Dharma-Artha-Kama-Moksha in Mahabharata

মহাভারতে পুরুষার্থ বিচার এবং যক্ষ-যুধিষ্ঠির সংবাদ

(অমলেশ ভট্টাচার্য)


সূচি


1) ভূমিকা
2) চতুর্বর্গ/পুরুষার্থ
2.1) ধর্ম
2.2) অর্থ
2.3) কাম
2.4) মোক্ষ
3) চাতুর্বর্ণ্য ও চতুরাশ্রমের উপযোগিতা
4) পঞ্চপাণ্ডবের মতামত
5) উপসংহার
6) যক্ষ ও যুধিষ্ঠির সংবাদ


1) ভূমিকা


ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষ – এই চারটি পুরুষার্থের গুরুত্ব সাধারণ মানুষের জীবনে অপরিসীম । এর কোন একটা বাদ দিলে জীবন শ্রীহীন ও পঙ্গু হয়ে পড়ে । মহাভারতে বর্ণিত জীবনের এই চতুর্বর্গের (পুরুষার্থের) চতুঃসীমার মধ্যেই সকলে বিচরণ করছে । স্বভাব প্রকৃতি অনুসারে এক-এক জনের ঝোঁক এক-একটির উপরে । এই চারটি বিষম উপাদানের মাত্রা নিরুপণ ও সমন্বয় সাধনের ভিতরেই জীবনের সুখ, শান্তি ও সার্থকতা,  কিন্তু তা করা এক অতি দুরূহ সমস্যা । এই সমস্যাকে জটিলতর করেছে প্রকৃতির তিনটি গুণ – সত্ত্ব, রজঃ, তম

এই সমস্যাকে প্রথমে যুধিষ্ঠিরের সামনে তুলে ধরেছিলেন যক্ষরূপী ধর্ম [বনপর্ব|৩১৩] । নিজের জীবনে যুধিষ্ঠির এই সমস্যার সমাধান পেলেও এর ব্যাবহারিক প্রয়োগ সম্পূর্ণ হয়নি । সেজন্য সারা জীবন তাঁকে অনুসন্ধান করতে হয়েছে । যেতে হয়েছে মহাপ্রস্থানের পথের শেষ পর্যন্ত ।


2) চতুর্বর্গ/পুরুষার্থ



2.1) ধর্ম

লোকস্থিতি যেমন ধর্ম তেমনি ঐহিক ও আধ্যাত্মিক সকল সম্পদকেও ধর্ম বলে ।
ধর্ম = ‘ধৃঞ্‌’ ধাতু + ‘মনৃ’ প্রত্যয় (অর্থাৎ সমস্ত লোকস্থিতিকে যা ধারণ করে)
ধর্ম = ‘ধন’ পূর্ব ‘ঋ’ ধাতু + ‘মকৃ’ প্রত্যয় (অর্থাৎ যা থেকে সকল ধনের প্রাপ্তি ঘটে)


2.2) অর্থ

মহাভারতে অর্থকে অত্যন্ত ব্যপক অর্থে গ্রহণ করা হয়েছেযা-কিছু আয়ত্ত করা যায় তাই অর্থ । ধর্ম ও বিদ্যাকেও বলা হয়েছে শ্রেষ্ঠ অর্থ [বনপর্ব|৩১৩|৭৪] । ধর্মের মূল যেমন অর্থ, অর্থেরও মূল তেমনি ধর্ম । অর্থ একটি শক্তি, এবং তাই অর্থেরও বিকার ঘটে । অন্যায় পথে অধর্ম উপায়ে অর্জিত অর্থের তো কথাই নেই, ধর্ম পথেও উপার্জিত অর্থ যদি অত্যধিক সঞ্চিত হয় তাহলে সৃষ্টি করে লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য, ভয়, উদ্বেগ, কার্পণ্য । ভীষ্ম বলছেন, ধর্মপথে উপার্জিত অর্থকে তিন ভাগ করে তার এক-তৃতীয়াংশ সঞ্চয়, এক-তৃতীয়াংশ দিয়ে জীবনযাত্রা, আর এক-তৃতীয়াংশ ধর্ম কার্যে ব্যয় করবে [অনুশাসনপর্ব|১৪১|৭৯] । অর্থ সঞ্চয়েরও একটা সীমা বেঁধে দিলেন – তিন বৎসর জীবনযাত্রা নির্বাহ হয় এই পরিমাণ অর্থই কেবল সঞ্চয় করবে, তার বেশী সঞ্চিত অর্থ হল অনর্থ [অনুশাসনপর্ব|৪৭|২২]

“সকল সম্পদই ভগবানের; যাদের রয়েছে ও জিনিষ তারা রক্ষক মাত্র, মালিক নয় – আজ তাদের আছে, কাল অন্যত্র চলে যেতে পারে । ... সর্বদা মনে রেখ – তাঁরই সম্পত্তি তুমি ব্যবহার করছ, তোমার নিজের নয় । ... অর্থদোষ হতে তুমি যখন মুক্ত অথচ তোমার নাই সন্ন্যাসের নিবৃত্তি, তখনই ভাগবত কর্মের জন্য অর্থ জয়ের অধিকতর ক্ষমতা তোমার জন্মাবে ।” [শ্রীঅরবিন্দ, The Mother, Chapter 4]


