Preamble - Jagadish Chandra Ghosh

গীতা-প্রবেশিকা

(গীতাশাস্ত্রী জগদীশচন্দ্র ঘোষ ও শ্রীঅনিলচন্দ্র ঘোষ)*
নারায়ণং নমস্কৃত্য নরঞ্চৈব নরোত্তমম্‌ ।
দেবীং সরস্বতীং ব্যাসং ততো জয়মুদীরয়েৎ ।।
(নারায়ণ, নরশ্রেষ্ঠ নর, সরস্বতী দেবী ও ব্যাসদেবকে নমস্কার করিয়া 'জয়' অর্থাৎ মহাভারতাদি গ্রন্থ পাঠ করি ।)
মূকং করোতি বাচালং পঙ্গুং লঙ্ঘয়তে গিরিম্‌ ।
যৎকৃপা তমহং বন্দে পরমানন্দমাধবম্‌ ।।
(যাঁহার কৃপা মূককে বাচাল করে, পঙ্গুকে পর্বত অতিক্রম করায়, সেই পরমানন্দ মাধবকে আমি বন্দনা করি ।)

ভূমিকা-সূচী


1) গীতার মাহাত্ম্য ও প্রভাব
2) গীতা সর্বশাস্ত্রময়ী, অপূর্ব রহস্যময়ী
3) বৈদিক ধর্মের ক্রমবিকাশ - সনাতন ধর্মের বিভিন্ন অঙ্গ

3.1) ঋগ্ বেদীয় ধর্ম
3.2) ত্রয়ীধর্ম : বেদবাদ
3.3) ঔপনিষদিক ব্রহ্মবাদ - বেদান্ত
3.4) কাপিল সাংখ্য - পুরুষ-প্রকৃতিবাদ
3.5) আত্মসংস্থ-যোগ বা সমাধি-যোগ
3.6) প্রতীকোপসনা - ভক্তিমার্গ
3.7) ধর্মশাস্ত্র বা স্মৃতিশাস্ত্র
4) বৈদিক ধর্মের ক্রমবিকাশের পৌর্বাপর্য-নির্ণয়
5) গীতার পূর্ণাঙ্গযোগ : সর্বধর্ম-সমন্বয়

5.1) সনাতন ধর্মের আপাত-পরস্পর-বিরোধী বিভিন্ন অঙ্গ
5.1.1) জ্ঞানমূলক সন্ন্যাসমার্গ ('সাংখ্য') ও জ্ঞানমূলক কর্মমার্গ ('যোগ')
5.1.2) গীতাই ত্রয়োদশ উপনিষদ
5.1.3) গীতায় 'যোগ'- ও 'সাংখ্য'-শব্দের ব্যবহার
5.1.4) গীতায় 'কর্ম'-শব্দের ব্যবহার
5.1.5) সাংখ্যজ্ঞানী ও ব্রহ্মজ্ঞানীদের আপত্তি
5.2) গীতার 'পুরুষোত্তম-তত্ত্ব' দ্বারা সমন্বয়
5.2.1) নির্গুণ ব্রহ্মবাদীর আপত্তির উত্তর
5.2.2) কাপিল সাংখ্যজ্ঞানীর আপত্তির উত্তর
5.2.3) গীতায় যোগের উদ্দেশ্য
5.3) ভাগবত ধর্ম
6) গীতোক্ত ভাগবত-ধর্মের প্রাচীন স্বরূপ
7) গীতা ও ভাগবত : আধুনিক বৈষ্ণবমত
7.1) নৈষ্কর্ম্যসিদ্ধি, ভগবানে কর্মার্পণ
7.1.1) বৈদান্তিক জ্ঞানমার্গ ও বৈদিক কর্মমার্গের ভক্তিহীনতা
7.1.2) নবদ্বীপে ধর্মের অধঃপতন
7.1.3) শ্রীচৈতন্যাবতারের আবির্ভাব ও যুগধর্মের প্রচার
8) গীতার শিক্ষা : সার্বভৌম ধর্মোপদেশ
8.1) ধর্মে উদারতা
8.2) কর্মে নিষ্কামতা
8.3) জ্ঞানে ব্রহ্মসদ্ভাব : সর্বভূতে ভগদ্ভাব, সমত্ববুদ্ধি
8.4) যোগে বা ধ্যানে ভগবানে চিত্তসংযোগ
8.5) ভক্তিতে ভগবৎ-শরণাগতি
8.6) নীতিতে আত্মৌপম্যদৃষ্টি : সাম্যবুদ্ধি
8.7) উপাসনা : ভগবৎকর্ম, জীব-সেবা, স্বধর্ম-পালন
8.8) সাধনা : ত্যাগানুশীলন
9) গীতার টীকা-ভাষ্য
9.1) সাম্প্রদায়িক টীকা-ভাষ্য 
9.1.1) অদ্বৈতবাদ-মায়াবাদ : শাঙ্কর-ভাষ্য
9.1.2) বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ : শ্রীরামানুজাচার্য
9.1.3) দ্বৈতাদ্বৈতবাদ : শ্রীনিম্বার্কাচার্য
9.1.4) দ্বৈতবাদ : শ্রীমধ্বাচার্য
9.1.5) অদ্বৈতবাদী ভক্তিমার্গ : শ্রীজ্ঞানেশ্বর
9.1.6) পুষ্টিমার্গ : শ্রীবল্লভাচার্য
9.1.7) অচিন্ত্য-ভেদাভেদ : শ্রীচৈতন্যদেব
9.1.8) গান্ধী-ভাষ্য : গান্ধীবাদ বনাম গীতার অহিংস-যুদ্ধবাদ (Gandhi's "Nonviolence" vs Gita's Violent deeds with Nonviolent mind)
9.2) অসাম্প্রদায়িক টীকা-ভাষ্য
10) বিদেশী ভাষায় গীতা
11) গীতোক্ত ধর্মের মূলকথা : ভাগবত-জীবন লাভ : জগতে সচ্চিদানন্দ প্রতিষ্ঠা
11.1) সৎ-চিৎ-আনন্দ : ভগবানের ত্রিবিধ শক্তি
11.2) জীবের ত্রিবিধ শক্তি
11.3) ত্রিবিধ সাধন পথ
12) গীতোক্ত যোগসাধনা : 'জগদ্ধিতায়'


1) গীতার মাহাত্ম্য ও প্রভাব


ন্যূনাধিক তিন সহস্র বৎসর হইল শ্রীগীতা বর্তমান আকারে প্রচারিত হইয়াছেন, তদবধি ইনি সর্বশাস্ত্রের শিরোভূষণ এবং সমভাবে সর্ব সম্প্রাদায়ের নমস্যা হইয়া আছেন । পদ্মপুরাণ, বরাহপুরাণ, শিবপুরাণ প্রভৃতির অন্তর্গত গীতা-মাহাত্ম্য, গীতার অনুকরণে বহু নূতন নূতন 'গীতা' রচনা, আবার স্থলবিশেষে গীতারই সারাংশ অক্ষরশঃ পুরাণাদির মধ্যে সন্নিবেশ - এই সকল হইতে স্পষ্টই প্রতীয়মান হয়, যে পৌরাণিক যুগেও গীতা সর্বমান্য ছিলেন । উপনিষৎ, গীতা ও বেদান্তদর্শন - তিন শাস্ত্রকে 'প্রস্থানত্রয়ী' বলা হয় । 'প্রস্থানত্রয়ীর' অর্থ কেহ বলেন যে, এই তিনটা সনাতন ধর্মের প্রধান স্তম্ভস্বরূপ; কেহ বলেন, 'প্রস্থান' কথার মর্ম এই যে, এই তিনটা ধ্রুবতারাকে লক্ষ্য করিয়া সংসার-সমুদ্রযাত্রী মোক্ষপথে প্রস্থান করেন । সে যাহা হউক, গীতা প্রাচীন প্রামাণ্য দ্বাদশ উপনিষদের পরবর্তী হইলেও উহাদের সমশ্রেণীস্থ ত্রয়োদশ উপনিষৎ বলিয়া গণ্য এবং বেদের ন্যায় সর্বসম্প্রদায়েরই মান্য । এই হেতু পরবর্তী কালে শ্রীমৎ শঙ্করাচার্য্য, ভামানুজাচার্য্য, শ্রীধর স্বামী, মধ্বাচার্য্য, বলদেব বিদ্যাভূষণ প্রভূতি যত শ্রেষ্ঠ ধর্মোপদেষ্টা আবির্ভূত হইয়াছেন, সকলেই গীতাজ্ঞান শিরোধার্য্য করিয়াছেন এবং স্বীয় স্বীয় সাম্প্রদায়িক মতের পরিপোষণার্থ গীতার টিকাভাষ্য রচনা করিয়াছেন । আধুনিক কালে ইংরেজী, জার্মান প্রভৃতি ভাষায় গীতার অনুবাদ প্রচারিত হওয়ার পর পাশ্চাত্যদেশেও গীতার আদর উত্তরোত্তর বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হইতেছে এবং অনেক চিন্তাশীল পাশ্চাত্য পণ্ডিত গীতা-জ্ঞানের ভিত্তিতেই ধর্ম ও নীতি তত্ত্বের আলোচনা করিতেছেন । স্বনামখ্যাত আমেরিকান পণ্ডিত এমার্সনের গভীর তত্ত্ব-পূর্ণ সন্দর্ভসমূহে গীতার প্রভাব অতি সুস্পষ্ট । প্রসিদ্ধ জার্মান পণ্ডিত ডয়সন্ গীতার নিষ্কাম কর্মযোগের প্রতিপত্তিই সম্পূর্ণরূপে গ্রহণ করিয়াছেন এবং তাঁহার অধ্যাত্মতত্ত্ব সন্বন্ধীয় গ্রন্থে (Elements of Metaphysics) গীতার "তস্মাদসক্তঃ সততং কার্য্যং কর্ম্ম সমাচার"(৩।১৯) এই শ্লোকাংশ ঊদ্ধৃত করিয়া উহার সুসঙ্গত আধ্যাত্মিক বিচার করিয়াছেন ।

সনাতন ধর্মের বাহিরেও গীতার প্রভাব কম নহে । বৌদ্ধধর্মের মহাযান পন্থার আবির্ভাব হইলে যে পরহিতব্রত নিষ্কামকর্মী সন্ন্যাসী-সঙ্ঘের সৃষ্টি হইয়াছিল তাঁহাদেরই প্রযত্নে বৌদ্ধধর্ম তিব্বত, চীন, জাপান, তুর্কীস্তান ও পূর্ব ইউরোপ পর্য্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করিয়াছিল । নিবৃত্তিমূলক নিরীশ্বর বৌদ্ধধর্ম হইতে এই প্রবৃত্তিমূলক ভক্তিপর মহাযানপন্থার উদ্ভব গীতার প্রভাবেই হইয়াছিল, ইহা বৌদ্ধধর্মের ঐতিহাসিকগণ বলিয়া থাকেন; এমন কি, এই মহাযানপন্থার উৎপত্তি সন্বন্ধে স্বয়ং বৌদ্ধ গ্রন্থকারগণই শ্রীকৃষ্ণের নাম পর্য্যন্ত স্পষ্ট নির্দেশ করিয়াছে - (লোকমান্য তিলক - গীতারহস্য; Dr. Kern's Manual of Indian Buddhism) ।

বস্তুতঃ, জ্ঞানমূলক বৌদ্ধধর্মের সন্ন্যাসবাদের সহিত গীতোক্ত ভক্তিবাদ ও নিষ্কাম কর্মের সংযোগ করিয়া উক্ত ধর্মের যে সংস্কার সাধিত হয় তাহাই মহাযানপন্থা নামে পরিচিত ।  এই মহাযানপন্থার বৌদ্ধ যতিগণের প্রাচীনকালে খ্রীষ্টের জন্ম ও কর্ম স্থান ইহুদীদেশেও যাতায়াত ছিল, ইহা আধুনিক ঐতিহাসিক আলোচনায় সপ্রমাণ হইয়াছে । বৌদ্ধধর্মের সন্ন্যাসবাদ ও গীতার ভক্তিবাদ ঐ দুইটীই খ্রীষ্টীয় ধর্মের মূ্লতত্ত্ব এবং মহাযান বৌদ্ধশাস্ত্রের এবং গীতার অনেক কথা বাইবেল গ্রন্থেও পাওয়া যায় । অনেকস্থলে গীতা ও বাইবেলের উপদেশ প্রায় শব্দশঃ একরূপ । যেমন, -

বাইবেল : 'সেই দিন তোমরা জানিতে পারিবে, আমি আমার পিতার মধ্যে এবং আমি তোমাদের মধ্যে আছি ।' John,14|20
গীতা : 'যিনি আমাকে সর্বভূতে অবস্থিত দেখেন এবং আমাতে সর্বভূত অবস্থিত দেখেন, আমি তাঁহার অদৃশ্য হই না, তিনিও আমার অদৃশ্য হন না ।' ৬।৩০; 'যে জ্ঞানদ্বারা সমস্ত ভূতগ্রাম স্বীয় আত্মাতে এবং অনন্তর আমাতে দেখিতে পাইবে ।' ৪।৩৫; 'যাঁহারা ভক্তিপূর্বক আমার ভজনা করেন তাঁহারা আমাতে অবস্থান করেন এবং আমিও সে সকল ভক্তেই অবস্থান করি ।' ৯।২৯
বাইবেল : 'তোমরা যাহা আহার কর, যাহা পান কর বা যাহা কিছু কর, ঈশ্বরের জন্য করিবে ।' Paul,1 Corinthians 10|31
গীতা : 'হে কৌন্তেয়, তুমি যাহা কিছু কর, যাহা কিছু ভোজন কর, যাহা কিছু হোম কর, যাহা কিছু দান কর, যাহা কিছু তপস্যা কর, তৎ সমস্তই আমাকে অর্পণ করিও ।' ৯।২৭
বাইবেল : 'যে আমার ধর্ম পালন করে ও আমাকে প্রীতি করে, আমিও তাহাকে প্রীতি করি ।' (জন, ১৫।২১) (Similar to Ecclesiastes 2|26)
গীতা : 'আমি জ্ঞানী(-ভক্ত)র অত্যন্ত প্রিয় এবং তিনিও আমার অত্যন্ত প্রিয় ।" (৭।১৭); 'যাঁহারা শ্রদ্ধাবান ও মৎপরায়ণ হইয়া পূর্বোক্ত অমৃততুল্য ধর্মের অনুষ্ঠান করেন, সেই সকল ভক্তিমান্‌ আমার অতীব প্রিয় ।' ১২।২০

জার্মান ভাষায় গীতা অনুবাদক ডাঃ লবিনসর গীতা ও বাইবেলের মধ্যে শতাধিক স্থলে এইরূপ শব্দসাদৃশ্য দেখাইয়াছেন এবং বাইবেল হইতেই তিনি সকল কথা গ্রহণ করিয়াছেন । কিন্তু এক্ষণে ইহা অবিসংবাদিতরূপে প্রমাণীকৃত হইয়াছে যে, গীতারচনা কালে যীশুখৃষ্টের আবির্ভাবই হয় নাই । অবশ্য উভয়ের একই তত্ত্ব প্রায় একই ভাষায় স্বতন্ত্রভাবেও উপদেশ দেওয়া কিছু বিচিত্র নহে । কিন্তু একের নিকট হইতে অপরে গ্রহণ করিয়াছেন, ইহাই যদি সাদৃশ্যের কারণ অনুমিত হয়, তাহা হইলে শ্রীকৃষ্ণের নিকট হইতেই যীশুখ্রীষ্ট গ্রহণ করিয়াছে, একথা না বলিয়া উপায় নাই; এবং অনেক পাশ্চ্যত্য পুরাবৃত্তজ্ঞ পণ্ডিতও সেইরূপ সিদ্ধান্তই স্থির করিয়াছেন । সে সকল ঐতিহাসিক তত্ত্বের বিস্তারিত আলোচনা এখানে নিষ্প্রয়োজন । (Robertson's Christianity and Mythology, Lillie's Buddha and Buddhism ইত্যাদি গ্রন্থ দ্রষ্টব্য) ।

2) গীতা সর্বশাস্ত্রময়ী, অপূর্ব রহস্যময়ী


গীতা বুঝিবার পক্ষে বিদেশীয় বিবিধ ধর্মতত্ত্বের আলোচনায় আমাদের তত প্রয়োজন নাই, কেননা গীতা স্বয়ম্ভু, সর্বতঃপূর্ণ, স্বতঃপুর্ণ, গীতা দানই করিয়াছেন, কাহারো নিকট হইতে কিছু গ্রহণ করেন নাই । কিন্তু প্রাচীন ভারতীয় বিভিন্ন ধর্মমত ও দার্শনিক তত্ত্বের সহিত অন্ততঃ সাধারণভাবে পরিচিত না হইলে গীতাতত্ত্ব সম্যক্ উপলব্ধি করা অসম্ভব । হিন্দু-ধর্ম বেদ-মূলক; বেদ সনাতন, নিত্য; এই হেতু এই ধর্মের প্রকৃত নাম বৈদিক ধর্ম বা সনাতন ধর্ম; 'হিন্দু' নাম বিদেশীয়; বেদার্থ, বিভিন্ন ঋষিগণ বিভিন্ন ভাবে ব্যাখ্যা করিয়াছেন এবং এই হেতুই বৈদিক ধর্মে সাধ্যসাধনা বিষয়ে নানা মত এবং নানা শাস্ত্রের সৃষ্টি হইয়াছে । গীতা-প্রচারকালে সাংখ্য-বেদান্তাদি দার্শনিক মত এবং কর্ম, যোগ, জ্ঞান ও প্রতীকোপাসনা প্রভৃতি বিভিন্ন আপাতবিরোধী সাধনমার্গ প্রচলিত ছিল । গীতায় এ সকলেরই সমাবেশ হইয়াছে এবং এই কারণেই বাহ্য-দৃষ্টিতে গীতার অনেক কথাই পূর্ব্বাপর অসঙ্গত ও পরস্পর বিরোধী বলিয়া প্রতীয়মান হয় । গীতায় শ্রীভগবান্ কোথাও বৈদিক যাগযজ্ঞাদি ও বেদবাদের তীব্র প্রতিবাদ করিতেছেন (২।৪২ - ৪৪, ৫৩), আবার কোথাও বলিতেছেন, যজ্ঞাবশিষ্ট 'অমৃত' ভোজনকারী সনাতন ব্রহ্মলাভ করেন (৪।৩০) । কোথাও বেদকে ত্রৈগুণ্য-বিষয়ক বলিয়া ব্রহ্মজ্ঞ ব্যক্তির পক্ষে নিস্প্রয়োজনীয় বলিতেছেন, (২।৪৫।৪৬।৫২।৫৩), আবার কোথায়ও 'আমিই সকল বেদে বেদ্য' 'আমিই বেদ-বেত্তা ও বেদান্তকৃৎ' ইত্যাদি বাক্যে বেদের মাহাত্ম্য কীর্তন করিতেছেন (১৫।১৫) । কোথায়ও বলিতেছেন, আমি সর্বভূতেই সমান, "আমার প্রিয়ও নাই, দ্বেষ্যও নাই" (৯।২৯); কোথায়ও আবার বলিতেছেন, "আমার ভক্তই আমার প্রিয়, আমার জ্ঞানী ভক্ত, আমার ধর্ম-অনুষ্ঠানকারী ভক্ত, আমার অতীব প্রিয়" (৭।১৭, ১২।১৩-২০) । কোথায়ও বলিতেছেন, "জ্ঞানের সদৃশ পবিত্র আর কিছুই নাই, জ্ঞানেই সমস্ত কর্মের পরিসমাপ্তি, জ্ঞানেই মুক্তি, জ্ঞানেই শান্তি" (৪।৩৬-৩৯); কোথাও বলিতেছেন, "সেই পরম পুরুষ একমাত্র । ভক্তিদ্বারাই লভ্য, আর কিছুতে নহে" (৮।১৪।২২, ৯।৩৪, ১৮।৫৫ ইত্যাদি) । আবার কোথাও শান্ত সমাহিত, ধ্যানযোগীর নির্বাতনিষ্কম্প প্রদীপবৎ অচঞ্চল চিত্তের বর্ণনা করিয়া শান্ত-রসাস্পদ পরমসুখকর ব্রহ্মনির্বাণ লাভার্থ অধ্যবসায় সহকারে যোগাভ্যাসের উপদেশ দিতেছেন (৬।১৯-২৭), আবার সঙ্গে সঙ্গেই বলিতেছেন, "স্বকর্ম দ্বারাই সিদ্ধিলাভ হয়, উঠ, যুদ্ধ কর" (৩।৩০, ৪।৪২, ১৮।৪৬।৫৬-৫৭ ইত্যাদি) । একি রহস্য । বস্তুতঃ গীতা অপূর্ব রঙ্গময়ী । ইহার রহস্যভেদ করিতে মহামতি অর্জুনকেও বিব্রত হইতে হইয়াছিল এবং তিনিও ভগবানকে বলিয়াছিলেন - 'তুমি যেন বড় ব্যামিশ্র বাক্য বলিতেছ' (৩।২, ৫।১) । এইরূপ দুরধিগম্যা বলিয়াই গীতা সন্বন্ধে এই সকল কথা বলা হয় - 'কৃষ্ণো জানাতি বৈ সম্যক্ কিঞ্চিৎ কুন্তীসুতঃ ফলম্' অথবা 'ব্যাসো বেত্তি ন বেত্তি বা', ইত্যাদি - গীতাতত্ত্ব শ্রীকৃষ্ণই সম্যক্ জানেন, অর্জুন কিঞ্চিৎ ফল অবগত আছেন, ব্যাসদেবও জানেন কি না জানেন বলা যায় না, ইত্যাদি ।

কথা এই, নানাত্বের মধ্যে থাকিয়া একত্ব দর্শন করা যায় না । কেবল শাস্ত্রজ্ঞানী, অযুক্ত, বদ্ধ জীবের পরমেশ্বর-স্বরূপ ও জ্ঞানকর্মাদি সাধন-তত্ত্ব বিষয়ক যে জ্ঞান ও ধারণা তাহা অন্ধের হস্তিদর্শনের ন্যায়, একদেশদর্শী । চারি অন্ধ হাতীর গায়ে হাত বুলাইয়া ঠিক করিলেন, হাতীটা কেমন বস্তু । কেহ বলিলেন, হাতী একটা প্রাচীরের ন্যায়, কেহ বলিলেন, হাতীটা থামের ন্যায়, কেহ আবার বলিলেন, হাতী কুলার ন্যায়, কেহ বলিলেন, রম্ভা তরুর ন্যায় - কাজেই ভেদবাদ ও বিবাদ । কিন্তু যে চক্ষুষ্মান্ সেই মাত্র হাতীর সমগ্র স্বরূপ দেখিতে পারে ও বুঝিতে পারে যে ওগুলি একই বস্তুর বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ মাত্র । গীতায়ও শ্রীভগবান্ সনাতন ধর্মের বিভিন্ন অঙ্গগুলির একত্র সমাবেশ করিয়া উহার সমগ্র স্বরূপটীই দেখাইতেছেন । উহা জানিলে আর জানিবার কিছুই অবশিষ্ট থাকে না (৭।১-২)। আমাদের সংস্কারান্ধ দৃষ্টি অঙ্গবিশেষেই আবদ্ধ থাকে, জ্ঞানচক্ষু ব্যতীত সমগ্রতত্ত্ব হৃদ্গত হয় । জ্ঞানলাভ তাঁহারই কৃপা-সাপেক্ষ । সুতরাং তাঁহার কৃপার উপর নির্ভর করিয়া যাহার যতটুকু সামর্থ্য তাহা লইয়াই উহা যৎকিঞ্চিৎ বুঝিবার চেষ্টা করিতে হইবে ।

তবে উহাতে প্রবেশ করিতে হইলেও সনাতন ধর্মের বাহ্য স্বরূপটীর অল্পবিস্তর জ্ঞান থাকা আবশ্যক । গীতা-প্রচারকালে বৈদিক কর্মবাদ, সাংখ্যের প্রকৃতিবাদ, উপনিষদের ব্রহ্মবাদ, যোগানুশাসন, প্রতীকোপাসনা ও অবতারবাদ প্রভৃতি বৈদিক ধর্মের প্রধান অঙ্গগুলি সকলই পূর্ণতা প্রাপ্ত হইয়াছিল । গীতা এ সকলই গ্রহণ করিয়াছেন এবং সকলের বিরোধ ভঞ্জনপূর্ব্বক অপূর্ব সমন্বয় করিয়া নিজের একটা বিশিষ্ট মতও প্রচার করিয়াছেন । এ সকল বিভিন্ন মতবাদের প্রকৃত তত্ত্ব কি, কি ভাবে গীতা ইহাদের উপপত্তি গ্রহণ করিয়াছেন, তাহা না বুঝিলে গীতা-তত্ত্ব প্রকৃতপক্ষে কিছুই হৃদয়ঙ্গম হয় না । তাহা বুঝিতে হইলেই বৈদিক ধর্মের ক্রমবিকাশের ঐতিহাসিক পরম্পরা এবং গীতাকালে প্রচলিত ঐসকল বিভিন্ন মতবাদের অন্ততঃ সাধারণ জ্ঞান থাকা একান্ত আবশ্যক । এই হেতু আমরা প্রথমে সনাতন ধর্মের ক্রমবিকাশতত্ত্ব ও প্রধান অঙ্গগুলির সাধারণ পরিচয় দেওয়া আবশ্যক বোধ করিতেছি ।


3) বৈদিক ধর্মের ক্রমবিকাশ - সনাতন ধর্মের বিভিন্ন অঙ্গ


3.1) ঋগ্ বেদীয় ধর্ম


ঋগ্বেদই সনাতন ধর্মের প্রথম গ্রন্থ । উহা প্রাচীনতম আর্য্যধর্মের ও আর্য্যসভ্যতার অকৃত্রিম প্রতিচ্ছবি । উহার ঋক্ বা মন্ত্রগুলি প্রায় সমস্তই ইন্দ্র, অগ্নি, সূর্য্য, বরুণ প্রভৃতি বৈদিক দেবগণের স্তব-স্তুতিতে পূর্ণ । এই সকল মন্ত্রদ্বারা প্রাচীন আর্য্যগণ দেবগণের উদ্দেশ্যে যাগযজ্ঞ করিয়া অভীষ্ট প্রার্থনা করিতেন । কিন্তু দেবতা অনেক থাকিলেও তাঁহারা এক ঐশী শক্তিরই বিভিন্ন বিকাশ এবং ঈশ্বর এক ও অদ্বিতীয় - এ তত্ত্ব তখনো অবিদিত ছিল না । অনেক মন্ত্রে একথা স্পষ্টরূপেই উল্লিখিত হইয়াছে, - (১) তিনি এক ও সত্য (নিত্য), তাঁহাকেই বিপ্রগণ বিভিন্ন নাম দিয়ে থাকেন - তাঁহাকেই অগ্নি, যম, মাতরিশ্বা বলা হয় । ('একংসদ্ বিপ্রা বহুধা বদন্তি' ইত্যাদি ঋক্ ১।১৬৪।৪৬) । (২) 'যিনি আমাদিগের পিতা ও জন্মদাতা, যিনি বিধাতা, যিনি বিশ্বভূবনের সকল স্থান অবগত আছেন, যিনি অনেক দেবগণের নাম ধারণ করেন কিন্তু এক ও অদ্বিতীয়, ভূবনের লোকে তাহাকে জানিতে ইচ্ছা করে' ('যো দেবানাং নামধা এক এব' ইত্যাদি ঋক্ ১০।৮২।৩) । (৩) (ক) তখন (মূলারম্ভে) অসৎও ছিল না, সৎও ছিল না, অন্তরীক্ষ ছিল না এবং তাহার অতীত আকাশও ছিল না; কে (কাহাকে) আবরণ করিল ? কোথায় ? কাহার সুখের জন্য ? অগাধ ও গহন জল কি তখন ছিল ? (খ) তখন মৃত্যুও ছিল না, অমৃতত্ত্বও ছিল না; রাত্রি ও দিনের ভেদ ছিল না । সেই এক ও অদ্বিতীয় এক মাত্র আপন শক্তিদ্বারাই বায়ু ব্যতীত, শ্বাসোচ্ছ্বাস করিয়া স্ফূর্ত্তিমান্ ছিলেন, তাঁহা ব্যতীতি অন্য কিছু ছিল না । ('নাসদাসীন্নো সদাসীৎ তদানীং' ইত্যাদি ঋক্ ১০।১২৯) ।

