Thursday, March 12, 2015

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা : দশম অধ্যায় - বিভূতি-যোগ (10-Jagadishchandra)


|||||||||১০|১১|১২|১৩|১৪|১৫|১৬|১৭|১৮
(গীতাশাস্ত্রী জগদীশচন্দ্র ঘোষ)*

শ্রীভগবান্‌ কহিলেন -
হে মহাবাহো, তুমি আমার বাক্য শ্রবণে প্রীতি লাভ করিয়াছ, আমি তোমার হিতার্থ পুনরায় উৎকৃষ্ট কথা বলিতেছি, তাহা শ্রবণ কর । ১

কি দেবগণ, কি মহর্ষিগণ কেহই আমার প্রভাব বা উৎপত্তির বিষয় জ্ঞাত নহেন ।  কেননা আমি দেব ও মনুষ্যগণের সর্বপ্রকারেই আদিকারণ । ২

যিনি জানেন যে আমার আদি নাই, জন্ম নাই, আমি সর্বলোকের মহেশ্বর, মনুষ্য মধ্যে তিনি মোহশূন্য হইয়া সর্বপাপ হইতে মুক্ত হন । ৩

বুদ্ধি, জ্ঞান, কর্তব্য বিষয়ে অব্যাকুলতা, ক্ষমা, সত্য, দম, শম, সুখ, দুঃখ, জন্ম, মৃত্যু, ভয়, অভয়, অহিংসা, রাগদ্বেষাদি বিষয়ে সমচিত্ততা, সন্তোষ, তপঃ, দান এবং যশ ও অযশ - প্রাণিগণের এই সমস্ত ভিন্ন ভিন্ন ভাব (অবস্থা) আমা হইতেই উৎপন্ন হইয়া থাকে । ৪,৫

ভৃগু প্রভৃতি সপ্তমহর্ষি, তাঁহাদের পূর্ববর্তী চারি জন মহর্ষি (অথবা সংকর্ষণাদি চতুর্ব্যুহ) এবং স্বায়ম্ভূবাদি মনুগণ,- ইহারা সকলেই আমার মানসজাত এবং আমার জ্ঞানৈশ্বর্য-শক্তিসম্পন্ন; জগতের সকল প্রজা তাহাদিগ হইতে উৎপন্ন হইয়াছে । ৬

যিনি আমার এই বিভূতি (ভৃগু, মন্বাদি) এবং যোগৈশ্বর্য যথার্থরূপে জানেন, তিনি মৎভক্তিলক্ষণ স্থির যোগ লাভ করেন এবং আমাতেই সমাহিতচিত্ত হন, তাহাতে সংশয় নাই । ৭

আমি সমস্ত জগতের উৎপত্তির কারণ ।  আমা হইতে সমস্ত প্রবর্তিত হয়; বুদ্ধিমান্‌গণ ইহা জানিয়া প্রেমাবিষ্ট হইয়া আমার ভজনা করেন । ৮

যাহাদিগের চিত্তই আমাতেই অর্পিত, যাঁহারদের প্রাণ মদ্গত (আমাকে ভিন্ন যাঁহারা প্রাণ ধারণে অসমর্থ), এইরূপ ভক্তগণ পরস্পরকে আমার কথা বুঝাইয়া এবং সর্বদা আমার কথা কীর্তন করিয়া পরম সন্তোষ লাভ করেন ।  তাঁহাদের আর কোন অভাব থাকে না, সুতরাং তাহারা পরম প্রেমানন্দ উপভোগ করিয়া থাকেন । ৯

যাঁহারা সতত আমাতে চিত্তার্পণ করিয়া প্রীতিপূর্বক আমার ভজনা করেন সেই সকল ভক্তকে আমি ঈদৃশ বুদ্ধিযোগ প্রদান করি, যদ্দারা তাঁহারা আমাকে লাভ করিয়া থাকেন । ১০

আমার সেই ভক্তগণের প্রতি অনুগ্রহার্থই তাঁহাদের অন্তঃকরণে অবস্থিত হইয়া উজ্জ্বল জ্ঞানরূপ দীপদ্বারা তাহাদের অজ্ঞানান্ধকার বিনষ্ট করি । ১১

