Varna (Krishna) vs Caste (Manu)


(গীতাশাস্ত্রী জগদীশচন্দ্র ঘোষ)*

গুণভেদে বর্ণভেদ ও কর্মভেদ


বর্ণচতুষ্টয় গুণ ও কর্মের বিভাগ অনুসারে আমি সৃষ্টি করিয়াছি বটে, কিন্তু আমি উহার সৃষ্টিকর্তা হইলেও আমাকে অকর্তা ও বিকাররহিত বলিয়াই জানিও । [৪|১৩]

হে পরন্তপ, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রদিগের কর্মসকল ভাবজাত গুণানুসারে পৃথক্‌ পৃথক্‌ বিভক্ত হইয়াছে । [১৮|৪১]

শম, দম, তপঃ, শৌচ, ক্ষমা, সরলতা, জ্ঞান, বিজ্ঞান ও সাত্ত্বিকী শ্রদ্ধা - এই সমস্ত ব্রাহ্মণের স্বভাবজাত কর্ম (লক্ষণ) । [১৮|৪২]

পরাক্রম, তেজ, ধৈর্য, কার্যকুশলতা, যুদ্ধে অপরাঙ্মুখতা, দানে মুক্তহস্ততা, শাসন-ক্ষমতা, এইগুলি ক্ষত্রিয়ের স্বভাবজাত কর্ম (লক্ষণ) । [১৮|৪৩]

কৃষি, গোরক্ষা ও বাণিজ্য বৈশ্যদিগের এবং সেবাত্মক কর্ম শূদ্রদিগের স্বভাবজাত । [১৮|৪৪]

এস্থলে ব্রাহ্মণাদির যে বিভিন্ন লক্ষণ ও কর্মভেদ বলা হইল তাহা প্রকৃতির গুণভেদানুসারেই নির্দিষ্ট হইয়াছে । ব্রাহ্মণ সত্ত্বগুণপ্রধান, শমদমাদি তাঁহার স্বভাবের প্রধান গুণ এবং তদনুসারেই যজন, যাজন, অধ্যয়ন, অধ্যাপনা, দান ও প্রতিগ্রহ (অযাচিত দানগ্রহণ), তাঁহার পক্ষে এই ছয়টি কর্ম নির্দিষ্ট হইয়াছে । তন্মধ্যে যাজন, অধ্যাপনা ও প্রতিগ্রহ এই তিনটি ব্রাহ্মণের জীবিকার্থ বিশেষ ধর্ম ।

ক্ষত্রিয়ের প্রকৃতি সত্ত্বসংমিশ্রিত রজোগুণপ্রধান এবং শৌর্য-বীর্যাদি তাহার চরিত্রের প্রধান গুণ, এই হেতু যজন, অধ্যয়ন, দান এই সকল ব্যতীতও রাজ্যরক্ষা, প্রজাপালনাদি কর্ম তাহার পক্ষে বিহিত হইয়াছে ।

বৈশ্য-চরিত্রে তমঃসংমিশ্রিত রজোগুণের আধিক্য, এই হেতু কৃষিবাণিজ্যাদি তাহার কর্ম নির্দিষ্ট হইয়াছে ।

শূদ্রের প্রকৃতিতে রজঃ-সংমিশ্রিত তমোগুণের আধিক্য, তাহারা স্বভাবতঃই জড়বুদ্ধি, এই হেতু কেবল পরিচর্যাত্মক কর্ম তাহাদের জন্য নির্দিষ্ট হইয়াছে ।

এইরূপে ব্রাহ্মণের জ্ঞান, ক্ষত্রিয়ের তেজ, বৈশ্যের ধন ও শূদ্রের সেবা দ্বারা সমাজ-রক্ষার সুশৃঙ্খল ব্যবস্থা হইয়াছে । সুতরাং সকলেরই সমাজ-রক্ষার অনুকূল এই ব্যবস্থা অনুসরণ করিয়া, স্বধর্ম পালন করা উচিত, ইহাই শাস্ত্রের অভিপ্রায় । মনুষ্য স্বধর্ম পালন করিলেই পরম সিদ্ধি লাভ করিতে পারে ।


স্বধর্ম


স্বধর্ম কিঞ্চিদ্দোষবিশিষ্ট হইলেও উহা উত্তমরূপে অনুষ্ঠিত পরধর্মাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ । স্বধর্মে নিধনও কল্যাণকর, কিন্তু পরধর্ম গ্রহণ করা বিপজ্জনক । [৩|৩৫]

গীতার মূলকথা, স্বধর্ম পালন । বর্তমানে (জাতিগতভাবে) ব্রাহ্মণগণ জীবিকানির্বাহার্থ বৈশ্য-শূদ্রাদির কর্ম গ্রহণ করিয়াছেন । পক্ষান্তরে (জাতিগতভাবে) শূদ্রাদিও অন্য বর্ণের কর্ম গ্রহণ করিয়া জীবিকার্জন করিতেছেন । অতএব 'স্বধর্ম' বলিতে আমরা আধুনিক হিন্দুগণ কি বুঝিব ?


স্বধর্ম শব্দের রক্ষণশীল (conservative) ব্যাখ্যা


স্বধর্ম = বর্ণাশ্রমবিহিত ধর্ম; স্বভাবনিয়ত ধর্ম

বর্ণাশ্রমধর্ম ত্যাগ করিলে হিন্দুধর্ম থাকে না । শ্রীভগবান্‌ স্বয়ং গীতায় বর্ণাশ্রম (বংশগত জাতিধর্ম নয় কিন্তু) পালনের কর্তব্যতা নির্দেশ করিয়াছেন [৩|৩৫], ইহার উপরে টীকা-টিপ্পনী চলে না । যাহাতে হিন্দু-সমাজে আবার বর্ণাশ্রমধর্ম সম্যক্‌রূপে সংস্থাপিত হয়, তাহাই কর্তব্য ।

"প্রাচীন সংস্কারবশতঃ মানুষ এক একটি মুখ্য অভ্যাস লইয়া জন্মগ্রহণ করে । যাহার যে অভ্যাস বা সংস্কারে জন্ম সে সেই ভাব লইয়াই ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শুদ্রত্ব প্রাপ্ত হয় । এ জন্য বর্ণাশ্রম-ধর্ম স্বাভাবিক ।" - [রামদয়াল মজুমদার]