এই শেষোদ্ধৃত অংশটা ঋগবেদীয় প্রসিদ্ধ নাসদীয় সূক্তের প্রথম দুই ঋক্। এই সূক্তের দেবতা - পরমাত্মা । সৃষ্টির পূর্বে কি ছিল, এই সূক্তে ঋষি তাহারই উত্তর দিতেছেন । এই নামরূপাত্মক ব্যক্ত দৃশ্য প্রপঞ্চের অতীত এক অব্যক্ত অদ্বয় তত্ত্ব আছে যাহা হইতে এই জগৎ-প্রপঞ্চ উৎপন্ন হইয়াছে বাঁ যাহাই এই জগৎ-প্রপঞ্চরূপে অভিব্যক্ত হইয়াছে, ইহাই ঋষির বলার অভিপ্রায় । কিন্তু সে তত্ত্ব অজ্ঞেয়, অনির্বাচ্য; সৎ, অসৎ, অমৃত, মর্ত্য, আলো (দিবা), অন্ধকার (রাত্রি) ইত্যাদির পরস্পর দ্বৈত বাঁ কথার জুরী সৃষ্টির পরে উৎপন্ন হইয়াছে । উহার একটা বলিলেই অপরটার জ্ঞান সঙ্গে সঙ্গেই আসে । কিন্তু যখন এক ভিন্ন দুই ছিল না সেই এক অদ্বিতীয় তত্ত্ব সন্বন্ধে এই দ্বৈত ভাষার ব্যবহার করা চলে না; তাই বলা হইতেছে, সৎও নয় অসৎও নয় ইত্যাদি । সেইরূপ, জলে বাঁ আকাশে সমস্ত আবৃত ছিল ইত্যাদি যে বলা হয় তাহাও বসু আবার আকাশাদির ন্যায় জড় পদার্থ নয়, চৈতন্যময় - তাই বলা হইতেছে - 'শ্বাসোচ্ছ্বাস করিতেছেন,' কিন্তু শ্বাসোচ্ছ্বাসে বায়ুর প্রয়োজন, বায়ু ত তখন হয় নাই, তাই বলা হইতেছে, "বিনা বায়ুতে, আত্মশক্তি দ্বারা" । ঋষির অন্তর্দৃষ্টি কতদূর, লক্ষ্য করুন । জগতের আদি, অব্যক্ত মূলতত্ত্বের এমন কৌশলময় গভীর মূলস্পর্শী বিচার ও বর্ণনা কোন দেশের কোন ধর্মগ্রন্থে কখনও হয় নাই । আর এ বিচার, এই জ্ঞানের উদয় হইয়াছিল ভারতে কখন ? - সেই সুদূর প্রাগ-ঐতিহাসিক যুগে আর্য্য সভ্যতার প্রাচীনতম অবস্থায়, যখন প্রায় সমস্ত আধুনিক সভ্যজগৎ অজ্ঞান অন্ধকারে আচ্ছন্ন ছিল । আধুনিক পাশ্চাত্য অজ্ঞেয়বাদিগণ পর্য্যন্ত এই বৈদিক সুত্রের প্রাচীনত্ব ও ভাবগাম্ভীর্য্য চিন্তা করিয়া বিস্ময় প্রকাশ করিতেছেন । পরবর্তীকালে এই তত্ত্বই উপনিষৎ সমূহে নানাভাবে বিবৃত হইয়াছে । বস্তুতঃ ঋগবেদীয় ধর্ম কেবল অগ্নিতে ঘৃতাহুতি এবং নানা দেবতার নিকট গো-বৎসাদির জন্য প্রার্থনা - ইহাই নহে । 

আমরা দেখিতেছি - (১) ঋগ্বেদীয় ঋষি জগৎ-প্রপঞ্চের অতীত অদ্বয় অব্যক্ত তত্ত্বের সন্ধান পাইয়াছিলেন । (২) সেই তত্ত্বই আবার জগতের এক ও অদ্বিতীয় ঈশ্বরও সৃষ্টিকর্ত্তা এবং দেবতাগণ সেই ঐশী শক্তিরই বিভিন্ন বিকাশ, ইহা জানিতেন । (৩) যজ্ঞদ্বারা দেবতা পরিতুষ্ট হইলে অভীষ্ট ফল প্রদান করেন, ইহা বিশ্বাস করিতেন এবং তদর্থে স্তব-স্তুতি সহ যজ্ঞ করিতেন । (৪) সেই যজ্ঞাদি শ্রদ্ধার সহিত সম্পন্ন হইত এবং "অর্চনা" "বন্দনা" "নমস্কার" ইত্যাদি ভক্ত্যঙ্গযুক্ত ছিল। ("শ্রদ্ধাং দেবা যজমানা বায়ু গোপা উপাসতে" - ঋক্ ১০।১৫১; "নমো ভরন্ত এমসি" ঋক্ ১।৭; 'দেবা বশিষ্টো অমৃতান্ ববন্দে' ঋক ১০।৬৬; "বিষ্ণবে চার্চ্চত", ইত্যাদি ঋক্) । সুতরাং সনাতন ধর্মের এই প্রাচীন স্বরূপ যজ্ঞপ্রধান হইলেও জ্ঞানভক্তি-বিবর্জিত ছিল না - কর্ম, জ্ঞান ও উপাসনা তিনেরই উহাতে সমাবেশ ছিল ।
 

3.2) ত্রয়ীধর্ম : বেদবাদ


ক্রমে সনাতন ধর্মে যাগযজ্ঞাদির প্রাধান্য ক্রমশঃ বর্ধিত হয় এবং বৈদিক ধর্ম সম্পূর্ণ কর্মপ্রধান হইয়া উঠে । ঋক্‌, যজুঃ, সাম - এই তিন বেদই এই ধর্ম প্রতিপাদন করেন, এই জন্য ইহার নাম 'ত্রয়ীধর্ম' । (অথর্ববেদের যজ্ঞে ব্যবহার নাই বলিয়াই বোধ হয় উহা ত্রয়ীর মধ্যে পরিলক্ষিত হয় নাই) । বেদের ব্রাহ্মণ-ভাগ এই সকল যাগ-যজ্ঞের বিস্তৃত বিধি-নিয়মে পরিপূর্ণ । বিভিন্ন ব্রাহ্মণ-গ্রন্থে বর্ণিত বিবিধ বিধি-নিয়মের বিরোধভঞ্জন ও সামঞ্জস্য-বিধানার্থ জৈমিনিসূত্র বা পূর্বমীমাংসা দর্শন প্রণীত হয় । কর্মমীমাংসা, যজ্ঞবিদ্যা ইত্যাদি ইহারই নামান্তর । মীমাংসা-দর্শন অপেক্ষাকৃত পরবর্তী কালের হইলেও উহার কর্মমার্গ সর্বপ্রাচীন; অধুনা যাগ-যজ্ঞাদি শ্রৌতকর্ম অধিকাংশই লুপ্ত হইয়াছে, কিন্তু বেদার্থ-অনুসরণে ব্যবস্থিত মন্বাদি-শাস্ত্রবিহিত পঞ্চমহাযজ্ঞ, বর্ণাশ্রমাচার, দান-ব্রত-নিয়মাদি স্মার্তকর্ম এখনো অনেকাংশে প্রচলিত আছে । কর্মমার্গ বলিতে এক্ষণে উহাই বুঝায় । কিন্তু মীমাংসকগণ বেদোক্ত কর্মকাণ্ড বা ত্রয়ীধর্মের যে ব্যাখ্যা করেন তাহার কিছুবিশেষত্ব আছে । এই মতে যাগযজ্ঞই একমাত্র নিঃশ্রেয়স, উহাতেই স্বর্গ ও অমৃতত্ব লাভ হয় । যজ্ঞকর্মই জীবের একমাত্র ধর্ম - কারণ উহা বেদের আজ্ঞা । শব্দ নিত্য, বেদমন্ত্র অপৌরুষেয়, নিত্য, স্বতঃপ্রমাণ - কর্ম উহার বাহ্য অভিব্যক্তি, কর্মই উয়াহার একমাত্র প্রতিপাদ্য । সুতরাং বেদবিহিত কর্মই একমাত্র ধর্ম । মীমাংসকগণ নিত্যশব্দবাদ ও স্ফোটতত্ত্বের বিচারে অসাধারণ পাণ্ডিত্য ও যুক্তিমত্তার পরিচয় দিয়াছেন; কিন্তু দুঃখের বিষয়, উহা তাঁহাদিগিকে নিরীশ্বর করিয়াছে । মীমাংসা-শাস্ত্রে কোথাও ঈশ্বর প্রসঙ্গ নাই । ইন্দ্রাদি-দেবতাও তাঁহারা স্বীকার করেন না, তাঁহাদের মতে দেবতা মন্ত্রাত্মক । ব্রহ্ম, ঈশ্বর, দেবতা সকলই অর্থবাদ; জ্ঞান, ভক্তি নিরর্থক । কর্মই কর্তব্য, আর-কিছু নাই । ইহার নাম বেদবাদ । গীতায় 'বেদবাদরতাঃ' 'নান্যদস্তীতিবাদিনঃ' ইত্যাদি বাক্যাংশে এই মতাবলম্বীদিগকে লক্ষ্য করা হইয়াছে ।


3.3) ঔপনিষদিক ব্রহ্মবাদ - বেদান্ত


কিন্তু পরমেশ্বরের জ্ঞান ব্যতীত কেবল কর্মদ্বারাই মোক্ষলাভ হয়, এই মতবাদ সকলের গ্রাহ্য হইবার নহে । আর্য-মনীষা ইহাতে অধিক দিন সন্তুষ্ট থাকিতে পারে নাই । অমৃতের সন্ধানে অনুসন্ধিৎসু আর্যঋষিগণ শীঘ্রই বেদার্থচিন্তনে নিমগ্ন হইয়া স্থির করিলেন যে, নামরূপাত্মক দৃশ্য-প্রপঞ্চকের অতীত যে নিত্যবস্তু, জ্ঞানযোগে তাহাকেই জানিতে হইবে, তাহাই পরতত্ত্ব, তাহাই ব্রহ্ম - 'তদ্‌ বিজিজ্ঞাসস্ব তদ্ব্রহ্ম' । জ্ঞানেই মুক্তি, কর্মে নহে; কর্ম বন্ধনের কারণ । উহাতে স্বর্গাদি লাভ হইতে পারে, কিন্তু স্বর্গ মোক্ষ নহে । বেদের আরণ্যক ও উপনিষৎ-ভাগে এই ব্রহ্মতত্ত্বই সবিস্তারে বিবৃত হইয়াছে । উপনিষৎ বেদের অন্ত বা শিরোভাগ, এই জন্য ইহার নাম বেদান্ত । উপনিষৎসমূহ বিভিন্ন ঋষিগণ কর্তৃক কথিত হইয়াছে । উহা সংখ্যায় অনেক, তন্মধ্যে ঈশ, ঐতরেয়, কৌষীতকী, তৈত্তিরীয়, বৃহদারণ্যক, কেন, ছান্দোগ্য, প্রশ্ন, কঠ, শেতাশ্বতর, মুণ্ডক, মাণ্ডূক্য - এই দ্বাদশখানিই প্রাচীন ও প্রামাণ্য বলিয়া গণ্য । উহাদের মধ্যেও পরস্পর মতভেদ আছে । মহর্ষি বাদরায়ণ ব্রহ্মসূত্রে সেই সকল বিভিন্ন মতের বিচারপূর্বক উহাদের বিরোধভঞ্জন ও সমন্বয় বিধান করিয়াছেন । বেদান্ত-দর্শন, উত্তর-মীমাংসা, শারীরকসূত্র, ব্যাসসূত্র প্রভৃতি ব্রহ্মসূত্রেরই নামান্তর ।

এইরূপে বৈদিক ধর্মের দুই স্বরূপ দেখা দিল । বেদের সংহিতা ও ব্রাহ্মণভাগ লইয়া কর্মকাণ্ড এবং আরণ্যক ও উপনিষদ-ভাগ লইয়া জ্ঞানকাণ্ড । দর্শনসমূহের মধ্যে জৈমিনিসূত্র বা পূর্ব-মীমাংসায় কর্মমার্গ এবং ব্যাসসূত্র বা উত্তর-মীমাংসায় বর্ণিত হইয়াছে জ্ঞানমার্গ


3.4) কাপিল সাংখ্য - পুরুষ-প্রকৃতিবাদ


এইরূপে উপনিষদে অধ্যাত্মতত্ত্বের বিচার আরব্ধ হইলে জীব, জগৎ ও ব্রহ্মতত্ত্ব সম্বন্ধে নানারূপ মৌলিক গবেষণা চলিতে থাকে এবং জ্ঞানমার্গেও মতভেদের সৃষ্টি হইয়া বিবিধ দর্শন-শাস্ত্রের উৎপত্তি হয় । তন্মধ্যে কাপিল সাংখ্যমত বিশেষ উল্লেখযোগ্য । সাংখ্যমতে মূলতত্ত্ব একমাত্র ব্রহ্ম নহেন; মূলতত্ত্ব দুই - পুরুষ ও প্রকৃতি । প্রকৃতি ও পুরুষ উভয়েই অনাদি, নিত্য । প্রকৃতি জড়া, গুণময়ী, পরিণামিনী, প্রসবধর্মিণী অর্থাৎ স্বয়ং সৃষ্টিসমর্থা । পুরুষ চেতন, নির্গুণ, অপরিণামী, অকর্তা, উদাসীন, সাক্ষিমাত্র । পুরুষ-প্রকৃতির সংযোগেই সৃষ্টি, এই দুঃখময় সংসার । প্রকৃতি-পুরুষের পার্থক্য-জ্ঞানেই মুক্তি । আধুনিক কালের ডার্বিন (Darwin), স্পেন্সার, হেকেল প্রমুখ পাশ্চাত্য বৈজ্ঞানিকগণের ব্যাখ্যাত বিবর্তনবাদ (Evolution Theory) এবং সাংখ্যের প্রকৃতি-পরিণামবাদ প্রায় একরূপ । উভয়েই ঈশ্বর-তত্ত্ব বাদ দিয়াই জগৎ-উৎপত্তির মীমাংসা করিয়াছেন । উভয়েই বলেন, ঈশ্বরের প্রত্যক্ষ প্রমাণ নাই । যাহা হউক, নিরীশ্বর হইলেও সাংখ্যশাস্ত্র সর্বমান্য; পুরাণ, ইতিহাস, মন্বাদি-স্মৃতি ও ভাগবত-শাস্ত্র, সর্বত্রই সাংখ্যশাস্ত্রের আলোচনা আছে এবং ঐ সকল শাস্ত্রে উহার অনেক সিদ্ধান্তও গৃহীত হইয়াছে । গীতাও সাংখ্যের অনেক সিদ্ধান্তই অবিকল গ্রহণ করিয়াছেন । তাহা যথাস্থানে আলোচিত হইয়াছে ।


3.5) আত্মসংস্থ-যোগ বা সমাধি-যোগ


উপনিষৎ যখন স্থির করিলেন যে, দেহমধ্যে অন্তর্যামিরূপে যিনি বিরাজমান তিনিই ব্রহ্মাণ্ডেরও মূল তত্ত্ব পরব্রহ্ম - যাহা পিণ্ডে, তাহাই ব্রহ্মাণ্ডে, তখনই উপদেশ হইল, আত্মাকে দর্শন করিবে, শ্রবণ করিবে, মনন করিবে, ধ্যান করিবে । এইরূপ আত্মচিন্তা-দ্বারা ব্রহ্মোপাসনার যে প্রণালী কথিত হইল উহাই সমাধি-যোগের মূল । এইরূপে উপনিষদের জ্ঞানমার্গ হইতেই যোগ-প্রণালীর উদ্ভব হইয়াছে । এই প্রণালীই যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়ামাদি বহিরঙ্গ-সাধন-সংযুক্ত হইয়া ক্রমোন্নতি লাভ করত অষ্টাঙ্গযোগ নামে পরিচিত হইয়াছে । যোগমার্গ অতি প্রাচীন । কথিত আছে, ব্রহ্মা উহার আদি বক্তা । পতঞ্জলি মুনি উহা সুশৃঙ্খলাবদ্ধ করিয়া পরবর্তী কালে যে যোগানুশাসন প্রবর্তিত করিয়াছিলেন, 'যোগ' বলিতে এখন তাহাই বুঝায় । ইহাই রাজযোগ, পাতঞ্জল-যোগ, অষ্টাঙ্গ-যোগ, আত্মসংস্থ-যোগ ইত্যাদি নামে অভিহিত হয় । সমাধি বা ইষ্টবস্তুতে চিত্তসংযোগ সর্ববিধ সাধনারই সাধারণ উদ্দেশ্য । সুতরাং যোগ-প্রণালী কোনো-না-কোনো ভাবে সকল সম্প্রদায়ই গ্রহণ করিয়াছেন ।

3.6) প্রতীকোপসনা - ভক্তিমার্গ


পূর্বে বৈদিক ধর্মের যে বিভিন্ন অঙ্গসমূহের উল্লেখ করা হইল, তাহার কোথাও ভক্তির বিশেষ প্রসং নাই । ষড়্‌দরশন-সমূহের মধ্যে বেদান্ত ব্যতীত আর সকলই নিরীশ্বর বলিলেও চলে । বেদান্তের নির্গুণ ব্রহ্মবাদেও ভক্তির সমাবেশ হয় নাই । যাহা নির্গুণ, নির্বিশেষ, নিষ্ক্রিয়, যাহাকে সৃষ্টিকর্তা, প্রভু বা ঈশ্বর কিছুই বলা চলে না - মনুষ্য তাহা ধারণা করিতে পারে না এবং তাহার সহিত ভাব-ভক্তির কোনো সম্বন্ধও স্থাপন করিতে পারে না । তাহা অচিন্ত্যস্বরূপ, নিজবোধরূপ । অথচ কোনো তত্ত্বে চিত্ত স্থির না করিলে আত্মবোধও জন্মে না । এই হেতু নির্গুণ ব্রহ্মোপাসনায় মন স্থির করিবার জন্য প্রতীকোপাসনা অর্থাৎ যাহা ব্রহ্মা নয় তাহাকে ব্রহ্মরূপে ভাবনা করার ব্যবস্থা আছে । যেমন মনকে ব্রহ্মরূপে ভাবনা করিবে, সূর্যকে ব্রহ্মরূপে ভাবনা করিবে ইত্যাদি । ইহা অবশ্য প্রকৃতপক্ষে উপাসনা নয়, সগুণ ব্রহ্ম ভিন্ন ভক্তিমূলক উপাসনা সম্ভপর নহে । কিন্তু ক্রমে রুদ্র, বিষ্ণু প্রভৃতি বৈদিক-দেবতাগণও ব্রহ্মের প্রতীকরূপে কল্পিত হন এবং কোনো কোনো উপনিষদে রুদ্র, বিষ্ণু প্রভৃতি পরমাত্মা বা পরমেশ্বরেরই রূপ, ইহাও স্পষ্টই উল্লিখিত হইয়াছে [মৈত্র|৭|৭; রাম পুঃ|১৬; অমৃতবিন্দু|২২] । কোথাও পরব্রহ্মের বর্ণনায় দেব, ঈশ্বর, মহেশ্বর, ভগবান প্রভৃতি শব্দও ব্যবহৃত হইয়াছে এবং 'যস্য দেবে পরা ভক্তিঃ' [শেতঃ ৬|৩৩] ইত্যাদি বাক্যও আছে । এ-সকল অবশ্য সগুণ ব্রহ্মেরই বর্ণনা । অস্থূল-অনণু, অহ্রস্ব-অদীর্ঘ ইত্যাদি নির্গুণ স্বরূপের বর্ণনা [শঙ্কর]; সর্বকর্মা, সর্বকামঃ ইত্যাদি সগুণ স্বরূপের বর্ণনা [শাণ্ডিল্য] । ছান্দোগ্য-উপনিষদের শাণ্ডিল্য ঋষিই সগুণ উপাসনা বা ভক্তিমার্গের প্রবর্তক বলিয়া পরিচিত [বেদান্তসার|৬] । স্থূলকথা, ভক্তিমার্গ বেদোপনিষদ হইতেই বহির্গত হইয়াছে এবং পরে অবতারবাদ ও প্রতিমা-পূজার প্রবর্তন হইলে উহা নানা শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত হইয়া পূর্ণাবয়ব প্রাপ্ত হইয়াছে ।


3.7) ধর্মশাস্ত্র বা স্মৃতিশাস্ত্র


আমরা দেখিলাম, বৈদিক ধর্মের প্রাথমিক স্বরূপ কর্মপ্রধানই ছিল; ঔপনিষদিক যুগে উহা জ্ঞানপ্রধান হইয়া উঠে এবং পরে পৌরাণিক যুগে উহা ভক্তিপ্রধান হয় । স্মৃতিশাস্ত্রসমূহ এই সকল বিভিন্ন মতবাদ কখন কোনটি কিরূপ ভাবে গ্রহণ করিয়াছেন, তাহাই এখন দ্রষ্টব্য; কেননা ধর্মশাস্ত্রই হিন্দুর ধর্মজীবন ও কর্মজীবনের মুখ্য নিয়ামক । বৈদিকযুগে বেদোক্ত কর্মকাণ্ডের বিধি-নিয়মাদি সংক্ষিপ্তভাবে সঙ্কলিত করিয়া বিবিধ সূত্রগ্রন্থ প্রণীত হইয়াছিল । ইহাদিগকে কল্পসূত্র বলে । কল্পসূত্র তিনভাগে বিভক্ত । যে-ভাগে শ্রৌতযজ্ঞের বিবরণ আছে তাহার নাম শ্রৌতসূত্র, যে অংশে গৃহ্য-অনুষ্ঠানের বিবরণ আছে তাহার নাম গৃহ্যসূত্র এবং যাহাতে পারিবারিক ও সামাজিক ধর্ম-কর্মের বিবরণ আছে তাহার নাম ধর্মসূত্র । এক্ষণে শ্রৌত ও গৃহ্যসূত্র প্রায় লুপ্ত হইয়াছে এবং প্রাচীন ধর্মসূত্রগুলি অধিকাংশই পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত হইয়া ধর্মসংহিতা নাম ধারণ করিয়াছে । বর্তমান সময়ে বৌধায়ন, আপস্তম্ব প্রভৃতি কয়েকখানি ধর্মসূত্র ও মনু, যাজ্ঞবল্ক্য, বিষ্ণু, পরাশর, দক্ষ প্রভৃতির নামে কুড়িখানি ধর্মসংহিতা পাওয়া যায় । ইহাই ধর্মশাস্ত্র বা স্মৃতিশাস্ত্র নামে পরিচিত । সংহিতাগুলির মধ্যে মনুসংহিতাই সর্বাপেক্ষা প্রাচীন ও প্রামান্য; অন্যান্যগুলি প্রাচীন নাম সংযুক্ত থাকিলেও অপেক্ষাকৃত আধুনিক কালে সঙ্কলিত হইয়াছে, সন্দেহ নাই ।

মন্বাদি-ধর্মশাস্ত্রসমূহে কর্মকাণ্ডের বর্ণনা-বাহুল্য থাকিলেও জ্ঞানের উপদেশও যথেষ্ট দেখা যায় । অনেক স্থলে স্পষ্টতই ধর্মশাস্ত্রকারগণ জ্ঞান ও কর্ম উভয়ের সমুচ্চয়ই উপদেশ করিয়াছেন । যথা -
"বেদোক্ত কর্মানুষ্ঠান ও জ্ঞান উভয়ই মোক্ষপ্রদ । কর্মের (তপঃ) দ্বারা দোষ নষ্ট হইয়া জ্ঞানের দ্বারা অমৃতত্ব লাভ হয়" [মনু|১২|১০৪] । তপঃ - বর্ণাশ্রমাচারোচিত কর্ম [মনু|১২|১০৪] 
"পক্ষীর গতি যেমন দুইটি পক্ষের যোগেই হইয়া থাকে, সেইরূপ জ্ঞান ও কর্ম এই দুইয়ের সমুচ্চয়েই শাশ্বত ব্রহ্ম লাভ হয়" [হারীত|৭|৯|১১]

পরবর্তী কালে ভক্তিমার্গের প্রবর্তন হইলে ধর্মশাস্ত্রসমূহেরও ভাগবত-ধর্মের অনুকূল করিয়া নানারূপ পরিবর্তন সাধিত হইয়াছে । ইহাতে প্রাচীন বিধিসমূহ কতক বর্জিত হইয়াছে, কতক সংশোধিত হইয়াছে এবং ভক্তিমার্গের অনুকূল অনেক নূতন ব্যবস্থাও বিধিবদ্ধ হইয়াছে । মনুসংহিতায় কেবল মাত্র বৈদিক যজ্ঞাদি ও বৈদিক দেবগণেরই উল্লেখ আছে, পৌরাণিক দেবতা ও প্রতিমা-পূজাদির কোনো স্পষ্ট উল্লেখ নাই । কিন্তু পরবর্তী ব্যাস, পরাশর প্রভৃতি সংহিতায় পৌরাণিক ত্রিমূর্তি, নানা দেবতার পূজা-পদ্ধতির ব্যবস্থা করা হইয়াছে । মনুর অষ্টপ্রকার বিবাহ, দ্বাদশপ্রকার পুত্র ইত্যাদি বিষয়ক ব্যবস্থা পরবর্তী কালে সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হইয়াছে । ভাগবত-ধর্মের প্রাদুর্ভাবের ফলে শ্রাদ্ধে মাংসাদি-ব্যবহার, সন্ন্যাসাশ্রম প্রভৃতি লুপ্তপ্রায় হইলে পরবর্তী কালে এ-সমস্তও 'কলিতে নিষিদ্ধ' বলিয়া কথিত হইয়াছে । এইরূপে ধর্মশাস্ত্র যুগে-যুগে যুগোপযোগী পরিবর্তন সাধন করিয়া সমাজ ও হিন্দুধর্মকে চিরজীবী করিয়া রাখিয়াছে; হিন্দুধর্ম এইরূপ পরিবর্তনসহ বলিয়াই ইহা সনাতন সামাজিক আচার-ব্যবহারের পরিবর্তন অথবা যুগধর্মাদির প্রবর্তনে ধর্মশাস্ত্রের এইরূপ পরিবর্তন অপেক্ষাকৃত আধুনিক কালেও সংঘটিত হইয়াছে, তাহার দৃষ্টান্ত আমাদের বঙ্গদেশে প্রচলিত স্মার্তপ্রবর রঘুনন্দনের স্মৃতিসংগ্রহ ও বৈষ্ণবাচার্যগণের হরিভক্তিবিলাস প্রভৃতি বৈষ্ণব-স্মৃতি ।

বিভিন্ন ধর্মসংহিতার মধ্যে নানারূপ মতভেদ আছে । আধুনিক কালে কোনো কোনো প্রসিদ্ধ স্মার্তপণ্ডিত এই সকল বিভিন্ন মতের যথাসম্ভব সামঞ্জস্য করিয়া সমগ্র ধর্মশাস্ত্রের সার সংগ্রহপূর্বক কতকগুলি বিধি-ব্যবস্থা নির্ধারণ করিয়া দিয়াছেন । বর্তমান হিন্দুসমাজ তদনুসারেই চলিতেছে । আমাদের বঙ্গীয় স্মার্ত-সমাজ পণ্ডিতপ্রবর রঘুনন্দনের শাসনাধীন । 


4) বৈদিক ধর্মের ক্রমবিকাশের পৌর্বাপর্য-নির্ণয়


পূর্বে বৈদিক ধর্মের বিভিন্ন অঙ্গসমূহের সংক্ষিপ্ত বিবরণ লিখিত হইয়াছে । ঐগুলির ক্রম-বিকাশের ঐতিহাসিক পৌর্বাপর্যের জ্ঞান না থাকিলে শাস্ত্রবিশেষের প্রকৃত তাৎপর্য-বিচার যথাযথরূপে করা যায় না । গীতার্থ-বিচারে উহা বিশেষ প্রয়োজনীয়, কেননা দেখা যায় অনেক সাম্প্রদায়িক টীকাকার পরবর্তী কালের শাস্ত্রসমূহের সাহায্যে প্রাচীন গীতা হইতে অনেক অদ্ভুত তত্ত্ব নিষ্কাশন করিয়া থাকেন । এই হেতু বৈদিক যুগ হইতে বর্তমানকাল পর্যন্ত সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখাগুলির উৎপত্তিকাল ঐতিহাসিক-পরম্পরাক্রমে নিম্নে প্রদর্শিত হইল ।