2.3) কাম

মহাভারতে ‘কাম’ শব্দও অত্যন্ত ব্যপক অর্থে গ্রহণ করা হয়েছে । যে কোন সঙ্কল্পরূপ মানস ইচ্ছাকেই কাম বলে [অনুশাসনপর্ব|৮৫|১১]ভীষ্ম বলছেন – সবকিছুর মূলে এই সঙ্কল্প [শান্তিপর্ব|১২৩|৪] । বিষয়ের সংস্পর্শে চিত্তে যখন প্রীতির ভাব জাগে এবং সেই প্রীতির সুখস্পর্শ পাওয়ার জন্য মনে যখন সঙ্কল্প জাগে তখন তাকে বলে কাম । কাম অশরীরী, অনঙ্গ [বনপর্ব|৩৩|৩০]

কিন্তু কামের স্বভাবই হল তা আগুনের (“দুষ্পুরণীয় অনল”) [গীতা|৩|৩৯] মত উত্তরোত্তর বেড়ে চলে । ত্যাগে, সংযমে অর্থাৎ ধর্ম দিয়ে তাকে শান্ত না করলে জীবনকে পুড়িয়ে ছারখার করে দেয় । ধর্মের অবিরোধী যে ‘কাম’ তা স্বয়ং ভগবান [গীতা|৭|১১]


2.4) মোক্ষ

মহাভারতের মোক্ষ তত্ত্বে এক বিপুল বৈরাগ্যের স্পর্শ পাওয়া যায় । দেখা যায় যে –
a) সংসারভূমিতে মানুষ ঘূর্ণ্যমান চক্রের মত সুখ দুঃখে আবর্তিত হচ্ছে (“সুখ-দুঃখে মনুষ্যানাং চক্রবৎ পরিবর্ততঃ”) ।

b) মৃত্যু এসে অতৃপ্ত জীবনকে বালির বাঁধের মত বার বার ভেঙ্গে দিচ্ছে (“সিদন্তে জলৈঃ সৈকতসেতবঃ”) ।

c) বনের হাতী যেমন কাদায় পড়ে, মানুষ তেমনি সংসারের শোকে পাঁকে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে (“শোকপঙ্কার্ণবে মগ্না বনগজা ইব”) ।

d) ওরই মধ্যে নিশ্চিন্তে অজ্ঞানের কম্বল চাপা দিয়ে শুয়ে আছে (“অবিজ্ঞানেন মহতা কম্বলেনেব সংবৃতা”) ।

“পিতা, মৃত্যুতাড়িত হয়ে মানুষ ছুটছে । জরা ব্যাধি শোক তাকে ঘিরে ফেলেছে । স্রোতের মত আয়ু শেষ হয়ে যাচ্ছে । মৃত্যু তো কারো জন্য অপেক্ষা করে না । ডোবার স্বল্প জলের মাছ আমরা । ক্রমশ জল শুকিয়ে আসছে । জেলে যেমন মাছ ধরে তেমনি কখন নিঃশব্দে মৃত্যু এসে আমাদের ধরবে । ... অতএব, পিতা আর সময় কোথায় ? কে জানে, আজ এই মুহূর্ত আমার শেষ মুহূর্ত কি না ?” [শান্তিপর্ব|১৭৫|৬-১৬]

জীবন এক অস্থির সমুদ্র । তাতে সুখ দুঃখের ঢেউ উঠছে ।
a) জলের স্রোতে ভেসে-চলা কাঠের টুকরোর মত আমরা পরস্পরের কাছে আসছি আবার দূরে সরে যাচ্ছি (“যথা কাষ্ঠঞ্চ কাষ্ঠঞ্চ সমেয়াতাং মহাদধৌ”) ।

b) আমার শরীরটাও তো আমার নয় (“আত্মাপি চায়ং ন মম”) ।

c) যখনই আমার বলে কিছু ভাবতে গিয়েছি তখনই দুঃখ এসে আমাকে ধরেছে (“কিঞ্চিদেব মমত্বেন তদা ভবতি কল্পিতম্‌ । তদেব পরিতাপার্থং সর্বং সম্পদ্যতে তথা”) । [শান্তিপর্ব|১৭৪|৪৪]

বীজ দগ্ধ হলে তা থেকে আর কোন অঙ্কুর জন্মায় না । তেমনি ত্রিবর্গের মধ্যে যে কামনার বীজ তাকে মোক্ষের আগুনে দগ্ধ করে নিলে আর দুঃখ থাকে না, শোক থাকে না [বনপর্ব|২১১|১৭]মহাভারতের এই মোক্ষ শ্রীকৃষ্ণের যোগতত্ত্ব, গীতার সারভূত ।

বিষয় সংসারে থাকলেই যে বন্ধন, এবং সংসারের সবকিছু পরিত্যাগ করলেই যে মোক্ষ তা নয় । ধনী ও নির্ধন, সংসারী ও সন্ন্যাসী সকলেই মোক্ষ লাভ করতে পারে । বন্ধনের মধ্যেও যিনি বন্ধনহীন, সংসারের মধ্যেও যিনি সন্ন্যাসী, তিনিই মোক্ষকে জেনেছেন ।


