Thursday, March 12, 2015

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা : অষ্টাদশ অধ্যায় - মোক্ষযোগ (18-Jagadishchandra)


|||||||||১০|১১|১২|১৩|১৪|১৫|১৬|১৭|১৮
(গীতাশাস্ত্রী জগদীশচন্দ্র ঘোষ)*

অর্জুন কহিলেন -
হে মহাবাহো, হে হৃষিকেষ, হে কেশিনিসূদন, সন্ন্যাস ও ত্যাগের তত্ত্ব কি, তাহা পৃথক্‌ ভাবে জানিতে ইচ্ছা করি । ১

শ্রীভগবান্‌ বলিলেন -
কাম্য কর্মের ত্যাগকেই পণ্ডিতগণ সন্ন্যাস বলিয়া জানেন; এবং সমস্ত কর্মের ফল-ত্যাগকেই সূক্ষ্মদর্শিগণ ত্যাগ বলিয়া থাকেন । ২

কোন কোন (সাংখ্য) পণ্ডিতগণ বলেন যে, কর্মমাত্রই দোষযুক্ত, অতএব ত্যাজ্য; অন্য কেহ কেহ (মীমাংসকগণ) বলেন যে, যজ্ঞ, দান ও তপঃকর্ম ত্যাজ্য নহে । ৩

হে ভরতশ্রেষ্ঠ, ত্যাগ বিষয়ে আমার সিদ্ধান্ত শ্রবণ কর; হে পুরুষশ্রেষ্ঠ, ত্যাগ ত্রিবিধ বলিয়া কথিত হইয়াছে । ৪

যজ্ঞ, দান ও তপস্যারূপ কর্ম ত্যাজ্য নহে, উহা করাই কর্তব্য । যজ্ঞ, দান ও তপস্যা বিদ্বান্‌গণেরও চিত্তশুদ্ধিকর । ৫

হে পার্থ, এই সকল কর্মও কর্তৃত্বাভিমান ও ফল কামনা ত্যাগ করিয়া করা কর্তব্য । ইহাই আমার নিশ্চিত মত এবং ইহাই উত্তম মত । ৬

স্বধর্ম বলিয়া যাহার যে কর্ম নির্দিষ্ট আছে, সেই কর্ম ত্যাগ করা কর্তব্য নহে । মোহবশতঃ সেই কর্ম ত্যাগ করাকে তামসত্যাগ বলে । ৭

কর্মানুষ্ঠান দুঃখকর মনে করিয়া কায়িক ক্লেশের ভয়ে যে কর্মত্যাগ করা হয়, তাহা রাজসত্যাগ । যিনি এই ভাবে কর্মত্যাগ করেন, তিনি প্রকৃত ত্যাগের ফল লাভ করেন না । ৮

হে অর্জুন, কর্তৃত্বাভিমান ও ফলকামনা ত্যাগ করিয়া, কেবল কর্তব্য বলিয়া যে বিহিত কর্ম করা হয়, তাহাই সাত্ত্বিক ত্যাগ বলিয়া কথিত হয় । ৯ (অর্থাৎ কর্তৃত্বাভিমান ও ফলকামনা ত্যাগই সাত্ত্বিক ত্যাগ, কর্মত্যাগ নহে) ।

সত্ত্বগুণবিশিষ্ট, স্থিরবুদ্ধি, সংশয়শূন্য পূর্বোক্ত সাত্ত্বিক ত্যাগী পুরুষ দুঃখকর কর্মেও দ্বেষ করেন না এবং সুখকর কর্মেও আসক্ত হন না । ১০ (অর্থাৎ রাগদ্বেষ হইতে বিমুক্ত থাকিয়া কেবল কর্তব্যবোধে কর্ম করিয়া থাকেন) ।

যে দেহ ধারণ করে তাহার পক্ষে কর্ম সম্পূর্ণরূপে ত্যাগ করা সম্ভবপর নয়; অতএব যিনি (কর্ম করিয়াও) কর্মফল ত্যাগ করেন, তিনিই প্রকৃত ত্যাগী বলিয়া কথিত হন । ১১

যাঁহারা ফল-কামনা ত্যাগ করেন না সেই অত্যাগী পুরুষগণের মৃত্যুর পরে অনিষ্ট, ইষ্ট ও ইষ্টানিষ্ট-মিশ্র, তাঁহাদের কর্মানুসারে এই তিন প্রকার ফল লাভ হয় । কিন্তু সন্ন্যাসীদের অর্থাৎ যাঁহারা কর্মফল ত্যাগ করিয়া কর্ম করেন, তাঁহাদের কখনও ফল লাভ হয় না । ১২ (অর্থাৎ তাঁহারা কর্ম করিলেও কর্মে আবদ্ধ হন না) ।

হে মহাবাহো, যে কোন কর্ম সম্পাদনের পক্ষে পাঁচটি কারণ সাংখ্য-সিদ্ধান্তে বর্ণিত আছে, তাহা আমার নিকট শ্রবণ কর । ১৩

অধিষ্ঠান (স্থান), কর্তা, বিবিধ করণ বা সাধন (যন্ত্র), কর্তার অনেক প্রকার চেষ্টা বা ব্যাপার এবং পঞ্চম কারণ দৈব । ১৪

মনুষ্য শরীর, মন ও বাক্যদ্বারা ন্যায্য বা অন্যায্য যে কোন কর্ম করে, পূর্বোক্ত পাঁচটি তাহার কারণ । ১৫

বাস্তবিক অবস্থা এইরূপ হইলেও (অর্থাৎ  পূর্বোক্ত পাঁচটি কর্মের কারণ হইলেও) নিঃসঙ্গ আত্মাকে যে কর্তা বলিয়া মনে করে, তাহার বুদ্ধি শাস্ত্রাদি জ্ঞানের দ্বারা পরিমার্জিত না হওয়ায় সে প্রকৃত তত্ত্ব দেখিতে পায় না । ১৬

যাঁহার 'আমি কর্তা' এই ভাব নাই, যাঁহার বুদ্ধি কর্মের ফলাফলে আসক্ত হয় না, তিনি সমস্ত লোক হনন করিলেও কিছুই হনন করেন না এবং তাহার ফলে আবদ্ধও হন না । ১৭

জ্ঞান, জ্ঞেয় ও পরিজ্ঞাতা, এই তিনটি কর্মচোদনা অর্থাৎ কর্মপ্রবর্তক বা কর্মপ্রবৃত্তির হেতু । করণ, কর্ম, কর্তা, এই তিনটি কর্মসংগ্রহ বা ক্রিয়ার আশ্রয় । ১৮

কাপিল সাংখ্যশাস্ত্রে জ্ঞান, কর্ম ও কর্তা সত্ত্বাদি গুণভেদে তিন প্রকার কথিত হইয়াছে, সে সকল যথাবৎ কহিতেছি, শ্রবণ কর । ১৯

যে জ্ঞানদ্বারা পরস্পর বিভক্তভাবে প্রতীয়মান সর্বভূতে এক অদ্বয় অব্যয় বস্তু (পরমাত্মতত্ত্ব) পরিদৃষ্ট হয়, সেই জ্ঞান সাত্ত্বিক জানিবে । ২০

যে জ্ঞানের দ্বারা ভিন্ন ভিন্ন ভূতসমূহে পৃথক্‌ পৃথক্‌ ভাবের অনুভূতি হয় তাহা রাজস জ্ঞান । ২১

যাহা প্রকৃত তত্ত্ব তাহা না বুঝিয়া, ইহাই যাহা কিছু সমস্ত, এইরূপ বুদ্ধিতে কোন একমাত্র বিষয়ে আসক্ত থাকে সেই যুক্তিবিরুদ্ধ, অযথার্থ, তুচ্ছ জ্ঞানকে তামস জ্ঞান কহে । ২২