খ্রীষ্টপূর্বাব্দ(BC)/খ্রীষ্টাব্দ(AD) শাস্ত্র
4500 BC ঋগবেদ
2500 BC অন্যান্য বেদ - ব্রাহ্মণগ্রন্থ; বৈদিক কর্মমার্গ - বেদবাদ ।
1600 BC প্রাচীন উপনিষৎ; ব্রহ্মবাদ - জ্ঞানমার্গ
1400 BC সাংখ্য, যোগ, ন্যায়; জ্ঞান-কর্ম-সমুচ্চয়মার্গ; সূত্র-গ্রন্থাদি । ভক্তিমার্গভাগবত-ধর্মের আবির্ভাব । গীতোক্ত ধর্মের প্রচার ।
900 BC মহাভারতগীতার রচনাকাল
500 BC বৌদ্ধধর্মের প্রচার - ধর্মবিপ্লব ।
200 AD শাণ্ডিল্য-সূত্রাদিতে ভক্তির ব্যাখ্যা । পৌরাণিক যুগ আরম্ভ - ব্রহ্মপুরাণ, বিষ্ণুপুরাণ, হরিবংশ প্রভৃতি গ্রন্থে শ্রীকৃষ্ণলীলাবর্ণন । শ্রীমদ্ভাগবতে শ্রীকৃষ্ণলীলা ও ভাগবত-ধর্মের বিস্তৃত বর্ণনা । নারদসূত্র, দেবী-ভাগবত প্রভৃতি শাক্ত পুরাণ ।
800 AD শঙ্করাচার্যের আবির্ভাব, বৈদিক ধর্মের পুনঃপ্রতিষ্ঠা, অদ্বৈত মায়াবাদ ও সন্ন্যাসবাদ প্রচার এবং তদনুযায়ী বেদান্ত ও গীতার ব্যাখ্যা ।
1000 AD রামানুজাচার্য কর্তৃক মায়াবাদের প্রতিবাদ, বাসুদেব-ভক্তি ও বিশিষ্টাদ্বৈত মত প্রচার এবং তদনুযায়ী গীতার ব্যাখ্যা ।
1000-1200 AD নিম্বার্ক, মধ্বাচার্য প্রমুখ কর্তৃক মায়াবাদের প্রতিবাদ ও ভক্তিবাদ প্রচার ।
1500-1600 AD শ্রীচৈতন্যদেবের আবির্ভাব ও ভক্তিমার্গ প্রচার । গৌড়ীয় গোস্বামিপাদগণ কর্তৃক বৈষ্ণবশাস্ত্র প্রণয়ন ও প্রচার । গীতার ভক্তিপর ব্যাখ্যা ।
1800 AD শাক্ত ও ভক্তের বাদ-বিসংবাদ
1900 AD পরমহংসদেবের আবির্ভাব; সমন্বয়বাদ প্রচার । আধুনিক যুগে গীতার অসাম্প্রদায়িক ব্যাখ্যা ।


উপরে মোটামুটিভাবে বিভিন্ন শাস্ত্রাদির ঐতিহাসিক কাল-পরম্পরা নির্দেশ করা হইল । এ-বিষয়ে নানারূপ মতভেদ আছে । আমরা অনেক স্থলেই লোকমান্য তিলকের মতের অনুসরণ করিয়াছি; অনেক পাশ্চাত্য প্রত্নতত্ত্বজ্ঞ পণ্ডিতও উহার যুক্তিমত্তা স্বীকার করিয়াছেন । প্রাচীনকালে কোনো ধর্মমত যখন প্রচারিত হইত, তখনই উহা পুস্তকাকারে লিপিবদ্ধ হইত না, সুতরাং গীতা বা মীমাংসাদি দর্শনশাস্ত্র রচিত হইবার পূর্বেই ঐ সকল ধর্মমত প্রচলিত ছিল, বুঝিতে হইবে । মহাভারত ও পুরাণাদি-শাস্ত্রের প্রকৃত সময় নির্দেশ একরূপ দুঃসাধ্য; কারণ আমরা ঐ সকল গ্রন্থ যে আকারে প্রাপ্ত হইয়াছি তাহা উহাদের মূলস্বরূপ নয় । দৃষ্টান্ত - মহাভারতের নারায়ণীয় পর্বাধ্যায়ে দশাবতারের বর্ণনায় বুদ্ধদেবের উল্লেখ নাই, অথচ ভাগবতে বুদ্ধাবতার, জৈনধর্ম ও দ্রাবিড়দেশীয় বৈষ্ণব-ধর্মাদিরও কথা আছে । সুতরাং বর্তমান ভাগবত অপেক্ষাকৃত পরবর্তী কালে সঙ্কলিত হইয়াছে এবং উহাতে অনেক নূতন বিষয় সংযোজিত হইয়াছে, ইহাই অনুমান করিতে হয় । সর্বশাস্ত্রেই এইরূপ প্রাচীন-অর্বাচীনের সংমিশ্রণ দেখা যায় । পৌরাণিক গ্রন্থাদির আলোচনা দুইভাবে হইতে পারে - (i) ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে; (ii) ভক্ত ও ভাবুকের দৃষ্টিতে । ঐতিহাসিক আলোচনা ভাবুক ভক্তের নিকট বিরক্তিকর এবং উহাতে তাঁহার কোনো প্রয়োজনও নাই । যিনি অকৃত্রিম ভক্তি-বলে অপ্রাকৃত নিত্যলীলায় আস্থাবান, তাঁহার নিকট ঐতিহাসিক তত্ত্বের মূল্য কি ? কিন্তু সেরূপ ভাগ্যবান সুদুর্লভ । আমাদের পুস্তক-প্রকাশও সর্বসাধারণের জন্য, সুতরাং ভক্তিশাস্ত্রের আলোচনায়ও ঐতিহাসিক-দৃষ্টি একেবারে বর্জন করা চলে না ।

5) গীতার পূর্ণাঙ্গযোগ : সর্বধর্ম-সমন্বয়


পূর্বোক্ত সংক্ষিপ্ত বিবরণ হইতে প্রতীত হইবে যে, গীতা প্রচারের সময় বেদবাদ ও বৈদিক কর্মমার্গ, বৈদান্তিক ব্রহ্মবাদ ও জ্ঞানমার্গ, সাংখ্যের পুরুষ-প্রকৃতিবাদ ও কৈবল্য জ্ঞান, আত্মসংস্থ-যোগ বা সমাধি-যোগ, অবতারবাদ ও ভক্তিমার্গ - এ সকলই প্রচলিত ছিল । এইগুলিই সনাতন ধর্মের প্রধান অঙ্গ এবং এগুলি আপাতত পরস্পর-বিরোধী বলিয়া বোধ হয় । বর্তমান কালেও কর্ম, জ্ঞান, যোগ, ভক্তি, এই সকল বিভিন্ন মার্গের পার্থক্য অবলম্বনে নানারূপ সাম্প্রদায়িক মতভেদের সৃষ্টি হইয়াছে । গীতা কিন্তু সনাতন ধর্মের এই সকল বিভিন্ন অঙ্গগুলির সমন্বয় করিয়া এক অপূর্ব পূর্ণাঙ্গ যোগ শিক্ষা দিয়াছেন । কিরূপে তাহা করিয়াছেন এবং সেই পূর্ণাঙ্গ যোগের স্বরূপ কি তাহা আমরা বিভিন্ন মার্গের ব্যাখ্যায় নানাস্থানে দেখাইতে চেষ্টা করিয়াছি ।

এ-স্থলে সাধারণভাবে সেই সমন্বয়-প্রণালীটি পুনরায় আলোচনা করিতেছি ।


5.1) সনাতন ধর্মের আপাত-পরস্পর-বিরোধী বিভিন্ন অঙ্গ 


বৈদিক ধর্মের এক প্রধান বিরোধ বেদবাদবেদান্তবাদে, কর্ম ও জ্ঞানে । প্রকৃতিপক্ষে এ-উভয়ই বেদবাদ, কেননা বেদান্ত বা উপনিষৎ বেদেরই অন্তর্ভাগ । বৈদিক ধর্মের দুই প্রধান শাখা - কর্ম ও জ্ঞান বা প্রবৃত্তিমার্গনিবৃত্তিমার্গ । সুতরাং ইহার কোনটি শ্রেয়ঃপথ, সকল শাস্ত্রেই এ-প্রশ্ন উঠিয়াছে এবং ইহার বিচারও আছে । মহাভারতের শুকানুপ্রশ্নে [মভাঃ শাঃ|২৩৭|৪০] শুকদেব পিতাকে জিজ্ঞাসা করিতেছেন -
"কর্ম কর, কর্ম ত্যাগ কর, এ দুই-ই বেদের আজ্ঞা; তাহা হইলে জ্ঞানের দ্বারা কোন গতি লাভ হয়, আর কর্মদ্বারাই বা কোন গতি লাভ হয় ?" [মভাঃ শাঃ ২৪০|১]
মহাভারতের বিভিন্ন স্থলে ইহার দুই-রকম উত্তর দেওয়া হইয়াছে । একটি উত্তর এইরূপ -
"কর্মদ্বারা জীব বদ্ধ হয়, জ্ঞানের দ্বারা মুক্ত হয়, সেই হেতু তত্ত্বদর্শী যতিগণ কর্ম করেন না ।"
ইহাই বৈদান্তিক সন্ন্যাসমার্গ বা নিবৃত্তিমার্গ । কর্মদ্বারা বন্ধন হয়, এ-কথা সর্বসম্মত; কিন্তু সেজন্য কর্ম ত্যাগ না করিলেও চলে, কর্তৃত্বাভিমান ও ফলাসক্তি বর্জন করিয়া কর্ম করিলেই বন্ধন হয় না, কেননা বন্ধনের কারণ আসক্তি, কর্ম নয় । সুতরাং পূর্বোক্ত প্রশ্নেরই উত্তর অন্যত্র এইরূপ দেওয়া হইয়াছে । -
"কর্ম কর, কর্ম ত্যাগ কর, উভয়ই বেদাজ্ঞা । সেইহেতু কর্তৃত্বাভিমান ত্যাগ করিয়া সমস্ত কর্ম করিবে ।"
"সেইহেতু যাঁহারা পারদর্শী তাঁহারা আসক্তি ত্যাগ করিয়া কর্ম করিয়া থাকেন ।"


5.1.1) জ্ঞানমূলক সন্ন্যাসমার্গ ('সাংখ্য') ও জ্ঞানমূলক কর্মমার্গ ('যোগ')

গীতাও এই কথাই পুনঃপুনঃ বলিয়াছেন - "অতএব তুমি আসক্তিশূন্য হইয়া সর্বদা কর্তব্য কর্ম সম্পাদন কর" [গী|৩|১৯; ৪|১৮-২৩] । আত্মজ্ঞান ব্যতীত আসক্তি ও কর্তৃত্বাভিমান দূর হয় না, এই হেতুই গীতায় কর্মোপদেশের সঙ্গে-সঙ্গেই আত্মজ্ঞানের উপদেশ । এই অংশে গীতা সম্পূর্ণ উপনিষদের অনুবর্তন করিয়াছেন এবং অনেক স্থলে উপনিষদের ভাষাই ব্যবহার করিয়াছেন । কিন্তু জ্ঞানলাভ করিয়াও কর্মসন্ন্যাস না করিয়া অনাসক্তভাবে লোকসংগ্রহার্থ কর্ম করাই কর্তব্য, ইহাই গীতার নিশ্চিত মত; ইহারই নাম জ্ঞান-কর্ম-সমুচ্চয়বাদ । এই মত গীতার পূর্বেও প্রচলিত ছিল এবং প্রাচীন ঈশোপনিষদে জ্ঞান-কর্মের সমুচ্চয় স্পষ্ট ভাষায় উপদেশ করা হইয়াছে [ঈশ|২; ১১] । বস্তুত বৈদান্তিক ব্রহ্মবাদিগণের মধ্যেও পূর্বাবধিই দুই পক্ষ ছিল । এক পক্ষ বলিতেন, জ্ঞান ও কর্ম পরস্পর-বিরোধী; কর্মত্যাগ অর্থাৎ সন্ন্যাস ব্যতীত মোক্ষলাভ হয় না; এই মত ও কাপিল-সাংখ্যের মত এক এবং পরবর্তী কালে এই বৈদান্তিক জ্ঞানমার্গেরই নাম হয় সাংখ্য । পক্ষান্তরে অন্য পক্ষ বলিতেন, জ্ঞানযুক্ত কর্মে অর্থাৎ নিষ্কাম কর্মে বন্ধন হয় না, সুতরাং মোক্ষার্থ কর্ম-ত্যাগের কোন প্রয়োজন নাই । ইহাই বৈদান্তিক কর্মযোগ বা যোগমার্গজ্ঞানমূলক সন্ন্যাসমার্গ বুঝাইতে 'সাংখ্য'-শব্দজ্ঞানমূলক কর্মমার্গ বুঝাইতে 'যোগ'-শব্দ মহাভারতে ও গীতায় পুনঃপুনঃ ব্যবহৃত হইয়াছে [গী|৫|২, ৪]


5.1.2) গীতাই ত্রয়োদশ উপনিষদ

বস্তুত এই বৈদান্তিক কর্মযোগই গীতার প্রতিপাদ্য । গীতার প্রতি-অধ্যায়ের শেষে যে ভণিতা আছে তাহাতেও এই কথাই ব্যক্ত হইয়াছে । উহাতে গীতার পরিচয় এইরূপ আছে -
'ইতি শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাসূ উপনিষৎসু ব্রহ্মবিদ্যায়াং যোগশাস্ত্রে অর্জুনবিষাদযোগো নাম প্রথমোহধ্যায়ঃ'
অর্থাৎ -
শ্রীভগবান কর্তৃক গীত উপনিষৎ বা ব্রহ্মবিদ্যার অন্তর্গত যোগশাস্ত্রে অর্জুনবিষাদযোগ নামক প্রথম অধ্যায় ।
উপনিষৎ-শব্দ সংস্কৃতে স্ত্রীলিঙ্গ, এই হেতু উহার বিশেষণ 'গীতা' এই স্ত্রীলিঙ্গ পদ ব্যবহৃত হইয়াছে । ইহা একখানি উপনিষৎ । বস্তুত ইহা প্রাচীন দ্বাদশখানি উপনিষদের তুল্য ত্রয়োদশ উপনিষদ বলিয়া গণ্য এবং বেদের ন্যায় মান্য । উপনিষৎসমূহে ব্রহ্মবিদ্যারই আলোচনা, কিন্তু তাহাতেও দুই মার্গ আছে - সাংখ্য ও যোগ । গীতা বেদান্তের অন্তর্গত যোগ বা কর্মযোগ মার্গের গ্রন্থ, তাই বলা হইয়াছে, 'ব্রহ্মবিদ্যায়াং যোগশাস্ত্রে' । এই যোগশাস্ত্র অষ্টাদশ অধ্যায়ে বিভক্ত, এই হেতু প্রত্যেক অধ্যায়ে প্রধানত যে বিষয়টি আলোচিত হইয়াছে তাহাকেও একটি যোগ বলা হইয়াছে, যেমন অর্জুনবিষাদ-যোগ, শ্রদ্ধাত্রয়-বিভাগযোগ ইত্যাদি । অষ্টাদশ অধ্যায় বা অঙ্গবিশিষ্ট এই যোগশাস্ত্রের এই অঙ্গ বলিয়াই উহার নাম 'যোগ', নচেৎ 'বিষাদযোগ' ইত্যাদি কথার অন্য কোনো অর্থ নাই ।


5.1.3) গীতায় 'যোগ'- ও 'সাংখ্য'-শব্দের ব্যবহার

'যোগ'-শব্দে পাতঞ্জল-যোগ বা সমাধি-যোগ এবং 'সাংখ্য'-শব্দে কাপিল সাংখ্যও বুঝায় । কিন্তু গীতায় 'যোগ' শব্দ প্রায় ৬০,৬৫ বার ব্যবহৃত হইয়াছে, তন্মধ্যে ৭,৮ স্থলে মাত্র উহা সমাধি-যোগ অর্থে ব্যবহৃত হইয়াছে [গী|৬|১০, ১২, ১৬, ১৭, ১৯, ২০] । আর সর্বত্রই বুদ্ধিযুক্ত কর্মযোগ অর্থেই ব্যবহৃত হইয়াছে । 'সাংখ্য' শব্দ প্রায় সর্বত্রই জ্ঞানমূলক সন্ন্যাসমার্গ অর্থে ব্যবহৃত হইয়াছে [গী|২|৩৯; ৩|৩; ৫|৪-৫] । একস্থলে মাত্র কাপিল-সাংখ্য বুঝাইতে 'গুণসংখ্যানে' শব্দ ব্যবহৃত হইয়াছে [গী|১৮|১৯]


5.1.4) গীতায় 'কর্ম'-শব্দের ব্যবহার

এই প্রসঙ্গে, 'কর্ম'-শব্দটিও গীতায় কী অর্থে ব্যবহৃত হইয়াছে তাহা বুঝা প্রয়োজন । মীমাংসাদি-শাস্ত্রে 'কর্ম' বলিতে যাগযজ্ঞাদিই বুঝায় । কিন্তু গীতায় 'কর্ম'-শব্দ সাধারণ ব্যাপক অর্থেই ব্যবহৃত হইয়াছে । মনুষ্য-জীবন কর্মময়, জীবনের সমস্ত কর্ম ('সর্বকর্মাণি') নিষ্কামভাবে ঈশ্বরার্পণ-বুদ্ধিতে লোকসংরহার্থ করিতে পারিলেই ইহা যজ্ঞ হয় । এই জীবনযজ্ঞকে কামনাশূন্য করিয়া ঈশ্বরমুখী করাই গীতার উদ্দেশ্য ও উপদেশ - কেননা উহাতেই জীবের মোক্ষ ও জগতের অভ্যুদয় যুগপৎ সাধিত হয় । কাজেই শ্রীভগবান গীতার কামনামূলক যাগযজ্ঞাদির নিন্দা করিলেও নিষ্কাম যাগযজ্ঞাদির প্রশংসা ও ব্যবস্থা করিয়াছেন; কেননা উহা চিত্তশুদ্ধিকর ও লোকরক্ষার অনুকূল [গী|৩|১৪-১৬; ১৮|৫-৬] এবং এইরূপে বেদবাদ বা বৈদিক কর্মমার্গের সহিত বৈদান্তিক জ্ঞানবাদের সমন্বয়-সাধন করিয়াছেন ।


5.1.5) সাংখ্যজ্ঞানী ও ব্রহ্মজ্ঞানীদের আপত্তি

কিন্তু এ-স্থলে কাপিল সাংখ্যজ্ঞানী ও বৈদান্তিক ব্রহ্মজ্ঞানী উভয়েরই এক গুরুতর আপত্তি আছে । মায়াবাদী ব্রহ্মজ্ঞানীর ব্রহ্ম নির্গুণ, নীরব, নিষ্ক্রিয়, সাংখ্যের পুরুষও তদ্রূপ । সাংখ্যমতে প্রকৃতি এবং বেদান্তমতে মায়া বা অজ্ঞানই কর্ম বা সংসার-প্রপঞ্চের মূল । সাংখ্যমতে পুরুষ যখন প্রকৃতি হইতে বিমুক্ত হইয়া স্ব-স্বরূপে ফিরিয়া আসে তখনই প্রকৃতির ক্রিয়া বন্ধ হয় । বেদান্তমতেও মায়ার যখন শেষ হয়, তখন জীব ব্রহ্ম হইয়া যায় ('ব্রহ্মবিদ্‌ ব্রহ্মৈব ভবতি'), কর্মও লোপ পায় । সুতরাং উভয় মতেই জ্ঞান বা মোক্ষের অর্থ কর্মের শেষ, বিশ্বলীলার লোপ । সে হেতু জ্ঞানবাদীরা বলেন, স্থিতি এবং গতি, আলোক ও অন্ধকার, জ্ঞান ও অজ্ঞান যেমন যুগপৎ সম্ভবে না, কর্ম ও জ্ঞানও সেইরূপ একত্রিত থাকিতে পারে না ।


5.2) গীতার 'পুরুষোত্তম-তত্ত্ব' দ্বারা সমন্বয়

গীতা পুরুষোত্তম-তত্ত্ব দ্বারা এই আপত্তির মীমাংসা করিয়াছেন । অধ্যাত্মতত্ত্বের বিচারে গীতা তিন পুরুষ ও দুই প্রকৃতির উল্লেখ করিয়াছেন এবং উহাদের দ্বারাই নিরীশ্বর সাংখ্যবাদ, নির্বিশেষ ব্রহ্মতত্ত্ব ও সগুণ ঈশ্বরবাদ বা ভগবত্তত্ত্বের সমন্বয় করিয়াছেন । সেই সমন্বয়মূলক দার্শনিক তত্ত্বের ভিত্তিতেই জ্ঞান-কর্ম-ভক্তিমিশ্র অপূর্ব যোগ-ধর্ম শিক্ষা দিয়াছেন । এ-সকল তত্ত্বের মর্ম কি, সমন্বয়-প্রণালীটিই বা কি তাহা তত্তৎ স্থলে বিস্তারিত ব্যাখ্যাত হইয়াছে । সংক্ষেপে মূল কথাটি এই - 


5.2.1) নির্গুণ ব্রহ্মবাদীর আপত্তির উত্তর

শ্রীভগবান বলিতেছেন - নির্গুণ ব্রহ্মই বল আর সগুণ ব্রহ্মই বল, আমিই সব । নির্গুণ, সগুণ - দুই-ই আমার বিভাব । নির্গুণভাবে আমি সম, শান্ত, নিষ্ক্রিয়, নীরব; সগুণভাবে আমি সৃষ্টিকর্তা, বিশ্বপ্রকৃতির সকল কর্মের নিয়ামক । জীবের যখন নানাত্ব-বুদ্ধি বিদূরিত হইয়া একত্ব জ্ঞান হয় তখন জীব সম, শান্ত, নির্মল হইয়া ব্রহ্মভাব প্রাপ্ত হয় [গী|১৮|২০, ৫৩] । তখন তাহার নিজের কর্ম থাকে না, তা ঠিক [গী|৩|১৭], কিন্তু তাহার কর্ম আমার কর্ম হইয়া যায় ('মৎকর্মকৃৎ' গী|১১|৫৫); আমার কর্মই তাহার মধ্য দিয়া হয়, সে নিমিত্তমাত্র [গী|১১|৩৩]; আমাতে তাহার পরাভক্তি জন্মে [গী|১৮|৫৪]; ভক্তিদ্বারা আমার সগুণ-নির্গুণ সমগ্রস্বরূপ অধিগত হয় [গী|১৮|৫৫]; তখন সেই মচ্চিত্ত, মদর্পিতকর্মা, মদ্ভক্ত কর্মযোগী কর্ম করিয়াও আমাতেই অবস্থিতি করে [গী|৬|৩১; ১৮|৫৬] । সুতরাং এই কর্মে ও জ্ঞানে কোনো বিরোধ নাই ।


5.2.2) কাপিল সাংখ্যজ্ঞানীর আপত্তির উত্তর

সেইরূপ কাপিল সাংখ্যজ্ঞানীকেও শ্রীভগবান বলিতেছেন - তোমাদের প্রকৃতি ও পুরুষ আমারই অপরা ও পরা প্রকৃতি [গী|৭|৪-৫], আমিই মূলতত্ত্ব । প্রকৃতিই কর্ম করে তা ঠিক [গী|৩|২৭; ১৩|২৯], সে আমারই ইচ্ছা বা অধিষ্ঠানবশত, আমিই প্রকৃতির অধীশ্বর [গী|১৪|৩-৪] । জীবের যখন অহংজ্ঞান বিদূরিত হয়, তখন সে প্রকৃতি হইতে মুক্ত হয় বা ত্রিগুণাতীত হয় । কিন্তু তখনও কর্ম বন্ধ হয় না, আমার বিশ্বলীলা লোপ পায় না, দেহ থাকিতে কর্ম যায় না [গী|১৮|১১]; কিন্তু জ্ঞান হইলে 'আমি কর্ম করি' এই ভ্রম লোপ পায়; সুতরাং তখন জীব অনাসক্ত, ফলাফলে উদাসীন, নির্দ্বন্দ্ব ও সমত্ববুদ্ধিযুক্ত হইয়া বিশ্বকর্ম করিতে পারে [গী|১৪|২২-২৩] এবং তাহাই কর্তব্য । এ-কর্মে বন্ধন হয় না [গী|১৮|১৭] এবং জ্ঞানের সহিতও ইহার কোনো বিরোধ নাই ।

সুতরাং দেখা গেল - মীমাংসা, সাংখ্য, বেদান্ত সকল শাস্ত্রেরই উপপত্তি গীতা অংশত গ্রহণ করিয়া পুরুষোত্তম-তত্ত্ব দ্বারা উহাদের সমন্বয় করিয়া দিয়াছেন । এক্ষণে পাতঞ্জল-যোগ বা সমাধি-যোগের অবতারণা গীতা কি উদ্দেশ্যে করিয়াছেন তাহাই দ্রষ্টব্য ।


5.2.3) গীতায় যোগের উদ্দেশ্য

চিত্তকে বাহ্য বিষয় হইতে প্রত্যাহৃত করিয়া নিত্য বস্তু-তত্ত্বে সমাহিত করার জন্য যোগের প্রয়োজন । ধ্যান-ধারণা সকল মার্গেই আবশ্যক; সেই হেতু সাংখ্য, বেদান্ত, ভক্তিশাস্ত্র - সকলেই কোনো-না-কোনো রূপ যোগের পন্থা অবলম্বন করিতে উপদেশ দিয়াছেন । গীতারও ষষ্ঠ অধ্যায়ে পাতঞ্জল-যোগ বা রাজযোগের উপদেশ আছে । কিন্তু উদ্দেশ্য ঠিক এক নহে । সাংখ্য ও পাতঞ্জলের উদ্দেশ্য অসম্প্রজ্ঞাত বা নির্বীজ সমাধি দ্বারা কৈবল্যলাভ অর্থাৎ 'কেবল' হওয়া বা প্রকৃতি হইতে মুক্ত হওয়া । ইহাতে আত্যন্তিক দুঃখনিবৃত্তি ঘটে; এ-অবস্থায় চিত্তের সর্ববিধ সংস্কার দগ্ধ হইয়া যায়, চিত্তের বৃত্তি নষ্ট হইয়া যায়, শরীরটা দগ্ধসূত্রের ন্যায় আভাসমাত্রে অবস্থান করে, ইহাতে সুখের বিশেষ সম্পর্ক নাই । ব্রহ্মজ্ঞানী সমাধিদ্বারা ব্রহ্ম সাক্ষাৎকার লাভ করেন - নির্গুণ ব্রহ্মে স্থিতিলাভ করেন, ইহাতে কেবল আত্যন্তিক দুঃখনিবৃত্তি নহে, ইহা দুঃখনিবৃত্তি সুখেরও অবস্থা । গীতায় এই অবস্থার সুন্দর বর্ণনা আছে [গী|৬|২১-২২] । কিন্তু গীতা ইহারও উপরে গিয়াছেন, গীতা ব্রহ্মতত্ত্বেরও উপরে ভগবত্তত্ত্ব স্থাপন করিয়াছেন [গী|১৪|২৭; ১৫|১৮]

সাংখ্যে ঈশ্বর নাই, পাতঞ্জলে ঈশ্বরের বিকল্প-বিধান, সেও অতি গৌণ ('ঈশ্বরপ্রণীধানাদ্‌ বা') । বেদান্তে নির্গুণ ব্রহ্মে স্থিতি, গীতায় নির্গুণ-গুণী পুরুষোত্তমে চিত্ত-সংযোগ । তাই গীতা ব্রাহ্মীস্থিতির নির্মল অদ্বয় আনন্দ বর্ণনা করিয়াও পরে বলিতেছেন - ব্রহ্মভূত সাধকও সর্বলোকমহেশ্বর সর্বভূতের সুহৃদ শ্রীভগবানকে জানিয়া পরম শান্তি লাভ করেন [গী|৫|২৯] । বস্তুত গীতায় যোগের প্রসঙ্গে সর্বত্রই ভগবদ্ভক্তির কথা । গীতার যোগানন্দ ঈশ্বরপ্রাপ্তিজনিত ('মৎসংস্থাম্‌' গী|৬|১৫); গীতার মতে ভগবদ্ভক্ত যোগীই যুক্ততম [গী|৬|৪৭]; গীতোক্ত যোগী আত্মসাক্ষাৎকার লাভ করিয়া সর্বত্র সর্বভূতে ঈশ্বরই দেখেন [গী|৬|২৯-৩০] এবং সর্বভূতেই নারায়ণ আছেন জানিয়া নিষ্কাম কর্মদ্বারা সর্বভূতের সেবা করেন [গী|৬|৩১] । তাই শ্রীভগবানে চিত্তার্পণই, তাঁহাতে আত্ম-সমর্পণই গীতার সর্বশেষ ও 'গুহ্যতম' উপদেশ ('মন্মনা ভব মদ্ভক্ত' গী|১৮|৬৫-৬৬) ।


