অর্জুন কহিলেন -
হে কৃষ্ণ, যাঁহারা শাস্ত্রবিধি ত্যাগ করিয়া (অথচ) শ্রদ্ধাযুক্ত হইয়া যাগযজ্ঞ পূজাদি করিয়া থাকেন, তাঁহাদিগের নিষ্ঠা কিরূপ ? সাত্ত্বিকী, না রাজসী, না তামসী ? ১
শ্রীভগবান্ কহিলেন -
দেহীদিগের সাত্ত্বিকী, রাজসী ও তামসী, এই তিন প্রকারের শ্রদ্ধা আছে, উহা স্বভাবজাত অর্থাৎ পূর্বজন্মের সংস্কার-প্রসূত; তাহা বিস্তারিত বলিতেছি, শ্রবণ কর । ২
হে ভারত, সকলেরই শ্রদ্ধা নিজ নিজ অন্তঃকরণ-প্রবৃত্তি বা স্বভাবের অনুরূপ হইয়া থাকে । মনুষ্য শ্রদ্ধাময়; যে যেইরূপ শ্রদ্ধাযুক্ত, সে সেইরূপই হয় । ৩
সাত্ত্বিক ব্যক্তিগণ দেবগণের পূজা করেন, রাজসিক প্রকৃতির ব্যক্তিগণ যক্ষরক্ষদিগের পূজা করেন এবং তামসিক ব্যক্তিগণ ভূত-প্রেতের পূজা করিয়া থাকে । ৪
দম্ভ, অহঙ্কার, কামনা ও আসক্তিযুক্ত এবং বলগর্বিত হইয়া যে সকল অবিবেকী ব্যক্তি শরীরস্থ ভূতগণকে এবং অন্তর্যামিরূপে দেহমধ্যস্থ আমাকে কৃশ করিয়া (কষ্ট দিয়া) শাস্ত্রবিধিবিরুদ্ধ অত্যুগ্র তপস্যাদি করিয়া থাকে, তাহাদিগকে আসুরবুদ্ধিবিশিষ্ট বলিয়া জানিবে । ৫,৬
(প্রকৃতিভেদে) সকলেরই প্রিয় আহারও ত্রিবিধ হইয়া থাকে; সেইরূপ যজ্ঞ, তপস্যা এবং দানও ত্রিবিধ; উহাদের মধ্যে যেরূপ প্রভেদ তাহা শ্রবণ কর । ৭
যাহা আয়ু, উৎসাহ, বল, আরোগ্য, চিত্ত-প্রসন্নতা ও রুচি - এ সকলের বর্ধনকারী এবং সরস, স্নেহযুক্ত, সারবান্ এবং প্রীতিকর - এইরূপ (সাত্ত্বিক) আহার সাত্ত্বিক ব্যক্তিগণের প্রিয় । ৮
অতি কটু, অতি অম্ল, অতি লবণাক্ত, অতি উষ্ণ, তীক্ষ্ণ, বিদাহী এবং দুঃখ, শোক ও রোগ উৎপাদক (রাজসিক) আহার রাজস ব্যক্তিগণের প্রিয় । ৯
যে খাদ্য বহু পূর্বে পক্ক, যাহার রস শুষ্ক হইয়া গিয়াছে, যাহা দুর্গন্ধ, পর্যুষিত (বাসি), উচ্ছিষ্ট ও অপবিত্র, তাহা তামস ব্যক্তিগণের প্রিয় । ১০
ফলাকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করিয়া 'যজ্ঞ করিতে হয় তাই করি' এইরূপ অবশ্য-কর্তব্য বোধে শাস্ত্রবিধি অনুসারে শান্তচিত্তে যে যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয়, তাহা সাত্ত্বিক যজ্ঞ । ১১
কিন্তু হে ভরতশ্রেষ্ঠ, ফল লাভের উদ্দেশ্যে এবং দম্ভার্থে (নিজ ঐশ্বর্য, মহত্ত্ব বা ধার্মিকতা প্রকাশার্থ) যে যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয় তাহাকে রাজস-যজ্ঞ বলিয়া জানিবে । ১২
শাস্ত্রোক্ত বিধিশূন্য, অন্নদানহীন, শাস্ত্রোক্ত মন্ত্রহীন, দক্ষিণাহীন, শ্রদ্ধাশূন্য যজ্ঞকে তামস-যজ্ঞ বলে । ১৩
দেব, দ্বিজ, গুরু, বিদ্বান্ ব্যক্তির পূজা, শৌচ, সরলতা, ব্রহ্মচর্য, অহিংসা, এই সকলকে শারীর তপস্যা বলে । ১৪
যাহা কাহারও উদ্বেগকর হয় না, যাহা সত্য, প্রিয় ও হিতকর এইরূপ বাক্য এবং যথাবিধি শাস্ত্রাভ্যাস - এই সকলকে বাঙ্ময় বা বাচিক তপস্যা বলা হয় । ১৫
চিত্তের প্রসন্নতা, অক্রুরতা, বাক্-সংযম, আত্মসংযম বা মনসংযম এবং অন্যের সহিত ব্যবহারে কপটতারাহিত্য, এই সকলকে মানসিক তপস্যা বলে । ১৬
পূর্বোক্ত ত্রিবিধ তপস্যা যদি ফলাকাঙ্ক্ষাশূন্য, ঈশ্বরে একাগ্রচিত্ত ব্যক্তিগণ কর্তৃক পরম শ্রদ্ধা সহকারে অনুষ্ঠিত হয়, তবে তাহাকে সাত্ত্বিক তপস্যা বলে । ১৭
সৎকার, মান ও পূজা লাভ করিবার জন্য দম্ভ সহকারে যে তপস্যা অনুষ্ঠিত হয় এবং ইহলোকে যাহার ফল অনিত্য এবং অনিশ্চিত, তাহাকে রাজসিক তপস্যা বলে । ১৮
মোহাচ্ছন্নবুদ্ধিবশে নিজের শরীরাদিকেও পীড়া দিয়া অথবা জারণ, মারণাদি অভিচার দ্বারা পরের বিনাশার্থ যে তপস্যা অনুষ্ঠিত হয়, তাহাকে তামস তপস্যা বলে । ১৯
"দান করা উচিত, তাই দান করি" এইরূপ কর্তব্য-বুদ্ধিতে উপযুক্ত দেশ, কাল ও পাত্র বিবেচনা করিয়া অনুপকারী ব্যক্তিকে (অর্থাৎ প্রত্যুপকারের আশা না রাখিয়া) যে দান করা হয়, তাহাকে সাত্ত্বিক দান বলে । ২০
পরন্তু প্রত্যুপকারের আশায় অথবা স্বর্গাদি ফল কামনায় অতি কষ্টের সহিত যে দান করা হয়, তাহাকে রাজস দান বলে । ২১
অনুপযুক্ত দেশে, অনুপযুক্ত কালে এবং অনুপযুক্ত পাত্রে যে দান এবং (উপযুক্ত দেশকালপাত্রে প্রদত্ত হইলেও) সৎকারশূন্য এবং অবজ্ঞাসহকারে কৃত যে দান, তাহাকে তামস দান বলে । ২২
(শাস্ত্রে) 'ওঁ তৎ সৎ' এই তিন প্রকারে পরব্রহ্মের নাম নির্দেশ করা হইয়াছে; এই নির্দেশ হইতেই পূর্বকালে বেদবিদ্ ব্রাহ্মণ, বেদ ও যজ্ঞ সৃষ্ট হইয়াছে । ২৩
এই হেতু ব্রহ্মবাদিগণের যজ্ঞ, দান ও তপস্যাদি শাস্ত্রোক্ত কর্ম সর্বদা 'ওঁ" উচ্চারণ করিয়া অনুষ্ঠিত হয় । ২৪