যিনি ব্রাহ্মণবংশে জন্মগ্রহণ করেন, তাঁহার স্বভাব সত্ত্বগুণ-প্রধান, যিনি শূদ্রবংশে জন্মগ্রহণ করেন, তাঁহার স্বভাব তমোগুণ-প্রধান, ইহাই সমীচীন সিদ্ধান্ত (?) । বংশানুক্রমদ্বারা স্বভাবের বিশুদ্ধি এবং স্বভাবানুগত কর্মকুশলতা পুরুষানুক্রমে রক্ষিত । এই জন্য জাতিভেদ বংশানুগত । "যেমন ব্যাঘ্রের শিশু ব্যাঘ্রই হয়, আম্রবীজ হইতে আম্রবৃক্ষই জন্মে, সেইরূপ ব্রাহ্মণ নিজশক্তির ব্যভিচার না করিলে তাঁহার সন্তান ব্রাহ্মণই হইয়া থাকেন ।"

স্বধর্ম শব্দের পরিবর্তবাদী/সংস্কারক (reformist/liberal) ব্যাখ্যা


স্বধর্ম = কর্তব্য কর্ম (duty); স্বভাবনিয়ত কর্ম [শ্রীঅরবিন্দ]

"To die performing duty is no ill;
But who seeks other roads shall wander still." - [The Song Celestial, Arnold]

"Better death in the discharge of one's
Own duty, the duty of another is full of danger." - [Annie Besant]

সমাজমাত্রেই কর্মানুসারে শ্রেণী-বিভাগ আছে । (i) যাঁহারা ধর্ম ও জ্ঞান চর্চা করেন এবং লোকশিক্ষা দেন তাঁহারাই ব্রাহ্মণ, (ii) যাঁহারা দেশ রক্ষা করেন তাঁহারা ক্ষত্রিয়, (iii) যাঁহারা কৃষি-শিল্প-বাণিজ্য দ্বারা দেশের অন্নবস্ত্রের ব্যবস্থা করেন তাঁহারা বৈশ্য এবং (iv) তিন শ্রেণীর সাহায্যার্থে যাঁহারা পরিচর্যাত্মক কর্ম করেন তাঁহারা শূদ্র

"এই সকল কর্মের মধ্যে যিনি যাহা গ্রহণ করেন, উপজীবিকার জন্যই হউক আর যে কারণেই হউক, যাহার ভার আপনার উপর গ্রহণ করেন, তাহাই তাঁহার অনুষ্ঠেয় কর্ম, তাঁহার duty, তাহাই তাঁহার স্বধর্ম ।" - [শ্রীমদ্ভগবদ্‌গীতা, বঙ্কিমচন্দ্র, পৃঃ২০]

অনাদি কাল হইতে আম্রবীজ হইতে আম্রবৃক্ষই জন্মিতেছে, ব্যাঘ্রের শিশু ব্যাঘ্রই হইতেছে; কিন্তু সত্ত্বগুণ-প্রধান আদি ব্রাহ্মণ হইতে কেবল শমদমাদিগুণসম্পন্ন সন্তানের জন্ম হইতেছে না, পক্ষান্তরে তমোগুণপ্রধান আদি শূদ্রের বংশধরগণের মধ্যেও সত্ত্বগুণ-সম্পন্ন লোক পরিদৃষ্ট হইতেছে ।  সুতরাং স্বভাবের বিশুদ্ধিরক্ষার বা স্বভাব নির্ণয়ের একমাত্র নিয়ামক বংশানুক্রম নহে ।


বিপিনচন্দ্র পালের ব্যাখ্যা

"প্রকৃতিজাত গুণানুসারেই চতুর্বর্ণের কর্মসকল  বিভক্ত হইয়াছে ।" [১৮|৪১] - এ কথার তাৎপর্য কি এবং "স্বধর্ম অপেক্ষা পরধর্ম ভয়াবহ" [৩|৩৫] কেন ? 

স্বধর্ম বলিতে ভগবান্‌ প্রত্যেক জীবের নিজস্ব প্রকৃতির যে ধর্ম তাহাকেই নির্দেশ করেছেন । জীবপ্রকৃতি সাত্ত্বিক, রাজসিক ও তামসিক এই তিন গুণের দ্বারা বিশিষ্ট হইয়া মোটের উপর তিন ভাবে বিভক্ত হইয়াছে । 


তামসিক প্রকৃতির ব্যক্তির রাজসিক ধর্ম অনুশীলনের প্রচেষ্টা

যাহার প্রকৃতি তামসিক, তাহার ধর্মও তামসিক হইবে । এই ধর্মের অনুশীলন করিয়াই এই তামসিক প্রকৃতি ক্রমে ক্রমে রজঃপ্রাধান্য লাভ করিয়া রাজসিক হইয়া উঠিবে । প্রকৃতি যাহার তামসিক, প্রকৃতি যাহার আলস্য, নিদ্রা, মূঢ়তার দ্বারা আচ্ছন্ন, তাহার রাজসিক অনুষ্ঠান সহজ নয়, ক্লেশকর হইয়া উঠে । যাহা ক্লেশকর তাহাতে জীবের অনুরাগ জন্মে না । অনুরাগ ব্যতীত অন্তরের পরিবর্তনও হয় না । তামসিক প্রকৃতির পক্ষে রাজসিক ধর্মের অনুশীলন বাহিরের অনুষ্ঠানেই আবদ্ধ হইয়া থাকে; যজমানের অন্তরকে স্পর্শ করে না; তাহা ভয়াবহ  পরধর্মই হইয়া থাকে ।


রাজসিক প্রকৃতির ব্যক্তির সাত্ত্বিক ধর্ম অনুশীলনের প্রচেষ্টা

প্রকৃতি যাহার রাজসিক - সুখ ও প্রভুত্ব যে চাহে, সুখ ও প্রভুত্বের আকাঙ্ক্ষা যাহার অস্থি-মজ্জাগত হইয়া আছে, তাহাকে ত্যাগপ্রধান সাত্ত্বিক বিশ্বধর্মের অনুশীলনে প্রবৃত্ত করাইলে তাহাও ভয়াবহ  পরধর্মই হইয়া রহিবে ।


সাত্ত্বিক প্রকৃতির ব্যক্তির রাজসিক/তামসিক ধর্মানুশীলনের প্রচেষ্টা

প্রকৃতি যাহার সাত্ত্বিক - নির্লোভ, অমানিত্ব, অদম্ভিতা, সত্য এবং সারল্য বা ঋজুতা যাহার সহজ-সিদ্ধ, তাহাকে রাজসিক বা তামসিক ধর্মানুষ্ঠানে প্রবৃত্ত করাইলে, ইহাও ভয়াবহ  পরধর্মই হইয়া উঠে ।

