Sunday, March 15, 2015

শ্রীশ্রীগীতামাহাত্ম্যম্‌ (Mahabharata)

(স্বামী বাসুদেবানন্দ)*

(বৈশম্পায়ন কহিলেন -)
সাক্ষাৎ পদ্মনাভ শ্রীভগবানের মুখপদ্ম বিনিঃসৃত গীতা উত্তমরূপে গীত হওয়া অর্থাৎ পাঠ করা কর্তব্য; অন্য শাস্ত্রপাঠের আর প্রয়োজন কি ? ১ [মহাভারত, ভীষ্মপর্ব, ৪৩|১]

গীতা সর্বশাস্ত্রময়ী, হরি (গোবিন্দ) সর্বদেবময়, গঙ্গা সর্বতীর্থময়ী এবং মনুঃ (অর্থাৎ গায়ত্রীমন্ত্র) সর্ববেদময় । ২ [মহাভারত, ভীষ্মপর্ব, ৪৩|২]

গকারসংযুক্ত গীতা, গঙ্গা, গায়ত্রী এবং গোবিন্দ - এই চতুষ্টয় যাঁর হৃদয়ে অবস্থিত থাকে তাঁর আর পুনর্জন্ম হয় না । ৩ [মহাভারত, ভীষ্মপর্ব, ৪৩|৩]

শ্রীকৃষ্ণকথিত শ্লোক ৬২০, অর্জুনকথিত শ্লোক ৫৭, সঞ্জয়কথিত শ্লোক ৬৭, ধৃতরাষ্ট্রকথিত শ্লোক ১ (মোট ৭৪৫) । এই হল গীতায় শ্লোকের মান । [মহাভারত, ভীষ্মপর্ব, ৪৩|৪, এই শ্লোকটি গীতামাহাত্ম্যের অন্তর্গত নয়]

শ্রীকৃষ্ণ কর্তৃক মহাভারত মথিত করে গীতারূপ সার উদ্ধৃত করে অর্জুনের মুখে আহুত হয়েছে । ৪ [মহাভারত, ভীষ্মপর্ব, ৪৩|৫]

[মহাভারত, ভীষ্মপর্ব, ৪৩ অধ্যায়]
_________________________________________

*Hard Copy Source:
"Srimadbhagabatdgita (Shankarbhashya)" translated by Swami Vasudebananda, 11th Reprint - August 2014 (1st Edition - 31 January 1968),  © President, Sriramkrishna Math, Belur. Published by Swami Viswanathananda,  Udbodhan Office, 1 Udbodhan Lane, Bagbazar, Kolkata-700003. Printed by Naba Press Pvt. Ltd., 66 Grey Street,  Kolkata-700006.

Sanskrit Source
English Translation

Disclaimer:
This site is not officially related to Ramakrishna Mission & Math. This is a personal, non-commercial, research-oriented effort of a novice religious wanderer.
এটি আধ্যাত্মিক পথের এক অর্বাচীন পথিকের ব্যক্তিগত, অবাণিজ্যিক, গবেষণা-ধর্মী প্রয়াস মাত্র ।

[Digitised by scanning (if required) and then by typing mostly in Notepad using Unicode Bengali "Siyam Rupali" font and Avro Phonetic Keyboard for transliteration. Uploaded by rk]


<Previous--Contents--Next>

Saturday, March 14, 2015

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা : চতুর্থ অধ্যায় - জ্ঞানযোগ (4-Jagadishchandra)


|||৪||||||১০|১১|১২|১৩|১৪|১৫|১৬|১৭|১৮
(গীতাশাস্ত্রী জগদীশচন্দ্র ঘোষ)*

শ্রীভগবান্‌ বলিলেন -
এই অব্যয় যোগ আমি সূর্যকে বলিয়াছিলাম । সূর্য (স্বপুত্র) মনুকে এবং মনু (স্বপুত্র) ইক্ষ্বাকুকে ইহা বলিয়াছিলেন । ১

এইরূপে পুরুষপরম্পরা প্রাপ্ত এই যোগ রাজর্ষিগণ বিদিত ছিলেন । হে পরন্তপ, ইহলোকে সেই যোগ দীর্ঘকালবশে নষ্ট হইয়াছে । ২


তুমি আমার ভক্ত ও সখা, এই জন্য এই সেই পুরাতন যোগ অদ্য তোমাকে বলিলাম; কারণ, ইহা উত্তম গুহ্য তত্ত্ব । ৩

অর্জুন বলিলেন -

আপনার জন্ম পরে, বিবস্বানের জন্ম পূর্বে; সুতরাং আপনি যে পূর্বে ইহা বলিয়াছিলেন, তাহা কিরূপে বুঝিব ? ৪

শ্রীভগবান্‌ বলিলেন -

হে অর্জুন ! আমার এবং তোমার বহু জন্ম অতীত হইয়াছে । আমি সে সকল জানি; হে পরন্তপ ! তুমি জান না । ৫

আমি জন্মরহিত, অবিনশ্বর এবং সর্বভূতের ঈশ্বর হইয়াও স্বীয় প্রকৃতিতে অনুষ্ঠান করিয়া আত্মমায়ায় আবির্ভূত হই । ৬

হে ভারত ! যখনই যখনই ধর্মের গ্লানি এবং অধর্মের অভ্যুত্থান হয়, আমি সেই সেই সময়ে নিজেকে সৃষ্টি করি (দেহ ধারণপূর্বক অবতীর্ণ হই) । ৭

সাধুগণের পরিত্রাণ, দুষ্টদিগের বিনাশ এবং ধর্মসংস্থাপনের জন্য আমি যুগে যুগে অবতীর্ণ হই ।

হে অর্জুন, আমার এই দিব্য জন্ম ও কর্ম যিনি তত্ত্বতঃ জানেন, তিনি দেহত্যাগ করিয়া পুনর্বার আর জন্মপ্রাপ্ত হন না - তিনি আমাকেই প্রাপ্ত হন । ৯

বিষয়ানুরাগ, ভয় ও ক্রোধ বর্জন করিয়া, আমাতে একাগ্রচিত্ত ও আমার শরণাপন্ন হইয়া, আমার জন্মকর্মের তত্ত্বালোচনা রূপ জ্ঞানময় তপস্যাদ্বারা পবিত্র হইয়া অনেকে আমার পরমানন্দভাবে চিরস্থিতি লাভ করিয়াছেন । ১০

হে পার্থ ! যে আমাকে যে-ভাবে উপাসনা করে, আমি তাহাকে সেই ভাবেই তুষ্ট করি । মনুষ্যগণ সর্বপ্রকারে আমার পথেরই অনুসরণ করে অর্থাৎ মনুষ্যগণ যে পথই অনুসরণ করুক না কেন, সকল পথেই আমাতে পৌঁছিতে পারে । ১১

ইহলোকে যাহারা কর্মসিদ্ধি কামনা করে তাহারা দেবতা পূজা করে, কেননা মনুষ্যলোকে কর্মজনিত ফললাভ শীঘ্রই পাওয়া যায় । ১২

বর্ণচতুষ্টয় গুণ ও কর্মের বিভাগ অনুসারে আমি সৃষ্টি করিয়াছি বটে, কিন্তু আমি উহার সৃষ্টিকর্তা হইলেও আমাকে অকর্তা ও বিকাররহিত বলিয়াই জানিও । ১৩

কর্মসকল আমাকে লিপ্ত করিতে পারে না, কর্মফলে আমার স্পৃহাও নাই, এইরূপে যিনি আমাকে জানেন, তিনি কর্মদ্বারা আবদ্ধ হন না । ১৪

এইরূপ জানিয়া (অর্থাৎ আত্মাকে অকর্তা, অভোক্তা মনে করিয়া) পূর্ববর্তী মোক্ষাভিলাষিগণ অর্থাৎ পূর্ববর্তী জনকাদি রাজর্ষিগণ কর্তৃত্বাভিমান বর্জনপূর্বক নির্লিপ্তভাবে স্বীয় কর্তব্য কর্ম সম্পাদন করিয়া গিয়াছেন, তুমিও সেইরূপ নিষ্কামভাবে স্বীয় কর্তব্য পালন কর । ১৫