যাঁহারা মোক্ষ কামনা করেন, তাঁহারা ফল কামনা ত্যাগ করিয়া 'তৎ' এই শব্দ উচ্চারণপূর্বক বিবিধ যজ্ঞ তপস্যা এবং দানক্রিয়ার অনুষ্ঠান করেন । ২৫
হে পার্থ, সদ্ভাব ও সাধুভাব অর্থাৎ কোন বস্তুর অস্তিত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব নির্দেশার্থ সৎ শব্দ প্রযুক্ত হয়; এবং (বিবাহাদি) মঙ্গল কর্মেও সৎ শব্দ ব্যবহৃত হয় । ২৬
যজ্ঞ, তপস্যা ও দানে স্থিতি অর্থাৎ নিষ্ঠা বা তৎপর হইয়া থাকাকেও সৎ বলে এবং এই সকলের জন্য যে কিছু কর্ম করিতে হয় তাহাও সৎ বলিয়া কথিত হয় । ২৭
হে পার্থ, হোম, দান, তপস্যা বা অন্য কিছু যাহা অশ্রদ্ধাপূর্বক অনুষ্ঠিত হয়, সে সমুদয় অসৎ বলিয়া কথিত হয় । সে সকল না ইহলোকে না পরলোকে ফলদায়ক হয় । ২৮
___________________________
(৩) পুরুষঃ = সংসারী জীবঃ (শঙ্কর)
(৪) কিন্তু সকাম দেবোপসনা মিশ্রসাত্ত্বিক । উহাতে কাম্যবস্তু বা দেব-লোকাদি প্রাপ্তি হয়, ভগবৎ-প্রাপ্তি হয় না । নিষ্কামভাবে একমাত্র ভগবানের আরাধনাই শুদ্ধ সাত্ত্বিকী শ্রদ্ধা, ভাগবতে ইহাকেই নির্গুণা শ্রদ্ধা বলা হইয়াছে [ভাগবত ১১|২৫|২৬] ।
ত্রিবিধ শ্রদ্ধা :
শ্রদ্ধাই উপাসনার প্রাণ; যজ্ঞ, দান, ব্রত-নিয়মাদিরও মুখ্য কথা শ্রদ্ধা । প্রেমভক্তি-পথের প্রথম কথাই শ্রদ্ধা, শ্রদ্ধা হইতে ক্রমে রুচি, রাগ, ভাব ও নির্মল প্রেমের বিকাশ । - [ভক্তিরসামৃতসিন্ধু|১|৪|১১, চৈ.চ. মধ্য|২৩|৯|১০]
শ্রদ্ধা মনের ধর্ম, মন স্বভাবতই অন্ধ, শ্রদ্ধাও অন্ধ; বুদ্ধিদ্বারা চালিত না হইলে উহা অযোগ্য বস্তুতেই শ্রদ্ধা জন্মাইয়া জীবকে অধঃপাতিত করে । পক্ষান্তরে, মনে যদি শ্রদ্ধা না থাকে, লোকে যদি কেবল বুদ্ধিদ্বারাই চালিত হয়, তবে কেবল শুষ্ক পাণ্ডিত্য, বিতর্ক ও নাস্তিকতা আনয়ন করে ।
বুদ্ধিও সাত্ত্বিকাদি-ভেদে ত্রিবিধ এবং শ্রদ্ধা এই বুদ্ধিকর্তৃক চালিত হয় বলিয়া উহাও ত্রিবিধ হয় । তামসিকবুদ্ধি-প্রসূত তামসিক শ্রদ্ধা - দস্যুগণের নরবলি দিয়া কালীপূজা করা । রাজসিকবুদ্ধি-প্রসূত রাজসিক শ্রদ্ধা - ছাগমহিষাদি বলিদান করা । সাত্ত্বিকবুদ্ধি-প্রসূত সাত্ত্বিক শ্রদ্ধা - ছাগমহিষাদিকে কামক্রোধাদি পাশব বৃত্তির প্রতীকমাত্র বুঝিয়া ঐ সকল রিপুকে বলিদান করাই মায়ের শ্রেষ্ঠ অর্চনা বলিয়া মনে করা ।
(১০) সাত্ত্বিকাদি-ভেদে তিন প্রকার আহার :-
আহার-শুদ্ধি
সর্বপ্রকার সাধনপক্ষেই, বিশেষতঃ ভক্তিমার্গে, আহারশুদ্ধির বিশেষ প্রাধান্য দেওয়া হয় । 'আহার শুদ্ধ হইলে চিত্ত শুদ্ধ হয়, চিত্ত শুদ্ধ হইলে সেই শুদ্ধ চিত্তে সর্বদা ঈশ্বরের স্মৃতি অব্যাহত থাকে' [ছান্দোগ্য ৭|২৬] ।
(1) শ্রীমৎ রামানুজাচার্যের মতে আহার = খাদ্য (food) । তাঁহার মতে খাদ্যের ত্রিবিধ দোষ পরিহার করা কর্তব্য । (i) জাতিদোষ অর্থাৎ খাদ্যের প্রকৃতিগত দোষ - যেমন মদ্য, মাংস, রশুন, পেঁয়াজ ইত্যাদি উত্তেজক খাদ্য; (ii) আশ্রয় দোষ - অর্থাৎ যে ব্যক্তির নিকট হইতে খাদ্য গ্রহণ করা যায়, তাহার দোষে খাদ্যে যে দোষ জন্মে - যেমন অশুচি, অতিকৃপণ, আসুর-স্বভাব, কুৎসিত-রোগাক্রান্ত খাদ্যবিক্রেতা, দাতা, পাচক বা পরিবেশনকারী প্রভৃতি; (iii) নিমিত্ত দোষ - অর্থাৎ খাদ্যে ধুলি, ময়লা, কেশ, মুখের লালা ইত্যাদি অপবিত্র দ্রব্যের সংস্পর্শ ।
(2) শ্রীমৎ শঙ্করাচার্যের মতে আহার = ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়জ্ঞান অর্থাৎ যাহা গ্রহণ করা যায় তাহাই আহার । তাঁহার মতে আহারশুদ্ধি অর্থ রাগ, দ্বেষ, মোহ এই ত্রিবিধ দোষবর্জিত হইয়া ইন্দ্রিয়ের দ্বারা বিষয়গ্রহণ ।
(3) স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন - "এই দুইটি ব্যাখ্যা আপাতবিরোধী বলিয়া বোধ হইলেও উভয়টিই সত্য ও প্রয়োজনীয় । সূক্ষ শরীর বা মনের সংযম, মাংস-পিণ্ডময় স্থূল শরীরের সংযম হইতে উচ্চতর কার্য বটে, কিন্তু সূক্ষের সংযম করিতে হইলে অগ্রে স্থূলের সংযম করা বিশেষ আবশ্যক । সুতরাং ইহা যুক্তিসিদ্ধ বোধ হইতেছে যে, খাদ্যাখাদ্যের বিচার মনের স্থিরতারূপ উচ্চাবস্থা লাভের জন্য বিশেষ আবশ্যক । নতুবা সহজে এই স্থিরিতা লাভ করা যায় না । কিন্তু আজকাল আমাদের অনেক সম্প্রদায়ে এই আহারাদির বিচারের এত বাড়াবাড়ি, এত অর্থহীন নিয়মের বাঁধাবাধি, এই বিষয়ে এত গোঁড়ামি যে, তাঁহারা যেন ধর্মটিকে রান্নাঘরের ভিতর পুরিয়াছেন । এইরূপ ধর্ম এক বিশেষ প্রকার খাঁটি জড়বাদ মাত্র । উহা জ্ঞান নহে, ভক্তিও নহে, কর্মও নহে ।" [ভক্তির সাধন, ভক্তিযোগ, স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, চতুর্থ খণ্ড, পৃঃ ৪০-৪১]
