Historicity & Essence

শ্রীকৃষ্ণ ও গীতাতত্ত্ব

(স্বামী হিরণ্ময়ানন্দ)*


সূচিপত্র

1) গীতার প্রাসঙ্গিকতা
2) শ্রীকৃষ্ণের ঐতিহাসিকতা
3) ভাগবত ধর্ম
4) গীতাতত্ত্ব
4.1) সমন্বয়
4.2) নূতন চিন্তাধারা
4.2.1) নিষ্কাম কর্মযোগ
4.2.2) ভক্তি
4.2.3) প্রপত্তি
4.2.4) অবতারতত্ত্ব

1) গীতার প্রাসঙ্গিকতা (Perspective)

গীতার পটভূমিকা হিসাবে বৈদিক ধর্মের শাস্ত্রগ্রন্থসমূহ এবং সেই শাস্ত্রগ্রন্থসমূহের স্থান না জানলে গীতা সম্যক্‌রূপে বোঝা যায় না । আপনারা সকলে ধর্মপরায়ণ । আপনাদের যে ধর্ম তা হচ্ছে হিন্দুধর্ম - স্বামীজীর কথায় বৈদিক বা বৈদান্তিক ধর্ম । তার ভেতরে কি রয়েছে তা জানা আপনাদের অবশ্য কর্তব্য । একজন মুসলমানকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয় তাঁর ধর্ম কি, তিনি বলবেন, 'আমি মুসলমান' এবং হয় তো কোরান থেকে কিছু উদ্ধৃতিও দেবেন । হিন্দুধর্মাবলম্বীদের ঐ প্রশ্ন করা হলে অনেকেই পরিষ্কার করে কিছু বলতে পারবেন না । কেউ কেউ কিছু পুরাণকাহিনী, কিছু রামায়ণ-মহাভারতের কথা, অথবা গীতার অস্পষ্ট ধারণা নিয়ে কিছু হয়তো বলতে পারবেন । আমরা হিন্দু । আমাদের নিজেদের ধর্মের ওপর ততটা টান নেই, যতটা আছে খৃষ্টান বা মুসলমানদের তাদের নিজেদের ধর্মের ওপর । স্বামীজী একবার কাশ্মীরে গিয়ে একজন দরিদ্রা মুসলমান বৃদ্ধা রমণীকে প্রশ্ন করেছিলেন - 'মা তোমার ধর্ম কি ?' তাতে সে রমণীটি বলেছিলেন, 'খুদা কী মেহরবানীসে মৈ তো মুসলমানী হূ ।' - 'ভগবানের দয়ায় আমি মুসলমানী' । আমরা কিন্তু ঠিক এইভাবে অনুভব করি না যে, ভগবানের অপার করূণায় আমরা হিন্দু । এই হিন্দুধর্মের ভেতর ধর্মের যা কিছু উৎকৃষ্ট ভাব সবই নিহিত রয়েছে, এ কথা আমরা অনুভব করি না । আচারগতভাবে আমরা হিন্দুধর্মকে গ্রহণ করেছি এবং আমাদের অধিকাংশ ধর্মীয় অনুষ্ঠানই হচ্ছে আচারগত । সেইটাকেই আমরা হিন্দুধর্ম বলে মনে করেছি । কিন্তু বৈদিক যে ধর্ম সেটাকে আমরা বুঝতে পারি না । সেটা বোঝা কঠিনও । কেন না বেদের ভাষা প্রচলিত সংস্কৃত ভাষা থেকে পৃথক এবং সেটা বোঝা সহজ নয় ।

সেই জন্যই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গীতামুখে বেদান্তের তত্ত্ব উপস্থাপিত করেছেন, যাতে আমরা আমাদের বৈদিক ধর্মের যে শিক্ষা, সেই শিক্ষা লাভ করতে পারি । তাই গীতা হচ্ছে হিন্দুর অবশ্যপাঠ্য গ্রন্থ । তবে গীতা পাঠ করলেই গীতার অর্থবোধ হয় না । ভগবান শঙ্করাচার্য বলেছেন, এটি 'দুর্বিজ্ঞেয়ার্থ' - এই শাস্ত্রের অর্থ বোঝা অত্যন্ত কঠিন । গীতাশাস্ত্র শুনতে হয় উত্তম শিক্ষকের কাছে, জানতে হয় তার তত্ত্ব কি । তবেই গীতার সম্বন্ধে জ্ঞান জন্মে । গীতার যে শ্লোকগুলি আছে সেগুলি কেবল-মাত্র পাঠ করে আমাদের পিপাসা নিবারিত হতে পারে না । অর্থ-নির্ণয় ব্যতিরেকে গীতাপাঠ সম্পূর্ণ সার্থক হয় না ।


2) শ্রীকৃষ্ণের ঐতিহাসিকতা (Historicity of Sri Krishna)