যাহার প্রকৃতি যাহা নহে, সে তাহা করিতে গেলে, ভাল করিয়া তাহা করিতে পারে না, অথচ সকল দিকেই কেবল নিষ্ফলতা আহরণ করে । এই জন্যই ভগবানের কথা অনুযায়ী বিগুণ স্বধর্ম বা প্রকৃতিগত ধর্মও নিজের প্রকৃতি-বিরুদ্ধ পরধর্ম অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ । নিজের প্রকৃতি অনুযায়ী ধর্ম অনুসরণ করিতে যাইয়া জীব যদি সংসারে সাংসারিক অর্থে বিনাশও প্রাপ্ত হয়, তাহাও শ্রেয়স্কর । কিন্তু পরধর্ম সর্বদাই ভয়াবহ । তাহাতে জীবের একূল অকূল দুই কূলই নষ্ট হইয়া যায় ।


উপসংহার

কালের গতিতে, অবস্থার পরিবর্তনে, জীবের কর্মফলে ব্যক্তিগত ও জাতিগত স্বভাবের নিয়ত পরিবর্তন হইতেছে । সুতরাং ব্রাহ্মণাদি জাতির সত্ত্বাদি স্বাভাবিক গুণের ব্যতিক্রম দৃষ্ট হইতেছে; তদনুসারে তাহাদের স্বধর্মের বা স্বকর্মের পরিবর্তন না করিলে বর্ণভেদের মূলসূত্র রক্ষিত হয় না, শাস্ত্রানুগত স্বধর্ম পালনও হয় না । এইরূপে সময়োপযোগী পরিবর্তন সাধনের জন্যই যুগধর্মের প্রবর্তন হয় এবং সনাতন ধর্মের বিশুদ্ধি রক্ষিত হয় । হিন্দুধর্ম এইরূপ পরিবর্তনসহ বলিয়াই উহা সনাতন, নিত্য, উহার কখনও লোপ হয় না । সুতরাং যুগধর্ম অনুসারেই আমাদের স্বধর্ম নির্ণয় করা প্রয়োজন ।


রহস্য - বর্ণভেদ ও জাতিভেদ

প্রশ্ন# - কিন্তু বর্তমান কালে ব্রাহ্মণাদি উচ্চ জাতির মধ্যেও শমদমাদি গুণের প্রাধান্য দৃষ্ট হয় না, আবার শূদ্রাদি জাতির মধ্যেও অনেক স্থলে ঐসকল গুণ পরিদৃষ্ট হয় । বস্তুতঃ বর্তমান সমাজে বর্ণভেদ থাকিলেও বর্ণধর্ম নাই বলিলেই চলে । সুতরাং শাস্ত্রোক্ত লক্ষণ অনুসারে স্ববর্ণ ও স্বধর্ম নির্ণয় করা চলে না, কাজেই গীতোক্ত স্বধর্ম পালন একরূপ অসম্ভব বলিয়া বোধ হয় । অথবা 'স্বধর্ম' কথার অর্থেরই সম্প্রসারণ করিতে হয় । এ অবস্থায় কর্তব্য কি ?



উত্তর#১ - কেবল বর্তমান কালে নয়, মহাভারতীয় যুগেও বংশানুক্রমিক বর্ণধর্মের অনেক ব্যতিক্রম ঘটিয়াছিল, তাহার যথেষ্ট প্রমাণ আছে । বস্তুতঃ উহা অবশ্যম্ভাবী । জীবের স্বভাব সংঘটনের দুইটি কারণ বর্তমান - (1) পূর্বজন্ম-সংস্কার এবং তদুপযোগী বিধি-নির্দিষ্ট বংশানুক্রম (Law of Heredity); (2) ইহজন্মের শিক্ষা-সংসর্গাদি পারিপার্শ্বিক অবস্থার প্রভাবে স্বভাবের স্বতঃপরিবর্তন (Law of Spontaneous Variation)

এই দ্বিতীয় নিয়ম না থাকিলে সংসারে উন্নতি-অবনতি বলিয়া কোন কথা থাকিত না । কাল-পরিবর্তনে লোক-স্বভাবের পরিবর্তন হইবেই, উহা চিরকাল একরূপ থাকিতে পারে না । আর্য ঋষিগণ এ তত্ত্ব বুঝিতেন এবং প্রাচীন শাস্ত্রাদির আলোচনায় এ কথা স্পষ্টই প্রতীত হয় যে, তাঁহাদের ব্যবস্থিত বর্ণভেদ ও বর্ণধর্ম গুণানুগত ছিল, মূলতঃ জাতিগত ছিল না । বস্তুতঃ 'জাতিভেদ' শব্দই অপেক্ষাকৃত আধুনিক, প্রাচীন সংস্কৃত গ্রন্থাদিতে প্রায় সর্বত্রই 'বর্ণভেদ' শব্দ দেখা যায় । জাতি ও বর্ণ এক কথা নহে । বর্ণ বলিতে এস্থলে প্রাকৃতিক সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ এই তিন গুণ বুঝায়; এই ত্রিগুণের ন্যূনাধিক্যবশতঃ যে ভেদ তাহাই বর্ণভেদ

এই জগৎ প্রকৃতিরই পরিণাম, সুতরাং পৃথিবীতে, আকাশে বা স্বর্গে কোথাও এমন প্রাণী বা বস্তু নাই যাহা ত্রিগুণ হইতে মুক্ত [১৮|৪০] । সুতরাং বর্ণভেদ কেবলমাত্র মনুষ্যমধ্যে নহে, উহা দেবতার মধ্যেও আছে, গ্রহ-নক্ষত্রেও আছে, পশু-পক্ষী, কীট-পতঙ্গ, বৃক্ষ-লতাদিতেও আছে, এমন কি জড়পদার্থেও আছে - ইহাই হিন্দু-দর্শনের ও হিন্দু-শাস্ত্রের ব্যাপক সিদ্ধান্ত । তবে জড়পদার্থে বা বৃক্ষ-লতাদিতে সত্ত্ব ও রজোগুণ, তমোগুণদ্বারা সম্পূর্ণ আবৃত থাকে, এই হেতু তাহাতে এই ভেদ প্রতীত হয় না; কিন্তু মনুষ্যের মধ্যে তিন গুণই সম্যক্‌ পরিস্ফুট, তাই ইহাদের মধ্যে গুণগত বর্ণভেদ বিশেষ স্পষ্ট ।