(১১) ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে শ্রীকৃষ্ণ এইরূপ সাত্ত্বিক যজ্ঞ করিতেই উপদেশ দিয়াছিলেন এবং তিনিও কর্তব্যানুরোধে নিষ্কামভাবে উহা সম্পন্ন করিয়াছিলেন । যুধিষ্ঠির বলিয়াছিলেন - "রাজপুত্রি, আমি কর্মফলান্বেষী হইয়া কোন কর্ম করি না; দান করিতে হয় তাই দান করি, যজ্ঞ করিতে হয় তাই যজ্ঞ করি; ধর্মাচরণের বিনিময়ে যে ফল চাহে, সে ধর্মবণিক, ধর্মকে সে পণ্যদ্রব্য করিয়াছে । সে হীন, জঘন্য ।" [মভাঃ বনপর্ব ৩১|২৫]
(১৫) অপ্রিয় সত্য বলা অনুচিত - মনু ৪|১৩৮ । অপ্রিয় সত্য ও হিত্যবাক্য বলার ও শোনার লোক অতি বিরল - মহাভারতে বিদুরবাক্য ।
(১৮) সৎকার = সাধুকার অর্থাৎ এই ব্যক্তি বড় সাধু, তপস্বী - এইরূপ প্রশংসা-বাক্যাদি । মান = মানন অর্থাৎ প্রত্যুত্থান (আসিতে দেখিয়া উঠিয়া দাঁড়ান), অভিবাদন প্রভৃতি দ্বারা সম্মান প্রদর্শন । পূজা = পাদ প্রক্ষালন, আসনাদি দান, ভোজন করান ইত্যাদি ।
(১৮) এইরূপ তপস্যায় আত্মোন্নতি বা পারলৌকিক কোন স্থায়ী ফল হয় না, কেবল ইহলোকে ক্ষণস্থায়ী প্রতিষ্ঠা লাভ হইতে পারে । কিন্তু সেইরূপ প্রতিষ্ঠা লাভও যে হইবে তাহারও নিশ্চয়তা নাই । এই জন্য ইহাকে অনিত্য ও অধ্রুব বলা হইয়াছে ।
(২০) সাত্ত্বিক দান
সাত্ত্বিক দানের তিনটি লক্ষণ - (1) ফলাকাঙ্ক্ষা না করিয়া নিষ্কাম কর্তব্য-বুদ্ধিতে দান, (2) অনুপকারী ব্যক্তিকে দান (যে পূর্বে উপকার করেনি অথবা পরেও প্রত্যুপকার করিবে না তাহাকে দান নচেৎ উহা আদান-প্রদান হইয়া যায়), (3) উপযুক্ত দেশ, কাল ও পাত্র বিবেচনা করিয়া দান ।
(3a) উপযুক্ত দেশের উদাহরণ - যে গ্রামে বিশুদ্ধ পানীয় জলের অভাব, তথায়ই পুষ্করিণী প্রতিষ্ঠায় জলদানের ফল হয়, বড় শহরে উহার কোন প্রয়োজন নাই । প্রাচীন টীকাকারগণদের সঙ্কীর্ণ মতে কুরুক্ষেত্রাদি পুণ্যক্ষেত্র ।
(3b) উপযুক্ত কালের উদাহরণ - কলেরার প্রাদুর্ভাবমাত্রেই ঔষধ দানের ব্যবস্থা করা বিধেয়, পূর্বে বা পরে উহাতে অর্থব্যয় করা নিষ্ফল । প্রাচীন টীকাকারগণদের সঙ্কীর্ণ মতে সংক্রান্তি গ্রহণাদি পুণ্যকাল ।
(3c) উপযুক্ত পাত্রের উদাহরণ - অভাবগ্রস্থ বিপন্ন ব্যক্তিকেই দান করিতে হয়, অর্থশালীকে দান করা নিষ্ফল । প্রাচীন টীকাকারগণদের সঙ্কীর্ণ মতে বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ (শঙ্কর) ।
কিন্তু আধুনিকগণ এইরূপ সঙ্কীর্ণ অর্থ অনুমোদন করেন না । যেমন মনস্বী বঙ্কিমচন্দ্র লিখিয়াছেন - "সর্বনাশ ! আমি যদি স্বদেশে বসিয়া (অর্থাৎ পুণ্যক্ষেত্রাদিতে নয়) ১লা হইতে ২৯শে তারিখের মধ্যে (অর্থাৎ সংক্রান্তিতে নয়) কোন দিনে অতি দীনদুঃখী, পীড়ায় কাতর একজন মুচি বা ডোমকে (অর্থাৎ ব্রাহ্মণকে নয়) কিছু দান করি, তবে সে দান ভগবদভিপ্রেত দান হইল না ! এইরূপে কখন কখন ভাষ্যকারদিগের বিচারে অতি উন্নত, উদার ও সার্বভৈমিক যে ধর্ম তাহা অতি সঙ্কীর্ণ এবং অনুদার উপধর্মে পরিণত হইয়াছে । ইহারা যাহা বলেন তাহা ভগবদ্বাক্যে নাই, স্মৃতিশাস্ত্রে আছে । কিন্তু বিনা বিচারে ঋষিদিগের বাক্যসকল মস্তকের উপর এতকাল বহন করিয়া এই বিশৃঙ্খলা, অধর্ম ও দুর্দশায় আসিয়া পড়িয়াছি । এখন আর বিনা বিচারে বহন কর্তব্য নহে ।" [ধর্ম্মতত্ত্ব (অনুশীলন), বঙ্কিম রচনাসমগ্র]
প্রকৃত পক্ষে এ বিষয়ে ঋষিশাস্ত্রের কোনরূপ অনুদারতা নাই । শাস্ত্রের মর্ম বুঝিবার বা বুঝাইবার ত্রুটিতে আমাদের দুর্দশা । শাস্ত্রে দীনদুঃখী, আর্ত, পীড়িত, অভ্যাগত (visitor), এমন কি পশুপক্ষী, বৃক্ষলতাদির পর্যন্ত ধারণ-পোষণের ব্যবস্থা আছে । সর্বভূতের রক্ষাই গার্হস্থ্য ধর্ম, ইহাই শাস্ত্রের অনুশাসন । তবে বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণকে দান সর্বশ্রেষ্ঠ দান বলিয়া উল্লিখিত কারণ তাঁহারা হিন্দু-সমাজের প্রতিষ্ঠা ও বর্ণাশ্রম ধর্মাদির ব্যবস্থা করিয়াও অর্থাগমের যাবতীয় কর্মেই (যেমন রাজত্ব, প্রভুত্ব, কৃষি, শিল্প, বাণিজ্যাদি) অন্য জাতির অধিকার দিয়াছেন । নিজেরা উঞ্ছবৃত্তি বা অযাচিত দানের (প্রতিগ্রহ) উপর নির্ভর করিয়া সামান্য গ্রাসাচ্ছাদনে সন্তুষ্ট থাকিয়া সমাজে ধর্ম (যজন-যাজন) ও জ্ঞান (অধ্যয়ন, অধ্যাপনা) বিস্তারের ভার লইয়াছেন । ঈদৃশ পরার্থপর ত্যাগী ব্রাহ্মণজাতির রক্ষাকল্পে শাস্ত্রের যে সকল ব্যবস্থা তাহা সম্পূর্ণ যুক্তিসঙ্গত ও সমাজরক্ষার অনুকূল । আবার, বেদজ্ঞানহীন নিরগ্নি (অর্থাৎ স্বধর্ম পালনে পরাঙ্মুখ) দ্বিজবন্ধুদিগকে দান করিলে নিরয়গামী (condemned to hell) হইতে হয়, শাস্ত্রে এমন কঠোর অনুশাসনও রহিয়াছে । সুতরাং ঋষিশাস্ত্রের অনুদারতা বা পক্ষপাতিতা কোথাও নাই ।