কর্ম কি, কর্মশূন্যতাই বা কি, এ বিষয়ে পণ্ডিতেরাও মোহ প্রাপ্ত হন অর্থাৎ ইহার প্রকৃত তত্ত্ব বুঝিতে পারেন না, অতএব কর্ম কি, (এবং অকর্ম কি) তাহা তোমাকে বলিতেছি, তাহা জানিলে অশুভ হইতে (সংসারবন্ধন হইতে) মুক্ত হইবে । ১৬

বিহিত কর্মের বুঝিবার বিষয় আছে, বিকর্ম বা অবিহিত কর্মের বুঝিবার বিষয় আছে, অকর্ম বা কর্মত্যাগ সন্বন্ধেও বুঝিবার বিষয় আছে; কেননা কর্মের গতি (তত্ত্ব) দুর্জ্ঞেয় । ১৭

যিনি কর্মে অকর্ম এবং অকর্মে কর্ম দেখেন মনুষ্যের মধ্যে তিনিই বুদ্ধিমান্‌; তিনি যোগী, তিনি সর্বকর্মকারী । ১৮

যাঁহার সমস্ত কর্মচেষ্টা, ফলতৃষ্ণা ও কর্ত্তৃত্বাভিমানবর্জিত, সুতরাং যাঁহার কর্ম জ্ঞানরূপ অগ্নিদ্বারা দগ্ধ হইয়াছে, সেইরূপ ব্যক্তিকেই জ্ঞানিগণ পণ্ডিত বলিয়া থাকেন । ১৯

যিনি কর্মে ও কর্মফলে আসক্তি পরিত্যাগ করিয়াছেন, যিনি সদা আপনাতেই পরিতৃপ্ত, যিনি কোন প্রয়োজনে কাহারও আশ্রয় গ্রহণ করেন না, তিনি কর্মে প্রবৃত্ত হইলেও কিছুই করেন না (অর্থাৎ তাঁহার কর্ম অকর্মে পরিণত হয়) । ২০

যিনি কামনা ত্যাগ করিয়াছে, যাঁহার চিত্ত ও ইন্দ্রিয় সংযত, যিনি সর্বপ্রকার দান-উপহারাদি গ্রহণ বর্জন করিয়াছেন, তাদৃশ ব্যক্তি কেবল শরীরদ্বারা কর্মানুষ্ঠান করিয়াও পাপভোগী হন না (কর্মবন্ধনে আবদ্ধ হন না) । ২১

যিনি প্রার্থনা ও বিশেষ চেষ্টা না করিয়া যাহা প্রাপ্ত হওয়া যায় তাহাতেই সন্তুষ্ট থাকেন, যিনি দ্বন্দ্বসহিষ্ণু, মাৎসর্য্যশূন্য সুতরাং বৈরবিহীন, যিনি সিদ্ধি ও অসিদ্ধি তুল্য জ্ঞান করেন, তিনি কর্ম করিয়াও কর্মফলে আবদ্ধ হয়েন না । ২২

যিনি ফলাকাঙ্ক্ষাবর্জিত, রাগদ্বেষাদিমুক্ত, যাঁহার চিত্ত আত্মবিষয়ক জ্ঞানে নিবিষ্ট বা জ্ঞানস্বরূপ ব্রহ্মে অবস্থিতি, যিনি যজ্ঞার্থ (অর্থাৎ ঈশ্বর-প্রীত্যর্থ যজ্ঞস্বরূপ) কর্ম করেন, তাঁহার কর্মসকল ফলসহ বিনষ্ট হইয়া যায়, ঐ কর্মের কোন সংস্কার থাকে না (অর্থাৎ তাহার কর্ম বন্ধনের কারণ হয় না) । ২৩


অর্পণ (স্রুবাদি-যজ্ঞপাত্র) ব্রহ্ম, ঘৃতাদি ব্রহ্ম, অগ্নি ব্রহ্ম, যিনি হোম করেন তিনিও ব্রহ্ম, এইরূপ জ্ঞানে ব্রহ্মরূপ কর্মে একাগ্রচিত্ত পুরুষ ব্রহ্মই প্রাপ্ত হন । ২৪

অন্য কোন কোন যোগিগণ দৈবযজ্ঞের অনুষ্ঠান করেন, অপর কেহ কেহ ব্রহ্মরূপ অগ্নিতে (পূর্বোক্ত ব্রহ্মার্পণ রূপ) যজ্ঞদ্বারাই যজ্ঞার্পণ করেন (অর্থাৎ সর্বকর্ম ব্রহ্মে অর্পণ করেন) । ২৫

অন্যে সংযমরূপ অগ্নিতে চক্ষুকর্ণাদি ইন্দ্রিয়সমূহকে হোম করেন অর্থাৎ ইন্দ্রিয়গুলিকে রূপরসাদি বিষয় হইতে প্রত্যাহার করিয়া সংযতেন্দ্রিয় হইয়া অবস্থান করেন, ইহার নাম সংযম-যজ্ঞ বা ব্রহ্মচর্য; অন্যে ইন্দ্রিয়রূপ অগ্নিতে শব্দাদি বিষয়সমূহকে আহুতি দেন - অর্থাৎ ইন্দ্রিয়সমূহ শব্দাদি বিষয় গ্রহণ করিতেছে, কিন্তু তিনি রাগদ্বেষশূন্যচিত্তে অনাসক্তভাবে থাকেন । মুমুক্ষু নির্লিপ্ত সংসারীরা এই যজ্ঞ করেন; ইহাকে বলা যায় ইন্দ্রিয়-যজ্ঞ । ২৬

অন্য কেহ (ধ্যানযোগিগণ) সমস্ত ইন্দ্রিয়-কর্ম ও সমস্ত প্রাণকর্ম ব্রহ্মজ্ঞানে প্রদীপিত আত্মসংযম বা সমাধিরূপ যোগাগ্নিতে হোম করেন অর্থাৎ পঞ্চ জ্ঞানেদ্রিয়, পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয় ও পঞ্চ প্রাণ - ইহাদের সমস্ত কর্ম নিরোধ করিয়া আত্মানন্দসুখে মগ্ন থাকেন । ইহার নাম আত্মসংযম বা সমাধি যজ্ঞ । ২৭

কেহ কেহ দ্রব্যদানরূপ যজ্ঞ করেন, কেহ কেহ তপোরূপ যজ্ঞ করেন, কেহ কেহ যোগরূপ যজ্ঞ করেন, কোন কোন দৃঢ়ব্রত যতিগণ বেদাভ্যাসরূপ যজ্ঞ করেন, কেহ কেহ বেদার্থপরিজ্ঞানরূপ যজ্ঞ সম্পাদন করেন । ২৮

আবার অন্য যোগিগণ অপান বায়ুতে 
প্রাণবায়ু এবং প্রাণবায়ুতে অপান বায়ু আহুতি দিয়া প্রাণ ও অপান বায়ুর গতি রোধ করিয়া প্রাণায়াম-পরায়ণ হইয়া থাকেন । ২৯

অপর কোনো-কোনো যোগী মিতাহারী হইয়া (আহার-সংযম-পূর্বক) ইন্দ্রিয়সমূহ প্রাণবায়ুতে আহুতি দেন । এই 
সকল যজ্ঞবিদ্‌গণ যজ্ঞদ্বারা পাপমুক্ত হন । ৩০

যাঁহারা অমৃত-স্বরূপ যজ্ঞাবশিষ্ট অন্ন ভোজন করেন, তাঁহারা সনাতন ব্রহ্মপদ লাভ করেন । হে কুরুশ্রেষ্ঠ! যে কোনরূপ যজ্ঞই করে না, তাহার ইহলোকই নাই, পরলোক তো দূরের কথা (অর্থাৎ ইহলোকেই তাহার কোন সুখ হয় না, পরলোকে আর কি হইবে ?) । ৩১

এইরূপ বহুবিধ যজ্ঞ ব্রহ্মের মুখে বিস্তৃত (বিহিত) আছে, এ সকলই কর্মজ অর্থাৎ কায়িক, বাচিক বা মানসিক এই ত্রিবিধ কর্ম হইতে সমুদ্ভূত বলিয়া জানিও; এইরূপ জানিলে মুক্তিলাভ করিবে । ৩২