কর্মকর্তা ফলকামনা পরিত্যাগপূর্বক রাগদ্বেষ-বর্জিত হইয়া অনাসক্তভাবে অবশ্যকর্তব্যরূপে বিহিত যে কর্ম করেন, তাহাকে সাত্ত্বিক কর্ম বলা হয় । ২৩

আর, ফলাকাঙ্ক্ষা করিয়া অথবা অহঙ্কার সহকারে বহু আয়াস স্বীকার করিয়া যে কর্ম অনুষ্ঠিত হয়, তাহা রাজস কর্ম বলিয়া কথিত হয় । ২৪

ভাবিফল কি হইবে, নিজের সামর্থ্য কতটুকু, প্রাণিহিংসাদি হইবে কিনা, পরিণামে কিরূপ হানি হওয়ার সম্ভাবনা - এইসকল বিচার না করিয়া মোহবশতঃ যে কর্ম আরম্ভ করা হয়, তাহা তামস কর্ম বলিয়া কথিত হয় । ২৫

যিনি আসক্তিবর্জিত, যিনি 'আমি', 'আমার' বলেন না অর্থাৎ কর্তৃত্বাভিমান ও মমত্ববর্জিত, যিনি সিদ্ধি ও অসিদ্ধিতে হর্ষবিষাদশূন্য হইয়া নির্বিকার চিত্তে ধৈর্য ও উৎসাহ সহকারে কর্ম করেন, তাঁহাকে সাত্ত্বিক কর্তা বলে । ২৬

বিষয়াসক্ত, কর্মফলাকাঙ্ক্ষী, লোভী, হিংসাপরায়ণ, শৌচাচারহীন, সিদ্ধিলাভে হর্ষান্বিত ও অসিদ্ধিতে শোকান্বিত - এরূপ কর্তাকে রাজস কর্তা বলে । ২৭

যে অস্থিরমতি, অভদ্র, অনম্র, শঠ, পরবৃত্তিনাশক, অলস, সদা অবসন্নচিত্ত ও দীর্ঘসূত্রী, তাহাকে তামস কর্তা বলে । ২৮

হে ধনঞ্জয়, বুদ্ধির ও ধৃতিরও যে গুণানুসারে তিনপ্রকার ভেদ হয় তাহা পৃথক্‌ পৃথক্‌ সুস্পষ্টরূপে বলিতেছি, শ্রবণ কর । ২৯

হে পার্থ, কর্ম করা অথবা কর্ম হইতে নিবৃত্ত থাকা (অর্থাৎ কর্মমার্গ বা সন্ন্যাস), কর্তব্য কি, অকর্তব্য কি, কিসে ভয়, কিসে অভয়, কিসে বন্ধ, কিসে মোক্ষ, এই সকল যে বুদ্ধিদ্বারা যথাযথরূপে বুঝা যায়, তাহাই সাত্ত্বিকী বুদ্ধি । ৩০

হে পার্থ, যে বুদ্ধিদ্বারা ধর্ম ও অধর্ম, কার্য ও অকার্য যথার্থরূপে বুঝা যায় না, তাহা রাজসী বুদ্ধি । ৩১

হে পার্থ, যে বুদ্ধি মোহাচ্ছন্ন থাকাতে অধর্মকে ধর্ম মনে করে এবং সকল বিষয়ই বিপরীত বুঝে, তাহা তামসী বুদ্ধি । ৩২

যে অবিচলিত ধৃতিদ্বারা মন, প্রাণ ও ইন্দ্রিয়ের ক্রিয়া সমাধি বা সমদর্শনরূপ যোগবলে নিয়মিত হয়, তাহা সাত্ত্বিকী ধৃতি । ৩৩

হে পার্থ, হে অর্জুন, যে ধৃতিদ্বারা মনুষ্য ধর্ম, অর্থ ও কামোপভোগেই লাগিয়া থাকে এবং সেই সেই প্রসঙ্গে ফলাকাঙ্ক্ষী হয়, তাহা রাজসী ধৃতি । ৩৪

হে পার্থ, যে ধৃতিদ্বারা দুর্বুদ্ধি ব্যক্তি নিদ্রা, ভয়, শোক, বিষাদ এবং মদ ছাড়িতে পারে না অর্থাৎ যাহাতে মনুষ্যকে এই সকল বিষয়ে আবদ্ধ করিয়া রাখে, তাহা তামসী ধৃতি । ৩৫

হে ভরতর্ষভ, এক্ষণে আমার নিকট ত্রিবিধ সুখের বিষয় শ্রবণ কর । ৩৬

যে সুখে ক্রমে ক্রমে অভ্যাসবশতঃ আনন্দ লাভ হয় (হঠাৎ নহে), যাহা লাভ হইলে দুঃখের অন্ত হয়, যাহা অগ্রে বিষের ন্যায়, পরিণামে অমৃততুল্য, যাহা আত্মনিষ্ঠ বুদ্ধির প্রসন্নতা হইতে জন্মে, তাহাই সাত্ত্বিক সুখ । ৩৭

রূপরসাদি বিষয়ে ইন্দ্রিয়ের সংযোগবশতঃ যে সুখ উৎপন্ন হয় এবং যাহা অগ্রে অমৃতের ন্যায় কিন্তু পরিণামে বিষতুল্য হয়, সেই সুখকে রাজস সুখ কহে । ৩৮ (ইহারই নাম বৈষয়িক বা আধিভৌতিক সুখ) ।

যে সুখ প্রথমে এবং পরিণামেও আত্মার বা বুদ্ধির মোহজনক এবং যাহা নিদ্রা, আলস্য ও কর্তব্যবিস্মৃতি হইতে উৎপন্ন হয়, তাহাকে তামস সুখ বলে । ৩৯

পৃথিবীতে, স্বর্গে অথবা দেবগণের মধ্যেও এমন প্রাণী বা বস্তু নাই যাহা প্রকৃতিজাত সত্ত্বাদি গুণ হইতে মুক্ত । ৪০

হে পরন্তপ, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রদিগের কর্মসকল ভাবজাত গুণানুসারে পৃথক্‌ পৃথক্‌ বিভক্ত হইয়াছে । ৪১

শম, দম, তপঃ, শৌচ, ক্ষমা, সরলতা, জ্ঞান, বিজ্ঞান ও সাত্ত্বিকী শ্রদ্ধা - এই সমস্ত ব্রাহ্মণের স্বভাবজাত কর্ম (লক্ষণ) । ৪২

পরাক্রম, তেজ, ধৈর্য, কার্যকুশলতা, যুদ্ধে অপরাঙ্মুখতা, দানে মুক্তহস্ততা, শাসন-ক্ষমতা, এইগুলি ক্ষত্রিয়ের স্বভাবজাত কর্ম (লক্ষণ) । ৪৩

কৃষি, গোরক্ষা ও বাণিজ্য বৈশ্যদিগের এবং সেবাত্মক কর্ম শূদ্রদিগের স্বভাবজাত । ৪৪

নিজ নিজ কর্মে নিষ্ঠাবান্‌ ব্যক্তি সিদ্ধি লাভ করে; স্বকর্মে তৎপর থাকিলে কিরূপে মনুষ্য সিদ্ধিলাভ করে তাহা শুন । ৪৫

যাঁহা হইতে ভূতসমূহের উৎপত্তি বা জীবের কর্মচেষ্টা, যিনি এই চরাচর ব্রহ্মাণ্ড ব্যাপিয়া আছেন, মানব নিজ কর্মদ্বারা তাঁহার অর্চনা করিয়া সিদ্ধিলাভ করিয়া থাকে । ৪৬

