Thursday, March 12, 2015

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা : ষষ্ঠ অধ্যায় - ধ্যানযোগ বা অভ্যাস-যোগ (6-Jagadishchandra)


|||||৬||||১০|১১|১২|১৩|১৪|১৫|১৬|১৭|১৮
(গীতাশাস্ত্রী জগদীশচন্দ্র ঘোষ)*

শ্রীভগবান্‌ বলিলেন -
কর্মফলে আকাঙ্ক্ষা না করিয়া যিনি কর্তব্য-কর্ম করেন, তিনিই সন্ন্যাসী, তিনিই যোগী । যিনি যজ্ঞাদি শ্রৌতকর্ম ত্যাগ করিয়াছেন অথবা সর্ববিধ শারীরকর্ম ত্যাগ করিয়াছেন, তিনি নহেন । ১

হে পাণ্ডব, যাহাকে সন্ন্যাস বলে, তাহাই যোগ বলিয়া জানিও, কেননা, সঙ্কল্পত্যাগ না করিলে কেহই যোগী হইতে পারে না । ২

যোগে আরোহণেচ্ছু মুনির পক্ষে নিষ্কামকর্মই যোগ-সিদ্ধির কারণ, যোগারূঢ় হইলে চিত্তের সমতাই ব্রাহ্মীস্থিতিতে নিশ্চল থাকিবার কারণ । ৩

যখন সাধক সর্বসঙ্কল্প ত্যাগ করায় রূপরসাদি ইন্দ্রিয় ভোগ্যবিষয়ে এবং কর্মে আসক্ত হন না, তখন তিনি যোগারূঢ় বলিয়া উক্ত হন । ৪

আত্মার দ্বারাই আত্মাকে বিষয়কূপ হইতে উদ্ধার করিবে, আত্মাকে অবসর করিবে না (নিম্নদিকে যাইতে দিবে না) । কেননা, আত্মাই আত্মার বন্ধু এবং আত্মাই আত্মার শত্রু । ৫

যে আত্মাদ্বারা আত্মা বশীভূত হইয়াছে, সেই আত্মাই আত্মার বন্ধু । অজিতাত্মার আত্মা শত্রুবৎ অপকারে প্রবৃত্ত হয় । ৬

জিতেন্দ্রিয়, প্রশান্ত অর্থাৎ রাগদ্বেষাদিশূন্য ব্যক্তির পরমাত্মা শীত-গ্রীষ্ম, সুখ-দুঃখ, অথবা মান-অপমান প্রাপ্ত হইলেও সমাহিত থাকে (অর্থাৎ অবিচলিতভাবে আপন সম-শান্ত-স্বরূপে অবস্থান করে) । ৭

যাঁহার চিত্ত শাস্ত্রাদির উপদেশজাত জ্ঞান ও উপদিষ্ট তত্ত্বের প্রত্যক্ষ অনুভূতির দ্বারা পরিতৃপ্ত, যিনি বিষয়-সন্নিধানেও নির্বিকার ও জিতেন্দ্রিয়, মৃৎপিণ্ড পাষাণ ও সুবর্ণখণ্ডে যাঁহারা সমদৃষ্ট, ঈদৃশ যোগীকে যুক্ত (যোগসিদ্ধ) বলে । ৮

সুহৃৎ, মিত্র, শত্রু, উদাসীন, মধ্যস্থ, দ্বেষ্য, বন্ধু, সাধু ও অসাধু - এই সকলের প্রতি যাঁহার সমান বুদ্ধি, তিনিই প্রশংসনীয় অর্থাৎ তিনি সর্ববিষয়ে সকলের প্রতি রাগদ্বেষশূন্য, তিনিই শ্রেষ্ঠ । ৯


যোগী একাকী নির্জন স্থানে থাকিয়া সংযতচিত্ত, সংযতদেহ, আকাঙ্ক্ষাশূন্য ও পরিগ্রহশূন্য হইয়া চিত্তকে সতত সমাধি অভ্যাস করাইবেন । ১০

পবিত্র স্থানে নিজ আসন স্থাপন করিবে; আসন যেন অতি উচ্চ অথবা অতি নিম্ন না হয় । কুশের উপরে ব্যাঘ্রাদির চর্ম এবং তাহার উপর বস্ত্র পাতিয়া আসন প্রস্তুত করিতে হয়; সেই আসনে উপবেশন করিয়া চিত্ত ও ইন্দ্রিয়ের ক্রিয়া সংযমপূর্বক মনকে একাগ্র করিয়া আত্মশুদ্ধির জন্য যোগ অভ্যাস করিবে । ১১,১২

শরীর (মেরুদণ্ড), মস্তক ও গ্রীবা সরলভাবে ও নিশ্চলভাবে রাখিয়া সুস্থির হইয়া আপনার নাসাগ্রবর্তী আকাশে দৃষ্টি রাখিবে, এদিক্‌ ওদিক্‌ তাকাইবে না; (এইরূপে উপবেশন করিয়া) প্রশান্ত-চিত্ত, ভয়বর্জিত, ব্রহ্মচর্যশীল হইয়া মনঃসংযমপূর্বক মৎপরায়ণ মদ্গতচিত্ত হইয়া সমাধিস্থ হইবে । ১৩,১৪

পূর্বোক্ত প্রকারে নিরন্তর মনঃসমাধান করিতে করিতে মন একাগ্র হইয়া নিশ্চল হয় । এইরূপ স্থিরচিত্ত যোগী নির্বাণরূপ পরম শান্তি লাভ করেন । এই শান্তি আমাতেই স্থিতির ফল । ১৫

হে অর্জুন, কিন্তু যিনি অত্যধিক আহার করেন অথবা যিনি একান্ত অনাহারী, তাঁহার যোগ হয় না; অতিশয় নিদ্রালু বা অতিজাগরণশীলের যোগসমাধি হয় না । ১৬

যিনি পরিমিতরূপ আহার-বিহার করেন, পরিমিতরূপ কর্মচেষ্টা করেন, পরিমিতরূপে নিদ্রিত ও জাগ্রত থাকেন, তাঁহার যোগ দুঃখনিবর্তক হয় । ১৭

যখন চিত্ত বিশেষরূপে নিরুদ্ধ হইয়া আত্মাতেই অবস্থিতি করে, তখন যোগী সর্বকামনাশূন্য হয় । ঈদৃশ যোগী পুরুষই যোগসিদ্ধ বলিয়া কথিত হন । ১৮

নির্বাত-প্রদেশে স্থিত দীপশিখা যেমন চঞ্চল হয় না, আত্মবিষয়ক যোগাভ্যাসকারী সংযতচিত্ত যোগীর অচঞ্চল চিত্তের উহাই দৃষ্টান্ত । ১৯

যে অবস্থায় যোগাভ্যাসদ্বারা নিরুদ্ধ চিত্ত উপরত (সর্ববৃত্তিশূন্য, নিষ্ক্রিয়) হয় এবং যে অবস্থায় আত্মাদ্বারা আত্মাতেই আত্মাকে দেখিয়া পরিতোষ লাভ হয় (তাহাই যোগ শব্দ বাচ্য জানিও) । ২০

যে অবস্থায় ইন্দ্রিয়ের অগোচর, কেবল শুদ্ধ বুদ্ধিগ্রাহ্য যে নিরতিশয় সুখ (আত্মানন্দ) যোগী তাহাই অনুভব করেন এবং যে অবস্থায় স্থিতি লাভ করিয়া আত্মস্বরূপ হইতে বিচলিত হন না, তাহাই যোগশব্দবাচ্য জানিবে । ২১

