Saturday, March 14, 2015

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা : চতুর্থ অধ্যায় - জ্ঞানযোগ (4-Jagadishchandra)


|||৪||||||১০|১১|১২|১৩|১৪|১৫|১৬|১৭|১৮
(গীতাশাস্ত্রী জগদীশচন্দ্র ঘোষ)*

শ্রীভগবান্‌ বলিলেন -
এই অব্যয় যোগ আমি সূর্যকে বলিয়াছিলাম । সূর্য (স্বপুত্র) মনুকে এবং মনু (স্বপুত্র) ইক্ষ্বাকুকে ইহা বলিয়াছিলেন । ১

এইরূপে পুরুষপরম্পরা প্রাপ্ত এই যোগ রাজর্ষিগণ বিদিত ছিলেন । হে পরন্তপ, ইহলোকে সেই যোগ দীর্ঘকালবশে নষ্ট হইয়াছে । ২


তুমি আমার ভক্ত ও সখা, এই জন্য এই সেই পুরাতন যোগ অদ্য তোমাকে বলিলাম; কারণ, ইহা উত্তম গুহ্য তত্ত্ব । ৩

অর্জুন বলিলেন -

আপনার জন্ম পরে, বিবস্বানের জন্ম পূর্বে; সুতরাং আপনি যে পূর্বে ইহা বলিয়াছিলেন, তাহা কিরূপে বুঝিব ? ৪

শ্রীভগবান্‌ বলিলেন -

হে অর্জুন ! আমার এবং তোমার বহু জন্ম অতীত হইয়াছে । আমি সে সকল জানি; হে পরন্তপ ! তুমি জান না । ৫

আমি জন্মরহিত, অবিনশ্বর এবং সর্বভূতের ঈশ্বর হইয়াও স্বীয় প্রকৃতিতে অনুষ্ঠান করিয়া আত্মমায়ায় আবির্ভূত হই । ৬

হে ভারত ! যখনই যখনই ধর্মের গ্লানি এবং অধর্মের অভ্যুত্থান হয়, আমি সেই সেই সময়ে নিজেকে সৃষ্টি করি (দেহ ধারণপূর্বক অবতীর্ণ হই) । ৭

সাধুগণের পরিত্রাণ, দুষ্টদিগের বিনাশ এবং ধর্মসংস্থাপনের জন্য আমি যুগে যুগে অবতীর্ণ হই ।

হে অর্জুন, আমার এই দিব্য জন্ম ও কর্ম যিনি তত্ত্বতঃ জানেন, তিনি দেহত্যাগ করিয়া পুনর্বার আর জন্মপ্রাপ্ত হন না - তিনি আমাকেই প্রাপ্ত হন । ৯

বিষয়ানুরাগ, ভয় ও ক্রোধ বর্জন করিয়া, আমাতে একাগ্রচিত্ত ও আমার শরণাপন্ন হইয়া, আমার জন্মকর্মের তত্ত্বালোচনা রূপ জ্ঞানময় তপস্যাদ্বারা পবিত্র হইয়া অনেকে আমার পরমানন্দভাবে চিরস্থিতি লাভ করিয়াছেন । ১০

হে পার্থ ! যে আমাকে যে-ভাবে উপাসনা করে, আমি তাহাকে সেই ভাবেই তুষ্ট করি । মনুষ্যগণ সর্বপ্রকারে আমার পথেরই অনুসরণ করে অর্থাৎ মনুষ্যগণ যে পথই অনুসরণ করুক না কেন, সকল পথেই আমাতে পৌঁছিতে পারে । ১১

ইহলোকে যাহারা কর্মসিদ্ধি কামনা করে তাহারা দেবতা পূজা করে, কেননা মনুষ্যলোকে কর্মজনিত ফললাভ শীঘ্রই পাওয়া যায় । ১২

বর্ণচতুষ্টয় গুণ ও কর্মের বিভাগ অনুসারে আমি সৃষ্টি করিয়াছি বটে, কিন্তু আমি উহার সৃষ্টিকর্তা হইলেও আমাকে অকর্তা ও বিকাররহিত বলিয়াই জানিও । ১৩

কর্মসকল আমাকে লিপ্ত করিতে পারে না, কর্মফলে আমার স্পৃহাও নাই, এইরূপে যিনি আমাকে জানেন, তিনি কর্মদ্বারা আবদ্ধ হন না । ১৪

এইরূপ জানিয়া (অর্থাৎ আত্মাকে অকর্তা, অভোক্তা মনে করিয়া) পূর্ববর্তী মোক্ষাভিলাষিগণ অর্থাৎ পূর্ববর্তী জনকাদি রাজর্ষিগণ কর্তৃত্বাভিমান বর্জনপূর্বক নির্লিপ্তভাবে স্বীয় কর্তব্য কর্ম সম্পাদন করিয়া গিয়াছেন, তুমিও সেইরূপ নিষ্কামভাবে স্বীয় কর্তব্য পালন কর । ১৫

কর্ম কি, কর্মশূন্যতাই বা কি, এ বিষয়ে পণ্ডিতেরাও মোহ প্রাপ্ত হন অর্থাৎ ইহার প্রকৃত তত্ত্ব বুঝিতে পারেন না, অতএব কর্ম কি, (এবং অকর্ম কি) তাহা তোমাকে বলিতেছি, তাহা জানিলে অশুভ হইতে (সংসারবন্ধন হইতে) মুক্ত হইবে । ১৬

বিহিত কর্মের বুঝিবার বিষয় আছে, বিকর্ম বা অবিহিত কর্মের বুঝিবার বিষয় আছে, অকর্ম বা কর্মত্যাগ সন্বন্ধেও বুঝিবার বিষয় আছে; কেননা কর্মের গতি (তত্ত্ব) দুর্জ্ঞেয় । ১৭

যিনি কর্মে অকর্ম এবং অকর্মে কর্ম দেখেন মনুষ্যের মধ্যে তিনিই বুদ্ধিমান্‌; তিনি যোগী, তিনি সর্বকর্মকারী । ১৮