স্বধর্ম দোষ-বিশিষ্ট হইলেও সম্যক্‌ অনুষ্ঠিত পরধর্ম অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ । স্বভাব-নির্দিষ্ট কর্ম করিয়া লোকে পাপভাগী হয় না । ৪৭

হে কৌন্তেয়, স্বভাবজ কর্ম দোষযুক্ত হইলেও তাহা ত্যাগ করিতে নাই । অগ্নি যেমন ধূমদ্বারা আবৃত থাকে, তদ্রূপ কর্মমাত্রই দোষযুক্ত । ৪৮

যিনি সর্ববিষয়ে অনাসক্ত, জিতেন্দ্রিয় ও নিস্পৃহ, তিনি কর্মফল ত্যাগের দ্বারা নৈষ্কর্ম্যসিদ্ধি লাভ করেন অর্থাৎ কর্মবন্ধন হইতে মুক্ত হন । ৪৯

হে কৌন্তেয়, এইরূপে নৈষ্কর্ম্যসিদ্ধি-প্রাপ্ত ব্যক্তি যে প্রকারে ব্রহ্মভাব প্রাপ্ত হন তাহা আমার নিকট শ্রবণ কর; উহাই জ্ঞানের চরম অবস্থা । ৫০

বিশুদ্ধ সাত্ত্বিক বুদ্ধিযুক্ত হইয়া, ধৈর্যসহ আত্মসংযমন করিয়া, শব্দাদি বিষয়সমূহ ত্যাগ করিয়া, রাগদ্বেষ বর্জন করিয়া, নির্জন স্থানে অবস্থিত ও মিতভোজী হইয়া, বাক্য, শরীর ও মনকে সংযত করিয়া, বৈরাগ্য অবলম্বন করিয়া, সর্বদা ধ্যানে নিরত থাকিয়া, অহঙ্কার, বল (পাশবিক শক্তির ব্যবহার), দর্প, কাম, ক্রোধ এবং বাহ্য ভোগ-সাধনার্থ প্রাপ্ত দ্রব্যাদি বর্জন করতঃ মমত্ববুদ্ধিহীন প্রশান্তচিত্ত সাধক ব্রহ্মভাব লাভে সমর্থ হন । ৫১,৫২,৫৩

ব্রহ্মভাব প্রাপ্ত হইলে পর তিনি প্রসন্নচিত্ত হইয়া (নষ্ট বস্তুর জন্য) শোক করেন না, বা (অপ্রাপ্ত বস্তুর জন্য) আকাঙ্ক্ষাও করেন না । তিনি সর্বভূতে সমদর্শী হন এবং আমাতে পরা ভক্তি লাভ করেন । ৫৪

(যিনি) এইরূপ পরাভক্তিদ্বারা আমাকে স্বরূপতঃ জানিতে পারেন, (তিনিই) বুঝিতে পারেন - আমি কে, আমার কত বিভাব, আমার সমগ্র স্বরূপ কি; এবং এইরূপে আমাকে স্বরূপতঃ জানিয়া তদনন্তর (তিনি) আমাতে প্রবেশ করেন । ৫৫

আমাকে আশ্রয় করিয়া সর্বদা সর্বকর্ম করিতে থাকিলেও আমার প্রসাদে শাশ্বত অব্যয় পদ প্রাপ্ত হন । ৫৬

মনে মনে সমস্ত কর্ম আমাতে সমর্পণ করিয়া, মৎপরায়ণ হইয়া, সাম্য-বুদ্ধিরূপ যোগ অবলম্বন করিয়া, সর্বদা আমাতে চিত্ত রাখ (এবং যথাধিকার স্বকর্ম করিতে থাক) । ৫৭

আমাতে চিত্ত রাখিলে তুমি আমার অনুগ্রহে সমস্ত সঙ্কট অর্থাৎ কর্মের শুভাশুভ ফল অতিক্রম করিবে । আর যদি আমার কথা না শুন, তবে বিনাশ-প্রাপ্ত হইবে । ৫৮

তুমি অহঙ্কারবশতঃ এই মনে করিতেছ আমি যুদ্ধ করিব না, তোমার এই সঙ্কল্প মিথ্যা; প্রকৃতিই (তোমার ক্ষত্রিয় স্বভাব) তোমাকে (যুদ্ধকর্মে) প্রবর্তিত করিবে । ৫৯ (৩|২৭ শ্লোক দ্রষ্টব্য)

হে কৌন্তেয়, মোহবশতঃ তুমি যাহা করিতে ইচ্ছা করিতেছ না, স্বভাবজ স্বীয় কর্মে আবদ্ধ থাকায় তোমাকে অবশ হইয়া তাহা করিতে হইবে । ৬০

হে অর্জুন, ঈশ্বর সর্ব জীবের হৃদয়ে অধিষ্ঠিত থাকিয়া মায়াদ্বারা যন্ত্রারূঢ় পুত্তলিকার ন্যায় তাহাদিগকে ভ্রমণ করাইতেছেন । ৬১

হে ভারত, সর্বতোভাবে তাঁহারই শরণ লও; তাঁহার প্রসাদে পরম শান্তি ও চিরন্তন স্থান প্রাপ্ত হইবে । ৬২

আমি তোমার নিকট এই গুহ্য হইতেও গুহ্য তত্ত্বকথা ব্যাখ্যা করিলাম, তুমি ইহা বিশেষভাবে পর্যালোচনা করিয়া যাহা ইচ্ছা হয় তাহা কর । ৬৩

এখন সর্বাপেক্ষা গুহ্যতম পরমশ্রেয়ঃসাধন আমার কথা শ্রবণ কর; তুমি আমার অত্যন্ত প্রিয়, এই হেতু তোমাকে এই কল্যাণকর কথা বলিতেছি । ৬৪

তুমি একমাত্র আমাতেই চিত্ত রাখ, আমাকে ভক্তি কর, আমাকে পূজা কর, আমাকে নমস্কার কর । আমি সত্য প্রতিজ্ঞাপূর্বক বলিতেছি, তুমি আমাকেই পাইবে, কেননা তুমি আমার প্রিয় । ৬৫

সকল ধর্ম পরিত্যাগ করিয়া তুমি একমাত্র আমারই শরণ লও; আমি তোমাকে সকল পাপ হইতে মুক্ত করিব, শোক করিও না । ৬৬


যে তপস্যা করে না বা স্বধর্মানুষ্ঠান করে না, যে অভক্ত, যে শুনিবার ইচ্ছা রাখে না এবং যে আমাকে নিন্দা করে, এরূপ ব্যক্তিকে তুমি গীতাশাস্ত্র বলিবে না । ৬৭

যিনি এই পরম গুহ্যশাস্ত্র আমার ভক্তগণের নিকট ব্যাখ্যা করিবেন, তিনি আমাকে পরাভক্তি করায় (অর্থাৎ এই কার্যে আমি ভগবানেরই উপাসনা করিতেছি এইরূপ মনে করায়) আমাকেই প্রাপ্ত হইবেন, ইহাতে সন্দেহ নাই । ৬৮

মনুষ্যমধ্যে গীতা-ব্যাখ্যাতা অপেক্ষা আমার অধিক প্রিয়কারী আর কেহ নাই এবং পৃথিবীতে তাহা অপেক্ষা আমার অধিক প্রিয় আর কেহ হইবেও না । ৬৯

আর যিনি আমাদের এই ধর্মসংবাদ (গীতাশাস্ত্র) অধ্যয়ন করিবেন, তিনি জ্ঞানযজ্ঞদ্বারা আমার অর্চনা করিলেন, ইহাই আমি মনে করিব । ৭০

যিনি শ্রদ্ধাবান্‌ ও অসূয়াশূন্য হইয়া শ্রবণ করেন, তিনিও পাপ হইতে বিমুক্ত হইয়া পুণ্যবান্‌গণের প্রাপ্য শুভ লোকসকল প্রাপ্ত হন । ৭১