3) চাতুর্বর্ণ্য ও চতুরাশ্রমের উপযোগিতা


জীবনের এই চারটি বর্গের শুদ্ধি, পুষ্টি ও বৃদ্ধির জন্য গোটা সমাজকে চারটি পৃথক বর্ণে ভাগ করা হয়েছে (চাতুর্বর্ণ্য) – ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র । প্রত্যেক বর্ণ এক একটি পুরুষার্থকে কখনো এককভাবে, কখনো-বা মিশ্রভাবে সাধনার চেষ্টা করতে লাগল । সমাজের মত ব্যক্তিজীবনও চারটি পৃথক আশ্রমে (চতুরাশ্রম) – ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ্য, বানপ্রস্থ ও সন্ন্যাস । জীবনের এই চারটি আশ্রমের ভিতর দিয়ে ব্যক্তি তার চতুর্বর্গ সাধনে ব্রতী হল । আবার এই চারটি বিষম উপাদানকে একত্রে, একমুখী ও তীব্র করে ধরা হল সাধারণ গৃহস্থ জীবনের মধ্যে [আশ্বমেধিকপর্ব|৪৫|১৩] । সকল নদী যেমন সাগরে গিয়ে মেশে তেমনি সমাজের চারটি আশ্রমই গার্হস্থ্য আশ্রমে এসে মিশেছে [শান্তিপর্ব|২৯৫|৩৯] । এমনি করে ভারতবর্ষের প্রতিটি গৃহ হয়ে উঠেছে চতুর্বর্গ সাধনের পরীক্ষাগার, প্রয়োগশালা ।


4) পঞ্চপাণ্ডবের মতামত


বিষয়টি নাটকীয়ভাবে উপস্থাপিত হয়েছে শান্তিপর্বে, ১৬৭ অধ্যায়ে । পঞ্চপাণ্ডব নিজেদের মধ্যে মত বিনিময় করছেন । মহামতি বিদুর এই অধিবেশনের সভাপতি ।

যুধিষ্ঠির জিজ্ঞাসা করলেন – “সকল মানুষের মধ্যেই ধর্ম-অর্থ-কাম এই তিন বৃত্তি কম-বেশি সক্রিয় । কি করে এদের তারতম্য করা যায় ? কোন্‌টা উত্তম, কোন্‌টা মধ্যম, কোন্‌টাকেই-বা অধম বলব ? কেমন করে এদের উপরে কর্তৃত্ব অর্জন করা যায় ?”

বিদুর বললেন – “সমস্যাকে দেখতে হবে একটা পরম পদে উঠে দাঁড়িয়ে । তাহলেই তার মূল খুঁজে পাওয়া যাবে । চেতনার যে পদে উঠে দাঁড়ালে তোমার মন আর টলবে না, তখন দেখবে ধর্মের, অর্থের বা কামের মূল কোথায় । তারতম্যের দিক থেকে ধর্মই শ্রেষ্ঠ গুণ, অর্থ মধ্যম, আর কাম লঘু । [শান্তিপর্ব|১৬৭|৮]

অর্জুন বললেন – “মহারাজ, এই পৃথিবী কর্মভূমি । এবং সকল কর্মের উদ্দেশ্য অর্থপ্রাপ্তি । অর্থ ছাড়া ধর্মই বলুন আর কাম অর্থাৎ ভোগই বলুন কিছুই চরিতার্থ হয় না । ধর্ম এবং কাম অর্থেরই দুইটি অবয়ব । অর্থের সিদ্ধিতেই ধর্ম ও কামের সিদ্ধি ।” [শান্তিপর্ব|১৬৭|১৪]

নকুলসহদেব বললেন – “মহারাজ, অর্থ যে অত্যন্ত মূল্যবান এবং দুর্লভ তাতে কোন সন্দেহ নেই । ধার্মিক যদি দরিদ্র হন তাহলে তাঁর জীবন নিষ্ফল । কিন্তু তাই বলে অধার্মিক যদি ধনী হয়ে উঠলে সে বড় ভয়াবহ । অর্থ যখন ধর্মের সঙ্গে মিলিত হয়, ধর্ম যখন অর্থের সঙ্গে মিলিত হয়, তখনই তা অমৃত । ধর্ম-অর্থের সংযোগে যে ভোগ তাই সফল-কাম । প্রথমে চাই ধর্ম, ধর্ম থেকে অর্থ, এই দুয়ের মিলনে যে ভোগ তাই মানুষের সার্থক ত্রিবর্গ ।”

ভীম বললেন – “মহারাজ, ত্রিবর্গের মধ্যে কামই শ্রেষ্ঠ । জগতের সবকিছু চলছে কামপ্রবৃত্তিতে । ধর্ম ও অর্থ কামের উপরই নির্ভর করে আছে ।”

যুধিষ্ঠির বললেন – “দুঃখপীড়িত এই সংসারে মানুষ নিজের কামনার জালে নিজেই মাকড়সার মত জড়িয়ে আছে । স্বয়ং ব্রহ্মা বলেছেন, বিষয়বাসনা থাকতে মানুষের মুক্তি নেই । শুধু যে পাপে মানুষ কষ্ট পায়, অর্থে ও কামে মানুষ অস্থির হয় তাই নয়, ধর্ম এবং পুণ্য এক ধরণের বন্ধন । শুধু পাপ ও অধর্ম থেকেই নয়, ধর্ম এবং পুণ্যেরও ঊর্ধ্বে উঠতে হবে । ভাল এবং মন্দ উভয়ের দোষ থেকে মুক্ত হলে, মাটি আর সোনা এক হয়ে যায় ।” [শান্তিপর্ব|১৬৭|৪৪]

যুধিষ্ঠির আরও বলছেন – “ধর্ম, অর্থ, কামের ঊর্ধ্বে উঠেই তাদের উপর সম্যক্‌ কর্তৃত্ব লাভ হয় ।”


