিক্ষা দিতে পারি, যাতে সে সর্বদা উপাজন করে নিজের জীবনোপায় নিজে করে নিতে পারে । এই উপকার অনেক দিন স্থায়ী ও মানসিক । তৃতীয়তঃ, আধ্যাত্মিক উপকার; ইহার ফল আরও বিস্তৃত । এর প্রভাবে তার মনের সর্বপ্রকার অভাব-বোধ চিরজীবনের জন্য নিবৃত্ত হয়ে যায় । এরূপ উপকার ধর্মোন্নত মহাপুরুষেরাই কেবলমাত্র করতে পারেন ।

একদিন ভগবান ঈশা রৌদ্রে ঘর্মাক্ত হয়ে একটি কূপের নিকট বসেছিলেন । একজন নীচজাতীয় স্ত্রীলোক জল নিতে এল । ঈশা তার নিকট জল পান করতে চাইলে সে আশ্চর্য হয়ে বললে, আমার হাতে আপনি জলপান করবেন ?

প্রত্যুত্তরে তিনি সম্মতিজ্ঞাপন ও জলপান করে বললেন, “এর বিনিময়ে আমি তোমাকে যে জল দিব, তাতে তোমার চিরজীবনের মত তৃষ্ণা মিটে যাবে ।” এরূপ দৃষ্টান্ত আমাদের শাস্ত্ৰেও শ্ৰীকৃষ্ণ, বুদ্ধ প্রভৃতি অবতারের চরিত্রে এবং পওহারীবাবা, ত্রৈলঙ্গ স্বামী প্রভৃতি সিদ্ধপুরুষগণের জীবনেও দেখতে পাওয়া যায় ।

আমরা যে কাজই করি না কেন, ভগবানের জন্য করছি, নিজের জন্য নয় - এরূপ ভেবে করতে হবে । সামান্য রাস্তা ঝাঁট যে দেয়, সে যদি সৰ্বসাধারণকে ভগবানের অংশ ভেবে তাঁর সেবার জন্য রাস্তা ঝাঁট দিচ্ছি এরূপ চিন্তা করে, তা হলে তার আর ঐ কর্মে কোন কষ্টবোধ হয় না । এরূপ কোন কৰ্মই নেই যা সম্পূর্ণ ভাল, অথবা যাতে কিছুমাত্ৰ দোষ নেই । আমরা এই যে ভগবচ্চৰ্চা করছি, তাতেও সকলে উপকৃত হচ্ছে না; মুখনিঃসৃত উষ্ণ বায়ুতে বায়ুসাগরে ভাসমান কত কীটাণুর মৃত্যু হচ্ছে । সকল কর্মই এরূপে ভালমন্দ মিশ্রিত হলেও যদি নিঃস্বার্থভাবে করা যায়, তা হলে উহার দোষ আমাদিগকে স্পর্শ করে না । শরীররক্ষার উপযোগী আহার-শয়নাদির সম্বন্ধেও যদি ভাবা যায় যে, আহার শয়নাদির উদ্দেশ্য শরীর রক্ষা, শরীর থাকলে তবে ভগবৎসাধন হবে; অতএব আহার-শয়নাদিও ভগবৎ-প্ৰাপ্তির জন্যই করছি, তবে এগুলিও নিষ্কামভাবে অনুষ্ঠিত হল । সকল কাৰ্যে ঐ রূপ করলে কর্মফলের দিকে আর দৃষ্টি থাকে না ও তজ্জনিত সুখদুঃখে আমাদিগকে আর আক্রান্ত হতে হয় না । কৰ্ম এরূপেই বন্ধনের কারণ না হয়ে অনুষ্ঠাতার মুক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায় ।

আমরা পূর্বেই বলেছি কর্ম অনাদি এবং কর্মের দ্বারাই শাস্ত্র জগতে বৈষম্যের ব্যাখ্যা করেছেন । কর্মের জন্যই এই বৈষম্য হয়েছে । যার যেরূপ কর্ম, সে সেরূপ অবস্থা পেয়েছে । কেউ কেউ এই বৈষম্যের অন্য কারণ নির্দেশ করে বলেন, জন্মসময়ে গ্ৰহাদির শুভ বা অশুভ যেরূপ সংস্থান থাকে, মানুষ সেরূপ অবস্থাপন্ন হয় । শুভগ্ৰহ থাকলে উত্তম জন্ম হয়, অশুভ গ্রহ থাকলে কুৎসিত জন্ম হয় । এর উত্তরে তাকে প্রশ্ন করা যেতে পারে - আমারই বা অশুভ গ্রহে জন্ম হল কেন এবং অপরেরই বা শুভ গ্রহে কেন জন্ম হল ? এই শুভাশুভ গ্ৰহ আমার জন্মের গতিনির্দেশক হতে পারে, কিন্তু কারণ হতে পারে না । এর কারণ অবশ্য আর কিছু আছে, যার জন্য আমার অশুভ জন্ম হচ্ছে । শাস্ত্ৰ জীবের পূর্বজন্মের কর্মকেই ঐ কারণ বলেন । কেউ কেউ আবার বলেন, পিতামাতার মানসিক ও শারীরিক অবস্থা সন্তানে সংক্রমিত হয় । পিতামাতার রোগাদি পর্যন্ত সন্তান প্ৰাপ্ত হয় । অতএব পিতামাতাই পূর্বোক্ত বৈষম্যের (hereditary transmission) কারণ । উত্তরে বলা যেতে পারে যে, তা হলে সন্তানের জন্মে পিতামাতার মানসিক শক্তির ক্ষয় হওয়া উচিত, কিন্তু তা হতে তো দেখা যায় না । আবার সামান্য-শক্তিশালী পিতামাতা হতে কখনো কখনো অদ্ভুতগুণসম্পন্ন সন্তান জন্মাতে দেখা যায় । উহাই বা কিরূপে হয় ? শুদ্ধোদনের ন্যায় অনেক ক্ষত্ৰিয় রাজা ছিলেন; কিন্তু তাদের কারও না হয়ে রাজা শুদ্ধোদনেরই কেন বুদ্ধদেবের ন্যায় উদারহৃদয়, বাল্যকাল হতেই সমাধিমগ্ন সন্তান উৎপন্ন হল ? ভগবান বুদ্ধ, ঈশা প্রভৃতি অবতার-পুরুষসকলের কথা ছেড়ে দিলেও মানবসাধারণের ভেতর ঐরূপ ঘটনা নিত্য হতে দেখা যায় । কোথা হতে ঐ রূপ হয় ? কাৰ্য কারণ হতে অধিক শক্তিসম্পন্ন কখনই তো হতে পারে না, তবে কেন ঐরূপ হয় ? দেখা যায় কর্মবাদেই কেবলমাত্র ঐরূপ প্ৰশ্নসকলের মীমাংসা পাওয়া যায় । মানবের প্রকৃতিই এরূপ যে, অন্যের উপর দোষারোপ করতে পারলে নিজের স্কন্ধে কখনও দোষ নেয় না । সেজন্যই সংসারে তার দুঃখ-কষ্ট পাবার কারণ-স্বরূপে সে হয় ভগবান, নয় গ্ৰহনক্ষত্র, নয় পিতামাতা ইত্যাদিকে নির্দেশ করে নিশ্চিন্ত হয়ে বসে । স্বয়ং যে সে তার ঐ রূপ কষ্টের কারণ, তা বলা দূরে থাকুক, একবার মনেও আনে না ! শাস্ত্রই তখন তার চক্ষে অঙ্গুলি প্ৰদান করে বলে, তোমার কষ্টের কারণ তুমি নিজেই, অপর কেউ নয় । কিন্তু তাতে ভয়ের কারণ নেই । যে শক্তিদ্বারা তুমি এই কষ্ট পাচ্ছ, তা দ্বারাই আবার তুমি উন্নত হতে পারবে । দুষ্কৰ্ম করেছ, তাতে ভয় কি ? আবার চেষ্টা কর, অনন্ত শক্তি তোমার রয়েছে, তোমার এ অবস্থার নিশ্চিত পরিবর্তন হবে । বেদ বলেন, “দ্রঢ়িষ্ঠো বলিষ্ঠো মেধাবী” পুরুষেরই ধৰ্মলাভ হয় । সাহস চাই, তেজ চাই; নির্জীব মন ও শরীরের দ্বারা ধর্মলাভ হয় না । নিৰ্ভীক হৃদয়ে আবার চেষ্টা কর, কর্ম কর, ধর্মপথে নিশ্চয় অগ্রসর হবে ।
[রামকৃষ্ণ মিশন সভা, ১০ই সেপ্টেম্বর, ১৮৯৮]


14) কর্ম-রহস্য


নিঃস্বাৰ্থ হয়ে ফলাকাঙ্ক্ষা না করে যে কৰ্ম করা যায়, তাকে কৰ্মযোগ বলে । কর্মফলের আকাঙ্ক্ষায় কর্ম করলে সুখ-দুঃখাদি কৰ্মফল ভোগ করতেই হবে । একটি কর্ম আবার অন্য কর্ম উৎপাদন করবে । এরূপে কৰ্মফলভোগ নিয়ত চলতে থাকবে । এখন প্রশ্ন হতে পারে, যদি কৰ্ম করলেই তার ফলভোগ অবশ্যম্ভাবী হয়, তবে কি মুক্তির সম্ভাবনা নেই ? শাস্ত্ৰ বলেন, আছে । নিষ্কাম হয়ে, নিঃস্বার্থ হয়ে কর্ম কর । কর্মফলের প্ৰতি লক্ষ্য না রেখে কৰ্ম কর; তা হলে আর কর্মফলে লিপ্ত হতে হবে না । বলতে পার, বাসনা শূন্য হয়ে কর্ম কি করা যায় ? কোনো-না-কোনো বাসনা হতেই তো কর্মের জন্ম । ভগবদ্দর্শন করব, এটাও তো একটা বাসনা । উত্তরে যা পরমহংসদেব বলতেন তাই বলি, “ভগবদ্দর্শনবাসনা বাসনার মধ্যে নয় । যেমন মিছরি মিষ্টির মধ্যে নয় ।” অর্থাৎ মিষ্টান্ন-ভিক্ষণের যে অপকারিতা, তা মিছরিতে নেই বললেই হয়; তবে কি কৰ্ম করাই দোষ ? কৰ্ম কি তবে বন্ধনের উপর বন্ধন এনে মানুষের শ্ৰেষ্ঠতম জীবনোদ্দেশ্যের পথে নিয়ত বিঘ্ন-বাধাই নিয়ে আসে ? শাস্ত্ৰ বলেন - না, কর্মে কোন দোষ নেই । তবে আমরা যে ভাবে কর্ম করি, সেই ভাবানুযায়ী উহা গুণ ও দোষ-বিশিষ্ট হয় । কর্মে স্বভাবতঃই যদি দোষ থাকত, তবে অত্যাচারীর হস্ত হতে দুর্বলকে রক্ষা করবার জন্য নরহত্যা করেও মানুষ বীরাগ্রণী বলে পরিচিত হত না । অবলার প্রাণ ও সতীত্ব রক্ষার জন্য লম্পটকে হত্যা করেও মানুষ আমাদের পূজনীয় হত না, অথবা দারিদ্রদুঃখ-কাতর সহৃদয় পুরুষেরা নিজ আত্মীয়বর্গের সুখ উপেক্ষা করেও সমাজে যশভোগী হতেন না । ভগবৎপ্রসাদ লাভ করে জীবনের চরম সার্থকতা শেখবার ও শেখাবার জন্য আত্মীয়, সমাজ প্রভৃতি সমস্ত উপেক্ষা করে সন্ন্যাসিবর্গও আমাদের স্বার্থের শীর্ষস্থানীয় হয়ে থাকতেন না । অতএব দেখা যাচ্ছে হিংসা, হত্যারূপ কর্মও যখন স্বার্থের জন্য কৃত না হয়ে কোন এক মহদুদ্দেশ্যের জন্য সাধিত হয়, তখন কর্তা দোষভাগী হয় না ।

অতএব কর্মে কোন দোষ নেই । আমাদের উদ্দেশ্য অনুযায়ী কর্ম ভাল বা মন্দ হয়ে থাকে - কর্মের স্বরূপে কোন দোষ নেই । অগ্নিতে রন্ধন ও গৃহদাহাদি উভয় কাৰ্যই হচ্ছে, তাতে অগ্নির কোন দোষ নেই । সূর্যের প্রতিবিম্ব সকল জলে পড়ছে, কিন্তু জলের নির্মলতা-অনুসারে প্রতিচ্ছায়ার তারতম্য হয়ে থাকে, এতে সূর্যের কোন দোষ নেই । তবে কিরূপে কৰ্ম করলে দোষ ভাগী হতে হবে না ? শাস্ত্র বলেন, যদি স্বাৰ্থ না থাকে এবং কর্মফলে আসক্তি না থাকলে সুখ বা দুঃখরূপ ফল উৎপন্ন হলেও কর্তার মন বিচলিত হবে না । সুতরাং তা আর বন্ধনের কারণ হবে না ।

দেখা গিয়েছে, বাসনা হতেই কর্মের জন্ম । নিজ নিজ মনের দিকে দৃষ্টি করলে মনে নানা বাসনা রয়েছে দেখা যায় । এমন কি, মনটিকে বাসনাময় বা নানা বাসনার সমষ্টি বলে বোধ হয় । সমুদয় বাসনা দূর হলে মনের অস্তিত্ব থাকবে কি না সে বিষয়েও সন্দেহ উপস্থিত হয় । আবার দেখা যায়, বাসনার সকলগুলিই সমান তীব্র নয় । কোনটি ‘এখনই সম্পন্ন হউক’ - মনে এইরূপ হয়; কোনটি হলে ভাল, না হলেও ভাল, অপর একটি না হয় তো ভাল হয় - এইরূপ মনে হয় । এই প্রকারে মন ভিন্ন ভিন্ন বাসনাসম্বন্ধে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে অবস্থিত দেখা যায় । বাসনাটি মনে উঠলেই আবার কার্য হয় না । একদিন, দুদিন, দশদিন উঠতে উঠতে একদিন মনে বলে - এটি না হলেই নয় এবং শরীর ও ইন্দ্ৰিয়সমূহকে উহা যাতে সফল হয়, তদ্বিষয়ে নিয়োগ করে । ঐ রূপ নিয়োগকেই আমরা সচরাচর কর্ম বলে থাকি । অতএব ঘনীভূত বাসনাই কর্মরূপে পরিণত হয়ে পুরুষকে সুখদুঃখরূপ ফল এনে দেয় এবং সেই সুখদুঃখময় কর্ম আবার অপর একটি সংস্কারের জনক হয় । মনে সঞ্চিত সূক্ষ্ম বাসনাসকলের নামই সংস্কার । ঐ সংস্কার সকলের সমান নয়; কারও কোনটি বাল্যকাল হতে প্ৰবল, কারও কোনো কোনো সংস্কার আদৌ নেই । কেউ বা সুসংস্কারের বশবর্তী হয়ে আজীবন সৎকাৰ্যই করে গেল, আবার অন্য কেউ কুসংস্কারচালিত হয়ে কুকাৰ্য করে লোকের নিন্দাভাজন হয়ে গেল । কেউ বা বুদ্ধিমান, ধার্মিক, যশস্বী; কেউ বা তার ঠিক বিপরীত হল ।

