Friday, March 13, 2015

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা : চতুর্দশ অধ্যায় - গুণত্রয়-বিভাগযোগ (14-Jagadishchandra)


|||||||||১০|১১|১২|১৩|১৪|১৫|১৬|১৭|১৮
(গীতাশাস্ত্রী জগদীশচন্দ্র ঘোষ)*

শ্রীভগবান্‌ বলিলেন -
আমি পুনরায় জ্ঞানসমূহের মধ্যে সর্বোত্তম জ্ঞান বলিতেছি, যাহা জানিয়া মুনিগণ এই দেহবন্ধন হইতে মোক্ষলাভ করিয়াছেন । ১

এই জ্ঞান আশ্রয় করিয়া যাঁহারা আমার সাধর্ম্য লাভ করেন অর্থাৎ ত্রিগুণাতীত অবস্থা প্রাপ্ত হন, তাঁহারা সৃষ্টিকালেও জন্মগ্রহণ করেন না, প্রলয়কালেও ব্যথিত হন না (
অর্থাৎ জন্ম-মৃত্যু অতিক্রম করেন) । ২

হে ভারত, প্রকৃতিই আমার গর্ভাধান-স্থান । আমি তাহাতে গর্ভাধান করি, তাহা হইতেই সর্বভূতের উৎপত্তি হয় । ৩

হে কৌন্তেয়, দেব-মনুষ্যাদি বিভিন্ন যোনিতে যে সকল শরীর উৎপন্ন হয়, প্রকৃতি তাহাদের মাতৃস্থানীয়া এবং আমিই গর্ভাধানকর্তা পিতা । ৪

হে মহাবাহো, সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ প্রকৃতিজাত এই তিন গুণ দেহমধ্যে অব্যয় আত্মাকে বন্ধন করিয়া রাখে । ৫

হে অনঘ, এই তিন গুণের মধ্যে সত্ত্বগুণ নির্মল বলিয়া প্রকাশক এবং নির্দোষ; এই সত্ত্বগুণ সুখসঙ্গ ও জ্ঞানসঙ্গদ্বারা আত্মাকে বন্ধন করিয়া রাখে । ৬

হে অর্জুন, রজোগুণ রাগাত্মক, তৃষ্ণা ও আসক্তি উহা হইতে উৎপন্ন হয় । উহা কর্মাসক্তিদ্বারা দেহীকে বন্ধন করে । ৭

হে ভারত, তমোগুণ অজ্ঞানজাত এবং দেহিগণের ভ্রান্তিজনক । ইহা প্রমাদ (অনবধানতা), আলস্য ও নিদ্রা (চিত্তের অবসাদ) দ্বারা জীবকে আবদ্ধ করে । ৮

হে ভারত, সত্ত্বগুণ সুখে এবং রজোগুণ কর্মে জীবকে আসক্ত করে । কিন্তু তমোগুণ জ্ঞানকে আবৃত করিয়া প্রমাদ (কর্তব্যমূঢ়তা বা অনবধানতা) উৎপন্ন করে । ৯

হে ভারত, সত্ত্বগুণ রজঃ ও তমোগুণকে অভিভূত করিয়া প্রবল হয়, রজোগুণ তমঃ ও সত্ত্বগুণকে অভিভূত করিয়া প্রবল হয় এব তমোগুণ রজঃ ও সত্ত্বগুণকে অভিভূত করিয়া প্রবল হয় । ১০

যখনই এই দেহে শ্রোত্রাদি সর্ব ইন্দ্রিয়দ্বারে জ্ঞানাত্মক প্রকাশ অর্থাৎ নির্মল জ্ঞান উৎপন্ন হয়, তখন জানিবে যে, সত্ত্বগুণ বৃদ্ধি প্রাপ্ত হইয়াছে । ১১

হে ভরতশ্রেষ্ঠ, লোভ, সর্বদা কর্মে প্রবৃত্তি এবং সর্ব কর্মে উদ্যম (সর্বদা ইহা করিব উহা করিব - এইরূপ অস্থিরতা), শান্তি ও তৃপ্তির অভাব, বিষয়স্পৃহা - এইসকল লক্ষণ রজোগুণ বৃদ্ধি প্রাপ্ত হইলে উৎপন্ন হয় । ১২