অর্জুন বলিলেন -

আপনি পরব্রহ্ম, পরম ধাম, পরম পবিত্র, ভৃগু প্রভৃতি ঋষিগণ, দেবর্ষি নারদ ও অসিত, দেবল এবং ব্যাস প্রভৃতি আপনাকে নিত্য-পুরুষ, স্বয়ংপ্রকাশ, আদিদেব, জন্মরহিত ও সর্বব্যাপী বিভু বলেন ।  আপনি স্বয়ং আমাকে তাহাই বলিলেন । (১২,১৩)

হে কেশব ! তুমি যাহা আমাকে বলিতেছ সে সকলই সত্য বলিয়া মানি; কারণ, হে ভগবন্ ‌! কি দেব কি দানব, কেহই তোমার প্রভাব (বা আবির্ভাবতত্ত্ব) জানেন না (আমি ক্ষুদ্র মনুষ্য, উহা কি বুঝিব ?) ১৪

হে পুরুষত্তম, হে ভূতভাবন, দেবদেব, হে জগৎপতে, তুমি আপনি আপন জ্ঞানে আপন স্বরূপ জান ।  (তোমার স্বরূপ আর কেহ জানে না) । ১৫

তুমি যে যে বিভূতি দ্বারা সর্বলোক ব্যাপিয়া রহিয়াছ তাহা তুমিই বলিতে সমর্থ ।  সে সকল বিস্তৃতরূপে আমাকে কৃপাপূর্বক বল । ১৬

হে যোগিন্‌, কি প্রকারে সতত চিন্তা করিলে আমি তোমাকে জানিতে পারি ? হে ভগবন্‌‌, আমি তোমাকে কোন্‌ কোন্‌ পদার্থে কি ভাবে চিন্তা করিব, তাহা বল । ১৭

হে জনার্দন ! তুমি পুনরায় তোমার যোগৈশ্বর্য ও বিভূতি-সকল আমাকে বিস্তৃতরূপে বল ।  যেহেতু তোমার অমৃতোপম বচন শ্রবণ করিয়া আমার তৃপ্তি হইতেছে না । ১৮

শ্রীভগবান্‌ কহিলেন
-

আচ্ছা, আমার প্রধান প্রধান দিব্য বিভূতিসকল তোমাকে বলিতেছি ।  কারণ আমার বিভূতি-বাহুল্যের অন্ত নাই ।  (সুতরাং সংক্ষেপে বলিতেছি ।) ১৯

হে অর্জুন, সর্বভূতের হৃদয়স্থিত আত্মা (প্রত্যক্‌ চৈতন্য) আমিই । আমিই সর্বভূতের উৎপত্তি, স্থিতি ও সংহার স্বরূপ (অর্থাৎ সৃষ্টি, স্থিতি ও লয়কর্তা) । ২০

দ্বাদশ আদিত্যের মধ্যে আমি বিষ্ণু নামক আদিত্য ।  জ্যোতিষ্কগণের মধ্যে আমি কিরণমালী সূর্য ।  মরুৎগণের মধ্যে আমি মরীচি এবং নক্ষত্রগণের মধ্যে চন্দ্র । ২১

বেদসমূহের মধ্যে আমি সামবেদ, দেবগণের মধ্যে আমি ইন্দ্র, ইন্দ্রিয়গণের মধ্যে আমি মন এবং ভূতগণের আমি চেতনা (জ্ঞানশক্তি) । ২২

একাদশ রুদ্রের মধ্যে আমি শঙ্কর, যক্ষরক্ষোগণের মধ্যে আমি কুবের, অষ্ট বসুর মধ্যে আমি অগ্নি এবং পর্বতগণের মধ্যে আমি সুমেরু । ২৩

হে পার্থ ! আমাকে পুরোহিতগণের প্রধান বৃহস্পতি জানিও, আমি সেনানায়কগণের মধ্যে দেব সেনাপতি কার্তিকেয় এবং জলাশয় সমূহের মধ্যে আমি সাগর । ২৪