কোথা হতে সংস্কার এত ভিন্ন ভিন্ন হল ? বাল্যকাল হতেই যখন কাকেও সৎ, কাকেও অসৎ দেখছি তখন বাসনা ঘনীভূত হয়ে সৎ বা অসৎ সংস্কাররূপে পরিণত হবারই বা সময় কোথায় ? অথবা কর্ম ও সংস্কার যদি বৃক্ষবীজসম্বন্ধেই গ্রথিত ও প্রবাহিত হয়ে থাকে, তবে সে কৰ্মই বা কোথায় — যা শৈশবেও সংস্কাররূপে দেখা দিতে পারে ? শাস্ত্র বলেন, পূৰ্বজন্মকৃত কৰ্মই বাল্যসংস্কাররূপে দেখা দেয় । পূর্ব জন্মের সৎ বা অসৎ অভ্যাস ইহজন্মের ভালমন্দ সংস্কাররূপে প্ৰকাশিত হয় । এই বাল্যসংস্কারসমূহকে আমরা ‘স্বভাব’ কথায় বিপরীত অৰ্থ কল্পনা করে কখনো ভগবানে, কখনো সৃষ্টিকাৰ্যে দোষারোপ করে থাকি । কখনো স্বভাব শব্দ কারণহীন অর্থে প্রয়োগ করি এবং কখনো বা কোন এক অদৃষ্ট অননুভূত কারণ, যার হস্তে মানুষ যন্ত্র-স্বরূপ হয়ে রয়েছে, এরূপ অর্থে প্রয়োগ করি । এরূপে মানব কুসংস্কারভারবাহী ঘোরতর অদৃষ্টবাদী হয়ে বা কাৰ্যকারণ-প্রবাহের মূলোচ্ছেদ করে, নাস্তিকতার পথ অবলম্বন করে যথার্থ সত্য হতে বহুদূরে অপনীত হয় ।

কর্মবাদ সত্য হলে পুনর্জন্মবাদও তার সঙ্গে অবশ্য সত্যরূপে উপস্থিত হয় । মৃত্যুকালে আত্মা একদেহ হতে দেহান্তরে আশ্রয়গ্ৰহণ করেন । স্থুল দেহ পড়ে থাকে, কিন্তু সূক্ষ্ম শরীর সেই জন্মের সমুদয় সংস্কার নিয়ে তদুপযোগী দেহ গঠন করে । সেই নবীন দেহে তার পূর্বজন্মের কর্মফল আবার পরিস্ফুট হয়। আমরা দেখেছি, পিতামাতার দোষ গুণ সন্তানের দেহ ও মন আশ্রয় করে । তার কারণ-সন্তানের কাৰ্যফল, যে পিতামাতা তাকে সেরূপ দোষ বা গুণযুক্ত সংস্কারসমূহ পরিস্ফুট হবার উপযোগী দেহ দিতে পারেন, সেইরূপ পিতামাতার নিকটেই তাকে আকর্ষণ করে । শাস্ত্ৰ বলছেন, জোঁক যেমন এক পাতা হতে অন্য পাতা আশ্রয় করে, আমরা সেরূপ এক কর্ম হতে কর্মান্তর আশ্রয় করে থাকি । অতএব কর্ম এরূপে করতে হবে, যাতে ক্ৰমে নিম্নতর হতে উচ্চতর কর্ম অবলম্বন করতে পারা যায় । আবার জোঁক যেমন অপর একটি অবলম্বন গ্ৰহণ না করে পূর্ব অবলম্বন ত্যাগ করে না, সেরূপ এক কৰ্ম আশ্রয় না করে অন্য কর্ম ত্যাগ করা যায় না ।

নীচ হতে উচ্চ কর্ম কিরূপে অবলম্বন করা যেতে পারে ? মহৎ হতে মহত্তর উদ্দেশ্য অবলম্বন কর, দেখবে তোমার কর্মও উচ্চ হতে উচ্চতর স্তরে প্রবাহিত হচ্ছে । একেবারে সর্বোচ্চ উদ্দেশ্য আশ্ৰয় করে কর্ম করতে পারছ না বলে হতাশ হয়ে না । ধীর দৃঢ়পদে অসীম সাহসে বুক বেঁধে শনৈঃ শনৈঃ ভগবানের প্রসাদ ও সাক্ষাৎকার-লাভরূপ জীবনের মহান্‌ উদ্দেশ্যের পথে অগ্রসর হতে হবে ।

আমাদের অনেকেরই একটা ভুল ধারণা আছে যে, সংসারে থাকলে ধর্ম হয় না, ভগবান লাভ হয় না । সংসার কাকে বলে ? যে বস্তু আমাদিগকে ঈশ্বরের দিকে অগ্রসর হতে দেয় না, তাই সংসার-নামে অভিহিত হয় । পূৰ্বজন্মকৃত যে-সকল সংস্কার আমাকে ঈশ্বরপথে অগ্রসর হতে দিচ্ছে না, সর্বদা সত্যোদ্দেশ্য হতে বিচলিত করছে, তাই আমার সংসার । এরূপ ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তির ভিন্ন ভিন্ন সংসার বর্তমান রয়েছে । কারও কাম, কারও ক্ৰোধ, কারও ধনচিন্তা ঈশ্বরপথের কণ্টক । এরূপ বিশেষ বিশেষ সংসার হতে মনের গতি ফেরাতে কোন উচ্চ উদ্দেশ্য অবলম্বন করতে হবে । ঐরূপ করলেই যে কর্মস্রোত এতকাল নীচের দিকে যাচ্ছিল, তার বেগ ফিরে অন্য দিকে চালিত হবে এবং যা পূর্বে ঈশ্বরপথের প্রতিবন্ধক ছিল, তাই আবার ঈশ্বরপথের সহায় হয়ে দাড়াবে । সংসারে থেকেই ঐরূপ করতে হবে । আমাদের সকলেরই ভেতর মহাশক্তি বর্তমান রয়েছে, অজ্ঞানে আবৃত আছি বলেই আমরা তা বুঝতে পারছি না । শারীরিক ও মানসিক শক্তির অপব্যয় না করে উচ্চতর পথে চালিত করতে হবে; তা হলে আমরা ঈশ্বরের দিকে অগ্রসর হতে পারব । দেখা গিয়েছে, কর্মে কোন দোষ নেই; দোষ আছে কেবল যে উদ্দেশ্য নিয়ে আমরা কর্ম করি তাতে; কর্তব্যজ্ঞানে কর্ম কর, কর্মকে ভালবেসে কর্ম কর, ফলের দিকে লক্ষ্য রেখো না । তা হলে কর্ম আমাদিগকে ঈশ্বরের দিকে নিয়ে যাবেই যাবে । ঈশ্বরের সৃষ্টিরূপ খেলার ভেতর বন্ধনযুক্ত হবার, তাঁকে পাবার এই প্ৰণালী বিদ্যমান রয়েছে । এরূপে তাঁর দিকে অগ্রসর হতে হবে ।

এরূপে কৰ্ম করলে কালে যথার্থ নিঃস্বার্থতা এসে উপস্থিত হবে । প্রশ্ন হতে পারে, সম্পূর্ণ নিঃস্বাৰ্থ হলে আর কি সে কোন কর্ম করতে পারে বা করে থাকে ? শাস্ত্র বলেন, সমুদ্রবৎ গম্ভীর, সুমেরুবৎ স্থির নিঃস্বাৰ্থ পুরুষ কেবল জগতের কল্যাণের নিমিত্ত কর্ম করেন । আব্ৰহ্মস্তম্ব পর্যন্ত সমস্তই সাক্ষাৎ ভগবান জেনে তিনি সেই বিরাট পুরুষের সেব করেন ।

প্রশ্ন হতে পারে, যদি কৰ্মই আমাদিগকে বিশেষ বিশেষ পিতামাতার দ্বারা দেহধারণ করায়, তা হলে অবতারাদি সম্বন্ধে যে শাস্ত্ৰপ্ৰমাণ আছে – “যে তাঁরা পূর্ব পূর্ব সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেন, পূর্ব পূর্ব বারের সহধর্মিণীই পুনরায় তাদের সহিত জন্মগ্রহণ করে থাকেন, তাঁদের মধ্যে এই নিত্যসম্বন্ধ কিরূপে স্থাপিত হয় ? ইহা কি সৃষ্টিপ্ৰণালীর একটি বিশেষ নিয়ম ? কাৰ্যকারণময় কর্মপ্রবাহের বেগ জগতের সর্বত্র ধাবিত রয়েছে, এর মধ্যে বিশেষ নিয়ম কিরূপেই বা সম্ভবে ? আবার মনুষ্যদেহ ধারণ করে ভগবান যখন মনুষ্যকে শিক্ষা দিতেই অবতীর্ণ হন, তখন নিজের সম্বন্ধে একটি বিশেষ নিয়ম প্রবর্তন করলে তাঁর শিক্ষাপ্রদানেরই বা সার্থকতা থাকে কোথায় ? স্বল্পশক্তি ভিন্ননিয়মাধীন মানবই বা সে শিক্ষা নিতে পারবে কিরূপে ? পিতামাতা স্ত্রীপুত্ৰাদির সহিত তো আমাদিগের নিত্যসম্বন্ধ বর্তমান নেই । তবে অবতারাদিসম্বন্ধে এরূপ হবার কারণ কি ? এর উত্তর - অবতারপুরুষের সাঙ্গোপাঙ্গগণ তাঁকে নিঃস্বার্থভাবে ভালবেসেছিল, সেইজন্য তারা তাঁর সহিত নিত্যসম্বন্ধ । আমরা স্বার্থের জন্য ভালবাসি । পিতামাতা, স্ত্রীপুত্র প্রভৃতি সকলকেই আমরা স্বার্থসিদ্ধির জন্য ভালবেসে থাকি । স্ত্রীর সুখের জন্য যদি তাকে ভালবাসাতাম, তা হলে আমাদের সম্বন্ধ নিত্য হত । কিন্তু আমরা কি তা করি ? ভালবাসার স্বরূপ স্বাধীনতা - দাসত্ব নয়, নিঃস্বাৰ্থতা - সুখলালসা নয় । যখনি কাকেও যথার্থ ভালবাসবে, তখনি তাকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে হবে । তার সুখ দেখতে হবে, নিজের সুখ দেখলে চলবে না । কিন্তু আমরা কি করে থাকি ? যা’দিগকে ভালবাসি তা’দিগকে আপনার অধীন করতে চাই । আমার কথা শুনবে, আমি যা ভাল বুঝি, তাকে তাই ভাল বুঝতে হবে । এরূপে তা’দিগকে ঘোরতর বন্ধনে বদ্ধ করতে যাই । এই জন্যই আমাদের সম্বন্ধ-বন্ধন নিয়ত ছিন্ন হচ্ছে এবং আমরা পরস্পর বিপরীত কেন্দ্ৰে উপস্থিত হচ্ছি । বিদ্যুৎ-আদি জড়শক্তিকে আয়ত্ত করতে গেলেও যখন তার স্বভাব, কাৰ্যপ্রণালী প্ৰভৃতি বিশেষৰূপে জেনে সেই উপায়ে অগ্রসর হতে হয়, তখন অনন্তস্বাধীনস্বভাব মনুষ্যমনকে কি তার স্বভাববিরুদ্ধ প্ৰণালীতে বশীভূত করে রাখতে পারা যায় ? কোনো-না-কোনো দিন তার সেই বন্ধন অসহ্য হয়ে উঠবে এবং স্বভাবনিহিত নিদ্রিত শক্তি জাগরিত হয়ে সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে ফেলবে ।

আমাদের দেশে এইরূপ ভালবাসা এখন অত্যন্ত প্ৰবল । দাসত্ববন্ধনই এর অপর নাম । সেজন্য দেশেরও এত দুরবস্থা । শাস্ত্ৰ বলেন, সমগ্র জগৎ এক সূত্রে গ্রথিত রয়েছে । সেইজন্যই একের অপকারে অপরের অপকার হচ্ছে । একের দোষে অপরে কষ্ট পাচ্ছে । অন্যের অমঙ্গল হলে আমাকেও তার জন্য কষ্ট পেতে হয় । এরূপ নিয়ম বর্তমান থাকতে অপরকে অধীন করে নিজে উচ্চ হবার চেষ্টা কখনই সিদ্ধ হতে পারে না । এই স্বাধীনতা-সংগ্রাম জড় হতে চেতন পর্যন্ত সমগ্র জগতে মহাবেগে প্রবর্তিত রয়েছে । এক পরমাণু অপর হতে বিযুক্ত হতে চেষ্টা করছে । পৃথিবী সূর্য হতে এবং সুর্য সূৰ্যান্তর হতে পলায়ন করতে চেষ্টা করছে । চোর এই স্বাধীনতার প্রেরণায় যথার্থ পথ না জানায় চুরি করেছে, আবার সাধু মহাপুরুষেরা ঈশ্বরকৃপায় স্বাৰ্থহীন বিশুদ্ধ ভালবাসাই এই স্বাধীনতালাভের একমাত্র পথ জেনে দিন দিন জীবনের মহান্‌ লক্ষ্যের দিকে অগ্রসর হচ্ছেন । এই স্বাধীনতালাভের জন্য সংগ্রামই মনুষ্যকে উচ্চ হতে উচ্চতর সোপানে আরোহণ করাচ্ছে এবং অবশেষে পূর্ণ জ্ঞানভত্তিতে ঈশ্বরের সহিত সম্মিলিত করে অনন্তু শক্তির অধিকারী করে দিচ্ছে । এ স্বাধীনতালোপ জগতে কে কারই বা করতে পারে ? স্ত্রী, পুত্র, পিতা, মাতা, বন্ধু, গুরু প্ৰভৃতির সহিত যদি নিত্যসম্বন্ধে সম্বন্ধ হতে চাও তো নিজের স্বার্থকে বলি দিয়ে তাদের সুখে সুখী হও । ভগবানের মূর্তি জেনে তাদের সেবায় রত থাক । জগতের যাবতীয় স্ত্রীকে দেবীজ্ঞানে ও পুরুষকে দেবতাজ্ঞানে দর্শন করতে চেষ্টা পাও এবং তাদের প্রতি তদ্রূপ সম্মান ও ভক্তি প্ৰদৰ্শন কর ।