গীতাশাস্ত্রের উদ্গাতা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা পুরাণাদি গ্রন্থে বিশেষভাবে আলোচিত হয়েছে কিন্তু পুরাণাদি গ্রন্থের কিয়দংশ অর্বাচীন তা থেকে আমরা ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সম্পর্কে অনেক কাহিনী জানতে পারি বটে, কিন্তু তাঁর যে ঐতিহাসিক রূপ সেটা জানতে পারি না । শ্রীমদ্‌ভাগবতে শ্রীকৃষ্ণকে বলা হয়েছে 'গূঢ়ঃ কপটমানুষঃ'; তিনি হচ্ছেন কপট মনুষ্য; তিনি ভগবান, কিন্তু তিনি মনুষ্যরূপ ধারণ করে আমাদের ভিতর অবতীর্ণ হয়েছেন এবং তিনি গূঢ়, লোককে জানতে দেন না তাঁর স্বরূপ । শ্রীমদ্‌ভাগবতের ভেতর অনেক অবতারের কথা বলা হয়েছে । তাঁদের মধ্যে অন্য সমস্ত অবতার সম্বন্ধে বলা হয়েছে, 'এতে চাংশকলাঃ পুংসঃ ।' অর্থাৎ এঁরা পরমপুরুষের অংশ বা কলা । আর শ্রীকৃষ্ণ সম্বন্ধে বলা হয়েছে, 'কৃষ্ণস্তু ভগবান্‌ স্বয়ম্‌ ।' অর্থাৎ, কৃষ্ণ হচ্ছেন স্বয়ং ভগবান । এই কৃষ্ণ কে ছিলেন ? কোন্‌ গ্রন্থের ভিতর আমরা কৃষ্ণ সম্পর্কে জানতে পারি ? কৃষ্ণ বলে কেউ ছিলেন কিনা ? কৃষ্ণ কবিদের মানসসৃষ্টি কিনা ? এ সম্বন্ধে জানার প্রয়োজন আছে ।

সেইজন্যই এই বিষয় নিয়ে আলোচনা করবো যে, শ্রীকৃষ্ণ বলে কোন ঐতিহাসিক ব্যক্তি ছিলেন কিনা । ঋগ্বেদের ভিতর একজন কৃষ্ণের উল্লেখ আছে, তিনি একটি গোষ্ঠির অধিপতি ছিলেন কিন্তু তাঁর সম্বন্ধে ঋগ্বেদে আর বিশেষ কিছু উল্লিখিত হয়নি । তারপরে শ্রীকৃষ্ণ যখন আমাদের কাছে এসে উপস্থিত হচ্ছেন, সেটি হচ্ছে উপনিষদের যুগ । ছান্দোগ্য উপনিষদে একজন শ্রীকৃষ্ণের কথা বলা হয়েছে । তিনি দেবকীপুত্র । ঘোর আঙ্গিরসের শিষ্য । তিনি ঘোর আঙ্গিরসের কাছে শিক্ষা পেয়েছিলেন এবং সেই শিক্ষার মধ্যে যেটির কথা বিশেষভাবে উল্লেখ আছে সেটি হচ্ছে ব্রহ্মতত্ত্বের শিক্ষা । তিনি শ্রীকৃষ্ণকে শিখিয়েছিলেন মৃত্যুর সময়ে কিভাবে ভগবানের শরণ নিতে হয় । তিনি 'অক্ষিত', অচ্যুত - তাঁর কোন ক্ষরণ নেই, তাঁর কোন চ্যুতি নেই, তিনি হচ্ছেন পরমব্রহ্ম, পরমতত্ত্ব । এই পরমতত্ত্বের কথা ছান্দোগ্য উপনিষদে বলা হয়েছে । সেই তত্ত্ব আমরা গীতাগ্রন্থেও পাই; অর্থাৎ সেখানে সংক্ষিপ্তভাবে যা বলা হয়েছে গীতায় তা আমরা বিশদভাবে পাই । সেইজন্য পাশ্চাত্য এবং আমাদের দেশের যে সকল পণ্ডিতগণ বলে থাকেন যে, গীতাকার ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলে কেউ ছিলেন না, গীতা অজ্ঞাত কোন ব্যক্তির রচিত গ্রন্থ, তাঁরা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জীবনের এই দিকটি ভাল করে অনুসন্ধান করে দেখেননি ।

তারপর আমরা ইতিহাসের একটি উল্লেখ দেখতে পাচ্ছি, সেটি চন্দ্রগুপ্তের সময়ে - খ্রীষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকে । মেগাস্থিনিস যখন চন্দ্রগুপ্তের রাজসভায় এসেছিলেন, সে সময় সেখানে তিনি বলছেন যে, যারা সৌরসেন নয় তাদের মধ্যে হেরাক্লিসের উপাসনা প্রচলিত আছে তিনি দেখেছেন । কোন্‌ খানে ? না, তিনি বলছেন ক্লীসোবোরা ও মেথোরাতে । এ থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে খ্রীষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন ক্লীসোবোরা এবং মেথোরায় । ক্লীসোবোরা হয়তো কৃষ্ণপুর অর্থাৎ বৃন্দাবন আর মেথোরা হচ্ছে মথুরা । এই কৃষ্ণপুর ও মথুরাতে তাঁর উপাসনা হত । শৌরসেনয় অর্থাৎ শূরসেনের বংশের লোকদের মধ্যে এই উপাসনা প্রচলিত ছিল । এ থেকে মনে হয় যে, শ্রীকৃষ্ণ তখন একটি গোষ্ঠির লোকের কাছে ভগবানরূপে প্রতিভাত ছিলেন ।