হে কুরুনন্দন, তমোগুণ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হইলে বিবেকভ্রংশ, নিরুদ্যমতা, কর্তব্যের বিস্মরণ এবং মোহ বা বুদ্ধি-বিপর্যয় - এইসকল লক্ষণ উৎপন্ন হয় । ১৩

সত্ত্বগুণ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হইলে যদি জীবের মৃত্যু হয়, তবে তিনি উত্তম তত্ত্ববিদ্‌গণের প্রাপ্য প্রকাশময় দিব্য লোকসকল প্রাপ্ত হন । ১৪

রজোগুণের বৃদ্ধিকালে মৃত্যু হইলে কর্মাসক্ত মনুষ্য-যোনিতে জন্ম হয় এবং তমোগুণের বৃদ্ধিকালে মৃত্যু হইলে পশ্বাদি মূঢ়-যোনিতে জন্ম হয় । ১৫

সাত্ত্বিক পুণ্য কর্মের ফল নির্মল সুখ, রাজসিক কর্মের ফল দুঃখ এবং তামসিক কর্মের ফল অজ্ঞান, তত্ত্বদর্শিগণ এইরূপ বলিয়া থাকেন । ১৬

সত্ত্বগুণ হইতে জ্ঞান উৎপন্ন হয়; রজোগুণ হইতে লোভ এবং তমোগুণ হইতে অজ্ঞান, প্রমাদ ও মোহ উৎপন্ন হইয়া থাকে । ১৭

সত্ত্বগুণপ্রধান ব্যক্তি ঊর্ধ্বলোকে অর্থাৎ স্বর্গাদি লোকে গমন করেন; রজঃপ্রধান ব্যক্তিগণ মধ্যলোকে অর্থাৎ ভূলোকে অবস্থান করেন; এবং প্রমাদ-মোহাদি নিকৃষ্টগুণসম্পন্ন তমঃপ্রধান ব্যক্তিগণ অধোগামী হয় (তমিস্রাদি নরক বা পশ্বাদি যোনি প্রাপ্ত হয়) । ১৮

যখন দ্রষ্টা জীব গুণ ভিন্ন অন্য কাহাকেও কর্তা না দেখেন (অর্থাৎ প্রকৃতিই কর্ম করে, আমি করি না, ইহা বুঝিতে পারেন) এবং তিন গুণের অতীত পরম বস্তুকে অর্থাৎ আত্মাকে জ্ঞাত হন, তখন তিনি আমার ভাব অর্থাৎ ব্রহ্মভাব বা ত্রিগুণাতীত প্রাপ্ত হন । ১৯

জীব দেহোৎপত্তির কারণভূত এই তিন গুণ অতিক্রম করিয়া জন্মমৃত্যু জরাদুঃখ হইতে বিমুক্ত হইয়া অমৃতত্ত্ব অর্থাৎ মোক্ষ লাভ করেন । ২০


অর্জুন কহিলেন -
হে প্রভো, কোন্‌ লক্ষণের দ্বারা জানা যায় যে জীব ত্রিগুণ অতিক্রম করিয়াছেন ? তাঁহার আচার কিরূপ ? এবং কি প্রকারে তিনি ত্রিগুণ অতিক্রম করেন ? ২১

 
শ্রীভগবান্‌ বলিলেন
হে পাণ্ডব, সত্ত্বগুণের কার্য প্রকাশ বা জ্ঞান, রজোগুণের ধর্ম কর্ম-প্রবৃত্তি এবং তমোগুণের ধর্ম মোহ, এই সকল গুণধর্ম প্রবৃত্ত হইলেও যিনি সুখবুদ্ধিতে উহা আকাঙ্ক্ষা করেন না, তিনিই গুণাতীত বলিয়া উক্ত হন । ২২