যে অবস্থা লাভ করিলে যোগী অন্য কোন লাভ ইহার অপেক্ষা অধিক সুখ-কর বলিয়া বোধ করেন না এবং যে অবস্থায় স্থিতি লাভ করিলে মহাদুঃখেও বিচলিত হন না (তাহাই যোগশব্দবাচ্য জানিবে) । ২২

এইরূপ অবস্থায় (চিত্তবৃত্তিনিরোধে) দুঃখসংযোগের বিয়োগ হয়, এই দুঃখ-বিয়োগই যোগশব্দবাচ্য । এই যোগ নির্বেদশূন্য চিত্তে অধ্যবসায় সহকারে অভ্যাস করা কর্তব্য । ২৩

সংকল্পজাত কামনাসমূহকে বিশেষরূপে ত্যাগ করিয়া, মনের দ্বারা (চক্ষুরাদি) ইন্দ্রিয়সমূহকে বিষয় ব্যাপার হইতে নিবৃত্ত করিয়া, ধৈর্য্যযুক্ত বুদ্ধিদ্বারা মন ধীরে ধীরে নিরুদ্ধ করিবে এবং এইরূপ নিরুদ্ধ মনকে আত্মাতে নিহিত করিয়া (আত্মাকারবিশিষ্ট করিয়া) কিছুই ভাবনা করিবে না । ২৪,২৫

মন স্বভাবতঃ চঞ্চল, অতএব অস্থির হইয়া উহা যে যে বিষয়ে ধাবিত হয়, সেই সেই বিষয় হইতে উহাকে প্রত্যাহার করিয়া আত্মাতেই স্থির করিয়া রাখিবে । ২৬

এইরূপ যোগসিদ্ধ পুরুষ চিত্তবিক্ষেপক রজোগুণবিহীন এবং চিত্তলয়ের কারণ তমোগুণ বর্জিত হইয়া ব্রহ্মভাব লাভ করেন, ঈদৃশ প্রশান্তচিত্ত যোগীকে নির্মল সমাধি-সুখ আশ্রয় করে । ২৭

এই রূপে সদা মনকে সমাহিত করিয়া নিষ্পাপ হওয়ায় যোগী ব্রহ্মানুভবরূপ নিরতিশয় সুখ লাভ করেন । ২৮

এইরূপ যোগযুক্ত পুরুষ সর্বত্র সমদর্শী হইয়া আত্মাকে সর্বভূতে এবং সর্বভূতকে আত্মাতে দর্শন করিয়া থাকেন । ২৯

যিনি আমাকে সর্বভূতে অবস্থিত দেখেন এবং আমাতে সর্বভূত অবস্থিত দেখেন, আমি তাহার অদৃশ্য হই না, তিনিও আমার অদৃশ্য হন না । ৩০

যে যোগী সমত্ববুদ্ধি অবলম্বনপূর্বক সর্বভূতে ভেদজ্ঞান পরিত্যাগ করিয়া সর্বভূতস্থিত আমাকে ভজনা করেন, তিনি যে অবস্থায়ই থাকুন না কেন, আমাতেই অবস্থান করেন । ৩১

হে অর্জুন, সুখই হউক, আর দুঃখই হউক, যে ব্যক্তি আত্মসাদৃশ্যে সর্বত্র সমদর্শী সেই যোগী সর্বশ্রেষ্ঠ ইহাই আমার অভিমত । ৩২

অর্জুন বলিলেন -

হে মধুসূদন, তুমি এই যে সমত্বরূপ যোগতত্ত্ব ব্যাখ্যা করিলে, মন যেরূপ চঞ্চল তাহাতে এই সমত্বভাব স্থায়ী হয় বলিয়া আমার বোধ হয় না । ৩৩

হে কৃষ্ণ, মন স্বভাবতঃই চঞ্চল, ইন্দ্রিয়াদির বিক্ষেপজনক মহাশক্তিশালী (বিচারবুদ্ধি বা কোনরূপ মন্ত্রৌষধিরও অজেয়), দৃঢ় (লৌহবৎ কঠিন, অনমনীয়); এই হেতু আমি মনে করি বায়ুকে আবদ্ধ করিয়া রাখা যেরূপ দুঃসাধ্য, মনকে নিরোধ করাও সেইরূপ সুদুষ্কর । ৩৪

শ্রীভবগান্‌ বলিলেন -

হে মহাবাহো ! মন স্বভাবতঃ চঞ্চল, উহাকে নিরোধ করা দুষ্কর, তাহাতে সংশয় নাই । কিন্তু হে কৌন্তেয়, অভ্যাস ও বৈরাগ্যের দ্বারা উহাকে বশীভূত করা যায় । ৩৫

অভ্যাস ও বৈরাগ্য দ্বারা যাহার চিত্ত সংযত হয় নাই তাহার পক্ষে যোগ দুষ্প্রাপ্য, ইহা আমারও মত; কিন্তু বিহিত উপায় অবলম্বন করিয়া সতত যত্ন করিলে চিত্ত বশীভূত হয় এবং যোগলাভ হইতে পারে । ৩৬

অর্জুন কহিলেন -

হে কৃষ্ণ, যিনি প্রথমে শ্রদ্ধাসহকারে যোগাভ্যাসে প্রবৃত্ত হন, কিন্তু যত্নের শিথিলতাবশতঃ যোগ হইতে ভ্রষ্টচিত্ত হওয়ায় যোগসিদ্ধি লাভে অসমর্থ হন, তিনি কি প্রকার গতি প্রাপ্ত হন ? ৩৭

হে মহাবাহো, তিনি ব্রহ্মপ্রাপ্তির উপায়ভূত যোগমার্গে অকৃতকার্য হওয়াতে মোক্ষ হইতে বঞ্চিত হন, এবং কাম্য কর্মের ত্যাগহেতু স্বর্গাদি হইতেও বঞ্চিত হন, সুতরাং ভোগ মোক্ষরূপ পুরুষার্থদ্বয় ভ্রষ্ট হইয়া, ছিন্ন মেঘখণ্ডের ন্যায় (মেঘখণ্ড যেমন মূল মেঘরাশি হইতে ছিন্ন হইয়া অপর মেঘরাশি প্রাপ্ত না হইলে মধ্যস্থলে বিলীন হইয়া যায় তদ্রুপ) নষ্ট হন না কি ? ৩৮

হে কৃষ্ণ, তুমি আমার সংশয় নিঃশেষরূপে ছেদন করিয়া দাও, কেননা, তুমি ভিন্ন আমার এই সংশয়ের অপনেতা আর কেহ নাই । ৩৯

শ্রীভগবান্‌ বলিলেন -

হে পার্থ, যোগভ্রষ্ট ব্যক্তির ইহলোকে কি পরলোকে কুত্রাপি বিনাশ নাই । কারণ, হে বৎস, শুভকর্মকারী পুরুষ কখনও দুর্গতি প্রাপ্ত হন না । ৪০

যোগভ্রষ্ট পুরুষ পুণ্যকর্মকারীদিগের প্রাপ্য স্বর্গলোকাদি প্রাপ্ত হইয়া তথায় বহু বৎসর বাস করিয়া পরে সদাচার সম্পন্ন ধনীর গৃহে জন্মগ্রহণ করেন । ৪১

পক্ষান্তরে, যোগভ্রষ্ট পুরুষ জ্ঞানবান্‌ যোগীদিগের কুলে জন্মগ্রহণ করেন । জগতে ঈদৃশ জন্ম অতি দুর্লভ (যেমন ব্যাসতনয় শুকদেবের) । ৪২