তার পরের দিকে যদি আমরা চলে আসি তাহলে দেখব, এই উপাসনা ধীরে ধীরে প্রসারিত হয়েছে । পণ্ডিতেরা অনুসন্ধান করে বলেছেন যে, একটি ধর্ম উদ্ভূত হয়েছিল, যার নাম ভাগবত ধর্ম । সেই ভাগবত ধর্মের উদ্ভবকালকে বলা হয়েছে অষ্টম শতক । আমাদের কিন্তু বিচার করে মনে হয় যে, এই ভাগবত ধর্মের উদ্ভব মহাভারতের সমসাময়িক । জনৈক ইতিহাসবিদের মতে মহাভারতের উদ্ভবকাল খ্রীষ্টপূর্ব আড়াই হাজার বৎসর পূর্বে । মোটামুটিভাবে আড়াই হাজার বা তিন হাজার বৎসর পূর্বের বলে এটিকে আমরা গ্রহণ করেছি । কেননা স্বামী বিবেকানন্দের লেখার ভেতর দেখতে পাচ্ছি, মহাভারতের যে যুদ্ধ, সেটি সংঘটিত হয়েছিল আজ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বৎসর পূর্বে । তাহলে সে সময়টি খ্রীষ্টপূর্ব তিন হাজার বৎসর বলেই ধরতে হয়, সেই সময় শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব হয়েছিল, মহাভারত লিখিত হয়েছিল, বা মহাভারতের যে কাহিনী তার সারাংশ প্রচলিত ছিল এবং একটা বিরাট যুদ্ধ, যে যুদ্ধে ভারতবর্ষের সমস্ত রাজন্যবর্গ যোগদান করেছিলেন, সেই বিরাট যুদ্ধে ভারতবর্ষের একটা সামাজিক পরিবর্তন ঘটেছিল । তাই ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে খ্রীষ্টপূর্ব তিন হাজার বৎসর পূর্বের মানুষ বলেই গ্রহণ করি এবং সেই সময়ই গীতা কথিত হয়েছিল বলে মনে হয় । গীতার ধর্মে একটা নতুন কিছু রয়েছে যার জন্য তাকে সমস্ত বৈদিক ধর্মের সারসংগ্রহ বলা যেতে পারে । আর গীতার সমকালেই অর্থাৎ খ্রীষ্টপূর্ব তিন হাজার বৎসরে ভাগবত ধর্মও প্রচলিত ছিল । ভাগবত ধর্ম হয়তো একটা সীমিত জায়গায় আবদ্ধ ছিল - মেগাস্থিনিসের সময় পর্যন্ত যেটা মথুরা, কৃষ্ণপুর বা বৃন্দাবন ও সন্নিহিত অন্যান্য অংশে একটা গোষ্ঠির ভিতরেই অন্তর্ভুক্ত ছিল । ক্রমে এই ভাগবত ধর্ম ধীরে ধীরে প্রসার লাভ করতে আরম্ভ করলো । আমরা যখন খ্রীষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে এসে পৌছই, তখন দেখি মধ্যভারতে বেসনগর বলে একটা জায়গা আছে, যার প্রাচীন নাম ছিল বিদিশা । এই বিদিশাতে একটি গরুড়ধ্বজ ছিল, যেটি এখনও আছে । এই গরুড়ধ্বজ সাধারণতঃ শ্রীকৃষ্ণের মন্দিরের সামনে থাকে । যে গরুড়ধ্বজটি সেখানে রয়েছে তার ওপরে লেখা আছে 'দেব-দেবস্য বাসুদেবস্য' - দেবদেব যে বাসুদেব, সেই বাসুদেবের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য এটি নির্মিত হল । কার দ্বারা এটি নির্মিত হল ? 'Holiodorus the Bhagavata' এর দ্বারা - হেলিওডোরাস যে ভাগবত ধর্মের প্রতি বিশ্বাসী তার দ্বারা । ইনি একজন গ্রীক । কাজেকাজেই আমরা দেখতে পাচ্ছি ভারতের বাইরেরও যে সব জাতি ভারতের সংস্পর্শে এসেছে, তাদের মধ্যেও এই ভাগবত ধর্ম প্রচলিত ছিল । এই ভাগবত ধর্মের প্রচার শ্রীকৃষ্ণ করেছিলেন । তিনি ধর্মস্থাপনের জন্য এসেছিলেন । যুদ্ধবিগ্রহের দ্বারা দুরাচার রাজন্যবর্গকে বিনাশ করা হয়েছিল । তিনি আবির্ভূত হয়েছিলেন এইজন্যই - যা গীতাতে তিনি স্বয়ং বলেছেন । এই আবির্ভাবের মাধ্যমে অপূর্ব গীতাশাস্ত্র তিনি সকলের সামনে তুলে ধরেছিলেন । শ্রীকৃষ্ণ যে একজন ঐতিহাসিক ব্যক্তি, তাতে কোন সন্দেহ নেই, যদিও তাঁর সময় নিয়ে সন্দেহ রয়েছে । পণ্ডিতরা এ বিষয়ে নানান মত পোষণ করলেও আমাদের ধারণা - যা আগেই বলেছি - তিনি খ্রীষ্টপূর্ব তিন হাজার বৎসরে বর্তমান ছিলেন এবং তখনই তিনি এই মহাগ্রন্থ গীতা অর্জ্জুনকে উপদেশ করেছিলেন । সেই গীতাগ্রন্থ তখন থেকে প্রচলিত, আর তাঁর যে উপদেশ এই গ্রন্থে লিপিবদ্ধ এক সময় তাকে বলা হত ভাগবত ধর্ম ।


3) ভাগবত ধর্ম

এই ভাগবত ধর্মকে বৈদিক ধর্ম বলে কেন মনে করা হত না ? কেন একে আলাদা একটা মতবাদ বলে মেনে নেওয়া হয়েছিল ? তার কারণ হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণ, যে সময়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন, সে সময় বৈদিক ধর্মের যে কর্মকাণ্ড সেটি অনুশীলিত হত এবং বলা হত সেইটাই শ্রেষ্ঠ ধর্ম । এমন কি আমরা দেখতে পাই, মহারাজ যুধিষ্ঠির বৈদিক রাজসূয় ও অশ্বমেধ যজ্ঞ করছেন । তাঁর বংশের জনমেজয় (অর্জ্জুনের প্রপৌত্র - পরীক্ষিতের পুত্র), তিনিও সর্পসত্র মহাযজ্ঞ ও অশ্বমেধ যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেছিলেন । ফলতঃ আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, তৎকালীন সমাজে যাগযজ্ঞাদি যথেষ্ঠ প্রচলিত ছিল । গীতায় আমরা দেখি শ্রীকৃষ্ণ এই কামনামূলক বৈদিক কর্মকাণ্ড পরিত্যাগ করে নিষ্কাম কর্ম করতে বলেছেন, ঈশ্বরে ভক্তির কথা বলছেন । এই সব কারণে তাঁর প্রচারিত ধর্মকে বৈদিক ধর্ম থেকে আলাদা বলে মনে করা হত ।