প্রশ্ন# - বর্ণভেদ গুণানুগত এই কথা শাস্ত্রে অনেক স্থলেই দেখিয়াছি, কিন্তু 'বর্ণ' বলিতে যে ত্রিগুণ বুঝায় ইহা কোথাও দেখি নাই, শুনিও নাই, অভিধানেও বলে না । 'বর্ণ' শব্দের এরূপ ব্যাখ্যা সম্পূর্ণ আনুমানিক । বর্ণ বলিতে বুঝায় রঙ (colour) - শ্বেত (white), পীত (yellow), লোহিত (red) ইত্যাদি, ইহাই তো জানি ।

উত্তর#২ - হিন্দু-সমাজের এই ভেদকে বর্ণভেদ কেন বলে এ প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর কোথাও পাওয়া যায় নাই । তবে শাস্ত্রালোচনায় যাহা বুঝিয়াছি তাহাই বলিতেছি । একথা স্বীকার্য যে, এ ব্যাখ্যা সম্পূর্ণই আমাদের অনুমান-প্রসূত, তবে এ অনুমানের যথেষ্ট ভিত্তি আছে । অনুমানের ভিত্তি শাস্ত্রসঙ্গত ও যুক্তিসঙ্গত হইলে উহাও প্রমাণ বলিয়া গণ্য হয় ।  বর্ণ বলিতে শ্বেত, পীতাদি রঙ বুঝায় তা ঠিক, প্রাচীন শাস্ত্রাদিতেও এইরূপ বর্ণনা আছে যে, সত্ত্বগুণ শ্বেতবর্ণ, রজোগুণ রক্তবর্ণ ও তমোগুণ কৃষ্ণবর্ণ এবং এই রূপক কল্পনা হইতেই সত্ত্বগুণপ্রধান ব্রাহ্মণ শ্বেতবর্ণ, রজোগুণপ্রধান ক্ষত্রিয় রক্তবর্ণ, রজস্তমোগুণপ্রধান বৈশ্য মিশ্র পীতবর্ণ এবং তমোগুণপ্রধান শূদ্র কৃষ্ণবর্ণ, এইরূপ বর্ণনার উৎপত্তি । অনেকস্থলে সিত (শ্বেত), অসিত (কৃষ্ণ), পীত, রক্ত, এই শব্দগুলিই ব্রাহ্মণ, শূদ্র, বৈশ্য ও ক্ষত্রিয় জাতি সম্পর্কে ব্যবহৃত হইয়াছে [মভাঃ শাং ১৮৮||| ১১-১৪] । শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে একটি 'লোহিতশুক্লকৃষ্ণা' ত্রিবর্ণ অজার (অজা বা অজ = without birth, existing without being born, জীবাত্মা) উল্লেখ আছে । ইহাতে সত্ত্বরজস্তমোগুণময়ী ত্রিগুণাত্মিকা প্রকৃতিকে বুঝাইতেছে [শ্বেত উ, ৪|৫] । বস্তুতঃ সত্ত্বাদি গুণ বুঝাইতে শ্বেত-পীতাদি বর্ণ শব্দের ব্যবহার প্রাচীন শাস্ত্রাদিতে সুপ্রচলিত ছিল । এই হেতুই সত্ত্বাদিগুণ-বৈষম্যে ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়াদির যে ভেদ তাহার নাম হইয়াছে 'বর্ণভেদ' ।

পরবর্তি কালে বর্ণভেদ বংশানুগত হইয়া ক্রমে বিভিন্ন বৃত্তিভেদ অনুসারে অসংখ্য জাতির উৎপত্তি হইয়াছে এবং উহার নাম 'জাতিভেদ' হইয়াছে । এই আধুনিক জাতিভেদ (Caste System) এবং আর্যশাস্ত্রের ব্যবস্থিত প্রাচীন বর্ণভেদ এক বস্তু নয় । বর্ণভেদ মূলতঃ গুণানুগত, জাতিভেদ সম্পূর্ণই বংশানুগত ।

প্রশ্ন# - এই ব্যাখ্যা যদি ঠিক হয় তাহা হইলে ব্রাহ্মণ জাতির মধ্যেও কাহারও শমদমাদি সত্ত্বগুণের লক্ষণ বর্তমান না থাকিলে তিনি হীনবর্ণ হন, পক্ষান্তরে ব্রাহ্মণেতর জাতির মধ্যেও কাহারও ঐ সকল গুণ থাকিলে তাহাকে ব্রাহ্মণ বলিতে হয় । শাস্ত্রের কি ইহাই অভিপ্রায়, ইহাই মর্ম ?

উত্তর# - মর্ম, অভিপ্রায় কেন, অনেক স্থলে স্পষ্ট বিধানই ঐরূপ আছে ।
(1) শ্রীমদ্ভাগবত পূর্বোক্তরূপে শমদমাদি ব্রাহ্মণের, শৌর্যবীর্যাদি ক্ষত্রিয়ের ইত্যাদি ক্রমে চতুর্বর্ণের লক্ষণ নির্দেশ করিয়া তৎপর বলিতেছেন - "যে পুরুষের বর্ণজ্ঞাপক যে লক্ষণ বলা হইল যদি তদন্যবর্ণেও সেই লক্ষণ দেখিতে পাও, তবে সেই ব্যক্তিকেও সেই লক্ষণ নিমিত্ত সেই বর্ণ বলিয়া নির্দেশ করিবে" [ভাঃ ৭|১১|৩৫] । অর্থাৎ যদি শমদমাদি লক্ষণ ব্রাহ্মণেতর জাতিতেও দেখা যায়, তবে সেই লক্ষনদ্বারাই তাহাকে ব্রাহ্মণ বলিয়া নির্দেশ করিবে, তাহার জাতি অনুসারে বর্ণ নির্দেশ হইবে না [চক্রবর্তী, স্বামী]অর্থাৎ বর্ণভেদ গুণগত, জাতিগত নহে

(2) বস্তুতঃ এক্ষণে যেমন প্রচলিত জাতিভেদের যৌক্তিকতা লইয়াই সন্দেহ ও সমস্যা উপস্থিত হইয়াছে, সেকালেও চিন্তাশীল ব্যক্তিগণের নিকট এই সমস্যা উপস্থিত হইয়াছিল । মহাভারতে এই প্রশ্ন অনেক বার উত্থাপিত হইয়াছে এবং সেকালের শ্রেষ্ঠ নীতিজ্ঞগণ সকলেই ঠিক পূর্বোক্তরূপ মতই প্রকাশ করিয়াছেন । ব্রাহ্মণ কে, ব্রাহ্মণের লক্ষণ কি, জাতিভেদ গুণানুগত না বংশানুগত ইত্যাদি প্রশ্ন ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের নিকট একাধিকবার উত্থাপিত হইয়াছে । তদুত্তরে তিনি বলিয়াছেন - "আমার এই বোধ হয়, সর্ববর্ণের সঙ্কর হেতু মনুষ্যমাত্রেতে জাতিনিশ্চয় দুঃসাধ্য । বর্ণসকলের সংস্কারাদি কৃত হইলেও যদি সচ্চরিত্রতা বিদ্যমান না থাকে, তবে সে স্থলে সঙ্করকে বলবান্‌ মনে করিতে হইবে । যে শূদ্রে শমদমাদি লক্ষণ থাকে সে শূদ্র শূদ্র নয়, ব্রাহ্মণই; আর যে ব্রাহ্মণে উহা না থাকে সে ব্রাহ্মণ ব্রাহ্মণ নয়, শূদ্রই" [মভাঃ বন ১৮০, অপিচ বন ৩১২|১০৮]