হে পরস্তপ, দ্রব্যসাধ্য দৈব্যযজ্ঞাদি হইতে জ্ঞানযজ্ঞ শ্রেষ্ঠ; কেননা, ফল-সহিত সমস্ত কর্ম নিঃশেষে জ্ঞানে পরিসমাপ্ত হয় । ৩৩

গুরুচরণে দণ্ডবৎ প্রণামদ্বারা, নানা বিষয় প্রশ্নদ্বারা এবং গুরুসেবা দ্বারা সেই জ্ঞান লাভ কর । জ্ঞানী, তত্ত্বদর্শী গুরু তোমাকে সেই জ্ঞান উপদেশ করিবেন । ৩৪

হে পাণ্ডব, যাহা জানিলে পুনরায় এরূপ (শোকাদি জনিত) মোহ প্রাপ্ত হইবে না, যে জ্ঞানদ্বারা সমস্ত ভূতগ্রাম স্বীয় আত্মাতে এবং অনন্তর আমাতে দেখিতে পাইবে । ৩৫

যদি তুমি সমুদয় পাপী হইতেও অধিক পাপাচারী হও, তথাপি জ্ঞানরূপ তরণী দ্বারা সমুদয় পাপসমুদ্র ঊত্তীর্ণ হইতে পারিবে । ৩৬

হে অর্জুন, যেমন প্রজ্জ্বলিত অগ্নি কাষ্ঠরাশিকে ভস্মীভূত করে, তেমন জ্ঞানরূপ অগ্নি কর্মরাশিকে ভস্মসাৎ করে । ৩৭

ইহলোকে জ্ঞানের ন্যায় পবিত্র আর কিছু নাই । কর্ম-যোগে সিদ্ধ-পুরুষ সেই জ্ঞান কালসহকারে আপনিই অন্তরে লাভ করে । ৩৮

যিনি শ্রদ্ধাবান্‌, একনিষ্ঠ সাধন-তৎপর এবং জিতেন্দ্রিয়, তিনিই জ্ঞানলাভ করেন । আত্মজ্ঞান লাভ করিয়া অচিরাৎ পরম শান্তি লাভ করেন । ৩৯

অজ্ঞ, শ্রদ্ধাহীন, সংশয়াকুল, ব্যক্তি বিনষ্ট হয়, সংশয়াত্মার ইহলোকও নাই, পরলোকই নাই, সুখও নাই । ৪০

নিষ্কাম কর্মযোগের দ্বারা যাঁহার কর্ম ঈশ্বরে সমর্পিত হইয়াছে, আত্মদর্শনরূপ জ্ঞানের দ্বারা যাঁহার সকল সংশয় ছিন্ন হইয়াছে, এইরূপ অপ্রমাদী আত্মবিদ্‌ পুরুষকে কর্মসকল আবদ্ধ করিতে পারে না অর্থাৎ তিনি কর্ম করিলেও কর্মফলে আবদ্ধ হন না । ৪১


অতএব হে, ভারত, অজ্ঞাতজাত হৃদয়স্থ এই তোমার সংশয়রাশিকে আত্মজ্ঞানরূপ খড়্গদ্বারা ছেদন করিয়া নিষ্কাম কর্মযোগ অবলম্বন কর, উঠ, যুদ্ধ কর । ৪২
___________________________


১) বিবস্বান (সূর্য) হইতেই সূর্যবংশের উৎপত্তি । বিবস্বানের পুত্র মনু, মনুর পুত্র ইক্ষ্বাকু । এই বৈবস্বত মনু হইতে ৫৮তম অধস্তন পুরুষ শ্রীরামচন্দ্র ।

এই শ্লোকে যে যোগধর্মের কথা উল্লেখ করা হইল, ইহাই মহাভারতের শান্তিপর্বে কথিত নারায়ণীয় ধর্ম বা সাত্বত ধর্ম । কল্পে কল্পে এই ধর্ম কিরূপে আবির্ভূত হইয়া প্রচারিত হইয়াছে তথাত তাহার বিস্তারিত পরম্পরা দেওয়া হইয়াছে । এ-স্থলে মাত্র ব্রহ্মার সপ্তম জন্মে অর্থাৎ বর্তমান কল্পে ত্রেতাযুগের প্রথমে এই ধর্ম কিরূপে প্রচারিত হইয়াছিল, সেই পরম্পরা দেওয়া হইয়াছে ।

২) রাজর্ষি = রাজা হইয়াও যিনি ঋষি, যেমন জনকাদি । সুতরাং যাঁহারা জ্ঞানী ও কর্মী, ইহা তাঁহাদেরই অধিগম্য ।

৬) মায়া = পরমেশ্বরের অপূর্ব সৃষ্টি-কৌশল, যোগমায়া, যোগ । শঙ্কর মতে অবস্তু বা ভ্রমাত্মক কোনো কিছু (illusion) ।
পরমেশ্বরের নিজের অব্যক্ত স্বরূপ হইতে সমস্ত জগৎ নির্মাণ করিবার অচিন্ত্য শক্তিকেই গীতাতে 'মায়া' বলা হইয়াছে [তিলক] ।

অবতারতত্ত্ব :
সর্বভূতেশ্বর জন্মমৃত্যু-রহিত, প্রাণিগণের যেরূপ জন্মমৃত্যু হয়, তাঁহার সেরূপে আবির্ভাব হয় না । তিনি তাঁহার ত্রিগুণাত্মিকা প্রকৃতিকে বশীভূত করিয়া মায়াবলে আবির্ভূত হন অর্থাৎ মায়া-শরীর ধারণ করেন [শ্রীমৎ শঙ্করাচার্য] । কিন্তু ভক্তিপন্থী শ্রীধরস্বামী প্রভৃতি বলেন - উহাই তাঁহার নিত্যসিদ্ধ-চিদ্রূপ, উহা জড়রূপ নহে ।

মহাভারতে নারায়ণীয়-পর্বাধ্যায়ে যে দশ অবতারের উল্লেখ আছে তাহাতে বুদ্ধ অবতার নাই, প্রথমে হংস (swan) অবতার । পরবর্তী পুরাণসমূহে বুদ্ধ-অবতার লইয়াই দশ অবতারের গণনা হইয়াছে । ভাগবতে দ্বাবিংশ অবতারের উল্লেখ আছে, এবং এই প্রসিদ্ধ শ্লোকাংশ আছে - 'শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং ভগবান পরব্রহ্ম; সমস্ত অবতার তাঁহারই অংশ ও কলা' । বিশদ

বেদান্তমতে ঈশ্বর কেবল এক নন, তিনি অদ্বিতীয়, একমেবদ্বিতীয়ম্‌, তিনিই সমস্ত, তিনি ছাড়া আর-কিছু নাই, সকলই তাঁহার সত্তায় সত্তাবান, সকলই তাঁহার মধ্যেই আছে, তিনি সকলের মধ্যেই আছেন । সুতরাং অজ আত্মার দেহ-সম্পর্ক গ্রহণ করা অসম্ভব তো নহেই, বরং সেই সম্পর্কেই জগতের অস্তিত্ব । কাজেই হিন্দুর পক্ষে অবতার-বাদ কেবল ভক্তি-বিশ্বাসের বিষয়মাত্র নহে, উহা বেদান্তের দৃঢ় ভিত্তির উপরেই প্রতিষ্ঠিত ।

৮) যুগে যুগে - তত্ত্বদবসরে, তত্তৎ সময়ে (শ্রীধর, বলদেব) যখনই ধর্মের গ্লানি হয়, তখনই অবতার; এক যুগে একাধিক অবতারও হয় । 

৯-১০) লীলা-তত্ত্বের অনুধ্যানই শ্রেষ্ঠ সাধনা
শ্রেষ্ঠ অধ্যাত্মতত্ত্ব : শ্রীভগবান অজ, অব্যয়, অব্যক্ত হইয়াও কিরূপে আত্মমায়ার দ্বারা অবতীর্ণ হন ।
দিব্য কর্মতত্ত্ব : তিনি নিষ্ক্রিয়, অকর্তা হইয়াও নির্লিপ্তভাবে কিরূপে কর্ম করেন ।
ভক্তি-তত্ত্ব : তিনি নির্গুণ হইয়াও সগুণ, অশেষকল্যাণগুণোপেত, অহেতুক কৃপাসিন্ধু; লোকসংগ্রার্থ, লোকশিক্ষার্থ বা ভক্তবাঞ্ছাপূরণার্থ তাঁহার এই লীলা - এই তত্ত্ব ।