হে কুরুনন্দন, যোগভ্রষ্ট পুরুষ সেই জন্মে পূর্বজন্মের অভ্যস্ত মোক্ষবিষয়ক বুদ্ধি লাভ করেন এবং মুক্তিলাভের জন্য পুনর্বার যত্ন করেন । ৪৩

তিনি অবশ হইয়াই পূর্বজন্মের যোগাভ্যাসজনিত শুভ সংস্কারবশতঃ যোগমার্গে আকৃষ্ট হন । যিনি কেবল যোগের স্বরূপ-জিজ্ঞাসু, তিনিই বেদোক্ত কাম্যকর্মাদির ফল অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ফল লাভ করেন (যিনি যোগের স্বরূপ জানিয়া যোগাভ্যাস-পরায়ণ তাঁহার আর কথা কি ?) । ৪৪

সেই যোগী পূর্বাপেক্ষাও অধিকতর যত্ন করেন, ক্রমে যোগাভ্যাসদ্বারা নিষ্পাপ হইয়া বহু জন্মের চেষ্টায় সিদ্ধিলাভ করিয়া পরম গতি লাভ করেন । ৪৫

যোগী তপস্বিগণ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ, জ্ঞানিগণ অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ, কর্মিগণ অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ, ইহাই আমার মত; অতএব হে অর্জুন, তুমি যোগী হয় । ৪৬

যিনি শ্রদ্ধাবান্‌ হইয়া মদ্গতচিত্তে আমার ভজনা করেন, সকল যোগীর মধ্যে তিনিই আমার সহিত যোগে সর্বাপেক্ষা অধিক যুক্ত, ইহাই আমার অভিমত অর্থাৎ ভগবানে ঐকান্তিক ভক্তিপরায়ণ যোগীই শ্রেষ্ঠ সাধক । ৪৭
___________________________

১) নিরগ্নি - অগ্নিসাধ্য শ্রৌতকর্মত্যাগী । ধর্মশাস্ত্রে উক্ত আছে যে, সন্ন্যাসাশ্রমীর অগ্নি রক্ষা করিবার প্রয়োজন নাই । তিনি ‘নিরগ্নি’ হইয়া, সর্ব কর্ম ত্যাগ করিয়া ভিক্ষা দ্বারা শরীর রক্ষা করিবেন । অক্রিয় - শারীরকর্মত্যাগী অর্দ্ধমুদিতনেত্র যোগী (বলদেব) ।

২) সন্ন্যাস - কর্মযোগ - ধ্যানযোগ : গীতার মতে সন্ন্যাসের স্থূলকথা ফলসন্ন্যাস, কামনা-ত্যাগ - কেবল কর্মত্যাগ নহে । ধ্যানযোগ বা চিত্তনিরোধ-যোগেরও স্থূলকথা সঙ্কল্পত্যাগ, কামনাত্যাগ; কারণ, সঙ্কল্পই চিত্তবিক্ষেপের হেতু । আবার কর্মযোগেরও মূলকথা - কামনা ত্যাগ । সুতরাং সন্ন্যাস, ধ্যানযোগ, কর্মযোগ - এ তিনই এক, তিনেরই মূলকথা সঙ্কল্পত্যাগ, ইহারই সাধারণ নাম গীতোক্ত যোগ । সুতরাং এখানে যোগ বলিতে ধ্যানযোগ ও কর্মযোগ উভয়ই বুঝায়, বস্তুতঃ গীতার মতে ধ্যানযোগ কর্মযোগের অঙ্গীভূত ।

৩) শম = শান্তি (তিলক, শ্রীঅরবিন্দ); নিষ্কামকর্মীর আত্মসংযম-জনিত চিত্তপ্রসাদ - Calm of Self-mastery and Self-possession gained by works. - Sri Aurobindo.

৬) এখানে রূপকভাবে বলা হইয়াছে যে, আত্মার দ্বারা আত্মাকে উদ্ধার করিবে । কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আত্মা একটিই এবং সে নিজেই । সুতরাং এ কথার অর্থ এই যে, নিজেই নিজেকে প্রকৃতির বন্ধন হইতে উদ্ধার করিবে, নিজেকে অধোগামী করিবে না, জীব নিজেই নিজের শত্রু, নিজেই নিজের মিত্র ।

যোগের উদ্দেশ্য আত্মার উদ্ধার । যে পর্যন্ত মন কূটস্থ-চৈতন্যে বিলীন না হয়, সে পর্যন্ত তাহাকে সংযত করিয়া রাখিবে, ইহাই ধ্যানযোগ - ইহাই সারকথা ।

আত্মশক্তি ও কৃপাবাদ : আমাদের শাস্ত্রে দুই-রকম ধর্মোপদেশ পাওয়া যায় - (i)মায়ামুক্ত না হইলে তাঁহাকে পাওয়া যাইবে না, আবার (ii)তাঁহাকে না পাইলে মায়াও ঘুচিবে না । উভয় কথাই সত্য, উভয়ই গ্রাহ্য কারণ ইহার আগে-পরে নাই । মায়া-মুক্তি ও ঈশ্বর-প্রাপ্তি একই অবস্থা এবং ঠিক একই সময়েই হয় । এই দুই-রকম উপদেশ প্রকৃতপক্ষে দুইটি বিভিন্ন মার্গ বা সাধন-পথের সঙ্কেত ।

  • জ্ঞানমার্গের (আত্মস্বাতন্ত্র্য ও আত্মশক্তি) উপদেশ : মায়া বা অজ্ঞান দূর না হইলে সেই পরতত্ত্ব উপলব্ধ হয় না । আত্মার দ্বারা আত্মার উদ্ধার । সাধনদ্বারা প্রকৃতির রজস্তমোগুণকে দমন করিয়া শুদ্ধ সত্ত্বগুণের উদ্রেক করিয়া প্রকৃতির অতীত হওয়াই নিজেই নিজেকে উদ্ধার করিতে পারা ।
  • ভক্তিমার্গের (আত্মসমর্পণ ও কৃপাবাদ) উপদেশ : সর্বতোভাবে তাঁহার শরণ না লইলে, তাঁহার কৃপা না হইলে, মায়া দূর হইবে না । ঈশ্বরই জীবকে যন্ত্রারূঢ় পুত্তলিকার ন্যায় মায়াদ্বারা চালাইতেছেন, জীব সর্বতোভাবে তাঁহার শরণ লইলে, অনন্যভক্তিযোগে তাঁহার ভজনা করিলে ঈশ্বরই তাহাকে এমন বুদ্ধিযোগ দেন, যাহাদ্বারা সে মায়ামুক্ত হইয়া ভগবানকে পাইতে পারে ।

৯) সর্ববিষয়ে সমচিত্ততাই যোগের শ্রেষ্ঠ ফল । এই সমচিত্ততা লাভ করা অবশ্য সহজ নহে । চঞ্চল মনকে স্থির করিয়া আত্মসংস্থা করার এক বিশিষ্ট উপায় ধ্যানযোগ বা অভ্যাসযোগ ।