5) উপসংহার


বস্তুত এখানে যুধিষ্ঠিরের বক্তব্য ভগবদ্গীতারই প্রতিধ্বনি বা সংক্ষিপ্তসার । অতএব জীবনে কোন্‌ পথ ধরে চলতে হবে, কি করতে হবে, তারই অতি সূক্ষ্ম নির্দেশ এই বিপুল মহাভারতের অন্তরতম তাৎপর্য ।


6) যক্ষ ও যুধিষ্ঠির সংবাদ


... সায়াহ্নে হ্রদের ধারে একা দাঁড়িয়ে যুধিষ্ঠির । তাঁর বীরশ্রেষ্ঠ চার ভাইয়ের মৃতদেহ ভূমিতে লুটিয়ে । তাই দেখে যুধিষ্ঠির শোকার্ত হয়ে বিলাপ করতে লাগলেন । অনেকক্ষণ পরে শেষে ভাবতে লাগলেন, এ কেমন করে সম্ভব ? এঁদের গায়ে তো কোন অস্ত্রাঘাতের চিহ্ন নেই । কারো শরাসনও ভঙ্গ হয়নি । মাটিতে কারো পদচিহ্নও নেই । তবে কি মহাশক্তিধর অলৌকিক কোন জীব এঁদের হত্যা করেছে ? অথবা দুর্যোধন শকুনির লোক এসে কি গুপ্তহত্যা করেছে ? জলে বিষ মেশানো নেই তো ? তিনি ভাল করে সরোবরের জল পরীক্ষা করে দেখলেন । তা বিষদুষিত দেখলেন না ।

যুধিষ্ঠির তখন সরোবরে নেমে জল পান করতে গেলেন, এমন সময় অন্তরীক্ষ থেকে আকাশবাণী গর্জন করে উঠল – “আমাকে অবজ্ঞা করার সাহস করো না । কুন্তিনন্দন, আমার প্রশ্নগুলির আগে উত্তর দাও, তারপরে জল পান করে জল নিয়ে যাও ।” [বনপর্ব|৩১৩]

যুধিষ্ঠির থমকে দাঁড়ালেন । তিনি অন্যদের মত হঠকারী নন । তিনি শান্ত, তিনি ধীর । অশরীরী কণ্ঠকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞাসা করলেন – “আমি জানতে চাই, কে আপনি ?”

“আমি যক্ষ ।”

মহাকায় বিকটাকার সূর্য ও অগ্নির ন্যায় তেজস্বী এক যক্ষ বৃক্ষে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে মেঘগম্ভীর স্বরে বললেন, “রাজা, আমি বহুবার বারণ করেছিলাম তথাপি তোমার ভ্রাতারা জল পান করতে গিয়েছিল । তাই আমি তাদের প্রাণহরণ করেছি । যুধিষ্ঠির, তুমি আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দাও, তারপর জল পান কর ।”

যুধিষ্ঠির বললেন – “আপনি প্রশ্ন করুন । আমি আমার বুদ্ধি অনুসারে উত্তর দেব ।”

যুধিষ্ঠিরকে মোট ৩৪’টি প্রশ্ন করেছিলেন যক্ষ । প্রতিটি প্রশ্নের ভাঁজে-ভাঁজে আবার আরো দুতিনটি করে প্রশ্ন ।

প্রশ্ন ১ : “কে সূর্যকে ঊর্ধ্বে ধরে রেখেছে ? কে সূর্যের চারিদিকে ভ্রমণ করে ? কোথায় তিনি প্রতিষ্ঠিত আছেন ?”
উত্তর ১ : “ব্রহ্মাই সূর্যকে উদিত করান । দেবগণই তাঁর পার্শ্বচর, ধর্মই সূর্যকে অস্তগমন করান । এবং সত্যেই তিনি প্রতিষ্ঠিত ।”

প্রশ্ন ২ : “ব্রাহ্মণ হয় কি প্রকারে ? মানুষ কিসে মহৎ পদ লাভ করে ? কিসে দ্বিতীয়বান্‌ হয় ? কিসে বুদ্ধিমান হয়  ?”
উত্তর ২ : “বেদ অধ্যয়নেই ব্রাহ্মণ । তপস্যাতেই মহৎ পদ লাভ হয় । ধৈর্য মানুষকে সহায়বান্‌ দ্বিতীয়বান্‌ করে । জ্ঞানীব্যক্তির সেবার দ্বারাই মানুষ বুদ্ধিমান হয় ।”

প্রশ্ন ৩ : “ব্রাহ্মণের দেবত্ব কি ? কোন্‌ ধর্মের জন্য তাঁরা সাধু ? তাঁদের মনুষ্যভাব কি ? অসাধুভাব কেন হয় ?”
উত্তর ৩ : “স্বাধ্যায়ই ব্রাহ্মণের দেবত্ব । তপস্যার ফলে সাধুতা । মৃত্যু আছে তাই তাঁদের মনুষ্যভাব । পরনিন্দার ফলে তাঁরা অসাধু হন ।”

প্রশ্ন ৪ : ক্ষত্রিয়ের দেবত্ব কি ? তাঁদের ধর্ম কি ? কিসে তাঁদের মনুষ্যভাব ? তাঁদের অসাধুতা কি ?”
উত্তর ৪ : “অস্ত্রনিপুণতাই ক্ষত্রিয়ের দেবত্ব । যজ্ঞই তাঁদের সাধু ধর্ম । ভয়ই মনুষ্যভাব । শরণাগতকে পরিত্যাগই তাঁদের অসাধুভাব ।”