'অবতারের আগমনের নিগূঢ় ফল তাহারা ল্ভ করে, যাহারা ইহা হইতে দিব্য জম্ন ও দিব্য কর্মের প্রকৃত মর্ম বুঝিতে পারে, যাহাদের চিত্ত তাঁহার চিন্তাতেই পূর্ণ হয়, যাহারা সর্বতোভাবে তাঁহার আশ্রয় গ্রহণ করে, যাহারা জ্ঞানের দ্বারা শুদ্ধ হইয়া এবং নিম্ন প্রকৃতি হইতে মুক্ত হইয়া দিব্য সত্তা ও দিব্য প্রকৃতি লাভ করে ।' [শ্রীঅরবিন্দের গীতা]

১১) গীতার এই শ্লোকটির তাৎপর্য বুঝিলে প্রকৃতপক্ষে ধর্মগত-পার্থক্য থাকে না, হিন্দুর হৃদয়ে ধর্মবিদ্বেষ থাকিতে পারে না । হিন্দুর নিকট কৃষ্ণ, খ্রীষ্ট, বুদ্ধ সকলেই এক । 

'ইহাই প্রকৃত হিন্দুধর্ম । হিন্দুধর্মের তুল্য উদার ধর্ম আর নাই - আর এই শ্লোকের তুল্য উদার মহাবাক্য আর নাই ।' [বঙ্কিমচন্দ্র]

১৩) অব্যয় - অবিকারী (নীলকন্ঠ) । তিনি নির্গুণ হইয়াও সগুণ, ‘নির্গুণো-গুণী’ । নির্গুণ বিভাবে তিনি নির্বিশেষ নিষ্ক্রিয়; সগুণবিভাবে তিনি সৃষ্টিস্থিতিপ্রলয়কর্তা । তাই তিনি কর্তা হইয়াও অকর্তা, ক্রিয়াশীল হইয়াও অবিকারী । কেহ সকামভাবে রাজসিক বা তামসিক পূজার্চনা করে, কেহ নিষ্কাম ভাবে উপাসনা করে । এরূপ কর্ম-বৈচিত্র্য কেন? তুমিই ত এসব ঘটাও ? - না, প্রকৃতিভেদবশতঃ এইরূপ হয় । প্রকৃতিভেদ অনুসারে বর্ণভেদ বা কর্মভেদ আমি করিয়াছি - কিন্তু আমি উহার কর্তা হইলেও উহাতে লিপ্ত হই না বলিয়া আমি অকর্তা । জীবেরও এই তত্ত্ব জানিয়া নিষ্কামভাবে স্বধর্ম পালন করা উচিত । মুমুক্ষু ব্যক্তিগণ পূর্বে এই ভাবেই কর্ম করিযাছেন ।  

চতুর্বর্ণের উৎপত্তি

১৪) শ্রীভগবান্‌ আদর্শ কর্মযোগী, তাঁহার নির্লিপ্ততা ও নিস্পৃহতা বুঝিতে পারিলে মনুষ্য নিষ্কাম কর্মের মর্ম বুঝিতে পারে, তাহার কর্ম নিষ্কাম হয় । সুতরাং কর্ম করিয়াও সে কর্মবন্ধন হইতে মুক্ত হয় ।

১৬) কর্ম - বিহিত কর্ম; বিকর্ম - অবিহিত কর্ম; অকর্ম - কর্মশূন্যতা; কর্মত্যাগ, কিছু না করিয়া তুষ্ণীম্ভাব অবলম্বন । 

১৮) কর্মতত্ত্বঃ, বিকর্মতত্ত্ব, অকর্মতত্ত্ব :
কর্মতত্ত্বঃ : যিনি কর্মে অকর্ম দর্শন করেন অর্থাৎ যিনি কর্ম করিয়াও মনে করেন যে দেহেন্দ্রিয়াদি কর্ম করিতেছে, আমি কিছুই করি না, তিনিই বুদ্ধিমান্‌, কেন না কর্ম করিয়াও তিনি কর্মের ফলভোগী হন না । অর্থাৎ যিনি কর্তৃত্বাভিমান ত্যাগ করিয়া কর্ম করেন, তাঁহার কর্মও অকর্মস্বরূপ ।

বিকর্মতত্ত্বঃ : কর্ম করিয়াও তাহার ফলভোগী হন না সুতরাং নির্লিপ্ত অনহঙ্কারী কর্মযোগীর পক্ষে বিকর্মও অকর্মস্বরূপ ।

অকর্মতত্ত্বঃ : আর যিনি অকর্মে কর্ম দর্শন করেন, তিনিই বুদ্ধিমান্‌ । অনেকে আলস্যহেতু, দুঃখবুদ্ধিতে কর্তব্যকর্ম ত্যাগ করেন, কিন্তু তাহারা জানেন না এ অবস্থায় প্রকৃতির ক্রিয়া চলিতে থাকে, কর্মবন্ধ হয় না । এই যে কর্মত্যাগ বা অকর্ম ইহা প্রকৃতপক্ষে কর্ম, কেননা ইহা বন্ধনের কারণ । আবার ইহারা কর্ম ত্যাগ করিয়া মনে করেন, আমি কর্ম করি না, আমি বন্ধনমুক্ত । কিন্তু “আমি কর্ম করি” ইহা যেমন অভিমান, “আমি কর্ম করি না” ইহাও সেইরূপ অভিমান, সুতরাং বন্ধনের কারণ । ইহারা বুঝেন না যে কর্ম করে প্রকৃত, ‘আমি’ নহে । বস্তুতঃ ‘আমি’ ত্যাগ না হইলে কেবল কর্মত্যাগে বন্ধন-মুক্ত হওয়া যায় না । সুতরাং এইরূপ অকর্ম বা কর্মত্যাগও বন্ধনহেতু বলিয়া প্রকৃতপক্ষে কর্মই ।

১৯) নিষ্কাম কর্ম দিব্য কর্ম, ভাগবৎ কর্ম ! ‘আমি করিতেছি’ এইরূপ কর্তৃত্বাভিমান যাঁহার নাই, তিনি কর্ম করিয়াও তাহার ফলভাগী হন না । অহং-বুদ্ধিত্যাগই প্রকৃত জ্ঞান । এই জ্ঞানরূপ অগ্নিদ্বারা তাঁহার কর্মের ফল দগ্ধ হইয়াছে, তাঁহার কর্মের ফলভাগিত্ব বিনষ্ট হইয়াছে । এইরূপ ব্যক্তিই কর্মে অকর্ম অর্থাৎ কর্মশূন্যতা দেখেন । 

২৩) যজ্ঞতত্ত্ব :
বৈদিক যজ্ঞাদি লইয়াই হিন্দুধর্মের আরম্ভ । যজ্ঞমাত্রেরই মূল তাৎপর্য হইতেছে ত্যাগ এবং ত্যাগের ফলস্বরূপ ভোগ - দিব্যভোগ ('অমৃতমশ্নুতে') । নৃযজ্ঞ, ভূতযজ্ঞ প্রভৃতি স্মার্ত-যজ্ঞগুলি সকলই ত্যাগমূলক । প্রাচীনকালে যজ্ঞই ঈশ্বর-আরাধনার প্রধান অঙ্গ ছিল । কালক্রমে এই সকল যজ্ঞবিধি অতি জটিল ও বিস্তৃত হইয়া পড়ে ।

