Thursday, March 12, 2015

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা : ত্রয়োদশ অধ্যায় - ক্ষেত্র-ক্ষেত্রজ্ঞ-বিভাগযোগ (13-Jagadishchandra)


|||||||||১০|১১|১২|১৩|১৪|১৫|১৬|১৭|১৮
(গীতাশাস্ত্রী জগদীশচন্দ্র ঘোষ)*

অর্জুন কহিলেন -
হে কেশব, প্রকৃতি ও পুরুষ, ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রজ্ঞ এবং জ্ঞান ও জ্ঞেয় এইগুলি জানিতে আমি ইচ্ছা করি । (প্রক্ষিপ্ত ? শ্রীমৎ শঙ্করাচার্য ও শ্রীধরস্বামী এই শ্লোকটি গ্রহণ করেন নাই ।)

শ্রীভগবান্‌ কহিলেন -

হে কৌন্তেয়, এই দেহকে ক্ষেত্র বলা হয় এবং যিনি এই ক্ষেত্রকে জানেন (অর্থাৎ ‘আমি’ ‘আমার’ এইরূপ মনে করেন) তিনিই ক্ষেত্রজ্ঞ (জীবাত্মা); ক্ষেত্র-ক্ষেত্রজ্ঞবেত্তা পণ্ডিতগণ এইরূপ বলিয়া থাকেন । ১

হে ভারত, সমুদয় ক্ষেত্রে আমাকেই ক্ষেত্রজ্ঞ বলিয়া জানিও; ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রজ্ঞের যে জ্ঞান তাহাই প্রকৃত জ্ঞান, ইহাই আমার মত । অথবা ক্ষেত্র-ক্ষেত্রজ্ঞের যে জ্ঞান তাহাই আমার (পরমেশ্বরের) জ্ঞান, ইহাই সর্বসম্মত । ২

সেই ক্ষেত্র কি, উহা কি প্রকার, উহা কি প্রকার বিকার-বিশিষ্ট, ইহার মধ্যেও কি হইতে কি হয়, এবং সেই ক্ষেত্রজ্ঞ কে এবং তাহার প্রভাব কিরূপ, এইসকল তত্ত্ব সংক্ষেপে আমার নিকট শ্রবণ কর । ৩

ঋষিগণ কর্তৃক নানা ছন্দে পৃথক্‌ পৃথক্‌ নানা প্রকারে এই ক্ষেত্রক্ষেত্রজ্ঞ-তত্ত্ব ব্যাখ্যাত হইয়াছে । ব্রহ্মসূত্র-পদসমূহেও যুক্তিযুক্ত বিচারসহ নিঃসন্দিগ্ধরূপে এই বিষয় ব্যাখ্যাত হইয়াছে । ৪
 

ক্ষিতি আদি পঞ্চমহাভূত, অহঙ্কার, বুদ্ধি (মহত্তত্ত্ব), মূল প্রকৃতি, দশ ইন্দ্রিয়, মন এবং রূপরসাদি পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের বিষয় (পঞ্চতন্মাত্র) এবং ইচ্ছা, দ্বেষ, সুখ, দুঃখ, সংঘাত, চেতনা ও ধৃতি এই সমুদয়কে সবিকার ক্ষেত্র বলে । ৫,৬

শ্লাঘা-রাহিত্য, দম্ভ-রাহিত্য, অহিংসা, ক্ষমা, সরলতা, গুরুসেবা, শৌচ, সৎকার্যে একনিষ্ঠা, আত্মসংযম, বিষয়-বৈরাগ্য, নিরহঙ্কারিতা, জন্ম-মৃত্যু-জরাব্যাধিতে দুঃখ দর্শন, বিষয়ে বা কর্মে অনাসক্তি, স্ত্রীপুত্রগৃহাদিতে মমত্ববোধের অভাব, ইষ্টানিষ্টলাভে সমচিত্ততা, আমাতে (ভগবান্‌ বাসুদেবে) অনন্যচিত্তে ঐকান্তিক ভক্তি, পবিত্র নির্জন স্থানে বাস, প্রাকৃত জনসমাজে বিরক্তি, সর্বতা অধ্যাত্মজ্ঞানের অনুশীলন (নিত্য আত্মজ্ঞাননিষ্ঠা), তত্ত্বজ্ঞানের প্রয়োজন আলোচনা - এই সকলকে জ্ঞান বলা হয়; ইহার বিপরীত যাহা তাহা অজ্ঞান । ৭-১১