প্রশ্ন ৫ : “যজ্ঞিয় সাম কি ? যজ্ঞিয় যজুঃ কি ? যজ্ঞকে বরণ করে কি ? কি সেই, যাকে যজ্ঞ অতিক্রম করে না ?”
উত্তর ৫ : “প্রাণ যজ্ঞিয় সাম । মন যজ্ঞিয় যজুঃ । ঋক্‌মন্ত্র যজ্ঞকে বরণ করে । যজ্ঞ তাকে অতিক্রম করতে পারে না ।”

প্রশ্ন ৬ : “কৃষকের কাছে প্রধান কি ? বপনকারীর কাছে প্রধান কি ? প্রতিষ্ঠিত ধনীর কাছে শ্রেষ্ঠ কি ? জনকের কাছে প্রধান কি ?”
উত্তর ৬ : “কৃষকের কাছে বর্ষণ, রোপনকারীর কাছে বীজ, ধনীর কাছে গো-সম্পদ, সন্তানেচ্ছুর কাছে পুত্রই শ্রেষ্ঠ ।”

প্রশ্ন ৭ : “এমন ব্যক্তি কে আছে যে বুদ্ধিমান, সকলের সম্মানিত, বিষয়ভোগে নিরত, শ্বাস-প্রশ্বাস নিচ্ছে তথাপি জীবিত নয় ?”
উত্তর ৭ : “যে ব্যক্তি দেবতা, অতিথি, ভৃত্য, পিতৃপুরুষগণ এবং আত্মা – এই পঞ্চবিধকে দানাদি দিয়ে পোষণ করে না, সে জীবিত থেকেও মৃত ।”

প্রশ্ন ৮ : “পৃথিবীর অপেক্ষা গুরুতর কি ? আকাশের থেকে উচ্চতর, বায়ুর চেয়ে দ্রুততর এবং তৃণ অপেক্ষা বহুতর কি ?”
উত্তর ৮ : “মাতা পৃথিবী অপেক্ষা গুরুতর । পিতা আকাশ অপেক্ষা উচ্চতর । মন বায়ু অপেক্ষা দ্রুততর এবং চিন্তা তৃণ অপেক্ষা বহুতর ।”

প্রশ্ন ৯ : “তাকিয়ে ঘুমায় কে ? কে জন্মের পরেও নিস্পন্দ থাকে ? কার হৃদয় নেই ? বেগ দ্বারা কে বৃদ্ধি পায় ?”
উত্তর ৯ : “মৎস্য নিদ্রাকালেও চক্ষু মুদ্রিত করে না । অণ্ড প্রসূত হয়েও স্পন্দিত হয় না । পাষাণের হৃদয় নেই । নদী বেগে বৃদ্ধি পায় ।”

প্রশ্ন ১০ : “প্রবাসী, গৃহবাসী, আতুর ও মুমূর্ষু – এদের বন্ধু কে ?”
উত্তর ১০ : “প্রবাসীর মিত্র সহযাত্রী । গৃহবাসীর মিত্র ভার্যা । আতুরের মিত্র চিকিৎসক । মুমূর্ষুর মিত্র দান ।”

প্রশ্ন ১১ : “সকল প্রাণীর অতিথি কে ? সনাতন ধর্ম কি ? অমৃত কি ? জগতের স্বরূপ কি ?”
উত্তর ১১ : “সকল প্রাণীর অতিথি অগ্নি । অবিনাশী নিত্যধর্মই সনাতন ধর্ম । গো-দুগ্ধই অমৃত । বায়ু সর্বজগতের স্বরূপ ।”

প্রশ্ন ১২ : “একাকী কে বিচরণ করে ? জাত হয়েও আবার জন্মায় কে ? হিমের ঔষধ কি ? মহাক্ষেত্র কি ?”
উত্তর ১২ : “সূর্যই একাকী বিচরণ করেন । চন্দ্রমা পুনঃপুনঃ জন্মগ্রহণ করেন । অগ্নিই হিমের ঔষধ । এই পৃথিবীই মহাক্ষেত্র ।”

প্রশ্ন ১৩ : “ধর্মের, যশের, স্বর্গের ও সুখের মুখ্যস্থান কি ?”
উত্তর ১৩ : “ধর্মের মুখ্যস্থান দক্ষতা । যশের মুখ্যস্থান দান । সত্য স্বর্গের এবং চরিত্র সুখের মুখ্যস্থান ।”

প্রশ্ন ১৪ : “মনুষ্যের আত্মা কে ? দৈবকৃত সখা কে ? জীবনের সহায় কি ? পরম অবলম্বন কি ?”
উত্তর ১৪ : “পুত্রই মানুষের আত্মা । ভার্যাই দৈবকৃত সখা । মেঘ তার সহায় এবং দানই পরম অবলম্বন ।”

প্রশ্ন ১৫ : “উত্তম গুণ কি ? উত্তম ধন কি ? উত্তম লাভ কি ?  উত্তম সুখ কি ?”
উত্তর ১৫ : “দক্ষতা উত্তম গুণ । বেদজ্ঞান উত্তম ধন । আরোগ্য উত্তম লাভ । অন্তরের সন্তোষ উত্তম সুখ ।”

প্রশ্ন ১৬ : “কোন্‌ ধর্ম শ্রেষ্ঠ ? কোন্‌ ধর্ম সদা ফলদায়ী ? কাকে সংযত করলে আর অনুশোচনা করতে হয় না ? কার দ্বারা সন্ধিভঙ্গ হয় না ?”
উত্তর ১৬ : “দয়া শ্রেষ্ঠ ধর্ম । বেদোক্ত ত্রয়ীধর্মই সদা ফলদায়ী । মনকে সংযত করলে আর অনুশোচনা করতে হয় না । সাধু ব্যক্তি দ্বারা সন্ধিভঙ্গ হয় না ।”