বেদের ব্রাহ্মণভাগে বিবিধ যাগযজ্ঞাদির বিস্তৃত বিবরণ আছে । বৈদিক ক্রিয়াকর্ম ও বৈদিক মন্ত্রের দুইটি অঙ্গ ছিল - (i)বাহ্য, আনুষ্ঠানিক; (ii)আভ্যন্তরীণ, আধ্যাত্মিক । বাহ্য অনুষ্ঠানটি প্রকৃতপক্ষে কোনো আধ্যাত্মিক গূঢ়-তত্ত্বেরই রূপক বা প্রতীকরূপে ব্যবহৃত হইত । যেমন সোমরস = অমৃত/অমরত্ব/ভূমানন্দের প্রতীক; ধান = ধনের প্রতীক; দূর্বা = দীর্ঘায়ুর প্রতীক । দূর্বার মৃত্যু নাই, রৌদ্রে পুড়িয়া, বর্ষায় পচিয়া গেলেও আবার গজাইয়া উঠে । উহার আর এক নাম 'অমর' । সুতরাং ধান-দূর্বা মস্তকে দেওয়ার অর্থ - ধনেশ্বর হও, চিরায়ু লাভ কর । বস্তুত, হিন্দুদিগের পূজার্চনা, আচার-অনুষ্ঠান সমস্তই রূপক বা প্রতীক-তান্ত্রিক (symbolic) ।

ক্রমে ব্রহ্মবিদ্যা বা জ্ঞানমার্গের প্রভাবে বৈদিক যাগযজ্ঞাদি গৌণ বলিয়া বিবেচিত হইতে লাগিল এবং জ্ঞানযজ্ঞ/ব্রহ্মযজ্ঞই শ্রেষ্ঠ যজ্ঞ বলে নির্ধারিত হইল । তাহার পর ভাগবত-ধর্ম ও ভক্রিমার্গের প্রচার হইলে পুরাণাদি-শাস্ত্রে জপযজ্ঞ/নামযজ্ঞেরই প্রাধান্য দেওয়া হইয়াছে । শ্রীগীতায়ও ভগবান দ্রব্যযজ্ঞ হইতে জ্ঞানযজ্ঞেরই শ্রেষ্ঠতা দিয়াছেন । বস্তুত ভারতীয় ধর্মচিন্তার ক্রমবিকাশ ও সম্প্রসারণের সঙ্গে-সঙ্গে যজ্ঞশব্দের অর্থ ও তাৎপর্য সম্প্রসারিত হইয়াছে । গীতায় এই সম্প্রসারণের সকল স্তরই স্বীকার করা হইয়াছে এবং যজ্ঞের যে মূলতত্ত্ব ত্যাগ, ঈশ্বরার্পণ, নিষ্কামতা তাহা যুক্ত করিয়া সবগুলিই মোক্ষপ্রদ করিয়া দেওয়া হইয়াছে ।

২৪) যিনি কর্মে ও কর্মের অঙ্গসকলে ব্রহ্মই দেখেন, তিনি ব্রহ্মত্বই প্রাপ্ত হন - ‘ব্রহ্মবিদ ব্রহ্মৈব ভবতি’ । 
জ্ঞানীর কর্ম ব্রহ্মকর্ম :
যিনি যজ্ঞ করিতে বসিয়া স্রুবাদি (হবিঃ-অর্পণ করিবার জন্য হাতা) কিছু দেখিতে পান না, সর্বত্রই ব্রহ্ম দর্শন করেন, ব্রহ্ম ব্যতীত আর-কিছু ভাবনা করিতে পারেন না, ব্রহ্মে একাগ্রচিত্ত সেই যোগী পুরুষ ব্রহ্মই প্রাপ্ত হন । এই স্থলে 'যজ্ঞ'-শব্দ রূপার্থক; বস্তুত জ্ঞানীর কর্মকেই এখানে যজ্ঞরূপে কল্পনা করা হইয়াছে । ইহাই কর্মযোগের শেষ কথা, এই অবস্থায় কর্ম জ্ঞানে পরিসমাপ্ত হয় । এই জন্যই বলা হইয়াছে, 'সাংখ্যগণ যে স্থান লাভ করেন, কর্মযোগীও তাহাই প্রাপ্ত হন' [৫|৫] । যাঁহারা 'সাংখ্যযোগ ও কর্মযোগকে পৃথক বলেন তাঁহারা অজ্ঞ' [৫|৪] । 'সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম' (এ-সমস্তই ব্রহ্ম), 'অহং ব্রহ্মাস্মি' (আমি ব্রহ্ম), ইত্যাদি শ্রুতিবাক্য এই জ্ঞানই প্রচার করিয়াছেন । জীবের অহংবুদ্ধি যখন সম্পূর্ণ বিদূরিত হয়, তখনই এই পূর্ণ একত্বের জ্ঞান আবির্ভূত হয় । তখন জ্ঞাতা-জ্ঞেয়, উপাস্য-উপাসক, কর্তা-কর্ম-করণ এইসকল ভেদবুদ্ধি থাকে না; সর্বত্রই এক তত্ত্ব, এক শক্তিই আবির্ভূত হয় । এইরূপ জ্ঞানে যিনি কর্ম করিতে পারেন, জীবনযাপন করিতে পারেন, তাঁহার কর্ম-বন্ধন কি ? তিনি তো মুক্ত পুরুষ ।

কর্ম, ভক্তি, জ্ঞান - এই তিন মার্গেরই শেষ ফল অদ্বয় তত্ত্বোপলব্ধি, পার্থক্য প্রারম্ভে ও সাধনাবস্থায় ।
  1. কর্মীর আরম্ভ লোকরক্ষার্থ বা ঈশ্বরপ্রীত্যর্থ নিষ্কাম কর্মে;
  2. ভক্তের আরম্ভ নিষ্কাম উপাসনায়;
  3. জ্ঞানমার্গী সাধকগণ প্রারম্ভ হইতেই অদ্বৈতভাবে চিন্তা করেন ।
বিশিষ্ট চিন্তা :
প্রকৃত পক্ষে জ্ঞানমার্গী সাধকগণদের কোনো উপাসনা নাই, কেননা সকলই যখন ব্রহ্ম, তখন কে কাহার উপাসনা করিবে ? কেবল ব্রহ্মচিন্তাই তাঁহাদের উপাসনা, তাই এই উপাসনার নাম 'বিশিষ্ট চিন্তা' । ইহা ত্রিবিধ -
  1. অঙ্গাববিদ্ধ উপাসনা = যজ্ঞের অঙ্গবিশেষকে ব্রহ্ম ভাবনা করা ।
  2. প্রতীক উপাসনা = যাহা ব্রহ্ম নয়, তাহাকে ব্রহ্ম-ভাবনা, যেমন মনকে ব্রহ্ম ভাবিয়া উপাসনা করা ।
  3. অহংগ্রহ = আত্মা ব্রহ্ম হইতে অভিন্ন, আমিই ব্রহ্ম ('অহং ব্রহ্মাস্মি') - এইরূপ ভাব-সাধনা ।
২৫-২৭) 'যজ্ঞ' শব্দ রূপকার্থে ব্যবহৃত হইয়াছে । যজ্ঞের লাক্ষণিক অর্থ গ্রহণ করিয়া বিভিন্ন সাধন-প্রণালী বর্ণিত হইয়াছে :-
  1. দৈবযজ্ঞ : ইন্দ্র-বরুণাদি দেবতার উদ্দেশে
  2. ব্রহ্মার্পণ যজ্ঞ বা জ্ঞানযজ্ঞ : ব্রহ্মাগ্নিতে জীবাত্মার আহুতি
  3. সংযমযজ্ঞ : ব্রহ্মচর্য অর্থাৎ ইন্দ্রিয়গুলিকে রূপরসাদি-বিষয় হইতে প্রত্যাহার
  4. ইন্দ্রিয়যজ্ঞ : ইন্দ্রিয়রূপ অগ্নিতে শব্দাদি-বিষয়সমূহের আহূতি (নির্লিপ্ত সংসারী)
  5. আত্মসংযম বা সমাধি-যজ্ঞ : আত্মাতে চিত্তকে একাগ্র করা (ধ্যানযোগিগণ)
প্রাণকর্মাণি - প্রাণ, অপান, ব্যান, উদান, সমান - মনুষ্য শরীরে এই পঞ্চপ্রাণ আছে :-
  1. প্রাণবায়ুর কর্ম : বহির্নয়ন
  2. অপান বায়ু্র কর্ম : অধোনয়ন
  3. ব্যান বায়ু্র কর্ম : আকুঞ্চন ও প্রসারণ
  4. উদান বায়ু্র কর্ম : ঊর্দ্ধনয়ন
  5. সমান বায়ুর কর্ম : ভুক্তপদার্থের পরিপাক-করণ
২৮) এই শ্লোকে পাঁচ প্রকার যজ্ঞের কথা বলা হইল :-
  1. দ্রব্যযজ্ঞ : দ্রব্যত্যাগরূপ যজ্ঞ । পূর্বের দৈবযজ্ঞ ও ব্রহ্মার্পণ যজ্ঞও দ্রব্যযজ্ঞ । উহা শ্রৌত কর্ম, আর বাপী-কূপাদি খনন, দেবমন্দির প্রতিষ্ঠা, অন্নসত্র দান ইত্যাদি স্মার্ত-কর্ম । এ-সকল এবং পুষ্পপত্র-নৈবেদ্যাদি দ্বারা পূজার্চনা সমস্তই দ্রব্যযজ্ঞ ।
  2. তপোযজ্ঞ : কৃচ্ছ্র-চান্দ্রায়ণাদি উপবাস ব্রত
  3. যোগযজ্ঞঅষ্টাঙ্গ যোগ বা রাজযোগ - যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধারণা, ধ্যান ও সমাধি ।
  4. স্বাধ্যায়-যজ্ঞব্রহ্মচর্য অবলম্বন করিয়া শ্রদ্ধাপূর্বক যথাবিধি বেদাভ্যাস
  5. বেদজ্ঞান-যজ্ঞ : যুক্তিদ্বারা বেদার্থ নিশ্চয় করা
২৯) প্রাণবায়ু = হৃদয় হইতে যে বায়ু বাহিরে আসে; অপান বায়ু = বাহির হইতে যে বায়ু হৃদয়ে প্রবেশ করে ।
প্রাণায়াম : প্রাণ = প্রাণবায়ু, আয়াম = নিরোধ; অর্থাৎ প্রাণবায়ুর নিরোধ । ইহা তিন প্রকার - (i)পূরক, (ii)রেচক, (iii)কুম্ভক ।