হে পার্থ, তুমি একাগ্রমনে ইহা শুনিয়াছ ত ? হে ধনঞ্জয়, তোমার অজ্ঞানজনিত মোহ দূর হইয়াছে ত ? ৭২

অর্জুন বলিলেন -
হে অচ্যুত, তোমার প্রসাদে আমার মোহ নষ্ট হইয়াছে, আমার কর্তব্যাকর্তব্য-জ্ঞান লাভ হইল, আমি স্থির হইয়াছি, আমার আর সংশয় নাই, আমি তোমার উপদেশ মত কার্য (যুদ্ধ) করিব । ৭৩

সঞ্জয় বলিলেন -
এইরূপে মহাত্মা বাসুদেব এবং অর্জুনের এই অদ্ভুত লোমহর্ষকর সংবাদ আমি শ্রবণ করিয়াছি । ৭৪

ব্যাসদেবের প্রসাদে সাক্ষাৎ যোগেশ্বর স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণের মুখ হইতেই আমি এই যোগশাস্ত্র শ্রবণ করিয়াছি । ৭৫

হে রাজন্‌, কেশব ও অর্জুনের এই পবিত্র অদ্ভুত সংবাদ বারংবার স্মরণ করিয়া মুহুর্মুহুঃ হর্ষ হইতেছে । ৭৬

হে রাজন্‌, হরির সেই অতি অদ্ভুত বিশ্বরূপ স্মরণ করিয়া আমার অতিশয় বিস্ময় জন্মিতেছে এবং বার বার হর্ষ হইতেছে । ৭৭

যে পক্ষে যোগেশ্বর কৃষ্ণ এবং যেখানে ধনুর্ধর পার্থ, সেখানেই লক্ষী, বিজয়, উত্তরোত্তর ঐশ্বর্যবৃদ্ধি ও অখণ্ডিত রাজনীতি আছে, ইহাই আমার মত । ৭৮ [অতএব আপনি পুত্রগণের জয়লাভের আশা ত্যাগ করুন, পাণ্ডবগণের সঙ্গে সন্ধি করুন ।]

___________________________
১) কেশিনিসূদন = শ্রীকৃষ্ণ ব্রজলীলায় কেশী নামক অসুরকে বধ করিয়াছিলেন

সন্ন্যাস ও ত্যাগের ব্যাখ্যা - সন্ন্যাস ও ত্যাগ এই দুইটির ধাত্বর্থ একই = পরিত্যাগ করা, ছাড়া । কিন্তু 'সন্ন্যাস' শব্দের একটি বিশেষ অর্থ এই যে, সর্বকর্ম ত্যাগ করিয়া চতুর্থ আশ্রম অবলম্বন করা । এই চতুর্থাশ্রম শাস্ত্রবিহিত এবং সন্ন্যাস অবলম্বন ব্যতীত মোক্ষলাভ হয় না, এই মতও সুপ্রচলিত । অর্জুনও মনে করিয়াছিলেন, শ্রীভগবান্‌ অবশ্য এই কথা শেষে বলিবেন । কিন্তু তিনি এ পর্যন্ত কোথাও কর্মত্যাগের উপদেশ দিলেন না । তিনি আরও এই কথা বলিলেন যে, যিনি আকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করেন তিনিই নিত্য সন্ন্যাসী । সেই জন্যই অর্জুন প্রশ্ন করিলেন যে, তিনি ত্যাগ ও সন্ন্যাস এই শব্দ দুইটি কি অর্থে ব্যবহার করিতেছেন । ইহাদের মধ্যে অর্থগত কোন পার্থক্য আছে কিনা এবং থাকিলে, তাহা কি ? এই কথার উত্তরেই শ্রীভগবান্‌কর্মযোগ-মার্গের সারার্থ পুনরায় স্পষ্টীকৃত করিয়া গীতাশাস্ত্রের উপসংহার করিয়াছেন ।

২) কাম্য কর্মের ত্যাগই সন্ন্যাস । কিন্তু সূক্ষদর্শী পণ্ডিতগণ বলেন যে, সকল কর্মের ফল-ত্যাগই প্রকৃত ত্যাগ; সুতরাং যিনি ফল ত্যাগ করেন, তিনি কর্ম করিলেও প্রকৃতপক্ষে সন্ন্যাসী ।

৬) পূর্বে বলা হইয়াছে যে, কর্তৃত্বাভিমান ও ফলকামনা বর্জন করিয়া ঈশ্বরার্পণ বুদ্ধিতে সমস্ত কর্ম করা উচিত । শ্রৌত স্মার্ত যজ্ঞদানাদি কর্মও ঠিক সেই ভাবেই করা কর্তব্য । ইহাই নিষ্কাম কর্মযোগ ।

৭) (স্বভাব)নিয়ত কর্ম - স্বধর্মানুসারে যথাধিকার প্রাপ্ত কর্ম । জীবের স্বভাব বা প্রকৃতির গুণভেদবশতঃই বর্ণভেদ ও কর্মভেদ শাস্ত্রে বিহিত হইয়াছে । সুতরাং যথাধিকার শাস্ত্রবিহিত কর্মই নিয়ত কর্ম । ইহাকেই স্বধর্ম, স্বকর্ম, সহজ কর্ম, স্বভাবজ কর্ম ইত্যাদি বলা হইয়াছে ।

৮) ত্যাগের ফল কর্মবন্ধন হইতে মুক্ত হওয়া অর্থাৎ মোক্ষ লাভ করা । কিন্তু কায়ক্লেশভয়ে কর্তব্য কর্ম ত্যাগ করিলে তাহাতে মোক্ষ লাভ হয় না । এইরূপ ত্যাগকে রাজসত্যাগ বলে ।

১৩) সাংখ্যে কৃতান্তে - এস্থলে 'সাংখ্যে' পদটি 'কৃতান্ত' পদের বিশেষণ । সাংখ্য = কাপিল সাংখ্য অথবা বেদান্তশাস্ত্র । কৃতান্ত = সিদ্ধান্ত শাস্ত্র । সুতরা 'সাংখ্যে কৃতান্তে' = কাপিল সাংখ্যশাস্ত্র অথবা
বেদান্তশাস্ত্র ।

১৪) কোন কর্ম হইতে গেলেই কর্তা, করণ বা সাধন (যন্ত্র), অধিকরণ বা স্থান এবং কর্তার নানাবিধ চেষ্টা প্রয়োজন । বেদান্তাদি শাস্ত্রের পরিভাষায় অহঙ্কারই কর্তা, চক্ষুরাদি ইন্দ্রিয় করণ, দেহই অধিষ্ঠান এবং প্রাণ অপানাদির ব্যাপারই চেষ্টা বলিয়া গৃহীত হয় । এই সকলের সহায়তাই কর্ম সম্পন্ন হয় । এতদ্ব্যতীতও আমাদের প্রযত্নের প্রয়োজক ও অনুকূল এমন কোন ব্যাপার আছে যাহা আমরা জানি না এবং দেখি না - ইহাকেই দৈব বলা হয় ।