(3) ভৃগু-ভরদ্বাজ-সংবাদে মহর্ষি ভৃগু বর্ণভেদের উৎপত্তি সম্বন্ধে বলিতেছেন - "পূর্বে এই সমস্ত জগৎ ব্রহ্মাকর্তৃক সৃষ্ট হইয়া ব্রাহ্মণময় ছিল, পরে স্ব স্ব কর্মদ্বারা পৃথক্‌ কৃত ব্রাহ্মণেরাই অন্য বর্ণে গমন করিয়াছিলেন" [মভাঃ শাং ১৮৮] । তৎপর তিনি কোন্‌ কর্মদ্বারা ব্রাহ্মণ হয়, কোন্‌ কর্মদ্বারা ক্ষত্রিয় হয় ইত্যাদি বর্ণনা করিয়া বলিলেন যে, এইরূপ গুণকর্মানুসারে বর্ণ নির্ণয় করিতে হইবে, জাতি অনুসারে নয় [মভাঃ, শাং ১৮৯|১-৮]

(4) উমা-মহেশ্বর-সংবাদে মহাদেব বলিতেছেন - "ব্রাহ্মণ-যোনিতে জন্ম, উপনয়নাদি সংস্কার বা বেদাধ্যয়নাদি ব্রাহ্মণত্বের কারণ নহে । একমাত্র চরিত্রই ব্রাহ্মণত্বের কারণ" । "শুদ্ধচিত্ত জিতেন্দ্রিয় শূদ্রও পবিত্র কর্মদ্বারা দ্বিজবৎ সেব্য হন, উহা স্বয়ং ব্রহ্মার অনুশাসন" - কেননা সচ্চরিত্র শূদ্র ব্রাহ্মণত্বই লাভ করেন [মভাঃ অনু, ১৪৪]

(5) ধর্মশাস্ত্র ও পুরাণাদি পর্যালোচনা করিলেও এই তত্ত্বই পাওয়া যায় । অত্রিসংহিতায় ব্রাহ্মণকে দেবব্রাহ্মণ, রাজা-ব্রাহ্মণ, বৈশ্য-ব্রাহ্মণ, শূদ্র-ব্রাহ্মণ, ম্লেচ্ছ-ব্রাহ্মণ ইত্যাদি দশ শ্রেণিতে বিভক্ত করা হইয়াছে । এই শ্রেণী-বিভাগের মূলও গুণকর্মানুগত । ভক্তিশাস্ত্রের কথার মর্মও উহাই - তবে ভক্তিশাস্ত্রে ভক্তির মর্যাদা সর্বোপরি, এই যা বিশেষ ।

সুতরাং সর্বত্রই দেখা যায়, বর্ণভেদ গুণকর্মানুগত, অর্থাৎ ব্যক্তিগত, বংশগত নয় । গুণকর্মানুসারে শ্রেণী-বিভাগ ও মর্যাদার তারতম্য সকল দেশে, সকল সমাজেই আছে, উহা সামাজিক ও ব্যক্তিগত উন্নতির অনুকূল, পরিপন্থী নহে । আমাদের শাস্ত্রেও ব্যক্তিগত যোগ্যতানুসারেই বর্ণভেদের ব্যবস্থা ছিল - কালক্রমে উহা বংশগত হওয়াতেই অবনতির কারণ হইয়াছে । প্রকৃতিভেদে মনুষ্যে মনুষ্যে ভেদ চিরকালই থাকিবে, উহারই নাম বর্ণভেদ । উহা পূর্বে কেবল আভিজাত্য-মূলক ছিল না, স্বাভাবিক গুণানুগত ছিল । পুনরায়, ব্যক্তিগত গুণ ও যোগ্যতার উপর প্রতিষ্ঠিত না হইলে উহা স্বভাবনিয়ত হয় না [১৮|৪৭ দ্রঃ], জীবের মোক্ষানুকূল বা সমাজের কল্যাণকর হইতে পারে না ।


প্রশ্ন# - কিন্তু বর্তমান জাতিভেদ গুণানুগত করা একরূপ অসম্ভব বলিয়াই বোধ হয় । স্বধর্মভ্রষ্ট বিবিধ বর্ণকে স্বভাবানুরূপে স্বধর্মে নিয়োজিত করিবে কে ? নিরঙ্কুশ রাজশক্তি বা সমাজশক্তি ভিন্ন তাহা হয় না । আর উহাতে সর্বদা সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও বিপ্লব উপস্থিত হইবারই সম্ভাবনা ।