গ্রহণাদি সময়ে বা পুণ্যক্ষেত্রাদিতে লোকের সাত্ত্বিক ভাব বৃদ্ধি হওয়ারই সম্ভাবনা থাকে, এই হেতু সেই কাল বা স্থান-দানাদি কর্মে প্রশস্ত বলিয়া বিবেচিত হইয়া থাকিবে, কেননা দানাদি কর্ম সাত্ত্বিক শ্রদ্ধার সহিত নিষ্পন্ন না হইলে নিষ্ফল হয় [গীতা ১৭|২৮] । কিন্তু কাল পরিবর্তনে ব্রাহ্মণজাতির ব্রাহ্মণত্ব বা তীর্থক্ষেত্রাদির মাহাত্ম্য যদি লোপ পায় এবং তদ্দরুণ লোকের ভক্তিশ্রদ্ধার যদি ব্যত্যয় ঘটে, তবে এই সকল বিধি-ব্যবস্থার কোন মূল্য থাকে না, তাহা বলাই বাহুল্য । সে স্থলে শাস্ত্রের প্রকৃত মর্ম ও উদ্দেশ্য বুঝিইয়া তদনুসারে কর্তব্যাকর্তব্য নির্ণয় করাই শ্রেয়কল্প; সংস্কারবশতঃ প্রাণহীন অনুষ্ঠান লইয়া বসিয়া থাকিলে ক্রমশঃ অধোগতি সুনিশ্চিত ।
(২৬) সদ্ভাব = থাকার ভাব বা অস্ত্যর্থে ।
(২৭) ওঁ তৎ সৎ (স্ফোট) - এই তিনটি ব্রহ্মবাচক । তিনটির পৃথক্ও ব্যবহার হয়, এক সঙ্গেও ব্রহ্ম নির্দেশার্থ ব্যবহৃত হয় । ওঁ (অ-উ-ম্) বা প্রণব বা শব্দব্রহ্ম বা স্ফোটরূপী ওঙ্কার হইতেই জগতের সৃষ্টি । " 'ওঁ' - গূঢ়াক্ষররূপী বৈদিক মন্ত্র; 'তৎ' - তাহা অর্থাৎ দৃশ্য জগতের অতীত দূরবর্তী অনির্বাচ্য তত্ত্ব; 'সৎ' - চক্ষুর সম্মুখস্থ দৃশ্য জগৎ । এই তিন মিলিয়া সমস্তই ব্রহ্ম, ইহাই এই সঙ্কল্পের অর্থ ।" - লোকমান্য তিলক । এ স্থলে বলা হইতেছে যে - 'ওঁ তৎ সৎ' এই ব্রহ্মনির্দেশ হইতে ব্রাহ্মণাদি কর্তা, করণরূপ বেদ এবং কর্মরূপ যজ্ঞ সৃষ্টি হইয়াছে । ইহারই নাম শব্দব্রহ্মবাদ । এই ওঙ্কারই জগতের অভিব্যক্তির আদি কারণ শব্দব্রহ্ম । ইহার নাম স্ফোট । স্ফোট হইতে কিরূপে জগতের সৃষ্টি হইল তাহা শ্রীমদ্ভাগবতে বর্ণিত আছে [ভা | ১২|৬|৩৩-৩৭] :-
১) সমাধিমগ্ন ব্রহ্মার হৃদাকাশ হইতে প্রথমত নাদ উৎপন্ন হইল;
২) নাদ হইতে ত্রিমাত্রা ওঙ্কার উৎপন্ন হইল যাহা সমস্ত বৈদিক মন্ত্রোপনিষদের বীজস্বরূপ;
৩) অব্যক্ত ওঙ্কারের অকার, উকার, মকার এই তিন বর্ণ প্রকাশ পাইল;
৪) এই তিন বর্ণ হইতে ক্রমশ সত্ত্বাদি গুণ, ঋগাদি বেদ, ভূর্ভুবাদি লোক অর্থাৎ জগৎপ্রপঞ্চ সৃষ্ট হইল ।
কর্মে ব্রহ্মনির্দেশ :
পূর্বে বলা হইয়াছে, ব্রহ্মবাচক স্ফোটরূপী ওঙ্কার হইতেই জগতের সৃষ্টি । জগতের ধারণ-পোষণের জন্য যজ্ঞসৃষ্টি । যজ্ঞ-শব্দে ব্যাপক অর্থে চাতুর্বর্ণ্যের আচরণীয় সমস্ত কর্ম বুঝায় । এই যজ্ঞ-কর্মের ব্যবস্থাই বেদে আছে এবং যজ্ঞরক্ষার ভার প্রধানত ব্রাহ্মণের উপর । ব্রাহ্মণ, বেদ ও যজ্ঞ পরব্রহ্ম হইতেই উৎপন্ন হইয়াছে; সুতরাং ব্রহ্মবাচক 'ওঁ তৎ সৎ' এই সঙ্কল্পই সমগ্র সৃষ্টির মূল । যজ্ঞ বা কর্মদ্বারাই সৃষ্টিরক্ষা হয়, সুতরাং 'ওঁ তৎ সৎ' এই সঙ্কল্পদ্বারাই সমস্ত কর্ম করিতে হয় । ইহার স্থূল মর্ম এই যে, সর্বকর্মই পরমাত্মাকে স্মরণ করিয়া ঈশ্বরার্পণ-বুদ্ধিতে করিবে অর্থাৎ কর্মকে ব্রহ্মকর্মে পরিণত করিবে, তাহা ত্যাগ করিবে না ।
হে কৃষ্ণ, যাঁহারা শাস্ত্রবিধি ত্যাগ করিয়া (অথচ) শ্রদ্ধাযুক্ত হইয়া যাগযজ্ঞ পূজাদি করিয়া থাকেন, তাঁহাদিগের নিষ্ঠা কিরূপ ? সাত্ত্বিকী, না রাজসী, না তামসী ? ১
শ্রীভগবান্ কহিলেন -
দেহীদিগের সাত্ত্বিকী, রাজসী ও তামসী, এই তিন প্রকারের শ্রদ্ধা আছে, উহা স্বভাবজাত অর্থাৎ পূর্বজন্মের সংস্কার-প্রসূত; তাহা বিস্তারিত বলিতেছি, শ্রবণ কর । ২
হে ভারত, সকলেরই শ্রদ্ধা নিজ নিজ অন্তঃকরণ-প্রবৃত্তি বা স্বভাবের অনুরূপ হইয়া থাকে । মনুষ্য শ্রদ্ধাময়; যে যেইরূপ শ্রদ্ধাযুক্ত, সে সেইরূপই হয় । ৩
সাত্ত্বিক ব্যক্তিগণ দেবগণের পূজা করেন, রাজসিক প্রকৃতির ব্যক্তিগণ যক্ষরক্ষদিগের পূজা করেন এবং তামসিক ব্যক্তিগণ ভূত-প্রেতের পূজা করিয়া থাকে । ৪
দম্ভ, অহঙ্কার, কামনা ও আসক্তিযুক্ত এবং বলগর্বিত হইয়া যে সকল অবিবেকী ব্যক্তি শরীরস্থ ভূতগণকে এবং অন্তর্যামিরূপে দেহমধ্যস্থ আমাকে কৃশ করিয়া (কষ্ট দিয়া) শাস্ত্রবিধিবিরুদ্ধ অত্যুগ্র তপস্যাদি করিয়া থাকে, তাহাদিগকে আসুরবুদ্ধিবিশিষ্ট বলিয়া জানিবে । ৫,৬