১৪,১৫) দৈব কি ? - শাস্ত্রে চক্ষুরাদি ইন্দ্রিয়ের প্রত্যেকের আনুকূল্যকারী এক একটি অধিষ্টাত্রী দেবতার উল্লেখ আছে । যেমন, শরীরের দেবতা পৃথিবী, চক্ষুর - অর্ক, হস্তের - ইন্দ্র, অহঙ্কারের - রুদ্র, মনের - চন্দ্র, ইত্যাদি । এই দেবগণের সাহায্যে ও শক্তিতেই ইন্দ্রিয়াদির কার্য সম্পন্ন হয় । অনেক টীকাকার ইহাকেই 'দৈব' বলিয়াছেন । কেহ কেহ বলেন 'সর্বপ্রেরক অন্তর্যামী' অথবা 'ধর্মাধর্ম-সংস্কার' । মূল তত্ত্বটি একই । সেইটিই বুঝা প্রয়োজন ।
প্রশ্ন এই - জীব কর্ম করে কেন ? কর্ম-প্রবৃত্তি কোথা হইতে আসিল ? জন্ম, কর্ম, সংসার, সৃষ্টি - ইহার আদি কোথায়, ইহার মূল কারণ কি ? ইহার মূলে ব্রহ্মসঙ্কল্প - 'আমি এক আছি, বহু হইব' - পরব্রহ্মের এই সঙ্কল্প হইতেই ব্রহ্মাদি স্তম্ব পর্যন্ত সর্বভূতের উৎপত্তি ও সকলের স্ব স্ব কার্যে প্রবৃত্তি । বলীবর্দাদি চতুষ্পদ জন্তু যেমন নাসিকায় বদ্ধ হইয়া মনুষ্যের ইচ্ছায় তাহার নিমিত্ত কর্ম করে, আমরা সকলেই সেইরূপ ত্রিগুণে বদ্ধ হইয়া ঈশ্বরের ইচ্ছায় তাঁহার কর্ম করি (শ্রীভাগবতে ব্রহ্মার বাক্য ৫।১।২৪) ।
সুতরাং সৃষ্টিকালে অথবা সৃষ্টির প্রাক্কালে (শ্রীশ্রীলোকনাথ ব্রহ্মচারী বাবা) যাহার ললাটে যাহা লিখিত হইয়াছে অর্থাৎ যাহার পক্ষে যাহা নির্দিষ্ট হইয়াছে, সকলেই তদনুসারে কর্ম করিতেছে, ইহার অন্যথা করিবার কাহারও সাধ্য নাই ।
এই ঈশ্বর-সঙ্কল্পকেই মহানিয়তি বা দৈব বলে । হরিহরব্রহ্মাও ইহা লঙ্ঘন করিতে পারেন না, কেননা তাঁহারাও এই সঙ্কল্পের অধীন । সৃষ্টি হইতে প্রলয় পর্যন্ত জগতে যাহা কিছু কর্ম হয় তাহা এই নিয়তিবলেই সম্পন্ন হয় । এই নিয়তিবলেইচন্দ্র-সূর্য, বায়ু-বরুণাদি স্ব স্ব কার্যে ব্যাপৃত আছেন, এই নিয়তিবলেই আদিত্যাদি দেবগণ চক্ষুরাদি ইন্দ্রিয়ের শক্তি দান করিতেছেন, এই হেতু এই শক্তিকেই 'দৈব' বলা হইয়াছে । এই ঈশ্বর-সঙ্কল্পকেই কেহ কেহ 'সর্বপ্রেরক অন্তর্যামী' বলিয়াছেন । এই নিয়তিই প্রাক্তন বা পূর্বজন্মের 'ধর্মাধর্ম সংস্কার'রূপে প্রকাশিত হয় এবং জন্মে জন্মে জীবের জন্মকর্মের ফলবৈষম্য উৎপন্ন করে, ইহাকেই লোকে অদৃষ্ট বলে ।
অনেকে মনে করেন, দৈবের যখন খণ্ডন নাই, তখন পুরুষকার অবলম্বন করা বৃথা । তাঁহারা বুঝিতে পারেন না যে, দৈব পুরুষকাররূপেই কর্মের নিয়ন্তা হয়, পুরুষকার আশ্রয় করিয়াই দৈব ফল প্রদান করে । শস্য উৎপাদনার্থ বীজ ও ক্ষেত্র উভয়েরই প্রয়োজন; দৈব কর্মের বীজস্বরূপ এবং সুপ্রযুক্ত পুরুষকার কর্ষিত ক্ষেত্রস্বরূপ; এই উভয়ের সংযোগে কর্মফল লাভ হয় ।

১৭) স্থিতপ্রজ্ঞ কর্মযোগী পাপপুণ্যের অতীত । প্রকৃতিই কর্ম করে, আত্মা অকর্তা, নিঃসঙ্গ । দেহ ইন্দ্রিয় অহঙ্কার এবং দৈব বা ঈশ্বর-সঙ্কল্প এই সকলই কর্মঘটনার কারণ, আত্মা বা 'আমি' ইহার কোনটির মধ্যেই নয় । সুতরাং যে মনে করে, আত্মা বা 'আমিই' কর্তা, সে অজ্ঞান, সে প্রকৃত তত্ত্ব জানে না । এই অজ্ঞানতাপ্রসূত কর্তৃত্বাভিমানবশতঃই তাহার কর্মবন্ধন হয় । যাঁহার অহং অভিমান নাই, বুদ্ধি যাঁহার নির্লিপ্ত, তাঁহার কর্মবন্ধন হয় না, সে কর্ম লোকরক্ষাই হউক, লোকহত্যাই হউক, তাহাতে কিছু আসে যায় না । এইরূপ কর্তৃত্বাভিমান ও কামনাবর্জিত আত্মজ্ঞানী পুরুষই স্থিতপ্রজ্ঞ, ব্রহ্মভূত, ত্রিগুণাতীত, জীবন্মুক্ত ইত্যাদি নামে অভিহিত হন । ঈদৃশ শুদ্ধ, বুদ্ধ, মুক্ত-স্বভাব ব্যক্তিগণের ব্যবহার সম্বন্ধে পাপ-পুণ্য, ধর্ম-অধর্ম, নীতি-অনীতি ইত্যাদির বিচার চলে না, কেননা তাঁহারা পাপ-পুণ্যাদি দ্বন্দ্বের অতীত (শঙ্করাচার্য) । কৌষীতকী উপনিষদে ইন্দ্র প্রতর্দনকে বলিতেছেন যে, বৃত্র অর্থাৎ ব্রাহ্মণকে বধ করিলেও আমার পাপ হয় না, একথার মর্মও ইহাই ।

১৮) কর্মচোদনা ও কর্মসংগ্রহ - কোন কর্ম আরম্ভ করিবার পূর্বে একটি প্রেরণা চাই, এই প্রেরণার জন্য জ্ঞান, জ্ঞেয় ও জ্ঞাতা, এই তিনটির প্রয়োজন । স্থুল কথা কর্মচোদনা = কর্মবিষয়ক মানসিক প্রেরণা, কর্মসংগ্রহ = সেই প্রেরণার বাহ্য প্রকাশ ।

২০) সাত্ত্বিক-জ্ঞান - জগতের নানাত্বের মধ্যে যে একত্ব দর্শন তাহাই প্রকৃত জ্ঞান । একমাত্র অদ্বয় অব্যয় সদ্বস্তুই আছেন, যাহা কিছু ছিল, আছে বা থাকিতে পারে, সমস্তই তাঁহাতেই আছে, তিনি 'সব', সমস্তই বাসুদেব; ইহাই অদ্বৈত জ্ঞান । এই জ্ঞান লাভ জীবের পরম নিঃশ্রেয়স্‌, উহাই মুক্তি । আত্মজ্ঞান, ব্রহ্মজ্ঞান, ব্রহ্মাত্ম্যৈক্যজ্ঞান, সর্বত্র সমদর্শন ইত্যাদি নানা কথায় এই জ্ঞানের বর্ণনা পূর্বে করা হইয়াছে । এই সাত্ত্বিক জ্ঞানলাভ করিয়া সাত্ত্বিক কর্তা বা কর্মযোগী সাত্ত্বিক (নিষ্কাম) কর্ম করেন ।