5.3) ভাগবত ধর্ম


গীতা, মীমাংসার বেদোক্ত কর্ম রাখিয়াছেন, বৌদ্ধের ন্যায় বেদ উড়াইয়া দেন নাই; কিন্তু বেদের অপব্যাখ্যা যে বেদবাদ তাহার প্রতিবাদ করিয়াছেন এবং মীমাংসার যজ্ঞাদির অর্থ-সম্প্রসারণ করিয়া, ভক্তিপূত এবং জ্ঞানসংযুক্ত করিয়া নিষ্কাম করিয়াছেনবেদান্তের ব্রহ্মবাদ সম্পূর্ণই গ্রহণ করিয়াছেন, কিন্তু বেদান্তীর ন্যায় কর্মত্যাগ করিতে বলেন নাই, বিশ্বলীলার লোপের ব্যবস্থা করেন নাই, বিশ্বকর্তার  কর্মকে বিশ্বকর্মে পরিণত করিয়াছেন । পাতঞ্জল যোগ-প্রণালী গ্রহণ করিয়া উহাকে ঈশ্বরমুখী করিয়াছেন । এইরূপে গীতা জ্ঞানযোগ, জ্ঞানযোগ, ধ্যানযোগ ও ভক্তিযোগের সমন্বয়ে অপূর্ব চতুরঙ্গ যোগধর্ম শিক্ষা দিয়াছেন । এ-প্রসঙ্গে ইহা বলা আবশ্যক যে - চতুরঙ্গ যোগ বলিতে ইহা মোটেই বুঝায় না যে 'জ্ঞানযোগ', 'ধ্যানযোগ' ইত্যাদি নামে যে চারিটি বিশিষ্ট সাধন-প্রণালী প্রচলিত আছে, প্রত্যেক সাধককেই ক্রমান্বয়ে তাহা অবলম্বন ও অভ্যাস করিতে হইবে । সেই সকল সাধন-প্রণালীর যাহা সারতত্ত্ব তাহা সকলই এই যোগধর্মের অন্তর্ভুক্ত আছে, ঐ সকল ইহাতে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত । এই যোগধর্ম একটিই, চারিটি নয় । ইহাই শ্রীভগবানের কথিত 'ভাগবত ধর্ম' । ইহার স্থূল কথা এই - পরমাত্মা পুরুষোত্তমই সমস্ত বেদে বেদ্য [১৫|১৫], তিনিই যজ্ঞ-দান-তপস্যাদির ভোক্তা [৫|২৯], তাঁহাতে চিত্তসংযোগই যোগ [৬|১৫], তাঁহাতে পরাভক্তিই জ্ঞান [১৩|১০], তাঁহার কর্মই পরম ধর্ম [১১|১৫], তিনিই জীবের পরম গতি । এই তত্ত্বটি নিম্নোক্ত ভাগবত-বাক্যে সংক্ষেপে এইরূপে ব্যক্ত হইয়াছে -
বাসুদেবপরা বেদা বাসুদেবপরা মখাঃ ।
বাসুদেবপরা যোগা বাসুদেবপরা ক্রিয়াঃ ।।
বাসুদেবপরা জ্ঞানং বাসুদেবপরা তপঃ ।
বাসুদেবপরা ধর্মো বাসুদেবপরা গতিঃ ।। - [ভাঃ ১ম ২|২৮|২৯]
বলা বাহুল্য যে, 'বাসুদেব' শব্দ পরব্রহ্মবাচক । সর্বভূতে বাস করেন বলিয়াই তিনি বাসুদেব ('সর্বভূতাধিবাসশ্চ বাসুদেবস্ততো হ্যহম্‌', মভাঃ শাঃ ৩৪১|৪১; বস্‌ - বাস করা), 'ব্রহ্ম' শব্দেরও উহাই অর্থ ('বৃহত্ত্বাৎ ব্রহ্ম', 'যেন সর্বম্‌ ইদং ততম্‌'গী|২|১৭) । এইরূপ, সমস্ত ব্যাপিয়া আছেন বলিয়াই তিনি আবার 'বিষ্ণু' (বিষ্‌ - বিস্তারে) । ব্রহ্মবাদী বলেন - সমস্তই ব্রহ্ম ('সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম'); গীতা বলেন - সমস্তই বাসুদেব ('বাসুদেবঃ সর্বমিতি', গী|৭|১৯]); বিষ্ণুপুরাণ বলেন - জগৎ বিষ্ণুময় ('ইদং বিষ্ণুময়ং জগৎ') । সর্বত্রই এক তত্ত্ব । বস্তুত শ্রীকৃষ্ণ বসুদেবের পুত্র বলিয়াই যে বাসুদেব তা নন, শ্রীকৃষ্ণ-অবতারের পূর্বেও যাঁহারা পরব্রহ্মের অবতার বলিয়া পুরাণে বর্ণিত হইয়াছেন, তাঁহারাও ভগবান 'বাসুদেব' বলিয়াই আখ্যাত হইয়াছেন [ভাঃ ৫|৫|৬; ৫|৬|১৬]

পৌরাণিক অবতার-তত্ত্ব, প্রতীকোপসনা এবং ইষ্টমূর্তির নানাবিধ ধ্যানধারণা প্রভৃতি ভক্তিমার্গের আবশ্যক অঙ্গগুলির প্রকৃত মর্ম হৃদ্গত না করিয়া এক অখণ্ড বস্তুকে আমরা খণ্ড-খণ্ড করিয়া 'ব্যক্তি'রূপে কল্পনা করিয়া থাকি এবং জড়োপাসকের ন্যায় উহা লইয়া বাদ-বসংবাদ করি । তাই গীতায় শ্রীভগবান স্পষ্টাক্ষরে বলিয়াছেন - অল্পবুদ্ধি মানব আমার পরম তত্ত্ব না জানিয়া অব্যক্ত অব্যয়স্বরূপ আমাতে ব্যক্তিত্ব আরোপ করিয়া থাকে ('অব্যক্তং ব্যক্তিমাপন্নং মন্যন্তে মামবদ্ধয়ঃ'গী|৭|২৪) । বস্তুত বৈষ্ণব, শৈব, শাক্ত, ব্রাহ্ম, খ্রীষ্টীয় ইত্যাদি ঈশ্বরবাদী মাত্রেই যাঁহার উপাসনা করেন, তিনিই বাসুদেব অবতারবাদ ইত্যাদি যাঁহারা মানেন না, তাঁহারাও বাসুদেবেরই উপাসনা করেন এবং বাসুদেব তাহা অগ্রাহ্য করেন না, ইহা তাঁহারই শ্রীমুখের বাণী ('যে যথা মাং প্রপদ্যন্তে', গী|৪|১১) । ভগবান বাসুদেব কর্তৃক যে উদার সর্বজনীন ধর্মমত গীতায় কথিত হইয়াছে তাহাই ভাগবত ধর্ম ।

6) গীতোক্ত ভাগবত-ধর্মের প্রাচীন স্বরূপ


পূর্বে বলা হইয়াছে, গীতায় যে পূর্ণাঙ্গ যোগধর্ম ব্যাখ্যাত হইয়াছে, উহাকে ভাগবত-ধর্ম বলে; ইহা অনুমানের কথা নহে । মহাভারতে শান্তিপর্বে নারায়ণীয় পর্বাধ্যায়ে এই ধর্মের বিস্তারিত বর্ণনা আছে এবং তথায় ইহাকে নারায়ণীয় ধর্ম, ঐকান্তিক ধর্ম, সাত্বত ধর্ম ইত্যাদি নামে অভিহিত করা হইয়াছে । ভাগবত-ধর্মের এই সকল নাম সুপরিচিত । এই ধর্ম বর্ণনপ্রসঙ্গে বৈশাম্পায়ন, জনমেজয়কে বলিয়াছেন -
'হে নৃপবর, পূর্বে হরিগীতায় এই মহান ধর্ম বিধিযুক্ত সংক্ষিপ্ত প্রণালীতে তোমার নিকট কথিত হইয়াছে ।' [মভাঃ শাঃ ৩৪৬|১১]
এ-স্থলে 'হরিগীতা' বলিতে ভগবদ্গীতাই বুঝাইতেছে । এ-কথা পরে আরও স্পষ্ট করিয়াই বলা হইয়াছে । এই ধর্মতত্ত্ব শ্রবণ করিয়া জনমেজয় বলিলেন - 'আমার নিশ্চয় বোধ হইতেছে, এই একান্তধর্মই শ্রেষ্ঠ ও নারায়ণের প্রিয়তম; যে সমস্ত বিপ্রগণ সযত্ন হইয়া বিধিপূর্বক উপনিষদের সহিত বেদ পাঠ করেন এবং যাঁহারা যতিধর্ম-সমন্বিত, তাঁহাদের অপেক্ষা একান্তি-মানবগণের গতি উৎকৃষ্ট বোধ হইতেছে । এই ধর্ম কোন সময় কোন দেব বা ঋষি কর্তৃক কথিত হইয়াছে, তাহা শুনিতে আমার বড় কৌতূহল হইতেছে ।' তখন বৈশাম্পায়ন কহিলেন - 'সংগ্রামস্থলে কুরু-পাণ্ডব সৈন্য উপস্থিত হইলে যখন অর্জুন বিমনস্ক হইলেন, তখন ভগবান স্বয়ং তাঁহাকে এই ধর্ম উপদেশ দিয়াছিলেন' [মভাঃ শাঃ|৩৪৮|৮]

কিন্তু এই ধর্ম যে কুরুক্ষেত্রেই প্রথম প্রচারিত হইয়াছিল তাহা নহে । এই ধর্ম নিত্য ও অব্যয়, উহা কল্পে-কল্পে আবির্ভূত ও তিরোহিত হইয়াছে । প্রতি-কল্পে উহা কি ভাবে প্রচারিত হইয়াছে নারায়ণীয়-উপাখ্যানে তাহার বিস্তারিত বর্ণনা আছে এবং তথায় উল্লিখিত হইয়াছে যে, বর্তমান কল্পে ত্রেতাযুগের প্রারম্ভে উহা বিবস্বান-মনু-ইক্ষ্বাকু প্রভৃতি পরম্পরাক্রমে বিস্তৃত হইয়াছে [মভাঃ শাঃ|৩৪৮|৫১-৫২]

গীতারও চতুর্থ অধ্যায়ের প্রারম্ভে শ্রীভগবান ঠিক এই পরম্পরারই উল্লেখ করিয়াছেন [গী|৪|১-৩] এবং এই ধর্মকেই 'যোগ' বলিয়া নির্দেশ করিয়াছেন । সুতরাং গীতোক্ত এই যোগধর্ম ও নারায়ণীয়োপাখ্যানে বর্ণিত ভাগবত-ধর্ম একই, ইহা সুনিশ্চিত । এই নারায়ণীয় ধর্মের সাধ্যসাধন-তত্ত্বের আলোচনায়ও সেই সিদ্ধান্তই দৃঢ়ীকৃত হয় । মহাভারতের বর্ণনা অতি বিস্তৃত, দুই-চারিটি মুখ্য কথার মর্মানুবাদ এ-স্থানে উদ্ধৃত হইতেছে ।

'ইহা সংসারে দ্বিজসত্তমগণ যাহাতে প্রবেশ করিয়া মুক্ত হন, সেই সনাতন বাসুদেবকে পরমাত্মা জানিবে । তিনি নির্গুণ অথচ গুণভোগী এবং গুণস্রষ্টা হইয়াও গুণাধিক' [মভাঃ শাঃ|৩৩৯] । ইনিই বেদসমূদয়ের আশ্রম, শ্রীমান, তপস্যার নিধি; ইনিই সাংখ্য, ইনিই যোগ, ইনিই ব্রহ্ম । ইনি ঐশ্বর্য-সমন্বিত এবং সর্বভূতের আবাস, এই নিমিত্ত বাসুদেব নামে অভিহিত হন । ইনি গুণবর্জিত অথচ কার্যবশত অবিলম্বে গুণগনের সহিত সংযুক্ত হইয়া থাকেন' [মভাঃ শাঃ|২৪৭] । 

'একান্ত ভক্তি-সমন্বিত নারায়ণ-পরায়ণ ব্যক্তি সতত পুরুষোত্তমকে চিন্তা করিয়া মনের অভিলষিত লাভ করেন ।' 'সুপ্রযুক্ত কর্ম ও অহিংসা ধর্মযুক্ত এই ধর্মজ্ঞান হইলে জগদীশ্বর হরি প্রীত হন ।' 'সেই নিষ্কাম কর্মকারী একান্ত ভক্তগণের আমিই (ভগবান বাসুদেব) আশ্রয় ।' 'সাংখ্য, যোগ, ঔপনিষদিক জ্ঞান ও পাঞ্চরাত্র বা ভক্তিমার্গ - এ-সকল পরস্পর পরস্পরের অঙ্গস্বরূপ । এই তো তোমার নিকট সাত্বত ধর্ম কথিত হইল' [মভাঃ শাঃ|৩৪৮]

এই সকল কথার স্থূলমর্ম এই যে, নির্গুণ-গুণী ভগবান পুরুষোত্তম বাসুদেবই পরব্রহ্ম । তিনিই সমস্ত ('বাসুদেবঃ সর্বমিতি'), সর্বভূতে তিনিই আছেন এবং তাঁহাতেই সর্বভূত আছেন [গী|৬|২৬-৩০], এই জ্ঞান লাভ করিয়া তাঁহাতে একান্ত ভক্তি করা এবং সর্বভূতহিত-কল্পে নিষ্কাম কর্ম করা, ইহাই এই ধর্মের স্থূলকথা । উপরি-উদ্ধৃত বাক্যে স্পষ্টই বলা হইয়াছে যে, সাংখ্য, যোগ, আত্মজ্ঞান ও ভগবদ্ভক্তি, এ-সকলই এ-ধর্মের অঙ্গস্বরূপ । আমরা পূর্বে দেখিয়াছি যে, গীতোক্ত পূর্ণাঙ্গ যোগধর্ম ঠিক ইহাই; ইহাই সাত্বত ধর্ম বা ভাগবত ধর্ম

পরব্রহ্ম বাসুদেবেরই দ্বিধামূর্তি নর-নারায়ণ ঋষি এই ধর্ম প্রথম প্রবর্তন করেন [মভাঃ শাঃ|৩৩৪] । মহাভারতে ও ভাগবতে উক্ত হইয়াছে যে, এই নারায়ণ ঋষি নিষ্কাম কর্ম শিক্ষা দিয়াছেন এবং নিজেও কর্ম আচরণ করিতেন [ভা|১১৪|৬; মভাঃ উদ্যোঃ|৪৯|২০|১১; মভাঃ শাঃ|২|৭|২] । শ্রীকৃষ্ণও গীতায় নিষ্কাম কর্ম শিক্ষা দিয়াছেন এবং নিজেও কর্ম আচরণ করিতেন । বস্তুত, ভগবান নারায়ণনরই দ্বাপরের শেষে কৃষ্ণার্জুনরূপে আবির্ভূত হইয়াছিলেন [মভাঃ উদ্যোঃ|৪৯|২০; মভাঃ শাঃ|৩৩৯-৪১]

এই নর-নারায়ণ ঋষি ভাগবত-ধর্মের আদি প্রবর্তক বলিয়াই উঁহাদিগকে নমস্কার করিয়া ভাগবত-ধর্মগ্রন্থাদি আরম্ভ করিতে হয় । 'নারায়ণং নমস্কৃত্য নরঞ্চৈব নরোত্তমম্‌ । দেবীং সরস্বতীং ব্যাসং ততো জয়মুদীরয়েৎ ।।' অর্থাৎ নারায়ণ, নরশ্রেষ্ঠ নর, সরস্বতী দেবী ও ব্যাসদেবকে নমস্কার করিয়া 'জয়' অর্থাৎ মহাভারতাদি গ্রন্থ পাঠ করিবে । মহাভারতের প্রাচীন নাম 'জয়' [মভাঃ আদিঃ|৬২|২০] এবং উহাই ভাগবত-ধর্মের প্রধান এবং মুখ্য গ্রন্থ । পরবর্তী কালে পুরাণাদি সমস্ত শাস্ত্রেই ভক্তিমার্গ ও ভাগবত-ধর্মই কথিত হইয়াছে, এই হেতু এই সকল শাস্ত্রেরও সাধারণ নাম 'জয়' হইয়াছে -
অষ্টাদশপুরাণানি রামস্য চরিতং তথা ।বিষ্ণুধর্মাদিশাস্ত্রাণি শিবধর্মাশ্চ ভারত । ...জয়েতি নাম এতেষাম্‌ ।
অধুনা ভাগবত-ধর্ম বলিতে সাধারণত বৈষ্ণবধর্মই বুঝায় । কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বৈষ্ণব, শৈব, শাক্ত প্রভৃতি ভক্তিমার্গের উপাসক সকল সম্প্রদায়ই ভাগবত-ধর্মাবলম্বী; কেননা ইহারা সকলেই অনির্দেশ্য ব্রহ্মতত্ত্বের স্থলে ভগবত্তত্ব অর্থাৎ ভক্তের ভগবান বলিয়া একটি উপাস্য বস্তু স্বীকার করেন, তিনি বিষ্ণুই হউন আর রুদ্রই হউন, তাহাতে কিছু আসে যায় না । পূর্বে বলা হইয়াছে, সনাতন ধর্ম প্রথমে কর্মপ্রধান ছিল, পরে ঔপনিষদিক যুগে অনির্দেশ্য ব্রহ্মবাদেরই প্রাধান্য হয় । পরে যখন ভক্তিমার্গ, অবতারবাদ ও প্রতীকোপাসনা বা মূর্তিপূজাদির প্রবর্তন হইয়া ঈশ্বরবাদ সুপ্রতিষ্ঠিত হয়, তখন বিষ্ণু-রুদ্রাদি বৈদিক দেবগণই ঈশ্বরের স্থানে প্রতিষ্ঠিত হন । কিন্তু দেবতা একাধিক, সুতরাং ঈশ্বরের স্থান লইয়া তাঁহাদের মধ্যে অর্থাৎ তাঁহাদের ভক্তগণের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও নানারূপ মতভেদ হইবারই কথা। এইরূপে বৈষ্ণব, শৈব, শাক্ত প্রভৃতি বিভিন্ন উপাসক-সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হয় । ইঁহারা সকলেই সগুণ ঈশ্বর, নিত্যা প্রকৃতি, জগতের সত্যতা এবং ভক্তিমার্গের শ্রেষ্ঠতা স্বীকার করেন অর্থাৎ ইঁহারা সকলেই ভাগবতধর্মী । বৈদিক কর্মবাদ ও বৈদান্তিক ব্রহ্মবাদ হইতে পৌরাণিক ভাগবত-ধর্মের এই সকল বিষয়েই পার্থক্য । বিষ্ণু, রুদ্র প্রভৃতি যে একই মূলতত্ত্বের বিভিন্ন বিকাশ বা মূর্তি তাহা সকল শাস্ত্রই বলেন - 'একং সত্তং দ্বিধাকৃতম্‌'; 'একং সদ্‌ বিপ্রা বহুধা বদন্তি' । একটি দৃষ্টান্ত ধরুন । শক্তিপূজা সম্বন্ধে দেবী-ভাগবতে দেবদেব বলিতেছেন -
'সুমুখি, আমি মায়ার উপাসনার কথা কোথাও বলি নাই, মায়ার অধিষ্ঠান যে চৈতন্য তিনিই উপাস্য, ইহাই বলিয়াছি ।'
সুতরাং বুঝা গেল, শক্তি-উপাসনা মায়ার অধিষ্ঠাত্রী পুরুষ যে চৈতন্য তাঁহারই উপাসনা । ইনিই সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বর, ভক্তের ভগবান । ইনিই উপনিষদের 'এই হিরণ্ময় আবরণে আচ্ছাদিত সত্যই মায়া-উপহিত জ্যোতির্ময় চৈতন্য', ইনিই ভক্তচিত্তে নানারূপে উদিত হন; কেহ বলেন চিন্ময়, কেহ বলেন চিন্ময়ী । ব্যাসদেব শ্রীমদ্ভাগবত রচনার প্রারম্ভে সমাধিযোগে এই তত্ত্বই উপলব্ধি করিয়াছিলেন - 'তিনি পূর্ণ পুরুষকে দেখিলেন এবং মায়াকেও দেখিলেন (মায়াঞ্চ), নচেৎ বিশ্বলীলার বর্ণনা হয় না' । এইরূপ তাত্ত্বিক দৃষ্টিতে হরি-হরেও কোনো ভেদ নাই, থাকিতে পারে না; কেননা, সনাতনধর্ম একেশ্বরবাদী, এক ভিন্ন দুই নাই, তবে ইহাদিগকে দেবতা বলিয়া কল্পনা করিলে ইহাদের উপাসকদের মনে ভেদবুদ্ধি স্বভাবতই হয় এবং তাহা লইয়া বাদ-বিসম্বাদও হয় । সম্প্রদায় বা দল হইতেই দলাদলি অবশ্যম্ভাবী । কিন্তু দেবতা অনেক থাকিলেও ঈশ্বর এক, সুতরাং যিনি একেশ্বরে বিশ্বাস করেন, যিনি প্রকৃত তত্ত্বজ্ঞ, তাঁহার ভেদবুদ্ধি নাই, তাঁহার কথা স্বতন্ত্র -
'বিষ্ণু যে প্রকার শিবময়, শিবও সেই প্রকার বিষ্ণুময়, আমার জীবন এমন মঙ্গলময় হউক যেন আমি ভেদ দর্শন না করি ।' [স্কন্দোপনিষৎ]
সুতরাং দেখা গেল, উপনিষদে, ভাগবত-পুরাণে বা দেবী-ভাগবতে - সর্বত্রই মূলতত্ত্ব একই । গীতায় সর্বত্রই এই মূলতত্ত্বেরই উপপাদন - কোথাও বিশেষভাবে কোনো মূর্তি-বিশেষের উল্লেখ নাই । এই হেতুই গীতা বৈষ্ণব, শাক্ত, শৈব প্রমুখ সকল সম্প্রদায়েরই মান্য ।

7) গীতা ও ভাগবত : আধুনিক বৈষ্ণবমত


ভাগবত-ধর্মের যে সকল বিশিষ্ট গ্রন্থ এক্ষণে পাওয়া যায়, তন্মধ্যে শ্রীগীতা, মহাভারতের নারায়ণীয়োপাখ্যান, শাণ্ডিল্যসূত্র, শ্রীভাগবত-পুরাণ, নারদ-পঞ্চরাত্র, নারদসূত্র, ভরদ্বাজসংহিতা, ব্রহ্মসংহিতা প্রভৃতি প্রাচীন গ্রন্থ এবং আধুনিক যুগের শ্রীরামানুজাচার্য, শ্রীমধ্বাচার্য প্রমুখ ও গৌড়ীয় গোস্বামিপাদগণের বৈষ্ণব-গ্রন্থাদিই প্রধান । এগুলি যেরূপ পৌর্বাপর্যক্রমে লিখিত হইল, উহাই উহাদের আবির্ভাবের কাল-পরম্পরা অর্থাৎ উহাদের মধ্যে শ্রীগীতা সর্বপ্রাচীন এবং গৌড়ীয় বৈষ্ণবসাহিত্য সর্বাপেক্ষা আধুনিক । সুতরাং সর্বপ্রাচীন শ্রীগীতায় ভাগবত-ধর্মের যে স্বরূপ দৃষ্ট হয়, আধুনিক বৈষ্ণব-শাস্ত্রে ও বৈষ্ণব-আচারে তাহার অনেকটা পরিবর্তন ঘটিয়াছে । এই পরিবর্তন কি কারণে কিরূপে সংঘটিত হইল তাহাই এক্ষণে দ্রষ্টব্য ।

ভাগবত-পুরাণ গীতার পরবর্তী হইলেও সর্বমান্য এবং আধুনিক বৈষ্ণব-সম্প্রদায়ের বেদস্বরূপ । তবে কি গীতায় ও ভাগবতে কোনো পার্থক্য আছে ? উভয়ই ভাগবত-ধর্মের শ্রেষ্ঠ প্রামাণ্য গ্রন্থ, সুতরাং উভয়ে কোনো পার্থক্য থাকিতে পারে না । বস্তুত এই দুই গ্রন্থে কোনো পার্থক্য নাই । উভয়ের ধর্মতত্ত্ব একই, পার্থক্য যাহা কিছু শাস্ত্রব্যাখ্যায়, সাম্প্রদায়িক মতবাদে ।

সমগ্র গীতার অষ্টাদশ-অধ্যায়ে শ্রীভগবান প্রিয়ভক্ত অর্জুনকে যে-সকল তত্ত্ব উপদেশ দিয়াছেন, ভাগবতের ১১শ স্কন্ধের ভগবদ্‌-উদ্ধব-সংবাদে ভাগবত-ধর্ম বর্ণনায় (৭ম-২৯শ অধ্যায়) ভক্তরাজ উদ্ধবকেও ঠিক সেই সকল তত্ত্বই উপদেশ দিয়াছেন । সাংখ্যযোগ, আত্মতত্ত্ব, বেদবাদের নিন্দা, নিষ্কাম কর্ম, ভগবানে কর্ম-সমর্পণ, ধ্যানযোগ, প্রকৃতিপুরুষ -বিবেক ও ত্রিগুণ-তত্ত্ব, বিভূতি-বর্ণনা, চাতুর্বর্ণ্য-ধর্ম, স্বধর্ম-পালন ইত্যাদি গীতার সমস্ত কথাই ভাগবতে আছে এবং গীতার ন্যায় সকলই ভক্তিসংযুক্ত করিয়া দেওয়া হইয়াছে । ভাগবতের অন্যান্য স্থলে নবযোগীন্দ্রগণ, ভগবান কপিলদেব প্রমুখ কর্তৃক ভাগবত-ধর্মের বর্ণনাও গীতারই অনুরূপ এবং অনেক স্থানে শব্দশঃ একরূপ । বিস্তারিত ইভয় গ্রন্থে দ্রষ্টব্য, এ-স্থলে দৃষ্টান্তস্বরূপ দুই-চারিটি বিষয় ভাগবত হইতে উল্লেখ করিতেছি ।
নিষ্কামকর্ম-স্বধর্মপালন
'ইতি মাং যঃ স্বধর্মেণ ভজেন্নিত্যমনন্যভাক্‌ । সর্বভূতেষু মদ্ভাবো মদ্ভক্তিং বিন্দতে দৃঢ়াম্‌ ।' - [১১|১৮|৪৪]
'স্বধর্মস্থো যজন্‌ যজ্ঞৈরনাশীঃকাম উদ্ধভ'[১১|২০|১০]
'কুর্যাৎ সর্বাণি কর্মাণি মদর্থং শনকৈঃ স্মরন্‌' - [১১|২০|১০]

জ্ঞানমিশ্রা ভক্তি
'সর্বভূতেষু যঃ পশ্যেৎ ভগবদ্ভাবমাত্মনঃ' - [১১|২|৪৩]
'জ্ঞানী প্রিয়তমোহতো মে জ্ঞানেনাসৌ বিভর্তি মাম্‌ ।' - [১১|১৯|৩]
'তস্মাজ্‌জ্ঞানেন সহিতং জ্ঞাত্বা স্বাত্মানমুদ্ধব । জ্ঞানবিজ্ঞানসম্পন্নো ভজ মাং ভক্তিভাবিতঃ ।' - [১১|১৯|৫]