এখন বেদান্তের বিবর্তনবাদের বিষয় কিছু বলে আজকার বক্তব্য শেষ করব । আমরা এই সৃষ্টিকাৰ্য দুই দিক দিয়ে অবলোকন করতে পারি । মনুষ্যের দিক দিয়ে দেখলে আমরা সৃষ্টি, তার ক্রম, নিয়ম, শক্তি প্ৰভৃতি এবং পাপ-পুণ্য, সুখ-দুঃখ, জ্ঞান-অজ্ঞান, হিতাহিত প্ৰভৃতিকে সত্য বলে দেখতে পাই । কিন্তু যদি কল্পনাসহায়ে ভগবানের দিক হতে এই সৃষ্টি দেখবার চেষ্টা করি, তা হলে কি দেখি ? সৃষ্টি ও সৃষ্টির ভেতরের কিছুরই বিদ্যমানতা দেখতে পাই না । কারণ সৃষ্টি তো সেই ভগবানেই রয়েছে । তিনি ছাড়া তো সৃষ্টিতে কিছুই অপর নেই । অতএব যদি কেউ কোন উপায়ে জগৎ-সম্বন্ধে ঈশ্বরের ন্যায় দৃষ্টিলাভ করতে পারে, তবে সে আর কখনই জগৎকে আমাদের মত দেখতে পারে না । জগৎ দেখতে হলে আপনাকে জগৎ হতে অন্ততঃ কিছু ভিন্ন না করে উহা কখনও দেখা সম্ভবে না । অতএব যিনি সৃষ্টি ও স্ৰষ্টার সহিত সর্বতোভাবে একত্ব অনুভব করছেন, তাঁর নিকট জগতের অস্তিত্ব নেই । এই শেষোক্ত অবস্থাই বেদান্তের বিবর্তবাদ নামে কথিত হয় এবং এই অবস্থা প্ৰাপ্ত হতে হলে জগতের অস্তিত্ব, পাপপুণ্য প্রভৃতি সমুদয় সত্য বলে মেনে নিয়ে বহুকাল কৰ্ম-ভক্তি-জ্ঞান-যোগাদি দৃঢ় অধ্যবসায়ের সহিত অভ্যাস করতে হবে। তবেই আমাদের পরমাত্মার সহিত সম্পূর্ণ একত্ববোধ এসে উপস্থিত হবে । সেই বাক্যাতীত অবস্থার এক্ষণে আলোচনা নিম্প্রয়োজন ।
[রামকৃষ্ণ মিশন সভা, ১৮ই সেপ্টেম্বর, ১৮৯৮]


15) উপসংহার


[এই বক্তৃতায় বক্তা রামকৃষ্ণ মিশন সভায় তাঁহার বক্তৃতাসমূহের (বেদকথা, সৃষ্টি-রহস্য, সাধননিষ্ঠা, কমের দ্বিবিধ রূপ ও কর্ম-রহস্য) সংক্ষেপে আলোচনাপূর্বক উপসংহার করেছেন ।]

পূর্বে যে-সকল বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে, আজ তার সংক্ষেপে পুনরাবৃত্তি করব; কারণ তা হলে সেসকল বিষয় মনে দৃঢ়রূপে অঙ্কিত হবে । প্ৰথমে আমরা দেখেছি, বেদ কাকে বলে । বেদ অর্থে জ্ঞান - ভগবানের অনন্ত জ্ঞান, যা তাঁর সহিত অনন্তকাল অবস্থিত রয়েছে । এজন্য আমাদের শাস্ত্রে বলে, বেদ অনাদি । যদিও আমরা উহা পুস্তকাকারে লিখিত দেখতে পাই, কিন্তু এই পুস্তকের যা বিষয় তা তিনকালেই বর্তমান, তার আদি নেই । এই অনাদি জ্ঞান কখনো কোনও ভাগ্যবানের নিকট আবির্ভূত হয় । যাঁরা এই জ্ঞান প্ৰত্যক্ষ করেন, তাঁ’দিগকে ঋষি বলে । ঋষি অর্থে মন্ত্রদ্রষ্টা । এই জ্ঞান কেবল যে বিশেষ কোন এক জাতির অথবা পুরুষের নিকটেই আবিভূর্ত হয় তা নয় । মেচ্ছাদি নীচজাতিসম্ভূত কোন কোন পুরুষেও কখনো ঐ জ্ঞানের আবির্ভাব দেখা গিয়েছে । আবার বেদে অনেক স্ত্রীলোকও ঋষি বলে কথিত হয়েছেন । সত্যাকামাদি জারজ ব্যক্তিও ঐ জ্ঞানপ্রভাবে ঋষি বলে অভিহিত হয়েছেন । এই জ্ঞান জাতি ও বর্ণ-নির্বিশেষে সকলেরই নিকট উপস্থিত হতে পারে । পূর্বে বৈদিক কালে ব্ৰাহ্মণত্ব জাতিগত ছিল বলে বোধ হয় না; ইহা গুণগত ছিল । আবার বেদের স্থলে স্থলে এরূপ উক্তিও দেখা যায় যে, পূর্বে সকল মনুষ্যই একবৰ্ণভুক্ত ছিল । উহার কোন কোন স্থানে এরূপ কথাও আছে যে, পূর্বে কেবলমাত্র ক্ষত্রিয় বর্ণ ছিল, পরে ব্ৰাহ্মণের সৃষ্টি হল । ইতিহাস পর্যালোচনা করলে একথা সম্ভব বলেও বোধ হয় । বেদের প্রাচীন অংশ ঋগ্বেদে দেখতে পাওয়া যায় যে, আর্যগণ পঞ্চনদের গুণগান করছেন এবং আপনাদের পূর্ব বাসস্থান অত্যন্ত শীতল বলে বর্ণনা করছেন । এই সময়ে তাঁরা নূতন দেশে এসে আদিম নিবাসীদিগের সহিত কখনো যুদ্ধ-বিগ্রহে ব্যাপৃত হতেন এবং স্বভাবতঃ ধৰ্ম বা গুণানুসারে সকলেই একজাতিনিবদ্ধ ছিলেন । পরে ধর্মকাৰ্যে ব্যাপৃত ও অধিক জ্ঞানসম্পন্ন হওয়াতে তাঁদের মধ্যে কতক লোক ব্ৰাহ্মণ হয়েছিলেন । ব্ৰাহ্মণত্ব, ক্ষত্ৰিয়ত্বাদি প্রথম প্ৰথম ব্যক্তিগত স্বভাবপ্রেরিত গুণ, যুদ্ধ-বিগ্ৰহ, যজ্ঞোপাসনাদি কৰ্মানুসারেই হওয়া সম্ভব । কারণ গুণকৰ্মানুসারে জাতি বিভাগ চিরকালই জগতে বর্তমান রয়েছে ও থাকবে । কিন্তু জাতিগত ব্ৰাহ্মণত্ব মনুষ্যের জ্ঞানোন্নতির সহিত ক্ৰমশঃ তিরোহিত হবে । এই ব্ৰাহ্মণত্ব ক্ষত্ৰিয়ত্বাদি গুণ আবার ভিন্ন জাতিতে ভিন্ন পরিমাণে দেখতে পাওয়া যায় । কোন জাতি ব্ৰাহ্মণত্বগুণসম্পন্ন, যেমন প্রাচীন আর্যগণ ছিলেন । আধুনিক ইউরোপীয় জাতিরা ক্ষত্রিয়গুণসম্পন্ন । ইংরেজ জাতিতে বৈশ্য গুণের অধিক সমাবেশ দেখতে পাওয়া যায় । আবার কোন কোন সময়ে পৃথিবীর সর্বত্র কোন এক গুণকে অধিক প্ৰবল হতে দেখা যায় । বর্তমান কাল বৈশ্যগুণপ্রধান । বৈশ্যগুণহীন লোকের একালে অধোগতিপ্ৰাপ্তি হচ্ছে । যাদের ঐ গুণ প্রবল, তারাই উন্নত হচ্ছে । মহাভারতেও আমরা পূর্বোক্ত কথা দেখতে পাই যে, পূর্বে এক জাতি ছিল, পরে গুণকৰ্ম-ভেদে জাতিভেদ হয়েছে । ভগবান গীতায় বলেছেন, গুণ ও কর্মের বিভাগ দ্বারা আমি চারবর্ণ সৃষ্টি করেছি । অতএব সদ্‌গুণসম্পন্ন হলেই বেদে অধিকার হত এবং এখনো হওয়া উচিত । আমরা দেখেছি, বেদ দুই ভাগে বিভক্ত - কর্মকাণ্ড ও জ্ঞানকাণ্ড । কর্মকাণ্ডে যাগযজ্ঞাদি ক্রিয়ার দ্বারা স্বৰ্গাদিলাভ হওয়ার কথা আছে । স্বৰ্গ অর্থে পৃথিবী অপেক্ষা কোন উচ্চতর লোক, যেখানে অধিককালস্থায়ী সুখভোগ করতে পারা যায় । কিন্তু এই সুখভোগের পর আবার মর্ত্যলোকে আসতে হয় । আমাদের শাস্ত্রোক্ত দেবতাসকল - ইন্দ্ৰ, বরুণ, অগ্নি প্ৰভৃতি এক একটি পদমাত্র । শাস্ত্রে দেখা যায়, কৰ্মদ্বারা উচ্চগতিপ্রাপ্ত হয়ে কেউ কেউ ইন্দ্ৰাদি হয়েছেন এবং সেই পদে কিছুদিন অবস্থান করে আবার তাঁর পৃথিবীতে পতন হয়েছে ।