পূরক প্রাণায়াম : প্রশ্বাস দ্বারা অপান বায়ুকে শরীর-ভিতরে প্রবেশ করাইলে প্রাণবায়ুর গতি রোধ হয়, ইহাই অপানে প্রাণের আহুতি; ইহাতে অন্তর বায়ুতে পূর্ণ হয় ।

রেচক প্রাণায়াম : নিঃশ্বাস দ্বারা প্রাণবায়ুকে শরীর থেকে নিঃসারণ করিলে অপান বায়ুর অন্তঃপ্রবেশরূপ গতিরোধ হয়, অর্থাৎ বাহিরের বায়ু ভিতরে প্রবেশ করিতে পারে না, ইহাই প্রাণে অপানের আহুতি; ইহাতে অন্তর বায়ুশূন্য হয় ।

কুম্ভক প্রাণায়াম : প্রাণ ও অপানের গতি রোধ করিয়া অর্থাৎ রেচন-পূরণ পরিত্যাগ-পূর্বক বায়ুকে শরীরের মধ্যে নিরুদ্ধ করিয়া অবস্থিতি করেন । এইরূপ কুম্ভকে শরীর স্থির হইলে ইন্দ্রিয়সমূহ প্রাণবায়ুতে লয় হইয়া যায়, ইহাই প্রাণে ইন্দ্রিয়সমূহের আহুতি ।

৩০) একথার তাৎপর্য এই যে, যজ্ঞই সংসারের নিয়ম । প্রত্যেকের কর্তব্য সম্পাদন দ্বারা, পরস্পরের ত্যাগ স্বীকার দ্বারা, আদান-প্রদান দ্বারাই জগৎ চলিতেছে এবং উহাতেই প্রত্যেকের সুখ-স্বাতন্ত্র্য অব্যাহত আছে । যে এই বিশ্ব-যজ্ঞ ব্যাপারে যোগদান করে না, যজ্ঞস্বরূপে স্বীয় কর্তব্য সম্পাদন করে না, তাহার ইহকাল ও পরকাল উভয়ই বিনষ্ট হয়, তাহার জীবন ব্যর্থ হয় । 

৩১) যজ্ঞাবশিষ্ট দ্রব্যকে অমৃত বলে । এ-স্থলে ইহা রূপকার্থক । যজ্ঞস্বরূপ কৃত নিষ্কাম কর্মদ্বারাই মোক্ষ লাভ হয় ।

৩৪) পরিপ্রশ্নেন - আমি কে ? আমার সংসার-বন্ধন কেন ? কিরূপে বন্ধনমুক্ত হইব ? ইত্যাদি প্রশ্ন দ্বারা ।

৩৭) 'ইহা দ্বারা মোটেই বুঝায় না যে, যখন জ্ঞান সম্পূর্ণ হয় তখন কর্ম বন্ধ হইয়া যায়' - [শ্রী অরবিন্দ]

পারমার্থিক জ্ঞান কি ? যাহা দ্বারা সর্বভূত এবং স্বীয় আত্মা অভিন্ন বোধ হয় এবং তারপর বোধ হয় সেই আত্মা শ্রীভগবানেরই সত্ত্বা, - আমি, সর্বভূত, যাহা কিছু তাঁহার সত্তায়ই সত্তাবান, তাঁহারই আত্ম-অভিব্যক্তি, তিনিই সকলের মূল [গী|৪|৩৫] । শ্রদ্ধা দ্বারাই অতীন্দ্রিয় এই পারমার্থিক জ্ঞানলাভ হয়, ভক্তি-বিশ্বাসই জ্ঞানের ভিত্তি ।

প্রাকৃত/লৌকিক জ্ঞান কি ? চক্ষু-কর্ণাদি ইন্দ্রিয় দ্বারা, বুদ্ধিবিচার দ্বারা নানা বিষয়ে আমরা যে জ্ঞানলাভ করি । ইহাতে শ্রদ্ধার প্রয়োজন হয় না । এই সকল নিম্নস্তরের সত্যের সহিত মিথ্যা মিশ্রিত থাকে, সংশয়বুদ্ধিতে পরীক্ষা করিয়া (scientific method) মিথ্যা হইতে সত্যকে পৃথক করিয়া লইতে হয় ।

৪০) যে অজ্ঞ, অর্থাৎ যাহার শাস্ত্রাদির জ্ঞান নাই, এবং যে সদুপদেশ লাভ করে নাই এবং যে শ্রদ্ধাহীন অর্থাৎ সদুপদেশ পাইয়াও যে তাহা বিশ্বাস করে না এবং তদনুসারে কার্য্য করে না, সুতরাং যে সংশয়াত্মা - অর্থাৎ যাহার সকল বিষয়েই সংশয় - এইটি কি ঠিক, না ঐটি ঠিক, - এইরূপ চিন্তায় যে সন্দেহাকুল তাহার অত্মোন্নতির কোন উপায় নাই । 

৪১) অর্থাৎ - জ্ঞানী কর্ম করিয়াও কর্মে আবদ্ধ হন না, সুতরাং জ্ঞানীরও কর্ম আছে, একথা স্পষ্টই বলা হইল, তবে সে কর্ম অকর্মস্বরূপ ।