ধর্মের যে আসল তত্ত্ব সেটা সে সময়ে ছিল গুহাহিত । 'ধর্মস্য তত্ত্বং নিহিতং গুহায়াম্‌ ।' সেটা বাইরে প্রচারিত ছিল না, থাকতো কিছুটা অরণ্যের ভিতরে আরণ্যক হিসাবে । এটা ছিল রহস্যবিদ্যা । সেই রহস্যবিদ্যা প্রকাশিত হত মুষ্টিমেয় মানুষের কাছে । ভাগবত ধর্মের সাহায্যে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সেই ধর্মকে জনসাধারণের কাছে উপস্থাপিত করলেন । তখন বেদপাঠের অধিকার সকলের ছিল না । ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় ছাড়া স্ত্রীজাতি ও শূদ্রের বেদপাঠের অধিকার ছিল না । তাই ঔপনিষদিক ধর্মের অধিকার সর্বসাধারণের ছিল না । ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যে ধর্ম ব্রাহ্মীস্থিতিতে নিয়ে যায়, যে ধর্ম হচ্ছে  ঔপনিষদিক, সেই ধর্মকেই বিস্তারিতভাবে সাধারণ্যে প্রচার করলেন । গীতার ভেতর দিয়ে সেটি দেওয়ায় সেটি সর্বসাধারণের কাছে এলো । এইভাবে গীতারূপ ভাগবত ধর্ম সকলের জন্য, সর্বসাধারণের জন্য, বর্ণ-ধর্ম-নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর স্ত্রী-পুরুষের জন্য কৃপা করে ভগবান ছড়িয়ে দিলেন সমগ্র ভারতবর্ষে ।

এর পরেও আমরা দেখছি এই ভাগবত ধর্ম অনেকে গ্রহণ করেছে, এমন কি খৃষ্টীয় ৩য়-৪র্থ শতকেও গুপ্তরাজবংশীয় রাজারা নিজেদের সম্বোধন করতেন পরম ভট্টারক, পরম ভাগবত বলে । নিজেদের তারা ভাগবতধর্মী বলে উল্লেখ করতেন । সুতরাং ধীরে ধীরে বহুকাল ধরে এই ভাগবত ধর্মের প্রসার হয়েছিল - ইতিহাসের পৃষ্ঠায় আমরা তার উল্লেখ দেখছি । তারপরে পুরাণাদি গ্রন্থের দ্বারা, বিশেষ করে শ্রীমদ্‌ভাগবতের দ্বারা এই ভাগবত ধর্ম বহুল প্রসারলাভ করেছিল । কাজেই শ্রীকৃষ্ণ সম্বন্ধে আমরা একটা সমাধানে এসে পৌছলুম । শ্রীকৃষ্ণ ঐতিহাসিক ব্যক্তি এবিষয়ে কোন সন্দেহ নেই, এবং তিনি যে ভাগবত ধর্ম প্রচার করেছিলেন তাতেও কোন সংশয় নেই ।


4) গীতাতত্ত্ব (Essence)

4.1) সমন্বয় (Synthesis of prevailing ideas)

এখন আমরা একটু আলোচনা করি যে, গীতার ভেতরে কি রয়েছে আর গীতা পাঠ করার মূল উদ্দেশ্য কি ? পণ্ডিতেরা, বিশেষ করে শ্রীযুত তিলক প্রভৃতি মনীষিবৃন্দ এই কথাই বলেছেন যে গীতার প্রধান শিক্ষা হচ্ছে কর্মযোগ । কিন্তু আমরা যদি গীতাকে একটু ভালো করে অনুশীলন করি, তাহলে দেখতে পাব এটি একটি অপূর্ব সমন্বয়-গ্রন্থ । এর ভেতরে শুধু যে কর্মযোগ বলে একটিই যোগ আছে, তা নয় । গীতাগ্রন্থে তৎকাল পর্যন্ত হিন্দুধর্ম বা বৈদিক ধর্মের যত কিছু চিন্তাধারা ছিল, সেই সমস্ত চিন্তাধারাকে গ্রহণ করা হয়েছে । গ্রহণ করে সমন্বিত করা হয়েছে, মিলিয়ে দেওয়া হয়েছে । এই সমন্বয়-সাধন আমরা গীতার ভেতরে দেখতে পাচ্ছি । এই সমন্বয়-সাধনের ভেতরে দেখা যাচ্ছে যে, যজ্ঞাদি কর্মকাণ্ড সে সময় সমাজে প্রচলিত ছিল, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ প্রথমতঃ তার সমালোচনা করলেন । তিনি বললেন, 'ত্রৈগুণ্যবিষয়া বেদা নিস্ত্রৈগুণ্যো ভবার্জুন' - 'হে অর্জুন, এই বেদের ভেতর সত্ত্ব রজঃ তমঃ, ত্রিগুণের বিষয় রয়েছে; তুমি নিস্ত্রৈগুণ্য হও, গুণাদির ঊর্ধে চলে যাও ।' যজ্ঞাদি করলে কি হয় ? না - ত্রিগুণের ভেতরে থাকতে হয় । সেইজন্য তিনি গীতামুখে বেদের কর্মকাণ্ডের কিছু সমালোচনা করলেন । কিন্তু সেইখানেই থামলেন না, যজ্ঞাদি বিষয়ে সাধারণের যে দৃষ্টিভঙ্গী রয়েছে সেই দৃষ্টিভঙ্গীটাকে পালটে দিলেন । সেটাকে একটা আধ্যাত্মিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করলেন । তিনি বললেন, নানারকম যজ্ঞ আছে : দ্রব্য-, জ্ঞান-, তপো-, স্বাধ্যায়-যজ্ঞ ইত্যাদি । এই সব যজ্ঞ যাঁরা করেন, তাঁরা সনাতন ব্রহ্মকে প্রাপ্ত হন । যজ্ঞ ভিন্ন কিছু হয় না । যজ্ঞ থেকে বৃষ্টি হয়, বৃষ্টি থেকে শস্য হয় । শস্য থেকেই প্রাণীদের শরীর উৎপন্ন হয় । ভগবান আরও বললেন, যজ্ঞ কর, তবে কেবল নিজের জন্য কোরো না । 'যারা কেবল নিজেদের জন্য পাক করে, তারা পাপান্ন ভোজন করে ।' সেজন্য অপরের জন্য পাক করো, অপরের জন্য যজ্ঞ করো, পরের কল্যাণের জন্য সমস্ত কিছু করো । এইভাবে যজ্ঞটাকে একটা উচ্চতর ভূমিতে তিনি প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন । যজ্ঞের সঙ্গে কর্মকাণ্ডের ও জ্ঞানকাণ্ডের যে সমন্বয় বা সংহতি সেটা তিনি দেখিয়ে দিলেন গীতার ভেতরে ।