১৩,১৪) নাসিকাগ্রং সংপ্রেক্ষ্য - টীকাকারগণ বলেন, ঠিক নাসাগ্রই যে অবলোকন করিতে হইবে এরূপ অর্থ নহে, দৃষ্টি এদিক্‌ ওদিক্‌ না পড়ে এই জন্যই নাসাগ্রবর্তী আকাশে দৃষ্টি রাখিতে হইবে । কেহ কেহ বলেন, ইহার অর্থ ভ্রূমধ্যে দৃষ্টি রাখিয়া, কেননা নিম্নদিক হইতে ধরিলে নাসাগ্র বলিতে ভ্রূমধ্য বুঝায় । মৎপর, মচ্চিত্ত হইয়া - আমিই একমাত্র প্রিয়, বিষয়াদি নয় - এইরূপ ভাবনাদ্বারা আমাতেই চিত্ত নিবিষ্ট করিয়া ।

বিবাহিত জীবনে যোগাভ্যাস : কামোপভোগই বিবাহিত জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য হইলে তাহা তো পশুজীবন । কিন্তু মুনিঋষিদের মধ্যেও স্বনামখ্যাত অনেকে বিবাহিত ছিলেন এবং সন্তানের জনকও ছিলেন । শাস্ত্রে আছে, বেদ অধ্যাপনান্তে আচার্য শিষ্যকে এইরূপ উপদেশ দিতেছেন - সত্য বলিবে, ধর্মানুষ্ঠান করিবে, সন্তানধারা অবিচ্ছিন্ন রাখিবে [তৈত্তিরিয় উপনিষদ ১|১১|১] । বংশরক্ষার জন্যই বিবাহ করার এইরূপ উপদেশ সকল ধর্মশাস্ত্রেই আছে । ঐ-উদ্দেশ্য-সাধনের জন্য বিবাহিত জীবনের কতটুকু সময় আবশ্যক ? - অতি সামান্য । বাকী সমস্ত জীবন ব্যাপিয়া সংযমের উপদেশ । এ-অনুশাসন সন্ন্যাসধর্মের চেয়ে বড় কম কঠোর নয়, এবং বিষয়ের মধ্যে থাকিয়া এইরূপ সংযম-সাধনে অধিকতর দৃঢ়তার প্রয়োজন, সন্দেহ নাই । এই হেতুই গৃহস্তের পক্ষে অবিহিত কালে (অর্থাৎ বংশরক্ষার্থ ভিন্ন অন্য সময়ে) স্ত্রী-সম্ভোগে নিবৃত্ত থাকাই ব্রহ্মচর্য [মহাভারত অনুশাসন পর্ব |১৬২; মনু |৩|৪৫, ৫০] । এই হেতু হিন্দুশাস্ত্রে বিবাহের অপর নাম উপযম (সংযম) ।

১৫) মৎসংস্থাম্‌ - আমাতেই যাহার অবস্থিতি বা সমাপ্তি (নীলকণ্ঠ); মদ্‌রূপেণ অবস্থিতাম্‌ (শ্রীধর); that has its foundation in Me (Sri Aurobindo).

২২) আত্মানন্দ পরম সুখকর, এমন কোন সুখ নাই যাহা ইহা অপেক্ষা অধিক সুখকর বলিয়া বোধ হইতে পারে, এবং এমন কোন দুঃখ নাই যাহাতে আত্মজ্ঞানীকে বিচলিত করে পারে - কেননা, তিনি আত্মারাম, বাহ্য সুখদুঃখের অতীত ।

২৩) দুঃখসংয়োগবিয়োগম্‌ - the putting away of the contact with pain, the divorce of the mind's marriage with grief (Sri Aurobindo).
নির্বেদ : এত কাল যোগাভ্যাস করিলাম, সিদ্ধিলাভ হইল না, আত কত কাল কষ্ট করিব - এইরূপ হতাশভাব (মধুসূদন) ।
অনির্বণ্ণচেতসা : নির্বেদশূন্য, শৈথিল্যরহিত চিত্তে যোগাভ্যাস কর্তব্য । 

২৪-২৬) সঙ্কল্প ও কামনা :
গীতায় সঙ্কল্প ও কামনা, উভয়ই ত্যাগ করার কথা আছে । কার্যত ব্যাপার একই, কিন্তু স্বরূপত সঙ্কল্প ও কামনার মধ্যে সূক্ষ্ম পার্থক্য আছে ।
সঙ্কল্প = শোভনাধ্যাস, যাহা শোভন বা সুন্দর নয় তাহাকে সুন্দর বলিয়া কল্পনা করার নাম । ইহাই অজ্ঞান, ইহা হইতেই বিষয়ে অভিলাষ জন্মে; ইহাই কাম । সুতরাং কামনা সঙ্কল্পজাত ।
ধৃতিগৃহীতয়া বুদ্ধ্যা = ধৈর্যযুক্ত বুদ্ধিদ্বারা [শঙ্কর]
উপরমেৎ = উপরতি অভ্যাস করিবেন, মনের নিরোধ করিবেন - 'cease from mental action'.

সমাধি অভ্যাস :
  1. কামনা ত্যাগ - সর্বপ্রকার কামনা নিঃশেষে ত্যাগ করিতে হয় ।
  2. মনের দ্বারা ইন্দ্রিয়সংযম - মনের দ্বারা ইন্দ্রিয়সমূহকে বিষয় হইতে প্রত্যাহরণ করিতে হইবে । চক্ষু দর্শন করিতেছে, কিন্তু মন তাহাতে যোগ দিতেছে না, সুতরাং দেখিয়াও দেখা হইল না । চক্ষু নষ্ট হইলে বা মুদ্রিত করিয়া থাকিলেই ইন্দ্রিয়সংযম হয় না ।
  3. চিত্তবৃত্তি নিরোধ - সাত্ত্বিকী-বুদ্ধি ভাল-মন্দ নিশ্চয় করিয়া, নিত্যানিত্য বিচার করিয়া মনকে সৎপথে চালিত করে । সাত্ত্বিকী ধৃতিশক্তি মনকে বহির্মুখী হইতে না দিয়া ভিতরে ধারণ করিয়া রাখে । এই ধৃতিসংযুক্ত বুদ্ধিদ্বারা মনকেও অন্তর্মুখী করিয়া ক্রমে-ক্রমে চিত্তবৃত্তি নিরোধ করিতে হইবে । সহসা চিত্তবৃত্তি নিরোধের চেষ্টা করিলে মস্তিষ্কের স্বাস্থ্যহানির সম্ভাবনা ।
  4. আত্মাতে বিলীন - মন নির্মল হইয়া যখন আত্মাকার প্রাপ্ত হইবে, তখনই আত্মস্বরূপ প্রতিভাত হইবে । এই অবস্থায় কোন চিন্তাই থাকিবে না, আত্মচিন্তাও নয় । কারণ চিন্তা থাকিলে মনের অতীত হওয়া যায় না । এ-অবস্থায় ধ্যাতা, ধ্যান, ধ্যেয় - জ্ঞাতা, জ্ঞান, জ্ঞেয় - সবই এক হইয়া যায় । এক আত্মস্বরূপই থাকে, চিন্তা করিবে কে ? কার ? তাই ভগবান শঙ্করাচার্য বলিয়াছেন - 'চিন্তাশূন্যতাই শ্রেষ্ঠ ধ্যান' ।
ব্রহ্মভাব : যাহা মনের অগোচর (যেমন নির্গুণ ব্রহ্ম), তাঁহার বিষয়ে চিন্তা করা যায় না । আবার যাহা চিন্তা করা যায়, যেমন বিষয়াদি, তাহাও অতত্ত্ব, অবস্তু বলিয়া চিন্তনীয় নয়; সুতরাং মন যখন আত্মচিন্তা এবং বিষয়চিন্তা, ইহার কোনো পক্ষই অবলম্বন করে না, অর্থাৎ সম্পূর্ণ নিরবলম্ব হয়, তখন ব্রহ্মভাব প্রাপ্ত হয় । [ব্রহ্মবিন্দু উপনিষদ |২৬]