যিনি উদাসীনের ন্যায় সাক্ষিরূপে অবস্থান করেন, সত্ত্বাদিগুণ-কার্য সুখদুঃখাদি কর্তৃক বিচালিত হন না, গুণসকল স্ব স্ব কার্যে বর্তমান আছে, আমার সহিত ইহার কোন সম্পর্ক নাই, ইহা মনে করিয়া যিনি চঞ্চল হন না, তিনি গুণাতীত বলিয়া কথিত হন । ২৩

যাঁহার নিকট সুখদুঃখ সমান, যিনি স্বস্থ অর্থাৎ আত্মরূপেই স্থিত, মৃত্তিকা, প্রস্তর ও সুবর্ণ যাঁহার নিকট সমান, যিনি প্রিয় ও অপ্রিয় এবং আপনার নিন্দা ও প্রশংসা তুল্য মনে করেন, যিনি ধীমান্‌ বা ধৈর্যযুক্ত, তিনিই গুণাতীত বলিয়া অভিহিত হন । ২৪

মানে ও অপমানে, শত্রুপক্ষ ও মিত্রপক্ষে যাঁহার তুল্যজ্ঞান এবং ফলাকাঙ্ক্ষা করিয়া যিনি কর্মোদ্যম করেন না (সর্বারম্ভপরিত্যাগী), এরূপ ব্যক্তি গুণাতীত বলিয়া কথিত হন । ২৫

যিনি ঐকান্তিক ভক্তিযোগ সহকারে আমার সেবা করেন, তিনি এই তিন গুণ অতিক্রম করিয়া ব্রহ্মভাব লাভে সমর্থ হন । ২৬

যেহেতু আমি ব্রহ্মের নিত্য অমৃতের অর্থাৎ মোক্ষের, সনাতন ধর্মের এবং ঐকান্তিক সুখের প্রতিষ্ঠা (অথবা আমি অমৃত ও অব্যয় ব্রহ্মের, শাশ্বত ধর্মের এবং ঐকান্তিক সুখের প্রতিষ্ঠা) । ২৭ 
___________________________

(১) পূর্ব অধ্যায়ে বলা হইয়াছে, সকল কর্ত্রিত্বই প্রকৃতির, পুরুষ অকর্তা । প্রকৃতির গুণসঙ্গবশতঃই জীবের সদসদ্‌ যোনিতে জন্ম ও সুখ-দুঃখ ভোগ অর্থাৎ সংসারিত্ব । এই গুণ কি, উহাদের লক্ষণ কি, উহারা কি ভাবে জীবকে আবদ্ধ করে, কিরূপে প্রকৃতি হইতে বিবিধ সৃষ্টি হয়, ইত্যাদি বিষয়ে বিস্তারিত কিছুই বলা হয় নাই । সেই হেতু এই প্রকৃতি-তত্ত্ব বা ত্রিগুণ-তত্ত্বই আবার বলিতেছেন ।

(২) সাধর্ম্য = স্বরূপতা অর্থাৎ আমি যেমন ত্রিগুণাতীত এইরূপ ত্রিগুণাতীত অবস্থা ।

(৩,৪) মহদ্‌ব্রহ্ম = প্রকৃতি; 'গর্ভাধান করি' = সর্বভূতের জন্মকারণ স্বরূপ বীজ প্রকৃতিরূপ যোনিতে আধান করি । ভূতগণকে তাহাদের স্বীয় প্রাক্তন কর্মানুসারে ক্ষেত্রের সহিত সংযোজিত করি । অথবা প্রকৃতিতে আমার সঙ্কল্পিত বীজ আধান করি অর্থাৎ আমার সঙ্কল্পানুসারেই প্রকৃতি সৃষ্টি করে । ঈশ্বরের সৃষ্টি-সঙ্কল্পই গর্ভাধানস্বরূপ - প্রকৃতির স্বতন্ত্র সৃষ্টি-সামর্থ্য নাই । বেদান্তে ইহাকেই 'ঈক্ষণ' বলে (জ্ঞান-বিজ্ঞান-যোগে 'সাংখ্যের সৃষ্টিতত্ত্ব - প্রকৃতি ও পুরুষ' দ্রষ্টব্য) ।