যাহা জ্ঞাতব্য বস্তু, যাহা জ্ঞাত হইলে অমৃত অর্থাৎ মোক্ষ লাভ করা যায়, তাহা বলিতেছি; তাহা আদ্যন্তহীন, আমার নির্বিশেষ স্বরূপ-ব্রহ্ম; তৎসন্বন্ধে বলা হয় যে, তিনি সৎও নহেন, অসৎও নহেন । ১২

সর্বদিকে তাঁহার হস্তপদ, সর্বদিকে তাঁহার চক্ষু, মস্তক ও মুখ, সর্বদিকে তাহার কর্ণঃ এইরূপে এই লোকে সমস্ত পদার্থ ব্যাপিয়া তিনি অবস্থিত আছেন । ১৩

তিনি চক্ষুরাদি সমুদয় ইন্দ্রিয় বৃত্তিতে প্রকাশমান অথচ সর্বেন্দ্রিয়বিবর্জিত, নিঃসঙ্গ অর্থাৎ সর্বসঙ্গশূন্য অথচ সকলের আধারস্বরূপ, নির্গুণ অথচ সত্ত্বাদি-গুণের ভোক্তা বা পালক । ১৪

সর্বভূতের অন্তরে এবং বাহিরেও তিনি; চল এবং অচলও তিনি; সূক্ষ্মতাবশতঃ তিনি অবিজ্ঞেয়; এবং তিনি দূরে থাকিয়াও নিকটে স্থিত । ১৫

তিনি (তত্ত্বতঃ বা স্বরূপতঃ) অপরিচ্ছিন্ন হইলেও সর্বভূতে ভিন্ন-ভিন্ন বলিয়া প্রতীত হন । তাঁহাকে ভূতসকলের পালনকর্তা, সংহর্তা ও সৃষ্টিকর্তা বলিয়া জানিবে । ১৬

তিনি জ্যোতিসকলেরও (সূর্যাদিরও) জ্যোতিঃ; তিনি তমের অর্থাৎ অবিদ্যারূপ অন্ধকারের অতীত, তিনি বুদ্ধিবৃত্তিতে প্রকাশমান জ্ঞান, তিনি জ্ঞেয় তত্ত্ব, তিনি জ্ঞানের দ্বারা লভ্য, তিনি সর্বভূতের হৃদয়ে অবস্থিত আছেন । ১৭

এই প্রকারে ক্ষেত্র, জ্ঞান এবং জ্ঞেয় কাহাকে বলে সংক্ষেপে কথিত হইল । আমার ভক্ত ইহা জানিয়া আমার ভাব বা স্বরূপ বুঝিতে পারেন, বা আমার দিব্য প্রকৃতি প্রাপ্ত হন । ১৮

প্রকৃতি ও পুরুষ, উভয়কেই অনাদি বলিয়া জানিও । দেহেন্দ্রিয়াদি বিকারসমূহ এবং সুখ, দুঃখ, মোহাদি গুণসমূহ প্রকৃতি হইতেই উৎপন্ন হইয়াছে জানিবে । ১৯


শরীর ও ইন্দ্রিয়গণের কর্তৃত্ব বিষয়ে প্রকৃতিই কারণ, এবং সুখ, দুঃখ ভোগ বিষয়ে পুরুষই (ক্ষেত্রজ্ঞ) কারণ বলিয়া উক্ত হন । ২০

পুরুষ প্রকৃতিতে অধিষ্ঠিত হইয়া প্রকৃতির গুণসমূহ ভোগ করেন এবং গুণসমূহের সংসর্গই পুরুষের সৎ ও অসৎ যোনিতে জন্মগ্রহণের কারণ হয় । ২১