২১) রাজস জ্ঞান - সর্বভূতে ভেদবুদ্ধি, একত্বের মধ্যে নানাত্ব দর্শন, ইহাই বদ্ধ জীবের জ্ঞান বা অজ্ঞান । ইহাতেই বদ্ধ হইয়া জীব জন্মমৃত্যুর চক্রে আবর্তিত হয় । এই রাজস জ্ঞান বা ভেদজ্ঞান হইতেই সংসার, ইহা হইতেই রাগদ্বেষ দম্ভদর্পাদি সর্ববিধ রাজস প্রবৃত্তি অ কাম্য কর্মের উৎপত্তি ।

২২) তামস জ্ঞান - তুচ্ছ একই বিষয়ে অভিনিবিষ্ট থাকে, উহার বাহিরে যায় না । যেমন মৃত্তিকা, পাথর, বৃক্ষাদিকেই একমাত্র উপাস্য বস্তু মনে করা, উহা ব্যতীত ঈশ্বরের অন্যবিধ স্বরূপ বা সত্তার ধারণা না থাকা । নিজের দেহ বা পরিবারের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যেই যে আসক্ত - তাহারও তামসিক জ্ঞান ।

২৪) কামনা ও অহঙ্কার থাকিলেই দুরাকাঙ্ক্ষা ও দুশ্চিন্তা অনিবার্য । অনেক-স্থলে নিজের অত্যধিক স্বার্থচিন্তায় অপরের স্বার্থের প্রতি দৃষ্টি থাকে না, তাহাতে সংঘর্ষ উপস্থিত হয় । আবার দুরাকাঙ্ক্ষাবশতঃ অনেকে কঠোর শারীরিক কষ্ট সহ্য করিয়াও স্বার্থ সাধনে যত্নপর হয়, এই সব কারণেই বলা হইয়াছে যে, সকাম কর্ম বহু আয়াসসাধ্য ।

২৫) ত্রিবিধ কর্ম - নিষ্কাম কর্ম = সাত্ত্বিক কর্ম, সকাম কর্ম = রাজসিক ও তামসিক কর্ম, নিষিদ্ধ কর্ম = সকাম কর্মের কতকগুলিকে শাস্ত্রে নিষিদ্ধ কর্ম বলা হইয়া থাকে । বিশেষ দ্রষ্টব্য - কর্মের এই শ্রেণী-বিভাগ কর্মেরই বাহ্য প্রকৃতি বা পরিণাম বিচার করিয়া করা হয় নাই, কর্তার বুদ্ধি অনুসারেই করা হইয়াছে । গীতার মতে কর্মের কর্তব্যাকর্তব্য-বিচারে কর্মের ফলাফল না দেখিয়া কর্তার বাসনাত্মিকা বুদ্ধিরই বিচার করা হয় । এইরূপ বিচারে হিংসাত্মক যুদ্ধাদি কর্মও সাত্ত্বিক হইতে পারে, আবার অবস্থা-বিশেষে লোকহিতকর দানাদি কর্মও রাজসিক বা তামসিক হইতে পারে । আবার একই কর্ম এক জনের পক্ষে সাত্ত্বিক হইতে পারে, অপরের পক্ষে রাজসিক বা তামসিক হইতে পারে । যেমন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধকর্ম - ইহা অর্জুনের পক্ষে সাত্ত্বিক, কেননা তিনি স্বধর্ম বলিয়া নিষ্কামভাবে উহা অনুষ্ঠান করিয়াছেন । কর্ণাদি যোদ্ধৃগণের পক্ষে ইহা রাজসিক, কেননা তাঁহারা ধনমানাদির আশায় উহাতে যোগদান করিয়াছিলেন; দুর্যোধনের পক্ষে উহা তামসিক, কেননা তিনি নিজের সামর্থ্য, শক্তিক্ষয়, ভাবিফল ইত্যাদি বিবেচনা না করিয়া মোহবশতঃ উহাতে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন ।

২৮) দীর্ঘসূত্রী = আজ না, কাল করিব এইরূপ ভাবে যে কাল-বিলম্ব করে ।

৩০) সাত্ত্বিকী বুদ্ধি ও সদসদ্বিবেক (Conscience) :
পাশ্চাত্য নীতিশাস্ত্র অনুযায়ী সদসদ্বিবেক (Conscience) হল মানুষের এক স্বাভাবিক স্বতন্ত্র শক্তি যাহাদ্বারা সে বিনা বিচারে (intuitionally) ভাল-মন্দ নির্ণয় করিতে পারে । কিন্তু চোর বা সাধুর conscience পৃথক হয় কেন, তাহার কোন সন্তোষজনক উত্তর পাশ্চাত্য শাস্ত্রের কাছে নাই । ভারতীয় দর্শনে এরূপ কোনো স্বতন্ত্র শক্তির অস্তিত্ব স্বীকৃত হয় নাই । হিন্দু-দর্শনমতে ভাল-মন্দ বা যাহা-কিছু বিচারের শক্তি একমাত্র বুদ্ধির । বুদ্ধি যখন আত্মনিষ্ঠ হইয়া শুদ্ধ হয় তখনই তাহার বিচার যথার্থরূপ হয়, কেননা তখন উহা আত্মার প্রেরণা বা স্বাধর্ম্য লাভ করে, ইহাই সাত্ত্বিকী বুদ্ধি । সাত্ত্বিকী বুদ্ধিই সন্দেহস্থলে প্রমাণস্বরূপ, কিন্তু রাজসী ও তামসী বুদ্ধি লোককে বিপথে চালিত করে । এই হেতুই পাশ্চাত্যগণ যাহাকে conscience বলেন, তাহা সকলের সমান হয় না । কেননা প্রকৃতির গুণভেদে বুদ্ধি বিভিন্ন হয় ।

২৯,৩৩,৩৫) ত্রিবিধ ধৃতি - সেই মানসিক শক্তি যাহাতে মনুষ্য কোন কর্মে দৃঢ়ভাবে লাগিয়া থাকিতে পারে ।
সাত্ত্বিকী ধৃতি = যাহা দ্বারা সাত্ত্বিক বা নিষ্কাম কর্মে লাগিয়া  থাকা যায়;
রাজসী ধৃতি= যাহাতে অর্থকামাদি রাজসিক বিষয়ে লাগিয়া থাকে;
তামসী ধৃতি = যাহা দ্বারা শোক, ভয় ইত্যাদি তামসিক ভাবে লাগিয়া থাকে ।

৩৯) প্রমাদ = কর্তব্যের ভ্রম বা বিস্মৃতি । অনবধানতা ।

কর্মতত্ত্ব বিশ্লেষণ :
যে কোনো কর্ম সম্পাদনের পক্ষে অধিষ্ঠান, কর্তা, করণ, নানাবিধ চেষ্টা এবং দৈব - এই সকল কারণ বিদ্যমান থাকে । সুতরাং যে মনে করে, কেবল 'আমিই' কর্ম করি, সে দুর্মতি প্রকৃত তত্ত্ব বোঝে না । যাহার 'আমি কর্তা' এই ভাব নাই, তিনি কর্মের শুভাশুভ ফলে আবদ্ধ হন না । কর্মপ্রবৃত্তির হেতু = (i)জ্ঞান, (ii)জ্ঞেয়, (iii)জ্ঞাতা । ক্রিয়ার আশ্রয় =  (i)কর্তা, (ii)কর্ম, (iii)করণ । তন্মধ্যে জ্ঞান, কর্তা ও কর্ম গুণভেদে ত্রিবিধ হয় । আবার কর্তার বুদ্ধি, ধৃতি এবং যে-সুখলাভার্থ কর্ম করা হয় সেই সুখও গুণভেদে ত্রিবিধ । এইরূপ গুণভেদবশতই বিভিন্ন কর্তার, বিভিন্ন কর্মের বিভিন্ন ফল হয় । যেমন সাত্ত্বিক জ্ঞান (সর্বত্র সমদর্শন) হইতে সাত্ত্বিক কর্তা (কর্মযোগী) সাত্ত্বিক কর্ম (নিষ্কাম কর্ম) করেন, তাঁহার সাত্ত্বিকী বুদ্ধি (বন্ধমোক্ষ-নির্ণয়-সমর্থা) এই কর্ম নিশ্চয় করিয়া দেয় । সাত্ত্বিকী ধৃতি তাঁহাকে এই কর্মে স্থির রাখে এবং তিনি এই সাত্ত্বিক কর্মের যে-ফল সাত্ত্বিক সুখ, নির্মল আত্মপ্রসাদ (আত্মানন্দ), তাহা লাভ করেন । রাজসিক ও তামসিক কর্তার কর্ম এবং তাহার ফলও এইরূপ গুণভেদে বিভিন্ন হয় ।