যাঁহার সমস্ত কর্মচেষ্টা, ফলতৃষ্ণা ও কর্ত্তৃত্বাভিমানবর্জিত, সুতরাং যাঁহার কর্ম জ্ঞানরূপ অগ্নিদ্বারা দগ্ধ হইয়াছে, সেইরূপ ব্যক্তিকেই জ্ঞানিগণ পণ্ডিত বলিয়া থাকেন । ১৯

যিনি কর্মে ও কর্মফলে আসক্তি পরিত্যাগ করিয়াছেন, যিনি সদা আপনাতেই পরিতৃপ্ত, যিনি কোন প্রয়োজনে কাহারও আশ্রয় গ্রহণ করেন না, তিনি কর্মে প্রবৃত্ত হইলেও কিছুই করেন না (অর্থাৎ তাঁহার কর্ম অকর্মে পরিণত হয়) । ২০

যিনি কামনা ত্যাগ করিয়াছে, যাঁহার চিত্ত ও ইন্দ্রিয় সংযত, যিনি সর্বপ্রকার দান-উপহারাদি গ্রহণ বর্জন করিয়াছেন, তাদৃশ ব্যক্তি কেবল শরীরদ্বারা কর্মানুষ্ঠান করিয়াও পাপভোগী হন না (কর্মবন্ধনে আবদ্ধ হন না) । ২১

যিনি প্রার্থনা ও বিশেষ চেষ্টা না করিয়া যাহা প্রাপ্ত হওয়া যায় তাহাতেই সন্তুষ্ট থাকেন, যিনি দ্বন্দ্বসহিষ্ণু, মাৎসর্য্যশূন্য সুতরাং বৈরবিহীন, যিনি সিদ্ধি ও অসিদ্ধি তুল্য জ্ঞান করেন, তিনি কর্ম করিয়াও কর্মফলে আবদ্ধ হয়েন না । ২২

যিনি ফলাকাঙ্ক্ষাবর্জিত, রাগদ্বেষাদিমুক্ত, যাঁহার চিত্ত আত্মবিষয়ক জ্ঞানে নিবিষ্ট বা জ্ঞানস্বরূপ ব্রহ্মে অবস্থিতি, যিনি যজ্ঞার্থ (অর্থাৎ ঈশ্বর-প্রীত্যর্থ যজ্ঞস্বরূপ) কর্ম করেন, তাঁহার কর্মসকল ফলসহ বিনষ্ট হইয়া যায়, ঐ কর্মের কোন সংস্কার থাকে না (অর্থাৎ তাহার কর্ম বন্ধনের কারণ হয় না) । ২৩


অর্পণ (স্রুবাদি-যজ্ঞপাত্র) ব্রহ্ম, ঘৃতাদি ব্রহ্ম, অগ্নি ব্রহ্ম, যিনি হোম করেন তিনিও ব্রহ্ম, এইরূপ জ্ঞানে ব্রহ্মরূপ কর্মে একাগ্রচিত্ত পুরুষ ব্রহ্মই প্রাপ্ত হন । ২৪

অন্য কোন কোন যোগিগণ দৈবযজ্ঞের অনুষ্ঠান করেন, অপর কেহ কেহ ব্রহ্মরূপ অগ্নিতে (পূর্বোক্ত ব্রহ্মার্পণ রূপ) যজ্ঞদ্বারাই যজ্ঞার্পণ করেন (অর্থাৎ সর্বকর্ম ব্রহ্মে অর্পণ করেন) । ২৫

অন্যে সংযমরূপ অগ্নিতে চক্ষুকর্ণাদি ইন্দ্রিয়সমূহকে হোম করেন অর্থাৎ ইন্দ্রিয়গুলিকে রূপরসাদি বিষয় হইতে প্রত্যাহার করিয়া সংযতেন্দ্রিয় হইয়া অবস্থান করেন, ইহার নাম সংযম-যজ্ঞ বা ব্রহ্মচর্য; অন্যে ইন্দ্রিয়রূপ অগ্নিতে শব্দাদি বিষয়সমূহকে আহুতি দেন - অর্থাৎ ইন্দ্রিয়সমূহ শব্দাদি বিষয় গ্রহণ করিতেছে, কিন্তু তিনি রাগদ্বেষশূন্যচিত্তে অনাসক্তভাবে থাকেন । মুমুক্ষু নির্লিপ্ত সংসারীরা এই যজ্ঞ করেন; ইহাকে বলা যায় ইন্দ্রিয়-যজ্ঞ । ২৬

অন্য কেহ (ধ্যানযোগিগণ) সমস্ত ইন্দ্রিয়-কর্ম ও সমস্ত প্রাণকর্ম ব্রহ্মজ্ঞানে প্রদীপিত আত্মসংযম বা সমাধিরূপ যোগাগ্নিতে হোম করেন অর্থাৎ পঞ্চ জ্ঞানেদ্রিয়, পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয় ও পঞ্চ প্রাণ - ইহাদের সমস্ত কর্ম নিরোধ করিয়া আত্মানন্দসুখে মগ্ন থাকেন । ইহার নাম আত্মসংযম বা সমাধি যজ্ঞ । ২৭

কেহ কেহ দ্রব্যদানরূপ যজ্ঞ করেন, কেহ কেহ তপোরূপ যজ্ঞ করেন, কেহ কেহ যোগরূপ যজ্ঞ করেন, কোন কোন দৃঢ়ব্রত যতিগণ বেদাভ্যাসরূপ যজ্ঞ করেন, কেহ কেহ বেদার্থপরিজ্ঞানরূপ যজ্ঞ সম্পাদন করেন । ২৮

আবার অন্য যোগিগণ অপান বায়ুতে 
প্রাণবায়ু এবং প্রাণবায়ুতে অপান বায়ু আহুতি দিয়া প্রাণ ও অপান বায়ুর গতি রোধ করিয়া প্রাণায়াম-পরায়ণ হইয়া থাকেন । ২৯

অপর কোনো-কোনো যোগী মিতাহারী হইয়া (আহার-সংযম-পূর্বক) ইন্দ্রিয়সমূহ প্রাণবায়ুতে আহুতি দেন । এই 
সকল যজ্ঞবিদ্‌গণ যজ্ঞদ্বারা পাপমুক্ত হন । ৩০