(৫) জীবাত্মা অবিকারী হইলেও প্রকৃতির গুণসঙ্গবশতঃ দেহাত্মভাব প্রাপ্ত হওয়ায় সুখ-দুঃখ মোহাদিতে জড়িত হইয়া পড়েন । ত্রিগুণের বন্ধন =  প্রকৃতি-সংযোগে পুরুষের সংসারবন্ধন ।

(৬) সত্ত্বগুণের বন্ধন - সত্ত্বগুণের মুখ্য ধর্ম - সুখ ও জ্ঞান - এই দুইটিও বন্ধনের কারণ বলা হইতেছে । সত্ত্বগুণ দুই প্রকার - (i) মিশ্রসত্ত্ব অর্থাৎ রজস্তমো-মিশ্রিত সত্ত্ব এবং (ii) শুদ্ধসত্ত্ব অর্থাৎ রজস্তমো-বর্জিত সত্ত্ব । রজস্তমোবর্জিত বিশুদ্ধ সত্ত্বগুণের লক্ষণ = নিস্ত্রৈগুণ্য বা ত্রিগুণাতীতের অবস্থা অর্থাৎ নির্দ্বন্দ্বভাব, বিমল সদানন্দ এবং অপরোক্ষ আত্মানুভূতির অবস্থা । গীতায় নিস্ত্রৈগুণ্য বলিতে 'নিত্য শুদ্ধসত্ত্বগুণাশ্রিত' বুঝায় । এই হেতুই ২|৪ শ্লোকে শ্রীভগবান অর্জুনকে 'নিস্ত্রৈগুণ্য' হইতে বলিয়াও 'নিত্যসত্ত্বস্থ' হইতে বলিয়াছেন ।
সত্ত্বগুণ জলের ন্যায় নির্মল হইলেও অপর দুইটির সহিত মিশ্রিত থাকায় উহা বন্ধনের কারণ হয় । "সত্ত্বগুণের খুব প্রাধান্য হইলেও তাহা প্রকৃত স্বাধীনতার অবস্থা নহে কারণ অন্যান্য গুণের ন্যায়ই বাসনা (মহত্তর) ও অহঙ্কারের (শুদ্ধতর) দ্বারাই বন্ধন করে । সাত্ত্বিক অহঙ্কারের উদাহরণ - আমি সাধু, আমি জ্ঞানী । প্রকৃত স্বাধীনতা, চরম স্বরাজ্য তখনই আরম্ভ হইবে যখন প্রাকৃত আত্মার উপরে আমরা পরমাত্মাকে দেখিতে পাইব, ধরিতে পারিব । আমাদের ক্ষুদ্র 'আমি' - আমাদের অহঙ্কার এই পরমাত্মাকে দেখিতে দেয় না । ইহার জন্য আমাদিগকে গুণত্রয়ের বহু ঊর্ধ্বে উঠিতে হইবে, ত্রিগুণাতীত হইতে হইবে, কারণ পরমাত্মা সত্ত্বগুণেরও উপরে ।" ...[abridged from শ্রীঅরবিন্দের গীতা (অনিলবরণ)] ।

(১০-১৩) সত্ত্বগুণ, রজোগুণ ও তমোগুণ কখনও পৃথক্‌ পৃথক্‌ থাকে না, একত্রেই থাকে । কিন্তু জীবের পূর্ব কর্মানুসারে অদৃষ্টবশে কখনও সত্ত্বগুণ অপর দুইটিকে অভিভূত করিয়া প্রবল হয় এবং জীবকে সুখাদিতে আসক্ত করে । এইরূপ কোথাও রজোগুণ প্রবল হইয়া কর্মাসক্তি, বিষয়-স্পৃহা, অস্থিরতা জন্মায় বা তমোগুণ প্রবল হইয়া নিদ্রা, অনুদ্যম, প্রমাদ, কর্তব্যের বিস্মৃতি, বুদ্ধি-বিপর্যয়, আলস্যাদি উৎপন্ন করে । এই হেতুই জীবের সাত্ত্বিক, রাজসিক ও তামসিক এইরূপ বিভিন্ন প্রকৃতি বা স্বভাব দৃষ্ট হয় ।