তারপর দেখতে পাচ্ছি, এইরকম একটা মতবাদ ছিল যে, সংসার ত্যাগ করে সন্ন্যাসী হয়ে সমস্ত কর্ম ছেড়ে না দিলে জীবনের চরম উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে না । অর্জুনকে আমরা তাই বলতে শুনি, 'আমি ভিক্ষুবৃত্তি অবলম্বন করবো - সন্ন্যাস গ্রহণ করবো, আমি যুদ্ধ করবো না ।' তখন শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বললেন, 'না - কর্মের প্রয়োজন রয়েছে । তাছাড়া কর্ম ছেড়ে কেউ থাকতে পারে না এক মুহূর্তও, শরীর যতক্ষণ আছে কর্মও ততক্ষণ আছে । শারীরিক কর্ম আপাতদৃষ্টিতে না থাকলেও মানসিক কর্ম থাকবেই ।' শ্রীকৃষ্ণ আরও বললেন - 'কর্মানুষ্ঠান না করে কেউ নৈষ্কর্ম্য-অবস্থা লাভ করতে পারে না, আর কর্মত্যাগ করলেই সিদ্ধিলাভ হয় না ।' কর্মের মধ্য দিয়েই - নিষ্কাম কর্মের দ্বারাই কর্মবন্ধন মোচন হয়, চিত্ত শুদ্ধ হয় । সেই শুদ্ধ চিত্তে আত্মসাক্ষাৎকার হয় । কর্ম মানুষকে করতেই হবে । কর্ম ছাড়া সে থাকতেই পারে না । তাই কর্মের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গীটাই পালটে দিতে হবে । ভগবান অর্জুনকে তাই বলছেন - 'শাস্ত্রবিহিত কর্ম তুমি করো ।' এইভাবে কর্ম ও কর্মসন্ন্যাস এই দুটোয় তিনি মিলন স্থাপন করলেন ।

তারপর তখন সাধনার নানা পন্থা ছিল । কেউ জ্ঞান-সাধনা করতো, কেউ ভক্তি-সাধনা, কেউ যোগ-সাধনা । আর এই সব পন্থা নিয়ে পরস্পর সংঘাত বিবাদ-বিসংবাদ লেগেই ছিল । ভগবান শ্রীকৃষ্ণ দেখিয়ে দিলেন যে, সব সাধন-পন্থাকে সমন্বিতভাবে গ্রহণ করতে হবে । কর্ম, ভক্তি, জ্ঞান ও যোগ - এই চারটির প্রত্যেকটি পৃথক্‌ পথ । কিন্তু চরমে সব পথই এক তত্ত্বে মিলিত হবে । কর্ম সম্বন্ধে শ্রীকৃষ্ণ বললেন - 'অনাসক্ত হয়ে কর্ম করলে মানুষ পরমা গতি প্রাপ্ত হয় । সুতরাং তুমি অনাসক্ত হয়ে সতত কর্তব্য কর্মের অনুষ্ঠান করো ।'

জ্ঞানপথের প্রসঙ্গে শ্রীকৃষ্ণ বললেন - 'সর্বত্র সমবুদ্ধি, সকলেরই কল্যাণে নিরত, যাঁরা ইন্দ্রিয়গুলিকে সংযত করে শব্দাদির অগোচর, অব্যক্ত, সর্বব্যাপী, অচিন্ত্য, নির্বিকার, অচল ও শাশ্বত নির্গুণব্রহ্মকে উপাসনা করেন, তাঁরা আমাকেই প্রাপ্ত হন ।' এখানে শ্রীভগবান জ্ঞানীর লক্ষ্য নির্গুণব্রহ্ম সম্বন্ধেও বললেন আবার জ্ঞানমার্গের সাধনপদ্ধতিরও উল্লেখ করলেন ।

আবার ভক্তির প্রসঙ্গে ভগবান অর্জুনকে বললেন - 'হে শত্রুতাপন অর্জুন, অনন্যা ভক্তির দ্বারাই আমাকে জানতে, প্রত্যক্ষ করতে এবং আমাতে প্রবেশ করতে অর্থাৎ মুক্তিলাভ করতে ভক্তেরা সমর্থ হয় ।' ভগবান আরও বললেন - 'ভক্তির দ্বারাই সাধক আমার সগুণ ও নির্গুণরূপ জানেন এবং সেই নির্গুণরূপ জানার পরেই আমাতে প্রবিষ্ট হন অর্থাৎ মুক্তিলাভ করেন ।'