যাঁহারা অমৃত-স্বরূপ যজ্ঞাবশিষ্ট অন্ন ভোজন করেন, তাঁহারা সনাতন ব্রহ্মপদ লাভ করেন । হে কুরুশ্রেষ্ঠ! যে কোনরূপ যজ্ঞই করে না, তাহার ইহলোকই নাই, পরলোক তো দূরের কথা (অর্থাৎ ইহলোকেই তাহার কোন সুখ হয় না, পরলোকে আর কি হইবে ?) । ৩১

এইরূপ বহুবিধ যজ্ঞ ব্রহ্মের মুখে বিস্তৃত (বিহিত) আছে, এ সকলই কর্মজ অর্থাৎ কায়িক, বাচিক বা মানসিক এই ত্রিবিধ কর্ম হইতে সমুদ্ভূত বলিয়া জানিও; এইরূপ জানিলে মুক্তিলাভ করিবে । ৩২

হে পরস্তপ, দ্রব্যসাধ্য দৈব্যযজ্ঞাদি হইতে জ্ঞানযজ্ঞ শ্রেষ্ঠ; কেননা, ফল-সহিত সমস্ত কর্ম নিঃশেষে জ্ঞানে পরিসমাপ্ত হয় । ৩৩

গুরুচরণে দণ্ডবৎ প্রণামদ্বারা, নানা বিষয় প্রশ্নদ্বারা এবং গুরুসেবা দ্বারা সেই জ্ঞান লাভ কর । জ্ঞানী, তত্ত্বদর্শী গুরু তোমাকে সেই জ্ঞান উপদেশ করিবেন । ৩৪

হে পাণ্ডব, যাহা জানিলে পুনরায় এরূপ (শোকাদি জনিত) মোহ প্রাপ্ত হইবে না, যে জ্ঞানদ্বারা সমস্ত ভূতগ্রাম স্বীয় আত্মাতে এবং অনন্তর আমাতে দেখিতে পাইবে । ৩৫

যদি তুমি সমুদয় পাপী হইতেও অধিক পাপাচারী হও, তথাপি জ্ঞানরূপ তরণী দ্বারা সমুদয় পাপসমুদ্র ঊত্তীর্ণ হইতে পারিবে । ৩৬

হে অর্জুন, যেমন প্রজ্জ্বলিত অগ্নি কাষ্ঠরাশিকে ভস্মীভূত করে, তেমন জ্ঞানরূপ অগ্নি কর্মরাশিকে ভস্মসাৎ করে । ৩৭

ইহলোকে জ্ঞানের ন্যায় পবিত্র আর কিছু নাই । কর্ম-যোগে সিদ্ধ-পুরুষ সেই জ্ঞান কালসহকারে আপনিই অন্তরে লাভ করে । ৩৮

যিনি শ্রদ্ধাবান্‌, একনিষ্ঠ সাধন-তৎপর এবং জিতেন্দ্রিয়, তিনিই জ্ঞানলাভ করেন । আত্মজ্ঞান লাভ করিয়া অচিরাৎ পরম শান্তি লাভ করেন । ৩৯

অজ্ঞ, শ্রদ্ধাহীন, সংশয়াকুল, ব্যক্তি বিনষ্ট হয়, সংশয়াত্মার ইহলোকও নাই, পরলোকই নাই, সুখও নাই । ৪০

নিষ্কাম কর্মযোগের দ্বারা যাঁহার কর্ম ঈশ্বরে সমর্পিত হইয়াছে, আত্মদর্শনরূপ জ্ঞানের দ্বারা যাঁহার সকল সংশয় ছিন্ন হইয়াছে, এইরূপ অপ্রমাদী আত্মবিদ্‌ পুরুষকে কর্মসকল আবদ্ধ করিতে পারে না অর্থাৎ তিনি কর্ম করিলেও কর্মফলে আবদ্ধ হন না । ৪১


অতএব হে, ভারত, অজ্ঞাতজাত হৃদয়স্থ এই তোমার সংশয়রাশিকে আত্মজ্ঞানরূপ খড়্গদ্বারা ছেদন করিয়া নিষ্কাম কর্মযোগ অবলম্বন কর, উঠ, যুদ্ধ কর । ৪২
___________________________


১) বিবস্বান (সূর্য) হইতেই সূর্যবংশের উৎপত্তি । বিবস্বানের পুত্র মনু, মনুর পুত্র ইক্ষ্বাকু । এই বৈবস্বত মনু হইতে ৫৮তম অধস্তন পুরুষ শ্রীরামচন্দ্র ।

এই শ্লোকে যে যোগধর্মের কথা উল্লেখ করা হইল, ইহাই মহাভারতের শান্তিপর্বে কথিত নারায়ণীয় ধর্ম বা সাত্বত ধর্ম । কল্পে কল্পে এই ধর্ম কিরূপে আবির্ভূত হইয়া প্রচারিত হইয়াছে তথাত তাহার বিস্তারিত পরম্পরা দেওয়া হইয়াছে । এ-স্থলে মাত্র ব্রহ্মার সপ্তম জন্মে অর্থাৎ বর্তমান কল্পে ত্রেতাযুগের প্রথমে এই ধর্ম কিরূপে প্রচারিত হইয়াছিল, সেই পরম্পরা দেওয়া হইয়াছে ।

২) রাজর্ষি = রাজা হইয়াও যিনি ঋষি, যেমন জনকাদি । সুতরাং যাঁহারা জ্ঞানী ও কর্মী, ইহা তাঁহাদেরই অধিগম্য ।

৬) মায়া = পরমেশ্বরের অপূর্ব সৃষ্টি-কৌশল, যোগমায়া, যোগ । শঙ্কর মতে অবস্তু বা ভ্রমাত্মক কোনো কিছু (illusion) ।
পরমেশ্বরের নিজের অব্যক্ত স্বরূপ হইতে সমস্ত জগৎ নির্মাণ করিবার অচিন্ত্য শক্তিকেই গীতাতে 'মায়া' বলা হইয়াছে [তিলক] ।

অবতারতত্ত্ব :
সর্বভূতেশ্বর জন্মমৃত্যু-রহিত, প্রাণিগণের যেরূপ জন্মমৃত্যু হয়, তাঁহার সেরূপে আবির্ভাব হয় না । তিনি তাঁহার ত্রিগুণাত্মিকা প্রকৃতিকে বশীভূত করিয়া মায়াবলে আবির্ভূত হন অর্থাৎ মায়া-শরীর ধারণ করেন [শ্রীমৎ শঙ্করাচার্য] । কিন্তু ভক্তিপন্থী শ্রীধরস্বামী প্রভৃতি বলেন - উহাই তাঁহার নিত্যসিদ্ধ-চিদ্রূপ, উহা জড়রূপ নহে ।