রাজযোগ : সমাধিযোগ/নিরোধযোগ/অষ্টাঙ্গ যোগ
যোগ - যে ক্রিয়াকৌশলে মনকে (চিত্তকে) আত্মসংস্থ করিয়া আত্মস্বরূপ বিকশিত করা যায় । চিত্ত অবস্থাভেদে পাঁচ রূপ ধারণ করে - (i)ক্ষিপ্ত - এই অবস্থায় মন কামনাকুলিত হইয়া নানা বিষয়ে ধাবিত হয়; (ii)মূঢ় - এই অবস্থায় মন তমোগুণাক্রান্ত হইয়া মোহে অভিভূত হইয়া থাকে; (iii)বিক্ষিপ্ত - এই অবস্থায় মনের চঞ্চলতা থাকিলেও উহা সময়-সময় অন্তর্মুখী হইতে চেষ্টা করে, ইহা সাধনার প্রথমাবস্থা; (iv)একাগ্র - এই অবস্থায় মন লক্ষ্য বিষয়ে সুস্থির হয়; (v)নিরুদ্ধ - এই অবস্থায় চিত্ত বৃত্তিশূন্য হইয়া থাকার মতো হয়, ইহাই চরম সমাধির অবস্থা ।

যেমন সূর্যকান্তমণিসংযোগে (আতস পাথর - magnifying glass) সূর্যরশ্মিসকল দাহ্যবস্তুতে কেন্দ্রীভূত হইলে উহাকে অগ্নিময় করিয়া তোলে, সেইরূপ ইতস্তত-বিক্ষিপ্ত মন যোগদ্বারা আত্মসংস্থ হইলে উহার স্বস্বরূপ প্রকাশিত করে । রাজযোগের অষ্ট অঙ্গ - (1)যম, (2)নিয়ম, (3)আসন, (4)প্রাণায়াম, (5)প্রত্যাহার, (6)ধারণা, (7)ধ্যান, (8)সমাধি ।

যম : অহিংসা, সত্য, অস্তেয়, ব্রহ্মচর্য, অপরিগ্রহ ।
অস্তেয় - পরদ্রব্য অপহরণ করিবে না, ওকথা মুখে আনিবে না, এরূপ চিন্তাও মনে স্থান দিবে না ।
অপরিগ্রহ - কোনো অবস্থায় কাহারো নিকট হইতে দান, উপহারাদি গ্রহণ না করা । দান ইত্যাদি গ্রহণে হৃদয় সঙ্কুচিত হয়, চিত্তের স্বাধীনতা বিনষ্ট হয়, মানুষ হীন হইয়া যায় । অপরিগ্রহের মূলে দুইটি গুণ - (i)স্বাবলম্বন (সাংসারিক উন্নতি), (ii)বৈরাগ্য (আধ্যাত্মিক উন্নতি) ।

নিয়ম : শৌচ (বাহ্য ও অন্তঃ), সন্তোষ, তপঃ, স্বাধ্যায়, ঈশ্বরপ্রণিধান ।
স্বাধ্যায় - মন্ত্রজপ, বেদপাঠ বা ধর্মশাস্ত্রাদির অধ্যয়ন । মন্ত্রজপ - (i)বাচিক, (ii)উপাংশু (কেবল ওষ্ঠস্পন্দন হয়, শব্দ শুনা যায় না), (iii)মানস ।
ঈশ্বরপ্রণিধান - স্মরণ-মননাদি ঈশ্বরোপাসনা (স্বামী বিবেকানন্দ), ঈশ্বরে সর্বকর্ম সমর্পণ (ব্যাসভাষ্য) ।

আসন : যাহাতে অনেকক্ষণ স্থিরভাবে স্বচ্ছন্দে বসিয়া থাকা যায় । যেমন সিদ্ধাসন, পদ্মাসন, সিংহাসন ও ভদ্রাসন । স্বস্তিকাসন সর্বাপেক্ষা সহজ । 'বক্ষঃস্থল, গ্রীবা ও মস্তক সমান রাখিয়া শরীরটাকে বেশ স্বচ্ছন্দভাবে রাখিতে হইবে ।' - স্বামী বিবেকানন্দ ।

প্রাণায়াম : (i)রেচক (বাহিরে শ্বাস ত্যাগ), (ii)পূরক (ভিতরে শ্বাস গ্রহণ), (iii)কুম্ভক (বায়ুকে শরীরের মধ্যে অথবা বাহিরে নিরুদ্ধ করিয়া রাখা) । এই সকল প্রক্রিয়া সদগুরু-উপদেশগম্য ।

প্রত্যাহার : বিষয়ে প্রবৃত্ত ইন্দ্রিয়সমূহের বলপূর্বক প্রত্যাকর্ষণের নাম ।

ধারণা : হৃৎপদ্মে, ভ্রূমধ্যে, নাসাগ্রে বা কোনো দিব্য মূর্তিতে চিত্ত আবদ্ধ রাখা । সাধারণত যোগশাস্ত্রে ধারণার ছয়টি স্থান নির্দিষ্ট করা হয় - ষট্‌চক্র ।

ধ্যান : যে বিষয়ে চিত্তকে ধারণা করা যায় সেই বিষয়ে অবিচ্ছিন্ন তৈলধারার ন্যায় চিত্তের একতান-প্রবাহের নাম ।

সমাধি : ধ্যানের পরিপক্ক অবস্থা সমাধি । দুইপ্রকার - (i)সম্প্রজ্ঞাত বা সবীজ (ধ্যেয় বস্তুর সম্যক জ্ঞান থাকে), (ii)সম্প্রজ্ঞাত বা নির্বীজ  বা নিরোধ-সমাধি (চিত্তবৃত্তি একেবারে তিরোহিত হয়, সমুদয় মানসিক ক্রিয়ার বিরাম হয়) । 

অষ্টাঙ্গ যোগ ও গীতোক্ত যোগ
ধারণার পরিপক্ক অবস্থা ধ্যান, ধ্যানের পরিপক্ক অবস্থা সমাধি; ধ্যান, ধারণা, সমাধি - এই তিনটি ক্রমে এক বস্তু সম্বন্ধে প্রযুক্ত হইলে তাহাকে 'সংযম' বলে [যো.সূ.|৩|৪] । এই তিনটিই যোগের অন্তরঙ্গ-সাধন, অপরগুলিই বহিরঙ্গ-সাধন [যো.সূ.|৩|৭] । যম ও নিয়ম চিত্তশুদ্ধির উপায়, উহা সকল সাধনার ভিত্তিস্বরূপ । আসন, প্রাণায়াম, মনঃ-সংযমের সহায়ক শারীরিক-প্রক্রিয়া । এই সকলই গীতাতে সাধারণভাবে স্থানে-স্থানে উল্লিখিত হইয়াছে । প্রকৃতপক্ষে, ধ্যান ও সমাধিই যোগের মূল কথা - গীতায় উহাই বিশেষরূপে উপদিষ্ট হইয়াছে । কিন্তু গীতার পূর্ণাঙ্গ যোগে কর্ম, ধ্যান, জ্ঞান, ভক্তি এই চারিটিরই সমন্বয় ।