যোগসাধনার প্রসঙ্গে ভগবান বললেন - 'বাহ্য বিষয়গুলি মনের বাহিরে রেখে অর্থাৎ সেগুলি চিন্তা না করে ভ্রূযুগলের মধ্যে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে, নাসিকার অভ্যন্তরে বিচরণশীল প্রাণ ও অপান বায়ুকে কুম্ভকের দ্বারা সমান করে - নিরুদ্ধ করে, যে মোক্ষপরায়ণ মুনি ইন্দ্রিয় মন ও বুদ্ধিকে সংযত করেছেন এবং ইচ্ছা, ভয় ও ক্রোধ রহিত হয়েছেন, তিনি সর্বদাই মুক্ত ।'

এই ভাবে চারটি যোগের সমন্বয়ও এই গীতাশাস্ত্রের মধ্য দিয়ে দেখান হয়েছে । তারপরে নানারকম তত্ত্বের সমন্বয় ভগবান করেছেন গীতাতে । আমরা দেখতে পাই উপনিষদের ভেতরেও রয়েছে এই সব তত্ত্ব । এক-একজন এক-একটা তত্ত্বকে গ্রহণ করে তার উপর ভাষ্য রচনা করেছেন । যেমন ভগবান শংকরাচার্য বলেছেন অদ্বৈত-তত্ত্বই হচ্ছে ঠিক ঠিক উপনিষদের উপদেশ । কিন্তু গীতার ভেতরে সব তত্ত্বই ভগবান গ্রহণ করছেন । যেমন তিনি বলছেন - 'জ্ঞানের সদৃশ পবিত্র আর কিছুই এ জগতে নেই ।' এখানে জ্ঞান মানে ব্রহ্মজ্ঞান । 'জ্ঞানাগ্নি সমস্ত কর্মকে পুড়িয়ে শেষ করে দেয় ।' আবার তিনি বলছেন - 'অব্যক্তের যাঁরা চিন্তা করেন, জ্ঞানের অনুশীলন যাঁরা করেন, তাঁদের অত্যন্ত ক্লেশ হয় ।' কেননা তাঁরা দেহবান তো ! দেহকে 'নেতি নেতি' করে, জগতের সব কিছু 'নেতি নেতি' করে অব্যক্তকে লাভ করা অত্যন্ত ক্লেশকর । এই অব্যক্তই হচ্ছে পরমতত্ত্ব, নির্গুণব্রহ্ম । আবার যখন যাচ্ছি পুরুষোত্তমযোগে, ভগবান বলছেন - 'ইহলোকে ক্ষর আর অক্ষর নামে প্রসিদ্ধ দুটি পুরুষ আছেন ।' আর এই দুই পুরুষ থেকে ভিন্ন এক উত্তম পুরুষ আছেন, যাঁকে পরমাত্মা বলা হয় । শংকারাচার্য এর অদ্বৈতপর ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন যে 'ক্ষর' মানে হচ্ছে জীবজগৎ । এই যে সমস্ত জীব রয়েছে, জগৎ রয়েছে এইটা হচ্ছে 'ক্ষর' বস্তু, এর সর্বদা ক্ষরণ হচ্ছে, ক্ষর হচ্ছে । আর 'অক্ষর' হচ্ছে কূটস্থ । জগতের সব কিছুর উৎপত্তিবীজ - শংকরের মতে সেটা হচ্ছে মায়া । এই কারণরূপিণী মায়া আর কার্যরূপী জীবজগতের উপরে রয়েছেন উত্তম পুরুষ - যাঁকে পরমাত্মা বলা হয় । শংকরের এই যে ব্যাখ্যা, এটা যদি আমরা বিচার করে দেখি, তাহলে মনে হয় একটু যেন টেনে ব্যাখ্যা করা হয়েছে ।

রামানুজ বিশিষ্টাদ্বৈতবাদের প্রবক্তা । তাঁর মতে পরমাত্মা জীবজগৎবিশিষ্ট - 'চিৎ' অর্থাৎ জীব এবং 'অচিৎ' অর্থাৎ জড়, এই দুই-ই তাঁর বিভূতি । রামানুজ 'ক্ষর' এর মানে করেছেন বদ্ধ আত্মা অর্থাৎ অচিৎ-সংসর্গযুক্ত জীব, যে বারবার জন্মমৃত্যুর অধীন হয়; আর 'অক্ষর' মানে মুক্ত আত্মা অর্থাৎ অচিৎ-সংসর্গমুক্ত জীব, যাঁর ক্ষরণ নেই, যিনি জন্মমৃত্যুর অধীন হন না । পরমাত্মা হচ্ছেন বদ্ধ আত্মা এবং মুক্ত আত্মা - 'ক্ষর' পুরুষ এবং 'অক্ষর' পুরুষ, এই দুই থেকে ভিন্ন, তিনি উত্তম পুরুষ । রামানুজের এই ব্যাখ্যা শংকরের ব্যাখ্যা অপেক্ষা স্বাভাবিক মনে হয় । আবার গীতার অন্যত্র মধ্বাচার্যের দ্বৈতপর ব্যাখ্যাও সমীচিন মনে হয় । সুতরাং দেখা যাচ্ছে, উপনিষদে যেমন, গীতাতেও তেমনি বিভিন্ন মতবাদের স্থান রয়েছে