মহর্ষিগণের মধ্যে আমি ভৃগু, শব্দসকলের মধ্যে আমি একাক্ষর ওঁকার, যজ্ঞসকলের মধ্যে আমি জপযজ্ঞ এবং স্থাবর পদার্থের মধ্যে আমি হিমালয় । ২৫

আমি বৃক্ষসকলের মধ্যে অশ্বত্থ, দেবর্ষিগণের মধ্যে নারদ, গন্ধর্বগণের মধ্যে চিত্ররথ এবং সিদ্ধপুরুষগণের মধ্যে কপিলমুনি । ২৬

অশ্বগণের মধ্যে অমৃতার্থ সমুদ্র মন্থনকালে উদ্ভূত উচ্চৈঃশ্রবাঃ বলিয়া আমাকে জানিও; এবং হস্তিগণের মধ্যে ঐরাবত এবং মনুষ্যগণের মধ্যে রাজা বলিয়া আমাকে জানিও । ২৭

আমি অস্ত্রসমুহের মধ্যে বজ্র, ধেনুগণের মধ্যে কামধেনু, আমি প্রাণিগণের উৎপত্তি হেতু কন্দর্প; এবং আমি সর্পগণের মধ্যে বাসুকি । ২৮

নাগগণের মধ্যে আমি অনন্ত, জলচরগণের মধ্যে আমি জলদেবতা বরুণ, পিতৃগণের মধ্যে আমি অর্যমা, এবং ধর্মাধর্ম ফলদানের নিয়ন্তৃগণ মধ্যে আমি যম । ২৯

দৈত্যগণের মধ্যে আমি প্রহ্লাদ, গ্রাসকারীদিগের মধ্যে আমি কাল, পশুগণের মধ্যে আমি সিংহ, পক্ষিগণের মধ্যে আমি গরুড় । ৩০

বেগবান্‌দিগের মধ্যে আমি বায়ু, শস্ত্রধারিগণের মধ্যে আমি দাশরথি রাম, মৎস্যগণের মধ্যে আমি মকর এবং নদীসমুহের মধ্যে আমি গঙ্গা । ৩১

হে অর্জুন, সৃষ্ট পদার্থ মাত্রেই আদি, মধ্য ও অন্ত (উৎপত্তি, স্থিতি ও বিনাশকর্তা) আমি, বিদ্যাসমূহের মধ্যে আমি আত্মবিদ্যা বা ব্রহ্মবিদ্যা; তার্কিকগণের বাদ, জল্প ও বিতণ্ডা নামক তর্কসমূহের মধ্যে আমি বাদ (তত্ত্বনির্ণয়ার্থ বিচার) । ৩২

অক্ষরসমূহের মধ্যে আমি অকার, সমাসসমূহের মধ্যে আমি দ্বন্দ্ব, আমিই অক্ষয় কালস্বরূপ, এবং আমিই সমুদয় কর্মফলের বিধান-কর্তা । ৩৩

সংহর্তাদিগের মধ্যে আমি সর্বসংহারক মৃত্যু, ভবিষ্য প্রাণিগণেরও আমি উদ্ভব স্বরূপ; নারীগণের মধ্যে আমি কীর্তি, শ্রী, বাক্‌, স্মৃতি, মেধা, ধৃতি, ক্ষমা - এই সকল দেবতাস্বরূপ, অর্থাৎ ঐ সকল আমারই বিভূতি । ৩৪

আমি সামবেদোক্ত মন্ত্রসকলের মধ্যে বৃহৎ সাম, ছন্দোবিশিষ্ট মন্ত্রের মধ্যে গায়ত্রী; আমি বৈশাখাদি দ্বাদশ মাসের মধ্যে অগ্রহায়ণ মাস, এবং ঋতুসকলের মধ্যে বসন্ত ঋতু । ৩৫