7.1) নৈষ্কর্ম্যসিদ্ধি, ভগবানে কর্মার্পণ


নিষ্কাম কর্ম, স্বধর্মপালন, সর্বভূতে ভগবদ্ভাব, ভগবানে আত্মসমর্পণ ইত্যাদি গীতোক্ত-ধর্মের যাহা সারকথা, ভাগবতেও সে সমস্তই আছে । কিন্তু এ-সকল ব্যতীত ভাগবতে আরো কিছু বেশী আছে, যাহা গীতায় নাই । সেটি হইতেছে ব্রজলীলা এবং তাহার মধ্যমণি রাসপঞ্চাধ্যায় । (i)শান্ত, (ii)দাস্য, (iii)সখ্য, (iv)বাৎসল্য, (v)মধুর - এই পাঁচটি মুখ্য স্থায়ী ভাবের মধ্যে শান্ত ও দাস্য ভাব মহাভারত, গীতা ও সমস্ত ভক্তিশাস্ত্রেরই অভিধেয়; কিন্তু সখ্য, বাৎসল্য ও মধুর ভাব ব্রজলীলা ব্যতীত আর কোথাও নাই । তন্মধ্যে মধুরভাব বা কান্তাপ্রেম 'সাধ্য শিরোমণি' - 'সেই মহাভাব-স্বরূপিণী রাধাঠাকুরাণী ।' শ্রীশ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু এই রাধাভাব অঙ্গীকার করিয়া জীবকে এই মহাভাবের আদর্শ প্রদর্শন করিয়াছেন - গম্ভীবা-লীলায় দ্বাদশবর্ষ দিবারাত্রি 'কৃষ্ণ' 'কৃষ্ণ' বলিয়া আর্তি-দৈন্য-হাসি-কান্নায় তপ্ত-ইক্ষুবসবৎ অন্তঃস্নিগ্ধ বহির্জ্বালাময় কৃষ্ণবিরহের সুখ-দুঃখে অতিবাহিত করিয়াছেন । বস্তুত শ্রীচৈতন্যলীলাতেই এই ভাবটি বিশেষরূপে জাগ্রত হইয়াছে, নচেৎ পুরাণের কাহিনী পুরাণেই থাকিত, জগতে কেহ উহা জানিত না, বুঝিত না ।
'রাধার মহিমা প্রেমরস সীমা জগতে জানাত কে ? - যদি গৌর না হত ।'
শ্রীচৈতন্যদেবের প্রসাদেই শিক্ষা ও শক্তি লাভ করিয়া গৌড়ীয় গোস্বামিপাদগণ এই ভাব অবলম্বন করিয়া অপূর্ব রসশাস্ত্রের সৃষ্টি করিয়াছেন । উহা বাঙালীর গৌরবের বস্তু - জগতের ধর্ম-সাহিত্যে এক অনুপম অপ্রাকৃত তত্ত্ব - মানবীয় ভাষায় ভগবৎপ্রেমের উজ্জ্বল চিত্র ।

শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু এইভাবে অনুপ্রাণিত হইয়া এবং এই ভাবের উৎকর্ষ স্থাপনার্থই গীতোক্ত ও ভাগবতোক্ত জ্ঞানমিশ্র-ভক্তিমার্গাদিকে 'বাহ্য' বলিয়াছেন [চৈঃচঃ, মধ্য ৮]গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মে এই ব্রজের ভাবেরই প্রাধান্য, এই হেতু গোস্বামিগ্রন্থে জ্ঞান-কর্ম-বিবর্জিত ভক্তিকেই উত্তমা ভক্তি বলা হইয়াছে । এই মতে বিশুদ্ধ ভক্তি জ্ঞান-কর্ম-বিবর্জিত, কারণ ব্রজের ভাবে জ্ঞান-কর্মের সমাবেশ হয় না ।

'কর্ম' শব্দে বুঝায় স্মৃত্যুক্ত নিত্যনৈমিত্তিক কর্ম, দেবদেবীর পূজার্চনাদি; আর জ্ঞান শব্দের অর্থ - কেহ বলেন অভেদ ব্রহ্মজ্ঞান, কেহ বলেন জীবেশ্বরের ভেদজ্ঞান, কেহ বলেন ভেদাভেদ-জ্ঞান । সে যাহাই হউক, ব্রজের ভাবে ঈশ্বরের কোনো জ্ঞানই নাই, পূজার্চনাদিও নাই - 'গোকুলে কেবলা রতি ঐশ্বর্যজ্ঞানহীন' [চৈঃচঃ] । কেননা, ঐশ্বর্য-জ্ঞান থাকিলে বাৎসল্যাদি-ভাবের বিকাশ হইতে পারে না - উহা 'বাৎসল্য সখ্য মধুরেরে করে সঙ্কোচন' ঐ । ব্রজের কৃষ্ণ মা-যশোদার স্নেহের পুতুল, গোপিকার হৃদয়বল্লভ, রাখালের খেলার সাথী - 'কান্ধে চড়ে কান্ধে চড়ায় করে ক্রীড়ারণ ।' তিনি কাহারও ঈশ্বর নন, সেভাবে তাঁহার পূজার্চনাও নাই । সুতরাং ব্রজের প্রেম 'জ্ঞান-কর্মাদি-অসংবৃত' । কিন্তু গীতার কৃষ্ণ সর্বলোক-মহেশ্বর, সর্বভূতাধিবাস, সর্বকর্মের নিয়ন্তা - সুতরাং সর্বভূতে ভগবদ্ভাবরূপ জ্ঞানই তাঁহার জ্ঞান এবং লোকসংগ্রহার্থ নিষ্কাম কর্ম তাঁহারই কর্ম, অনাসক্তভাবে স্বধর্ম পালন তাঁহারই অর্চনা - এই হেতু গীতোক্ত ভক্তি জ্ঞান-কর্মমিশ্র ।

পরম ভাগ্যবান উচ্চাধিকারী ভিন্ন ব্রজের ভাব সকলে গ্রহণ করিতে পারেন না, উহার কোনো সাধনও নাই । এই হেতু শ্রীচৈতন্য-ধর্মে দাস্যভাব, নাম-যজ্ঞ, জীবে দয়া - সর্বসাধারণের জন্য এই সকলের ব্যবস্থা, ইহাই বৈধী মার্গ । উহা জ্ঞানকর্মবর্জিত হইতে পারে না, উহাতে যে জ্ঞান-কর্মের নিষেধ তাহা গীতোক্ত জ্ঞানকর্ম নয়, তাহা ভক্তিহীন শুষ্কজ্ঞান ও কাম্য-কর্মাদি । উহা নিষেধের জন্যই শ্রীচৈতন্যাবতার ।


7.1.1) বৈদান্তিক জ্ঞানমার্গ ও বৈদিক কর্মমার্গের ভক্তিহীনতা

বৌদ্ধ-যুগের শেষে শ্রীমৎ শঙ্করাচার্য বৈদান্তিক জ্ঞানমার্গ এবং কুমারিল ভট্ট বৈদিক কর্মমার্গের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন । এই দুই মার্গই কালক্রমে একরূপ নিরীশ্বর হইয়া পড়িয়াছিল । জ্ঞান ও কর্মের সঙ্গে ভক্তির সম্পর্ক ছিল না । সেকালের জ্ঞানিগণের দুই-একটি দৃষ্টান্ত দেখুন । কথিত আছে, কোনো পণ্ডিতকে মৃত্যুকালে ঈশ্বরের নাম করিতে বলা হইয়াছিল, তখন তিনি 'পেলব, পরমাণু' 'পেলব, পরমাণু' বলিতে-বলিতে চক্ষু মুদিলেন । ইনি কণাদের পরমাণুবাদই সার ভাবিয়াছিলেন - এই মতে পরমাণুই জগতের মূল কারণ, সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বর কেহ নাই । আর একজন পণ্ডিত অদ্বৈতবাদ স্থাপনার্থ একটি গ্রন্থ লিখিতে আরম্ভ করিয়া সংস্কারবশত শিষ্টাচারের অনুবর্তী হইয়া গ্রন্থারম্ভে ঈশ্বরের নমস্ক্রিয়াসূচক কিছু লিখিতে উদ্যোগী হইলেন, অমনি তাঁহার সোহহংজ্ঞান উদিত হইল, কি ভ্রম ! আমিই তো তিনি - 'অব্ধি অপার স্বরূপ মম লহরী বিষ্ণু মহেশ' - প্রণাম করিব কাহাকে - 'কহাঁ করুঁ প্রণাম ?' - কাজেই তাঁহার আর প্রণাম করা হইল না ।


7.1.2) নবদ্বীপে ধর্মের অধঃপতন

সেকালে বিদ্যার কেন্দ্রস্থল নবদ্বীপে দেখা যাইত, পণ্ডিতগণ দুই দলে বিভক্ত হইয়া - তাল ঢুপ করিয়া পড়ে, না পড়িয়া ঢুপ করে - এই অপূর্ব তত্ত্ব নির্ণয়ার্থ ছল-তর্ক-বাদ-বিতণ্ডার ঢেউ উঠাইতেছেন । এই সকল ছিল সেকালের জ্ঞানচর্চা ও পাণ্ডিত্যের লক্ষণ ।

আর কর্মের তো অন্তই ছিল না । বেদের তেত্রিশ দেবতা তেত্রিশ কোটী হইয়াছিলেন - তার পর উপদেবতা, অপদেবতা, গ্রাম্যদেবতাও অনেক ছিলেন, এমন কি জ্বর, বসন্ত প্রভৃতিও দেবতার স্থানে অধিষ্ঠিত হইয়াছিল । তন্ত্র-মন্ত্রের অসদ্ব্যবহার, অভিচার, ব্যভিচারাদিরও অন্ত ছিল না । নিত্যনৈমিত্তিক কর্মে ধর্মধ্বজিতা যথেষ্ট বৃদ্ধি পাইয়াছিল, ধর্মপ্রাণতা ছিল না । প্রভুত্ব, প্রতিষ্ঠা, কামিনী-কাঞ্চনাদির কামনায় কলুষিত চিত্তে এই সকল 'ধর্মকর্ম' বা ধর্মবাণিজ্য সম্পন্ন হইত, উহাতে ভক্তির প্রসঙ্গ ছিল না ।


7.1.3) শ্রীচৈতন্যাবতারের আবির্ভাব ও যুগধর্মের প্রচার

এইরূপে যখন শোচনীয় ধর্মের গ্লানি, তখনই শ্রীচৈতন্য অবতার, ভক্তিহীন জ্ঞান-মার্গ ও কর্ম-মার্গের সম্পূর্ণ পরিহার এবং প্রেমভক্তি ও হরিনাম প্রচার । ইহার নাম যুগধর্ম । এই যুগধর্মে কোন অবস্থায় কি কারণে কিরূপ কর্ম ও কিরূপ জ্ঞানের বর্জন উপদিষ্ট হইয়াছিল, তাহা বুঝা প্রয়োজন, নচেৎ উহাদের সর্বথা পরিহারে সঙ্কির্ণতা ও অকর্মণ্যতা বৃদ্ধি পায় । এই ধর্মে অধিকারভেদে রাগানুগা ভক্তি ও বৈধী ভক্তি এবং নিবৃত্ত কর্ম ও সন্ন্যাসের ব্যবস্থা আছে । কিন্তু এক্ষণে রাগমার্গ ও বৈধীমার্গ, কর্ম ও সন্ন্যাস, বৈষ্ণব ও স্মার্ত আচারের সংমিশ্রণে এই ধর্মের বর্তমান স্বরূপ অনেকটা বিমিশ্র হইয়া পড়িয়াছে । গীতা ও ভাগবতের তত্ত্বালোকে এই অত্যুদার ধর্মমত ব্যাখ্যাত ও স্ব-স্বরূপে প্রতিষ্ঠিত হইলে বর্তমান সময়ে দেশের অশেষ কল্যাণের আকর হইতে পারে ।


8) গীতার শিক্ষা : সার্বভৌম ধর্মোপদেশ


গীতা কোনো সম্প্রদায়-বিশেষের ধর্মগ্রন্থ নহে, ইহা মানব-ধর্মগ্রন্থ । গীতায় সার্বভৌম ধর্মোপদেশ; জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে সকলেই উহা গ্রহণ করিতে পারেন । গীতার সেই সার্বজনীন স্থূল উপদেশগুলি কি এবং সেই উপদেশের অনুবর্তী হইয়া কি ভাবে স্বকীয় ধর্মজীবন ও কর্মজীবন নিয়মিত করিলে সকলেই ঐহিক ও পারলৌকিক কল্যাণ লাভ করিতে পারেন, তাহাই এক্ষণে বিবেচ্য । সংক্ষেপে বলিতে গেলে গীতোক্ত উপদেশের সারমর্ম এই -
১) ধর্মে উদারতা;
২) কর্মে নিষ্কামতা;
৩) জ্ঞানে ব্রহ্মসদ্ভাব - সর্বভূতে ভগবদ্ভাব;
৪) যোগে বা ধ্যানে ভগবানে চিত্ত-সংযোগ;
৫) ভক্তিতে ভগবৎ-শরণাগতি;
৬) নীতিতে আত্মৌপম্যদৃষ্টি - সাম্যবুদ্ধি;
৭) উপাসনা - ভগবৎকর্ম, জীবসেবা, স্বধর্মপালন;
৮) সাধনা - ত্যাগানুশীলন ।
ইহাই সমগ্র গীতার সারোদ্ধার, গীতা-ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বিভিন্ন স্থানে এগুলির আলোচনা করা হইয়াছে । গীতা-পাঠকালে পাঠক এই স্থূল তত্ত্বগুলির প্রতি লক্ষ্য রাখিবেন ।


8.1) ধর্মে উদারতা


ধর্ম এ স্থলে 'কোনো বিশেষ সাম্প্রদায়িক মত বা সাধন-প্রণালী' এই অর্থে ব্যবহৃত হইয়াছে । ধর্মমত লইয়া বাদ-বিতর্ক বিরোধ-বিদ্বেষ কেবল আমাদের দেশে নহে, সকল দেশেই আছে । আমাদের দেশে তবু এই বিরোধ কেবল বিদ্বেষ-বহ্নি উদ্গীরণ করিয়াই ক্ষান্ত আছে, অন্যান্য দেশে ধর্মের নামে অমানুষিক নির্যাতন ও ভীষণ হত্যাকাণ্ড-সকল সংঘটিত হইয়াছে । ইহার কারণ, অনেক ধর্মোপদেষ্টাই বলেন - একমাত্র এই ধর্মই সত্য ও মুক্তিদায়ক, অন্য ধর্ম মিথ্যা । বিধর্মীকে পাশবিক শক্তিবলে স্বীয় ধর্মে দীক্ষিত করাও পুণ্যকর্ম বলিয়া গণ্য হইয়া থাকেগীতায় শ্রীভগবান বলিতেছেন সম্পূর্ণ বিপরীত কথা - 'লোকে যে-পথই অবলম্বন করুক সকল পথেই আমাতেই পৌঁছিবে; যে আমাকে যে-ভাবে ভজনা করে আমি তাহাকে সেইভাবে সন্তুষ্ট করি' [গী|৪|১১] । কি উদার অভয়বাণী ! 'অদ্বৈত জ্ঞান বা দ্বৈত ভক্তি, যে-পথেই যাও, সগুণ-নির্গুণ যাহাই চিন্তা কর, আমাকেই পাইবে, কেননা মূলতত্ত্ব একমাত্র আমিই' [গী|৯|১৫, ১২|২-২০] । 'জ্ঞান, ধ্যান, কর্ম, উপাসনা সকল মার্গেই আত্মস্বরূপ আমাকে পাওয়া যায়' [গী|১৩|২৪-২৫] । নিরাকারবাদী, সাকারবাদী, বৈষ্ণব, শাক্ত, হিন্দু, অহিন্দু - গীতোক্ত ধর্মে সকলেরই স্থান আছে ।


8.2) কর্মে নিষ্কামতা


কর্মশিক্ষা, কর্ম-প্রেরণা, গীতার একটি বিশেষত্ব । গীতা এবং মহাভারতের অন্যান্য স্থলেও শ্রীকৃষ্ণ যেরূপ কর্মমাহাত্ম্য কীর্তন করিয়াছেন, সনাতন ধর্ম-সাহিত্যে অন্যত্র তাহা অধিক দৃষ্ট হয় না । বস্তুত প্রাচীন ভারত কর্মবলেই শ্রেষ্ঠ হইয়াছিল - শৌর্যবীর্য, জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য, সুখ-সমৃদ্ধি, শিক্ষা-সভ্যতায় জগতে শীর্ষস্থান অধিকার করিয়াছিল । কিন্তু বর্তমান ভারতবাসী, কর্মবিমুখ, অদৃষ্টবাদী, পুরুষকারহীন, বাক্যবাগীশ বলিয়া উপহাসাস্পদ - এরা কেবল 'ঘরেতে বসে গর্ব করে পূর্ব পুরুষের ।' পক্ষান্তরে দেখা যায়, যীশুখ্রীষ্ট সর্বত্রই সন্ন্যাসের উপদেশ দিয়াছেন -
"Do not acquire gold, or silver, or copper for your money belts, or a bag for your journey, or even two coats, or sandals, or a staff; for the worker is worthy of his support.…" [Matthew 10:9-10]
“Again I tell you, it is easier for a camel to go through the eye of a needle than for someone who is rich to enter the kingdom of God.” [Matthew 19:24]
"In the same way, those of you who do not give up everything you have cannot be my disciples." [Luke 14:33]
কিন্তু খ্রীষ্টীয় জগৎ এক্ষণে কর্মকেই সারসর্বস্ব করিয়াছেন । খ্রীষ্টীয়ান বাইবেল গুটাইয়া রাখিয়াছেন, আমরা গীতা ভুলিয়াছি । আমরা এক্ষণে পাশ্চাত্যের কর্ম-মাহাত্ম্য শিক্ষা করিতেছি, কর্ম-জীবনে তাঁহারাই আমাদের আদর্শস্থানীয় হইয়াছেন । কিন্তু সে-আদর্শ গীতোক্ত কর্মের আদর্শ নহে, উহা ভারতীয় শিক্ষা-সভ্যতার সম্পূর্ণ বিরোধী । পাশ্চাত্যের কর্ম-জীবনের মূলে অভিমান, আত্মপ্রতিষ্ঠা, বিশ্বময় আমিত্বের প্রসার; গীতার কর্মসূত্রের মূল নিরভিমানিতা, অহংত্যাগ, জগতে সচ্চিদানন্দ প্রতিষ্ঠাপাশ্চাত্য কর্মী রাজস কর্তা - অশান্ত, ফলাকাঙ্ক্ষী, সুখান্বেষী [গী|১৮|২৭]গীতোক্ত কর্মযোগী সাত্ত্বিক কর্তা - নিষ্কাম, সম, শান্ত [গী|২|৫৬; ১৮|২৬] । পাশ্চাত্যের কর্ম - ভোগ, বন্ধন; গীতোক্ত কর্ম - যোগ, মোক্ষ-সেতু ।

অনেকে গীতোক্ত-কর্মযোগের ব্যাখ্যা-প্রসঙ্গে পাঠকের মানসপটে পাশ্চাত্যের কর্ম-জীবনের উজ্জ্বল আদর্শ অঙ্কিত করিয়া দেন । উহাতে গণেশ গড়িতে বানর গড়া হয় - 'বিনায়কং প্রকুর্বাণো রচয়ামাস বানরম্‌ ।' পাশ্চাত্যের কর্মসূত্রের যে উচ্চতম আদর্শ, তাহাও গীতোক্ত আদর্শের নিম্নে । কথাটা আরো একটু স্পষ্টীকৃত করা প্রয়োজন হইতেছে । ইংরেজীতে একটি সুন্দর কথা আছে -
'I slept and dreamt that life was Beauty,
I woke and found that life was Duty'.
ইহার ভাবানুবাদ এইরূপ করা হইয়াছে -
'নিদ্রায় দেখিনু হায় ! মধুর স্বপন, -
কি সুন্দর সুখময় মানব-জীবন ।
জাগিয়া মেলিনু আঁখি, চমকিনু পুনঃ দেখি -
কঠোর কর্তব্য-ব্রত জীবন-যাপন ।' - [প্রভাতচিন্তা]
এ-স্থলে কবি বলিতেছেন, জীবনকে সুখময় মনে করা স্বপ্নদেখা মাত্র, জীবন কঠোর কর্তব্যময় । এটি অতি উচ্চ কথা, কিন্তু গীতার আদর্শ উচ্চতর । অবশ্য, কর্তব্যজ্ঞান ও কর্মনিষ্ঠা পাশ্চাত্যের নিকট আমরা এক্ষণে শিখিতে পারি, কেননা আমরা তমোগুণাক্রান্ত, জড়ভাবাপন্ন, কর্মবিমুখ হইয়া পড়িয়াছি । এক্ষণে প্রথমত সমাজে রজোগুণের উদ্রেকের প্রয়োজন এবং পাশ্চাত্য জাতিসমূহই উহার আদর্শস্বরূপ । এইভাবে অনুপ্রাণিত হইয়া অনেক আধুনিক কৃতবিদ্য ব্যক্তি গীতাকে কর্তব্যশাস্ত্র (Gospel of Duty) বলিয়া থাকেন । কিন্তু মনে রাখিতে হইবে, কর্তব্যপালন (Duty) ও কর্মযোগ ঠিক এক কথা নহে । কর্তব্যপালনে কর্তার অহংজ্ঞান থাকে, ফলের দিকে সাগ্রহ দৃষ্টি থাকে, অনেক সময় একটা কঠোরতার অনুভূতিও থাকে এবং সর্বদাই অন্যের প্রতি বাধ্যবাধকতার ভাব থাকে । কিন্তু গীতোক্ত কর্মযোগী এ-সকলের উপরে । তিনি অনহংবাদী, মুক্তসঙ্গ, সিদ্ধি ও অসিদ্ধিতে নির্বিকার [গী|১৮|২৬] । তিনি আত্মারাম, আত্মতৃপ্ত; তাঁহার নিজের কোনো কর্তব্য নাই [গী|৩|১৭], তিনি সমস্ত কর্তব্য ত্যাগ করিয়া ভগবানে আত্মসমর্পণ করিয়াছেন [গী|১৮|৬৬] । ভগবানের কার্য তাঁহার মধ্য দিয়া হইতেছে [গী|১১|৩৩] । কর্তা ঈশ্বর, তিনি যন্ত্রমাত্র; এই হেতুই তিনি অনাসক্ত-বুদ্ধিতে যথাপ্রাপ্ত কর্ম করিতে পারেন । কর্তব্যজ্ঞানের প্ররোচনা থাকিতে একেবারে নিষ্কাম হওয়া যায় না ।

কথা হইতেছে এই, গীতা লৌকিক কর্তব্যাকর্তব্য-নির্ণায়ক গ্রন্থ নহে, উহার কর্মোপদেশের সহিত অধ্যাত্মজ্ঞান ও ঐকান্তিক ভগবদ্ভক্তি মিশ্রিত । কিন্তু পাশ্চাত্যগণ কর্মতত্ত্বের বিচার করেন কেবল আধিভৌতিক দৃষ্টিতে; আত্মা, ঈশ্বর, বন্ধ, মোক্ষ, জ্ঞান-ভক্তির সহিত উহার কোনো সম্পর্ক নাই । পাশ্চাত্য জর্মন-পণ্ডিত নিৎসে কর্ম-মাহাত্ম্য বা শক্তি-সাধনা, যুদ্ধের কর্তব্যতা, আদর্শ মনুষ্যত্ব ইত্যাদি সম্বন্ধে অনেক তাত্ত্বিক বিচার করিয়াছেন এবং তৎপ্রসঙ্গে বলিয়াছেন যে, ঊনবিংশ শতাব্দীতে পরমেশ্বর গতাসু হইয়াছেন এবং ভবিষ্য আদর্শ মানব-সমাজে খ্রীষ্টের স্থান নাই । গীতাতেও আদ্যোপান্ত কর্মপ্রেরণা, যুদ্ধপ্রেরণা, কিন্তু গীতায় শ্রীভগবান এতৎপ্রসঙ্গে কি বলিতেছেন ? 'আমাকে স্মরণ কর আর যুদ্ধ কর' [গী|৮|৭], 'আমাতে চিত্ত রাখ, ফলাশা ত্যাগ কর, আমাতে কর্ম অর্পণ কর, আর যুদ্ধ কর' [গী|৩|৩০; ১৮|৫৭] । গীতায় আদ্যোপান্ত ঈশ্বরবাদ । পাশ্চাত্যের সর্বোচ্চ আদর্শ 'অধিক লোকের অধিক সুখ' । গীতার উপদেশ - সুখদুঃখের অতীত হও - নির্দ্বন্দ্ব, নিত্যসত্ত্বস্থ, নির্যোগক্ষেম এবং আত্মবান হও [গী|২|৪৫] । ইহা অধ্যাত্মতত্ত্বের শেষ কথা । বস্তুত নিষ্কাম কর্ম মানবীয় কর্ম নহে, ঐশ্বরিক কর্ম, উহাতে ঐশ্বরিক প্রকৃতি লাভ করিতে হয় [গী|১৪|২] । সামাজিক কর্তব্যজ্ঞানের সহিত উহার তুলনা হয় না ।

'That which the Gita teaches is not a human but a divine action; not the performance of social duties but the abandonment of all other standards of duty or conduct for a selfless performance of divine will working through our nature.