উত্তর# - তা ঠিক, প্রকৃতপক্ষে উহা রাজশক্তিরও কর্ম নয়, লোকরাক্ষার্থ প্রত্যেক বর্ণকেই স্বধর্মে প্রতিষ্ঠিত রাখা হিন্দু-রাজগণের শ্রেষ্ঠ কর্তব্য বলিয়া শাস্ত্রে উক্ত হইয়াছে বটে, কিন্তু তাহা সম্ভবপর হয় তখনই যখন সমাজ ক্ষুদ্রাবয়ব থাকে, বর্ণধর্ম গুণানুগত, রাজবিধির অনুগত ও সুনিশ্চিত থাকে এবং বিভিন্ন বর্ণের লোকসংখ্যা এমন থাকে যে, অধিকাংশ লোক জীবিকার্জনের জন্য বর্ণধর্ম ত্যাগ করিতে বাধ্য না হয় । বর্তমান হিন্দু-সমাজের অবস্থা ইহার বিপরীত এবং প্রাচীনকালেও পূর্বোক্তরূপ অবস্থা যে অধিক দিন কখনও বিদ্যমান ছিল তাহারও বিশিষ্ট প্রমাণ নাই । অথচ বংশানুগত জাতিভেদ অতি প্রাচীনকাল হইতেই বর্তমান আছে । এই হেতুই শাস্ত্রে বিধান আছে যে, জাতিতে ব্রাহ্মণ হইলেও ব্রাহ্মণোচিত গুণগ্রাম না থাকিলে তাহাকে অব্রাহ্মনই জ্ঞান করিতে হইবে এবং ব্রাহ্মণেতর জাতির মধ্যেও কেহ শমদমাদি গুণগ্রামে ভূষিত হইলে তিনি ব্রাহ্মণোচিত সম্মানই লাভ করিবেন । এমন কি, আবশ্যক হইলে ব্রাহ্মণগণও ব্রাহ্মণেতর জাতীয় সুযোগ্য ব্যক্তির শিষ্যত্য গ্রহণ করিয়া শিক্ষাদীক্ষা লাভ করিবেন এবং সেই গুরুর প্রতি শিষ্যজনোচিত ব্যবহার করিবেন, শাস্ত্রে এ সকল [মনু ২|২৩৮-৪১]  বিধানও রহিয়াছে । বস্তুতঃ এ সকল বিষয়ে শাস্ত্রবিধি কোনক্রমেই অনুদার বা অযৌক্তিক নহে, শাস্ত্র সর্বদাই ব্যক্তিগত গুণগ্রামের উপরই বিশেষ লক্ষ রাখিয়াছিলেন, বৃথা আভিজাত্যের প্রশ্রয় দেন নাই ।

কার্যতঃও দেখা যায়, রাজর্ষি জনক, পাঞ্চালরাজ প্রবাহণ, পাণ্ডব-পিতামহ ভীষ্মদেব, পুরাণ-বক্তা সূত, বারাণসীর ধর্মব্যাধ, বিদেহ রাজ্যের বণিক তুলাধার প্রভৃতি মুনি-ঋষিদিগকেও তত্ত্বোপদেশ দিয়াছেন এবং ব্রাহ্মণের নিকট যথোচিত সম্মানও লাভ করিয়াছেন, কিন্তু সেজন্য তাঁহাদিগের ব্রাহ্মণ জাতিভুক্ত হওয়ার কোন প্রয়োজন হয় নাই ।

ব্রাহ্মণগণই হিন্দু-সমাজের ধর্ম-ব্যবস্থাপক ছিলেন এবং তাঁহারা নিজেদের জন্য কঠোর সংযম ও ত্যাগের ব্যবস্থা করিয়া ধর্ম-জীবনে বহুকাল ব্যাপিয়া আধ্যাত্মিকতার উচ্চ আদর্শ প্রদর্শন করিয়া গিয়াছেন । ব্রাহ্মণ মনুষ্যত্বের পূর্ণাদর্শ, মূর্তিমান সনাতন ধর্ম [মনু] । সমস্ত ধর্মশাস্ত্রবিধির মূল উদ্দেশ্যই সমাজকে সেই ধর্মাদর্শের দিকে চালিত করা । সকলেরই তাহাতে অধিকার আছে । তবে ধৈর্যসহকারে সাধনা চাই । সাধনার দ্বারা ব্রাহ্মণেতর জাতির মধ্যেও অনেক সিদ্ধ জীবন লাভ করিয়া সকল বর্ণেরই নমস্য হইয়া আছেন এরূপ দৃষ্টান্ত বিরল নহে । বস্তুতঃ জাতির পূজা কেহ করে না, সকলেই গুণের পূজা করিয়া থাকেন [গৌতম-সংহিতা]

আধুনিক হিন্দু-সমাজের বিভিন্ন জাতি-নির্ণয়, সমাজ-তত্ত্ব ও ঐতিহাসিক আলোচনার অন্তর্ভুক্ত, কেননা নানারূপ ধর্ম-বিপ্লব, রাষ্ট্র-বিপ্লব ও সমাজ-বিপ্লবে আধুনিক সমাজ-প্রকৃতির আমূল পরিবর্তন ঘটিয়াছে । অধুনা যাহাদিগকে শূদ্র বলা হয় তাহারা সকলেই যে প্রাচীন শাস্ত্রোক্ত শূদ্রজাতিভুক্ত তাহা নহে এবং যাহারা ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়াদি উচ্চবর্ণভুক্ত বলিয়া পরিচিত, তাহাদেরও তদনুরূপ বর্ণ-বিশুদ্ধি নাই । ধর্মশাস্ত্র-দৃষ্টিতে এই কথাটি মনে রাখিলেই হয় যে, যিনি যে দেহ লইয়া যেখানে জন্মগ্রহণ করিয়াছেন উহাই তাঁহার উপযোগী, কেননা উহা তাঁহার প্রাক্তন কর্মানুযায়ী বিধি-নির্দিষ্ট স্থান । ঐ স্থানে থাকিয়াই নিজের প্রকৃতি, শিক্ষাদীক্ষা ও যোগ্যতানুসারে যিনি যে কর্ম অবলম্বন করিয়াছেন তাহাই তাঁহার স্বধর্ম । উহাই ঈশ্বরার্পণ বুদ্ধিতে নিষ্কামভাবে করিতে পারিলেই গীতোক্ত স্বধর্ম পালন করা হয় । উহা দ্বারা এক জন্মেই হউক বা জন্মে জন্মে ক্রমোন্নতি দ্বারাই হউক - তাহার পরিণামে মোক্ষলাভ হইবে ।

জন্মান্তর-বাদ ও কর্মফলে বিশ্বাসের নাম আস্তিক্য বুদ্ধি । উহা হিন্দুধর্মের একটি বিশেষ লক্ষণ । জন্মান্তরবাদ হিন্দুশাস্ত্রের মেরুদণ্ডস্বরূপ, উহা অস্বীকার করিলে সমস্ত শাস্ত্রীয় ব্যবস্থা পঙ্গু হইয়া পড়ে, শাস্ত্রীয় বিচারও সম্ভবপর হয় না ।


চতুর্বর্ণের উৎপত্তি

শ্রীভগবান বলিতেছেন, গুণ ও কর্মের বিভাগানুসারে আমি বর্ণ-চতুষ্টয়ের সৃষ্টি করেছি । এই সৃষ্টি হইল কখন ? আগে জন্ম, পরে স্বভাব ? না আগে স্বভাব, পরে জন্ম ? যে জন্মিবে তাহার জন্মিবার পূর্বেই কি সত্ত্বপ্রধানাদি স্বভাব সৃষ্টি হইয়াছে ? ধর্মাধর্মরূপ-কর্মজনিত যে সংস্কার তাহাই স্বভাব । জন্মের পূর্বে কর্মই বা হয় কিরূপে, আর কর্মজনিত-সংস্কারই বা গঠিত হয় কিরূপে ?