(প্রকৃতিভেদে) সকলেরই প্রিয় আহারও ত্রিবিধ হইয়া থাকে; সেইরূপ যজ্ঞ, তপস্যা এবং দানও ত্রিবিধ; উহাদের মধ্যে যেরূপ প্রভেদ তাহা শ্রবণ কর । ৭
যাহা আয়ু, উৎসাহ, বল, আরোগ্য, চিত্ত-প্রসন্নতা ও রুচি - এ সকলের বর্ধনকারী এবং সরস, স্নেহযুক্ত, সারবান্ এবং প্রীতিকর - এইরূপ (সাত্ত্বিক) আহার সাত্ত্বিক ব্যক্তিগণের প্রিয় । ৮
অতি কটু, অতি অম্ল, অতি লবণাক্ত, অতি উষ্ণ, তীক্ষ্ণ, বিদাহী এবং দুঃখ, শোক ও রোগ উৎপাদক (রাজসিক) আহার রাজস ব্যক্তিগণের প্রিয় । ৯
যে খাদ্য বহু পূর্বে পক্ক, যাহার রস শুষ্ক হইয়া গিয়াছে, যাহা দুর্গন্ধ, পর্যুষিত (বাসি), উচ্ছিষ্ট ও অপবিত্র, তাহা তামস ব্যক্তিগণের প্রিয় । ১০
ফলাকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করিয়া 'যজ্ঞ করিতে হয় তাই করি' এইরূপ অবশ্য-কর্তব্য বোধে শাস্ত্রবিধি অনুসারে শান্তচিত্তে যে যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয়, তাহা সাত্ত্বিক যজ্ঞ । ১১
কিন্তু হে ভরতশ্রেষ্ঠ, ফল লাভের উদ্দেশ্যে এবং দম্ভার্থে (নিজ ঐশ্বর্য, মহত্ত্ব বা ধার্মিকতা প্রকাশার্থ) যে যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয় তাহাকে রাজস-যজ্ঞ বলিয়া জানিবে । ১২
শাস্ত্রোক্ত বিধিশূন্য, অন্নদানহীন, শাস্ত্রোক্ত মন্ত্রহীন, দক্ষিণাহীন, শ্রদ্ধাশূন্য যজ্ঞকে তামস-যজ্ঞ বলে । ১৩
দেব, দ্বিজ, গুরু, বিদ্বান্ ব্যক্তির পূজা, শৌচ, সরলতা, ব্রহ্মচর্য, অহিংসা, এই সকলকে শারীর তপস্যা বলে । ১৪
যাহা কাহারও উদ্বেগকর হয় না, যাহা সত্য, প্রিয় ও হিতকর এইরূপ বাক্য এবং যথাবিধি শাস্ত্রাভ্যাস - এই সকলকে বাঙ্ময় বা বাচিক তপস্যা বলা হয় । ১৫
চিত্তের প্রসন্নতা, অক্রুরতা, বাক্-সংযম, আত্মসংযম বা মনসংযম এবং অন্যের সহিত ব্যবহারে কপটতারাহিত্য, এই সকলকে মানসিক তপস্যা বলে । ১৬
পূর্বোক্ত ত্রিবিধ তপস্যা যদি ফলাকাঙ্ক্ষাশূন্য, ঈশ্বরে একাগ্রচিত্ত ব্যক্তিগণ কর্তৃক পরম শ্রদ্ধা সহকারে অনুষ্ঠিত হয়, তবে তাহাকে সাত্ত্বিক তপস্যা বলে । ১৭
সৎকার, মান ও পূজা লাভ করিবার জন্য দম্ভ সহকারে যে তপস্যা অনুষ্ঠিত হয় এবং ইহলোকে যাহার ফল অনিত্য এবং অনিশ্চিত, তাহাকে রাজসিক তপস্যা বলে । ১৮
মোহাচ্ছন্নবুদ্ধিবশে নিজের শরীরাদিকেও পীড়া দিয়া অথবা জারণ, মারণাদি অভিচার দ্বারা পরের বিনাশার্থ যে তপস্যা অনুষ্ঠিত হয়, তাহাকে তামস তপস্যা বলে । ১৯
"দান করা উচিত, তাই দান করি" এইরূপ কর্তব্য-বুদ্ধিতে উপযুক্ত দেশ, কাল ও পাত্র বিবেচনা করিয়া অনুপকারী ব্যক্তিকে (অর্থাৎ প্রত্যুপকারের আশা না রাখিয়া) যে দান করা হয়, তাহাকে সাত্ত্বিক দান বলে । ২০
পরন্তু প্রত্যুপকারের আশায় অথবা স্বর্গাদি ফল কামনায় অতি কষ্টের সহিত যে দান করা হয়, তাহাকে রাজস দান বলে । ২১
অনুপযুক্ত দেশে, অনুপযুক্ত কালে এবং অনুপযুক্ত পাত্রে যে দান এবং (উপযুক্ত দেশকালপাত্রে প্রদত্ত হইলেও) সৎকারশূন্য এবং অবজ্ঞাসহকারে কৃত যে দান, তাহাকে তামস দান বলে । ২২
(শাস্ত্রে) 'ওঁ তৎ সৎ' এই তিন প্রকারে পরব্রহ্মের নাম নির্দেশ করা হইয়াছে; এই নির্দেশ হইতেই পূর্বকালে বেদবিদ্ ব্রাহ্মণ, বেদ ও যজ্ঞ সৃষ্ট হইয়াছে । ২৩
এই হেতু ব্রহ্মবাদিগণের যজ্ঞ, দান ও তপস্যাদি শাস্ত্রোক্ত কর্ম সর্বদা 'ওঁ" উচ্চারণ করিয়া অনুষ্ঠিত হয় । ২৪
যাঁহারা মোক্ষ কামনা করেন, তাঁহারা ফল কামনা ত্যাগ করিয়া 'তৎ' এই শব্দ উচ্চারণপূর্বক বিবিধ যজ্ঞ তপস্যা এবং দানক্রিয়ার অনুষ্ঠান করেন । ২৫
হে পার্থ, সদ্ভাব ও সাধুভাব অর্থাৎ কোন বস্তুর অস্তিত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব নির্দেশার্থ সৎ শব্দ প্রযুক্ত হয়; এবং (বিবাহাদি) মঙ্গল কর্মেও সৎ শব্দ ব্যবহৃত হয় । ২৬
যজ্ঞ, তপস্যা ও দানে স্থিতি অর্থাৎ নিষ্ঠা বা তৎপর হইয়া থাকাকেও সৎ বলে এবং এই সকলের জন্য যে কিছু কর্ম করিতে হয় তাহাও সৎ বলিয়া কথিত হয় । ২৭
হে পার্থ, হোম, দান, তপস্যা বা অন্য কিছু যাহা অশ্রদ্ধাপূর্বক অনুষ্ঠিত হয়, সে সমুদয় অসৎ বলিয়া কথিত হয় । সে সকল না ইহলোকে না পরলোকে ফলদায়ক হয় । ২৮
___________________________
(৩) পুরুষঃ = সংসারী জীবঃ (শঙ্কর)