অতএব মনুষ্যমাত্রেই কর্মদ্বারা দেবত্বপদ লাভ করতে পারেন । বেদের কর্মকাণ্ড স্বৰ্গাদি লোক-লাভের উপায় বলে দেয় । কিন্তু ঐ সকল সুখও নিত্য নয় । সেজন্য মনুষ্য তাতে তৃপ্তিলাভ করতে পারে না । তার প্রাণ নিত্য-বস্তুলাভের জন্য লালায়িত । বেদের জ্ঞানকাণ্ডে সেই নিত্য পদার্থের বিষয়ই বর্ণিত আছে । আমরা দেখেছি শাস্ত্ৰে সৃষ্টিকে অনাদি বলেছেন । অন্যান্য ধর্মে সৃষ্টির আদি আছে, এরূপ কথা বলে । বলে, এমন এক সময় ছিল যখন সৃষ্টি আদৌ ছিল না । ঈশ্বর সৃষ্টি করলেন । কিন্তু বেদ তা বলেন না । সৃষ্টির আদি আছে বললে ভগবানে বৈষম্য ও নিঘৃণ্য-দোষ এসে পড়ে । জগতের এই বিষমতা দেখছি - কেউ পণ্ডিত, কেউ মূর্খ, কেউ সুখী, কেউ দুঃখী ইত্যাদি, সৃষ্টির আদি থাকলে ঈশ্বর তার কারণ হন এবং তাঁকে পক্ষপাতিত্ব দোষের ভাগী হতে হয় । দ্বিতীয়তঃ, তাঁকে নিষ্ঠুরও বলতে হয় । সৃষ্টি অনাদি হলেও সৃষ্টির বিকাশাবস্থা চিরকাল থাকবে না । শাস্ত্র বলেন, কখনো প্ৰকাশিত এবং কখনো লুপ্তাবস্থায় থেকে বীজ হতে বৃক্ষ ও পুনরায় বৃক্ষ হতে বীজের ন্যায় সম্বন্ধে সম্বন্ধ সৃষ্টির ঐ দুই ভাব অনাদিকাল হতে প্রবাহিত রয়েছে । যেমন ক্ষুদ্রতম বীজ হতে বৃহৎ অশ্বত্থবৃক্ষ উৎপন্ন হয়, আবার সেই বৃক্ষ কালে বীজে পরিণত হয়, সেরূপ সৃষ্টজগৎ কখনো বীজরূপে ও কখনো প্ৰকাশরূপে বর্তমান রয়েছে । ইহা ভগবান হতে নিৰ্গত, ভগবানেরই অংশ, তাঁ হতে ভিন্ন নয় । গীতাদি শাস্ত্রেও দেখা যায়, ভগবান বলছেন - জগৎ আমার এক অংশমাত্র । যদি সৃষ্টি অনাদি হল, তবে এই বৈষম্যের কারণ কি ? শাস্ত্ৰ বলেন, এই বৈষম্যের কারণ কর্ম । সুতরাং কৰ্মও অনাদি । আমাদের সকলকেই কর্ম করতে হচ্ছে । কর্ম না করে কেউ থাকতে পারে না । কর্মের সহিত তার ফল, নিত্যসংযুক্ত হয়ে রয়েছে । কর্ম করলে তার ফলভোগ করতেই হবে; তবে মুক্তি কিরূপে সম্ভবে ? নিষ্কামভাবে নিঃস্বাৰ্থ হয়ে কাজ করলে কর্মফলে লিপ্ত হতে হয় না এবং সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থত৷ সমগ্র বন্ধন নাশ করে দেয় । একেই কর্মযোগ বলে । এক কথায় বলতে গেলে স্বাৰ্থশূন্য হওয়াই ধৰ্ম । কি কৰ্মযোগী, কি ভক্তিযোগী, কি জ্ঞানযোগী, সকলেই নিঃস্বার্থ হতে চেষ্টা করছে । কেউ ‘আমি আমি’ করে, কেউ বা ‘তুমি তুমি’ করে পূর্ণ নিঃস্বার্থতার দিকে অগ্রসর হচ্ছে । সকলেই ছোট স্বার্থপর ‘আমি’-জ্ঞান ভূমা মহান্‌ 'আমি’তে ডুবাতে চেষ্টা করছে । কেউবা সর্বভূতে সেই এক আত্মাকে প্রত্যক্ষ ক'রে সেই মহান্‌,’আমি’কে সকলের ভেতর দেখতে চেষ্টা করছে । অপর কেউ ক্ষুদ্র অহংজ্ঞানকে পরিত্যাগ করে কেবল ভগবানকেই সর্বত্র দেখতে চেষ্টা করছে । বুঝে দেখলে দুই পথের উদ্দেশ্য একই বলে প্ৰতীয়মান হয় । আমরা দেখেছি, কর্মে কোন দোষ নেই । কর্মের ভাল-মন্দ গুণ আমাদের নিজের মনোগত ভাব বা উদ্দেশ্য নিয়ে হয়ে থাকে । আমরা যখন যে ভাবে কার্য করি, আমাদের ঐ কাৰ্য তখন সেই ভাবানুসারে আমাদিগকে উন্নত বা অবনত করে ভাল বা মন্দ বলে প্রতীয়মান হয় । একটি কার্য আশ্ৰয় না করে আমরা অন্য একটি কাৰ্য পরিত্যাগ করতে পারি না । নীচ কর্ম পরিত্যাগ করে উচ্চতর কর্ম গ্ৰহণ করতে আমাদিগকে সর্বদা উদ্‌যুক্ত থাকতে হবে । তা হলেই ক্ৰমে নিঃস্বাৰ্থ হতে পারব । যে ঘোর ইন্দ্ৰিয়পরতন্ত্র, সে বিবাহ করে এক স্ত্রীতে মন নিবদ্ধ রাখলে তার পক্ষে স্বাৰ্থত্যাগ করাই হবে, কিন্তু সন্ন্যাসীর পক্ষে বিবাহ তদ্বিপরীত স্বার্থপরতা বৃদ্ধিরই পরিচায়ক হবে । অতএব একের পক্ষে যা নিঃস্বাৰ্থ কর্ম, অপরের পক্ষে আবার স্বার্থপর কর্ম । যে যে অবস্থায় অবস্থিত তার সম্বন্ধে যা ঈশ্বরপথে অগ্রসর হবার প্রতিবন্ধকতা করে, তাই তার সম্বন্ধে সংসার । সেই সংসার তাকে ত্যাগ করতে হবে । কারও কাম, কারও ক্ৰোধ, কারও বা ধন ঈশ্বর-পথের কণ্টক; তাকে তাই পরিত্যাগ করতে হবে । কিন্তু পরিত্যাগ করতে হলে পূর্বে আর এক উচ্চতর বিষয় অবলম্বন করতে হবে । এরূপে ক্রমশঃ উচ্চ হতে উচ্চতর অবস্থায় উঠতে হবে, নিঃস্বাৰ্থ হবার জন্য চেষ্টা করতে হবে, এরূপে কালে সকলেই আমরা এরূপ অবস্থায় উপস্থিত হব, যখন সম্পূর্ণ নিঃস্বাৰ্থ হয়ে কাৰ্য করতে পারব । আমরা দেখেছি, পূর্ব পূর্ব জন্মের কার্যানুসারে মানব পর পর জন্মে উন্নতাবনত দেহাদি প্ৰাপ্ত হয় । পূর্বকৃত কর্মসমূহ দ্বারা মনুষ্য এরূপ পিতামাতা প্রাপ্ত হয়, যাঁরা তাকে ঐরূপ দোষ বা গুণযুক্ত দেহাদি প্ৰদান করতে পারেন । সেজন্য আপাতত: দেখলে সন্তানের দোষ-গুণ অনুক্রমিত হওয়ার কারণ পিতামাতাই বলে বোধ হয়, কিন্তু তা নয় ; বাস্তবিক সন্তানের কর্মই স্বরূপ পিতামাতাকে অন্বেষণ করে নেয় । প্রশ্ন হতে পারে - কর্ম করবার শক্তি কোথা হতে উৎপন্ন হয় ? আমরা দেখেছি, এই দৃষ্ট স্থুল ব্ৰহ্মাণ্ড এক বিরাট দেহ । আমাদের এই সকল ক্ষুদ্ৰ দেহ বিরাটেরই অংশমাত্র । সেইরূপ আমাদের মনসমূহও সেই বিরাট মনের অংশমাত্র । অতএব শরীর ও মনের পুষ্টি সেই বিরাট শরীর ও মন হতেই নিত্য হচ্ছে । আহার ও নিঃশ্বাসের দ্বারা আমরা শরীরে যা গ্রহণ করি, তা সেই অনন্ত বিরাটেরই অংশ । আমরা না জানলেও আমাদের মনের পুষ্টিও সেরূপ বিরাট মন হতেই হয়ে থাকে । নূতন জল যেমন আবর্তে আসছে ও যাচ্ছে কিন্তু আবর্ত একই রূপ দেখছি, সেইরূপ দেহ ও মন একই রূপ দেখতে থাকলেও বিরাট দেহ ও মন হতে তাদের উপাদান আমরা অবিরত গ্রহণ করছি । এজন্য শাস্ত্ৰ বলেন, ভগবানের অনন্ত শক্তি সকলেরই অন্তরে নিহিত রয়েছে। তাঁ হতেই আমরা নিজ নিজ শক্তি গ্রহণ ও বিকাশ করছি । এ শক্তির অপব্যয় না করে উহাকে উচ্চ হতে উচ্চতর কার্যে নিযুক্ত করতে পারলেই জীবনের মহান্‌ লক্ষ্যে আমরা উপনীত হতে পারব ।
[রামকৃষ্ণ মিশন সভা, ২৫শে সেপ্টেম্বর, রবিবার, ১৮৯৮]


16) আপ্তপুরুষ ও অবতারকুলের জীবনানুভব



বেদই হিন্দুর জাতীয়, ধন, হিন্দু আচার ব্যবহার বিশ্বাস আস্তিক্য প্রভৃতি সকল বিষয়ের ভিত্তি । ইহকালে সে বৈদিক আচার-অনুষ্ঠানে অন্য সকল দেশের, অন্য সকল জাতির, অন্য সকল ধর্মের আচারাদি অগ্রাহ্য করে থাকে এবং দেহাবসানে মৃত্যুর মোহান্ধকার এসে যখন ইহ-জগতের চিরপরিচিত সুখ-দুঃখ, লাভ-লোকসান, যশ-অপযশ প্রভৃতি দ্বন্দ্বসমূহের একপ্রকার সাময়িক সমতা এনে দেয়, তখন অজ্ঞাত অপরিচিত কল্পনায় করালায়িত পরকালের ছবি দেখতে সে বেদোক্ত বিশ্বাস ও শিক্ষাসহায়েই আশায় নির্ভর করে ‘তপ্তা বৈতরণী’তে ঝম্প প্ৰদান করে ।

বলা যেতে পারে, একথা কিরূপে সত্য হতে পারে ? কোথায় সে আহুতি-সমুত্থিত পর্জন্যপ্রসবকারী যজ্ঞীয় ধুম ? কোথায় সে গোমেধ, অশ্বমেধাদি যজ্ঞসমূহ ? কোথায় সে সোমরসপানে অর্ধনিমীলিতনেত্ৰে যজমান-কল্যাণকারী মিত্র মরুৎ পূষণ ভগ প্রভৃতি বৈদিক দেবগণ ? কোথায় সে সত্যনিষ্ঠ অপ্রতিগ্ৰাহী ক্রিয়াপ্ৰাণ বেদজ্ঞ ব্ৰাহ্মণ ? কালরাত্রির গভীরান্ধকারে এরূপ লুক্কায়িত যে, কোন কালে তাঁদের অস্তিত্ব ছিল কি না, সে বিষয়ে সন্দিহান হতে হয় ।

উত্তরেও বলা যেতে পারে, যুগবিপর্যয়ে পরিবর্তনের খরস্রোত ঐ সমস্ত পুনঃ পুনঃ ভেঙ্গে অভিনব রূপ এবং ভাবে গড়লেও মধ্যে মধ্যে এমন নিদর্শনও রেখে গিয়েছে, যা দ্বারা বেশ বোধ হয়, হিন্দুর আচার-ব্যবহারাদি পূর্ব পূর্ব যুগানুষ্ঠিত আচারাদির উপর ভিত্তিস্থাপন করেই দণ্ডায়মান । একটির অপরটির সহিত সাদৃশ্য-বৰ্তমান বংশধরের অতিবৃদ্ধ পিতামহাদির সহিত জাতি, বংশ এবং গুণগত সাদৃশ্যের ন্যায় । বর্তমান ভাষার সহিত পূর্বকার ভাষারও ঠিক সেই সম্বন্ধ । প্রাচীন তত্ত্বসকল দিন দিন যতই আবিষ্কৃত হচ্ছে, ততই একথা চিরসুদূর মরীচিকার রাজত্ব হতে, ইন্দ্ৰিয়োপলব্ধ প্ৰত্যক্ষ রাজ্যের নিকট হতে নিকটতর হচ্ছে ।

অতএব হিন্দুর সর্বপ্রকার আশা-ভরসার স্থল যে বেদ, একথা স্বতঃই প্রমাণিত । আমরা উৎকৃষ্টই হই বা পৃথিবীর অপরাপর জাতি অপেক্ষা নিকৃষ্টই হই, আমাদের জাতীয়ত্বের মূল ঐ বেদেই রয়েছে । ঐ বেদ নিয়ে আমরা পূর্বে উঠেছিলাম এবং যদি আবার উঠতে হয়, তা হলে ঐ মূলাবলম্বনেই উঠতে হবে ।

বৃক্ষশরীর হতে নিত্যবিগলিত শুষ্ক পত্ররাশির ন্যায় ধর্মশরীর হতে নিয়ত পরিত্যক্ত আচাররাশির কথা এখন দূরে থাক । ধর্মশরীরে যে অংশগুলি যুগে যুগে একরূপ থাকে, তাই চিরকাল আমাদের জাতীয়ত্বের মূলে রয়েছে ও থাকবে এবং ঐ মূল কোনরূপে বিনষ্ট হলে আমাদের জাতীয় জীবনও চিরকালের নিমিত্ত অন্তর্হিত হবে । মনে কর, হিন্দুর সমাধি-অবলম্বনে জ্ঞানের উচ্চ ভূমিতে আরোহণে বিশ্বাস, ব্ৰহ্মচৰ্য-অবলম্বনে ভোগসুখ এবং বংশবিস্তারে ব্যয়িত শক্তির মানসিক এবং আধ্যাত্মিক শক্তিসমূহে এবং ঐ উপায়ে ইহ জীবনেই মানুষ্যের দেবত্বপ্রাপ্তি-বিষয়ক ধারণা, আত্মসংযমেই জাতিগত এবং ব্যক্তিগত পুরুষাৰ্থ, ত্যাগের অমৃতত্বলাভ, আত্মার পূর্ণত্ব, অব্যয়ত্ব ও অবিনাশিত্ব, কর্মফলের অবশ্যম্ভাবিত্ব প্রভৃতি বিশ্বাস-নিচয়, যা বৈদিক যুগ হতে এখনও পর্যন্ত সমভাবে বংশ হতে বংশানুগত হয়ে প্রবাহিত রয়েছে, সে সকলের লোপ হলে আমাদের জাতীয়ত্ব বা অপর জাতি হতে পার্থক্য আর কোথা থাকবে ? এবং ঐরূপ হলে সমগ্ৰ ধৰ্ম-শরীরের নাশের সঙ্গে সঙ্গে কি আমাদের অস্তিত্বেরও লোপ হবে না ?

প্রশ্ন হচ্ছে, এখন বেদের বেদত্ব কি নিয়ে ? কোন্‌ শক্তিপ্রভাবে উহা সমগ্ৰ হিন্দুমনে আবহমানকাল ধরে এই অদ্ভুত প্ৰভুত্বস্থাপন করে বর্তমান ? যোগিজননিষেবিত মুক্তি-অলক্তক-রঞ্জিত কমনীয় শ্রতিপদে কেনই বা সৌর গাণপত্য শৈব শাক্ত প্ৰভৃতি অশেষ সম্প্রদায়ের ভক্তিনম্রশিরসমূহ সর্বদা নত রয়েছে ? কেনই বা নিরীশ্বরবাদী কপিলাদি মহামুনিগণ স্বকীয় প্রতিভাপ্রভাবে সকল বিষয় অতিক্রম করে বেদের প্রভাব অতিক্রম করতে সমর্থ হন নাই ? এর নিশ্চিত কোন গূঢ় কারণ আছেঊ; কোন অপূৰ্ব সর্বজনমিলনভূমি সাধারণ সত্য আছে, যা প্রত্যক্ষ করেই সেশ্বর নিরীশ্বরাদি অতি বিভিন্ন সম্প্রদায়ীরাও এককালে একবাক্যে এর প্রভুত্ব স্বীকার করেছেন । সেটি কি ?