মহাভারতে নারায়ণীয়-পর্বাধ্যায়ে যে দশ অবতারের উল্লেখ আছে তাহাতে বুদ্ধ অবতার নাই, প্রথমে হংস (swan) অবতার । পরবর্তী পুরাণসমূহে বুদ্ধ-অবতার লইয়াই দশ অবতারের গণনা হইয়াছে । ভাগবতে দ্বাবিংশ অবতারের উল্লেখ আছে, এবং এই প্রসিদ্ধ শ্লোকাংশ আছে - 'শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং ভগবান পরব্রহ্ম; সমস্ত অবতার তাঁহারই অংশ ও কলা' । বিশদ

বেদান্তমতে ঈশ্বর কেবল এক নন, তিনি অদ্বিতীয়, একমেবদ্বিতীয়ম্‌, তিনিই সমস্ত, তিনি ছাড়া আর-কিছু নাই, সকলই তাঁহার সত্তায় সত্তাবান, সকলই তাঁহার মধ্যেই আছে, তিনি সকলের মধ্যেই আছেন । সুতরাং অজ আত্মার দেহ-সম্পর্ক গ্রহণ করা অসম্ভব তো নহেই, বরং সেই সম্পর্কেই জগতের অস্তিত্ব । কাজেই হিন্দুর পক্ষে অবতার-বাদ কেবল ভক্তি-বিশ্বাসের বিষয়মাত্র নহে, উহা বেদান্তের দৃঢ় ভিত্তির উপরেই প্রতিষ্ঠিত ।

৮) যুগে যুগে - তত্ত্বদবসরে, তত্তৎ সময়ে (শ্রীধর, বলদেব) যখনই ধর্মের গ্লানি হয়, তখনই অবতার; এক যুগে একাধিক অবতারও হয় । 

৯-১০) লীলা-তত্ত্বের অনুধ্যানই শ্রেষ্ঠ সাধনা
শ্রেষ্ঠ অধ্যাত্মতত্ত্ব : শ্রীভগবান অজ, অব্যয়, অব্যক্ত হইয়াও কিরূপে আত্মমায়ার দ্বারা অবতীর্ণ হন ।
দিব্য কর্মতত্ত্ব : তিনি নিষ্ক্রিয়, অকর্তা হইয়াও নির্লিপ্তভাবে কিরূপে কর্ম করেন ।
ভক্তি-তত্ত্ব : তিনি নির্গুণ হইয়াও সগুণ, অশেষকল্যাণগুণোপেত, অহেতুক কৃপাসিন্ধু; লোকসংগ্রার্থ, লোকশিক্ষার্থ বা ভক্তবাঞ্ছাপূরণার্থ তাঁহার এই লীলা - এই তত্ত্ব ।

'অবতারের আগমনের নিগূঢ় ফল তাহারা ল্ভ করে, যাহারা ইহা হইতে দিব্য জম্ন ও দিব্য কর্মের প্রকৃত মর্ম বুঝিতে পারে, যাহাদের চিত্ত তাঁহার চিন্তাতেই পূর্ণ হয়, যাহারা সর্বতোভাবে তাঁহার আশ্রয় গ্রহণ করে, যাহারা জ্ঞানের দ্বারা শুদ্ধ হইয়া এবং নিম্ন প্রকৃতি হইতে মুক্ত হইয়া দিব্য সত্তা ও দিব্য প্রকৃতি লাভ করে ।' [শ্রীঅরবিন্দের গীতা]

১১) গীতার এই শ্লোকটির তাৎপর্য বুঝিলে প্রকৃতপক্ষে ধর্মগত-পার্থক্য থাকে না, হিন্দুর হৃদয়ে ধর্মবিদ্বেষ থাকিতে পারে না । হিন্দুর নিকট কৃষ্ণ, খ্রীষ্ট, বুদ্ধ সকলেই এক । 

'ইহাই প্রকৃত হিন্দুধর্ম । হিন্দুধর্মের তুল্য উদার ধর্ম আর নাই - আর এই শ্লোকের তুল্য উদার মহাবাক্য আর নাই ।' [বঙ্কিমচন্দ্র]

১৩) অব্যয় - অবিকারী (নীলকন্ঠ) । তিনি নির্গুণ হইয়াও সগুণ, ‘নির্গুণো-গুণী’ । নির্গুণ বিভাবে তিনি নির্বিশেষ নিষ্ক্রিয়; সগুণবিভাবে তিনি সৃষ্টিস্থিতিপ্রলয়কর্তা । তাই তিনি কর্তা হইয়াও অকর্তা, ক্রিয়াশীল হইয়াও অবিকারী । কেহ সকামভাবে রাজসিক বা তামসিক পূজার্চনা করে, কেহ নিষ্কাম ভাবে উপাসনা করে । এরূপ কর্ম-বৈচিত্র্য কেন? তুমিই ত এসব ঘটাও ? - না, প্রকৃতিভেদবশতঃ এইরূপ হয় । প্রকৃতিভেদ অনুসারে বর্ণভেদ বা কর্মভেদ আমি করিয়াছি - কিন্তু আমি উহার কর্তা হইলেও উহাতে লিপ্ত হই না বলিয়া আমি অকর্তা । জীবেরও এই তত্ত্ব জানিয়া নিষ্কামভাবে স্বধর্ম পালন করা উচিত । মুমুক্ষু ব্যক্তিগণ পূর্বে এই ভাবেই কর্ম করিযাছেন ।  

চতুর্বর্ণের উৎপত্তি

১৪) শ্রীভগবান্‌ আদর্শ কর্মযোগী, তাঁহার নির্লিপ্ততা ও নিস্পৃহতা বুঝিতে পারিলে মনুষ্য নিষ্কাম কর্মের মর্ম বুঝিতে পারে, তাহার কর্ম নিষ্কাম হয় । সুতরাং কর্ম করিয়াও সে কর্মবন্ধন হইতে মুক্ত হয় ।