রহস্য : কর্ম ও জ্ঞানে সংযোগ কিরূপে সম্ভব ? অদ্বৈত-ব্রহ্মজ্ঞানে কর্মের স্থান কোথায় ?
গতি ও স্থিতি, আলোক ও অন্ধকার যেমন একত্র থাকিতে পারে না, তদ্রূপ কর্ম ও জ্ঞানের সমুচ্চয় অসম্ভব বলিয়াই বোধ হয় । সন্ন্যাসবাদিগণ এইরূপ যুক্তিবলেই জ্ঞান-কর্মের সমুচ্চয় অস্বীকার করেন । নির্গুণ, নিষ্ক্রিয়, নির্বিশেষ ব্রহ্মও আছেন; আবার সগুণ সবিশেষ, ক্রিয়াশীল ব্রহ্মও আছেন - এই দুই বিভাব যাঁহার তিনিই পুরুষোত্তম [১৫|১৮] । 'আমিত্ব' বর্জন করিয়াও 'আমি' রাখা, জ্ঞানলাভ করিয়াও কর্ম করা - এটা অসম্ভব নহে । বস্তুত যোগিগণ সর্বদাই আবশ্যক কর্ম করেন যেমন রাজর্ষি জনকাদি, দেবর্ষি নারদাদি, ব্রহ্মর্ষি বশিষ্ঠাদি, মহর্ষি বিশ্বমিত্রাদি, পরমহংস রামকৃষ্ণাদি । সর্বোপরি শ্রীভগবান স্বয়ং নিজ কর্মের আদর্শ দেখাইয়া, জ্ঞানিগণকে বিশ্বকর্মে আহ্বান করিয়া বলিতেছেন - 'লোকরক্ষার্থ জ্ঞানিগণও অনাসক্তচিত্তে কর্ম করিবে' । ইহার উপর আর টীকা-টীপ্পনী চলে না, দার্শনিক মতবাদ যাহাই হউক ।

৪২) তুমি যুদ্ধে অনিচ্ছুক, কারণ তোমার হৃদয়ে নানারূপ সংশয় উপস্থিত হইয়াছে । গুরুজনাদি বধ করিয়া কি পাপভাগী হইব ? আত্মীয়-স্বজনাদির বিনাশে শোক-সন্তপ্ত হইয়া রাজ্যলাভেই বা কি সুখ হইবে ? এইরূপ শোক, মোহ ও সংশয়ে অভিভূত হইয়া তুমি স্বীয় কর্তব্য বিস্মৃত হইয়াছ । তোমার এই সংশয় অজ্ঞান-সম্ভূত । যাঁহার দেহাত্মবোধ বিদূরিত হইয়াছে, সর্বভূতে একাত্মবোধ জন্মিয়াছে - তাঁহার চিত্তে এ সকল সংশয় উদিত হয় না; তিনি শোক-দুঃখে অভিভূত হন না [ঈশোপনিষৎ|৭]; ইহাই প্রকৃত জ্ঞান, তাহা পূর্বে বলিয়াছি । শ্রদ্ধা, আত্মসংযম একনিষ্ঠা - সেই জ্ঞান লাভের যে উপায় তাহাও বলিয়াছি । আমার বাক্যে তোমার শ্রদ্ধা আছে, তোমার আত্মসংযম ও একনিষ্ঠা আছে, সুতরাং তোমাকে আমি জ্ঞানোপদেশ দিতেছি । তুমি আত্মজ্ঞান লাভপূর্বক নিঃসন্দেহ হইয়া নিষ্কাম কর্মযোগ অবলম্বন কর, স্বীয় কর্তব্য পালন কর, যুদ্ধ কর ।
___________________________
Online Source: 
http://geetabangla.blogspot.com/2011/09/blog-post.html

*Hard Copy Source:

"Sri Gita" or "Srimadbhagabadgeeta" by Gitashastri Jagadish Chandra Ghosh & Anil Chandra Ghosh. 26th Edition - June 1997 (1st Edition, 1925 from Dhaka now in Bangladesh). Published by Subhadra Dey (Ghosh), Presidency Library, 15 Bankim Chatterjee Street, Kolkata-700073. Printed by Web Impressions Pvt.Ltd., 34/2 Beadon Street, Kolkata-700006.



Disclaimer: This site is not officially related to Presidency LibraryKolkata. This is a personal, non-commercial, research-oriented effort of a novice religious wanderer.
এটি আধ্যাত্মিক পথের এক অর্বাচীন পথিকের ব্যক্তিগত, অবাণিজ্যিক, গবেষণা-ধর্মী প্রয়াস মাত্র ।

[Digitised by scanning (if required) and then by typing mostly in Notepad using Unicode Bengali "Siyam Rupali" font and Avro Phonetic Keyboard for transliteration. Uploaded by rk]


<Previous--Contents--Next>

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা : সপ্তদশ অধ্যায় - শ্রদ্ধাত্রয়‌-বিভাগযোগ (17-Jagadishchandra)


|||||||||১০|১১|১২|১৩|১৪|১৫|১৬|১৭|১৮
(গীতাশাস্ত্রী জগদীশচন্দ্র ঘোষ)*

অর্জুন কহিলেন -
হে কৃষ্ণ, যাঁহারা শাস্ত্রবিধি ত্যাগ করিয়া (অথচ) শ্রদ্ধাযুক্ত হইয়া যাগযজ্ঞ পূজাদি করিয়া থাকেন, তাঁহাদিগের নিষ্ঠা কিরূপ ? সাত্ত্বিকী, না রাজসী, না তামসী ? ১

শ্রীভগবান্‌ কহিলেন -
দেহীদিগের সাত্ত্বিকী, রাজসী ও তামসী, এই তিন প্রকারের শ্রদ্ধা আছে, উহা স্বভাবজাত অর্থাৎ পূর্বজন্মের সংস্কার-প্রসূত; তাহা বিস্তারিত বলিতেছি, শ্রবণ কর । ২

হে ভারত, সকলেরই শ্রদ্ধা নিজ নিজ অন্তঃকরণ-প্রবৃত্তি বা স্বভাবের অনুরূপ হইয়া থাকে । মনুষ্য শ্রদ্ধাময়; যে যেইরূপ শ্রদ্ধাযুক্ত, সে সেইরূপই হয় । ৩

সাত্ত্বিক ব্যক্তিগণ দেবগণের পূজা করেন, রাজসিক প্রকৃতির ব্যক্তিগণ যক্ষরক্ষদিগের পূজা করেন এবং তামসিক ব্যক্তিগণ ভূত-প্রেতের পূজা করিয়া থাকে । ৪

দম্ভ, অহঙ্কার, কামনা ও আসক্তিযুক্ত এবং বলগর্বিত হইয়া যে সকল অবিবেকী ব্যক্তি শরীরস্থ ভূতগণকে এবং অন্তর্যামিরূপে দেহমধ্যস্থ আমাকে কৃশ করিয়া (কষ্ট দিয়া) শাস্ত্রবিধিবিরুদ্ধ অত্যুগ্র তপস্যাদি করিয়া থাকে, তাহাদিগকে আসুরবুদ্ধিবিশিষ্ট বলিয়া জানিবে । ৫,৬

(প্রকৃতিভেদে) সকলেরই প্রিয় আহারও ত্রিবিধ হইয়া থাকে; সেইরূপ যজ্ঞ, তপস্যা এবং দানও ত্রিবিধ; উহাদের মধ্যে যেরূপ প্রভেদ তাহা শ্রবণ কর । ৭

যাহা আয়ু, উৎসাহ, বল, আরোগ্য, চিত্ত-প্রসন্নতা ও রুচি - এ সকলের বর্ধনকারী এবং সরস, স্নেহযুক্ত, সারবান্‌ এবং প্রীতিকর - এইরূপ (সাত্ত্বিক) আহার সাত্ত্বিক ব্যক্তিগণের প্রিয় । ৮

অতি কটু, অতি অম্ল, অতি লবণাক্ত, অতি উষ্ণ, তীক্ষ্ণ, বিদাহী এবং দুঃখ, শোক ও রোগ উৎপাদক (রাজসিক) আহার রাজস ব্যক্তিগণের প্রিয় । ৯

যে খাদ্য বহু পূর্বে পক্ক, যাহার রস শুষ্ক হইয়া গিয়াছে, যাহা দুর্গন্ধ, পর্যুষিত (বাসি), উচ্ছিষ্ট ও অপবিত্র, তাহা তামস ব্যক্তিগণের প্রিয় । ১০

ফলাকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করিয়া 'যজ্ঞ করিতে হয় তাই করি' এইরূপ অবশ্য-কর্তব্য বোধে শাস্ত্রবিধি অনুসারে শান্তচিত্তে যে যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয়, তাহা সাত্ত্বিক যজ্ঞ । ১১

কিন্তু হে ভরতশ্রেষ্ঠ, ফল লাভের উদ্দেশ্যে এবং দম্ভার্থে (নিজ ঐশ্বর্য, মহত্ত্ব বা ধার্মিকতা প্রকাশার্থ) যে যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয় তাহাকে রাজস-যজ্ঞ বলিয়া জানিবে । ১২