হিন্দুর বিশ্বাস, বেদ অপৌরুষেয় অর্থাৎ মনুষ্যরচিত নয় - পুরুষনিঃশ্বসিত অর্থাৎ জগৎকর্তা ঈশ্বরের নিঃশ্বাসস্বরূপ, অতএব নিত্য অর্থাৎ ভূত-ভবিষ্যৎ-বর্তমানাদি কালজয়েরও পূর্ব হতে ঈশ্বরের সহিত সদা বর্তমান, ঈশ্বরের স্বরূপবিশেষ । বেদরাশিলিপিবদ্ধ জ্ঞান ঐশ্বরিক জ্ঞানের মানববুদ্ধিগ্রহণযোগ্য আংশিক বিকাশমাত্র । অতএব ঐশ্বরিক জ্ঞানকে যেমন ঈশ্বরের স্বরূপ হতে কখনও ভিন্ন করা যায় না, সেরূপ বৈদিক জ্ঞানও তা হতে অভিন্ন-তাঁর স্বরূপ ভিন্ন আর কিছুই নয় ।

বেদের অপরটির নাম আপ্তবাক্য অর্থাৎ অতীন্দ্ৰিয় অবাঙ্‌মনসোগোচর ঈশ্বরস্বরূপ, সমাধি-অবলম্বনে সর্বোচ্চ ভূমিকায় আরোহণ করে যাঁরা সাক্ষাৎ উপলব্ধি করেছেন, তাঁদের বাক্য বা শিক্ষা ।

ভারতের সকল দার্শনিকেরাই একবাক্যে স্বীকার করেছেন যে, সমাধিই সত্যলাভের একমাত্র পথ । সমাধির সাধারণ অর্থ চিত্তের একাগ্ৰতা । এই চিত্তের একাগ্রতার আবার তারতম্য আছে । সেই তারতম্য-অনুসারে মহামুনি পতঞ্জলি সমাধির সবিকল্প ও নির্বিকল্প - এই দুই বিভাগ করেছেন । অপরাপর বিষয়ক চিন্তাপ্রবাহসমূহকে তৎকালের নিমিত্ত তিরোহিত বা স্থগিত করে এক বিষয়ক চিন্তাপ্রবাহে মন কেন্দ্রীভূত হলে তাকে সবিকল্প সমাধি বলা যায় । মনের এই অবস্থায় যে বিষয়ক চিন্তাতরঙ্গে মন কেন্দ্রীভূত হয়েছে, সেই বিষয়ক সত্য উপলব্ধ হয় । বিজ্ঞান, বাণিজ্য, কবিত্ব, শিল্প, ঔষধ, রাজনীতি প্ৰভৃতি বিষয়ে অদ্যাবধি যে সকল সত্য আবিষ্কৃত করা হয়েছে বা হচ্ছে, তা ভূয়োদর্শন ও পরীক্ষাসহায়ে মানবমনের তত্ত্বৎ বিষয়ে ঐ রূপ কেন্দ্রীভূত হবার ফলে ধর্মবিষয়ক সত্য উপলব্ধি করতে যেমন শ্ৰবণ মনন নিদিধ্যাসনের প্রয়োজন, ঐ ঐ বিষয়েও তদ্রূপ । কেবল ধর্মবিষয়ে ধর্মসংক্রান্ত পদার্থনিচয়ের উপর এবং ঐ সকল বিভিন্ন বিষয়ে তত্তৎ বিভিন্ন বিভিন্ন পদার্থসমূহ নিয়ে শ্ৰবণ মনন নিদিধ্যাসন করতে হয়, এই মাত্র ভেদ । রাসায়নিক তত্ত্বের অনুসন্ধিৎসু হয়ে নাম জপাদি করলে হবে না বা ধর্মবিষয়ক তত্ত্বের উপলব্ধি নিমিত্ত যন্ত্রসহায়ে পদার্থনিচয়ের সংশ্লেষণ বিশ্লেষণাদিতে নিয়ত রত থাকলে চলবে না । ইত্যাদি ।

সবিকল্প সমাধি নানাভাব নানাবিষয় নিয়ে নানাপ্রকারের হলেও নির্বিকল্প সমাধি একই প্ৰকার । উহাতে একবিষয়ক চিন্তাতরঙ্গপরম্পরা না থেকে কেবলমাত্র একটি চিন্তা বর্তমান থাকে এবং গাঢ়াবস্থায় তারও জ্ঞান থাকে না । তখন জ্ঞাতা, জ্ঞেয় ও জ্ঞান, যা মানবমনের প্রত্যেক উপলব্ধির দৃঢ় ভিত্তিস্বরূপ, তাও একত্র মিলে যায় এবং এক ব্যতীত অন্য পদার্থের জ্ঞানাভাবে একের জ্ঞানও তিরোহিত হয়ে যায় । একেই যোগীর নিবাত-নিষ্কম্প প্ৰদীপবৎ হয়ে সমস্ত চিত্তবৃত্তি নিরুদ্ধ করে অবস্থান বলে । তখন শরীর জড়বৎ ইন্দ্ৰিয়াদির স্ব স্ব ব্যাপারশূন্য, মনবুদ্ধি এককালে শুদ্ধ এবং জগতের কোলাহল সুদূরপরাহত হয়ে থাকে ।

ইউরোপ প্রভৃতি পাশ্চাত্ত্য দেশের দার্শনিকেরা উক্ত সমাধি-অবস্থায় শরীরেন্দ্রিয়াদির জড়বৎ অবস্থিতি এবং কোন কোন শারীরিক রোগবিশেষের সহিত বাহ্যিক সৌসাদৃশ্য দেখে উহাকে মানবসাধারণের চৈতন্যাবস্থা হতে নিম্নভূমির অবস্থা বলে স্থিরসিদ্ধান্ত করেছেন । চিন্তাশীল দার্শনিক পণ্ডিতসমূহের যখন এরূপ ধারণা, তখন ভোগলোলুপ সকাম কৰ্মৈকপ্ৰাণ সাধারণ পাশ্চাত্ত্য মানব যে উক্তাবস্থালাভ ভীতির চক্ষে দেখবে বা কারও উক্তাবস্থার বিন্দুমাত্র লাভ হলে তাকে দয়ার পাত্র বিবেচনা করবে, এতে আর আশ্চর্য কি ?

পাশ্চাত্ত্য দেশসমূহে ভ্ৰমণকালে বর্তমান লেখককে নিত্য এই প্রশ্নের বারবার উত্তর দিতে হত যে, প্ৰাচ্যদৰ্শননিবিদ্ধ সমাধি-অবস্থা জড়াবস্থা নহে বা গাছ-পাথরের মত হয়ে সুখ-দুঃখের হাত অতিক্রম করা নহে; এবং জ্ঞান জ্ঞেয় জ্ঞাতার ভেতর দিয়ে যে জ্ঞান চৈতন্যের স্ফূর্তি হয়, তা ঐ তিনের একত্র মিলিতাবস্থায় অনুভূত জ্ঞান-চৈতন্যের অপেক্ষা সকল বিষয়ে নিকৃষ্ট, এবং এখনও পর্যন্ত ঐ অবস্থা কোন কোন ভাগ্যবান ভারতে লাভ করে থাকেন; এবং জড় হওয়া তো দূরের কথা, তাঁদের ভিতর দিয়ে পূর্বাপেক্ষা সৰ্বতোমুখী অদ্ভুত শক্তি প্ৰকাশিত হয়ে জগতের যাবতীয় ধর্মের সত্যতা-সম্বন্ধে এবং জ্ঞানের চরম সীমায় অদ্বৈতবোধে উপনীত হওয়ার সম্বন্ধে সাক্ষ্য প্রদান করে । কিন্তু চির সংস্কারের প্রবল প্রভাবে সে-কথা ধারণা হবে কেন ? আবার পরদিন সেই ব্যক্তিই পুনরায় সেই প্রশ্নের সমুত্থান করত । একদিন একজন দার্শনিক বন্ধু সমাধি এবং অদ্বৈতবোধ-সম্বন্ধে অনেক কথা শুনে এবং অনেক তর্ক বিতর্ক করে পরিশেষে বলেছিলেন, “তুমি যা বলছি তাতে ভ্ৰম-প্ৰমাদ কিছুমাত্র নেই, কিন্তু দুৰ্ভাগ্যবশতঃ আমাদের দেশে ঐরূপ সমাধিস্থ পুরুষ একজনও জন্মে না । সেজন্যই আমাদের ওকথা হৃদয়ঙ্গম হওয়া এত কঠিন ৷” শুনে মনে হল, সত্যই বটে । চিরপদদলিত ভারত এ বিষয়ে সকল দেশাপেক্ষা এখনও ধনী । জড়বাদ, সংশয়বাদ বা অজ্ঞেয়বাদাদি চার্বাক-মতসকল চূৰ্ণ করে যথার্থ ধর্মালোক দিবার শক্তি ভারতের রয়েছে । ভারতই তা পূর্বে অপরাপর দেশবাসীকে দিয়েছে এবং এখনও মুক্তহস্তে ঐ ধন বিতরণ করে স্বীয় মর্যাদা রক্ষা করবে । নিরাশায় আশার সঞ্চার হল । মনে হল, দরিদ্র এবং বিজিত হলেও আমাদের এ বিষয়ে কেউ পরাজিত করতে সমর্থ হয়নি । আমাদের ধর্মবীরগণেরই পদপ্রান্তে নত হয়ে এই অপূর্ব আলোক সকল দেশবাসীকে নিয়ে যেতে হবে ।

অকুতোভয় হিন্দু দার্শনিক অপরিবর্তনীয় দেশকালাতীত সৰ্বকরণ-কারণ নিত্য সত্যের উপলব্ধি পঞ্চেন্দ্ৰিয়ের দ্বারা অসম্ভব দেখে ‘মনোনিবৃত্তিঃ পরমোপশান্তিঃ” রূপ তীর্থবৰ্ষা মণিকর্ণিকার অনুসন্ধানে নিৰ্গত হলেন এবং তদাবিষ্কারে স্বয়ং ধন্য হয়ে অপর সাধারণকে কৃতাৰ্থ করলেন । সমাধি-অবলম্বনে উপলব্ধি করলেন যে, মানবসাধারণের সসীম জ্ঞান ও চৈতন্য, দেশকালাতীত এক অসীম জ্ঞান-চৈতন্যের আপেক্ষিক বিকাশমাত্র এবং আরও উপলব্ধি করলেন যে, সেই জ্ঞান-চৈতন্যের আরও নিম্নভূমির বিকাশ রয়েছে গোমহিষাদি পশুসমূহে, তরু গুল্ম-লতাদিতে এবং সব চাইতে জড় বলে যাদের সম্বন্ধে মানবের ধারণা, ধাতুলোষ্ট্রাদি পদার্থনিচয়ে । অনন্তভাবে বিভক্ত জগৎ তখন তাঁর চক্ষে এক নতুন আলোকে আলোকিত ও প্রতিভাসিত হল এবং ‘নিত্যো নিত্যানাং চেতনশ্চেতনানাং একো বহূনাং যো বিদধাতি কামান্‌’ পদার্থের উপলব্ধি ক'রে তিনি শাশ্বতী শান্তি প্ৰাপ্ত হলেন । কামকাঞ্চনপ্রসূত গাঢ় অমানিশার অন্ধকারে সংযতেন্দ্ৰিয় সুসারথি তিনিই একমাত্র জাগ্রত রইলেন এবং মোহমুগ্ধ অপর জনসাধারণকে জাগ্রত করবার জন্য অভয় আশ্বাসবাণী প্ৰদান করলেন । ইন্দ্ৰিয়াদির অতীত পদাৰ্থ দৰ্শন করেই তিনি ঋষি হলেন এবং দেশকালাতীত পূর্ণানন্ত পরম-ধামের সাক্ষাৎ সত্য সংবাদ দেওয়াতেই তাঁর বাক্য বেদ অথবা ঐশ্বরিক জ্ঞান বলে প্ৰসিদ্ধ হল ।

প্রশ্ন হতে পারে, সমাধিসহায়ে উপলব্ধ বিষয় যে মস্তিষ্কের ভ্ৰমমাত্র অথবা রোগবিশেষ নহে, তার প্রমাণ কি ? উত্তরে বলা যায়, সমাধিলাভের পূর্বে তোমার যেরূপ জ্ঞান, সংযম, ইচ্ছাশক্তি, সুখদুঃখাদিদ্বন্দ্ব-সহিষ্ণুতা প্রভৃতি ছিল, সমাধিলাভের পর যদি সেই সকলের বিন্দুমাত্র হ্রাস না হয়ে শতগুণে বৃদ্ধি দেখতে পাও, তা হলে ঐ অবস্থাকে কি বলতে চাও ? তারপর শান্তি - যে শান্তির জন্য নানা প্রকার অভাবপূরণের দিবারাত্র ছুটাছুটি করেও পূর্ণমাত্রায় কখনও পাচ্ছে না, সেই শান্তি যদি তোমার সদা সর্বক্ষণ বিদ্যমান থাকে, তা হলে সে রোগবিশেষ যে প্রার্থনীয় !

পরমহংস শ্ৰীরামকৃষ্ণদেব বলতেন, বেদ-পুরাণাদি জগতের যাবতীয় ধর্মগ্রন্থ কোন জিনিসের - যথা, সন্দেশ প্রভৃতি মিষ্টান্নাদির – তালিকাবিশেষ । যদি তুমি সেই পদার্থের সহিত কথঞ্চিৎ পরিচিত থাক, তা হলে মিলিয়ে নিতে পার, সেই পদার্থের কোন্‌ কোন্‌ রূপের সহিত তোমার পরিচয় হয়েছে এবং কোন্‌ কোন্‌ রূপের সহিত হয়নি । তখন যে যে রূপের উপলব্ধি হয়নি, তাদের যাতে উপলব্ধি হয়, সে বিষয়ে চেষ্টা করতে পার । অতএব বেদ যে শুদ্ধ সমাধি-অবস্থার উপলব্ধিসমূহ যথাসম্ভব লিপিবদ্ধ করে জগৎপুজ্য হয়েছেন তা নয়, কিন্তু ধৰ্মরাজ্যের নিম্নাৎ নিম্ন স্তর হতে সর্বোচ্চ স্তরের চরমসীমা নির্বিকল্প সমাধি পৰ্যন্ত উঠবার কালে সাধক মানবের শরীর এবং মনে যেরূপ পরিবর্তন, অনুভব এবং তৎফলস্বরূপ ধর্মমত, আস্তিক্য ও বিশ্বাসাদি এসে উপস্থিত হয়, জগতের কল্যাণের জন্য তৎসমুদয়ও যথাসম্ভব লিপিবদ্ধ করেছেন । তাতে আমাদের লাভালাভ কি ? মনুষ্যমাত্রকেই ধর্মরাজ্যে অগ্রসর হতে গেলে ক্ৰমে ক্রমে নানাপ্ৰকার শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন, নানাপ্রকার মতে সত্য বলে বিশ্বাস, নানাপ্রকারের ধারণা, বহির্জগতের নানাপ্রকার পদার্থসাহায্যের জন্য অবলম্বন প্রভৃতির ভেতর দিয়ে গমন করে নিত্য পদাৰ্থ লাভ করতে হবে । ভেতরের ও বাইরের এই সকল পরিবর্তন বৃক্ষবিশেষের প্রতিপত্রে রূপের ন্যায় প্রতিমানবের কিঞ্চিৎ কিঞ্চিৎ ভিন্ন হলেও সাধারণত সৰ্বকালেই একরূপ থাকবে । কারণ, এই সৃষ্টির নিয়ম - বহুর মধ্যে একের বিকাশ, একের অনুস্যুততা - যা হতে মানবীয় সর্বপ্রকার জ্ঞান সম্ভবপর হয়েছে । তোমার অনুভূত বিষয়সকলের সহিত পূর্ব পূর্ব ঋষিগণ-অনুভূত এবং বেদাদিধর্মগ্রন্থনিবদ্ধ অনুভবের যদি সমতা পেতে থাক, তা হলে নিঃসন্দিহান চিত্তে তুমি স্বীয় পথে অগ্রসর হয়ে উদ্দেশ্যলাভে কৃতকৃতাৰ্থ হবে ।