১৬) কর্ম - বিহিত কর্ম; বিকর্ম - অবিহিত কর্ম; অকর্ম - কর্মশূন্যতা; কর্মত্যাগ, কিছু না করিয়া তুষ্ণীম্ভাব অবলম্বন । 

১৮) কর্মতত্ত্বঃ, বিকর্মতত্ত্ব, অকর্মতত্ত্ব :
কর্মতত্ত্বঃ : যিনি কর্মে অকর্ম দর্শন করেন অর্থাৎ যিনি কর্ম করিয়াও মনে করেন যে দেহেন্দ্রিয়াদি কর্ম করিতেছে, আমি কিছুই করি না, তিনিই বুদ্ধিমান্‌, কেন না কর্ম করিয়াও তিনি কর্মের ফলভোগী হন না । অর্থাৎ যিনি কর্তৃত্বাভিমান ত্যাগ করিয়া কর্ম করেন, তাঁহার কর্মও অকর্মস্বরূপ ।

বিকর্মতত্ত্বঃ : কর্ম করিয়াও তাহার ফলভোগী হন না সুতরাং নির্লিপ্ত অনহঙ্কারী কর্মযোগীর পক্ষে বিকর্মও অকর্মস্বরূপ ।

অকর্মতত্ত্বঃ : আর যিনি অকর্মে কর্ম দর্শন করেন, তিনিই বুদ্ধিমান্‌ । অনেকে আলস্যহেতু, দুঃখবুদ্ধিতে কর্তব্যকর্ম ত্যাগ করেন, কিন্তু তাহারা জানেন না এ অবস্থায় প্রকৃতির ক্রিয়া চলিতে থাকে, কর্মবন্ধ হয় না । এই যে কর্মত্যাগ বা অকর্ম ইহা প্রকৃতপক্ষে কর্ম, কেননা ইহা বন্ধনের কারণ । আবার ইহারা কর্ম ত্যাগ করিয়া মনে করেন, আমি কর্ম করি না, আমি বন্ধনমুক্ত । কিন্তু “আমি কর্ম করি” ইহা যেমন অভিমান, “আমি কর্ম করি না” ইহাও সেইরূপ অভিমান, সুতরাং বন্ধনের কারণ । ইহারা বুঝেন না যে কর্ম করে প্রকৃত, ‘আমি’ নহে । বস্তুতঃ ‘আমি’ ত্যাগ না হইলে কেবল কর্মত্যাগে বন্ধন-মুক্ত হওয়া যায় না । সুতরাং এইরূপ অকর্ম বা কর্মত্যাগও বন্ধনহেতু বলিয়া প্রকৃতপক্ষে কর্মই ।

১৯) নিষ্কাম কর্ম দিব্য কর্ম, ভাগবৎ কর্ম ! ‘আমি করিতেছি’ এইরূপ কর্তৃত্বাভিমান যাঁহার নাই, তিনি কর্ম করিয়াও তাহার ফলভাগী হন না । অহং-বুদ্ধিত্যাগই প্রকৃত জ্ঞান । এই জ্ঞানরূপ অগ্নিদ্বারা তাঁহার কর্মের ফল দগ্ধ হইয়াছে, তাঁহার কর্মের ফলভাগিত্ব বিনষ্ট হইয়াছে । এইরূপ ব্যক্তিই কর্মে অকর্ম অর্থাৎ কর্মশূন্যতা দেখেন । 

২৩) যজ্ঞতত্ত্ব :
বৈদিক যজ্ঞাদি লইয়াই হিন্দুধর্মের আরম্ভ । যজ্ঞমাত্রেরই মূল তাৎপর্য হইতেছে ত্যাগ এবং ত্যাগের ফলস্বরূপ ভোগ - দিব্যভোগ ('অমৃতমশ্নুতে') । নৃযজ্ঞ, ভূতযজ্ঞ প্রভৃতি স্মার্ত-যজ্ঞগুলি সকলই ত্যাগমূলক । প্রাচীনকালে যজ্ঞই ঈশ্বর-আরাধনার প্রধান অঙ্গ ছিল । কালক্রমে এই সকল যজ্ঞবিধি অতি জটিল ও বিস্তৃত হইয়া পড়ে ।

বেদের ব্রাহ্মণভাগে বিবিধ যাগযজ্ঞাদির বিস্তৃত বিবরণ আছে । বৈদিক ক্রিয়াকর্ম ও বৈদিক মন্ত্রের দুইটি অঙ্গ ছিল - (i)বাহ্য, আনুষ্ঠানিক; (ii)আভ্যন্তরীণ, আধ্যাত্মিক । বাহ্য অনুষ্ঠানটি প্রকৃতপক্ষে কোনো আধ্যাত্মিক গূঢ়-তত্ত্বেরই রূপক বা প্রতীকরূপে ব্যবহৃত হইত । যেমন সোমরস = অমৃত/অমরত্ব/ভূমানন্দের প্রতীক; ধান = ধনের প্রতীক; দূর্বা = দীর্ঘায়ুর প্রতীক । দূর্বার মৃত্যু নাই, রৌদ্রে পুড়িয়া, বর্ষায় পচিয়া গেলেও আবার গজাইয়া উঠে । উহার আর এক নাম 'অমর' । সুতরাং ধান-দূর্বা মস্তকে দেওয়ার অর্থ - ধনেশ্বর হও, চিরায়ু লাভ কর । বস্তুত, হিন্দুদিগের পূজার্চনা, আচার-অনুষ্ঠান সমস্তই রূপক বা প্রতীক-তান্ত্রিক (symbolic) ।