প্রশ্ন ১৭ : “কি ত্যাগ করলে লোকপ্রিয় হওয়া যায় ? কি ত্যাগ করলে শোক হয় না ? কি ত্যাগ করলে সুখী হয় ?”
উত্তর ১৭ : “অভিমান ত্যাগ করলে লোকপ্রিয় হওয়া যায় । ক্রোধ ত্যাগ করলে কখনও শোক করতে হয় না । কামনা ত্যাগ করলে লোকে সুখী হয় ।”

প্রশ্ন ১৮ : “ব্রাহ্মণকে, নট ও নর্তককে, ভৃত্য এবং রাজাকে কেন দান করা হয় ?”
উত্তর ১৮ : “ধর্মের জন্য ব্রাহ্মণকে, যশের জন্য নট ও নর্তককে, প্রতিপালনের জন্য ভৃত্যকে এবং ভয়ের জন্য রাজাকে দান করা হয় ।”

প্রশ্ন ১৯ : “জগৎ কি দিয়ে আবৃত ? কেন তা প্রকাশিত হয় না ? কিসের জন্য মানুষ মিত্রকে ত্যাগ করে ? কিসের জন্য মানুষ স্বর্গে যায় না ?”
উত্তর ১৯ : “অজ্ঞানের দ্বারা জগৎ আবৃত । তমোগুণের দ্বারা একে অপরকে প্রকাশিত করে না  । লোভের বশে মানুষ মিত্রকে ত্যাগ করে । সংসার-আসক্তির জন্য মানুষ স্বর্গে যায় না ।”

প্রশ্ন ২০ : “কোন্‌ মানুষ, কোন্‌ রাষ্ট্র, কিরূপ শ্রাদ্ধ এবং কিরূপ যজ্ঞকে মৃত বলে ?”
উত্তর ২০ : “দরিদ্র মানুষ, অরাজক রাষ্ট্র, ব্রাহ্মণহীন শ্রাদ্ধ এবং দক্ষিণাবিহীন যজ্ঞকে মৃত বলে ।”

যক্ষের বোধহয় প্রশ্নবাণ শেষ হয়ে আসছে । তাই একটু থেমে জিজ্ঞাসা করলেন -

প্রশ্ন ২১ : “কাকে দিক্‌, কাকে উদক, কাকে অন্ন এবং কাকে বিষ বলে ? শ্রাদ্ধের কাল কি ? এই কথার উত্তর দিয়ে জলপান করতে পার ।”
উত্তর ২১ : “সাধুগণ দিক্‌, আকাশই জল, ধেনুই অন্ন, যাচ্‌ঞা বিষ । ব্রাহ্মণই হলেন শ্রাদ্ধের কাল ।

এই বলে যুধিষ্ঠির পাল্‌টা প্রশ্ন করলেন – “এবিষয়ে আপনি কি বলেন ?” উত্তর না দিয়ে যক্ষ আবার প্রশ্ন করলেন -

প্রশ্ন ২২ : “তপস্যার লক্ষণ কি ? দম কাকে বলে ? পরম ক্ষমা এবং পরম লজ্জা কি ?”
উত্তর ২২ : “স্বধর্মনিষ্ঠাই তপস্যা । মনের দমনই দম । দ্বন্দ্ব-সহিষ্ণুতাই ক্ষমা । অকার্য থেকে নিবৃত্ত হওয়ার নামই লজ্জা ।”

প্রশ্ন ২৩ : “জ্ঞান কি ? দয়া, শম, সরলতাই-বা কি ?”
উত্তর ২৩ : “আত্মতত্ত্বের অপরোক্ষ জ্ঞানই জ্ঞান । চিত্তের শান্তিই শম । সকলের সুখ ইচ্ছা করা দয়া এবং সমচিত্ততাই সরলতা ।”

প্রশ্ন ২৪ : “কোন্‌ শত্রু দুর্জয় ? কোন্‌ ব্যাধি অশেষ ? কে সাধু, কেই-বা অসাধু ?”
উত্তর ২৪ : “ক্রোধ দুর্জয় শত্রু । লোভ মানুষের অশেষ ব্যাধি । সর্বজীবের হিতাকাঙ্ক্ষী যিনি তিনিই সাধু । নির্দয় মানুষই অসাধু ।”

প্রশ্ন ২৫ : “রাজন্‌, মান মোহ আলস্য এবং শোক কাকে বলে ?”
উত্তর ২৫ : “ধর্মমূঢ়তাই মোহ । আত্মাভিমানই মান । ধর্মে নিষ্ক্রিয়তাই আলস্য । অজ্ঞানই শোক ।”

প্রশ্ন ২৬ : “ঋষিরা ধৈর্য, স্থৈর্য, পরম স্নান ও পরম দান কাকে বলেছেন ?”
উত্তর ২৬ : “স্বধর্মে স্থিরতা স্থৈর্য । ইন্দ্রিয়সংযম ধৈর্য । মনের মালিন্য ধুয়ে ফেলাই পরম স্নান । প্রাণীগণের রক্ষা পরম দান ।”