'...In other words, the Gita is not a book of practical ethics but of spiritual life.' [Sri Aurobindo | Essays on the Gita | The Core of the Teaching | p.31]


8.3) জ্ঞানে ব্রহ্মসদ্ভাব : সর্বভূতে ভগদ্ভাব, সমত্ববুদ্ধি


গীতার অনেক স্থলেই 'ব্রহ্মভাব', 'ব্রহ্মভূত', 'ব্রাহ্মীস্থিতি', 'সাম্যবুদ্ধি' ইত্যাদি কথা আছে । এই ভাব লাভ করিয়াই কর্ম করিতে হইবে এবং এই ভাব লাভ হইলেই ভগবানে পরাভক্তি জন্মে, এরূপ কথাও আছে [গী|২|৭২; ৪|৪১; ৫|১০,১৯; ১৪|২৬; ১৮|৫৩-৫৫] । 'ব্রহ্ম' বলিতে বুঝায় যাহা সর্ব-বৃহৎ, যাহা সর্বব্যাপী; যিনি সমস্ত ব্যাপিয়া আছেন, যাঁহাতে সমস্ত আছে, যাঁহার সত্তায় সমস্ত সত্তাবান, সেই অদ্বয় নিত্যবস্তুই ব্রহ্ম । ইহা পরমেশ্বরের নির্বিশেষ নির্গুণ বিভাব । এই ব্রহ্মসত্তার অনুভূতির নামই ব্রহ্মসদ্ভাব বা ব্রহ্মজ্ঞান । এই জ্ঞান লাভ হইলে সমস্ত ভেদবুদ্ধি বিদূরিত হয়, নানাত্বের মধ্যে একত্ব দর্শন হয় [গী|১৮|২০], জীব প্রকৃতির বন্ধন হইতে মুক্ত হয় [গী|১৩|৩০], ঈশ্বরের প্রকৃতি লাভ করে [গী|১৪|২], তখন আত্মাতে ও ভগবানে সর্বভূত এবং সর্বভূতে ভগবদ্দর্শন হয় [গী|৪|৩৫; ৬|২৬-৩০], তখন সাধক ভগবানের মধ্যেই বাস করেন [গী|৬|৩১] । তখনই ভগবানে পরাভক্তি জন্মে [গী|১৮|৫৪], সর্বভূতে প্রীতি জন্মে, সর্বত্র সমত্ববুদ্ধি জন্মে [গী|৫|১৮-১৯], নিষ্কাম কর্মে অধিকার জন্মে, তখন তাঁহার নিজের কর্ম থাকে না [গী|৩|১৭]; সর্বকর্ম ভস্মসাৎ হইয়া যায় [গী|৪|৩৭], বিশ্বময়ের বিশ্বকর্মের তাঁহার মধ্য দিয়া চলিতে থাকে । কিন্তু মায়াবাদী বেদান্তী ব্রহ্মজ্ঞানের যে ব্যাখ্যা করেন, গীতোক্ত ব্রহ্মভাব ঠিক তাহা নহে । মায়াবাদীর ব্রহ্মভাবে জীব, জগৎ, ঈশ্বর সকলই লোপ পায়; কেননা এ-সকল মায়ার বিজৃম্ভণ - এক অদ্বয়, নীরব, নিষ্ক্রিয়, নির্বিশেষ তত্ত্বই থাকে; সুতরাং উহাতে কর্ম ও ভক্তির কোনো প্রসঙ্গই নাই । কিন্তু গীতোক্ত ব্রহ্মভাব নির্গুণ-গুণী পুরুষোত্তম পরমেশ্বরেরই নির্গুণ বিভাব, উহা তাঁহাতেই প্রতিষ্ঠিত [গী|১৪|২৭], তিনি অক্ষর ব্রহ্ম হইতেও উত্তম [গী|১৫|২৮], তিনি কেবল নির্গুণ ব্রহ্ম নহেন, তিনি জগতের সৃষ্টিকর্তা, পিতা, মাতা, ধাতা, পিতামহ, প্রভু, সখা, শরণ ও সুহৃদ [গী|৯|১৭-১৮] । সুতরাং গীতোক্ত ব্রহ্মভাব জীবকে নিষ্ক্রিয় নীরবতার মধ্যে স্থাপিত করে না, উহাতে জীবকে নিষ্কাম ভগবৎকর্মের অধিকার দেয় এবং ভগবানে পরাভক্তি প্রদান করে । এই হেতু গীতা ও ভাগবতে জ্ঞানীকেই 'শ্রেষ্ঠভক্ত' ও 'ভাগবতোত্তম' বলা হইয়াছে [গী|৭|১৭-১৮; ভা|১১|২|৪৩]এই গীতোক্ত পুরুষোত্তম-তত্ত্বব্রহ্মতত্ত্ব না বুঝিলে গীতার বহু কথা পরস্পর-অসমঞ্জস ও অসঙ্গত বলিয়া বোধ হইবে ।


8.4) যোগে বা ধ্যানে ভগবানে চিত্তসংযোগ


'যোগ' শব্দ এ-স্থলে ধ্যানযোগ, আত্মসংস্থ-যোগ বা সমাধি-যোগ অর্থে ব্যবহৃত হইয়াছে । পাতঞ্জল-দর্শনে যম-নিয়মাদি অষ্টাঙ্গ যোগ বিবৃত হইয়াছে । চিত্ত স্থির করিবার জন্য সকল সাধনায়ই যোগসাধনের প্রয়োজন । গীতারও ষষ্ঠ-অধ্যায়ে যোগসাধনের উপদেশ আছে, কিন্তু উদ্দেশ্য ঠিক এক নহে । পাতঞ্জল-যোগের উদ্দেশ্য প্রকৃতপক্ষে যোগ নহে, বিয়োগ, - প্রকৃতি-পুরুষের বিয়োগ [ভোজবৃত্তি] । এই বিয়োগেই আত্যন্তিক দুঃখনিবৃত্তি - কৈবল্যলাভ । কিন্তু গীতোক্ত যোগের উদ্দেশ্য, বিয়োগের পর আবার যোগ অর্থাৎ প্রকৃতি হইতে মুক্ত হইয়া ভগবানে চিত্তসংযোগ । সুতরাং উহাতে কেবল আত্যন্তিক দুঃখনিবৃত্তি নয়, উহা আত্যন্তিক সুখেরও অবস্থা [গী|৬|২১-২৮] । এই সুখ ভগবানে স্থিতিলাভ-জনিত [গী|৬|১৫] । এইরূপ যোগী যে-অবস্থায়ই থাকুন-না-কেন - ধ্যানস্তিমিতনেত্রে তুষ্ণীম্ভাবে অবস্থানই করুন বা সংসারী সাজিয়া ভগবানের কর্মই করুন, তিনি সর্বদা ভগবানেই অবস্থান করেন [গী|৬|৩১,৪১] । এই হেতু যোগপদেশ প্রসঙ্গে গীতায় সর্বত্রই এই কথা - মনঃসংযম করিয়া চিত্ত আমাতে সমাহিত কর, মচ্চিত্ত হও, মদ্ভক্ত হও, আমার ভক্ত যোগীই যুক্ততম [গী|৬|১৪,৪৭] । গীতার কর্ম, জ্ঞান, যোগ সকল মার্গেই ঈশ্বরবাদ জড়িত, সর্বত্রই ভগবান - 'আদাবন্তে চ মধ্যে চ হরিঃ সর্বত্র গীয়তে'


8.5) ভক্তিতে ভগবৎ-শরণাগতি


কর্মে নিষ্কামতা, ব্রহ্মভাব, সমত্ববুদ্ধি, সমাধিযোগ - এ-সকল তত্ত্ব পূর্বে বিবৃত হইয়াছে । এ-সকলেরই মূলকথা হইতেছে প্রকৃতি বা মায়ার হস্ত হইতে মুক্ত হওয়া - মোক্ষলাভ বা ভগবানে স্থিতি লাভ করা । এই মায়া-ত্যাগের উপায় সম্বন্ধে শাস্ত্র ও ধর্মোপদেষ্টৃগণ দুই রকম কথা বলেন । কেহ বলেন - মায়া হইতেছে অজ্ঞান [গী|৫|১৫] । জ্ঞান ব্যতীত অজ্ঞান বা মায়া দূর হয় না, মোক্ষলাভও হয় না । মোক্ষ-বিষয়ে জীবের আত্মস্বাতন্ত্র্য আছে, সে সদ্গুরুর আশ্রয়ে আত্মপ্রযত্নে বা আত্মসংস্থযোগ বা আত্মানাত্মবিবেক-বিচার দ্বারা আত্মজ্ঞান লাভ করিতে পারে । ইহাই জ্ঞানমার্গ । গীতারও অনেক স্থলে এই মার্গের উল্লেখ আছে [গী|৬|৫-৬] । ইহা পুরুষকার-সাপেক্ষ । পুরুষকারের প্রতিমূর্তি, জ্ঞানগুরু ভগবান বশিষ্ঠদেব সর্বত্রই এই মার্গেরই উপদেশ দিয়াছেন এবং ভক্তিমার্গে ভগবৎকৃপার উপর নির্ভর করা অজ্ঞানতার ফল, এই কথা বলিয়াছেন । "রাম, যাবৎ বিমল জ্ঞানের উদয় না হয়, সেই পর্যন্তই লোকে মূর্খতাবশত ভক্তিদ্বারা মোক্ষলাভের বাঞ্ছা করিয়া থাকে ।" [যোঃবাঃ]

পক্ষান্তরে, ভক্তিমার্গ ও ভাগবত-ধর্মের উপদেষ্টা ভগবান ব্যাসদেব সর্বত্র ভক্তিরই প্রাধান্য দিয়াছেন এবং বলিয়াছেন যে, ভক্তিদ্বারাই ভগবৎকৃপায় জ্ঞান হয়, জ্ঞানেই মোক্ষ, সুতরাং ভক্তিই মোক্ষদায়িনী [অঃ রামাঃ যুদ্ধ|৭; অরণ্য|১০] । গীতায়ও শ্রীভগবান স্পষ্টই বলিয়াছেন - 'আমার মায়া সুদুস্তরা, যে আমাকে আশ্রয় করে সে-ই মায়া অতিক্রম করিতে পারে' [গী|৭|১৪] এবং প্রিয় ভক্তকে শেষে এইরূপ 'সর্বগুহ্যতম' উপদেশ দিয়াছেন - 'তুমি সর্বধর্ম পরিত্যাগ করিয়া একমাত্র আমার শরণ লও, আমি তোমাকে সর্বপাপ হইতে মুক্ত করিব' [গী|১৮|৬৬] । ইহাই ভগবৎ-শরণাগতি - 'আমি তোমারই, তুমি আমার একমাত্র গতি, প্রভো, রক্ষা কর' - এই ভাব অবলম্বন করিয়া একান্তভাবে আত্ম-সমর্পণ - ইহাই গীতার শেষ উপদেশ ।

ভক্তিমার্গের আর একটি উচ্চতর ভাব হইতেছে 'তুমি আমার' । যেমন ব্রজাঙ্গনা বলিতেছেন - 'হে কৃষ্ণ, তুমি জোর করিয়া হাত ছাড়াইয়া চলিয়া গেলে, ইহাতে তোমার পৌরুষ কি ? যদি আমার হৃদয় ছাড়াইয়া বলপূর্বক চলিয়া যাইতে পার, তবেই বুঝি তোমার পৌরুষ ।'

এ বড় জোরের কথা । ইহাই প্রেমভক্তি - ব্রজের ভাব । এখানে 'রক্ষা কর', 'মুক্ত কর' ইত্যাদির কোনো প্রসঙ্গই নাই, কেননা যিনি ভগবানকে হৃদয়ে বসাইয়াছেন, 'মুক্তি তার দাসী' । এখানে কেবল বিশুদ্ধ প্রেম - কেবল রসাস্বাদন । এই রসের পরিপক্কাবস্থায় 'আমিই তুমি' এই ভাব উপস্থিত হয় । তখন কেবল 'আমি কৃষ্ণ, আমি কৃষ্ণ' [বিঃপুঃ|৫|১৩; ভা|১০|৩০|১৪] । ইহাই ভক্তিশাস্ত্রের অধিরূঢ় ভাব, বেদান্তের সোহহং জ্ঞান, পরমাত্মার সহিত জীবাত্মার মিলন । এই স্থলে বেদান্ত ও ভাগবত এক হইয়া গেলেন । এই হেতুই বলা হইয়াছে, ভাগবত বেদান্তের ভাষ্যস্বরূপ [গারুড়ে; তত্ত্বসন্দর্ভ]

8.6) নীতিতে আত্মৌপম্যদৃষ্টি : সাম্যবুদ্ধি


'নীতি' শব্দে বুঝায় কর্তব্যাকর্তব্য-নির্ণায়ক সূত্র বা বিধি-নিয়ম । আমাদের শাস্ত্রগ্রন্থাদিতে 'ধর্ম' শব্দ এই অর্থেই সাধারণত ব্যবহৃত হয় এবং কর্তব্যাকর্তব্য-নির্ণায়ক শাস্ত্রকেই 'ধর্মশাস্ত্র' বলা হয় । ধর্মের দুই দিক - একটি বহির্মুখ বা ব্যাবহারিক ধর্ম, অপরটি অন্তর্মুখ বা মোক্ষধর্ম । পারিবারিক, সামাজিক বা জাগতিক সম্পর্কে অপরের সহিত যেরূপ কর্তব্য, তাহারই নাম লৌকিক বা ব্যাবহারিক ধর্ম; পাশ্চাত্যগণ ইহাকেই 'নীতি' (Morality) বলেন । আর পরমেশ্বরের জ্ঞান বা সাক্ষাৎকার লাভার্থ যে-সকল বিশিষ্ট সাধন-প্রণালী নির্দিষ্ট আছে তাহারই নাম মোক্ষধর্ম, পাশ্চাত্যগণ ইহাকে ধর্ম বা Religion বলেন । আমাদের নীতিশাস্ত্র বা ধর্মশাস্ত্রের বিধি-ব্যবস্থা সকলই মোক্ষানুকূল; এই হেতু প্রাচীন শাস্ত্রে 'নীতি' ও 'ধর্মে' বিশেষ কোনো পার্থক্য করা হয় নাই । কিন্তু পাশ্চাত্যগণের নীতি-তত্ত্বের ভিত্তি আধিভৌতিক, উহা আধ্যাত্মিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত নয় । এই হেতু তাঁহারা নীতি-তত্ত্বকে (Morality) মোক্ষতত্ত্ব বা ঈশ্বরতত্ত্ব (Religion) হইতে সম্পূর্ণ পৃথক করিয়া ফেলিয়াছেন ।

এক্ষণে দ্রষ্টব্য এই, আমাদের শাস্ত্র এবং গীতার নীতির মূলভিত্তি কি ? - উহা হইতেছে সর্বভূতাত্মৈক্য-জ্ঞান । পূর্বে বলা হইয়াছে - 'আমাতে ও সর্বভূতে একই আত্মা - সর্বত্রই ভগবান' এই জ্ঞানই প্রকৃত জ্ঞান, উহাতেই মোক্ষ, এই জ্ঞানলাভ হইলে সর্বত্র সমত্ব-বুদ্ধি জন্মে; তখনই জীব বুঝিতে পারে, আমার যাহাতে সুখ অপরেরও তাহাতে সুখ, আমার যাহাতে দুঃখ অপরেরও তাহাতে দুঃখ । ইহাই আত্মৌপম্য-দৃষ্টি । এইরূপ বিশুদ্ধ সাম্যবুদ্ধি লাভ করিলে তাহাকে আর পৃথক উপদেশ দিতে হয় না - 'পরের দ্রব্য চুরি করিও না', 'অপরকে হিংসা করিও না', 'প্রতিবেশীকেও আপনার মতো ভালবাসিবে' ইত্যাদি । কেননা, তখন আপন ও পর উভয়ের সমাবেশ ভগবানে, তাই গীতার উপদেশ - এই আত্মৌপম্য-দৃষ্টি অবলম্বন করিয়া সকলের সহিত ব্যবহার করিবে । কেবল গীতাতেই নয়, উপনিষদ, মহাভারত, মন্বাদি-শাস্ত্র সর্বত্র এই নীতিই পুনঃপুনঃ উল্লিখিত হইয়াছে -
'আপনার ক্ষেত্রে যাহা প্রতিকূল বা দুঃখজনক বলিয়া বোধ কর, অন্য লোকের সহিত সেরূপ ব্যবহার করিবে না; ইহাই সমস্ত ধর্মের সার, অন্য যাহা কিছু, কামনা-প্রসূত [মভাঃঅনু ১১৩|৮; ১১৩|১০|৬; উদ্যোঃ ৩৮|৭২; শাঃ ১৬৭|৯; বৃহঃউঃ ২|৪|১৪; ঈশ ৬; মনু ১২|৯১|১২৫]
পাশ্চাত্য নীতিশাস্ত্রে (Ethics) নীতি-তত্ত্ব বিষয়ে প্রধানত দুই মত । সদসদ্‌বিবেকবাদ (Conscience বা Intuition Theory); এই নীতি সর্বজনীন হইতে পারে না, কেননা সকলের বিবেক বা ধর্মবুদ্ধি একরূপ হয় না । অপর মত হইতেছে, হিতবাদ বা অধিকতম লোকের অধিকতম সুখ (Utility, the greatest good of the greatest number) । এই নীতির এক প্রধান দোষ এই যে, ইহাতে কর্তার বুদ্ধির কোনো বিচারই হয় না, কেবল কর্মের বাহ্যফল দেখিয়া নীতির বিচার করতে হয় । কিন্তু গীতা বলেন, কর্মের বাহ্যফল অপেক্ষা কর্তার বুদ্ধি শ্রেষ্ঠ এবং তাহাই নীতি-বিচারের কষ্টিপাথর । কান্ট, গ্রীন, ডয়সন প্রমুখ পাশ্চাত্য নীতি-তত্ত্ববিদগণও এ-বিষয়ে গীতার মতেরই অনুবর্তন করিয়াছেন । পাশ্চাত্য হিতবাদের আর একটি ত্রুটি এই যে, অধিক লোকের অধিক সুখের জন্য আমি চেষ্টা করিব, স্বার্থ অপেক্ষা পরার্থ শ্রেষ্ঠ কেন - হিতবাদী ইহার কোনো উত্তর দিতে পারেন না; সে-উত্তর দিয়াছেন আমাদের বেদান্ত ও গীতা; কারণ, 'তৎ ত্বম্‌ অসি' - তুমি তাহাই । সুতরাং সর্বভূতে একই বস্তু, এই জ্ঞানলাভ করিয়া আত্মৌপম্যদৃষ্টিতে সর্বভুতহিতে রত হও, ইহাই গীতার উপদেশ ।

8.7) উপাসনা : ভগবৎকর্ম, জীব-সেবা, স্বধর্ম-পালন


উপাসনাই ভক্তিমার্গের প্রাণ । গীতার উপদিষ্ট উপাসনা কি ? - ভগবৎকর্ম [গী|১১|৫৫; ১২|১০] । 'ভগবৎকর্ম' বলিতে বুঝায় ভগবানের কর্ম বা ভগবানের উদ্দেশ্যে কৃত কর্ম । সে কর্ম কি ? - ভগবৎস্বরূপ যিনি যে-ভাবে গ্রহণ করেন, ভগবৎকর্মও তাঁহার সেইরূপই হয় । সাকার উপাসক ষোড়শোপচারে প্রতিমা পূজা করেন; গ্রীষ্মে ব্যজন, শীতে পশমী বস্ত্রদ্বারা শ্রীমূর্তি আবরণ করেন; তিনি মনে করেন উহাই ভগবৎকর্ম; অবশ্য যিনি শীত-গ্রীষ্মের জন্মদাতা, যাঁহার শাসনে চন্দ্র-সূর্য, বায়ু-বরুণাদি অহর্নিশ স্ব-স্ব কার্যে ব্যাপৃত রহিয়াছে - তিনি যে শীত-গ্রীষ্মে কষ্ট পান, ইহা কল্পনামাত্র । তবে ভাবগ্রাহী জনার্দন ভাবের কাঙাল, দ্রব্যের নহেন, তাই তিনি ভক্তের ভক্তিভাবটুকুই গ্রহণ করিয়া প্রীত হন । কিন্তু এ-উপাসনায় একটি আশঙ্কা আছে । মূর্তিতে ভগবান আছেন, ইহা ঠিক, কিন্তু এই ধারণা অজ্ঞের নিকট হইয়া উঠে মূর্তিই বাস্তব ভগবান - 'অজ্ঞা যজন্তি বিশ্বেশং পাষাণাদিষু সর্বদা' [বৃহঃনাঃপুঃ] । ভগবান কেবল মূর্তিতে নন, ভগবান সর্বভূতে । সুতরাং সর্বভূতের ভজনাই ঈশ্বরের উপাসনা । জ্ঞানীর পক্ষে উহাই ভগবৎকর্ম [গী|৬|৩১] । এই হেতু ভাগবত-শাস্ত্রে মূর্তিপূজা অপেক্ষা জীবসেবার অধিক প্রশংসা । শ্রীভাগবত বলেন - যে সর্বভূতে অবস্থিত নারায়ণকে উপেক্ষা করিয়া প্রতিমাতে নারায়ণের অর্চনা করে, সে ভস্মে ঘৃতাহুতি দেয় । তবে কি প্রতিমা পূজার প্রয়োজন নাই ? না, ঠিক তাহাও নহে । যে-পর্যন্ত সর্বভূতে নারায়ণ-জ্ঞান না হয়, সে-পর্যন্ত উহার প্রয়োজন আছে, কিন্তু উহাই চরম উদ্দেশ্য নয়, উহা চরমে পৌঁছিবার উপায় মাত্র -
'যে ব্যক্তি স্বকর্মে নিরত সে যত দিন আপনার হৃদয়ে সর্বভূতস্থিত ঈশ্বরকে জানিতে না পারে তত দিন প্রতিমাদিতে ঈশ্বরকে অর্চনা করিবে' [ভা|৩|২৯|২০]
সুতরাং জীবসেবাই শ্রেষ্ঠ উপাসনা, নিষ্কামভাবে যথাপ্রাপ্ত স্বধর্মপালন, সর্বভূতেরই ভজনা, কেননা উহার প্রেরণা লোকসংগ্রহ [গী|৩|২৫], স্বার্থাভিসন্ধি নহে । ইহা প্রকৃতপক্ষে ভগবানের কর্ম, নিজের কর্ম মনেকরাটাই অজ্ঞান । কেননা যদি সকলেই স্বকর্ম বা স্বধর্মপালনে বিরত হয়, তাহা হইলে বিশ্বলীলা লোপ পায় । বস্তুত প্রত্যেক জীবেরই স্বকর্ম বিশ্বময়ের বিশ্বকর্ম এবং উহাই তাঁহার উপাসনা, উহাতেই সিদ্ধি [গী|১৮|৪৬], কিন্তু এই জ্ঞান চাই যে উহা ভগবানের কর্ম, আমার কর্ম নহে ।

8.8) সাধনা : ত্যাগানুশীলন


উপাসনা ভক্তিমার্গের সাধনা, শ্রবণ-মননাদি জ্ঞানমার্গের সাধনা, প্রাণায়ামাদি যোগমার্গের সাধনা; ত্যাগ সকল মার্গেরই সাধনা । ত্যাগ ব্যতীত জ্ঞান, ভক্তি, যোগ, কর্ম - কোনো পথেই সিদ্ধিলাভ হয় না । কেননা ত্যাগ সকল সাধনার মূল । এই হেতু গীতায় সর্বত্রই ত্যাগানুশীলনের উপদেশ; কিন্তু গীতায় ত্যাগ অর্থ কর্মত্যাগ বা সন্ন্যাসমার্গ নহে, গীতোক্ত ত্যাগ কামনা-ত্যাগ, কর্মফল-ত্যাগ [গী|১৮|১১] । দ্বিতীয় অধ্যায়ে স্থিতপ্রজ্ঞের লক্ষণ-বর্ণনায় আদ্যোপান্ত কামনাত্যাগের কথা [গী|২|৫৫-৭১] । কর্মযোগে ফলত্যাগই মুখ্য কথা, সুতরাং কর্মযোগ-প্রসঙ্গে সর্বত্রই সেই উপদেশ । দ্বাদশ অধ্যায়ে ভক্তিযোগের বর্ণনা-প্রসঙ্গেও পূজার্চনা-ধ্যানাদি অপেক্ষা কর্মফল-ত্যাগেরই শ্রেষ্ঠতা প্রতিপন্ন করা হইয়াছে [গী|১২|১১-১২] এবং উহার পরেই ভগবদ্ভক্তের যে-সকল লক্ষণ বর্ণিত হইয়াছে, ত্যাগই তাহার মূল কথা; ইহাকেই 'ধর্মামৃত' বলা হইয়াছে [গী|১২|১৩-২০] । আবার ত্রয়োদশ অধ্যায়ে জ্ঞানের সাধনা বা জ্ঞানীর যে-লক্ষণ বর্ণিত হইয়াছে, তাহারও মূল কথা ত্যাগ [গী|১৩|৭-১১] । বস্তুত কর্ম, জ্ঞান, ভক্তি, যোগ সকল মার্গেই ত্যাগের শ্রেষ্ঠতা এবং গীতোক্ত পূর্ণাঙ্গ যোগধর্মে এ-সকলেরই সমন্বয়; সুতরাং গীতার সাধনতত্ত্বের মূলসূত্র ত্যাগ । গীতার প্রকৃত মর্ম কি ? এ-কথার উত্তরে পরমহংসদেব বলিয়াছেন - 'গীতা' শব্দটি তিন চারিবার উচ্চারণ করিলেই উহা পাওয়া যায় অর্থাৎ 'গীতা' 'গীতা' বারবার বলিতে-বলিতে বর্ণ-বিপর্যয়ে উহার বিপরীত 'তাগী বা ত্যাগী' শব্দ উচ্চারিত হয় । উহাই গীতার সার-মর্ম । কেমন সুন্দর সরল ভাষায় সারগর্ভ মর্মস্পর্শী উপদেশ !


9) গীতার টীকা-ভাষ্য



9.1) সাম্প্রদায়িক টীকা-ভাষ্য


সনাতন ধর্ম-সাহিত্যে শ্রীগীতা যে সর্বমান্য গ্রন্থ, তাহার আর একটি প্রমাণ - ইহার অসংখ্য টীকা-ভাষ্য । বিগত সহস্র বৎসর যাবৎ এ-দেশে যত বিভিন্ন ধর্ম-সম্প্রদায়ের উদ্ভব হইয়াছে, তাঁহারা সকলেই নিজ-নিজ সাম্প্রদায়িক মতের পরিপোষণার্থ শ্রীগীতার টীকা-ভাষ্য প্রণয়ন করা আবশ্যক বোধ করিয়াছেন, কেননা (i)শ্রীগীতা, (ii)উপনিষৎ ও (iii)বেদান্ত দর্শনের অনুকূল না হইলে কোনো ধর্ম এ-দেশে প্রতিষ্ঠা লাভ করিতে পারে না । এই তিন শাস্ত্র সনাতনধর্মের স্তম্ভ বা ভিত্তিস্বরূপ, এই হেতু উহাদিগকে প্রস্থানত্রয়ী বলে । অতি-আধুনিক কালেও শ্রীগীতার নব নব টীকা-ভাষ্য বাহির হইতেছে । মহাত্মা গান্ধীর অহিংসাবাদের সহিত সকলে পরিচিত আছেন । তাঁহার মতে যুদ্ধাদি-হিংসাত্মক কর্ম কোনো অবস্থাতেই কর্তব্য নহে । গীতোক্ত ধর্মের সহিত এই গান্ধীবাদ বা অহিংসানীতির (Pacifism) আপাত-বিরোধ দৃষ্ট হয়, কেননা শ্রীগীতায় তত্ত্বকথার মধ্যে-মধ্যে যুদ্ধ-প্রেরণাও আছে । এই বিরোধ খণ্ডনের জন্যই সম্প্রতি শ্রীগীতার গান্ধী-ভাষ্য প্রকাশিত হয়েছে, কারণ শ্রীগীতার বিরুদ্ধ মত এ-দেশে সমাদৃত হইবার সম্ভাবনা কম

জীব, জগৎ, ব্রহ্ম - এই তিনের পরস্পর সম্বন্ধ কি, এ-বিষয়ে নানারূপ বিভিন্ন দার্শনিক মত প্রচলিত আছে । যথা - অদ্বৈতবাদ, মায়াবাদবিবর্তবাদ, পরিণামবাদ, বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ, দ্বৈতবাদ, দ্বৈতাদ্বৈতবাদ ইত্যাদি । আবার সাধন-প্রণালী সম্বন্ধেও জ্ঞানযোগ, ভক্তিযোগ, কর্মযোগ, রাজযোগ ইত্যাদি বিভিন্ন মত প্রচলিত আছে এবং তদনুযায়ী বিভিন্ন সম্প্রদায়ের উদ্ভব হইয়াছে । শ্রীগীতা সর্বমান্য, সুতরাং প্রত্যেক সম্প্রদায়ই টীকা-ভাষ্য রচনা করিয়া ইহা প্রমাণ করিতে আগ্রহশীল যে, শ্রীগীতায় সেই সম্প্রদায়ের স্বীকৃত মতই প্রতিপাদিত হইয়াছে । ইহা করিতে হইলে অনেক স্থলে শব্দার্থ ও ব্যাকরণের অনেক প্রকার 'টানাবুনা' ও মারপ্যাঁচ করিতে হয় । সেকালের সাম্প্রদায়িক ধর্মাচার্যগণ ইহা দোষাবহ মনে করেন নাই । এ-প্রসঙ্গে স্বামী বিবেকানন্দ বলিয়াছেন -
'আমরা দেখিতে পাই অদ্বৈতবাদী যে-শ্লোকগুলিতে বিশেষভাবে অদ্বৈতবাদের শিক্ষা দেওয়া হইয়াছে সেগুলি যথাযথ রাখিয়া দিতেছেন, কিন্তু যে-শ্লোকগুলিতে দ্বৈতবাদ বা বিশিষ্টাদ্বৈতবাদের উপদেশ সেইগুলি টানিয়া অদ্বৈত অর্থ করিতেছেন । আবার দ্বৈতবাদী আচার্যগণ দ্বৈত শ্লোকগুলির যথাযথ অর্থ করিয়া অদ্বৈত শ্লোকগুলিও টানিয়া দ্বৈত অর্থ করিতেছেন । শঙ্করাচার্যের ন্যায় বড় বড় ভাষ্যকারেরা পর্যন্ত নিজ নিজ মত-পোষকতার জন্য স্থলে-স্থলে শাস্ত্রের এরূপ অর্থ করিয়াছেন যাহা আমার সমীচীন বলিয়া বোধ হয় না । অবশ্য ইঁহারা মহাপুরুষ, আমাদের গুরুপদবাচ্য । তবে ইহাও কথিত হইয়াছে যে, 'দোষা বাচ্যা গুরোরপি' - গুরুরও দোষ বলা উচিত ।'

'আমাদের পণ্ডিতদিগের মধ্যে এই ধারণা দেখিতে পাওয়া যায় যে, বিভিন্ন সম্প্রদায়গুলির মধ্যে একটি মাত্র সত্য হইতে পারে, আর সমস্তই মিথ্যা । আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছি যে, উহারা পরস্পর পরস্পরের বিরোধী নহে । আমাদের শাস্ত্রের বিকৃত ব্যাখ্যা করিবার প্রয়োজন নাই । অধিকারভেদের অপূর্ব রহস্য বুঝিলে উহা তোমাদের নিকট অতি সহজ বলিয়া প্রতীয়মান হইবে ।' - [স্বামী বিবেকানন্দ, বেদান্ত, পৃঃ ৩০০]