গান্ধীবাদ ও অহিংসা :
পূর্বোক্ত যম-নিয়মের অভ্যাস নৈতিক চরিত্র-গঠনের শ্রেষ্ঠ উপায় এবং আধ্যাত্মিক উন্নতির ভিত্তিস্বরূপ । মহাত্মা গান্ধীর প্রতিষ্ঠিত সত্যাগ্রহাশ্রমে বিদ্যার্থীদের এগুলি অভ্যাস করিতে হইত । সত্য-অহিংসাদির অভ্যাসে সম্যক সিদ্ধ হইলে যে যোগবল বা আত্মশক্তি লাভ হয় তাহা দ্বারাই রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সিদ্ধ হইতে পারে । যেমন যোগশাস্ত্রে আছে 'যিনি অহিংসা সাধনে চরম সিদ্ধিলাভ করিয়াছেন, তাঁহার সম্মুখে সকল প্রাণীই বৈরভাব ত্যাগ করে' [যো.সূ.|২|৩৫] । মহাত্মা গান্ধী তাই বিশ্বাস করতেন অহিংসার প্রভাবে হিংস্র বন্যপশুও যখন হিংসা ত্যাগ করে, তখন অত্যাচারী নরপশু হইলেও অহিংসা ও ত্যাগের প্রভাবে তাহার ভাবান্তর (change of hearts) অনিবার্য । তাই তাঁর আন্দোলনের মূল কথা ছিল আত্মত্যাগ ও আত্মশুদ্ধি (self-sacrifice and self-purification).

২৭) যোগসিদ্ধির ফল নির্মল ব্রহ্মানন্দ ও সর্বত্র সমত্ববুদ্ধি ।

২৯-৩০) 'যাঁহা যাঁহা নেত্র পড়ে, তাঁহা তাঁহা কৃষ্ণ স্ফুরে ।' - [চৈ.চৈ.]
শ্রীভগবান বলিতেছেন - আমার ভক্ত কখনো আমাকে হারান না, আমিও ভক্তকে কখনো হারাই না । আমার ভক্ত সর্বত্র আমাকেই দেখেন এবং আমাতেই সমস্ত দেখেন । তিনি জগতের দিকে তাকাইলে জগৎময় আমার মূর্তিই অনুভব করেন । আবার আমার দিকে তাকাইলে তিনি দেখেন আমিই সব, আমাতেই সব । অপার সমুদ্রে যেমন তরঙ্গমালা, সেইরূপ বিধি, বিষ্ণু, শিব, শক্তি, রবি, চন্দ্র, বরুণ, যমাদি সকলই আমাতে ভাসিতেছে ।

৩১) জীবে প্রেম, স্বার্থ ত্যাগ, ভক্তি ভগবানে :
'আমাকে ভজনা করা' এবং 'সর্বভূতস্থ আমাকে ভজনা করা' - এই দুই-কথার মধ্যে কি পার্থক্য তাহা প্রণিধানযোগ্য । এই কথাটি শ্রীমদ্ভাগবতে নির্গুণভক্তিতত্ত্ব-বর্ণনা প্রসঙ্গে অতি স্পষ্টরূপে উল্লেখ করা হইয়াছে -
'আমি সর্বভূতে ভূতাত্মস্বরূপে অবস্থিত আছি । অথচ সেই আমাকে অবজ্ঞা করিয়া মনুষ্য প্রতিমাদিতে পূজারূপ বিড়ম্বনা করিয়া থাকে । সর্বভূতে অবস্থিত আত্মা ও ঈশ্বর আমাকে উপেক্ষা করিয়া যে প্রতিমাদি ভজনা করে সে ভস্মে ঘৃতাহুতি দেয় । যে প্রাণীগণের অবজ্ঞাকারী, সে বিবিধ দ্রব্য ও বিবিধ ক্রিয়াদ্বারা আমার প্রতিমাতে আমার পূজা করিলেও আমি তাহার প্রতি সন্তুষ্ট হই না । সুতরাং মানুষের কর্তব্য হইল, আমি সর্বভূতে আছি ইহা জানিয়া সকলের প্রতি সমদৃষ্টি, সকলের সহিত মিত্রতা ও দান-মানাদির দ্বারা সকলকে অর্চনা করে ।' - [ভা|৩|২৯|২১-২২, ২৪, ২৭]
সর্বজীবের সেবাই ঈশ্বরের অর্চনা । বিশ্বপ্রেমই ঈশ্বরে ভক্তি । অবশ্য ইষ্টবস্তুর উপাসনা আবশ্যক নয়, নিষিদ্ধও নয় । 'পুরুষ যে-পর্যন্ত সর্বভূতস্থিত আমাকে আপনার হৃদয়ের মধ্যে জানিতে না পারে, সে-পর্যন্ত প্রতিমা-প্রভৃতিতে আমার অর্চনা করিবে [ভা|৩|২৯|২৫] । সুতরাং সর্বদা মনে রাখিতে হইবে প্রতিমাতে কাহার অর্চনা হইতেছে এবং সে-অর্চনার উদ্দেশ্য কি । উহা বিস্মৃত হইয়া যদি প্রতীককেই ঈশ্বর করিয়া তুলি, তবে উহা জড়োপাসনায় পরিণত হয় ।
'হে দৈত্যগণ, এই বিশজগৎ বিষ্ণুর বিস্তারমাত্র । তোমরা সকলকে আপনার সঙ্গে অভেদ দেখিও । এইরূপ সমত্বদর্শনই ঈশ্বর-আরাধনা ।' [প্রহ্লাদ, বিষ্ণু পুরাণ |১|১৭|৮৪|৯০]
ইহাই বেদান্তে ব্রহ্মজ্ঞান । ইহাই যোগীর সমদর্শন, ইহাই কর্মীর নিষ্কাম কর্ম, ইহাই ভক্তের নির্গুণা ভক্তি । এই শ্লোকটিতে জ্ঞান, কর্ম, ভক্তি ও যোগের অপূর্ব সমন্বয় । ইহাই গীতোক্ত পূর্ণাঙ্গযোগ । তাই শ্রীঅরবিন্দ লিখিয়াছেন, এই শ্লোকটিকে সমগ্র গীতার চরম সিদ্ধান্ত বলিয়া গ্রহণ করা যায়
'Whoever loves God in all and whose soul is founded upon the divine oneness, however he lives and acts, lives and acts in God - that may almost be said to sum up the whole final result of the Gita's teaching.' - Sri Aurobindo.
ঈশ্বর-সম্বন্ধে সাধারণ ধারণা এই, তিনি জীব ও জগৎ হইতে স্বতন্ত্র । তিনি জগতের পালনকর্তা, শাসনকর্তা । তিনি প্রার্থনা মঞ্জুর করেন, দণ্ড-পুরস্কার দেন, সকলকে রক্ষা করেন । সুতরাং সমাজরক্ষক পার্থিব রাজাকে যেমন ধন্যবাদ দেওয়া সম্মান করা আমাদের কর্তব্য, সেইরূপ জগৎরক্ষক ঈশ্বরকেও ভক্তি করাও আমাদের কর্তব্য । বস্তুত, সকল ধর্মেই, সকল সমাজেই, ঈশ্বরের ধারণা কতকটা এইরূপ । 'কিন্তু হিন্দুর ঈশ্বর সেরূপ নহেন । তিনি সর্বভূতময়, তিনি সর্বভূতের অন্তরাত্মা । কোনো মনুষ্য তাঁহা ছাড়া নাই । মনুষ্যকে না ভালবাসিলে তাঁহাকে ভালবাসা হইল না । যতক্ষণ না বুঝিতে পারিব যে, সকল জগৎই আমি, সর্বলোক ও আমাতে অভেদ, ততক্ষণ আমার জ্ঞান হয় নাই, ভক্তি হয় নাই, প্রীতি হয় নাই । অতএব জাগতিক প্রীতি হিন্দুধর্মের মূলেই আছে । অচ্ছেদ্য, অভিন্ন, জাগতিক প্রীতি ভিন্ন হিন্দুত্ব নাই । মনুষ্য-প্রীতি ভিন্ন ঈশ্বরভক্তি নাই । ভক্তি ও প্রীতি হিন্দুধর্মে অভিন্ন ।' - বঙ্কিমচন্দ্র ।