প্রশ্ন ২৭ : “পণ্ডিত, নাস্তিক, মূর্খ, কাম এবং মাৎসর্য কাকে বলে ?”
উত্তর ২৭ : “ধর্মজ্ঞ ব্যক্তিকে পণ্ডিত বলে । নাস্তিককে মূর্খ বলা হয় । সংসারের হেতু কাম । হৃদয়ের সন্তাপকে বলে মাৎসর্য ।”

প্রশ্ন ২৮ : “অহঙ্কার, দম্ভ, পরম দৈব এবং পৈশুন্য (খলতা) কাকে বলে ?”
উত্তর ২৮ : “অজ্ঞানকে অহঙ্কার বলে । নিজেকে অত্যন্ত ধার্মিক মনে করাই দম্ভ । দানের ফল পরম দৈব । অন্যের উপর দোষারোপ করাকেই পৈশুন্য বলে ।”

যক্ষ এবার তাঁর মোক্ষম প্রশ্নটি ছুড়লেন -

প্রশ্ন ২৯ : “ধর্ম অর্থ কাম এরা পরস্পর বিরোধী । নিত্য বিরোধী এই তিনের একত্র অবস্থান কি সম্ভব ?
উত্তর ২৯ : “যখন ধর্ম এবং ভার্যা পরস্পর অবিরোধী হয় তখন সদা পরস্পর বিরোধী ধর্ম অর্থ কামের একত্র অবস্থা সম্ভব ।”

প্রশ্নটি যেমন জটিল এবং ব্যাপক, যুধিষ্ঠিরের উত্তরও তেমনি ঋজু এবং সরল । মহাভারতের মধ্যে ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষ এই চারটি তত্ত্বেরই সমন্বয় ও সিদ্ধির কথা বলা হয়েছে [আদিপর্ব|১|৮৫] অতএব যক্ষের এই প্রশ্নটি মহাভারতের অন্যতম মূল প্রশ্নেরই এক গ্রন্থগ্রন্থি । (উভয়ভারতীর এমনি এক প্রশ্নের উত্তর দিতে সন্ন্যাসী শঙ্করাচার্যকে কিছু দিনের জন্য ফিরে যেতে হয়েছিল সংসারে ।) যুধিষ্ঠিরের এই সংক্ষিপ্ত উত্তরে যক্ষ বোধহয় অবাক হলেন । সঙ্গে সঙ্গে একটা পাল্‌টা প্রশ্ন ছুড়লেন । বলছেন, তাড়াতাড়ি উত্তর দাও -

প্রশ্ন ৩০ : “কে অক্ষয় নরকে গমন করে ?”
উত্তর ৩০ : “প্রার্থী দরিদ্র ব্রাহ্মণকে যে নিজেই ডেকে এনে পরে ‘নেই’ বলে ফিরিয়ে দেয় সেই অক্ষয় নরকে যায় । ধর্মশাস্ত্র বেদ ব্রাহ্মণ দেবতা ও পিতৃপুরুষদের প্রতি যে মন্দবুদ্ধি রাখে সেই অক্ষয় নরকে যায় । অর্থ থাকতেও যে দান করে না, দানযোগ্য ব্রাহ্মণকে দেয় না, স্ত্রীপুত্রদের দেবার সময় ‘নেই’ বলে প্রত্যাখ্যান করে, সেই অক্ষয় নরকে যায় ।”

প্রশ্ন ৩১ : “কুল, সদাচার, স্বাধ্যায় এবং শাস্ত্রশ্রবণ – এর মধ্যে কোন্‌টির দ্বারা উত্তম ব্রাহ্মণত্ব লাভ হয় ?”
উত্তর ৩১ : “কুল, স্বাধ্যায়, শাস্ত্রশ্রবণ এর কোনটাই উত্তম ব্রাহ্মণত্বের কারণ নয় । ব্রাহ্মণোচিত বৃত্তির আচরণেই উত্তম ব্রাহ্মণত্ব লাভ হয় । চারি বেদে পারদর্শী হয়েও যে ব্রাহ্মণ দুরাচারী সে শূদ্রের অধম । আবার বিদ্বান্‌ না হয়েও যিনি ব্রতপরায়ণ, দমগুণসম্পন্ন তিনিই ব্রাহ্মণ ।”

প্রশ্ন ৩২ : “মিষ্টভাষী, বিচার-বিবেচনা করে যিনি কাজ করেন, যিনি বহু মিত্রকারী ধর্মপরায়ণ তিনি কি লাভ করেন ?”
উত্তর ৩২ : “মিষ্টভাষী সকলের প্রিয় হন । ভেবেচিন্তে যিনি কাজ করেন তিনি বেশী সাফল্য লাভ করেন । বহু মিত্রকারী সুখী হন । আর ধর্মপরায়ণ ব্যক্তি সদ্‌গতি লাভ করেন ।”

এবার যক্ষ নিক্ষেপ করলেন তাঁর চতুর্মুখী এক ভয়ঙ্কর গূঢ় প্রশ্ন -

প্রশ্ন ৩৩ : “সুখী কে ? আশ্চর্য কি ? পথ কি ? বার্তা কি ?”
উত্তর ৩৩ : “দিবসের পঞ্চম অথবা ষষ্ঠভাগে (সন্ধ্যায়) নিজের গৃহে বসে যে শাকান্ন আহার করে, যে অঋণী অপ্রবাসী, সেই সুখী
প্রতিদিন মানুষের মৃত্যু হচ্ছে দেখেও মানুষ চিরকাল বেঁচে থাকতে চায়, এর চেয়ে আশ্চর্য আর কি আছে ?
তর্কের শেষ নেই, শ্রুতিসমূহও বিভিন্ন, এমন মুনি নেই যাঁর মত ভিন্ন নয়, তার কোনটাই একমাত্র প্রমাণ বলে গণ্য নয়, সুতরাং ধর্মের তত্ত্ব গুহায় নিহিত । তাহলে মহাজন যে পথে গেছেন তাঁদের পথই একমাত্র পথ
এই মহামোহরূপ কটাহে মহাকাল প্রাণসমূহকে পাক করছেন । সূর্য তার অগ্নি, রাত্রিদিন তার ইন্ধন, মাস ঋতু তার আলোড়নের দর্বী (হাতা), এই হল বার্তা ।”

