Purushottam Philosophy


(গীতাশাস্ত্রী জগদীশচন্দ্র ঘোষ)*

পুরুষোত্তম-তত্ত্ব


এস্থলে তিনটি পুরুষের কথা বলা হইতেছে - (1) ক্ষর, (2) অক্ষর ও (3) উত্তম (পুরুষোত্তম) । ইহার কোন্‌টিতে কোন্‌ তত্ত্ব প্রকাশ করে ? শ্রীভগবান বলিতেছেন - "ক্ষর পুরুষ সর্বভূত, অক্ষর কূটস্থ এবং আমি ক্ষরের অতীত এবং অক্ষর হইতেও উত্তম, এই হেতু আমি পুরুষোত্তম ।" [১৫|১৬-১৮]


নির্গুণ ব্রহ্মতত্ত্ব এবং সগুণ-ব্রহ্ম

সাধারণতঃ কূটস্থ অক্ষর বলিতে নির্গুণ নির্বিশেষ ব্রহ্মতত্ত্বই বুঝায় । উপনিষদে এবং ব্রহ্মসূত্রে ব্রহ্মই অদ্বয় পরতত্ত্ব । ব্রহ্মস্বরূপ কোথাও নির্গুণ, কোথাও সগুণ, কোথাও সগুণ-নির্গুণ উভয়রূপেই বর্ণনা করা হইয়াছে । শ্বেতাশ্বতর প্রভৃতি উপনিষদে মূল তত্ত্বের বর্ণনায় দেব, ঈশ্বর, পুরুষ প্রভৃতি শব্দও ব্যবহৃত হইয়াছে । ভাগবত-শাস্ত্রে উপনিষদের এই দেব, ঈশ্বর বা সগুণ-ব্রহ্মই পুরুষোত্তম বলিয়া বর্ণিত হইয়াছেন এবং নির্গুণ ব্রহ্মতত্ত্ব অপেক্ষা ইঁহাকে শ্রেষ্ঠ স্থান দেওয়া হইয়াছে; কেননা ভক্তিমার্গে অনির্দেশ্য অচিন্ত্য নির্গুণ তত্ত্বের বিশেষ উপযোগিতা নাই । মহাভারতের নারায়ণীয় পর্বাধ্যায়ে (যাহা ভাগবত শাস্ত্রের বা সাত্বত ধর্মের মূল) এই পুরুষোত্তম শব্দ পুনঃ পুনঃ ব্যবহৃত হইয়াছে এবং তিনি নির্গুণ হইয়াও গুণধারক, তিনিই অব্যয়, পরমাত্মা, পরমেশ্বর, ইহা স্পষ্টই বলা হইয়াছে । পুরাণাদিতে ভগবান্‌ পুরুষোত্তমই পরতত্ত্ব ও পরব্রহ্ম বলিয়া কীর্তিত এবং অনেক স্থানেই তাঁহার নির্বিশেষ নির্গুণ স্বরূপ অপেক্ষা সবিশেষ সগুণ বিভাবেরই বৈশিষ্ট বর্ণিত হইয়াছে । গীতাও ভাগবত ধর্মেরই গ্রন্থ, উহাতেও পুরুষোত্তম বা ভগবত্তত্ত্বই পরমেশ্বরের শ্রেষ্ঠ স্বরূপ বলিয়া বর্ণিত হইয়াছেন এবং উহাতেই ব্রহ্মতত্ত্বের প্রতিষ্ঠা, এরূপ বর্ণনাও আছে [১৪|২৭]
"জিকড়ে পহাবে তিকড়ে অপার । 
কোনীকড়ে নাহি পার ।। 
এক জিনসী স্বতন্ত্র । দুসরে নাহীঁ ।।
যে দিকে দেখিবে সেই দিকেই অসীম, কোন দিকেই সীমা নাই; একমাত্র বস্তু ও স্বতন্ত্র, তাঁহাতে দ্বৈত বা অন্য কিছুই নাই ।" - [পরব্রহ্মের বর্ণনা, শ্রীসমর্থ রামদাস স্বামী, দা, ২০.২.৩, উদ্ধৃত - কাপিলসাংখ্যশাস্ত্র কিংবা ক্ষরাক্ষরবিচার, গীতারহস্য, লোকমান্য তিলক, অনুবাদ শ্রীজ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, পৃঃ১৬১]