৩২) বেদান্ত, বিশ্বপ্রেম ও হিতবাদ :
'আজকাল অনেকের মতে নীতির ভিত্তি হিতবাদ (utility) অর্থাৎ যাহাতে অধিকাংশ লোকের অধিক পরিমাণে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য হইতে পারে তাহাই নীতির ভিত্তি । ইহাদিগকে জিজ্ঞাসা করি, আমরা এই ভিত্তির উপর দণ্ডায়মান হইয়া নীতি পালন করিব, তাহার হেতু কি ? যদি আমার উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়, তাহা হইলে কেননা আমি  অধিকাংশ লোকের অত্যধিক অনিষ্ট সাধন করিব ?
... অবশ্য নিঃস্বার্থপরতা কবিত্বহিসাবে সুন্দর হইতে পারে, কিন্তু কবিত্ব তো যুক্তি নহে, আমাকে যুক্তি দেখাও, কেন আমি নিঃস্বার্থপর হইব । হিতবাদিগণ (utilitarians) ইহার কি উত্তর দিবেন ? তাঁহারা তখন কিছুই উত্তর দিতে পারেন না ।' - স্বামী বিবেকানন্দ ।

বস্তুত ইহার উত্তর হিন্দু ভিন্ন, হিন্দুর বেদান্ত ভিন্ন আর কেহ দিতে পারে না । 'লোকসমূহের প্রতি অনুরাগবশত লোকসমূহ প্রিয় হয় না, আত্মার প্রতি (আপনার প্রতি) অনুরাগবশতই লোকসমূহ প্রিয় হয় । সর্বভূতের প্রতি অনুরাগবশত সর্বভূত প্রিয় হয় না, আত্মার প্রতি (আপনার প্রতি) অনুরাগবশতই সর্বভূত প্রিয় হয় ।' - [বৃহদারণ্যক উপনিষদ |৪|৫|৬]

তুমি অপরকে, তোমার শত্রুকেও ভালবাসিবে কেন ? কারণ তুমি তোমার আত্মাকে অর্থাৎ আপনাকে ভালবাসে বলিয়া । তুমিই সেই - 'তত্ত্বমসি' । এই তত্ত্বই হিন্দু-ধর্মনীতির ভিত্তি । তাই হিন্দুধর্ম কেবল হিন্দুর ধর্ম নহে, উহা বিশ্বমানবের ধর্ম, সনাতন বিশ্বধর্ম ।

'প্রহ্লাদকে যখন হিরণ্যকশিপু জিজ্ঞাসা করিলেন, শত্রুর সঙ্গে রাজার কি রকম ব্যবহার করা কর্তব্য ? প্রহ্লাদ উত্তর করিলেন, শত্রু কে ? সকলই বিষ্ণু-(ঈশ্বর)ময়, শত্রু-মিত্র কি প্রকারে প্রভেদ করা যায় ? প্রীতিতত্ত্বের এইখানে একশেষ হইল; এবং এই এক কথাতেই সকল ধর্মের উপর হিন্দুধর্মের শ্রেষ্ঠতা প্রতিপন্ন হইল মনে করি ।' - বঙ্কিমচন্দ্র ।

The highest and purest morality is the immediate consequence of the Vedanta. The Gospels fix correctly as the highest law of morality - 'Love your neighbour as yourself'. But why should I do so, since by the order of nature, I feel pain and pleasure only in myself and not in my neighbour ? The answer is not in the Bible, but it is in the Vedas - in the great formula - 'That thou art' (তৎ ত্বম্‌ অসি), which gives in three words metaphysics and morals together.' - [Dr. Paul Deuseen,1,2]

'The Vedanta gives profoundly-based reasons for charity and brotherliness.' - [Sir John Woodroffe, 1]

দয়া ও মায়া :
প্রশ্নঃ আত্মজ্ঞ যোগী দ্বন্দ্ববর্জিত পুরুষ । তিনি সুখদুঃখের অতীত । তিনি জীবের সুখদুঃখে অভিভূত হইবেন কিরূপে ? সে তো তাঁহার অধঃপতন, আধ্যাত্মিক অপমৃত্যু । আর জগতের দুঃখের পসরা নিজের মাথায় লইয়া তাঁহার স্বস্তি কোথায় ? সমদর্শনের কি এই ফল ? কেবল দুঃখের মাত্রা বৃদ্ধি ?

উত্তরঃ কথাটা ধরেছ ভাল, কিন্তু তা হলে ঈশ্বরের মতো দুঃখী বোধ হয় আর কেহ নাই । তাঁহাকে 'দয়াময়' বলা হয়, জীবের দুঃখে দুঃখিত না হইলে তিনি দয়াময় হন কিরূপে ? স্মরণ রাখিতে হইবে, এ-স্থলে বদ্ধ জীবের কথা হইতেছে না, এ হইতেছে জীবন্মুক্ত যোগীর কথা যিনি প্রকৃতির মধ্যে থাকিয়াও, সুখদুঃখের মধ্যে থাকিয়াও সেই পরম পুরুষেই অবস্থান করেন । তাঁহার আর পতনের সম্ভাবনা কোথায় ? তাঁহার সংসারে থাকার একমাত্র উদ্দেশ্য জীবের যাহাতে দুঃখমোচন হয়, জীব যাহাতে সুখী হয়, তাহাই করা । তিনি নির্লিপ্তভাবে, নিষ্কামভাবে সেই কর্মই করেন - সময়-সময় সুখদুঃখের অভিনয়ও করেন - কিন্তু সে অভিনয় মাত্র, তিনি অভিভূত হন না । তাঁহার দয়া আছে, তিনি জড়পিণ্ড নহেন, কিন্তু তাঁহার মায়া নাই, অর্থাৎ সুখদুঃখাদি যে প্রকৃতির ধর্ম, তাহাতে তিনি বদ্ধ হন না । অবতারগণ, মহাপুরুষগণ, জনকাদি রাজর্ষিগণ - ইঁহারা সকলেই এইরূপেই জীবের সঙ্গে হাসিয়া-কাঁদিয়া লীলাখেলা করিয়াছেন, জীবের দুঃখমোচনের চেষ্টা করিয়াছেন । নরেন্দ্রাদি অন্তরঙ্গ ভক্তের জন্য শ্রীরামকৃষ্ণের এত ব্যাকুলতা কেন ? সে দয়া, মায়া নহে । জীবের দুঃখে গৌতম গৃহত্যাগী, শ্রীচৈতন্য সন্ন্যাসী । সে-ও দয়া, মায়া নহে ।