আমি বঞ্চনাকারিগণের দ্যূতক্রীড়া (Gambling), আমি তেজস্বিগণের তেজঃ ।  বিজয়ী পুরুষের জয়, উদ্যোগী পুরুষের উদ্যম এবং সাত্ত্বিক পুরুষের সত্ত্বগুণ । ৩৬

আমি বৃষ্ণি-বংশীয়দিগের মধ্যে শ্রীকৃষ্ণ, পাণ্ডবগণের মধ্যে ধনঞ্জয়, মুনিগণের মধ্যে ব্যাস, কবিগণের মধ্যে শুক্রাচার্য । ৩৭

আমি শাসনকর্তৃগণের দণ্ড, জয়েচ্ছু ব্যক্তিগণের সামাদি-নীতি, গুহ্য বিষয়ের মধ্যে মৌন, এবং জ্ঞানিগণের জ্ঞান । ৩৮

হে অর্জুন, সর্বভূতের যাহা বীজস্বরূপ তাহাই আমি, আমা ব্যতীত উদ্ভূত হইতে পারে চরাচরে এমন পদার্থ নাই । ৩৯

হে পরন্তপ, আমার দিব্য বিভূতিসমূহের অন্ত নাই ।  আমি এই যাহা কিছু বিভূতি বিস্তার বলিলাম, তাহা আমার বিভূতিসকলের সংক্ষেপে বা দিগ্‌দর্শন মাত্র । ৪০

যাহা যাহা কিছু ঐশ্বর্যযুক্ত, শ্রীসম্পন্ন অথবা অতিশয় শক্তিসম্পন্ন তাহাই আমার শক্তির অংশসম্ভূত বলিয়া জানিবে । ৪১

অথবা হে অর্জুন, তোমার এত বহু বিভূতিবিস্তার জানিয়া প্রয়োজন কি? (এক কথায় বলিতেছি) আমি এই সমস্ত জগৎ আমার একাংশ মাত্র দ্বারা ধারণ করিয়া অবস্থিত আছি । ৪২
___________________________


(১) সপ্তম, অষ্টম ও নবম অধ্যায়ে  পরমেশ্বরের স্বরূপ বর্ণনপ্রসঙ্গে তাঁহার নানা ব্যক্ত রূপ বা বিভূতির কথা সংক্ষেপে বলা হইয়াছে ।  উহাই এই অধ্যায়ে সবিস্তারে বলিবেন ।

(২) ঋগ্‌বেদীয় নাসদীয় সূক্তের ঋষি আদি কারণ সন্বন্ধে ঠিক এই কথাই বলিয়াছে - ‘অর্বাগ্‌ দেবা অস্য বিসর্জ্জনেনাথ কো বেদ যত আবভূব’ [ঋক্‌|১০|১|৯|৬], - দেবতারাও এই বিসর্গের (সৃষ্টির) পরে হইল ।  আবার উহা সেখান হইতে নিঃসৃত হইল তাহা কে জানিবে ?

(৪,৫) তিনিই সকল অবস্থা, সকল ভাব, সকল বৃত্তির মূল কারণ ।  তাহাই এই দুইটি শ্লোকে বলা হইয়াছে ।

৬) সপ্ত মহর্ষি : 1)মরীচি, 2)অঙ্গিরস, 3)অত্রি, 4)পুলস্ত্য, 5)পুলহ, 6)ক্রতু, 7)বশিষ্ঠ [মভাঃ|শাঃ|৩৩৫|২৮-২৯, ৩৪০|৪৪-৪৫] । মতান্তরে 1)ভৃগু, 2)মরীচি, 3)অত্রি, 4)অঙ্গিরা, 5)পুলহ, 6)পুলস্ত্য, 7)ক্রতু ।