(১৮) সত্ত্বগুণ-প্রধান ব্যক্তিগণ স্বর্গাদি দিব্যলোক প্রাপ্ত হন । কিন্তু তাহা হইলেও তাহাদের মোক্ষলাভ বা ভগবৎপ্রাপ্তি ঘটে না । ঐ সকল লোক হইতেও পতন আছে । তবে মোক্ষলাভ কিসে হয় ? - পরের দুই শ্লোক ।

(২০) প্রকৃতির গুণসঙ্গবশতঃই জীবের দেহোৎপত্তি ও সংসারিত্ব । এই ত্রিগুণ অতিক্রম করিতে পারিলেই মোক্ষ । তাহার উপায় কি ? সাংখ্যদর্শন বলেন যে, জীব যখন বুঝিতে পারে যে প্রকৃতি পৃথক্‌, আমি পৃথক্‌, তখনই তাহার মুক্তি হয় । কিন্তু বেদান্ত ও গীতা সাংখ্যের এই প্রকৃতি-পুরুষরূপী দ্বৈতকে মূল তত্ত্ব বলিয়া স্বীকার করেন না । সুতরাং এই কথাটিই গীতায় এইরূপ ভাবে বলা হয় যে, প্রকৃতি ও পুরুষের উপরে যে পরমাত্মা বা পুরুষোত্তম আছেন, সেই পরমাত্মাকে যখন জীব জানিতে পারে, তখনই তাহার মোক্ষ বা ব্রহ্মলাভ হয় ।

(২১) ব্রাহ্মীস্থিতি = স্থিতপ্রজ্ঞ অথবা ত্রিগুণাতীতের অবস্থা

(২২,২৩) দেহে প্রকৃতির কার্য চলিতেছে চলুক । আমি উহাতে লিপ্ত নই । আমি অকর্তা, উদাসীন্, সাক্ষিস্বরূপ । এই জ্ঞান যাঁহার হইয়াছে তিনিই ত্রিগুণাতীত ।

(২৫) আরম্ভ = ঐহিক বা পারত্রিক ফল কামনা করিয়া কর্মের উদ্যোগ । সর্বারম্ভপরিত্যাগী = এইরূপ আরম্ভ যিনি করেন না । উদাহরণ ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির ।