'এই বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক কলহ-দ্বন্দ্বের ভিতর এমন একজনের অভ্যুদয় হইল যিনি ভারতের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে যে সামঞ্জস্য রহিয়াছে, সেই সামঞ্জস্য কার্যে পরিণত করিয়া নিজ জীবনে দেখাইয়াছিলেন । আমি রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবকে লক্ষ্য করিয়া এ কথা বলিতেছি ।' - [স্বামী বিবেকানন্দ, সর্বাবয়ব বেদান্ত, পৃঃ ২৪৫]

শ্রীগীতার এই সকল সাম্প্রদায়িক বিকৃত ব্যাখ্যায় ব্যথিত হইয়া প্রসিদ্ধ মহারাষ্ট্র-টীকাকার বামন পণ্ডিত এইরূপ লিখিয়াছেন -

'হে ভগবান, এই কলিযুগে যে-যে গীতার্থ যোজিত হইয়াছে তাহা নিজ-নিজ মতানুরূপ । কোনো কারণে কোনো লোক গীতার্থের অন্যথা ব্যাখ্যা করিয়াছেন, ঐ বড় লোকদের কাজ আমার ভাল লাগে না, কি করিব ভগবান ।'


9.1.1) অদ্বৈতবাদ-মায়াবাদ : শাঙ্কর-ভাষ্য (৭৮৮-৮২০ খ্রী)

শ্রীগীতার যে সকল প্রাচীন টীকা-ভাষ্য এক্ষণে পাওয়া যায়, সে-সকলের মধ্যে শাঙ্কর-ভাষ্যই প্রাচীনতম । শঙ্করের পূর্বেও অবশ্য গীতার অনেক-ভাষ্য রচিত হইয়াছিল, একথা শাঙ্কর-ভাষ্য হইতে জানা যায় । শ্রীমৎ শঙ্করাচার্যের আবির্ভাব-কাল নিশ্চিতরূপে নির্ধারিত করা যায় না, সম্ভবত তিনি খ্রীষ্টীয় অষ্টম শতকের শেষ পাদ ও নবম শতকের প্রথম পাদে বিদ্যমান ছিলেন । এই সময়ে এই অদ্বিতীয় তত্ত্বজ্ঞানী মহাপুরুষের আবির্ভাব না হইলে হিন্দুর বেদোপনিষদের কি হইত বলা দুষ্কর । বৌদ্ধধর্মের প্রভাবে সনাতন ধর্মের অতি শোচনীয় অবস্থা ঘটিয়াছিল । তিনিই উহার গৌরব পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন । তিনি সমস্ত প্রাচীন উপনিষৎ, বেদান্ত দর্শন ও শ্রীগীতার টীকা-ভাষ্য প্রণয়ন করেন, আসমুদ্রহিমাচল ভারতবর্ষ পরিভ্রমণ করিয়া ধর্মপ্রচার করেন এবং ভারতের চতুঃসীমায় চারিটি মঠ স্থাপন করিয়া সনাতন ধর্মের ভিত্তি সুদৃঢ় করেন । প্রত্যেক ধর্ম-সম্প্রদায়েরই উদ্দিষ্ট বিষয় দুইটি - তত্ত্ব-নির্দেশ আর সাধন-নির্দেশ । শ্রীমৎ শঙ্করাচার্য তাত্ত্বিক-দৃষ্টিতে নির্গুণ ব্রহ্মবাদ, অদ্বৈতবাদ ও মায়াবাদ এবং সাধন-পথে সন্ন্যাস ও জ্ঞানমার্গ গ্রহণ করিয়াছিলেন । এই মতের পরিপোষণার্থই তাঁহার সমস্ত টীকা-ভাষ্য রচিত হইয়াছে । এই মতানুসারে জ্ঞান ও কর্মের সমুচ্চয় হয় না এবং ভক্তিরও ইহাতে বিশেষ উপযোগিতা নাই । কিন্তু শ্রীগীতায় জ্ঞান, কর্ম ও ভক্তি সমভাবেই উপদিষ্ট হইয়াছে, কাজেই কর্ম ও ভক্তির গৌণত্ব এবং সন্ন্যাস ও জ্ঞানের প্রাধান্য স্থাপনার্থ তাঁহাকে অনেক বিচার-বিতর্কের অবতারণা করিতে হইয়াছে । এই সকল গভীর পাণ্ডিত্যপূর্ণ আলোচনায় তাঁহার যে অপূর্ব মনীষার পরিচয় পাওয়া যায়, তাহাতে বিস্ময় জন্মে, কিন্তু সকল স্থলে সংশয়ের নিরসন হয় না । আবশ্যক-বোধে এই পুস্তকে কোনো কোনো স্থলে এই সকল আলোচনার সারমর্ম সংক্ষেপে উল্লেখ করা হইয়াছে ।

গীতা-বেদান্তাদি শাস্ত্রের আলোচনায় এক কালে শাঙ্কর-ভাষ্যের অপ্রতিহত প্রভাব ছিল । পরবর্তী কালে আনন্দগিরি (১৩শ শতক, টীকা), শ্রীমৎ মধুসূদন সরস্বতী ('গূঢ়ার্থদীপিকা', ১৬শ শতক) প্রভৃতি অনেক শ্রেষ্ঠ বৈদান্তিক এই মত অবলম্বন করিয়াই গীতা ব্যাখ্যা করিয়াছেন । আধুনিক কালে শ্রীমৎ কৃষ্ণানন্দ স্বামী প্রভৃতি অনেকেই এই মতানুসরণেই গীতার তাৎপর্য ব্যাখ্যা করিয়াছেন । স্বনামখ্যাত অধ্যাপক ম্যাক্সমূলর (Maxmullar) কর্তৃক প্রকাশিত 'প্রাচ্য ধর্মগ্রন্থমালা'য় (The Sacred Books Of The East) যে ভগবদ্গীতার অনুবাদ আছে, তাহাতেও প্রধানত শাঙ্কর-ভাষ্যেরই অনুসরণ করা হইয়াছে ।


9.1.2) বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ : শ্রীরামানুজাচার্য (১১শ শতক)

কিন্তু অতি প্রাচীন কালেই শাঙ্কর-মায়াবাদের প্রতিবাদও প্রচারিত হইয়াছিল । কথিত আছে, দ্রাবিড়-ভূমিতে নাথমুনি বা শ্রীরঙ্গনাথাচার্য শাঙ্কর-অদ্বৈতবাদের প্রতিবাদ করিয়া স্বীয় মত প্রচার করেন এবং শ্রী-বৈষ্ণব-সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠা করেন । তাঁহার পৌত্র শ্রীযামুনাচার্য এই মতাবলম্বনেই গীতার ভাষ্য প্রণয়ন করেন ('গীতার্থসংগ্রহঃ', ১১শ শতক) । তাঁহার পরবর্তী শ্রীরামানুজাচার্যই শ্রী-বৈষ্ণব-সম্প্রদায়ের সর্বশ্রেষ্ঠ নেতা । এই সম্প্রদায়ের দার্শনিক মত বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ ও সাধনপথ বাসুদেব-ভক্তি । এই মতের পরিপোষণার্থই তিনি ব্রহ্মসূত্র, গীতার ভাষ্য এবং 'বেদার্থসংগ্রহঃ' প্রভৃতি গ্রন্থ প্রণয়ন করেন ।


9.1.3) দ্বৈতাদ্বৈতবাদ : শ্রীনিম্বার্কাচার্য (১১০০-১১৬২ খ্রী)

দ্বাদশ শতকে নিম্বার্ক সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয় । শ্রীনিম্বার্ক অন্ধ্রদেশীয় ব্রাহ্মণ, তিনি তাত্ত্বিক দৃষ্টিতে ভেদাভেদবাদ এবং সাধনমার্গে রাধাকৃষ্ণ-ভক্তি প্রচার করেন । এই মতের পরিপোষণার্থ শ্রীনিম্বার্কাচার্য বেদান্ত সম্বন্ধে একখানি ভাষ্য রচনা করেন এবং এই সম্প্রদায়ের কেশব কাশ্মীরী ভট্টাচার্য গীতার টীকা প্রণয়ন করেন ('তত্ত্বপ্রকাশিকা') । শ্রীনিম্বার্ক স্বয়ং বৃন্দাবনবাসী হন এবং তাঁহার মত উত্তরভারতে, মথুরা অঞ্চলে এবং বাংলাদেশে অনেকটা প্রতিষ্ঠা লাভ করে ।


9.1.4) দ্বৈতবাদ : শ্রীমধ্বাচার্য (১১৯৯-১২৭৬ খ্রী)

ত্রয়োদশ শতাব্দীতে দাক্ষিণাত্যে কর্ণাটকভূমিতে মাধ্ব-সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয় । শ্রীমধ্বাচার্য (আনন্দতীর্থ) এই সম্প্রদায়ের প্রবর্তক । তিনি শুদ্ধ দ্বৈতবাদী, তাহার মতে ভক্তিই চরম নিষ্ঠা । তিনি শাঙ্কর-মতের ঘোর বিরোধী ছিলেন । তিনি প্রস্থানত্রয়ীর (উপনিষদ, বেদান্ত ও গীতা) ভাষ্য প্রণয়ন করিয়া প্রমাণ করিতে চেষ্টা করিয়াছেন যে, এই সকল গ্রন্থ দ্বৈতবাদের প্রতিপাদক । 'গীতাভাষ্য' ও 'গীতা-তাৎপর্য' নামক গ্রন্থে তিনি গীতার ব্যাখ্যা করিয়াছেন ।


9.1.5) অদ্বৈতবাদী ভক্তিমার্গ : শ্রীজ্ঞানেশ্বর (১২৭৫-৯৬ খ্রী)

মহারাষ্ট্রে ভক্ত-কবি জ্ঞানদেব বা জ্ঞানেশ্বর  ষোড়শ বর্ষ বয়সে 'জ্ঞানেশ্বরী' নামক নয়-হাজার শ্লোক-সম্বলিত গীতার পদ্য-ব্যাখ্যা মারাঠীভাষায় প্রণয়ন করেন; ইহা মারাঠীদের নিত্যপাঠ্য আরাধ্য গ্রন্থ । ইহাতে বিশেষভাবে ভক্তিমার্গেরই প্রাধান্য দেওয়া হইয়াছে, যদিও অদ্বৈতবাদও স্বীকৃত হইয়াছে ।

স্বনামখ্যাত টীকাকার শ্রীধর স্বামীও ('সুবোধিনী', ১৪শ শতক) এই মতাবলম্বী । তিনি তত্ত্বদৃষ্টিতে অদ্বৈতবাদ স্বীকার করিয়াও সাধনপথে ভক্তিরই প্রাধান্য দিয়াছেন । তাঁহার মতে একান্ত ভক্তিযোগে শ্রীভগবানের শরণ লইলেই তাঁহার প্রসাদে আত্মবোধ জনে এবং মোক্ষলাভ হয়, ইহাই গীতার তাৎপর্য । শ্রীগীতায় ৮|২২; ১০|১০; ১৮|৫৪-৫৫ প্রভৃতি শ্লোকের অর্থ বিচার করিয়া তিনি সিদ্ধান্ত করিয়াছেন যে, ভক্তিই মোক্ষহেতু ।


9.1.6) পুষ্টিমার্গ : শ্রীবল্লভাচার্য

ষোড়শ শতকের প্রথম ভাগে অন্ধ্রদেশে শ্রীবল্লভাচার্য রাধাকৃষ্ণ-ভক্তিপর বৈষ্ণব-সম্প্রদায়ের প্রবর্তন করেন । এই সম্প্রদায়ের মত এই যে, মায়াবদ্ধ জীবের মোক্ষলাভ ঈশ্বরানুগ্রহ ব্যতীত হইতে পারে না এবং ঈশ্বরের এই অনুগ্রহকে পুষ্টি বা পোষণ বলা হয়; এই হেতু এই সাম্প্রদায়িক মতকে পুষ্টিমার্গ বলে । এই সম্প্রদায়ের 'তত্ত্বদীপিকাদি' ভাষ্যগ্রন্থে শ্রীগীতার ১৮|৬৫-৬৬ প্রভৃতি শ্লোকের উল্লেখ করিয়া ইহাই প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করা হইয়াছে যে, শ্রীগীতায় জ্ঞান ও কর্মের উল্লেখ থাকিলেও শেষাংশে পুষ্টিমার্গীয় ভক্তিরই প্রাধান্য দেওয়া হইয়াছে এবং ইহাই গীতার মুখ্য প্রতিপাদ্য বিষয় ।


9.1.7) অচিন্ত্য-ভেদাভেদ : শ্রীচৈতন্যদেব (১৪৮৬-১৫৩৪ খ্রী)

শ্রীচৈতন্যদেব-প্রবর্তিত গৌড়ীয় বৈষ্ণব-সম্প্রদায়ের প্রভাবে বৈষ্ণবধর্ম ও বৈষ্ণব-সাহিত্য এক নূতন যুগের উদ্ভব হয় । জীব-ব্রহ্মের সম্বন্ধ বিষয়ে এই সম্প্রদায়ের যে দার্শনিক মত, তাহাকে বলা হয় অচিন্ত্য-ভেদাভেদ । এই সম্প্রদায়ের সাধনমার্গ সুপরিচিত, এ-বিষয়ে বিস্তারিত অন্যত্র উল্লেখ করা হইয়াছে । শ্রীমৎ বলদেব বিদ্যাভূষণ (১৮শ শতক, 'গীতাভূষণ-ভাষ্য') এই সম্প্রদায়ের মতানুযায়ী গীতা-ব্যাখ্যা করিয়াছেন । বলা বাহুল্য, এই সম্প্রদায়ও শঙ্করমতের বিরোধী ।


9.1.8) গান্ধী-ভাষ্য : গান্ধীবাদ বনাম গীতার অহিংস-যুদ্ধবাদ (Gandhi's "Nonviolence" vs Gita's Violent deeds with Nonviolent mind)

কয়েক বৎসর হইল মহাত্মা গান্ধী 'অনাসক্তি যোগ' নাম দিয়া গুজরাতি-ভাষায় ভাষ্য ও অনুবাদ সহ শ্রীগীতার একখানি সংস্করণ প্রকাশ করেন; শ্রদ্ধেয় সতীশচন্দ্র দাশগুপ্ত উহার বাংলা অনুবাদ স্বলিখিত উপক্রমণিকা-সহ 'গান্ধী-ভাষ্য' নামে প্রকাশিত করিয়াছেন । গান্ধীজীর মতে শ্রীগীতায় যে-যুদ্ধের প্রেরণা আছে উহা ভৌতিক যুদ্ধ নহে, নৈতিক যুদ্ধ, উহা রূপকের ভাষা । তিনি লিখিয়াছেন - 'ইহা ঐতিহাসিক গ্রন্থ নহে, পরন্তু রূপকের ভিতর দিয়া প্রত্যেক মানুষের হৃদয়ের ভিতর যে দ্বন্দ্ব-যুদ্ধ নিরন্তর চলিতেছে, ইহাতে তাহাই বর্ণিত হইয়াছে ।' দাশগুপ্ত মহাশয় এই রূপকটি এই ভাবে বিশদ করিয়াছেন - 'দেহ রথ, রথী অর্জুন, শ্রীকৃষ্ণ সারথি, ইন্দ্রিয়গণ অশ্ব ও লাগাম মন । রথ যে-যুদ্ধক্ষেত্রে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে তাহাই কুরুক্ষেত্ররূপ হৃদয়ক্ষেত্র । দৈবী ও আসুরী, হৃদয়স্থ এই দুই বৃত্তি দুই পক্ষ । এই যুদ্ধ নিয়তই মানুষের হৃদয়ক্ষেত্রে চলিতেছে । সেই যুদ্ধে যাহাতে দৈবী পক্ষই জয়ী হয়, তজ্জন্য ভগবান সারথি-বেশে অনুভবসিদ্ধ জ্ঞান অজ্ঞ দেহী অর্জুনকে দিয়াছেন ।'

অন্তর্যুদ্ধের এইরূপ রূপক-বর্ণনা মহাভারত, কঠোপনিষৎ এবং অন্যান্য শাস্ত্রগ্রন্থেও আছে । শ্রীগীতাতেও এই তত্ত্বটির উল্লেখ আছে এবং তথায়ও যুদ্ধের ভাষাই ব্যবহৃত হইয়াছে । তথায় শ্রীভগবান বলিতেছেন - 'কামনা-বাসনাই জীবের প্রবল শত্রু; উহাই সর্ববিধ পাপের মূল, তুমি এই কামরূপ দুর্জয় শত্রুকে সংহার কর ' । কিরূপে সংহার করিতে হইবে তাহাও বলিয়াছেন [৩|৩৬-৪৩] ।

সাধারণভাবে কেহ যদি বলেন যে, ইহাই গীতার সারকথা, মূল তাৎপর্য, তাহা অসঙ্গত হয় না । কিন্তু গীতার আদ্যন্ত নানা তত্ত্বালোচনার মধ্যে-মধ্যে 'যুদ্ধ কর', 'যুদ্ধ কর' এইরূপ প্রেরণা আছে । সে-সকলের দ্বারা যে এই অন্তর্যুদ্ধের প্রতিই লক্ষ্য করা হইয়াছে, ইহা বড়ই কষ্টকল্পনা বলিয়া বোধ হয় ।

তবে ইহা মনে রাখা উচিত যে, যুদ্ধপ্রেরণাই গীতার মূলকথা নহে । কর্ম-তত্ত্বের আলোচনা-প্রসঙ্গেই উহা উল্লিখিত হইয়াছে । অর্জুন স্বজনাদি-বধ পাপজনক মনে করিয়া যুদ্ধে বিরত হইয়াছিলেন, তাঁহার প্রবোধার্থই গীতার অপূর্ব অধ্যাত্মতত্ত্বপূর্ণ কর্মোপদেশ এবং এই হেতুই উহার মধ্যে যুদ্ধপ্রেরণার কথা আসিয়াছে ।


অহিংসানীতি গীতারও মান্য, তবে গীতা বলেন, অহিংস হইয়াও যুদ্ধ করা চলে, স্থিতপ্রজ্ঞ হইয়াও যুদ্ধ করা চলে, কেননা হিংসা-অহিংসা বুদ্ধিতে, কর্মে নহে [গী|১১|৫৫] । ফলত্যাগী, কর্তৃত্বাভিমানশূন্য, সমত্ববুদ্ধিযুক্ত কর্মযোগীর কর্মে পাপ স্পর্শে না, উহার ফল যাহাই হউক [গী|২|৪৯-৫১; ১৮|১৭] । কিন্তু মহাত্মাজী বলেন, 'ভৌতিক যুদ্ধের সহিত  স্থিতপ্রজ্ঞের সম্বন্ধ থাকিতে পারে না' । এই স্থলেই মহাত্মাজীর অহিংসাবাদ - যাহাকে গান্ধীবাদ বলা হয়, এবং গীতোক্ত অহিংস-যুদ্ধবাদে পার্থক্য । এ-প্রসঙ্গে মহাত্মাজী লিখিয়াছেন - 'ভৌতিক যুদ্ধ সম্পূর্ণ কর্মফলত্যাগী দ্বারাও হইতে পারে, এ-কথা গীতাকারের ভাষায় অক্ষরে-অক্ষরে মানে করিলেও করা যায় । কিন্তু গীতার শিক্ষা ব্যবহারে আনিবার জন্য প্রায় চল্লিশ বৎসর পর্যন্ত সতত প্রযত্ন করিবার পর নম্রতাপূর্বক আমাকে একথা বলিতে হইবে যে, সত্য ও অহিংসা পালন না করিলে সম্পূর্ণ কর্মফলত্যাগ মনুষ্যের পক্ষে অসম্ভব' । এ-কথা সকলের শিরোধার্য । কিন্তু অহিংসাটা কর্মে না বুদ্ধিতে এ-বিষয়ে মতভেদের অবকাশ আছে ।


9.2) অসাম্প্রদায়িক টীকা-ভাষ্য


পূর্বে শঙ্কর-রামানুজাদি যে সকল টীকা-ভাষ্যকারগণের উল্লেখ করা হইয়াছে, তাঁহারা অনেকেই সম্প্রদায়-প্রবর্তক এবং সাম্প্রদায়িক দৃষ্টি অবলম্বন করিয়াই গীতার তাৎপর্য ব্যাখ্যা করিয়াছেন । কিন্তু অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিতেও গীতার আলোচনা পূর্বাবধিই চলিতেছে । বর্তমান কালে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ('কৃষ্ণচরিত্র'), দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর ('গীতাপাঠ'), উপাধ্যায় গৌরগোবিন্দ রায় ('গীতা সমন্বয়ভাষ্য'), লোকমান্য বাল গঙ্গাধর তিলক ('গীতারহস্য'), বেদান্তরত্ন হীরেন্দ্রনাথ দত্ত ('গীতায় ঈশ্বরবাদ'), অরবিন্দ ঘোষ ('Essays on the Gita') প্রমুখ অনেকে অসাম্প্রদায়িক ভাবেই গীতার আলোচনা করিয়াছেন ।

লোকমান্য বাল গঙ্গাধর তিলকের মতে গীতায় যে বিশিষ্ট যোগধর্ম উপদিষ্ট হইয়াছে, তাহা জ্ঞান-ভক্তিমিশ্র কর্মযোগ । তিনি শঙ্করাদি প্রাচীন বৈদান্তিক গীতাচার্যগণের সন্ন্যাসবাদাত্মক ব্যাখ্যার নানারূপ অসঙ্গতি প্রদর্শন করিয়াছেন এবং উহার তীব্র প্রতিবাদ করিয়াছেন । তাত্ত্বিক-দৃষ্টিতে তিনি অদ্বৈতবাদ ও মায়াবাদও স্বীকার করেন, তবে মায়াতত্ত্বের একটু বিশিষ্ট অর্থ করেন ।

শ্রীঅরবিন্দের মতে গীতোক্ত যোগে জ্ঞান, কর্ম ও ভক্তি এ-তিনেরই সমন্বয় আছে এবং উহাই পূর্ণাঙ্গ যোগ । তাঁহার মতে কেবল নির্গুণ ব্রহ্মতত্ত্ব ও মায়া-মিথ্যাত্ববাদ গ্রহণ করিলে গীতার সরল ব্যাখ্যা করা যায় না, কেননা মায়াবাদে কর্মের স্থান অতি গৌণ; উহা মায়াই, উহার সহিত জ্ঞানের সমুচ্চয় হয় না এবং নির্গুণতত্ত্বে ভাব-ভক্তিরও উপযোগিতা নাই । নির্গুণ-গুণী ঈশ্বরতত্ত্ব স্বীকার না করিলে জ্ঞান-কর্ম-ভক্তির সমন্বয় হয় না । ইহাই পঞ্চদশ অধ্যায়োক্ত পুরুষোত্তমবাদ [গী|১৫|২৮] । কিন্তু এই তত্ত্বটি পূর্বাচার্যগণ বিশেষ আলোচনা করেন নাই । এই তত্ত্বালোকেই শ্রীঅরবিন্দ জ্ঞান-কর্ম-ভক্তিমিশ্র পূর্ণাঙ্গ যোগের ব্যাখ্যা করিয়াছেন ।

বঙ্কিমচন্দ্র, হীরেন্দ্রনাথ দত্ত প্রমুখ আধুনিক সমালোচকগণ অনেকেই এই সমন্বয়মূলক-ব্যাখ্যারই পক্ষপাতী । এই পুস্তকের ভূমিকা এবং অন্যত্রও এ-বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা আছে । পরবর্তী পরিচ্ছেদেও এই তত্ত্বটি মনস্তত্ত্বের আলোকে পুনরায় আলোচনা করা হইয়াছে ।


10) বিদেশী ভাষায় গীতা



'পৃথিবীর ছত্রিশটি ভাষায় গীতার যে পঁচিশ শতাধিক সংস্করণ হইয়াছে, তাহার মধ্যে সাতাশটি ভাষায় প্রায় এগার শত সংস্করণের নমুনা-গীতা কলিকাতায় বাঁশতলা গলিস্থিত গীতা লাইব্রেরিতে সংগৃহীত আছে' [স্বামী জগদীশ্বরানন্দ, শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা] । গীতার প্রসারের পরিচয় আমরা মধ্যযুগ হইতে পাই । সম্রাট আকবরের মন্ত্রী ফজল ও তাঁহার ভ্রাতা ফৈজী ফার্সীভাষায় গীতার দুইটি অনুবাদ করেন । ফৈজী ফার্সী গীতা ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে বহুবার মুদ্রিত হইয়াছে । মুঘল আমলে গীতার আরো ফার্সী ও আরবী অনুবাদ হয় ।

গীতার সর্বপ্রথম ইংরেজী অনুবাদ করেন চার্লস উইলকিন্‌স (১৭৪৯|৫০-১৮৩৬ খ্রী) । উইলকিন্‌স ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির কেরানী হইয়া এদেশে আসেন এবং ফার্সী ও সংস্কৃত ভাষা শিক্ষা করেন । গীতার অনুবাদে তৎকালীন ভারতের প্রথম বড়লাট ওয়ারেন হেস্টিংস তাঁহাকে উৎসাহ দান করেন । হেস্টিংস তাঁহার গীতার পাণ্ডুলিপি লণ্ডনে ইস্ট-ইণ্ডিয়া-কোম্পানির আপিসে পাঠাইয়া দেন এবং কোম্পানির খরচে উহা ছাপাইবার সুপারিশ করেন । হেস্টিংস উহাতে একটি মূল্যবান ভূমিকা লিখিয়া দেন । তিনি নিজেও গীতার প্রশংসক ছিলেন । তিনি মনে করিতেন, গীতার বাণী কোনো জাতিকে গৌরবের সর্বোচ্চ শিখরে উন্নীত করিতে পারে । ১৭৮৫ খ্রীষ্টাব্দে লণ্ডন হইতে (পরে 'স্যর') উইলকিন্‌সের ইংরেজী গীতা হেস্টিংসের ভূমিকাসহ প্রকাশিত হয় । এই দুর্লভ গ্রন্থের এক কপি কলিকাতা এশিয়াটিক সোসাইটির গ্রন্থাগারে রক্ষিত আছে ।

১৭৮৭ খ্রীষ্টাব্দে নভিকভ রুশভাষায় গীতা অনুবাদ করেন । ১৮২৩ খ্রীষ্টাব্দে জর্মন সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত শ্লেগেল গীতার মূল শ্লোক দেবনাগরী অক্ষরে এবং অনুবাদ লাতিনভাষায় প্রকাশ করেন । ইউজেন বুর্নফ ১৮২৫ খ্রীষ্টাব্দে ফরাসী-ভাষায় গীতা অনুবাদ করেন এবং ডোমোট্রিয়া নামে একজন গ্রীক পণ্ডিত ১৮৫৮ খ্রীষ্টাব্দে গ্রীকভাষায় গীতার অনুবাদ প্রকাশ করেন । ১৮৬৯ খ্রীষ্টাব্দে এফ্‌. লরিঞ্জর জর্মনভাষায় টীকাসহ গীতার অনুবাদ প্রকাশ করেন । ইহা ছাড়াও ইউরোপ ও এশিয়ায় বিভিন্ন ভাষায় গীতা অনুদিত হয়, কোনো কোনো ভাষায় একাধিক অনুবাদও প্রকাশিত হয় ।

বর্তমানে ইংরেজী ভাষায় গীতার অনেকগুলি অনুবাদ প্রকাশিত হইয়াছে । তন্মধ্যে রামকৃষ্ণ মিশনের স্বামী স্বরূপানন্দ, স্বামী পরমানন্দ, স্বামী প্রভবানন্দ, স্বামী বিরেশ্বরানন্দস্বামী নিখিলানন্দের গীতা বিশেষ খ্যাতি লাভ করিয়াছে । ইহাদের মধ্যে স্বামী প্রভবানন্দ ও কবি ক্রীস্টোফার ঈশারউডের পদ্যে-গদ্যে গীতার অনুবাদটি অত্যন্ত সুন্দর হইয়াছে । উহাতে মনীষী অল্‌ডাস হাক্সলি যে ভূমিকা লিখিয়াছেন, তাহা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । হাক্সলি লিখিয়াছেন, - "আনন্দ কুমারস্বামী তাঁহার 'হিন্দুধর্ম ও বৌদ্ধধর্ম' নামক বিখ্যাত পুস্তকে লিখিয়াছেন, 'এই গ্রন্থ (গীতা) পূর্বতন বেদ, ব্রাহ্মণ ও উপনিষদের যাবতীয় মতবাদের সার-সংগ্রহ, এবং ইহা পরবর্তী ভারতীয় সকল চিন্তাধারার ভিত্তিমূল, সুতরাং ইহাকে ভারতীয় তাবৎ ধর্মের মিলন-বিন্দু (focus) বলা হয় । ভারতীয় ধর্মের মিলন-বিন্দু সনাতন দর্শনেরও (Perennial Philosophy) প্রাঞ্জলতম ও পূর্ণতম সংক্ষিপ্তসার । এই হেতু ইহার স্থায়ী মূল্য শুধু ভারতীয়গণের জন্য নয়, সমগ্র মানব-জাতির জন্যই । ... ভগবদ্গীতা সনাতন দর্শনের সম্ভবত সর্বাপেক্ষা সুসমঞ্জস আধ্যাত্মিক বিবৃতি ।'