পূর্বে চত্বারঃ : টীকাকারগণের অনেকেই বলেন, ইঁহারা (i)সনক, (ii)সনন্দ, (iii)সনাতন, (iv)সনৎকুমার, এই চারি মহর্ষি; কিন্তু ইঁহারা সকলেই চিরকুমার, প্রজা সৃষ্টি করেন নাই । সুতরাং লোকমান্য তিলক বলেন, - ইঁহারা (i)বাসুদেব (আত্মা), (ii)সঙ্কর্ষণ (জীব), (iii)প্রদ্যুম্ন (মন), (iv)অনিরুদ্ধ (অহঙ্কার), এই চারি মূর্তি বা 'চতুর্ব্যূহ' । মহাভারতে নারায়ণীয় বা ভাগবত-ধর্ম বর্ণনায় এই চতুর্ব্যূহের উল্লেখ আছে এবং গীতায়ও এই ভাগবত-ধর্মই প্রতিপাদিত হইয়াছে । এখানে বলা হইতেছে যে, এই চারি ব্যূহ এক সর্বতঃপূর্ণ বাসুদেবেরই বিভাব ।

মনবঃ : চতুর্দশ মনু, যথা 1)স্বায়ম্ভূব, 2)স্বারোচিষ, 3)উত্তম, 4)তামস, 5)রৈবত, 6)চাক্ষুষ, 7)বৈবস্বত, 8)সাবর্ণি, 9)দক্ষসাবর্ণি, 10)ব্রহ্মসাবর্ণি, 11)ধর্মসাবর্ণি, 12)রুদ্রসাবর্ণি, 13)দেবসাবর্ণি, 14) ইন্দ্রসাবর্ণি । [বিশদ]

১১) 'পরাভক্তি ও পরা বিদ্যা এক...' [স্বামী বিবেকানন্দ] । যাঁহারা অনন্যভক্তি যোগে তাঁহার ভজনা করেন, তাঁহারা সেই ভক্তিবলেই তত্ত্বজ্ঞান লাভ করিয়া মায়ামোহ-নির্মুক্ত হইয়া তাঁহাকে প্রাপ্ত হন ।

১৭) অবতার, আবেশ, বিভূতি :
অবতার : ভক্তিশাস্ত্রে নানাবিধ অবতারের উল্লেখ আছে - পুরুষ অবতার (সঙ্কর্ষণাদি), লীলাবতার (মৎস্য-কূর্মাদি), যুগাবতার (শ্রীচৈতন্য, শ্রীরামকৃষ্ণ) ।

আবেশ : যখন কোনো মহাপুরুষে ঈশ্বরের শক্তিবিশেষের বিশেষ অভিব্যক্তি হয়, তখন তাহাকে আবেশ বলে; যেমন সনকাদিতে জ্ঞানশক্তি, নারদে ভক্তিশক্তি, অনন্তে ভূধারণশক্তি ইত্যাদি । ইঁহাদিগকে শক্ত্যাবেশ-অবতারও বলা হয় ।

বিভূতি : বিশ্বে সর্বত্রই ঐশী শক্তিরই প্রকাশ, কিন্তু যাহা-কিছু অতিশয় ঐশ্বর্যযুক্ত, শ্রীসম্পন্ন বা শক্তিসম্পন্ন তাহাতেই তাঁহার শক্তির বিশেষ অভিব্যক্তি কল্পনা করা হয় । ইহাকেই বিভূতি বলে । বলা বাহুল্য, বিভূতি ঈশ্বর নহেন ।

'একটি বিড়ালের মধ্যে ঈশ্বর দর্শন - সে তো খুব ভাল কথা - তাহাতে কোনো বিপদাশঙ্কা নাই, বিড়ালের বিড়ালত্ব ভুলিতে পারিলেই আর-কোনো গোল নাই, কারণ তিনিই সব । কিন্তু বিড়ালরূপী ঈশ্বর প্রতীক মাত্র ।' - [স্বামী বিবেকানন্দ]

২১) দ্বাদশ আদিত্য - ধাতা, মিত্র, অর্যমা, রুদ্র, বরুণ, সূর্য, ভগ, বিবস্বান, পূষা, সবিতা, ত্বষ্টা, বিষ্ণু । [বিশদ]