এই দেহে যে পরম পুরুষ আছেন, তিনি উপদ্রষ্টা, অনুমন্তা, ভর্তা, ভোক্তা, মহেশ্বর ও পরমাত্মা বলিয়া উক্ত হন । ২২
 

যিনি এই প্রকার পুরুষতত্ত্ব এবং বিকারাদি গুণ সহিত প্রকৃতিতত্ত্ব অবগত হন, তিনি যে অবস্থায় থাকুন না কেন, পুনরায় জন্মলাভ করেন না অর্থাৎ মুক্ত হন । ২৩

কেহ কেহ (স্বয়ং) আপনি আপনাতেই ধ্যানের দ্বারা আত্ম দর্শন করেন । কেহ-কেহ সাংখ্যযোগ দ্বারা এবং অন্য কেহ-কেহ কর্মযোগের দ্বারা আত্মাকে দর্শন করেন । ২৪

আবার অন্য কেহ-কেহ এইরূপ আপনা আপনি আত্মাকে না জানিয়া অন্যের নিকট শুনিয়া উপাসনা করেন । শ্রদ্ধাপূর্বক উপদেশ শ্রবণ করিয়া উপাসনা করতঃ তাঁহারাও মৃত্যুকে অতিক্রম করেন । ২৫


হে ভরতর্ষভ, স্থাবর, জঙ্গম যত কিছু পদার্থ উৎপন্ন হয়, তাহা সমস্তই ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রজ্ঞের সংযোগ হইতে হইয়া থাকে জানিবে । ২৬
 

যিনি সর্বভূতে সমভাবে অবস্থিত এবং সমস্ত বিনষ্ট হইলেও যিনি বিনষ্ট হন না, সেই পরমেশ্বরকে যিনি সম্যক দর্শন করিয়াছেন, তিনিই যথার্থদর্শী । ২৭

যিনি সর্বভূতে সমান ও সমভাবে অবস্থিত ঈশরকে দর্শন করেন, তিনি আত্মাদ্বারা আত্মাকে হনন করেন না এবং সেই হেতু তিনি পরম গতি প্রাপ্ত হন । ২৮

প্রকৃতিই সমস্ত প্রকারে সমস্ত কর্ম করেন এবং আত্মা অকর্তা, ইহা যিনি দর্শন করেন তিনিই যথার্থদর্শী । ২৯

যখন তত্ত্বদর্শী সাধক ভূতসমূহের পৃথক্‌ পৃথক্‌ ভাব বা নানাত্ব একস্থ অর্থাৎ এক ব্রহ্মবস্তুতেই অবস্থিত এবং সেই ব্রহ্ম হইতেই এই  নানাত্বের বিস্তার দর্শন করেন, তখন তিনি ব্রহ্মভাব প্রাপ্ত হন । ৩০
 

হে কৌন্তেয়, অনাদি ও নির্গুণ বলিয়া এই পরমাত্মা অবিকারী; অতএব দেহে থাকিয়াও তিনি কিছুই করেন না এবং কর্মফলে লিপ্ত হন না । ৩১

যেমন আকাশ সর্ববস্তুতে অবস্থিত থাকিলেও অতি সূক্ষ্মতা হেতু কোন বস্তুতে লিপ্ত হয় না, সেরূপ আত্মা সর্বদেহে অবস্থিত থাকিলেও কিছুতেই লিপ্ত হন না । ৩২

হে ভারত, যেমন এক সূর্য সমস্ত জগৎকে প্রকাশিত করেন, সেরূপ এক ক্ষেত্রজ্ঞ (আত্মা) সমস্ত ক্ষেত্র বা দেহকে প্রকাশিত করেন । ৩৩

যাহারা জ্ঞানচক্ষুদ্বারা ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রজ্ঞের প্রভেদ এবং ভূতপ্রকৃতি অর্থাৎ অবিদ্যা হইতে মোক্ষ কি প্রকার তাহা দর্শন করেন (জানিতে পারেন) তাহারা পরমপদ প্রাপ্ত হন । ৩৪
___________________________


২) আমি কেবল ক্ষেত্রজ্ঞ নহি, ক্ষেত্রও আমি । কারণ প্রকৃতির পরিণামই দেহ এবং সেই প্রকৃতি আমার বিভাব ও শক্তি [গী|৪|১০] ।