যক্ষ সন্তুষ্ট হয়ে বললেন, তুমি আমার প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দিয়েছ । এখন বল -

প্রশ্ন ৩৪ : “পুরুষ কে ? সর্বধনেশ্বর কে ?”
উত্তর ৩৪ : “পুণ্যকর্মের যশোগৌরব পৃথিবী ও স্বর্গ স্পর্শ করে, যতকাল সেই গৌরববাণী থাকে ততকালই লোকে পুরুষ বলে গণ্য হয় । প্রিয়-অপ্রিয়, সুখ-দুঃখ, অতীত-ভবিষ্যৎ যিনি তুল্যজ্ঞান করেন তিনিই সর্বধনেশ্বর ।”

এবার যক্ষ ক্ষান্ত হলেন । তাঁর আর কোন প্রশ্ন নেই । কিন্তু যুধিষ্ঠিরের পরীক্ষা তখনও বুঝি শেষ হয়নি । যক্ষ দেখতে চান, যুধিষ্ঠির এতক্ষণ যে সব উত্তর দিলেন তা কেবল মুখের কথা না তাঁর জীবনের ধর্ম ? কেননা, জ্ঞানকে বুদ্ধি দিয়ে পাওয়া এক কথা আর তাকে জীবনে সত্য করে তোলা আর এক তপস্যা ।

যক্ষ বললেন – “রাজা, তুমি তোমার এক ভ্রাতার জীবন প্রার্থনা কর ।”

যুধিষ্ঠির বললেন – “তাহলে নকুলকে বাঁচিয়ে দিন ।”

যক্ষ প্রশ্ন করলেন - “ভীম অর্জুনের জীবন না চেয়ে তুমি নকুলের জীবন চাইলে কেন ?”

যুধিষ্ঠির বললেন – “ধর্মকে রক্ষা করলে ধর্মই আমাকে রক্ষা করবে । কুন্তী ও মাদ্রী দুজনেই আমার মাতা । আমি চাই, আমার দুই মায়েরই অন্তত দুটি সন্তান বেঁচে থাকুক ।”

যক্ষ এবার সন্তুষ্ট হয়ে বললেন – “ভারতশ্রেষ্ঠ, তুমি অর্থ ও কাম অপেক্ষা অনৃশংসতাই শ্রেষ্ঠ মনে কর, অতএব তোমার সকল ভ্রাতাই জীবন লাভ করুক ।”

যুধিষ্ঠিরের চার ভাই তখন জীবন পেয়ে জেগে উঠলেন ।

তিনি বিস্মিত হয়ে যক্ষকে জিজ্ঞাসা করলেন – “আপনি কোন দেবতা ? মনে হচ্ছে আপনি আমাদের পরম সুহৃদ ।” এতক্ষণে যুধিষ্ঠিরের চিনতে ভুল হয়নি । তিনি জিজ্ঞাসা করলেন – “আপনি আমাদের পিতা নয় তো ?”

যক্ষ বললেন – “বৎস, আমি তোমার পিতা ধর্ম । তুমি বর প্রার্থনা কর ।”

পিতা-পুত্রের এই প্রথম সাক্ষাৎ । ইচ্ছা করলেই যুধিষ্ঠির বর প্রার্থনা করে আবার ফিরে পেতে পারেন তাঁর হারানো রাজত্ব । কিন্তু এত কাণ্ডের মধ্যেও যুধিষ্ঠির ভোলেননি সেই অসহায় ব্রাহ্মণের কথা । বললেন – “দরিদ্র ব্রাহ্মণ তাঁর অরণিমন্থ ফিরে পান শুধু এই বর প্রার্থনা করি ।”

ধর্ম বললেন – “আমিই মৃগরূপ ধারণ করে ব্রাহ্মণের অরণি হরণ করেছিলাম শুধু তোমাকে পরীক্ষা করার জন্য । আমি ব্রাহ্মণকে তা ফিরিয়ে দিচ্ছি । তুমি অন্য এক বর প্রার্থনা কর ।”...(সংক্ষিপ্ত)

___________________________
Reference:
অমলেশ ভট্টাচার্য,১৯৮৫ : "মহাভারতের কথা", প্রকাশক : আর্যভারতী
Amalesh Bhattacharya, 1985: "Mahabharater Katha"; Published by Aryabharati.

Disclaimer:
This is a personal, non-commercial, research-oriented effort of a novice religious wanderer.
এটি আধ্যাত্মিক পথের এক অর্বাচীন পথিকের ব্যক্তিগত, অবাণিজ্যিক, গবেষণা-ধর্মী প্রয়াস মাত্র ।

[Digitised by typing mostly in MS-Word/Notepad using Unicode Bengali "Siyam Rupali" font and Avro Phonetic Keyboard for transliteration. Uploaded by rk]

<Contents>

No comments:

Post a Comment