৪৬) স্বধর্ম বা কর্তব্য পালনেই ঈশ্বরের অর্চনা - তাহাতেই সিদ্ধি । কর্ম ভগবানেরই সৃষ্টি এবং তাহা হইতেই জীবের কর্ম-প্রবৃত্তি । ইহাই তাঁহার লীলা । জীব কর্মে বিরত হইলে তৎক্ষণাৎ ভবলীলা শেষ হয় । সুতরাং তাঁহার সৃষ্টি-রক্ষার্থ গীতার ভাষায় লোকসংগ্রহার্থ বা ভক্তিশাস্ত্রের ভাষায় তাঁহার লীলাপুষ্টির জন্য জীবের যথাপ্রাপ্ত কর্ম করিতে হয় । হিন্দুর কর্ম-জীবনে ও ধর্ম-জীবনে পার্থক্য নাই । তাহার সমস্ত কর্মই ধর্মশাস্ত্রনির্দিষ্ট । এই সমস্ত কর্ম, ফলকামনা ত্যাগ করিয়া একমাত্র শ্রীবিষ্ণুপ্রীতিকাম হইয়া, করিতে পারিলেই তাঁহার অর্চনা হয় এবং তাহাতেই সদ্গতি লাভ হয়, ইহা সমস্ত ভক্তিশাস্ত্রের সিদ্ধান্ত ।

৪৮) ক্ষত্রিয়ের যুদ্ধকর্মে বা কৃষকের কৃষিকর্মেও প্রাণিহিংসা অনিবার্য; কিন্তু এইরূপ হিংসাদিযুক্ত হইলেও তাহা ত্যাগ করিয়া অন্য বর্ণের কর্ম গ্রহণ করা কর্তব্য নয় । কেননা কর্মমাত্রই দোষযুক্ত, যেহেতু উহা বন্ধনের কারণ, কর্ম করিলেই তাহার শুভাশুভ ফলভোগার্থ পুন; পুনঃ জন্মগ্রহণ ও সংসার-যাতনা ভোগ অনিবার্য । তবে কর্মত্যাগই ত শ্রেয়ঃকল্প ? না, কর্ম করিয়াও যাহাতে কর্মবন্ধন না হয় তাহার উপায় আছে । (পরের শ্লোক) ।

৪৯) জিতাত্মা = জিতেন্দ্রিয় (শঙ্কর), নিরহঙ্কার (শ্রীধর) ।

৪৯) নৈষ্কর্ম্যসিদ্ধি = কর্মবন্ধন হইতে মুক্তি । সমস্ত অধ্যাত্ম-শাস্ত্রের মূল কথাই হইতেছে, কিরূপে জীব জন্ম-কর্মচক্র হইতে নিষ্কৃতি লাভ করিতে পারে তাহার উপায় নির্দেশ ।

৫৩) পরিগ্রহম্‌ = শরীরধারণার্থ বা ধর্মানুষ্ঠানার্থ লোকের নিকট হইতে অর্থ বা দ্রব্যাদি গ্রহণ । প্রকৃত যোগযুক্ত সাধু পুরুষ এ সকলও ত্যাগ করেন ।

৫৪-৫৬) নিষ্কাম কর্ম -> নৈষ্কর্ম্যসিদ্ধি -> সাত্ত্বিকী বুদ্ধি -> ব্রহ্মভূত (ব্রহ্মভাব প্রাপ্তি) -> পরাভক্তি -> মোক্ষ (ভগবৎ-প্রাপ্তি)

এস্থলে জ্ঞানবাদী ও ভক্তিবাদীর মধ্যে এক সূক্ষ তর্ক উপস্থিত হয় । জ্ঞানবাদী বলেন, জ্ঞান ব্যতীত মুক্তি নাই এবং এই হেতুই - আমাকে স্বরূপতঃ জানিয়া আমাতে প্রবেশ করেন - এস্থলে এই কথা আছে । ভক্তিবাদী বলেন, ব্রহ্মভাবলাভেই জীবের মুক্তি, ইহাই জ্ঞানমার্গের চরম অবস্থা । কিন্তু এস্থলে শ্রীভগবান্‌ বলিতেছেন, ব্রহ্মভাবলাভ হইলেই আমাতে পরাভক্তি জন্মে এবং ভক্তিদ্বারাই আমার স্বরূপের অবগতি হইলে ভক্ত আমাকে প্রাপ্ত হন । সুতরাং এস্থলে ভক্তিরই প্রাধান্য দেওয়া হইয়াছে; বস্তুত পরম জ্ঞান ও পরাভক্তিতে কোন পার্থক্য নাই, সাধক যে পথেই সাধনা আরম্ভ করুক না কেন, একটি থাকিলে অপরটি আসিবেই, সুতরাং জ্ঞান-ভক্তির প্রাধান্য লইয়া বিবাদ নিরর্থক ।

৫৭) বুদ্ধিযোগ : গীতায় শ্রীভগবান যে যোগ বলিতেছেন, তাহাকে কখনো বুদ্ধিযোগ, কখনো বা কেবল যোগ শব্দদ্বারাই প্রকাশ করিয়াছেন । এ-স্থলে বুদ্ধি অর্থ শুদ্ধ সাম্য-বুদ্ধি, উহাই কর্মযোগের মূল, কর্ম করিবার সময় বুদ্ধিকে স্থির, পবিত্র সম ও শুদ্ধ রাখাই সেই যোগ, 'যুক্তি' বা কৌশল যাহাতে কর্মের বন্ধন হয় না, সে কর্ম যাহাই হউক-না-কেন । এই হেতুই 'কর্ম হইতে বুদ্ধি শ্রেষ্ঠ' [২|৪৮-৫১] ।

৫৯-৬৩) প্রকৃতি-পারতন্ত্র ও আত্মস্বাতন্ত্র্য - এস্থলে শ্রীভগবান্‌ বলিতেছেন - তুমি ইচ্ছা না করিলেও প্রকৃতি তোমাকে স্বাভাবিক কর্মে প্রবর্তিত করিবে, তোমাকে অবশভাবেই সে কর্ম করিতে হইবে । প্রকৃতির প্রেরণায় কর্ম, কর্মফলে সদসৎ যোনিতে জন্ম, জন্মিয়া আবার কর্ম, কর্মফলে আবার জন্ম । সুতরাং দেখা যায়, জীবকে অবিরত জন্ম-কর্মের ভবচক্রেই ঘুরিতে হয় । এই প্রকৃতি-পারতন্ত্র বা কর্মবিপাক হইতে মুক্তিলাভের উপায় কি ? জ্ঞানলাভার্থ, মোক্ষার্থ জীবের কি কোন স্বাতন্ত্র্য নাই ? অধ্যাত্মশাস্ত্র বলেন, আছে । পরমাত্মা শুদ্ধবুদ্ধমুক্তস্বভাব এবং তিনিই বা তাঁহারই সনাতন অংশ জীবাত্মারূপে দেহে আছেন; তিনি কখনও প্রকৃতির পরতন্ত্র হইতে পারেন না । দেহেন্দ্রিয়াদির বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ায় তাঁহাকে বদ্ধ অ পরাধীনের ন্যায় বোধ হয়; তিনি মায়াধীন হন । কিন্তু তাহা হইলেও স্বতঃই তাঁহার মুক্ত হইবার প্রেরণা আসে । গুরুপদেশ, সাধুসং প্রভৃতি অনুকূল অবস্থায় সেই প্রেরণা মন এবং বুদ্ধির উপর কার্য করে, তাহাতেই মনুষ্যের মনে আত্মোন্নতি বা মোক্ষানুকূল কর্ম করিবার প্রবৃত্তি জন্মে ।