'যিনি বলিবেন যে, আগে জীবের জন্ম, তৎপর তাহার সত্ত্বপ্রধানাদি স্বভাব, তাহাকে অবশ্য স্বীকার করিতে হইবে, মনুষ্যের বংশানুসারে নহে, গুণানুসারে তাহার ব্রাহ্মণত্বাদি । ব্রাহ্মণের পুত্র হইলেই তাহাকে ব্রাহ্মণ হইতে হইবে, এমন নহে । সত্ত্বগুণ-প্রধান স্বভাব হইলে শূদ্রের পুত্র হইলেও ব্রাহ্মণ হইবে এবং ব্রাহ্মণের পুত্রের তমোগুণ-প্রধান স্বভাব হইলে সে শূদ্র হইবে । ভগবদ্বাক্য হইতে ইহাই সহজ উপলব্ধি । আমি যে একটা নূতন মত নিজে গড়িয়া প্রচার করিতেছি, তাহা নহে । প্রাচীনকালে শঙ্কর শ্রীধরের অনেক পূর্বে, প্রাচীন ঋষিগণও এই মত প্রচার করিয়াছিলেন (বৃদ্ধ গৌতম সংহিতা ২১ অধ্যায়; মহাভারত বনপর্ব ২১৫, ১৯০ অধ্যায়) ।' [বঙ্কিমচন্দ্র]

অবশ্য বর্ণভেদের এরূপ ব্যাখ্যা সকলে স্বীকার করেন না । তাহাদের মতে 'সৃষ্টি অনাদি বলিয়া ধর্মাধর্মরূপ কর্মসংস্কার প্রকৃতিতে বা শক্তিতে মহাপ্রলয়েও লীন থাকে । প্রলয়ান্তে সৃষ্টিকালে সেই-সেই সংস্কারবশত সত্ত্বাদি গুণপ্রাধান্য লইয়া ব্রাহ্মণাদি জাতির সৃষ্টি হয় ।' সুতরাং 'সৃষ্টির সঙ্গে-সঙ্গে জাতিভেদ, অথবা জাতিভেদ লইয়াই সৃষ্টি ।' এই মতের মূল ঋগ্বেদ-সংহিতার বিখ্যাত (বা কুখ্যাত) পুরুষসূক্তের দ্বাদশ ঋক -
ব্রাহ্মণোহস্য মুখমাসীদ্‌ বাহূ রাজন্যকঃ কৃতঃ ।
ঊরূ তদস্য যদ্‌ বৈশ্যঃ পদ্ভ্যাং শূদ্রোহজায়ত ।। 
ব্রাহ্মণ সেই পুরুষের (সৃষ্টিকর্তার) মুখ হইলেন; ক্ষত্রিয় বাহু (কৃত) হইলেন; বৈশ্যই ইহার ঊরু; পদ হইতে শূদ্রের জন্ম হইল (দ্রষ্টব্য একমাত্র শূদ্রই 'জন্মিলেন', বাকিরা 'হইলেন') । - [দ্বাদশ ঋক্‌, পুরুষসূক্ত, ঋগ্বেদ-সংহিতা]

এই ঋক্‌ রূপকের ব্যাখ্যা - যাহারা জ্ঞান ও ধর্ম শিক্ষা দেন তাহার সমাজের মুখস্বরূপ, যাহারা শত্রু হইতে সমাজ রক্ষা করেন তাহার বাহুস্বরূপ, যাহারা অন্নবস্ত্রাদির সংস্থান করেন তাহারা উদর বা ঊরুস্বরূপ । বেদের অন্যান্য স্থলে, যেমন শতপথ ব্রাহ্মণে [২|১০|১১] ও তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণে বর্ণসমূহের উৎপত্তি অন্যরূপে বর্ণিত হইয়াছে এবং তথায় শূদ্রের উল্লেখই নাই । ইহাতে অনুমান করা যায় যে, শুদ্রগণ সমাজে পরে গৃহীত হইয়াছেন । ঐতিহাসিকগণ বলেন যে, আর্যগণ বিজিত অনার্যদিগকে হিন্দু-সমাজে গ্রহণ করিয়া পরিচর্যাত্মক কর্মে নিযুক্ত করিয়াছেন ।

ঋগ্বেদ প্রাচীনতম গ্রন্থ হইলেও ইহার সকল ঋক্‌ প্রাচীন নহে । বিভিন্ন সময়ে রচিত ঋক্‌সমূহ পরবর্তী কালে সংহিতাকারে সঙ্কলিত হইয়াছে । উক্ত সূক্তটিও জাতিভেদ প্রবর্তিত হইবার পরে রচিত হইয়াছে বলিয়াই অনেকে অনুমান করেন ।

আধুনিক ঐতিহাসিক সমালোচকগণ বলেন - প্রাচীন বৈদিক যুগে বর্ণভেদ ছিল না । পরবর্তী বৈদিক যুগে লোকসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় কর্মভেদের প্রয়োজন হওয়াতে উহার সৃষ্টি হইয়াছে । প্রথমত, এই বর্ণভেদ বংশগত ছিল না, কর্মগত ছিল । এক পরিবারের কেহ ব্রাহ্মণ, কেহ ক্ষত্রিয়, কেহ বৈশ্য বা কেহ শূদ্রের কার্য করিতেন । পরে পৌরাণিক যুগে উহা বংশগত হইয়াছে ।

যুক্তি ১ : প্রাচীন বৈদিক যুগের সামাজিক রীতি-নীতি, লোকের বৃত্তি-ব্যবসায় ধর্মকর্ম ইত্যাদি পর্যালোচনা করিয়া কোথাও জাতিভেদের অস্তিত্বের কোনো নিদর্শন পাওয়া যায় না । ঋগ্বেদের একটি সুক্তের সংক্ষিপ্ত অনুবাদ - 'হে সোম, সকল ব্যক্তির কার্য এক প্রকার নহে; আমাদের কার্যও নানাবিধ; দেখ, তক্ষ (সূত্রধর) কাঠ তক্ষণ করে, বৈদ্য রোগের প্রার্থনা করে, স্তোতা যজ্ঞকর্তাকে চাহে । দেখ, আমি স্তোত্রকার, পুত্র চিকিৎসক, কন্যা যবভর্জনকারিণী (ভাজা-পোড়া তৈরী করা যার বৃত্তি, বর্তমান শূদ্র বা বৈশ্য) ।' মন্বাদি-শাস্ত্রানুসারে ব্রাহ্মণপুত্র চিকিৎসক হইলে জাতি যাইত ।