মানুষের ভেতরে বিভিন্ন রকমের লোক রয়েছে । তাদের মধ্যেও একটা সমন্বয় শ্রীকৃষ্ণ করেছেন । সাত্ত্বিক, রাজসিক ও তামসিক - বিভিন্ন চরিত্রের মানুষের কথা বলেছেন, কাউকে তিনি বাদ দেন নি, দূর করে দেন নি । সকলকেই গ্রহণ করেছেন । আহার নিয়েও বিচার করেছেন । কোন্‌ স্বভাবের লোকের কি ধরণের আহার প্রিয় এবং ইচ্ছা করলে মানুষ কিভাবে তম থেকে রজে ও রজঃ থেকে সত্ত্বে যেতে পারে আহার নির্বাচন করে, তাও তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন ।  এইভাবে বিভিন্ন তত্ত্ব, সাধনপন্থা, অধিকারী-ভেদ, সাধকদের স্বভাব, তাদের বিভিন্ন রুচি, এই সব কিছু নিয়ে একটা পূর্ণাঙ্গ চিত্র সৃষ্টি করে শ্রীকৃষ্ণ সমন্বয় সাধন করেছেন । সেইজন্য স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, গীতা হচ্ছে 'ধর্মসমন্বয়-শাস্ত্র' । তিনি বলেছেন, গীতার যে সমন্বয় সেটি বিরাট, তদানীন্তন কালে ভারতের যে সকল ভাবধারা ছিল, সেগুলি গ্রহণ করে শ্রীকৃষ্ণ একত্র সমন্বিত করেছিলেন । বহু ভাবধারার - শত শত বৎসরের ঐতিহ্যময় ভাবধারার সমন্বয় তিনি করেছিলেন । তারপর আবার বহু ভাবধারা এই ভারতবর্ষে এসেছে, বহু ভাবধারার উদ্ভব হয়েছে । মানুষের ভেতর কোলাহল, কলহ, সংঘর্ষ উপস্থিত হয়েছে । তাই আবার এই ভাবধারায় সমন্বয়ের প্রয়োজন হয়েছিল । এবং ঐ ভাবধারায় সমন্বয়ের যে প্রয়োজন সেটি সাধিত করেছিলেন ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ । আর স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণের মধ্য দিয়ে যে সমন্বয় সেটা আরও বিস্তৃততর, আরও ব্যাপকতর । যাই হোক ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এই সমন্বয় করেছিলেন । অন্যান্য অবতাররা আসেন - নির্দিষ্ট যুগের কিছু প্রয়োজন মিটিয়ে দিয়ে চলে যান । রামচন্দ্রকে মর্যাদা-পুরুষোত্তম বলা হয় । তিনি রাজারূপে, স্বামীরূপে, পুত্ররূপে, ভ্রাতারূপে একটা আদর্শ জীবন সকলের সামনে তুলে ধরে দেখিয়ে গেলেন । কিন্তু শ্রীকৃষ্ণের জীবনে এ ছাড়াও আছে একটা সমন্বয় সমস্ত চিন্তাধারার । সকল চিন্তাধারার সমন্বয় তাঁতে হয়েছে । সেইজন্যই ভাগবতকার তাঁকে বলেছেন - 'কৃষ্ণস্তু ভগবান্‌ স্বয়ম্‌' অর্থাৎ 'তিনি অন্যান্য অবতার থেকে পৃথক্‌ । স্বয়ং ভগবান ।' কাজেই সমন্বয়-পুরুষ হচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণ । এই সমন্বয়ই হচ্ছে গীতার প্রধান শিক্ষা ।


4.2) নূতন চিন্তাধারা (Nascent ideas)

4.2.1) নিষ্কাম কর্মযোগ

এ ছাড়া আরও কতকগুলি শিক্ষা গীতায় আছে যেগুলি বেদের ভিতরে স্ফুটনোন্মুখ - প্রস্ফুটিত ভাবে পাওয়া যায় না । যেমন, নিষ্কাম কর্মযোগ, যে সম্বন্ধে আগেই বলা হয়েছে ।


4.2.2) ভক্তি

তারপরে আর একটা চিন্তাধারা । সেটিও প্রায় নূতন । সেটি হচ্ছে ভক্তি, ভক্তির কথা, যা উপনিষদে প্রায় নেই, খুব নবীন কালের উপনিষদ্‌ ছাড়া এবং যেগুলি গীতার পরেই লিখিত বলে মনে হয় । প্রাচীন উপনিষদের ভেতরে আমরা কি দেখতে পাচ্ছি ? শ্রদ্ধার কথা - নচিকেতার শ্রদ্ধার কথা । নচিকেতার কি হল ? শ্রদ্ধা আবিবেশ - তার ভেতরে শ্রদ্ধা এলো । শ্রদ্ধা কি ? শঙ্করের ভাষ্য অনুসারে 'আস্তিক্যবুদ্ধি' । সেটিকেই অন্য জায়গায় বলা হয়েছে - 'গুরু ও বেদান্তবাক্যে বিশ্বাস ।' এই হল শ্রদ্ধা, এর কথা উপনিষদে আছে । কিন্তু ভক্তির কথা নেই, আছে কেবলমাত্র শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে, যেটি অনেক পরবর্তী কালের । 'যার দেবতাতে পরমা ভক্তি আছে এবং ঐ ভক্তি যার শ্রীগুরুতেও আছে' ইত্যাদি কথা সেখানে বলা হয়েছে । গীতার আগে কিন্তু ভক্তির কথা অন্য কোথাও পাওয়া যায় না । ভাগবত ধর্ম হচ্ছে এই ভক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত ।


4.2.3) প্রপত্তি (Taking refuge in God)