ক্রমে ব্রহ্মবিদ্যা বা জ্ঞানমার্গের প্রভাবে বৈদিক যাগযজ্ঞাদি গৌণ বলিয়া বিবেচিত হইতে লাগিল এবং জ্ঞানযজ্ঞ/ব্রহ্মযজ্ঞই শ্রেষ্ঠ যজ্ঞ বলে নির্ধারিত হইল । তাহার পর ভাগবত-ধর্ম ও ভক্রিমার্গের প্রচার হইলে পুরাণাদি-শাস্ত্রে জপযজ্ঞ/নামযজ্ঞেরই প্রাধান্য দেওয়া হইয়াছে । শ্রীগীতায়ও ভগবান দ্রব্যযজ্ঞ হইতে জ্ঞানযজ্ঞেরই শ্রেষ্ঠতা দিয়াছেন । বস্তুত ভারতীয় ধর্মচিন্তার ক্রমবিকাশ ও সম্প্রসারণের সঙ্গে-সঙ্গে যজ্ঞশব্দের অর্থ ও তাৎপর্য সম্প্রসারিত হইয়াছে । গীতায় এই সম্প্রসারণের সকল স্তরই স্বীকার করা হইয়াছে এবং যজ্ঞের যে মূলতত্ত্ব ত্যাগ, ঈশ্বরার্পণ, নিষ্কামতা তাহা যুক্ত করিয়া সবগুলিই মোক্ষপ্রদ করিয়া দেওয়া হইয়াছে ।

২৪) যিনি কর্মে ও কর্মের অঙ্গসকলে ব্রহ্মই দেখেন, তিনি ব্রহ্মত্বই প্রাপ্ত হন - ‘ব্রহ্মবিদ ব্রহ্মৈব ভবতি’ । 
জ্ঞানীর কর্ম ব্রহ্মকর্ম :
যিনি যজ্ঞ করিতে বসিয়া স্রুবাদি (হবিঃ-অর্পণ করিবার জন্য হাতা) কিছু দেখিতে পান না, সর্বত্রই ব্রহ্ম দর্শন করেন, ব্রহ্ম ব্যতীত আর-কিছু ভাবনা করিতে পারেন না, ব্রহ্মে একাগ্রচিত্ত সেই যোগী পুরুষ ব্রহ্মই প্রাপ্ত হন । এই স্থলে 'যজ্ঞ'-শব্দ রূপার্থক; বস্তুত জ্ঞানীর কর্মকেই এখানে যজ্ঞরূপে কল্পনা করা হইয়াছে । ইহাই কর্মযোগের শেষ কথা, এই অবস্থায় কর্ম জ্ঞানে পরিসমাপ্ত হয় । এই জন্যই বলা হইয়াছে, 'সাংখ্যগণ যে স্থান লাভ করেন, কর্মযোগীও তাহাই প্রাপ্ত হন' [৫|৫] । যাঁহারা 'সাংখ্যযোগ ও কর্মযোগকে পৃথক বলেন তাঁহারা অজ্ঞ' [৫|৪] । 'সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম' (এ-সমস্তই ব্রহ্ম), 'অহং ব্রহ্মাস্মি' (আমি ব্রহ্ম), ইত্যাদি শ্রুতিবাক্য এই জ্ঞানই প্রচার করিয়াছেন । জীবের অহংবুদ্ধি যখন সম্পূর্ণ বিদূরিত হয়, তখনই এই পূর্ণ একত্বের জ্ঞান আবির্ভূত হয় । তখন জ্ঞাতা-জ্ঞেয়, উপাস্য-উপাসক, কর্তা-কর্ম-করণ এইসকল ভেদবুদ্ধি থাকে না; সর্বত্রই এক তত্ত্ব, এক শক্তিই আবির্ভূত হয় । এইরূপ জ্ঞানে যিনি কর্ম করিতে পারেন, জীবনযাপন করিতে পারেন, তাঁহার কর্ম-বন্ধন কি ? তিনি তো মুক্ত পুরুষ ।

কর্ম, ভক্তি, জ্ঞান - এই তিন মার্গেরই শেষ ফল অদ্বয় তত্ত্বোপলব্ধি, পার্থক্য প্রারম্ভে ও সাধনাবস্থায় ।
  1. কর্মীর আরম্ভ লোকরক্ষার্থ বা ঈশ্বরপ্রীত্যর্থ নিষ্কাম কর্মে;
  2. ভক্তের আরম্ভ নিষ্কাম উপাসনায়;
  3. জ্ঞানমার্গী সাধকগণ প্রারম্ভ হইতেই অদ্বৈতভাবে চিন্তা করেন ।
বিশিষ্ট চিন্তা :
প্রকৃত পক্ষে জ্ঞানমার্গী সাধকগণদের কোনো উপাসনা নাই, কেননা সকলই যখন ব্রহ্ম, তখন কে কাহার উপাসনা করিবে ? কেবল ব্রহ্মচিন্তাই তাঁহাদের উপাসনা, তাই এই উপাসনার নাম 'বিশিষ্ট চিন্তা' । ইহা ত্রিবিধ -
  1. অঙ্গাববিদ্ধ উপাসনা = যজ্ঞের অঙ্গবিশেষকে ব্রহ্ম ভাবনা করা ।
  2. প্রতীক উপাসনা = যাহা ব্রহ্ম নয়, তাহাকে ব্রহ্ম-ভাবনা, যেমন মনকে ব্রহ্ম ভাবিয়া উপাসনা করা ।
  3. অহংগ্রহ = আত্মা ব্রহ্ম হইতে অভিন্ন, আমিই ব্রহ্ম ('অহং ব্রহ্মাস্মি') - এইরূপ ভাব-সাধনা ।
২৫-২৭) 'যজ্ঞ' শব্দ রূপকার্থে ব্যবহৃত হইয়াছে । যজ্ঞের লাক্ষণিক অর্থ গ্রহণ করিয়া বিভিন্ন সাধন-প্রণালী বর্ণিত হইয়াছে :-
  1. দৈবযজ্ঞ : ইন্দ্র-বরুণাদি দেবতার উদ্দেশে
  2. ব্রহ্মার্পণ যজ্ঞ বা জ্ঞানযজ্ঞ : ব্রহ্মাগ্নিতে জীবাত্মার আহুতি
  3. সংযমযজ্ঞ : ব্রহ্মচর্য অর্থাৎ ইন্দ্রিয়গুলিকে রূপরসাদি-বিষয় হইতে প্রত্যাহার
  4. ইন্দ্রিয়যজ্ঞ : ইন্দ্রিয়রূপ অগ্নিতে শব্দাদি-বিষয়সমূহের আহূতি (নির্লিপ্ত সংসারী)
  5. আত্মসংযম বা সমাধি-যজ্ঞ : আত্মাতে চিত্তকে একাগ্র করা (ধ্যানযোগিগণ)
প্রাণকর্মাণি - প্রাণ, অপান, ব্যান, উদান, সমান - মনুষ্য শরীরে এই পঞ্চপ্রাণ আছে :-
  1. প্রাণবায়ুর কর্ম : বহির্নয়ন
  2. অপান বায়ু্র কর্ম : অধোনয়ন
  3. ব্যান বায়ু্র কর্ম : আকুঞ্চন ও প্রসারণ
  4. উদান বায়ু্র কর্ম : ঊর্দ্ধনয়ন
  5. সমান বায়ুর কর্ম : ভুক্তপদার্থের পরিপাক-করণ
২৮) এই শ্লোকে পাঁচ প্রকার যজ্ঞের কথা বলা হইল :-
  1. দ্রব্যযজ্ঞ : দ্রব্যত্যাগরূপ যজ্ঞ । পূর্বের দৈবযজ্ঞ ও ব্রহ্মার্পণ যজ্ঞও দ্রব্যযজ্ঞ । উহা শ্রৌত কর্ম, আর বাপী-কূপাদি খনন, দেবমন্দির প্রতিষ্ঠা, অন্নসত্র দান ইত্যাদি স্মার্ত-কর্ম । এ-সকল এবং পুষ্পপত্র-নৈবেদ্যাদি দ্বারা পূজার্চনা সমস্তই দ্রব্যযজ্ঞ ।
  2. তপোযজ্ঞ : কৃচ্ছ্র-চান্দ্রায়ণাদি উপবাস ব্রত
  3. যোগযজ্ঞঅষ্টাঙ্গ যোগ বা রাজযোগ - যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধারণা, ধ্যান ও সমাধি ।
  4. স্বাধ্যায়-যজ্ঞব্রহ্মচর্য অবলম্বন করিয়া শ্রদ্ধাপূর্বক যথাবিধি বেদাভ্যাস
  5. বেদজ্ঞান-যজ্ঞ : যুক্তিদ্বারা বেদার্থ নিশ্চয় করা
২৯) প্রাণবায়ু = হৃদয় হইতে যে বায়ু বাহিরে আসে; অপান বায়ু = বাহির হইতে যে বায়ু হৃদয়ে প্রবেশ করে ।
প্রাণায়াম : প্রাণ = প্রাণবায়ু, আয়াম = নিরোধ; অর্থাৎ প্রাণবায়ুর নিরোধ । ইহা তিন প্রকার - (i)পূরক, (ii)রেচক, (iii)কুম্ভক ।