আমাদের মধ্যে দুইটি 'আমি' আছে - (i)কাঁচা আমি, বদ্ধ আমি, অহঙ্কারী আমি, প্রকৃতির দাস আমি (Lower-self, ego-sense); (ii) পাকা আমি, শুদ্ধ, বুদ্ধ, স্বতন্ত্র্য আমি (Higher self, soul) । এই পাকা আমি দ্বারা কাঁচা আমি উদ্ধার করিতে হইবে । এই গেল জ্ঞানমার্গের কথা ।

কৃপাবাদ - কিন্তু ভক্তিমার্গে বলা হয় যে, শ্রীভগবান্‌ই অন্তর্যামীরূপে হৃদয়ে অধিষ্ঠিত থাকিয়া জীবকে যন্ত্রারূঢ় পুত্তলিকার ন্যায় মায়াদ্বারা চালাইতেছেন, সুতরাং সর্বতোভাবে তাঁহার শরণ লইলেই তাঁহার প্রসাদে মুক্তিলাভ হয় । মনে রাখা প্রয়োজন, কৃপাবাদ অর্থ নিশ্চেষ্টতা নয়, আত্মচেষ্টা ব্যতীত ভগবৎকৃপা হয় না ।

ইচ্ছা-স্বাতন্ত্র্য (Freedom of the Will) - পাশ্চাত্য দার্শনিকগণ ইহা সম্বন্ধে অনেক গবেষণা করিয়াছেন, কিন্তু কোন স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হইতে পারিয়াছেন বলিয়া বোধ হয় না । আর্য ঋষিগণ সাংখ্য-বেদান্তাদি শাস্ত্রে মনস্তত্ত্ব ও আত্মতত্ত্বের যে সূক্ষানুসূক্ষ বিশ্লেষণ করিয়াছেন তাহা পর্যালোচনা করিলে দেখা যায় যে, 'ইচ্ছা-স্বাতন্ত্র্য' শব্দটিই একরূপ অর্থহীন । কারণ, ইচ্ছা মনের ধর্ম; মন বুদ্ধির দ্বারা চালিত হয়, মনবুদ্ধি প্রকৃতিরই পরিণাম এবং প্রকৃতির গুণানুসারেই বিভিন্ন হয়, সুতরাং ইচ্ছাও সর্বদাই প্রকৃতির অধীন - উহার স্বাতন্ত্র্য নাই । উহার স্বাতন্ত্র্য তখনই হয়, যখন জীব ত্রিগুণাতীত বা নিত্যসত্ত্বস্থ হয়, অর্থাৎ জীবের স্বাতন্ত্র্য-ইচ্ছা থাকে না, যখন জীবের ইচ্ছা এবং ঈশ্বরেচ্ছা এক হইয়া যায় - প্রকৃতপক্ষে উহা আত্ম-স্বাতন্ত্র্য, 'ইচ্ছা-স্বাতন্ত্র্য' নহে । এই হেতুই গীতায় মিশ্র-সাত্ত্বিক বুদ্ধিকেও বন্ধনের কারণ বলা হইয়াছে ।

৬৪,৬৬) সর্বধর্মত্যাগ করিয়া আমার শরণ লও (শরণাগতি)

অর্জুনের মোহ অপসারণার্থে শ্রীভগবান্‌ এ পর্যন্ত কর্মজ্ঞান-ভক্তিমিশ্র অপূর্ব যোগধর্মের উপদেশ প্রদান করিলেন । পরিশেষে সর্বগুহ্যতম এই সারকথাটি বলিয়া দিলেন - শ্রুতি, স্মৃতি বা লোকাচারমূলক নানা ধর্মের নানারূপ বিধিনিষেধের দাসত্ব ত্যাগ করিয়া (abandoning all rules of conduct - Aurobindo) তুমি সর্বতোভাবে আমার শরণ লও, আমার কর্মবোধে যথাপ্রাপ্ত কর্তব্য কর্ম করিয়া যাও, তোমাত কোন ভয় নাই, আমিই তোমাকে সর্বপাপ হইতে মুক্ত করিব । ইহাই গীতায় শ্রীভগবানের অভয়বাণী, ইহাই ভক্তমার্গের সারকথা । ইহারই নাম ভগবৎ-শরণাগতি বা আত্মসমর্পণ-যোগ । ভক্তিশাস্ত্রে শরণাগতির ষড়্‌বিধ লক্ষণ বর্ণিত আছে - (i) শ্রীভগবানের প্রীতিজনক কার্যে প্রবৃত্তি, (ii) প্রতিকূল কার্য হইতে নিবৃত্তি, (iii) তিনি রক্ষা করিবেন বলিয়া দৃঢ় বিশ্বাস, (iv) রক্ষাকর্তা বলিয়া তাঁহাকেই বরণ, (v) তাঁহাতে সম্পূর্ণ আত্ম-সমর্পণ, (vi) 'রক্ষা কর' বলিয়া দৈন্য ও আর্তি প্রকাশ ।

৬৭) শুশ্রূষা শব্দের দুই অর্থ - (i) শ্রবণের ইচ্ছা, (ii) পরিচর্যা, সেবা । এস্থলে যে কোন অর্থ গ্রহণ করা যায় ।

৭৮) এস্থলে "যোগেশ্বর ও ধনুর্ধর" এই বিশেষণের সার্থকতা লক্ষ করিবার বিষয় । যুক্তি ও শক্তি মিলিত হইলেই কার্য-সফলতা সম্ভবপর, নচেৎ কেবল বলে বা কেবল বুদ্ধিদ্বারা কৃতকার্য হওয়া যায় না, উদাহরণ জরাসন্ধ-বধ ।

___________________________
*Hard Copy Source:

"Sri Gita" or "Srimadbhagabadgeeta" by Gitashastri Jagadish Chandra Ghosh & Anil Chandra Ghosh. 26th Edition - June 1997 (1st Edition, 1925 from Dhaka now in Bangladesh). Published by Subhadra Dey (Ghosh), Presidency Library, 15 Bankim Chatterjee Street, Kolkata-700073. Printed by Web Impressions Pvt.Ltd., 34/2 Beadon Street, Kolkata-700006.



Disclaimer: This site is not officially related to Presidency LibraryKolkataThis is a personal, non-commercial, research-oriented effort of a novice religious wanderer.
এটি আধ্যাত্মিক পথের এক অর্বাচীন পথিকের ব্যক্তিগত, অবাণিজ্যিক, গবেষণা-ধর্মী প্রয়াস মাত্র ।

[Digitised by scanning (if required) and then by typing mostly in Notepad using Unicode Bengali "Siyam Rupali" font and Avro Phonetic Keyboard for transliteration. Uploaded by rk]


<Previous--Contents--Next>

No comments:

Post a Comment