অক্ষরভাব, ক্ষরভাব ও পুরুষোত্তম ভাব

'ব্রহ্মই সমস্ত' এই বৈদান্তিক মূলতত্ত্বই গীতার প্রতিপাদ্য । পূর্বোক্ত তিন পুরুষ সেই মূল তত্ত্বেরই বিশ্লেষণ । ঐ তিন পুরুষ এক তত্ত্বেরই তিন বিভাব । এই পরিণামী চেতনাচেতনাত্মক জগৎ (সর্বভূতানি) তাঁহা হইতেই জল-বুদ্বুদের ন্যায় উত্থিত হইয়া আবার তাঁহাতেই বিলীন হয় । তাঁহার অপরা ও পরা প্রকৃতি সংযোগে উহা সৃষ্ট এবং তাঁহার জীবভূতা পরা প্রকৃতিই (ক্ষরভাব) উহা ধারণ করিয়া আছে । অক্ষরভাব - তাঁহার অপরিণামী, নির্বিশেষ, কূটস্থ, নির্গুণ স্বরূপ ।

পুরুষোত্তম ভাবে তিনি নির্গুণ হইয়াও সগুণ, যজ্ঞ-তপস্যার ভোক্তা, সর্বভূতের গতি, ভর্তা (পোষণকর্তা), প্রভু (নিয়ন্তা), সাক্ষী (শুভাশুভ দ্রষ্টা), নিবাসঃ (স্থিতি-স্থান), শরণং (রক্ষক), সুহৃৎ (উপকারকর্তা), প্রভবঃ (স্রষ্টা), প্রলয়ঃ (সংহর্তা), স্থানং (আধার), নিধানম্‌ (লয়স্থান) এবং অবিনাশী বীজস্বরূপ । [৯|১৮]

শ্রীঅরবিন্দ এই তিন তত্ত্বের এইরূপ ব্যাখ্যা দিয়েছেন :-
(1) ক্ষর পুরুষ = সচল পরিণামী ভগবানের বহুরূপ (Multiplicity of the Divine Being) । পুরুষ এই প্রকৃতি হইতে স্বতন্ত্র নহে, ইহা প্রকৃতিরই অন্তর্গত ।
(2) অক্ষর পুরুষ = অচল অপরিণামী ভগবানের একরূপ (The Unity of the Divine Being) । প্রকৃতির সাক্ষী, কিন্তু প্রকৃতি ও তাহার কার্য হইতে এই পুরুষ মুক্ত ।
(3) পুরুষোত্তম = পরমেশ্বর, পরব্রহ্ম, পরম পুরুষ, 'একমেবাদ্বিতীয়ং' । উল্লিখিত পরিণামী বহুত্ব ও অপরিণামী একত্ব এই দুইই (পুরুষ-) উত্তমের ।

(a) ক্ষর রূপে তিনি তাঁহার প্রকৃতির, তাঁহার শক্তির বিরাট্‌ ক্রিয়ার বলে, তাঁহার ইচ্ছা ও প্রভাবের বশেই নিজেকে সংসারে ব্যক্ত করেছেন ।
(b) অক্ষর রূপে তিনি আরও মহান্‌ নীরবতা ও অচলতার দ্বারা নিজেকে স্বতন্ত্র নির্লিপ্ত রাখিয়াছেন ।
(c) পুরুষোত্তম রূপে তিনি 'প্রকৃতি হইতে স্বতন্ত্রতা' এবং 'প্রকৃতিতে লিপ্ততা' এই দুইয়েরই উপরে ।