পূরক প্রাণায়াম : প্রশ্বাস দ্বারা অপান বায়ুকে শরীর-ভিতরে প্রবেশ করাইলে প্রাণবায়ুর গতি রোধ হয়, ইহাই অপানে প্রাণের আহুতি; ইহাতে অন্তর বায়ুতে পূর্ণ হয় ।

রেচক প্রাণায়াম : নিঃশ্বাস দ্বারা প্রাণবায়ুকে শরীর থেকে নিঃসারণ করিলে অপান বায়ুর অন্তঃপ্রবেশরূপ গতিরোধ হয়, অর্থাৎ বাহিরের বায়ু ভিতরে প্রবেশ করিতে পারে না, ইহাই প্রাণে অপানের আহুতি; ইহাতে অন্তর বায়ুশূন্য হয় ।

কুম্ভক প্রাণায়াম : প্রাণ ও অপানের গতি রোধ করিয়া অর্থাৎ রেচন-পূরণ পরিত্যাগ-পূর্বক বায়ুকে শরীরের মধ্যে নিরুদ্ধ করিয়া অবস্থিতি করেন । এইরূপ কুম্ভকে শরীর স্থির হইলে ইন্দ্রিয়সমূহ প্রাণবায়ুতে লয় হইয়া যায়, ইহাই প্রাণে ইন্দ্রিয়সমূহের আহুতি ।

৩০) একথার তাৎপর্য এই যে, যজ্ঞই সংসারের নিয়ম । প্রত্যেকের কর্তব্য সম্পাদন দ্বারা, পরস্পরের ত্যাগ স্বীকার দ্বারা, আদান-প্রদান দ্বারাই জগৎ চলিতেছে এবং উহাতেই প্রত্যেকের সুখ-স্বাতন্ত্র্য অব্যাহত আছে । যে এই বিশ্ব-যজ্ঞ ব্যাপারে যোগদান করে না, যজ্ঞস্বরূপে স্বীয় কর্তব্য সম্পাদন করে না, তাহার ইহকাল ও পরকাল উভয়ই বিনষ্ট হয়, তাহার জীবন ব্যর্থ হয় । 

৩১) যজ্ঞাবশিষ্ট দ্রব্যকে অমৃত বলে । এ-স্থলে ইহা রূপকার্থক । যজ্ঞস্বরূপ কৃত নিষ্কাম কর্মদ্বারাই মোক্ষ লাভ হয় ।

৩৪) পরিপ্রশ্নেন - আমি কে ? আমার সংসার-বন্ধন কেন ? কিরূপে বন্ধনমুক্ত হইব ? ইত্যাদি প্রশ্ন দ্বারা ।

৩৭) 'ইহা দ্বারা মোটেই বুঝায় না যে, যখন জ্ঞান সম্পূর্ণ হয় তখন কর্ম বন্ধ হইয়া যায়' - [শ্রী অরবিন্দ]

পারমার্থিক জ্ঞান কি ? যাহা দ্বারা সর্বভূত এবং স্বীয় আত্মা অভিন্ন বোধ হয় এবং তারপর বোধ হয় সেই আত্মা শ্রীভগবানেরই সত্ত্বা, - আমি, সর্বভূত, যাহা কিছু তাঁহার সত্তায়ই সত্তাবান, তাঁহারই আত্ম-অভিব্যক্তি, তিনিই সকলের মূল [গী|৪|৩৫] । শ্রদ্ধা দ্বারাই অতীন্দ্রিয় এই পারমার্থিক জ্ঞানলাভ হয়, ভক্তি-বিশ্বাসই জ্ঞানের ভিত্তি ।