মরুতাম্‌ - ঊনপঞ্চাশ বায়ুর মধ্যে ।

২২) সাধারণতঃ বেদসমূহ মধ্যে ঋগ্বেদকেই প্রধান বলা হয় এবং ৯।১৭ শ্লোকে ‘ঋক্‌সামযজুরেব চ’ এই কথায় উহাকেই অগ্র স্থান দেওয়া হইয়াছে ।  কিন্তু সামবেদ গান-প্রধান বলিয়া উহার আকর্ষণী শক্তি অধিক এবং ভক্তিমার্গে পরমেশ্বরের স্তবস্তুতিমূলক সঙ্গীতেরই প্রাধান্য দেওয়া হয় ।  - ‘মদ্ভক্তা যত্র গায়ন্তি তত্র তিষ্ঠামি নারদ ।’ এই হেতু যাগযজ্ঞাদি ক্রিয়াকর্মাত্মক বেদ অপেক্ষা গানপ্রধান সামবেদেরেই শ্রেষ্ঠত্ব কথিত হইয়াছে ।

২৫) জপযজ্ঞ - নামমাহাত্ম্য : সর্ববিধ যজ্ঞের (দ্রব্য-, জ্ঞান-, ব্রহ্ম-, তপো-যজ্ঞ) মধ্যে জপযজ্ঞ বা নামযজ্ঞই শ্রেষ্ঠ । সুতরাং উহাই শ্রীভগবানের বিভূতি । কলিতে নাম-সংকীর্তনই শ্রেষ্ঠ সাধন বলিয়া পরিগণিত । শ্রীমাদ্ভাগবত বলেন - কলি অশেষ দোষের আকর হইলেও উহার একটি মহৎ গুণ এই যে, কলিতে কৃষ্ণনাম-কীর্তন দ্বারাই সংসারবন্ধন হইতে মুক্ত হইয়া পরমগতি প্রাপ্ত হওয়া যায়

নামের দার্শনিক তত্ত্ব : নাম ও নামী অভেদ । সমগ্র জগৎ নামরূপাত্মক । ভাব, নাম ও রূপ - একই বস্তু, সূক্ষতর, কিঞ্চিৎ ঘনীভূত ও সম্পূর্ণ ঘনীভূত । সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডের অন্তরালে নাম রহিয়াছে, আর সেই নাম হইতেই এক বহির্জগৎ সৃষ্ট বা বহির্গত হইয়াছে ।

সকল ধর্মেই এই নামকে শব্দব্রহ্ম বলিয়া থাকে । হিন্দুদের মতে এই নাম বা শব্দ ওঁ; এই ওঁকার জগতের সমষ্টিভাব বা ঈশ্বরের নাম । ব্যষ্টিভাব তাঁহার অনন্ত নাম । বস্তুত এইরূপ নাম বা পবিত্র শব্দ অনেক আছে । ভক্ত যোগীরা সেই বিভিন্ন নামের সাধন-উপদেশ দিয়া থাকেন । সদ্গুরু-পরম্পরা-ক্রমে আসিলেই নাম শক্তিসম্পন্ন থাকে এবং পুনঃপুনঃ জপে তাহা অনন্তশক্তিসম্পন্ন হয় । ঐ মন্ত্রের বারবার উচ্চারণে ভক্তির উচ্চতম অবস্থা আসে । - [স্বামী বিবেকানন্দ, ভক্তিরহস্য]

২৬) দেবর্ষি - দেবতা হইয়াও যিনি মন্ত্রদ্রষ্টা বলিয়া ঋষিত্ব লাভ করিয়াছেন, যেমন নারদ ।
গন্ধর্বগণ = দেবগায়ক
কপিলমুনি = সাংখ্যদর্শনের প্রণেতা ।

২৮) কন্দর্পঃ = কাম
প্রজনঃ : প্রাণিগণের উৎপত্তি-হেতু কন্দর্প (কাম), এই কথাতে সম্ভোগমাত্র যে কামের পরিণাম তাহা নিকৃষ্ট, ইহাই সূচিত হইয়াছে ।