(২৭) আমিই ব্রহ্মের প্রতিষ্ঠা - ভগবৎ-তত্ত্ব ও ব্রহ্মতত্ত্ব

সাংখ্যমতে ত্রিগুণাতীত হইয়া বা কৈবল্য লাভের একমাত্র উপায় পঞ্চবিংশতি তত্ত্বের জ্ঞান [সাংখ্যসূত্র ৩|২৩] । পাতঞ্জলমতে ধ্যান-ধারণা ও পরিশেষে নির্বীজ সমাধি; সাংখ্যে যাহাকে প্রকৃতি বলে, অদ্বৈত বেদান্তে তাহাই অজ্ঞান বা মায়া । বেদান্ত মতেও জ্ঞানই ব্রহ্মভাব বা মোক্ষলাভের উপায়, ব্রহ্মসূত্রে কোথাও 'ভক্তি' শব্দ নাই । কিন্তু এস্থলে ভগবান্‌ বলিতেছেন - ত্রিগুণাতীত হইয়া ব্রহ্মভাব লাভের উপায় আমাতে অব্যভিচারিণী ভক্তি; আমাকে একান্ত ভক্তিযোগে সেবা করিলেই ত্রিগুণাতীত হইয়া ব্রহ্মভাব লাভ করা যায়, কারণ আমিই ব্রহ্মের প্রতিষ্ঠা [১৪|২৬,২৭]; ব্রহ্মভাব প্রাপ্ত হইলে আমাতে পরাভক্তি জন্মে [১৮|৫৪] । 'আমি' বলিতে অবশ্য এস্থলে বুঝায় ভগবান্‌ শ্রীকৃষ্ণ । কিন্তু ভগবানে ও ব্রহ্মে কি কোন পার্থক্য আছে ? আছেও; নাইও । স্বরূপতঃ না থাকিলেও সাধকের নিকট যে পার্থক্য আছে তাহা বুঝা যায় দ্বাদশ অধ্যায়ে অর্জুনের প্রশ্নে - 'তোমাকে যাঁহারা ত্বদ্‌গতচিত্ত হইয়া ভজনা করেন, আর যাঁহারা অক্ষর ব্রহ্ম চন্তা করেন, এ উভয়ের মধ্যে শ্রেষ্ঠ সাধক কে ?' তদুত্তরে শ্রীভগবান্‌ বলিলেন - 'আমার ভক্তই শ্রেষ্ঠ সাধক, তবে অক্ষর ব্রহ্মচিন্তকেরাও আমাকেই পান ।' এই কথার মর্ম - অক্ষর ব্রহ্ম আমিই, ব্রহ্মভাব আমারই বিভাব, নির্গুণভাবে আমি অক্ষর ব্রহ্ম, সগুণভাবে আমি বিশ্বরূপ, লীলাভাবে আমি অবতার - আমি পুরুষোত্তমই পরতত্ত্ব । ব্রহ্ম, আত্মা, বিরাট্‌, বৈশ্বানর, তৈজস, প্রাজ্ঞ, তুরীয় - সকলই আমি, সকল অবস্থাই আমার বিভাব বা বিভিন্ন ভাব । এই সগুণ-নির্গুণ, সৃষ্টিস্থিতি-প্রলয়কর্তা, যজ্ঞ-তপস্যার ভোক্তা, সর্বলোকমহেশ্বর পরমাত্মা পুরুষোত্তমই ভগবৎ-তত্ত্ব; আর উহার যে অনির্দেশ্য, অক্ষর, নির্বিশেষ নির্গুণ বিভাব, তাহাই ব্রহ্মতত্ত্ব । এই অর্থে বলা হইয়াছে, আমিই ব্রহ্মের অথবা শাশ্বত ধর্মের প্রতিষ্ঠা ।

সাধনপথে ভক্তির উপযোগিতা স্বীকার করিলেই ভগবত্তত্তের শ্রেষ্ঠতা স্বতঃই আসিবে, এই হেতু গীতা বেদান্তাদি শাস্ত্রের মূলতত্ত্ব স্বীকার করিলেও উহাতে ঈশ্বর-বাদেরই প্রাধান্য । 'গীতা সাধারণভাবে সেই সেই দর্শনের (সাংখ্য, বেদান্তাদির) মূল প্রতিপাদ্য অঙ্গীকার করিয়া তাহার সহিত ঈশ্বরবাদ সংযুক্ত করিয়া তাহাদিগকে সুসম্পূর্ণ করিয়াছেন । এই ঈশ্বরবাদই গীতার প্রাণ; গীতার আদি, অন্ত, মধ্য - সমস্তই ঈশ্বরবাদে সমুজ্জল ।' - বেদান্তরত্ন হীরেন্দ্রনাথ, গীতায় ঈশ্বরবাদ ।

___________________________
*Hard Copy Source:

"Sri Gita" or "Srimadbhagabadgeeta" by Gitashastri Jagadish Chandra Ghosh & Anil Chandra Ghosh. 26th Edition - June 1997 (1st Edition, 1925 from Dhaka now in Bangladesh). Published by Subhadra Dey (Ghosh), Presidency Library, 15 Bankim Chatterjee Street, Kolkata-700073. Printed by Web Impressions Pvt.Ltd., 34/2 Beadon Street, Kolkata-700006.



Disclaimer: This site is not officially related to Presidency LibraryKolkata. এটি এক অর্বাচীন ভক্তের প্রয়াস মাত্র 

[Digitised by scanning (if required) and then by typing mostly in Notepad using Unicode Bengali "Siyam Rupali" font and Avro Phonetic Keyboard for transliteration. Uploaded by rk]


<Previous--Contents--Next>

No comments:

Post a Comment