"If then with all the documents before us, we ask the question, does caste as we find it in Manu and at the present day, form part of the most ancient religious teaching of the Vedas ? We can answer with a decided No." - [Maxmuller, German Workshop]

যুক্তি ২ : মহাভারতে শান্তিপর্বে ১৮৮ অধ্যায়ে ভরদ্বাজের প্রতি ভৃগুবাক্য - 'বর্ণসকলের বিশেষ নাই, পূর্বে সকলেই ব্রাহ্মণ ছিল, পরে কর্মানুসারে ক্ষত্রিয়াদি বিবিধ বর্ণ হইয়াছে ।' বায়ুপুরাণ, রামায়ণ প্রভৃতি গ্রন্থেও এইরূপ উক্তি আছে ।

যুক্তি ৩ : পূর্বোক্ত ঋগ্বেদ-সংহিতার পুরুষসূক্তের দ্বাদশ ঋকের সম্বন্ধে ইঁহাদের বক্তব্য পূর্বেই দেওয়া হইয়াছে ।

চাতুর্বর্ণ্য-ব্যবস্থা - লোকমান্য তিলকের টীকা
"সমাজের সমস্ত ব্যবহার যাহাতে সুচারুরূপে পরিচালিত হয়, কোন এক বিশিষ্ট ব্যক্তির উপরে কিংবা মণ্ডলীর উপরেও সমস্ত ভার না পড়ে এবং সমাজের সকল পক্ষেরই ভালরূপে সংরক্ষণ ও পোষণ হয়, এই নিমিত্ত শ্রমবিভাগরূপ চাতুর্বর্ণ ব্যবস্থা পুরাকালীন ঋষিগণ কর্তৃক সংস্থাপিত হয় । ইহা পৃথক কথা যে, কিছুকাল পরে চতুর্বর্ণের লোক কেবল জাতিমাত্রোপজীবী হইয়া পড়িল । ইহা নিঃসন্দেহ যে, গোড়ায় এই ব্যবস্থা সমাজধারণার্থ করা হইয়াছিল; এবং চতুর্বর্ণের মধ্যে যদি কোন বর্ণ আপন ধর্ম অর্থাৎ কর্তব্য পরিত্যাগ করে, কিংবা যদি কোন বর্ণ সমূলে বিনষ্ট হয় ও তাহার স্থান অন্য লোক আসিয়া পূর্ণ না করে, তাহা হইলে সমস্ত সমাজ সেই পরিমাণেই পঙ্গু হইয়া ধীরে ধীরে বিনাশ প্রাপ্ত হয়, কিংবা উহা নিকৃষ্ট অবস্থাতে তো নিশ্চয়ই আসিয়া পৌছে । যদিও এ কথা সত্য যে, পাশ্চাত্য খণ্ডে চাতুর্বর্ণ্য ব্যবস্থা ব্যতীত অনেক সমাজের অভ্যুদয় হইয়াছে, তথাপি ইহা মনে রাখিতে হইবে যে, সে দেশে চাতুর্বর্ণ্য ব্যবস্থা না থাকিলেও চারিবর্ণের সমস্ত ধর্ম, জাতিরূপে না হউক, গুণবিভাগরূপে জাগ্রত রহিয়াছে ।" - [কর্মযোগশাস্ত্র, গীতারহস্য, লোকমান্য তিলক, অনুবাদ শ্রীজ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, পৃঃ৬৭]

গীতার কালে চাতুর্বর্ণ্য-ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল, এই কারণেই এই সামাজিক কর্ম চাতুর্বর্ণ্য বিভাগানুসারে প্রত্যেকের ভাগে আসে, এইরূপ বলা হইয়াছে । কিন্তু উহা হইতেই গীতার নীতি-তত্ত্ব যে চাতুর্বর্ণ্য সমাজ-ব্যবস্থার উপরেই অবলম্বিত এরূপ যেন মনে করা না হয় । ... চাতুর্বর্ণ্য-ব্যবস্থা যদি কোথাও প্রচলিত নাও থাকে অথবা পঙ্গুভাবে অবস্থিতি করে, তাহা হইলে সেস্থলেও তৎকাল-প্রচলিত সমাজ-ব্যবস্থানুসারে সমাজের ধারণ-পোষণের যে যে কর্ম নিজেদের ভাগে আসিবে তাহা লোক-সংগ্রহার্থ ধৈর্য ও উৎসাহ সহকারে এবং নিষ্কামবুদ্ধিতে কর্তব্য বোধে করিতে থাকা উচিত - ইহাই সমস্ত গীতাশাস্ত্রের ব্যাপক সিদ্ধান্ত [গীতারহস্য, লোকমান্য তিলক]
___________________________
*Hard Copy Source:

"Sri Gita" or "Srimadbhagabadgeeta" by Gitashastri Jagadish Chandra Ghosh & Anil Chandra Ghosh. 26th Edition - June 1997 (1st Edition, 1925 from Dhaka now in Bangladesh). Published by Subhadra Dey (Ghosh), Presidency Library, 15 Bankim Chatterjee Street, Kolkata-700073. Printed by Web Impressions Pvt.Ltd., 34/2 Beadon Street, Kolkata-700006. pp.519-525.

Online References:

1)"Shrimadbhagabadgita Rahasya" or "Karmajogsastra" by Lokmanya Bal Gangadhar Tilak, translated by Sri Jyotirindranath Tagore, 1924. Published by Sri Khitindranath Thakur, Adi Bramha Samaj, 55 Upper Chitpur Road, Kolkata. Printed by Adi Bramha Samaj Press, 55 Upper Chitpur Road, Kolkata.

2a)"Srimadbhagabadgeeta" by Sri Bankim Chandra Chattopadhyay. Bankim Rachanabali, unicode compliant electronic edition provided by Society for Natural Language Technology Research.


2b)"Srimadbhagabadgeeta" by Sri Bankim Chandra Chattopadhyay. Bankim Rachanabali, unicode compliant electronic edition provided by Eduliture.

Disclaimer:
This site is not officially related to Presidency LibraryKolkata. This is a personal, non-commercial, research-oriented effort of a novice religious wanderer.
এটি আধ্যাত্মিক পথের এক অর্বাচীন পথিকের ব্যক্তিগত, অবাণিজ্যিক, গবেষণা-ধর্মী প্রয়াস মাত্র ।

[Digitised by scanning (if required) and then by typing mostly in Notepad using Unicode Bengali "Siyam Rupali" font and Avro Phonetic Keyboard for transliteration. Uploaded by rk]

No comments:

Post a Comment