এই ভক্তির কথা বলতে গিয়ে আর একটা নূতন চিন্তাধারার মধ্যে গিয়ে গীতা পৌঁছেছেন । সেটা হচ্ছে প্রপত্তি । প্রপত্তি হচ্ছে শরণাগতি - ভগবানের শরণ নেওয়া সর্বতোভাবে । এই প্রপত্তির কথা গীতার সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছে । শুরুতেই অর্জুন বলছেন - 'আমি তোমার শিষ্য, তোমার প্রপন্ন - তোমার শরণাগত, আমাকে উপদেশ দাও ।' গীতার শেষেও ভগবান অর্জুনকে বলছেন - 'হে অর্জুন, তুমি সর্বতোভাবে তাঁরই - সেই ঈশ্বরেরই - শরণাগত হও; সব ধর্মাধর্ম ছেড়ে একমাত্র আমারই শরণ নাও ।' আর গীতার মধ্যেও বহ্যবার এই প্রপত্তির কথা এসেছে । যেমন - 'ভগবান সকলেরই আশ্রয়, সকলেরই শরণ্য ও মঙ্গলকারী ।' আবার প্রপন্ন ভক্তকে কিভাবে প্রার্থনা করতে হবে, তাও ভগবান শেখাচ্ছেন - 'আমি সেই আদিপুরুষের শরণ নিচ্ছি, যিনি এই অনাদি-সংসার-প্রবাহের উৎস ।'

এই যে প্রপত্তি, এটিও একটি নূতন চিন্তাধারা, যা গীতার মধ্যে আমরা পাই । আদিতে, মধ্যে ও অন্তে শরণাগতির কথা থাকায় অনেকে গীতাকে শরণাগতি-শাস্ত্র বলেন ।


4.2.4) অবতারতত্ত্ব (Avatar principle)

আর একটি নূতন চিন্তাধারা গীতায় আছে, যা বেদের ভেতর নেই । সেটি অবতারতত্ত্ব । বেদের ভেতরে আধিকারিক পুরুষের কথা আছে । যেমন ছান্দোগ্য উপনিষদের এক জায়গায় আদিত্যের যে কথা আছে, শঙ্করাচার্যের মতে তা আধিকারিক পুরুষের প্রসঙ্গ । আধিকারিক পুরুষেরা একটা কল্প ধরে অধিকার নিয়ে থাকেন - যেমন সূর্য সহস্র যুগ পর্যন্ত জগতের অধিকার (তাপদানাদি কার্য) নির্বাহ করেন । তবে এঁরা সৃষ্টি-স্থিতি-লয় করতে পারেন না । কিন্তু গীতার অবতারতত্ত্ব হচ্ছে সম্পূর্ণ পৃথক্‌ । যে পরম তত্ত্ব হচ্ছে জগতের একমাত্র বস্তু - The reality behind the whole universe - সেই পরম তত্ত্বই এই জগতে নেমে আসে, মানুষের দেহ অবলম্বন করে । সেই ভগবানকে, যিনি মানুষদেহ ধারণ করে নেমে এসেছেন, তাঁকেই ভক্তি করতে হবে, তাঁর কথা অনুসারে চলতে হবে, তাঁতে সর্বকর্মফল সমর্পণ করতে হবে । ভগবান মানুষ হয়ে নেমে আসেন (doctrine of incarnation) - এই তত্ত্বটা হচ্ছে সবচেয়ে বড় তত্ত্ব গীতার ভেতর । কি করে তা সম্ভব হয় ? কেউ কেউ বলছেন, তাঁর অচিন্ত্য শক্তি আছে, সেই শক্তিতে তিনি মানুষ হয়ে যান । এমন কি ভগবান শঙ্করাচার্য, যিনি অদ্বৈতবাদী, যাঁর মতে ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা; যাঁর নিজের কথা - 'কোটি কোটি গ্রন্থের দ্বারা যা বলা হয়েছে, সেইটাই আমি অর্ধ, শ্লোকে বলবো - ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা', তিনি পর্যন্ত গীতাভাষ্যের শুরুতে বলেছেন, জ্ঞান ঐশ্বর্য শক্তি বল বীর্য তেজ ইত্যাদি সম্পন্ন ভগবান মানুষদেহ ধারণ করলেন । কি করে করলেন ? না - নিজেরই মায়া মূলপ্রকৃতিকে বশ করে । ভগবান মায়াধীশ আর জীব মায়াধীন । তাই ভগবানই নিজ মায়াকে বশীভূত করতে পারেন এবং তাই করে তিনি যুগে যুগে জীবের কল্যাণের জন্য অবতীর্ণ হন ।
_________________________________________
*Hard Copy Source:
"Srimadbhagabadgeeta" translated by Swami Jagadeeshwarananda, edited by Swami Jagadananda. 27th Reprint - January, 1997 (1st Edition - 1941), © President, Sriramkrishna Math, Belur. Published by Swami Satyabrotananda, Udbodhan Office, 1 Udbodhan Lane, Bagbazar, Kolkata-700003. Printed by Rama Art Press, 6/30 Dum Dum Road, Kolkata-700030.

Contents with numbering, subheadings & emphases are not present in the original source. They are added later by uploader for clarity.
_________________________________________ 
Disclaimer:
This site is not officially related to Ramakrishna Mission & MathThis is a personal, non-commercial, research-oriented effort of a novice religious wanderer.
এটি আধ্যাত্মিক পথের এক অর্বাচীন পথিকের ব্যক্তিগত, অবাণিজ্যিক, গবেষণা-ধর্মী প্রয়াস মাত্র ।

[Digitised by scanning (if required) and then by typing mostly in Notepad using Unicode Bengali "Siyam Rupali" font and Avro Phonetic Keyboard for transliteration. Uploaded by rk]

No comments:

Post a Comment