৩৫) অভ্যাস ও বৈরাগ্য :
অভ্যাসে দুঃসাধ্য কার্যও সুসাধ্য হয় । স্বভাব অভ্যাসেরই ফল । শারীরিক অভ্যাস অপেক্ষা মানসিক অভ্যাসের ফল আরও অদ্ভুত । আমাদের মনে যে কোনো চিন্তা-প্রবাহ উদিত হয়, তাহাই একটি সংস্কার রাখিয়া যায় । এই সংস্কারগুলির সমষ্টিই আমাদের স্বভাব । আমাদের বর্তমান স্বভাব পূর্ববর্তী অভ্যাসের ফল । আমাদের পরবর্তী স্বভাব হইবে বর্তমান অভ্যাসের ফল । সুতরাং সৎস্বভাব গঠন করিতে হইলে সর্বদা সৎচিন্তা ও সৎকর্মের অভ্যাস কর্তব্য । যোগ কতকগুলি সদভ্যাসের অনুশীলন মাত্র, এই জন্য ইহাকে অভ্যাসযোগ বলে । কিসের অভ্যাস ? প্রধানত বহির্মুখী চঞ্চল মনকে অন্তর্মুখী করিয়া আত্মসংস্থ করিবার অভ্যাস ।

৪০) যোগাভ্যাসের যে কোনরূপ চেষ্টামাত্রই শুভকর্ম । সম্পূর্ণ সিদ্ধি লাভ না হওয়াতে তাহার পুনর্জন্ম নির্ধারিত হয় না বটে, কিন্তু শুভকর্মজনিত অন্যরূপ শুভফল তিনি প্রাপ্ত হন, তাহার সদ্গতিই লাভ হয় ।

৪১) যিনি বিষয়-ভোগে বিরত হইয়া যোগাভ্যাসে রত ছিলেন, তিনি পরজন্মে ধনীর গৃহে যান কেন ? - তাহার সম্পূর্ণ বিষয়বৈরাগ্য জন্মে নাই বলিয়া, মৃত্যুকালে ভোগবাসনা বলবতী ছিল বলিয়া । কিন্তু যাঁহার মৃত্যুকালে তীব্র বৈরাগ্য ও মোক্ষেচ্ছা বর্তমান থাকে, তাঁহার অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ গতি হয়, তাহা পরবর্তী শ্লোকে বলিতেছেন ।

৪৬) তপস্বী = 'যাঁহারা কৃচ্ছ্রসাধ্য চান্দ্রায়ণাদি-ব্রতনিষ্ঠ' ।
কর্মী = যাঁহারা স্বর্গাদি-ফলকামনায় যাগযজ্ঞাদি কাম্য-কর্ম করেন ।
পরোক্ষ জ্ঞানী = যাঁহার কেবল শাস্ত্রজ্ঞান আছে, আত্মা, জীব, জগৎ এ-সব কি তাহা শাস্ত্রানুশীলনে বুঝিয়াছেন, কিন্তু আত্মানুভব হয় নাই ।
অপরোক্ষ জ্ঞানী = যাঁহার প্রত্যক্ষ আত্মদর্শন হইয়াছে ।
এ-স্থলে জ্ঞানী অপেক্ষা যোগী শ্রেষ্ঠ বলায় শাস্ত্রজ্ঞানী বা পরোক্ষ জ্ঞানীকেই লক্ষ্য করা হইয়াছে ।
এ-স্থলে 'যোগী' = কর্মযোগী, 'জ্ঞানী' = সাংখ্যজ্ঞানী সন্ন্যাসী [গীতারহস্য, লোকমান্য তিলক]

৪৭) নির্গুণ ব্রহ্মজ্ঞানে কর্ম ও ভক্তির স্থান কিরূপে সম্ভব ?
উঃ অক্ষর ব্রহ্ম সম, শান্ত, নিষ্ক্রিয়, নির্বিকার - তিনি কর্মে লিপ্ত নন, কর্ম করে প্রকৃতি, উহাই মায়া বা অজ্ঞান; সুতরাং কর্ম অজ্ঞান-প্রসূত, উহার সহিত জ্ঞানের সমুচ্চয় হয় না এবং অচিন্ত্য, অব্যক্ত, নির্গুণ ব্রহ্মে ভক্তিও সম্ভব না । গীতা পুরুষোত্তম-তত্ত্ব দ্বারা জ্ঞানবাদিগণের এ-আপত্তি খণ্ডন করিয়াছেন । গীতায় শ্রীভগবান বলিতেছেন - প্রকৃতি কর্ম করে তা ঠিক, কিন্তু প্রকৃতি আমারই প্রকৃতি - আমারই শক্তি । ক্ষর ও অক্ষর দুই-ই আমার বিভাব - আমি পুরুষোত্তম [১৫|১৬-১৮] । অহংশূন্য জীবন্মুক্তের কর্মের সহিত জ্ঞানের বিরোধ নাই, কারণ সে কর্ম তাঁহার নয়, আমারই কর্ম । আর এ-জ্ঞানের সহিত ভক্তিরও কোনো বিরোধ নাই; কেননা এ-জ্ঞান কেবল অচিন্ত্য, অব্যক্ত, অক্ষর ব্রহ্মের জ্ঞান নহে, ইহা অব্যক্ত-ব্যক্ত, নির্গুণ-গুণী 'সমগ্র' পুরুষোত্তমের জ্ঞান । তাই শ্রীভগবান বলিয়াছেন, জ্ঞানীই আমার শ্রেষ্ঠ ভক্ত, 'আমার আত্মস্বরূপ' [৭|১৭-১৮], আমাতে অব্যভিচারিণী ভক্তিই জ্ঞান [১৩|১০-১১] ।

এইরূপে গীতা কর্ম, জ্ঞান, ভক্তির সমন্বয়ে সুন্দর সম্পূর্ণ সাধনতত্ত্ব প্রচার করিয়াছেন । ইহাই গীতার পূর্ণাঙ্গযোগ । গীতোক্ত যোগী একাধারে জ্ঞানী, কর্মী ও ভক্ত । এ-যোগী নিত্যসমাহিত, নিত্যমুক্ত, - যুদ্ধ-কোলাহলে তাঁহার চিত্তবিক্ষেপের ভয় কি ? এ সমাধির অর্থ ভগবৎ-সত্তায় আপন সত্তা মিলাইয়া দেওয়া, তাঁহারই প্রেমানন্দে সর্বকামনা ভুলিয়া তাঁহারই কর্ম বাহিরে দেহেন্দ্রিয়াদি দ্বারা সম্পন্ন করা, আর অন্তরে সতত সর্বাবস্থায় তাঁহাতেই অবস্থান করা ।

এই অধ্যায়ে প্রধানতঃ ধানযোগ বা সমাধি-যোগের প্রক্রিয়া ও ধ্যানযোগীর লক্ষণ বর্ণিত হইয়াছে । এই হেতু ইহাকে ধ্যানযোগ বা অভ্যাসযোগ বলে ।
___________________________ 
Online Source: 
http://geetabangla.blogspot.com/2013/06/blog-post_3309.html

*Hard Copy Source:

"Sri Gita" or "Srimadbhagabadgeeta" by Gitashastri Jagadish Chandra Ghosh & Anil Chandra Ghosh. 26th Edition - June 1997 (1st Edition, 1925 from Dhaka now in Bangladesh). Published by Subhadra Dey (Ghosh), Presidency Library, 15 Bankim Chatterjee Street, Kolkata-700073. Printed by Web Impressions Pvt.Ltd., 34/2 Beadon Street, Kolkata-700006.



Disclaimer: This site is not officially related to Presidency LibraryKolkataThis is a personal, non-commercial, research-oriented effort of a novice religious wanderer.
এটি আধ্যাত্মিক পথের এক অর্বাচীন পথিকের ব্যক্তিগত, অবাণিজ্যিক, গবেষণা-ধর্মী প্রয়াস মাত্র ।

[Uploaded by rk]


<Previous--Contents--Next>

No comments:

Post a Comment