(৪) কিন্তু সকাম দেবোপসনা মিশ্রসাত্ত্বিক । উহাতে কাম্যবস্তু বা দেব-লোকাদি প্রাপ্তি হয়, ভগবৎ-প্রাপ্তি হয় না । নিষ্কামভাবে একমাত্র ভগবানের আরাধনাই শুদ্ধ সাত্ত্বিকী শ্রদ্ধা, ভাগবতে ইহাকেই নির্গুণা শ্রদ্ধা বলা হইয়াছে [ভাগবত ১১|২৫|২৬] ।
ত্রিবিধ শ্রদ্ধা :
শ্রদ্ধাই উপাসনার প্রাণ; যজ্ঞ, দান, ব্রত-নিয়মাদিরও মুখ্য কথা শ্রদ্ধা । প্রেমভক্তি-পথের প্রথম কথাই শ্রদ্ধা, শ্রদ্ধা হইতে ক্রমে রুচি, রাগ, ভাব ও নির্মল প্রেমের বিকাশ । - [ভক্তিরসামৃতসিন্ধু|১|৪|১১, চৈ.চ. মধ্য|২৩|৯|১০]
শ্রদ্ধা মনের ধর্ম, মন স্বভাবতই অন্ধ, শ্রদ্ধাও অন্ধ; বুদ্ধিদ্বারা চালিত না হইলে উহা অযোগ্য বস্তুতেই শ্রদ্ধা জন্মাইয়া জীবকে অধঃপাতিত করে । পক্ষান্তরে, মনে যদি শ্রদ্ধা না থাকে, লোকে যদি কেবল বুদ্ধিদ্বারাই চালিত হয়, তবে কেবল শুষ্ক পাণ্ডিত্য, বিতর্ক ও নাস্তিকতা আনয়ন করে ।
বুদ্ধিও সাত্ত্বিকাদি-ভেদে ত্রিবিধ এবং শ্রদ্ধা এই বুদ্ধিকর্তৃক চালিত হয় বলিয়া উহাও ত্রিবিধ হয় । তামসিকবুদ্ধি-প্রসূত তামসিক শ্রদ্ধা - দস্যুগণের নরবলি দিয়া কালীপূজা করা । রাজসিকবুদ্ধি-প্রসূত রাজসিক শ্রদ্ধা - ছাগমহিষাদি বলিদান করা । সাত্ত্বিকবুদ্ধি-প্রসূত সাত্ত্বিক শ্রদ্ধা - ছাগমহিষাদিকে কামক্রোধাদি পাশব বৃত্তির প্রতীকমাত্র বুঝিয়া ঐ সকল রিপুকে বলিদান করাই মায়ের শ্রেষ্ঠ অর্চনা বলিয়া মনে করা ।
(১০) সাত্ত্বিকাদি-ভেদে তিন প্রকার আহার :-
- সাত্ত্বিক আহার : যাহা আয়ু, উৎসাহ, বল, আরোগ্য, চিত্ত-প্রসন্নতা ও রুচি বর্ধনকারী এবং সরস, স্নেহযুক্ত, সারবান এবং প্রীতিকর ।
- রাজস আহার : অতি কটু, অতি অম্ল, অতি লবণাক্ত, অতি উষ্ণ, তীক্ষ্ণ, বিদাহী এবং দুঃখ, শোক ও রোগ-উৎপাদক ।
- তামস আহার : যে খাদ্য বহু পূর্বে পক্ক, যাহার রস শুষ্ক হইয়া গিয়াছে, যা হা দুর্গন্ধ, পর্যুষিত (বাসি) উচ্ছিষ্ট ও অপবিত্র ।
আহার-শুদ্ধি
সর্বপ্রকার সাধনপক্ষেই, বিশেষতঃ ভক্তিমার্গে, আহারশুদ্ধির বিশেষ প্রাধান্য দেওয়া হয় । 'আহার শুদ্ধ হইলে চিত্ত শুদ্ধ হয়, চিত্ত শুদ্ধ হইলে সেই শুদ্ধ চিত্তে সর্বদা ঈশ্বরের স্মৃতি অব্যাহত থাকে' [ছান্দোগ্য ৭|২৬] ।
(1) শ্রীমৎ রামানুজাচার্যের মতে আহার = খাদ্য (food) । তাঁহার মতে খাদ্যের ত্রিবিধ দোষ পরিহার করা কর্তব্য । (i) জাতিদোষ অর্থাৎ খাদ্যের প্রকৃতিগত দোষ - যেমন মদ্য, মাংস, রশুন, পেঁয়াজ ইত্যাদি উত্তেজক খাদ্য; (ii) আশ্রয় দোষ - অর্থাৎ যে ব্যক্তির নিকট হইতে খাদ্য গ্রহণ করা যায়, তাহার দোষে খাদ্যে যে দোষ জন্মে - যেমন অশুচি, অতিকৃপণ, আসুর-স্বভাব, কুৎসিত-রোগাক্রান্ত খাদ্যবিক্রেতা, দাতা, পাচক বা পরিবেশনকারী প্রভৃতি; (iii) নিমিত্ত দোষ - অর্থাৎ খাদ্যে ধুলি, ময়লা, কেশ, মুখের লালা ইত্যাদি অপবিত্র দ্রব্যের সংস্পর্শ ।
(2) শ্রীমৎ শঙ্করাচার্যের মতে আহার = ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়জ্ঞান অর্থাৎ যাহা গ্রহণ করা যায় তাহাই আহার । তাঁহার মতে আহারশুদ্ধি অর্থ রাগ, দ্বেষ, মোহ এই ত্রিবিধ দোষবর্জিত হইয়া ইন্দ্রিয়ের দ্বারা বিষয়গ্রহণ ।
(3) স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন - "এই দুইটি ব্যাখ্যা আপাতবিরোধী বলিয়া বোধ হইলেও উভয়টিই সত্য ও প্রয়োজনীয় । সূক্ষ শরীর বা মনের সংযম, মাংস-পিণ্ডময় স্থূল শরীরের সংযম হইতে উচ্চতর কার্য বটে, কিন্তু সূক্ষের সংযম করিতে হইলে অগ্রে স্থূলের সংযম করা বিশেষ আবশ্যক । সুতরাং ইহা যুক্তিসিদ্ধ বোধ হইতেছে যে, খাদ্যাখাদ্যের বিচার মনের স্থিরতারূপ উচ্চাবস্থা লাভের জন্য বিশেষ আবশ্যক । নতুবা সহজে এই স্থিরিতা লাভ করা যায় না । কিন্তু আজকাল আমাদের অনেক সম্প্রদায়ে এই আহারাদির বিচারের এত বাড়াবাড়ি, এত অর্থহীন নিয়মের বাঁধাবাধি, এই বিষয়ে এত গোঁড়ামি যে, তাঁহারা যেন ধর্মটিকে রান্নাঘরের ভিতর পুরিয়াছেন । এইরূপ ধর্ম এক বিশেষ প্রকার খাঁটি জড়বাদ মাত্র । উহা জ্ঞান নহে, ভক্তিও নহে, কর্মও নহে ।" [ভক্তির সাধন, ভক্তিযোগ, স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, চতুর্থ খণ্ড, পৃঃ ৪০-৪১]
(১১) ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে শ্রীকৃষ্ণ এইরূপ সাত্ত্বিক যজ্ঞ করিতেই উপদেশ দিয়াছিলেন এবং তিনিও কর্তব্যানুরোধে নিষ্কামভাবে উহা সম্পন্ন করিয়াছিলেন । যুধিষ্ঠির বলিয়াছিলেন - "রাজপুত্রি, আমি কর্মফলান্বেষী হইয়া কোন কর্ম করি না; দান করিতে হয় তাই দান করি, যজ্ঞ করিতে হয় তাই যজ্ঞ করি; ধর্মাচরণের বিনিময়ে যে ফল চাহে, সে ধর্মবণিক, ধর্মকে সে পণ্যদ্রব্য করিয়াছে । সে হীন, জঘন্য ।" [মভাঃ বনপর্ব ৩১|২৫]