ধর্মপথে অগ্রসর হতে সাধকশরীরমনে যে কি আমূল পরিবর্তন এসে মধ্যে মধ্যে উপস্থিত হয়, তা পূর্ব পূর্ব বৈদিক ও পৌরাণিক ঋষিগণ, ঐতিহাসিক যুগের সিদ্ধ ও সাধকগণ এবং বর্তমান কালের ধর্মবীরগণের জীবনী-আলোচনায় বিশেষ উপলব্ধি হয় । নচিকেতার যমসদনে গিয়ে ব্ৰহ্মজ্ঞানলাভ, সত্যকাম জাবালের অগ্নি-উপাসনার ফলে আচাৰ্যত্বপ্রাপ্তি, মিথিলাধিপতি জনকরাজের রাজ্যশাসন করতে করতে বিদেহত্ববোধ ইত্যাদি, সিদ্ধপুরুষোপলব্ধ অনুভবের ভেতর অথবা পূজ্যপাদ আচাৰ্য শঙ্করের হৃদয়ে কিশোর কালেই অদ্বৈতবোধস্ফূর্তি এবং তৎপরে ধীরে সেই জ্ঞান অপরকে প্ৰদান করবার শক্তিবিকাশ, মহামতি ঈশার চল্লিশ দিন উপবাস, শ্ৰীগৌরাঙ্গদেবের গয়াধামে শ্ৰীপাদপদ্ম-দৰ্শন হতে ধর্মশক্তি-প্ৰকাশ এবং বর্তমানকালে শ্ৰীরামকৃষ্ণদেব-শরীরে দ্বাদশবৎসর কঠোর তপস্যাদির পর অদ্ভুত ধৰ্মসমন্বয়শক্তি-বিকাশাদির ভেতর তত্তৎ জগদ্‌গুরুর মহান্‌ হৃদয়ে কত দেবাসুরের সংগ্রাম ও জয়-পরাজয়, কত উদ্যম, আশা ও নিরাশা, কত আনন্দ ও বিরহ, কত যুগান্ত-পরিবর্তনের পর চিত্তের সমতাবস্থালাভ এবং তৎসঙ্গে তত্তং দেবপ্রতিম শুদ্ধসত্ত্ব শরীরে কত অদ্ভুত পরিবর্তন হয়েছিল, তার ইতিহাসের কতটুকু আমরা পেয়েছি বা রাখতে পেরেছি ? যতটুকু রাখতে পেরেছি, তার জন্য জগৎ আজি কত ধনী, কত ধন্য হয়েছে; আবার সেই ইতিহাসের অধিকাংশই কি ভারতের ধর্মগ্রন্থে নেই ? জগৎ জুড়ে একটা রব উঠেছে, ভারতবর্ষের ইতিহাস পাওয়া যায় না, ইতিহাস লিখতে ভারতের লোক জানত না ! আরে মুর্খ ! রাম শ্যামকে মেরে রাজা হল, তৎপরে রামের দশটি সন্তান হল, তিনি বিশ বৎসর রাজত্ব করলেন অর্থাৎ কতকগুলি আইন চালালেন, কাকেও পুরস্কার এবং কাকেও বা দণ্ড দিলেন, খেলেন, শুলেন, বিবাদ করলেন, আনন্দ করলেন, কষ্ট সইলেন এবং মরলেন - এই কি তোমার ইতিহাস ? এ ইতিহাস রইল বা না রইল, তাতে জগতের বিশেষ ক্ষতি-বৃদ্ধি কি ? কিন্তু ইতিহাসঅর্থে যদি - যে-সকল মহাপুরুষের চিন্তাস্রোত সমগ্ৰ দেশবাসীর মনের উপর আধিপত্য বিস্তার করে, তাদের নূতন ভাবে গড়েছে; যে-সব মহান হৃদয়ের ভালবাসা আপামর সাধারণ মানবকে নিঃস্বার্থ হতে শিখিয়েছে, যে-সকল মহৎ চরিত্রের আদর্শ দেশবাসীর চক্ষের ভেতর দিয়ে হৃদয়ের অন্তস্তলে প্ৰবেশ করে প্রস্তরাঙ্কিত মূর্তিবৎ চিরজাজ্জ্বল্যমান রয়েছে - সেই সকল মহাপুরুষের প্রাণের উপলব্ধির ইতিহাস হয়, তা হলে ভারতই যে তা বিশেষভাবে রেখেছে । তা হতেই কি বর্তমান যুগে জাগতিক ধৰ্মজ্ঞান বুঝবার বিশেষ সহায়তা হচ্ছে না ?

উন্নতোদার চিন্তাতরঙ্গপরম্পরা হৃদয়ে ধারণ করতে করতে মানব-শরীরমনে যে বিশেষ পরিবর্তন সংঘটিত হয়, তাতে আশ্চর্য নেই । বর্তমান যুগের সকল পণ্ডিতই উহা একবাক্যে বিশ্বাস করেন । বিজ্ঞানচর্চা যতই অধিক হচ্ছে, ততই এ বিশ্বাস দৃঢ়মূল হচ্ছে এবং তৎফলস্বরূপ জার্মানি, আমেরিকা প্রভৃতি দেশসমূহে অপূর্ব অভিনবর উপায়ে মনোবিজ্ঞানের চর্চা আরম্ভ হয়েছে । ইহার নাম পরীক্ষাসিদ্ধ মনোবিজ্ঞান বা experimental psychology, প্রত্যেক মানসিক পরিবর্তন বা ভাবের এক এক শারীরিক অনুরূপ এবং প্রত্যেক শারীরিক পরিবর্তনের সহিত চিরসম্বন্ধ এক এক মানসিক প্রতিকৃতি বের করাই এর উদ্দেশ্য । একজন বন্ধু বলেছিলেন - ঔষধ, রাজনীতি এবং ধর্ম, এদের মা-বাপ নেই; বয়স হলে সকলেরই আপনা-আপনি হয়, যত্ন করে শিক্ষা করতে হয় না । কোনস্থানে ঐ তিন বিষয়-সম্বন্ধীয় কোন প্রশ্ন যদি উপস্থিত হয়, তো সমাগত ব্যক্তিমাত্রেই ঐ প্রশ্ন সিদ্ধান্ত করে দিতে অধীর হবে । মনোবিজ্ঞান সম্বন্ধেও এত দিন ঠিক ঐরূপ ছিল - বিশেষতঃ অপরাপর দেশে । পরীক্ষাসিদ্ধ মনোবিজ্ঞানের চর্চা যতই দিন দিন বৃদ্ধি হচ্ছে, ততই কল্পনার আলোকান্ধকারমিশ্রিত ভ্ৰান্তছায়া মনোবিজ্ঞানের অধিকার হতে দূরাপসৃত হয়ে মানসিক গঠন এবং কার্যপ্রণালীর যথাযথ তত্তসমূহ যথার্থ অ্যালোকে আলোকিত হচ্ছে এবং মনোবিজ্ঞান যথার্থ বিজ্ঞানইপদবাচ্যত্ব লাভ করে প্রত্যক্ষসিদ্ধ অন্যান্য শাস্ত্রনিচয়ের সমকক্ষ হচ্ছে ।

প্ৰত্যেক মানসিক ভাবের এক একটি শারীরিক প্ৰতিকৃতি আছে । আবার তদ্বিপরীত অর্থাৎ প্রত্যেক শারীরিক পরিবর্তন এক-একটি মানসিক পরিবৰ্তন উপস্থিত করে, ইহাও সত্য । বহিঃস্থ শক্তিবিশেষ চক্ষুরাদি পঞ্চেন্দ্ৰিয়-পথে পাঁচ প্রকারে শারীরিক পরিবর্তন উপস্থিত করাতেই ঐ সকলের মানসিক প্রতিকৃতিস্বরূপ রূপরসাদি পাঁচ প্রকারের জ্ঞান আমাদের হয়ে থাকে । আবার বিষয় বিশেষে গাঢ় মনোনিবেশ করলে ঘৰ্মনিঃশ্বাসমান্দাদি হওয়াও সকলের প্রত্যক্ষ । নিষ্ঠুর চিন্তাপরম্পরা সর্বক্ষণ মনে জাগরূক থাকাতে চৌরঘাতকাদির বিকট মুখশ্ৰী এবং উদারভাবপ্রবাহ হৃদয়ে নিয়ত ধারণের ফলে সাধুর সৌম্যদর্শনাদিও প্রত্যক্ষসিদ্ধ । আমরা স্থুল স্থুল কতকগুলি পরিবর্তনের কথাই এখানে উল্লেখ করলাম; নতুবা বহিঃশক্তি ইন্দ্ৰিয়পথে আঘাত করে স্নায়ুমণ্ডলকে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে স্পন্দিত করলে সমুদ্রাভিমুখী নদীসকলের ন্যায় স্বায়ু-তরঙ্গসকল মস্তিষ্কাভিমুখে গমন করে এবং চন্দ্ৰমাতাড়িত-সমুদ্রস্ফীতির তরঙ্গাকারে নদীগর্ভপ্রবেশের ন্যায়, আত্মতাড়িত অন্তঃকরণতরঙ্গনিচয় প্ৰথমে মস্তিষ্কে প্ৰবেশ করে স্থূলতর রূপ ধারণ করে । তৎপরে স্বায়ুমণ্ডলে স্পন্দন উৎপন্ন করে, স্নায়বিক তরঙ্গাকারে শরীরেন্দ্ৰিয়ে সঞ্চরণ করে বিভিন্ন-পদার্থবিষয়িণী বুদ্ধি জন্মায়, ইত্যাদি অনেক কথা বলা যেতে পারত । স্নায়ুমণ্ডল এবং মস্তিষ্কের ঐ সকল তরঙ্গরাজি শারীরবিজ্ঞানের আলোচনার বিষয় । পাঠকের কৌতুহল হলে শরীরবিজ্ঞানসম্বন্ধীয় গ্রন্থে উহার অনুসন্ধান করতে পারেন । অন্তঃকরণতরঙ্গনিচয় আবিষ্কার করা এবং যথাযথ পাঠ করাই মনোবিজ্ঞানের বিষয় ।

জ্ঞান-অজ্ঞান, সুখ-দুঃখ, স্বাস্থ্য-অস্বাস্থ্য প্রভৃতি মানবের সকল অবস্থাই ঐরূপে মানসিক এবং শারীরিক পরিবর্তনের ফলে অনুভূত হয় । মানব আপন বুদ্ধি ও কর্ম দ্বারা উন্নত বা অবনত যে অবস্থাতেই উপনীত হউক না কেন, উহা তার শরীর-মনে পূর্বোক্ত পরিবর্তন-তরঙ্গ-পরম্পরার ফলেই এসে উপস্থিত হবে, এ কথা নিশ্চিত । ঐ সকল পরিবর্তনরাজির প্রধানতঃ তিন শ্রেণীতে বিভাগ হতে পারে ।
প্রথম – যেগুলি আদর্শস্থানীয় আত্মপুরুষদিগের শরীর-মনে অনুভূত হওয়াতে মানবমনের বিশেষ উন্নতির পরিচায়ক বলে স্থিরীকৃত হয়েছে;
দ্বিতীয় - যেগুলি জনসাধারণের নিয়ত প্রত্যক্ষ বা অল্পায়াসপ্ৰত্যক্ষ হওয়ার সাধারণ উন্নতির পরিচায়ক, এবং
তৃতীয় - যেগুলি রোগী, দস্যু, লম্পটাদি নিম্নস্থানীয় মানবশরীরমনে নিয়তানুভূত হওয়াতে উহাদের নীচত্বপরিচায়ক ।
উহাদের মধ্যে তৃতীয়শ্রেণীভুক্ত পরিবর্তনরাজি নির্ণয় করা শারীরবিজ্ঞানের বিষয় । দ্বিতীয় শ্রেণীভূক্তগুলি আধুনিক ইউরোপীয় মনোবিজ্ঞানের অধিকারের ভেতর এবং প্রথম শ্রেণীভুক্তগুলি বেদাদি জগতের যাবতীয় ধর্মগ্রন্থনিবদ্ধ দেখতে পাওয়া যায় । এর মধ্যে ভারতীয় মনোবিজ্ঞানের একটু বিশেষত্ব আছে । উহা প্রথম শ্রেণীর পবিবর্তনগুলিকে মনুষ্যোপলব্ধ নিত্য ঐশ্বরিক জ্ঞান বলে এবং ঐ প্রকার অবস্থালাভ করাই সমগ্ৰ সৃষ্টি ও মানবজীবনের একমাত্র চরম লক্ষ্য বলে ধারণা করে দ্বিতীয় ও প্রথম শ্রেণীর কিয়দংশভুক্ত পরিবর্তনরাজি যথাযথ পাঠ করতে চেষ্টা করছে । ভারতের দার্শনিক সেজন্যই বেদনিবদ্ধ ঐ সমস্ত পরিবর্তনরাজি বা অনুভব-সমূহের ইতিহাসকে ‘পুরুষনিঃশ্বসিত আপ্তবাক্যাদি’ নামে অভিহিত করছেন । ভারতের দর্শন সেইজন্য সাধারণ-মানবের উপলব্ধির উপর ভিত্তিস্থাপন না করে জ্বলন্তমহিম মহাপুরুষদিগের উপলব্ধির উপর ভিত্তিস্থাপন করে দণ্ডায়মান । ভারতের দর্শন সেজন্য কেবল কল্পনানুমান সহায়ে রচিত না হয়ে, অন্যান্য দেশের দর্শনসমূহের ন্যায় প্রত্যক্ষীকৃত অনুভব-নিচয়ের উপরেই রচিত হয়েছে । ইউরোপীয় দার্শনিক ভারতের দর্শনসমূহ কল্পনানুমানপ্রসূত ইত্যাদি বলে যতই ঘৃণার চক্ষে দেখুক না কেন, উহা তাঁরই আপ্তপুরুষের অবস্থাবিষয়ক অজ্ঞান এবং অ্যাপ্তবাক্যে শ্ৰদ্ধাহীনতার পরিচায়কমাত্র ।