"পুরুষোত্তম সম্বন্ধে এইরূপ ধারণা উপনিষদে প্রায়ই সূচিত হইলেও গীতাতেই ইহা স্পষ্টভাবে বর্ণিত হইয়াছে এবং তাহার পর হইতে ভারতীয় ধর্মচিন্তার উপর এই ধারণা বিশেষ প্রভাব বিস্তার করিয়াছে । যে সর্বোত্তম ভক্তিযোগ অদ্বৈতবাদের কঠিন নিগড় ছাড়াইয়া যাইতে চায়, ইহাই (অর্থাৎ এই পুরুষোত্তম-তত্ত্ব) তাহার ভিত্তি; ভক্তিরসাত্মক পুরাণ-সমূহের মূলে এই পুরুষোত্তম-বাদ নিহিত রহিয়াছে ।" - [সাংখ্য ও যোগ, শ্রীঅরবিন্দের গীতা, অনুবাদ শ্রীঅনিলবরণ রায়, পৃঃ১০৬]


কর্ম-জ্ঞান-ভক্তির সমুচ্চয়

পুরুষোত্তম-বাদ দ্বারাই গীতা জ্ঞান, কর্ম ও ভক্তির সমন্বয় সাধন করিয়াছেন । ব্রহ্মবাদে উহা হয় না, কেননা মায়াবাদিগণের ব্রহ্ম নীরব, অক্ষর, নিষ্ক্রিয়; সাংখ্যদিগের পুরুষও তদ্রূপ; সুতরাং এই উভয় মতেই কর্মত্যাগ ভিন্ন মোক্ষলাভের অন্য উপায় নাই এবং এই মোক্ষ বা মিলনে ভক্তিরও স্থান নাই । এই হেতু গীতায় নিষ্ক্রিয় অক্ষর-ব্রহ্ম অপেক্ষা ক্রিয়াশীল 'ভক্তের ভগবান্‌' 'নির্গুণ-গুণী' ব্রহ্মের বৈশিষ্ট্য । ইনি পুরুষোত্তম ।


সব প্রশ্নের উত্তর - গীতার সমন্বয়

"মায়াবাদীদিগের ব্রহ্ম নীরব, অক্ষর, নিষ্ক্রিয় । সাংখ্যদিগের পুরুষও তদ্রূপ । অতএব, উভয়ের মতেই সংসার ও কর্ম পরিত্যাগ করিয়া সন্ন্যাসীর জীবন যাপন ভিন্ন মোক্ষলাভের আর অন্য উপায় নাই । কিন্তু, গীতার যোগ এবং বৈদান্তিক কর্মযোগ উভয় মতানুসারেই কর্ম শুধু মোক্ষের সহায় নহে - কর্মের দ্বারাই মোক্ষলাভ হইতে পারে; এবং এই কথারই যুক্তিযুক্ততা গীতা জোরের সহিত পুনঃ পুনঃ বলিয়াছে ।" - [সাংখ্য, যোগ ও বেদান্ত, শ্রীঅরবিন্দের গীতা, অনুবাদ শ্রীঅনিলবরণ রায়, পৃঃ১১৬]

"But if the Supreme is only this immutable Self and the individual is only something that has gone forth from him in the Power, then the moment it returns and takes its poise in the self, everything must cease except the supreme unity and the supreme calm. ...Why then this insistence on the most violent and disastrous form of action, this chariot, this battle, this warrior, this divine charioteer ?

The Gita answers by presenting the Supreme as something greater even than the immutable Self, more comprehensive, one who is at once this Self and the Master of works in Nature." - [The Gist of the Karmayoga, Essays on the Gita, Sri Aurobindo, pp.257]

"ভগবান্‌ যদি শুধু এই অক্ষর আত্মা হন এবং তাহা হইতে যে সত্তা প্রকৃতির খেলায় বাহির হইয়াছে তাহাই যদি জীব হয়, তাহা হইলে যে মুহূর্তে জীব ফিরিয়া আসিবে ও আত্মায় প্রতিষ্ঠিত হইবে, তখনই সমস্ত বদ্ধ হইয়া যাইবে, কেবল থাকিবে পরম ঐক্য, পরম নিস্তব্ধতা । ... তাহা হইলে সর্বাপেক্ষা ভীষণ ও ধ্বংস-সঙ্কুল কর্ম করিতে পুনঃ পুনঃ আদেশ কেন, এই রথ কেন, এই যুদ্ধ কেন, এই যোদ্ধা কেন, এই দিব্য সারথি কেন ?