(১৫) অপ্রিয় সত্য বলা অনুচিত - মনু ৪|১৩৮ । অপ্রিয় সত্য ও হিত্যবাক্য বলার ও শোনার লোক অতি বিরল - মহাভারতে বিদুরবাক্য ।
(১৮) সৎকার = সাধুকার অর্থাৎ এই ব্যক্তি বড় সাধু, তপস্বী - এইরূপ প্রশংসা-বাক্যাদি । মান = মানন অর্থাৎ প্রত্যুত্থান (আসিতে দেখিয়া উঠিয়া দাঁড়ান), অভিবাদন প্রভৃতি দ্বারা সম্মান প্রদর্শন । পূজা = পাদ প্রক্ষালন, আসনাদি দান, ভোজন করান ইত্যাদি ।
(১৮) এইরূপ তপস্যায় আত্মোন্নতি বা পারলৌকিক কোন স্থায়ী ফল হয় না, কেবল ইহলোকে ক্ষণস্থায়ী প্রতিষ্ঠা লাভ হইতে পারে । কিন্তু সেইরূপ প্রতিষ্ঠা লাভও যে হইবে তাহারও নিশ্চয়তা নাই । এই জন্য ইহাকে অনিত্য ও অধ্রুব বলা হইয়াছে ।
(২০) সাত্ত্বিক দান
সাত্ত্বিক দানের তিনটি লক্ষণ - (1) ফলাকাঙ্ক্ষা না করিয়া নিষ্কাম কর্তব্য-বুদ্ধিতে দান, (2) অনুপকারী ব্যক্তিকে দান (যে পূর্বে উপকার করেনি অথবা পরেও প্রত্যুপকার করিবে না তাহাকে দান নচেৎ উহা আদান-প্রদান হইয়া যায়), (3) উপযুক্ত দেশ, কাল ও পাত্র বিবেচনা করিয়া দান ।
(3a) উপযুক্ত দেশের উদাহরণ - যে গ্রামে বিশুদ্ধ পানীয় জলের অভাব, তথায়ই পুষ্করিণী প্রতিষ্ঠায় জলদানের ফল হয়, বড় শহরে উহার কোন প্রয়োজন নাই । প্রাচীন টীকাকারগণদের সঙ্কীর্ণ মতে কুরুক্ষেত্রাদি পুণ্যক্ষেত্র ।
(3b) উপযুক্ত কালের উদাহরণ - কলেরার প্রাদুর্ভাবমাত্রেই ঔষধ দানের ব্যবস্থা করা বিধেয়, পূর্বে বা পরে উহাতে অর্থব্যয় করা নিষ্ফল । প্রাচীন টীকাকারগণদের সঙ্কীর্ণ মতে সংক্রান্তি গ্রহণাদি পুণ্যকাল ।
(3c) উপযুক্ত পাত্রের উদাহরণ - অভাবগ্রস্থ বিপন্ন ব্যক্তিকেই দান করিতে হয়, অর্থশালীকে দান করা নিষ্ফল । প্রাচীন টীকাকারগণদের সঙ্কীর্ণ মতে বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ (শঙ্কর) ।
কিন্তু আধুনিকগণ এইরূপ সঙ্কীর্ণ অর্থ অনুমোদন করেন না । যেমন মনস্বী বঙ্কিমচন্দ্র লিখিয়াছেন - "সর্বনাশ ! আমি যদি স্বদেশে বসিয়া (অর্থাৎ পুণ্যক্ষেত্রাদিতে নয়) ১লা হইতে ২৯শে তারিখের মধ্যে (অর্থাৎ সংক্রান্তিতে নয়) কোন দিনে অতি দীনদুঃখী, পীড়ায় কাতর একজন মুচি বা ডোমকে (অর্থাৎ ব্রাহ্মণকে নয়) কিছু দান করি, তবে সে দান ভগবদভিপ্রেত দান হইল না ! এইরূপে কখন কখন ভাষ্যকারদিগের বিচারে অতি উন্নত, উদার ও সার্বভৈমিক যে ধর্ম তাহা অতি সঙ্কীর্ণ এবং অনুদার উপধর্মে পরিণত হইয়াছে । ইহারা যাহা বলেন তাহা ভগবদ্বাক্যে নাই, স্মৃতিশাস্ত্রে আছে । কিন্তু বিনা বিচারে ঋষিদিগের বাক্যসকল মস্তকের উপর এতকাল বহন করিয়া এই বিশৃঙ্খলা, অধর্ম ও দুর্দশায় আসিয়া পড়িয়াছি । এখন আর বিনা বিচারে বহন কর্তব্য নহে ।" [ধর্ম্মতত্ত্ব (অনুশীলন), বঙ্কিম রচনাসমগ্র]
প্রকৃত পক্ষে এ বিষয়ে ঋষিশাস্ত্রের কোনরূপ অনুদারতা নাই । শাস্ত্রের মর্ম বুঝিবার বা বুঝাইবার ত্রুটিতে আমাদের দুর্দশা । শাস্ত্রে দীনদুঃখী, আর্ত, পীড়িত, অভ্যাগত (visitor), এমন কি পশুপক্ষী, বৃক্ষলতাদির পর্যন্ত ধারণ-পোষণের ব্যবস্থা আছে । সর্বভূতের রক্ষাই গার্হস্থ্য ধর্ম, ইহাই শাস্ত্রের অনুশাসন । তবে বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণকে দান সর্বশ্রেষ্ঠ দান বলিয়া উল্লিখিত কারণ তাঁহারা হিন্দু-সমাজের প্রতিষ্ঠা ও বর্ণাশ্রম ধর্মাদির ব্যবস্থা করিয়াও অর্থাগমের যাবতীয় কর্মেই (যেমন রাজত্ব, প্রভুত্ব, কৃষি, শিল্প, বাণিজ্যাদি) অন্য জাতির অধিকার দিয়াছেন । নিজেরা উঞ্ছবৃত্তি বা অযাচিত দানের (প্রতিগ্রহ) উপর নির্ভর করিয়া সামান্য গ্রাসাচ্ছাদনে সন্তুষ্ট থাকিয়া সমাজে ধর্ম (যজন-যাজন) ও জ্ঞান (অধ্যয়ন, অধ্যাপনা) বিস্তারের ভার লইয়াছেন । ঈদৃশ পরার্থপর ত্যাগী ব্রাহ্মণজাতির রক্ষাকল্পে শাস্ত্রের যে সকল ব্যবস্থা তাহা সম্পূর্ণ যুক্তিসঙ্গত ও সমাজরক্ষার অনুকূল । আবার, বেদজ্ঞানহীন নিরগ্নি (অর্থাৎ স্বধর্ম পালনে পরাঙ্মুখ) দ্বিজবন্ধুদিগকে দান করিলে নিরয়গামী (condemned to hell) হইতে হয়, শাস্ত্রে এমন কঠোর অনুশাসনও রহিয়াছে । সুতরাং ঋষিশাস্ত্রের অনুদারতা বা পক্ষপাতিতা কোথাও নাই ।