এখানে প্রশ্ন হতে পারে, ধর্মগ্ৰন্থসমূহনিবদ্ধ জগতের যাবতীয় ধর্মবীরগণের অনুভবসমূহ অশেষ প্রকারে বিভিন্ন, ঐ সকলের ভেতর এমন কোন সর্বজনপ্রত্যক্ষ সাধারণ ভূমি আছে কি, যার উপর মনোবিজ্ঞান ভিত্তিস্থাপন করে দণ্ডায়মান হতে পারে ? বিভিন্নতার ভেতর একথা যতক্ষণ আবিষ্কৃত না হবে, ততক্ষণ কোন বিষয় বিজ্ঞানরাজ্যের অন্তর্বর্তী কেমন করে হবে ? উত্তরে বলা যেতে পারে, নির্বিকল্প সমাধি-অনুভূত প্ৰত্যক্ষ এবং তাৎকালিক শরীরাবস্থান সর্বকালে সৰ্বপুরুষের একরূপই হয়েছে, ইহা ধর্মেতিহাসপ্ৰসিদ্ধ । পরমহংস শ্ৰীরামকৃষ্ণদেব বলতেন, “যেমন সব শিয়ালের এক রা” (এক প্রকার আওয়াজ), সেরূপ নির্বিকল্প-অবস্থায় অনুভূত বিষয়সম্বন্ধে যাবতীয় ঋষি এবং অবতারকুল এক কথাই বলে গেছেন । এখানে ‘নানা মুনির নানা মত’ নেই । সকলের এক মত । বৈদিক ঋষিগণ-সেবিত ‘মহাবাক্যচতুষ্টয়’ অমিতাভ বুদ্ধ-প্রচারিত ‘মহানির্বাণাবস্থা', শিবাবতার শঙ্কর-ঘোষিত 'সোহহংজ্ঞানাবস্থান’, মধুর বৃন্দারণ্যে মাধবপদে উৎসৰ্গীকৃতসর্বস্ব তন্ময়প্ৰাণা গোপীদের আপনাতে শ্ৰীকৃষ্ণবোধ, পিতৃভাবের জ্বলন্ত নিদর্শন মহাত্মা ঈশার জগৎ-পিতার সহিত একত্ববোধ ইত্যাদি সকলই উপাস্য ও উপাসকের মিলনসম্ভূত দ্বৈতবিবর্জিত এক অবস্থাবিশেষকেই যে লক্ষ্য করছে, ইহা স্পষ্ট । ঐ অবস্থাবিশেষ এক হলেও উহাতে উপনীত হবার পথ নানা । একথার আভাসও উদারচরিত বৈদিক ঋষিগণ এবং যাবতীয় অবতারগণও দিয়ে গেছেন । যাস্ককৃত নিরুক্তে আপ্তপুরুষ-সম্বন্ধীয় আলোচনায় বলা হয়েছে যে, দ্বৈতবর্জিত অবস্থানুভব করে আপ্তত্বলাভ আৰ্য এবং ম্লেচ্ছ উভয়জাতীয় পুরুষই নির্বিশেষে করতে পারে ।

আপ্তবাক্যের যথার্থ অর্থ কি, তা আমরা এতক্ষণে বুঝলাম এবং ম্লেচ্ছজাতীয় পুরুষের বাক্যও যে বেদ বলে গণ্য হতে পারে, তাও ঋষিগণ বলেছেন, দেখলাম । আর একটি কথার সত্যতাও এখানে অনুমিত হয় যে, নিৰ্বিকল্প অবস্থা ও উপলব্ধ বিষয় এক হলেও এতে উপনীত হবার পথের নানাত্ব ও ভিন্নত্ব সর্বদাই বর্তমান থাকবে । জগৎ কখনই একধর্মমতাবলম্বী হবে না, কিন্তু কালে ভগবান শ্ৰীরামকৃষ্ণদেব-প্রচারিত “যত মত তত পথ”-বাণীর সত্যতা উপলব্ধি করে পরস্পরের প্রতি দ্বেষভাব পরিত্যাগ করবে ।

ভারতের দর্শন যেমন মহাপুরুষকূলের প্রত্যক্ষের উপর দণ্ডায়মান, ধৰ্মও তদ্রূপ । সেজন্যই ভারতে দর্শন এবং ধর্মের ভিন্ন ভিন্ন ভূমি নির্দিষ্ট হয়নি । ভারতের ঋষি ধৰ্মকে সংসার হতে বিভিন্ন করে মানব উহা করলেও পারে, না করলেও পারে - এ ভাবে দেখেননি । তাঁর দৃষ্টিতে ধর্ম সমগ্র জগৎকে অধিকার করে রয়েছে । সমগ্র সৃষ্টির চরোমোদ্দেশ্যই ধর্ম বা মুক্তিলাভ করা । প্রতি মানব নিজ জীবনে প্রতি কার্যের অনুষ্ঠান করে যে যে অনুভূতিলাভ করছে, সে সকল তাকে ঋজু কুটিল পথ দিয়ে ঐ উদ্দেশ্যলাভের দিকেই অগ্রসর কচ্ছে । ধর্ম এক অবস্থাবিশেষ, মানবের সখের বিষয় নয় । ভাল-মন্দ উভয় প্রকার কার্যের ভেতর দিয়ে, সুখ-দুঃখ উভয় প্রকার কার্যের ভেতর দিয়ে, সুখ-দুঃখ উভয় প্রকার অনুভবের ভেতর দিয়ে, আস্তিক্য-নাস্তিক্য প্ৰভৃতি নানাবিধ বিশ্বাস ও ধারণার ভেতর দিয়ে অবশেষে চরমোন্নতির ফলরূপ মানবজীবনে ধর্ম বা মুক্তি এসে উপস্থিত হয় এবং তখনই মানব নিজে ধন্য হয়ে জগৎ পবিত্র করে ।

আপ্তপুরুষের জীবানুভব-আলোচনায় যে বিশেষ ফল আছে, তা স্পষ্টই বুঝতে পারা যায় । জ্ঞান ষে বিষয়েরই হউক না কেন, মানবের পূর্বকৃত কর্মের কিয়দংশ দগ্ধ করে দেয় । কারণ সংস্কার বা পূৰ্বানুষ্টিত অভ্যাসই মানবকে কর্মে প্ৰবৃত্তি দেয় এবং সংস্কারবিশেষের উৎপত্তি আবার বস্তুবিশেষের বিপরীত ধারণা জন্মে থাকে । সাপের দংশনস্বভাব না জেনেই অজ্ঞ বালক সম্মুখস্থ সর্পধারণে সযত্ন হয় । ইন্দ্ৰিয়পঞ্চক এবং মনের সসীম স্বভাব না জানাতেই মানব এদের সহায়ে নিত্য সত্য উপলব্ধি করবার প্রয়াস করে । অবিমিশ্ৰ সুখলাভ অসম্ভব না জেনেই আমরা এর অন্বেষণে সতত ছুটাছুটি করি ইত্যাদি । অতএব সেই বিপরীত ধারণার স্থানে সেই বস্তুবিষয়ক যথাযথ জ্ঞানের যদি কোনরূপে উদয় হয়, তা হলে সে সংস্কার এবং তৎপ্ৰসূতপূর্ব চেষ্টাদিরও নাশ হবে, এতে আর সন্দেহ কি ? এবং পূর্ণ জ্ঞানানুভবে যে সর্বপ্রকার সংস্কার এবং তৎপ্রসূত নিখিল কর্মসমূহের একান্ত নাশ হবে, এও স্পষ্ট । এজন্যই শ্ৰীভগবান গীতায় বলেছেন - “সৰ্বং কর্মাখিলং পার্থ জ্ঞানে পরিসমাপ্যতে ।” অতএব “ন হি জ্ঞানেন সদৃশং পবিত্ৰমিহ বিদ্যতে” - মানবকে পবিত্র করতে জ্ঞানের সদৃশ দ্বিতীয় বস্তু আর নেই । বস্তুবিষয়ক যথাযথ জ্ঞানই আবার মানুষকে অদ্ভুতশক্তিসম্পন্ন করে তোলে, এও প্রত্যক্ষসিদ্ধ । মনে কর, চৌরলম্পটাদির নীচ প্রবৃত্তিনিচয় তত্তৎ শরীর মনে কেন উপস্থিত হয়, এবিষয়ের কারণানুসন্ধানে তুমি নিযুক্ত হলে । প্রথমতঃ দেখলে যে, যে বিষয় নিয়ে তাদের ঐসকল জঘন্য প্রবৃত্তির উদয় হয়, সেই সেই বিষয় সম্মুখে উপস্থিত হবামাত্র তাদের শরীরস্থ বহিরন্তরবার্তাবাহি-স্নায়ুসমূহ চিরুভ্যাসবশতঃ হৃদয়াদি শারীর যন্ত্রের ন্যায় মানসিক ইচ্ছাশক্তি-প্রয়োগের অপেক্ষা না রেখে আপনা-আপনি স্ব স্ব কার্যে প্রবৃত্ত হয় এবং তৎফলস্বরূপ তারা তত্ত্বৎ জঘন্য কার্য করতে যাচ্ছে, ইহা বিশেষরূপে জানবার পূর্বেই ঐ সকল করে বসে । আরও দেখলে যে, তারা ঐ সকল কার্যই বিশেষ পুরুষত্ব-পরিচায়ক বলে অহংকার করে থাকে এবং তত্ত্বৎ কার্যানুষ্ঠানে বিশেষ আনন্দলাভ হবে ধারণা করে আছে এবং পরিশেষে দেখলে যে, ঐ প্রকার ধারণা হতে তাদের তত্ত্বৎ কার্য-অকরণের বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই । ঐ সকল বিষয় বুঝামাত্রই তোমার বোধ হল যে, তাদের ঐ সকল কার্য ত্যাগ করাতে হলে তাদের বিপরীত অভ্যাসসমূহ করতে শরীরকে শেখাতে হবে । উহা করতে হলে প্রথমতঃ তা’দিগকে এমন স্থানে রাখতে হবে যেখানে প্রলোভনের বিষয়সকল সহজে তাদের সম্মুখে উপস্থিত না হয় । তৎপরে তোমার বোধ হল যে, তাদের পূর্বাভ্যাস তত্ত্বৎ কার্যসমূহ পুরুষত্ব-পরিচায়ক ও বিশেষ আনন্দজনক এই ধারণা হতেই উপস্থিত হয়েছে । তুমি দেখলে যে, তত্ত্বৎ বস্তুবিষয়ক ভুল ধারণা হতেই ঐপ্রকার কার্য করতে তারা পুনঃ পুনঃ অভ্যাস করেছে এবং এখনও করছে । অতএব উহাদিগকে ঐ সকল ত্যাগ করতে হলে পূর্বোক্ত ঐসকল ভুল ধারণাস্থলে ঐ বিষয়ক যথাযথ জ্ঞান যাতে আসে, তোমাকে তাই করতে হবে । মনে কর ঐসকল কার্যকরণে অবশ্যম্ভাবী দুঃখসকল দেখিয়ে তুমি কালে তাদের ধারণাসমূহ পরিবর্তন করতে পারলে । তা হলে তৎফলস্বরূপ তাদের ঐসকল কার্যও যে কালে ত্যাগ হবে, সে বিষয় কি আর বুঝতে হবে ? বৃক্ষের প্রধান মূল ছিন্ন হলে উহার জীবন যেমন অসম্ভব, সেইরূপ ঐ মূলধারণাত্যাগে ঐসকল কার্যের অস্তিত্বও নষ্ট হল । অতএব ঐসকল নীচ মানবমনের কার্যকলাপ-সম্বন্ধীয় জ্ঞানই যে তোমায় ঐ সকল মনপরিবর্তনে শক্তিসম্পন্ন করল, ইহা স্পষ্ট ।

আপ্তপুরুষের অনুভব, স্বভাব ও চেষ্টাদির আলোচনাও আমাদিগকে ঠিক ঐ প্রকার শক্তিসম্পন্ন করে এবং জগৎ মানবজীবন-সম্বন্ধিনী কি প্রকার ধারণা হতে তাঁদের ঐ প্রকার নিঃস্বার্থ চেষ্টাদি হয়ে থাকে, তা বুঝিয়ে দেয় । অশান্তিপূর্ণ মানবজীবনে তাঁদের অপূর্ব শান্তি এবং শোক, দুঃখ, আনন্দাদিতে অদ্ভুত অবিচলতা দেখে তদবস্থালাভে আমাদের অনুরাগী করে এবং তাঁদের জীবনের অদৃষ্টপূর্ব শক্তিপ্রকাশ তাঁদের অবস্থা যে সাধারণ মানুষের অবস্থা হতে অনেক উচ্চ ভূমির অবস্থা এ কথা বুঝিয়ে দিয়ে মানবজীবনের প্রকৃত লক্ষ্য আমাদের চক্ষের সম্মুখে ধারণ করে । তবে শ্রদ্ধার সহিত তাঁদের জীবন-আলোচনা করা আবশ্যক । কারণ শ্রদ্ধাই কোন বিষয়ের জ্ঞানলাভের একমাত্র উপায় । শ্রদ্ধাবিরহিত মন সকল বিষয় আলোচনা করবার কোন আবশ্যকতাই অনুভব করবে না । গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, “অজ্ঞশ্চাশ্রদ্ধধানশ্চ সংশয়াত্মা বিনশ্যতি” – শ্রদ্ধা-বিরহিত সংশয়পূর্ণ মন অজ্ঞান মানব নষ্ট হয় অর্থাৎ সত্য-লাভে সমর্থ হয় না । কারণ শ্রদ্ধার অভাবেই নানাপ্রকার সন্দেহ এসে উপস্থিত হয় এবং মানবকে জ্ঞানলাভ করতে দেয় না ।

এস্থলে প্রশ্ন হতে পারে, তবে কি কোন বিষয়ে সন্দেহ করব না ? যে যা বলে তাই চোখ কান বুজে বিশ্বাস করব ? না, তা করতে হবে না । সত্যলাভ করব - এই দৃঢ় সঙ্কল্প করে শ্রদ্ধার সহিত সকল বিষয় অনুশীলন কর এবং যতক্ষণ না সম্পূর্ণরূপে বুঝতে পার, সকল বিষয় পরীক্ষায় মিলিয়ে পাও, ততক্ষণ নানাপ্রকার প্রশ্ন ও চেষ্টাদি করো । উহাকে সংশয় বা সন্দেহ বলে না । পরীক্ষা না করেই কোন বিষয় মিথ্যা বলে ধারণা করা এবং অগ্ৰাহ্য করাই এস্থলে সংশয় শব্দের অর্থ । উহা না করলেই হল ।

আর এক কথা, শাস্ত্ৰ বলেন আপ্তাবস্থা অর্থাৎ যে অবস্থা লাভ করলে মানব জ্ঞানের চরম সীমায় উপস্থিত হয়ে অতীন্দ্ৰিয় পদার্থের দর্শনে সমর্থ হয় - অপরের জানবার বিষয় নয় । উহা সৰ্বতোভাবে স্বসংবেদ্য । যাঁর হয়েছে, তিনিই জানতে ও বুঝতে পারেন । একথা সত্য বটে, কিন্তু শাস্ত্র একথাও বলেন যে, আপ্তপুরুষের বাহ্যিক প্রকাশ দেখলে তাঁর উচ্চ প্ৰকৃতির বিষয় আমরা জানতে পারি এবং তাঁদের অনুভবাদির আলোচনাই যে অজ্ঞ মানবের তদাবস্থা-লাভের প্রধান সহায়, একথা পতঞ্জলি প্রভৃতি ঋষিকুল একবাক্যে স্বীকার করে গেছেন । তবে যতদিন না আমাদের তদাবস্থা-লাভ হবে, ততদিন যে আমরা তাঁদের মানসিক গঠন ও কার্যপ্রণালী সম্পূর্ণরূপে বুঝতে পারব না এ কথায় আর সন্দেহ কি ?