গীতা এই বলিয়া জবাব দিয়াছেন যে, ভগবান্‌ অক্ষর আত্মা অপেক্ষাও বড়, আরও অধিক ব্যাপক, তিনি একাধারে এই অক্ষর-ব্রহ্ম বটেন, আবার প্রকৃতির কার্যের অধীশ্বরও বটেন । ... জ্ঞান, ভক্তি ও কর্মের মিলনের দ্বারা আত্মা সর্বোচ্চ ঐশ্বরিক অবস্থায় প্রতিষ্ঠিত হয়, যিনি, এক কালে অনন্ত আধ্যাত্মিক শান্তি এবং অনন্ত বিশ্বব্যাপী কর্ম উভয়েরই অধীশ্বর, সেই পুরুষোত্তমের মধ্যে বাস করেন । ইহাই গীতার সমন্বয় ।" - [কর্মযোগের সারতত্ত্ব, শ্রীঅরবিন্দের গীতা, অনুবাদ শ্রীঅনিলবরণ রায়, পৃঃ২৯২-২৯৩]

___________________________
*Hard Copy Source:

"Sri Gita" or "Srimadbhagabadgeeta" by Gitashastri Jagadish Chandra Ghosh & Anil Chandra Ghosh. 26th Edition - June 1997 (1st Edition, 1925 from Dhaka now in Bangladesh). Published by Subhadra Dey (Ghosh), Presidency Library, 15 Bankim Chatterjee Street, Kolkata-700073. Printed by Web Impressions Pvt.Ltd., 34/2 Beadon Street, Kolkata-700006. pp.460-465.

Online References:

1)"Essays on the Gita" by Sri Aurobindo. The Complete Works of Sri Aurobindo. © Sri Aurobindo Ashram Trust 1997. Published by Sri Aurobindo Ashram Publication Department. Printed at Sri Aurobindo Ashram Press, Pondicherry, India. Volume-19.

2a)"Sri Aurobinder Gita" translated by Sri Anil Baran Roy (translator's biography at the end of the linked web-page), 1924. Published by Sri Bibhutibhushan Ray, Saraswati Library, 9 Romanath Majumdar Street, Kolkata. Printed by Sri Mohendranath Dutta, Sri Saraswati Press, 26/1 Beniyatola Lane, Kolkata.

2b)"Sri Aurobinder Gita", Volume 2, translated by Sri Anil Baran Roy, 1926. Published by Sri Bibhutibhushan Ray, D.A. Library, 61 Cornwallis Street, Kolkata. Printed by Sri Mokkhodaronjan Bhattacharya, Anandamayee Printing Works, 25 Nimtala Ghat Street, Kolkata.

3)"Shrimadbhagabadgita Rahasya" or "Karmajogsastra" by Lokmanya Bal Gangadhar Tilak, translated by Sri Jyotirindranath Tagore, 1924. Published by Sri Khitindranath Thakur, Adi Bramha Samaj, 55 Upper Chitpur Road, Kolkata. Printed by Adi Bramha Samaj Press, 55 Upper Chitpur Road, Kolkata.

Disclaimer:
This site is not officially related to Presidency LibraryKolkata. This is a personal, non-commercial, research-oriented effort of a novice religious wanderer.
এটি আধ্যাত্মিক পথের এক অর্বাচীন পথিকের ব্যক্তিগত, অবাণিজ্যিক, গবেষণা-ধর্মী প্রয়াস মাত্র ।

[Digitised by scanning (if required) and then by typing mostly in Notepad using Unicode Bengali "Siyam Rupali" font and Avro Phonetic Keyboard for transliteration. Uploaded by rk]

No comments:

Post a Comment