গ্রহণাদি সময়ে বা পুণ্যক্ষেত্রাদিতে লোকের সাত্ত্বিক ভাব বৃদ্ধি হওয়ারই সম্ভাবনা থাকে, এই হেতু সেই কাল বা স্থান-দানাদি কর্মে প্রশস্ত বলিয়া বিবেচিত হইয়া থাকিবে, কেননা দানাদি কর্ম সাত্ত্বিক শ্রদ্ধার সহিত নিষ্পন্ন না হইলে নিষ্ফল হয় [গীতা ১৭|২৮] । কিন্তু কাল পরিবর্তনে ব্রাহ্মণজাতির ব্রাহ্মণত্ব বা তীর্থক্ষেত্রাদির মাহাত্ম্য যদি লোপ পায় এবং তদ্দরুণ লোকের ভক্তিশ্রদ্ধার যদি ব্যত্যয় ঘটে, তবে এই সকল বিধি-ব্যবস্থার কোন মূল্য থাকে না, তাহা বলাই বাহুল্য । সে স্থলে শাস্ত্রের প্রকৃত মর্ম ও উদ্দেশ্য বুঝিইয়া তদনুসারে কর্তব্যাকর্তব্য নির্ণয় করাই শ্রেয়কল্প; সংস্কারবশতঃ প্রাণহীন অনুষ্ঠান লইয়া বসিয়া থাকিলে ক্রমশঃ অধোগতি সুনিশ্চিত ।
(২৬) সদ্ভাব = থাকার ভাব বা অস্ত্যর্থে ।
(২৭) ওঁ তৎ সৎ (স্ফোট) - এই তিনটি ব্রহ্মবাচক । তিনটির পৃথক্ও ব্যবহার হয়, এক সঙ্গেও ব্রহ্ম নির্দেশার্থ ব্যবহৃত হয় । ওঁ (অ-উ-ম্) বা প্রণব বা শব্দব্রহ্ম বা স্ফোটরূপী ওঙ্কার হইতেই জগতের সৃষ্টি । " 'ওঁ' - গূঢ়াক্ষররূপী বৈদিক মন্ত্র; 'তৎ' - তাহা অর্থাৎ দৃশ্য জগতের অতীত দূরবর্তী অনির্বাচ্য তত্ত্ব; 'সৎ' - চক্ষুর সম্মুখস্থ দৃশ্য জগৎ । এই তিন মিলিয়া সমস্তই ব্রহ্ম, ইহাই এই সঙ্কল্পের অর্থ ।" - লোকমান্য তিলক । এ স্থলে বলা হইতেছে যে - 'ওঁ তৎ সৎ' এই ব্রহ্মনির্দেশ হইতে ব্রাহ্মণাদি কর্তা, করণরূপ বেদ এবং কর্মরূপ যজ্ঞ সৃষ্টি হইয়াছে । ইহারই নাম শব্দব্রহ্মবাদ । এই ওঙ্কারই জগতের অভিব্যক্তির আদি কারণ শব্দব্রহ্ম । ইহার নাম স্ফোট । স্ফোট হইতে কিরূপে জগতের সৃষ্টি হইল তাহা শ্রীমদ্ভাগবতে বর্ণিত আছে [ভা | ১২|৬|৩৩-৩৭] :-
১) সমাধিমগ্ন ব্রহ্মার হৃদাকাশ হইতে প্রথমত নাদ উৎপন্ন হইল;
২) নাদ হইতে ত্রিমাত্রা ওঙ্কার উৎপন্ন হইল যাহা সমস্ত বৈদিক মন্ত্রোপনিষদের বীজস্বরূপ;
৩) অব্যক্ত ওঙ্কারের অকার, উকার, মকার এই তিন বর্ণ প্রকাশ পাইল;
৪) এই তিন বর্ণ হইতে ক্রমশ সত্ত্বাদি গুণ, ঋগাদি বেদ, ভূর্ভুবাদি লোক অর্থাৎ জগৎপ্রপঞ্চ সৃষ্ট হইল ।
কর্মে ব্রহ্মনির্দেশ :
পূর্বে বলা হইয়াছে, ব্রহ্মবাচক স্ফোটরূপী ওঙ্কার হইতেই জগতের সৃষ্টি । জগতের ধারণ-পোষণের জন্য যজ্ঞসৃষ্টি । যজ্ঞ-শব্দে ব্যাপক অর্থে চাতুর্বর্ণ্যের আচরণীয় সমস্ত কর্ম বুঝায় । এই যজ্ঞ-কর্মের ব্যবস্থাই বেদে আছে এবং যজ্ঞরক্ষার ভার প্রধানত ব্রাহ্মণের উপর । ব্রাহ্মণ, বেদ ও যজ্ঞ পরব্রহ্ম হইতেই উৎপন্ন হইয়াছে; সুতরাং ব্রহ্মবাচক 'ওঁ তৎ সৎ' এই সঙ্কল্পই সমগ্র সৃষ্টির মূল । যজ্ঞ বা কর্মদ্বারাই সৃষ্টিরক্ষা হয়, সুতরাং 'ওঁ তৎ সৎ' এই সঙ্কল্পদ্বারাই সমস্ত কর্ম করিতে হয় । ইহার স্থূল মর্ম এই যে, সর্বকর্মই পরমাত্মাকে স্মরণ করিয়া ঈশ্বরার্পণ-বুদ্ধিতে করিবে অর্থাৎ কর্মকে ব্রহ্মকর্মে পরিণত করিবে, তাহা ত্যাগ করিবে না ।
___________________________
*Hard Copy Source:
*Hard Copy Source:
"Sri Gita" or "Srimadbhagabadgeeta" by Gitashastri Jagadish Chandra Ghosh & Anil Chandra Ghosh. 26th Edition - June 1997 (1st Edition, 1925 from Dhaka now in Bangladesh). Published by Subhadra Dey (Ghosh), Presidency Library, 15 Bankim Chatterjee Street, Kolkata-700073. Printed by Web Impressions Pvt.Ltd., 34/2 Beadon Street, Kolkata-700006.
Online Reference:
1)"Dharma-tatta" by Sri Bankim Chandra Chattopadhyay. Bankim Rachanabali. Unicode compliant electronic edition provided by Society for Natural Language Technology Research.
2)"Bhaktir Sadhan" in Bhaktiyoga by Swami Vivekananda. Swamiji's Vani & Rachana. Volume-4, pp.40-41. Unicode compliant electronic edition provided by Society for Natural Language Technology Research.
2)"Bhaktir Sadhan" in Bhaktiyoga by Swami Vivekananda. Swamiji's Vani & Rachana. Volume-4, pp.40-41. Unicode compliant electronic edition provided by Society for Natural Language Technology Research.
Disclaimer: This site is not officially related to Presidency Library, Kolkata. This is a personal, non-commercial, research-oriented effort of a novice religious wanderer.
এটি আধ্যাত্মিক পথের এক অর্বাচীন পথিকের ব্যক্তিগত, অবাণিজ্যিক, গবেষণা-ধর্মী প্রয়াস মাত্র ।
No comments:
Post a Comment