প্রাকৃত/লৌকিক জ্ঞান কি ? চক্ষু-কর্ণাদি ইন্দ্রিয় দ্বারা, বুদ্ধিবিচার দ্বারা নানা বিষয়ে আমরা যে জ্ঞানলাভ করি । ইহাতে শ্রদ্ধার প্রয়োজন হয় না । এই সকল নিম্নস্তরের সত্যের সহিত মিথ্যা মিশ্রিত থাকে, সংশয়বুদ্ধিতে পরীক্ষা করিয়া (scientific method) মিথ্যা হইতে সত্যকে পৃথক করিয়া লইতে হয় ।

৪০) যে অজ্ঞ, অর্থাৎ যাহার শাস্ত্রাদির জ্ঞান নাই, এবং যে সদুপদেশ লাভ করে নাই এবং যে শ্রদ্ধাহীন অর্থাৎ সদুপদেশ পাইয়াও যে তাহা বিশ্বাস করে না এবং তদনুসারে কার্য্য করে না, সুতরাং যে সংশয়াত্মা - অর্থাৎ যাহার সকল বিষয়েই সংশয় - এইটি কি ঠিক, না ঐটি ঠিক, - এইরূপ চিন্তায় যে সন্দেহাকুল তাহার অত্মোন্নতির কোন উপায় নাই । 

৪১) অর্থাৎ - জ্ঞানী কর্ম করিয়াও কর্মে আবদ্ধ হন না, সুতরাং জ্ঞানীরও কর্ম আছে, একথা স্পষ্টই বলা হইল, তবে সে কর্ম অকর্মস্বরূপ ।

রহস্য : কর্ম ও জ্ঞানে সংযোগ কিরূপে সম্ভব ? অদ্বৈত-ব্রহ্মজ্ঞানে কর্মের স্থান কোথায় ?
গতি ও স্থিতি, আলোক ও অন্ধকার যেমন একত্র থাকিতে পারে না, তদ্রূপ কর্ম ও জ্ঞানের সমুচ্চয় অসম্ভব বলিয়াই বোধ হয় । সন্ন্যাসবাদিগণ এইরূপ যুক্তিবলেই জ্ঞান-কর্মের সমুচ্চয় অস্বীকার করেন । নির্গুণ, নিষ্ক্রিয়, নির্বিশেষ ব্রহ্মও আছেন; আবার সগুণ সবিশেষ, ক্রিয়াশীল ব্রহ্মও আছেন - এই দুই বিভাব যাঁহার তিনিই পুরুষোত্তম [১৫|১৮] । 'আমিত্ব' বর্জন করিয়াও 'আমি' রাখা, জ্ঞানলাভ করিয়াও কর্ম করা - এটা অসম্ভব নহে । বস্তুত যোগিগণ সর্বদাই আবশ্যক কর্ম করেন যেমন রাজর্ষি জনকাদি, দেবর্ষি নারদাদি, ব্রহ্মর্ষি বশিষ্ঠাদি, মহর্ষি বিশ্বমিত্রাদি, পরমহংস রামকৃষ্ণাদি । সর্বোপরি শ্রীভগবান স্বয়ং নিজ কর্মের আদর্শ দেখাইয়া, জ্ঞানিগণকে বিশ্বকর্মে আহ্বান করিয়া বলিতেছেন - 'লোকরক্ষার্থ জ্ঞানিগণও অনাসক্তচিত্তে কর্ম করিবে' । ইহার উপর আর টীকা-টীপ্পনী চলে না, দার্শনিক মতবাদ যাহাই হউক ।

৪২) তুমি যুদ্ধে অনিচ্ছুক, কারণ তোমার হৃদয়ে নানারূপ সংশয় উপস্থিত হইয়াছে । গুরুজনাদি বধ করিয়া কি পাপভাগী হইব ? আত্মীয়-স্বজনাদির বিনাশে শোক-সন্তপ্ত হইয়া রাজ্যলাভেই বা কি সুখ হইবে ? এইরূপ শোক, মোহ ও সংশয়ে অভিভূত হইয়া তুমি স্বীয় কর্তব্য বিস্মৃত হইয়াছ । তোমার এই সংশয় অজ্ঞান-সম্ভূত । যাঁহার দেহাত্মবোধ বিদূরিত হইয়াছে, সর্বভূতে একাত্মবোধ জন্মিয়াছে - তাঁহার চিত্তে এ সকল সংশয় উদিত হয় না; তিনি শোক-দুঃখে অভিভূত হন না [ঈশোপনিষৎ|৭]; ইহাই প্রকৃত জ্ঞান, তাহা পূর্বে বলিয়াছি । শ্রদ্ধা, আত্মসংযম একনিষ্ঠা - সেই জ্ঞান লাভের যে উপায় তাহাও বলিয়াছি । আমার বাক্যে তোমার শ্রদ্ধা আছে, তোমার আত্মসংযম ও একনিষ্ঠা আছে, সুতরাং তোমাকে আমি জ্ঞানোপদেশ দিতেছি । তুমি আত্মজ্ঞান লাভপূর্বক নিঃসন্দেহ হইয়া নিষ্কাম কর্মযোগ অবলম্বন কর, স্বীয় কর্তব্য পালন কর, যুদ্ধ কর ।
___________________________
Online Source: 
http://geetabangla.blogspot.com/2011/09/blog-post.html

*Hard Copy Source:

"Sri Gita" or "Srimadbhagabadgeeta" by Gitashastri Jagadish Chandra Ghosh & Anil Chandra Ghosh. 26th Edition - June 1997 (1st Edition, 1925 from Dhaka now in Bangladesh). Published by Subhadra Dey (Ghosh), Presidency Library, 15 Bankim Chatterjee Street, Kolkata-700073. Printed by Web Impressions Pvt.Ltd., 34/2 Beadon Street, Kolkata-700006.



Disclaimer: This site is not officially related to Presidency LibraryKolkata. This is a personal, non-commercial, research-oriented effort of a novice religious wanderer.
এটি আধ্যাত্মিক পথের এক অর্বাচীন পথিকের ব্যক্তিগত, অবাণিজ্যিক, গবেষণা-ধর্মী প্রয়াস মাত্র ।

[Digitised by scanning (if required) and then by typing mostly in Notepad using Unicode Bengali "Siyam Rupali" font and Avro Phonetic Keyboard for transliteration. Uploaded by rk]


<Previous--Contents--Next>

No comments:

Post a Comment