৪) ব্রহ্মসূত্র :
ব্রহ্মসূত্র বলিতে বেদান্ত দর্শন বুঝায় । বিভিন্ন ঋষিগণ বিভিন্ন উপনিষদে পৃথক্‌ পৃথক্‌ অধ্যাত্মতত্ত্বের আলোচনা করিয়াছেন । যুক্তিযুক্ত বিচার বিতর্ক দ্বারা ঐ সকল বিভিন্ন মতের সমন্বয় ও সামঞ্জস্য বিধান করিয়া বেদান্ত দর্শন রচিত হইয়াছে । এই শ্লোকে তাহাই বলা হইল । ঋষিগণ বিভিন্ন উপনিষদে পৃথক্‌ ভাবে যাহা আলোচনা করিয়াছেন, ব্রহ্মসূত্র তাহাই কার্যকারণহেতু দেখাইয়া নিঃসন্দিগ্ধরূপে ব্যাখ্যা করিয়াছে । এই হেতু উহার অপর নাম উত্তর মীমাংসা এবং উহাতে ক্ষেত্রজ্ঞের বিচার আছে বলিয়া উহাকে শারীরক সূত্রও বলে (শরীর=ক্ষেত্র) । ব্রহ্মসূত্র বা বেদান্তদর্শন গীতার পরে রচিত হইয়াছে মনে করিয়া কেহ কেহ ‘ব্রহ্মসূত্র’ পদে ব্রহ্মপ্রতিপাদক সূত্র অর্থাৎ উপনিষদাদি এইরূপ অর্থ করেন । কিন্তু লোকমান্য তিলক প্রভৃতি আধুনিক পণ্ডিতগণের মত এই যে বর্তমান মহাভারত, গীতা এবং বেদান্তদর্শন বা ব্রহ্মসূত্র এই তিনই বাদরায়ণ ব্যাসদেবেরই প্রণীত । এই হেতু ব্রহ্মসুত্রকে ব্যাসসূত্রও বলে ।

৬) ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রজ্ঞ : আমি সুখী, আমি দুঃখী, 'আমার দেহ', 'আমার গৃহ' - এই আমি কে ?
এই 'আমি' দেহ নহে, হস্তপদাদি-ইন্দ্রিয় নহে, মনও নহে, বুদ্ধিও নহে; 'আমি' এ-সকলের অতীত কোনো বস্তু, যাহার নাম জীব ও জীবাত্মা । কৃষক যেমন ক্ষেত্র হইতে ফল উৎপন্ন করিয়া ভোগ করে, জীবও তদ্রূপ এই দেহ অবলম্বন করিয়া প্রাক্তন-কর্মজনিত সুখ-দুঃখাদি ভোগ করেন, এই জন্য এই দেহের নাম ক্ষেত্র । আবার ক্ষেত্রস্বামী যেমন জানেন যে, ইহা আমার ক্ষেত্র, সুতরাং আমি মালিক, আমিই ভোক্তা, এইরূপ অভিমান করেন, সেইরূপ জীবও এই দেহ আমারই ভোগভূমি বলিয়া জানেন এবং আমার দেহ, আমার মন ইত্যাদি রূপ অভিমান করেন । এই হেতু জীবকে ক্ষেত্রজ্ঞ বলা হয় । সুতরাং বেদান্তমতে দেহ ও আত্মার যে তত্ত্ব বা বিচার তাহারই নাম ক্ষেত্র-ক্ষেত্রজ্ঞ বিচার । ইহাই সাংখ্যমতে প্রকৃতি-পুরুষ বিচার । [বিশদ]