শ্ৰীকৃষ্ণ-বুদ্ধপ্রমুখ অবতারকুলের জীবনানুভব আবার আপ্ত-পুরুষাপেক্ষাও সমধিক বিচিত্র এবং উচ্চভূমিকারূঢ় । তজ্জন্য তাঁদের চেষ্টাদিকে ঋষিগণ ‘লীলাবিলাসাদি’ নামে এবং তচ্চেষ্টাদির অধিষ্ঠানভূমি - তাঁদের শরীরেন্দ্ৰিয়াদিও শুদ্ধ-সত্ত্ব-গুণনির্মিত বলে নির্দেশ করেছেন । ভগবান শ্ৰীরামকৃষ্ণদেব বলতেন, “যেমন খাদ না হলে গড়ন হয় না, অর্থাৎ স্বর্ণ-রৌপ্যাদি মূল্যবান ধাতুনিচয়ে অলঙ্কারাদি গঠন করতে হলে তাতে তাম্রাদি নিকৃষ্ট ধাতুসকল মিশ্রিত করতে হয়, নতুবা গঠন টেকে না - সেইরূপ রজঃ ও তমোগুণের কিয়দংশ না থাকলে মনুষ্যশরীর হওয়া অসম্ভব ।” অতএব অবতায় শরীর-গঠনে রজঃ-তমোগুণ স্বল্পমাত্রায় বর্তমান, ইহা সত্য । কিন্তু উহা এত অল্প যে, ঐ ভাগ লক্ষ্য না করে তাঁদের শরীর-মনের চেষ্টাদি শুদ্ধসত্ত্বগুণ-প্ৰসুত বলতে পারা যায় ।

আবহমানকাল ধরে মানব বিশ্বাস করেছে, অবতারকুল জগৎকর্তা ঈশ্বরের অংশ হতে উৎপন্ন, অতএব ঐশীশক্তিসম্পন্ন । তাঁরা মানবশরীর ধারণ করে ধর্ম-জগতের চরম তত্ত্বে উপনীত হবার নূতন নূতন পথ আবিষ্কার করে উহা উন্নতাবনত অবস্থাপন্ন সর্বপ্রকারে বিভিন্নপ্রকৃতি মানবের বুদ্ধিগ্রাহ্য করে দেন । ঐ সকল নূতন পথাবিষ্কারে সবিশেষ শক্তির প্রয়োজন । তজ্জন্য তাঁদের শরীরেন্দ্ৰিয়াদির গঠনও তদুপযোগী হয়ে থাকে । সূক্ষ্মাৎ সূক্ষ্ম পরিবর্তন ও অনুভবাদিও উহাতে ধৃত এবং যথাযথ গঠিত হয়ে থাকে । তাঁদের সাধনোদ্যমাদিও অমানুষী চেষ্টাসম্পন্ন এবং জগতের কল্যাণের জন্যই অনুষ্ঠিত কারণ সংযম, প্ৰেম, মুক্তি বা মনুষ্যোপলব্ধ এমন কোন সদ্‌গুণই নেই, যা তাঁদের ‘অনবাপ্তমবাপ্তব্যম্’-লাভ হয়নি, অতএব লাভ করতে হবে । তথাপি তাঁরা ঐ প্রকার অদ্ভুত কর্মাদির অনুষ্ঠান করে থাকেন । সাধারণ মানবের তো কথাই নেই, তাঁরা মনুষ্যশরীরে - দেবপ্রতিম আপ্তপুরুষকুলেরও আদর্শস্থানীয় । আপ্তপুরুষেরা তাঁদের পদানুসরণ করেই আপ্তত্বাদির অবস্থা লাভ করে থাকেন । অথচ তাঁদের সমস্ত জীবনানুভব আপ্তপুরুষদিগেরও হয় না; কেন না ধর্মজগতের নূতন তত্ত্ব ও পথাদি আবিষ্করণজন্য তাঁদের জন্ম গ্ৰহণ নয় । অতএব অবতারকুলের শরীর-মনের অনুভবাদি যে সর্বাপেক্ষা বিচিত্র হবে, এতে আর আশ্চর্য কি ! ভগবান শ্ৰীরামকৃষ্ণদেব বলতেন, “সিদ্ধপুরুষ ও অবতারের প্ৰভেদ শক্তির বিকাশ লয়ে হয়ে থাকে; নতুবা নির্বিকল্প-সমাধিলব্ধ জ্ঞান উভয়ের একরূপই হয়ে থাকে ।” একজন মায়াপ্রসূত কাম-কাঞ্চনাদি হতে কোনরূপে আপনাকে বাঁচিয়ে মুক্তি লাভ করে প্রস্থান করেন; অপর জন অপরকে সাহায্য করবার নিমিত্ত বন্ধনের উপর বন্ধনাদি স্বেচ্ছাপূর্বক গ্রহণ করে তাদের নিকট উপস্থিত হয়ে তাদেরও বন্ধনমোচন করে দেন এবং আপনার বন্ধনও ইচ্ছামাত্ৰ মোচন করে ফেলেন । ভারতের পুরাণসমূহ আর কিছু করুক না করুক, তাঁদের অনুভবাদির ইতিহাস লিপিবদ্ধ করতে কথঞ্চিৎ চেষ্টা করে মনুষ্যকে অমূল্য ধনে ধনী করেছে ।

প্ৰত্যেক ঈশ্বরাবতার বা আপ্তপুরুষচরিত্র আমরা তিন ভাবে আলোচনা করতে পারি । অবিশ্বাস ও নাস্তিকতার চোখে তাঁদের কার্যকলাপাদি দেখে বা শুনে উহা ভণ্ডধূর্তাদির মিথ্যা-কল্পনা-প্ৰসূত বা মানবের রোগবিশেষ বলে বিশেষ অনুধাবন না করেই, একেবারে অগ্ৰাহ্য করতে পারি । অথবা বিশেষ শ্ৰদ্ধা-প্রণোদিত হয়ে ঐ সকল পুরুষের মানবকুল হতে সম্পূৰ্ণ জাতিগত পার্থক্য অনুমান করে তাঁ’দিগকে এক অপূর্ব জীববিশেষ বলে ধারণা করতে পারি । অথবা তাঁদের অস্তিত্বে পূর্ণভাবে বিশ্বাস করে অসক্তবুদ্ধি সত্যানুসন্ধিৎসু দার্শনিকের চোখে তাঁদের কার্যকলাপাদির বিশেষ অনুধাবন ও পরীক্ষা করে তদ্বিষয়ক যথাযথ জ্ঞান লাভে কৃতাৰ্থ হতে পারি ।

প্রথম দৃষ্টি অবলম্বন করলে মানবের যাবতীয় ধর্মেতিহাসই মিথ্যা বলে অগ্রাহ্য করতে হয় এবং মিথ্যা বিশ্বাসাদিও যেমন কখনো কখনেো গৌণভাবে মানবের উপকারে এসেছে, যাবতীয় ধর্মবিশ্বাসাদিও পূর্ব যুগে সেই ভাবে মানবের উন্নতির সহায় হলেও এখন আর তাদের আবশ্যকতা নেই, ইহাই স্বীকার করতে হয় ।

দ্বিতীয় দৃষ্টিতে ঐ সকল মহাপুরুষ-উপলব্ধ অবস্থা ও অনুভবনিচয় তাঁদেরই একায়াত্ত সম্পত্তিবিশেষ বলে স্থির করতে হয় এবং উহা মানব সাধারণের জীবনে কখনই অনুভূত হবার নয়, এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হয় এবং ভক্তিলাভের উপায়মাত্র ভিন্ন অন্য কোন কারণে তদালোচনার নিস্ফলতা প্রমাণ করে অথবা তাঁ’দিগকে নিগ্ৰহাণুগ্রহসমর্থ জীববিশেষ বলে ধারণা করে মানবকে কেবলই তাঁদের কৃপাপ্রার্থী হয়ে থাকতে শিক্ষা দেয়, কিংবা ক্ৰোধনস্বভাধ দণ্ডদাতা উৎকোচগ্ৰাহী দেবতাবিশেষ বলে ধারণা করিয়ে সকাম মানবকে দুর্বলতার পথে দিন দিন অগ্রসর করে ।

তৃতীয় দৃষ্টিতে তাঁ’দিগকে অসাধারণ হলেও মানব বলে সিদ্ধান্ত করে, তাঁদের অনুভবাদি প্ৰত্যেক মানবের মহামূল্য জীবনাধিকারসম্পত্তি বলে নির্ধারিত করে, তাঁ’দিগকে বিশেষরূপে আপনার করে মানবকে আশা ভরসা এবং বিশেষশক্তিসম্পন্ন করে । তাঁদের উচ্চগতি দেখে মানব আপনার উচ্চগতিতে বিশ্বাসাবান হয় এবং সেও সেই বংশপ্রসূত, অতএব সকল ধনের অধিকারী বলে আত্মনিহিত শক্তিতে নির্ভর করে দাঁড়াতে শেখে । এই দৃষ্টি অবলম্বনে মহাপুরুষচরিত্রালোচনার ইচ্ছা বারান্তরে রইল । এখন ভাগীরথীনিষেবিত পঞ্চবটীতলে যাঁর অলৌকিক জীবন বেদাগম-পুরাণাদি জগতের যাবতীয় ধর্মগ্রন্থ-নিবদ্ধ সমগ্র অবতারকুলেরও অনুভবাদি অতিক্রম করে উচ্চতর ভূমিকায় আরোহণ করেছিল, যাঁর অপূর্ব শক্তি-প্রকাশের আরম্ভমাত্র দেখে জগৎ স্তম্ভিত হয়েছে, যাঁর অপূর্ব জীবনালোকে কালরাত্রির ঘনান্ধক্ৰোড়ে লুক্কায়িতপ্রায় বেদাদির অর্থবোধে বাসনাপ্ৰাণ ভোগালোলুপ বর্তমান কালের মানবের একমাত্ৰ সহায়, কামকাঞ্চনপূতিগন্ধপূর্ণ শোকদুঃখময় স্বার্থপর সংসারে ‘বহুজনহিতায় বহুজনসুখায়’ যাঁর বার বার আগমন ও উদ্বোধন, এস, আমরা ধর্মতনু জগদ্‌গুরু সেই ভগবান শ্ৰীরামকৃষ্ণদেবের শ্ৰীপাদুকা মস্তকে ধারণ করে তাঁরই জীবনানুভব সময়ে সময়ে যথাসম্ভব লিপিবদ্ধ করি এবং ধন্য হই ।

_________________________________________
*Scanned Copy Source:
স্বামী সারদানন্দ, ১৯৫৯ : "গীতাতত্ত্ব ও ভারতে শক্তিপূজা", প্রথম প্রকাশ : নভেম্বর ১৯৫৯, প্ৰকাশক : ভোলানাথ দাস, সপ্তর্ষি, ১৩ বঙ্কিম চ্যাটার্জী স্ট্রীট, কলিকাতা-৭০০০৭৩, মুদ্রক : প্রিন্টার্স কর্নার,  ৪৫/এ রাজা দীনেন্দ্ৰ স্ট্রীট, কলিকাতা-৭০০০০৯ । 
"Gitatattwa O Bharote Shaktipuja" by Swami Saradananda, November 1959. Published by Bholanath Das, Saptarshi, 13 Bankim Chatterjee Street, Kolkata-700073. Printed by Printer’s Corner, 45/A Raja Deenendra Street, Kolkata-700009. 

Hard Copy Source:
স্বামী সারদানন্দ, ১৯৬৬ : "গীতাতত্ত্ব", ষষ্ঠ সংস্করণ,  প্ৰকাশক : স্বামী বিশ্বনাথানন্দ, উদ্বোধন কার্যালয়, ১ উদ্বোধন লেন, বাগবাজার, কলকাতা-৭০০০০৩, ২৬তম পুনর্মুদ্রণ ঃ জুন ২০১৫, মুদ্রক : রমা আর্ট প্রেস, ৬/৩০ দনদম রোড, কলকাতা-৭০০০৩০
"Gitatattwa" by Swami Saradananda, July 1966. Published by Udbodhan Office, 1 Udbodhan Lane, Bagbazar, Kolkata-700003; 6th Edition, 26th Reprint: June 2015. Printed by Rama Art Press, 6/30 Dumdum Road, Kolkata-700030.

Headings were later added by rk for clarity.
_________________________________________
Disclaimer:
This site is not officially related to Ramakrishna Mission & Math. This is a personal, non-commercial, research-oriented effort of a novice religious wanderer.
এটি আধ্যাত্মিক পথের এক অর্বাচীন পথিকের ব্যক্তিগত, অবাণিজ্যিক, গবেষণা-ধর্মী প্রয়াস মাত্র ।

[Digitised by scanning (if required) and then by typing mostly in Notepad using Unicode Bengali "Siyam Rupali" font and Avro Phonetic Keyboard for transliteration. Uploaded by rk]

No comments:

Post a Comment