এডুইন আর্নল্ড-কৃত গীতার ইংরেজী পদ্য-অনুবাদ 'Song Celestial', গীতার বাণী জনপ্রিয় করিতে সহায়তা করিয়াছে । এ্যানি বেসান্তের ইংরেজী পকেট গীতাখানিও (গদ্য) অনেক কাল যাবৎ সুপ্রচলিত । বড় বইয়ের মধ্যে ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণানের ইংরেজী-গীতাখানি মূল্যবান ভূমিকা ও টীকা-টিপ্পনিসহ মুদ্রিত হইয়াছে । ইহা এদেশে ও বিদেশে সর্বত্রই সমাদৃত । অধুনা আমাদের এই গীতাখানিরও ইংরেজীতে একটি সংক্ষিপ্ত সংস্করণ মূল্যবান ভূমিকা-সহ প্রকাশিত হইয়াছে । বিংশ শতাব্দীতে ইংরেজীতে গীতার সবচেয়ে বিখ্যাত ও বিস্ময়কর মৌলিক ব্যাখ্যান শ্রীঅরবিন্দের 'Essays on the Gita' । মহাযোগীর সাধনালব্ধ উপলব্ধির স্বাক্ষর এই গ্রন্থের ছত্রে-ছত্রে প্রোজ্জ্বল । শ্রীঅরবিন্দের গ্রন্থখানি নিবিষ্টচিত্ত তন্ময় পাঠককে আকর্ষণ করিয়া সর্বগুহ্যতম পরম শ্রেয়-পথে চালিত করিবে, তাহার হৃদয়-কন্দরে স্ফুরিত হইবে শ্রীভগবানের সর্বশেষ বাণী - 'সর্বধর্মান্‌ পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ' [গী|১৮|৬৬]


11) গীতোক্ত ধর্মের মূলকথা : ভাগবত-জীবন লাভ : জগতে সচ্চিদানন্দ প্রতিষ্ঠা


পূর্বে গীতার সমন্বয়-তত্ত্ব ও গীতার শিক্ষা সম্বন্ধে যাহা বলা হইয়াছে তাহার স্থূলমর্ম এই যে, গীতোক্ত ধর্মে জ্ঞান-কর্ম-ভক্তি - এই তিনের সমাবেশ আছে । গীতার টীকা-ভাষ্যের আলোচনায় আমরা দেখিয়াছি, অনেকে গীতায় কোনো একটি বিশেষ মার্গই প্রতিপাদিত হইয়াছে, ইহাই প্রতিপন্ন করিতে আগ্রহশীল । কেহ বলেন গীতা ভক্তিশাস্ত্র, কেহ বলেন গীতা কর্মযোগশাস্ত্র, কেহ বলেন গীতা ব্রহ্মবিদ্যা - তৎ ত্বম্‌ অসি (তুমিই সেই ব্রহ্ম) বেদান্তের এই মহাবাক্যই উহার একমাত্র প্রতিপাদ্য বিষয় । কিন্তু আধুনিক গীতা-সমালোচকগণ প্রায় সকলেই সমন্বয়বাদেরই পক্ষপাতী; তবে তাঁহারা কেহ বলেন, গীতায় জ্ঞান-ভক্তি মিশ্র কর্মযোগেরই প্রাধান্য; কেহ বলেন, উহাতে জ্ঞান-কর্মমিশ্র ভক্তিরই প্রাধান্য । বস্তুত গীতোক্ত পূর্ণাঙ্গ ধর্মে জ্ঞান-কর্ম-ভক্তির সমন্বয় কেন করা হইয়াছে, জীব-ব্রহ্মস্বরূপ ও মোক্ষ-তত্ত্বের আধ্যাত্মিক বিচারেও তাহা বুঝা যায় ।


11.1) সৎ-চিৎ-আনন্দ : ভগবানের ত্রিবিধ শক্তি


গীতার সর্বত্রই দেখা যায়, মোক্ষ বা সিদ্ধাবস্থার বর্ণনায় শ্রীভগবান বলিতেছেন - 'মদ্ভাবমাগতাঃ', 'মম সাধর্ম্যমাগতাঃ', 'মদ্ভাবায়োপপদ্যতে' ইত্যাদি । এই সকল কথার মর্ম এই, সাধনবলে জীব আমার ভাব প্রাপ্ত হয় । ভগবানের ভাব কি ? তিনি সচ্চিদানন্দস্বরূপ - 'ঈশ্বরঃ পরমঃ কৃষ্ণঃ সচ্চিদানন্দবিগ্রহঃ' [ব্রহ্মসংহিতা]; 'সত্যং জ্ঞানমনন্তং ব্রহ্ম' [তৈত্তি|২|১|৩], 'বিজ্ঞানমানন্দং ব্রহ্ম' [বৃহ|৩|৯|৮] । সৎ, চিৎ, আনন্দ - এই তিনটি তাঁহার ভাব । এই তিন ভাবে তাঁহার ত্রিবিধ শক্তি - সন্ধিনী, সংবিৎ, হ্লাদিনী শক্তি [বিষ্ণু পুরাণ] । শক্তির প্রকাশ ক্রিয়াতে ।


সন্ধিনী শক্তি (The Principle of Creative Life)

সৎ-ভাবে যে শক্তি ক্রিয়া করে তাহার নাম সন্ধিনী, জগতে যাহা-কিছু আছে, যাহা-কিছু সত্য বলিয়া প্রতীত হইতেছে, এই যে জগৎ-সৃষ্টি, এই জীবজগতের কর্মপ্রবাহ, কর্ম-প্রবৃত্তি, ইহার মূলে যা শক্তি ক্রিয়া করে তাহাই সন্ধিনী শক্তি ।


সংবিৎ শক্তি (The Principle of Knowledge)

চিৎ-ভাবের যে শক্তি তাহার নাম সংবিৎ, এই শক্তির ক্রিয়াতেই তিনি স্বতঃচেতন, ইহাদ্বারাই তিনি জীব-জগৎকে সচেতন করেন, জ্ঞানবুদ্ধির প্রেরণা দেন ।


হ্লাদিনী শক্তি  (The Principle of Delight)

আনন্দ-ভাবের যে শক্তি তাহার নাম হ্লাদিনী । এই শক্তির ক্রিয়াতেই তিনি নিজে আনন্দময়, নিজের স্বরূপানন্দ উপভোগ করেন এবং জীব-জগৎকে আনন্দিত করেন ।

এই তো সচ্চিদানন্দ-তত্ত্ব - সচ্চিদানন্দের ভাব ও শক্তি । জীবও সেইভাব কিরূপে লাভ করিবে ? জীব-তত্ত্ব কি তাহা পর্যালোচনা করিলেই উহা বুঝা যাইবে । জীব ব্রহ্মেরই অংশ, ব্রহ্ম-কণা, ব্রহ্ম-অগ্নিরই স্ফুলিঙ্গ; স্ফুলিঙ্গে অগ্নির লক্ষণ থাকিবেই, কাজেই জীবেও ব্রহ্ম-লক্ষণ আছে [পঞ্চদশী] । কিন্তু জীবে উহা অস্ফুট, বীজাবস্থ; ব্রহ্মে পূর্ণ-উচ্ছ্বসিত, এই হেতু ব্রহ্ম জীব হইতে অধিক [ব্রহ্ম সূত্র]


11.2) জীবের ত্রিবিধ শক্তি


জীব একাধারে কর্তা, জ্ঞাতা ও ভোক্তা । উহার এই ত্রিবিধ শক্তি ব্রহ্মশক্তিরই অনুরূপ, কিন্তু অস্ফুট, অবিশুদ্ধ ।


কর্মশক্তি (Conation or Action)

কর্মশক্তির ক্রিয়ায় ইনি কর্তা । উহার বিকাশ চেষ্টনায় । উহাই উচ্চতম-গ্রামে সন্ধিনী, যাহার ফল প্রতাপ (Power) ।


জ্ঞানশক্তি (Cognition or Thought)

জ্ঞানশক্তির ক্রিয়ায় ইনি জ্ঞাতা । উহার বিকাশ ভাবনায় । উহাই উচ্চতম-গ্রামে সংবিৎ, যাহার ফল প্রজ্ঞা (Wisdom) ।


ইচ্ছাশক্তি (Emotion or Desire)

ইচ্ছাশক্তির ক্রিয়ায় ইনি ভোক্তা । উহার বিকাশ কামনায় । উহাই উচ্চতম-গ্রামে হ্লাদিনী, যাহার ফল প্রেম (Love) ।

এ-সকল মনোবৈজ্ঞানিক সত্য এবং স্বানুভবসিদ্ধ । 


11.3) ত্রিবিধ সাধন পথ


কর্ম, জ্ঞান, প্রেম (Life, Light and Love) এই তিনটি জীবে অস্ফুট, অপূর্ণ, প্রকৃতি-জড়িত অবিশুদ্ধ অবস্থায় থাকে । সাধন-বলে এই তিনটি বিশুদ্ধ ও ঈশ্বরমুখী হইয়া পূর্ণরূপে বিকাশপ্রাপ্ত হইলে জীবও ঐশ্বরিক প্রকৃতি বা ভগবদ্ভাব প্রাপ্ত হয় । ভাগবতশাস্ত্রে ইহা পুনঃপুনঃ উল্লিখিত হইয়াছে ।

জীবের অন্তর্নিহিত এই যে তিনটি শক্তি আছে, তদনুসারে সাধনের তিনটি পথের নামকরণ হইয়াছে - কর্মযোগ, জ্ঞানযোগ, ভক্তিযোগজীবের যে অস্ফুট সদ্ভাব, উহার প্রকাশ তাহার কর্মে, সুতরাং তাহার কর্ম ঈশ্বরমুখী হইলেই উহা বিশুদ্ধ হইয়া নিষ্কাম কর্মযোগ হয় । জীবের মধ্যে যে চিদ্ভাব, উহার প্রকাশ তাহার জ্ঞানে, ভাবনায়; উহা ঈশ্বরমুখী হইয়া সমত্ব প্রাপ্ত হইলেই জ্ঞানযোগ হয় । জীবের মধ্যে যে আনন্দদ্ভাব, উহার প্রকাশ তাহার কামনায়; উহা ঈশ্বরমুখী হইয়া বিশুদ্ধ হইলেই প্রেমভক্তিযোগ হয় । এই তিনটির যুগপৎ অনুষ্ঠানেই জীবের পূর্ণবিকাশ, সচ্চিদানন্দের সাধর্ম্যলাভ ।


'শ্রীভগবান সমন্বয়ের উচ্চ চূড়ায় আরূঢ় হইয়া ইহাই প্রতিপন্ন করিয়াছেন যে, জীবকে সচ্চিদানন্দে পূণর্বিকশিত হইতে হইলে এই মার্গত্রয়কে সম্পূর্ণ আয়ত্ত করিতে হয় । সেই জন্য গীতায় দেখি, কর্মবাদ, জ্ঞানবাদ ও ভক্তিবাদের অপূর্ব সামঞ্জস্য বিধান করিয়া শ্রীকৃষ্ণ এক অদ্ভুত যুক্তত্রিবেণীসঙ্গম রচনা করিয়াছেন, যে পুণ্যতর কল্যাণতর ত্রিবেণীতে সরস্বতীর কর্মধারা, যমুনার জ্ঞানধারা এবং গঙ্গার ভক্তিধারা সমান উজ্জ্বল, সমস্রোতে প্রবহমান ।' - বেদান্তরত্ন হীরেন্দ্রনাথ দত্ত


12) গীতোক্ত যোগসাধনা : 'জগদ্ধিতায়'


বলা বাহুল্য, মার্গত্রয়ের অর্থ মোটেই ইহা নহে যে, সাধককে প্রচলিত তিনটি মার্গই অবলম্বন করিতে হইবে; মার্গ একটিই, তাহার মধ্যেই জ্ঞান-কর্ম-ভক্তির সমন্বয় ও সামঞ্জস্য আছে, বিরোধ নাই । অবশ্য প্রচলিত জ্ঞানযোগ বা রাজযোগেও সিদ্ধিলাভ হইতে পারে, কিন্তু গীতাতত্ত্বের আলোকে আমরা বুঝিতে পারি যে, সেই সিদ্ধি এবং গীতোক্ত সাধর্ম্য-সিদ্ধি এক নহে, উভয়ের উদ্দেশ্যও এক নহে । রাজযোগী বা জ্ঞানযোগীর উদ্দেশ্য কৈবল্যসিদ্ধি লাভ করিয়া 'কেবল' বা এক হইয়া যাওয়া । কিন্তু একই যে বহু হইয়াছেন, একই যে বহুর মধ্যে আছেন, তাহা তিনি বিস্মৃত হন । জীব-জগতের সহিত তাঁহার কোনো সম্পর্ক নাই । গীতোক্ত যোগীও একই দেখেন, কিন্তু এককে তিনি বহুর মধ্যে দেখেন, বহুকে তিনি একের মধ্যে দেখেন । ইহার ফলে তিনি সর্বভূতে সমদর্শী এবং সর্বভূতহিতসাধনে রত থাকেন ।

প্রচলিত ভক্তিযোগের সাধক জগৎকে অস্বীকার করেন না । তিনি রসব্রহ্মের উপাসক; রসলিপ্সায় বিভোর হইয়া তিনি জীবজগৎ হইতে যেন দূরে সরিয়া যান, এই জগৎলীলা যে সেই রসময়েরই রাসলীলা, আনন্দলীলা, - তিনি যে সর্বভূতময়, তাহা বিস্মৃত হইয়া যান । তিনি ভুলিয়া যান ভগবদুক্তি - সর্বভূতে আমার স্বরূপ চিন্তা করা এবং মন, বাক্য ও শরীর-বৃত্তিদ্বারা সর্বভূতের সেবা করাই ভক্তের শ্রেষ্ঠ ধর্ম [ভা|১১|২৯|১৯] । ভাগবত-শক্তি জীবকে শুধু রসগ্রাহী ভোক্তা করেন নাই, বিশ্বলীলার সহায়কারী কর্তাও করিয়াছেন । তাই লোকরক্ষার্থ যজ্ঞস্বরূপে স্বীয়-স্বীয় কর্ম করিয়া জাগতিক স্থিতি অব্যাহত রাখিলেই ভগবানের তুষ্টি হয়, তাহাতেই ভগবানের অর্চনা হয়, ইহাই ভাগবত-শাস্ত্রের বিধান [গী|১৮|৪৬] । তাই ভক্তের প্রতি শ্রীভগবানের উপদেশ - তুমি জ্ঞানী হও, তুমি ভক্ত হও, তুমি কর্মী হও, নিষ্কামতা দ্বারা কর্মের বন্ধন ঘুচাইয়া উহাকে মোক্ষদায়ক আমার কর্মে - ভাগবত-কর্মে পরিণত কর [গী|১১|১৫], 'জ্ঞানবিজ্ঞানসম্পন্নো ভজ মাং ভক্তিভাবিতঃ' [ভাগবত] । ইহাই পূর্ণাঙ্গ যোগ । জ্ঞান, কর্ম ও প্রেম - এই তিনটি বৃত্তি মানুষে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত, উহাদের পৃথক করিলে যোগ পূর্ণাঙ্গ হয় না । 

শ্রীভাগবতে ভক্তরাজ প্রহ্লাদের একটি উক্তি আছে
"মুনিগণ কেবল নিজেদের মুক্তির জন্য নির্জনে মৌনাবলম্বন করিয়া তপস্যা করেন, তাঁহারা তো অন্য জীবের দিকে চাহেন না, তাঁহারা তো পরার্থনিষ্ঠা নন ।"

কিন্তু গীতোক্ত যোগী বিশ্বকর্মী, তাঁহার সাধনা কেবল নিজের মুক্তির জন্য নহে, বিশ্বমানবকে শুদ্ধ ও মুক্ত করিবার জন্য । জগতে মানবমাত্রেই যখন জাতিধর্মনির্বিশেষে এই উদার ধর্মমত গ্রহণ করিবে, সর্বদাই যখন এই ধর্ম সম্যক অনুষ্ঠিত হইবে -

  • জ্ঞানে যখন সকলেই সর্বভূতে সমদর্শী হইবে,
  • প্রেমে যখন সর্বভূতে প্রীতিমান হইবে,
  • কর্মে যখন সর্বভূতহিতসাধনে রত হইবে,

তখনই জগতে সচ্চিদানন্দ প্রতিষ্ঠা হইবে । এই সার্বভৌম ধর্ম জগতে সুপ্রতিষ্ঠিত হইলে সকল ব্যক্তিই আত্মবান, সমদর্শী, নিষ্কাম কর্মী, সর্বভূতহিতে রত ও ভগবানে ভক্তিমান হইবে । তখন হিংসা-দ্বেষ, যুদ্ধ-বিবাদ, অশান্তি-উপদ্রব সমস্ত দূরীভূত হইবে - জগতে অখণ্ড অনাবিল শান্তি বিরাজ করিবে । ইহাই ভাগবত-ধর্মের মহান আদর্শ ।

অধুনা পাশ্চাত্য দেশে এবং এদেশেও সমাজতান্ত্রিক মতবাদ বিশেষ প্রসার লাভ করিয়াছে । আধুনিক সমাজতান্ত্রিকগণ মানব-সমাজে যে আদর্শ পরিকল্পনা করেন তাহা এইরূপ - এই সমাজে প্রত্যেক ব্যক্তি সমাজ-রক্ষার্থে সাধ্যানুসারে স্বীয়-স্বীয় কর্তব্য কর্ম সম্পন্ন করিবে, সেই কর্মের দ্বারা উৎপন্ন ধন বা দ্রব্যজাত সাধারণ সম্পত্তি বলিয়া গণ্য হইবে । উহা সমাজের সকলের মধ্যে প্রয়োজনানূরূপ বিতরিত হইবে; কাহারও ব্যক্তিগত সম্পত্তি থাকিবে না । সমাজে উচ্চ-নীচ, ধনী-নির্ধন, ধনিক-শ্রমিক, ভূস্বামী-প্রজা ইত্যাদি শ্রেণী-বিভেদ থাকিবে না । সুখে-স্বচ্ছন্দে জীবনযাত্রার সর্ববিধ প্রয়োজনে প্রত্যেক ব্যক্তি সাধারণ ধন-ভাণ্ডার হইতে অর্থাদি পাইবে । সুতরাং আমার ধন, আমার জন, আমি ধনী, আমি মানী ইত্যাদি ব্যক্তিগত অহংবুদ্ধি সমাজ হইতে ক্রমশ বিলুপ্ত হইবে । সকলেই নিঃস্বার্থভাবে সমাজের কল্যাণার্থে সোৎসাহে কর্মনিরত থাকিবে । এই সমাজে ব্যক্তিগত ধন-সংসৃষ্ট হিংসা-দ্বেষ, বিবাদ-বিসংবাদ লোপ পাইবে । দুর্বলের উপর প্রবলের প্রভুত্ব লোপ পাইবে এবং সমাজে সাম্য-মৈত্রী ও অনাবিল শান্তি বিরাজ করিবে ।

বলা বাহুল্য, পূর্বে যে অহিংসক সর্বভূতহিতে রত নিষ্কামকর্মী আদর্শ মানব-সমাজের বর্ণনা করা হইয়াছে, সেই সমাজ এবং আধুনিক সমাজতান্ত্রিকগণের পরিকল্পিত মানব-সমাজ আদর্শত এক । তবে পার্থক্য এই, সমাজতান্ত্রিকগণের মধ্যে অনেকে ধর্ম-বস্তুটিকে একেবারে বাদ দিয়াছেন । কিন্তু সকল সমাজতান্ত্রিক আদর্শে ধর্ম অস্বীকৃত হয় নাই । বস্তুত অজ্ঞ কুসংস্কারান্ধ জনসাধারণের উপর সেকালের উন্নতি-বিরোধী ধর্মযাজক-সম্প্রদায়ের নিরঙ্কুশ আধিপত্য যাঁহারা প্রত্যক্ষ করেছেন, তাঁহাদের পক্ষে ধর্ম-বস্তুটির প্রতি এতাদৃশ বিদ্বেষ কিছু বিচিত্র নহে । বৈদান্তিক সমত্ব-জ্ঞান ও গীতোক্ত নিষ্কাম কর্ম যে-ধর্মের মূলভিত্তি সেই উচ্চাঙ্গের ধর্মের সহিত যদি তাঁহারা পরিচিত থাকিতেন, তবে তাঁহারাও ধর্ম-বস্তুটিকে এমন সরাসরি বাদ দিতে পারিতেন না । কেননা, তাঁহারা যে কর্মনীতি প্রচার করেন, ইহলৌকিক দৃষ্টিতে গীতোক্ত ধর্মের কর্মনীতিও প্রায় তাহাই, পারলৌকিক-তত্ত্ব যাহাই হউক । সমাজতন্ত্রবাদের একটি মূলনীতি (maxim) এই যে, সমাজের সকলকে সমভাবে ভোগ করিতে না দিয়া, নিজের প্রয়োজনের অতিরিক্ত ব্যক্তিগত ধন-সম্পত্তি সঞ্চয় করা চৌর্য মাত্র ('Property is theft') । আমারা দেখিতে পাই, ভাগবত-শাস্ত্রে গার্হস্থ্যধর্মের বর্ণনা-প্রসঙ্গে অনুরূপ ভাষায় ঠিক এই নীতিরই উল্লেখ আছে - 
"যে পরিমাণ ধনাদি নিজের ভরণ-পোষণ হয়, তাবন্মাত্রেই দেহীদিগের স্বত্ব । যে তাহার অতিরিক্ত ধন-সম্পত্তির অভিলাষ করে সে চৌর; সে দণ্ড পাইবার যোগ্য ।" [ভা|৭|১৪|৮]

এই প্রসঙ্গে শ্রীমৎ শ্রীশঙ্করাচার্য (ডঃ কুর্তোকোটি) ১৯৩৬ খ্রীষ্টাব্দে হিন্দু মহাসভার সভাপতিরূপে যে অভিভাষণ দিয়াছিলেন, তাহার নিম্নলিখিত বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য ।

'The Aryan principle, for instance, has already provided us the practice of equality and the principle of equableness as evinced by সমত্বযোগ of Bhagavad Gita. If socialist creed are to be imported in the land... I should advise... first of all to adjust them to our national brand of সমত্বযোগ which will refine and sublimate the equality of the West...' [The Leader].

'ভগবদগীতার সমত্ব-যোগ হইতেই প্রমাণিত হয় যে, আর্য্যধর্ম আমাদিগকে সাম্যনীতি ও তন্মূলক নিষ্কাম কর্মপন্থাই প্রদান করিয়াছে । যদি সমাজতান্ত্রিক মতবাদ-সমূহ এদেশে আনিতে হয়, তাহা আমাদের স্বদেশীয় সমত্ব-যোগের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখিয়াই গ্রহণ করিতে হইবে, তবেই পাশ্চাত্যের সাম্যবাণী ঊর্দ্ধস্তরে উন্নীত হইবে ।'

বস্তুত সর্বভূতে সাম্যদৃষ্টি ও সর্বভূতহিতসাধনার্থ বা নিষ্কাম কর্মনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত সর্বপ্রকার অত্যাচার ও শোষণ-বর্জিত আদর্শ মানব-সমাজের পরিকল্পনা ভারতে প্রথম হইয়াছে ।

প্লেটো, এরিস্টটল, এপিক্যুরস প্রভৃতি প্রাচীন গ্রীক-তত্ত্বজ্ঞগণও পূর্ণজ্ঞানী শুদ্ধতত্ত্ব আদর্শ মানব-সমাজের বর্ণনা করিয়াছেন । কিন্তু অনেক পাশ্চাত্য পণ্ডিতের মত এই যে, উহা কল্পনাপ্রসূত উচ্চ আদর্শমাত্র, বাস্তব জগতে এরূপ অবস্থা কখনও হয় নাই, হইবেও না । আমাদের শাস্ত্র বলেন যে, এ-অবস্থা অত্যন্ত দুর্লভ বটে [মঃভাঃ|শা|৩৪৮|৬২], কিন্তু ইহা কাল্পনিক নহে । সত্যযুগে এই ধর্মই প্রচলিত ছিল [মঃভাঃ|শা|৩৪৮|২৯|৩৪] এবং পুনরায় বিশ্বময় এই ধর্ম অনুষ্ঠিত হইলে সত্যযুগের আবির্ভাব হইবে [মঃভাঃ|শা|৩৪৮|৬৩] ।

"অহিংসক, আত্মজ্ঞানী, সর্বভূতহিতে রত, একান্তী অর্থাৎ ভাগবত-ধর্মাবলম্বী দ্বারা যদি জগৎ পরিপূর্ণ হয়, তবে জগতে স্বার্থবুদ্ধিতে কৃত কর্ম লোপ পায় এবং পুনরায় সত্যযুগের আবির্ভাব হয় ।" [মঃভাঃ|শা|৩৪৮|৬২|৬৩]

তাই পুণ্যাত্মা অশ্বিনীকুমারের ভাষায় বলিতেছিলাম - ভাগবত-ধর্মের উদ্দেশ্য, জীবের একমাত্র লক্ষ্য - 'বিশ্বময় সর্বত্র সচ্চিদানন্দোপলব্ধি, সচ্চিদানন্দাবলম্বন ও সচ্চিদানন্দ প্রতিষ্ঠা ।'

জীবের জীবন্মুক্তি এবং জগতের ভাবী উন্নতির ইহা অপেক্ষা উচ্চ ধারণা অন্য কোনো ধর্ম-সাহিত্যে পাওয়া যায় কি ? ভগবদ্ভক্তি, বিশ্বপ্রীতি ও কর্মনীতির ইহা অপেক্ষা উচ্চ আদর্শ আর-কিছু আছে কি ? এইরূপ উদার অসাম্প্রদায়িক সার্বভৌম ধর্মমত আর প্রচারিত হইয়াছে কি ?
বিশ্বধর্ম, বিশ্বপ্রেম, বিশ্বমানবতা । 
কে শিখালো জগতেরে ? - ভারতের গীতা । 
তাই - দেশে দেশে অনূদিতা আদৃতা অধীতা । 
জগতের ধর্মগ্রন্থ ভারতের গীতা ।।
___________________________
Partial online source (Heading 1 to 3.1): 
http://geetabangla.blogspot.com/2011/08/blog-post_6446.html
http://geetabangla.blogspot.com/2011/08/blog-post_19.html

*Hard Copy Source:

"Sri Gita" or "Srimadbhagabadgeeta" by Gitashastri Jagadish Chandra Ghosh & Anil Chandra Ghosh. 26th Edition - June 1997 (1st Edition, 1925 from Dhaka now in Bangladesh). Published by Subhadra Dey (Ghosh), Presidency Library, 15 Bankim Chatterjee Street, Kolkata-700073. Printed by Web Impressions Pvt.Ltd., 34/2 Beadon Street, Kolkata-700006.

Content numbering done by uploader for clarity.

Disclaimer:
This site is not officially related to Presidency LibraryKolkata. This is a personal, non-commercial, research-oriented effort of a novice religious wanderer.
এটি আধ্যাত্মিক পথের এক অর্বাচীন পথিকের ব্যক্তিগত, অবাণিজ্যিক, গবেষণা-ধর্মী প্রয়াস মাত্র ।

[Digitised by scanning (if required) and then by typing mostly in Notepad using Unicode Bengali "Siyam Rupali" font and Avro Phonetic Keyboard for transliteration. Uploaded by rk]


<Previous--Contents--Next>

No comments:

Post a Comment