সাংখ্যের ২৪ তত্ত্ব ব্যতীত ইচ্ছা, দ্বেষ, সুখ, দুঃখ, সংঘাত, চেতনা, ধৃতি - এই কয়েকটি অতিরিক্ত তত্ত্বের এ-স্থলে উল্লেখ করা হইয়াছে । ইচ্ছা, দ্বেষ, সুখ, দুঃখ - মনেরই গুণ, সুতরাং মনেই উহাদের সমাবেশ হয় ।
চেতনা : জীবদেহে প্রাণের ক্রিয়া বা চেষ্টা-চাঞ্চল্য । চেতনা ও চৈতন্য এক কথা নহে । সুষুপ্তি-অবস্থায় চেতনা অর্থাৎ প্রাণের ক্রিয়া থাকে কিন্তু চৈতন্য বা আমি-জ্ঞান থাকে না । এই চেতনা নামক ক্রিয়া জড় দেহেরই গুণ, আত্মার নহে, এই জন্য ইহাকে ক্ষেত্রের মধ্যেই সমাবেশ করা হয় ।
ধৃতি : মন, প্রান ইত্যাদির ক্রিয়া শরীরের মধ্যে যে শক্তির দ্বারা স্থির থাকে । ইহাও জড়দেহেরই গুণ ।
সংঘাত = সমুচ্চয় বা সংহতি; জ্ঞানেন্দ্রিয়, কর্মেন্দ্রিয়, উভয়েন্দ্রিয়, মন, প্রাণ ইত্যাদি শারীরিক ও মানসিক সমস্ত তত্ত্বের যে  সংহতি বা সমুচ্চয়, দার্শনিক ভাষায় তাহারই নাম সংঘাত বা শরীর । ক্ষেত্রের মধ্যেই উহার সমাবেশ করা হইয়াছে ।

১১) জ্ঞানীর ২০টি লক্ষণ : 'যাহা পিণ্ডে তাহা ব্রহ্মাণ্ডে' অর্থাৎ এই নশ্বর দেহেন্দ্রিয়াদির অতিরিক্ত যে অবিনশ্বর আত্মতত্ত্ব এবং নামরূপাত্মক নশ্বর ব্যক্ত জগতে অভিব্যাপ্ত যে অবিনশ্বর ব্রহ্মতত্ত্ব - এই উভয়ই এক; জীব, প্রকৃতি বা মায়ামুক্ত হইলেই এই একত্ব-জ্ঞান লাভ করে, উহাই প্রকৃত জ্ঞান । ইহাই আত্মজ্ঞান, ব্রহ্মাত্মৈক্যজ্ঞান, দেহাত্মবিবেক, পুরুষ-প্রকৃতি-বিবেক, ব্রাহ্মী-স্থিতি, কৈবল্য মুক্তি ইত্যাদি নানা কথায় ব্যক্ত করা হয় । বেদান্তী ও ব্রহ্মজ্ঞানী এক কথা নহে । যিনি এই জ্ঞান লাভ করেন, তাঁহার সর্বত্র সাম্যবুদ্ধি জন্মে, তাঁহার সর্বসময়ে শুদ্ধ বুদ্ধি, শুদ্ধ বাসনা ও শুদ্ধ আচরণ পরিদৃষ্ট হয় এবং তাঁহার অমানিত্ব, অদম্ভিত্ব প্রভৃতি গুণের উদ্রেক হয় ।

১৫) এই শ্লোকটি সম্পূর্ণ শেতাশ্বেতর উপনিষৎ [৩|১৬] হইতে আসিয়াছে ।

১৯) সাংখ্যমতে পুরুষ ও প্রকৃতি উভয়ই অনাদি এবং স্বতন্ত্র মূলতত্ত্ব; কিন্তু বেদান্তী বলেন, প্রকৃতি স্বতন্ত্র নহে, উহা পরমেশ্বর হইতেই উৎপন্ন, পরমেশ্বরেরই শক্তি এবং এই হেতুই অনাদি । গীতায় ইহাদিগকেই অপরা ও পরা প্রকৃতি বলা হইয়াছে ।