২৯) অর্যমা - পিতৃগণের অধিপতি । পিতৃগণের নাম এই - অগ্নিষ্বত্বা, সৌম্য, হবিষ্মান, উষ্মপা, সুকাল, বহির্ষদ এবং আজ্যপ । বেদে অর্যমার নাম দৃষ্ট হয় ।

নাগ ও সর্প : ইহারা এ-স্থলে দুই বিভিন্ন জাতি বলিয়া বর্ণিত হইয়াছে । সর্পগণের রাজা বাসুকি এবং নাগগণের রাজা অনন্ত বা শেষনাগ । অনন্ত অগ্নিবর্ণের এবং বাসুকি হরিদ্রাবর্ণের ।

৩০) কলয়তাম্‌ : সকলকেই বশীভূত করেন বা সকলেরই দিন গণনা করেন কাল, অথবা ঘটনাসমূহের নির্দেশকারিগণের মধ্যে কালই শ্রেষ্ঠ । কিংবা কলয়ৎ-শব্দের অর্থ গ্রাসকারীও হয় [তিলক] ।

৩২) তর্কশাস্ত্রে তিন প্রকার তর্ক আছে - (i)জল্প (জিগীষা-পরতন্ত্র হইয়া যে-প্রকারেই হউক আত্মমত-স্থাপন), (ii)বিতণ্ডা (পরপক্ষদূষণ), (iii)জিগীষু না হইয়া কেবল সত্য নির্ণয়ের জন্য উভয় পক্ষে যে বিচার) ।

পূর্বে ২০ শ্লোকে ‘আমি ভূত সকলের আদি, অন্ত ও মধ্য’ এরূপ বলা হইয়াছে ।  উহা সচেতন সৃষ্টি সন্বন্ধে বলা হইয়াছে এবং এই শ্লোকে চরাচর সমগ্র সৃষ্টি সন্বন্ধেই এই কথা বলা হইল, ইহাই প্রভেদ ।

৩৩) অকার আদি বর্ণ এবং সকল বর্ণের ইচ্চারণে উহাই প্রকাশিত হয়; এই হেতু উহার শ্রেষ্ঠত্ব ।
দ্বন্দ্ব-সমাসে উভয় পদেরই প্রাধান্য থাকে, এই হেতু উহা শ্রেষ্ঠ ।
এখানে কাল বলিতে অবিচ্ছিন্ন প্রবাহস্বরূপ অক্ষয় কাল (eternal time) ।

৩৪) কীর্তি, লক্ষ্মী, ধৃতি, সেবা, পুষ্টি, শ্রদ্ধা, ক্রিয়া, বুদ্ধি, লজ্জা, মতি - দক্ষের এই দশ কন্যার ধর্মের সহিত বিবাহ হয় ।  এইজন্য ইহাদিগকে ধর্মপত্নী বলে ।  উহার তিনটা এখানে উল্লিখিত হইয়াছে ।

৩৫) বৃহৎসাম - এই মন্ত্রদ্বারা ইন্দ্র (ব্রহ্ম) সর্বেশ্বররূপে স্তুত হন । এইহেতু মোক্ষ-প্রতিপাদক বলিয়া উহার শ্রেষ্ঠত্ব ।
মার্গশীর্ষ বা অগ্রহায়ণ মাস হইতেই সে-সময়ে বৎসর গণনা হইত, এই হেতু মার্গশীর্ষকে প্রধান স্থান দেওয়া হয়েছে [মভা|অনু|১০৬,১০৯; বাল্মিকী রামায়ণ|৩|১৬; ভাগবত|১১|১৬|২৭] । মার্গশীর্ষ নক্ষত্রকে অগ্রহায়ণী অর্থাৎ বর্ষারম্ভের নক্ষত্র বলা হইত [গীতারহস্য, লোকমান্য তিলক] ।

৩৬) ভাল-মন্দ সকলই তাঁহা হইতে জাত, সুতরাং বঞ্চনা করিবার শ্রেষ্ঠ উপায় যে দ্যূতক্রীড়া তাহাও তাঁহারই বিভূতি [গী|৭|১২] ।