২১) পুরুষের সংসারিত্বের কারণ :
পুরুষ-প্রকৃতির সংসর্গবশত প্রকৃতির গুণ অর্থাৎ সত্ত্ব, রজঃ, তমোগুণের ধর্ম সুখ-দুঃখ-মোহাদিতে আবদ্ধ হইয়া পড়েন এবং আমি সুখী, আমি দুঃখী, আমি কর্তা, আমার কর্ম ইত্যাদি অভিমান করিয়া কর্মপাশে আবদ্ধ হন । এই সকল কর্মের ফলভোগের জন্য তাঁহাকে পুনঃপুনঃ সদসদ্‌-যোনিতে জন্মগ্রহণ করিতে হয় । সত্ত্বগুণের প্রাবল্যে দেব-যোনিতে, রজোগুণের উৎকর্ষে মনুষ্য-যোনিতে এবং তমোগুণের আধিক্যে পশ্বাদি-যোনিতে তাঁহার জন্ম হয় ।

যিনি পুরুষকে প্রকৃতি হইতে পৃথক বলিয়া জানেন, যিনি জানেন যে পুরুষ অকর্তা, উদাসীন, উপদ্রষ্টা মাত্র - তিনিই জ্ঞানী, তিনিই এই জন্মকর্মের বন্ধন হইতে মুক্ত ।

২২) উপদ্রষ্টা = সমীপে থাকিয়া যিনি দেখেন অথচ নিজে ব্যাপৃত হন না;
ভর্তা : ইন্দ্রিয়, মন, বুদ্ধি প্রভৃতি জড় হইলেও চৈতন্যময় পুরুষের চৈতন্যাভাসে উদ্ভাসিত হইয়া থাকে । ইহাকেই পুরুষের ভরণ বলা হইয়াছে এবং এই হেতুই পুরুষকে ভর্তা বলা হয় ।
ভোক্তা : যিনি স্বরূপত নির্বিকার ও নির্লিপ্ত হইলেও সুখ-দুঃখাদি যেন উপলব্ধি করেন অর্থাৎ নিত্য চৈতন্যময় বলিয়া সুখ-দুঃখাদি বৃত্তিকেও চৈতন্যগ্রস্ত করিয়া প্রকাশ করেন, তাই তিনি ভোক্তা ।

সাংখ্য দর্শন যাহাকে স্বতন্ত্র মূলতত্ত্ব পুরুষ বলেন, তাহাকেই এস্থলে পরমপুরুষ পরমাত্মা বলা হইতেছে । সুতরাং এস্থলে সাংখ্য ও বেদান্তের সমন্বয় হইয়া গেল ।

২৩) প্রকৃতি-পুরুষ বিবেক :
এই জ্ঞেয় বস্তুই ক্ষেত্রজ্ঞ, পরমাত্মা বা পরব্রহ্ম এবং প্রকৃতি-সম্ভূত দেহেন্দ্রিয়াদিই ক্ষেত্র । বেদান্তে যাহা ক্ষেত্র বা ক্ষেত্রজ্ঞ, সাংখ্য-শাস্ত্রের পরিভাষায় তাহাই প্রকৃতি ও পুরুষ এবং ক্ষেত্র-ক্ষেত্রজ্ঞ-জ্ঞানই সাংখ্যের পুরুষ-প্রকৃতি-বিবেক । এই প্রকৃতি-পুরুষের বিবেকজ্ঞান অর্থাৎ পার্থক্য-জ্ঞানেই কৈবল্য মুক্তি - যাঁহার এই জ্ঞান হইয়াছে, তাঁহার পক্ষে ধর্ম-কর্ম, বিধি-নিষেধ কিছু নাই; অনাসক্তভাবে কর্ম করিলেও তাঁহার কর্মবন্ধন নাই, কেননা তিনি ত্রিগুণাতীত মুক্তপুরুষ । প্রকৃতিই মায়া, উহাই সংসারের কারণ; সুতরাং তিনি মায়ামুক্ত, তাঁহার সংসারের ক্ষয় হইয়াছে ।

২৪) আত্মকারা : মন যখন নির্বিষয় হয়, তখন আর উহা মন থাকে না, আত্মকারাকারিত হয় । এই অবস্থায় আত্মদর্শন হয়; 'আপনি আপনাতে আত্মদর্শন করেন' [লোকমান্য তিলক] ।

২৫) ধ্যান, জ্ঞান, কর্ম, ভক্তি - গীতা এই চারটি বিভিন্ন মার্গের উল্লেখ করিয়াছেন এবং ইহার যে কোন মার্গে সাধন আরম্ভ হউক না কেন, শেষে পরমেশ্বর প্রাপ্তি বা মোক্ষ লাভ হয়ই, ইহাই গীতার উদার মত । গীতোক্ত যোগ বলিতে ইহার ঠিক কোন একটা বুঝায় না । গীতা এই চারিটি মার্গের সমন্বয় করিয়া অপূর্ব যোগধর্ম শিক্ষা দিয়াছেন । সেই যোগ কি তাহা পূর্বে নানা স্থানে প্রদর্শিত হইয়াছে । 

২৬) বেদান্ত মতে এ সংযোগকে অধ্যাস, ঈক্ষণ ইত্যাদি বলা হয় । এই অধ্যাসের ফলে ক্ষেত্রজ্ঞের ধর্ম ক্ষেত্রে আরোপিত হয় এবং ক্ষেত্রের ধর্ম ক্ষেত্রজ্ঞে আরোপিত হয় ।

২৭) ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রজ্ঞ বা প্রকৃতি ও পুরুষের সংযোগে সৃষ্টি, একথা পূর্বে বলা হইয়াছে । এই সংযোগের মধ্যে যিনি বিয়োগ দর্শন করেন অর্থাৎ প্রকৃতি হইতে পুরুষের, বা দেহ হইতে আত্মার পার্থক্য দর্শন করেন, এবং সেই এক বস্তুই সর্বত্র সমভাবে বিদ্যমান ইহা অনুভব করেন, তিনিই মুক্ত । এই শ্লোক এবং পরবর্তী কয়েকটি শ্লোকে এই তত্ত্বই বিবৃত হইয়াছে ।

২৮) আত্মঘাতী : এই দুর্লভ মানব-জন্ম লাভ করিয়াও যে আত্মার উদ্ধারের চেষ্টা করে না সে আত্মঘাতী । অথবা যিনি জানেন যে, পরহিংসা ও আত্মহিংসা একই কথা, তিনি 'আত্মার দ্বারা আত্মাকে হনন করেন না' । স্বামী বিবেকানন্দ দ্বিতীয় অর্থই গ্রহণ করিয়াছেন ।

৩০) জগতের নানাত্বের মধ্যে যিনি একমাত্র ব্রহ্মসত্ত্বাই অনুভব করেন, এবং সেই এক ব্রহ্ম হইতেই এই নানাত্বের অভিব্যক্তি ইহা যখন সাধক বুঝিতে পারেন, তখনই তাঁহার ব্রহ্মভাব লাভ হয় । 

৩২) যেমন আকাশ সর্বব্যাপী হইয়াও সুগন্ধ, দুর্গন্ধ, সলিল, পঙ্কাদির দোষ-গুণে লিপ্ত হয় না, সেইরূপ আত্মা সর্বদেহে অবস্থিত থাকিলেও দৈহিক দোষগুণে লিপ্ত হন না । 

৩৩) সূর্যের সহিত উপমার তাৎপর্য এই যে, যেমন এক সূর্য সকলের প্রকাশক অথচ নির্লিপ্ত, আত্মাও সেইরূপ । 
___________________________
Online Source: 
http://geetabangla.blogspot.com/2013/07/blog-post_27.html

*Hard Copy Source:
"Sri Gita" or "Srimadbhagabadgeeta" by Gitashastri Jagadish Chandra Ghosh & Anil Chandra Ghosh. 26th Edition - June 1997 (1st Edition, 1925 from Dhaka now in Bangladesh). Published by Subhadra Dey (Ghosh), Presidency Library, 15 Bankim Chatterjee Street, Kolkata-700073. Printed by Web Impressions Pvt.Ltd., 34/2 Beadon Street, Kolkata-700006.



Disclaimer: This site is not officially related to Presidency LibraryKolkataThis is a personal, non-commercial, research-oriented effort of a novice religious wanderer.
এটি আধ্যাত্মিক পথের এক অর্বাচীন পথিকের ব্যক্তিগত, অবাণিজ্যিক, গবেষণা-ধর্মী প্রয়াস মাত্র ।

[Uploaded by rk]


<Previous--Contents--Next>

No comments:

Post a Comment