৩৭) মুনি = বেদার্থমননশীল; কবি = সূক্ষ্মার্থদর্শী; শুক্রাচার্য = অসুরদিগের গুরু

যে শ্রেণীর যাহা প্রধান তাহাতেই ঐশ্বরিক শক্তির সমধিক বিকাশ এবং তাহাই বিভূতি বলিয়া গণ্য ।  এই হেতু বৃষ্ণিগণের প্রধান শ্রীকৃষ্ণ, ভগবান্‌ শ্রীকৃষ্ণের বিভূতি ।  ব্যাসদেব মুনিগণের প্রধান ।  ইনি বেদ বিভাগ করেন এবং মহাভারত, ভাগবত ও অন্যান্য পুরাণ সমস্ত রচনা করেন ।  আবার, ব্রহ্মসূত্র বা বেদান্ত দর্শনের রচয়িতা বলিয়াও ইনি প্রসিদ্ধ ।  অথচ এই সকল গ্রন্থের রচনাকাল শত শত বৎসর ব্যবধান ।  এই হেতু অনেকে বলেন - এক ব্যাসই বহুবার জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন ।  যোগিশ্রেষ্ঠ বশিষ্ঠদেব লিখিয়াছেন যে, এক ব্যাসকেই বহুবার জন্মগ্রহণ করিতে দেখিয়াছেন ।  -“ইমং ব্যাসমুনিং তত্র দ্বাত্রিংশং সংস্মরাম্যহম্‌’’ ।

৩৮) নীতিঃ : শত্রুজয় বা রাজ্যরক্ষার উপায় । রাজনীতি (State-crafts) - সাম, দান, ভেদ, দণ্ড ।

দণ্ড, রাজ্যশাসন বা সমাজশাসনের মুখ্য উপায়, এই হেতু উহা বিভূতি; মৌনাবলম্বন করিলে মনোভাব কিছুতেই ব্যক্ত হয় না, সুতরাং উহাই শ্রেষ্ঠ গোপনহেতু ।

বিশ্বানুগ - বিশ্বাতিগ :
শ্রীভগবান বলিতেছেন, - 'আমি একাংশে এই চরাচর বিশ্ব ব্যাপিয়া আছি, আমি বিশ্বরূপ ।' তবে অপরাংশ কিরূপ, কোথায় ? মানব-বুদ্ধি বিশ্বরূপের ধারণাতেই বিহ্বল হইয়া যায়, বিশ্বের অতীত, নাম-রূপের অতীত যে বস্তু, তাহা সে ধারণাই করিতে পারে না । তাহা অনন্ত, অব্যক্ত, অজ্ঞেয় । তিনি মায়া স্বীকার করিয়া সোপাধিক হইলেও সসীম হন না । তিনি বিশ্বানুগ (Immanent) হইয়াও বিশ্বাতিগ (Transcendental), প্রপঞ্চাভিমানী হইয়াও প্রপঞ্চাতীত । তাঁহার এই প্রপঞ্চাতীত বিশ্বাতিগ নির্গুণ স্বরূপ ধারণার অতীত ।
___________________________
Online Source: 
http://geetabangla.blogspot.com/2013/07/blog-post.html

*Hard Copy Source:
"Sri Gita" or "Srimadbhagabadgeeta" by Gitashastri Jagadish Chandra Ghosh & Anil Chandra Ghosh. 26th Edition - June 1997 (1st Edition, 1925 from Dhaka now in Bangladesh). Published by Subhadra Dey (Ghosh), Presidency Library, 15 Bankim Chatterjee Street, Kolkata-700073. Printed by Web Impressions Pvt.Ltd., 34/2 Beadon Street, Kolkata-700006.



Disclaimer: This site is not officially related to Presidency LibraryKolkataThis is a personal, non-commercial, research-oriented effort of a novice religious wanderer.
এটি আধ্যাত্মিক পথের এক অর্বাচীন পথিকের ব্যক্তিগত, অবাণিজ্যিক, গবেষণা-ধর্মী প্রয়াস মাত্র ।

[Uploaded by rk]


<Previous--Contents--Next>

No comments:

Post a Comment