শাস্ত্রোক্ত বিধিশূন্য, অন্নদানহীন, শাস্ত্রোক্ত মন্ত্রহীন, দক্ষিণাহীন, শ্রদ্ধাশূন্য যজ্ঞকে তামস-যজ্ঞ বলে । ১৩

দেব, দ্বিজ, গুরু, বিদ্বান্‌ ব্যক্তির পূজা, শৌচ, সরলতা, ব্রহ্মচর্য, অহিংসা, এই সকলকে শারীর তপস্যা বলে । ১৪

যাহা কাহারও উদ্বেগকর হয় না, যাহা সত্য, প্রিয় ও হিতকর এইরূপ বাক্য এবং যথাবিধি শাস্ত্রাভ্যাস - এই সকলকে বাঙ্‌ময় বা বাচিক তপস্যা বলা হয় । ১৫

চিত্তের প্রসন্নতা, অক্রুরতা, বাক্‌-সংযম, আত্মসংযম বা মনসংযম এবং অন্যের সহিত ব্যবহারে কপটতারাহিত্য, এই সকলকে মানসিক তপস্যা বলে । ১৬

পূর্বোক্ত ত্রিবিধ তপস্যা যদি ফলাকাঙ্ক্ষাশূন্য, ঈশ্বরে একাগ্রচিত্ত ব্যক্তিগণ কর্তৃক পরম শ্রদ্ধা সহকারে অনুষ্ঠিত হয়, তবে তাহাকে সাত্ত্বিক তপস্যা বলে । ১৭

সৎকার, মান ও পূজা লাভ করিবার জন্য দম্ভ সহকারে যে তপস্যা অনুষ্ঠিত হয় এবং ইহলোকে যাহার ফল অনিত্য এবং অনিশ্চিত, তাহাকে রাজসিক তপস্যা বলে । ১৮

মোহাচ্ছন্নবুদ্ধিবশে নিজের শরীরাদিকেও পীড়া দিয়া অথবা জারণ, মারণাদি অভিচার দ্বারা পরের বিনাশার্থ যে তপস্যা অনুষ্ঠিত হয়, তাহাকে তামস তপস্যা বলে । ১৯

"দান করা উচিত, তাই দান করি" এইরূপ কর্তব্য-বুদ্ধিতে উপযুক্ত দেশ, কাল ও পাত্র বিবেচনা করিয়া অনুপকারী ব্যক্তিকে (অর্থাৎ প্রত্যুপকারের আশা না রাখিয়া) যে দান করা হয়, তাহাকে সাত্ত্বিক দান বলে । ২০

পরন্তু প্রত্যুপকারের আশায় অথবা স্বর্গাদি ফল কামনায় অতি কষ্টের সহিত যে দান করা হয়, তাহাকে রাজস দান বলে । ২১

অনুপযুক্ত দেশে, অনুপযুক্ত কালে এবং অনুপযুক্ত পাত্রে যে দান এবং (উপযুক্ত দেশকালপাত্রে প্রদত্ত হইলেও) সৎকারশূন্য এবং অবজ্ঞাসহকারে কৃত যে দান, তাহাকে তামস দান বলে । ২২

(শাস্ত্রে) 'ওঁ তৎ সৎ' এই তিন প্রকারে পরব্রহ্মের নাম নির্দেশ করা হইয়াছে; এই নির্দেশ হইতেই পূর্বকালে বেদবিদ্‌ ব্রাহ্মণ, বেদ ও যজ্ঞ সৃষ্ট হইয়াছে । ২৩

এই হেতু ব্রহ্মবাদিগণের যজ্ঞ, দান ও তপস্যাদি শাস্ত্রোক্ত কর্ম সর্বদা 'ওঁ" উচ্চারণ করিয়া অনুষ্ঠিত হয় । ২৪

যাঁহারা মোক্ষ কামনা করেন, তাঁহারা ফল কামনা ত্যাগ করিয়া 'তৎ' এই শব্দ উচ্চারণপূর্বক বিবিধ যজ্ঞ তপস্যা এবং দানক্রিয়ার অনুষ্ঠান করেন । ২৫

হে পার্থ, সদ্ভাব ও সাধুভাব অর্থাৎ কোন বস্তুর অস্তিত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব নির্দেশার্থ সৎ শব্দ প্রযুক্ত হয়; এবং (বিবাহাদি) মঙ্গল কর্মেও সৎ শব্দ ব্যবহৃত হয় । ২৬

যজ্ঞ, তপস্যা ও দানে স্থিতি অর্থাৎ নিষ্ঠা বা তৎপর হইয়া থাকাকেও সৎ বলে এবং এই সকলের জন্য যে কিছু কর্ম করিতে হয় তাহাও সৎ বলিয়া কথিত হয় । ২৭

হে পার্থ, হোম, দান, তপস্যা বা অন্য কিছু যাহা অশ্রদ্ধাপূর্বক অনুষ্ঠিত হয়, সে সমুদয় অসৎ বলিয়া কথিত হয় । সে সকল না ইহলোকে না পরলোকে ফলদায়ক হয় । ২৮

 ___________________________
(৩) পুরুষঃ = সংসারী জীবঃ (শঙ্কর) 

(৪) কিন্তু সকাম দেবোপসনা মিশ্রসাত্ত্বিক । উহাতে কাম্যবস্তু বা দেব-লোকাদি প্রাপ্তি হয়, ভগবৎ-প্রাপ্তি হয় না । নিষ্কামভাবে একমাত্র ভগবানের আরাধনাই শুদ্ধ সাত্ত্বিকী শ্রদ্ধা, ভাগবতে ইহাকেই নির্গুণা শ্রদ্ধা বলা হইয়াছে [ভাগবত ১১|২৫|২৬] ।
 

ত্রিবিধ শ্রদ্ধা :
শ্রদ্ধাই উপাসনার প্রাণ; যজ্ঞ, দান, ব্রত-নিয়মাদিরও মুখ্য কথা শ্রদ্ধা । প্রেমভক্তি-পথের প্রথম কথাই শ্রদ্ধা, শ্রদ্ধা হইতে ক্রমে রুচি, রাগ, ভাব ও নির্মল প্রেমের বিকাশ । - [ভক্তিরসামৃতসিন্ধু|১|৪|১১, চৈ.চ. মধ্য|২৩|৯|১০]
শ্রদ্ধা মনের ধর্ম, মন স্বভাবতই অন্ধ, শ্রদ্ধাও অন্ধ; বুদ্ধিদ্বারা চালিত না হইলে উহা অযোগ্য বস্তুতেই শ্রদ্ধা জন্মাইয়া জীবকে অধঃপাতিত করে । পক্ষান্তরে, মনে যদি শ্রদ্ধা না থাকে, লোকে যদি কেবল বুদ্ধিদ্বারাই চালিত হয়, তবে কেবল শুষ্ক পাণ্ডিত্য, বিতর্ক ও নাস্তিকতা আনয়ন করে ।
বুদ্ধিও সাত্ত্বিকাদি-ভেদে ত্রিবিধ এবং শ্রদ্ধা এই বুদ্ধিকর্তৃক চালিত হয় বলিয়া উহাও ত্রিবিধ হয় । তামসিকবুদ্ধি-প্রসূত তামসিক শ্রদ্ধা - দস্যুগণের নরবলি দিয়া কালীপূজা করা । রাজসিকবুদ্ধি-প্রসূত রাজসিক শ্রদ্ধা - ছাগমহিষাদি বলিদান করা । সাত্ত্বিকবুদ্ধি-প্রসূত সাত্ত্বিক শ্রদ্ধা - ছাগমহিষাদিকে কামক্রোধাদি পাশব বৃত্তির প্রতীকমাত্র বুঝিয়া ঐ সকল রিপুকে বলিদান করাই মায়ের শ্রেষ্ঠ অর্চনা বলিয়া মনে করা । 

(১০) সাত্ত্বিকাদি-ভেদে তিন প্রকার আহার :-
  1. সাত্ত্বিক আহার : যাহা আয়ু, উৎসাহ, বল, আরোগ্য, চিত্ত-প্রসন্নতা ও রুচি বর্ধনকারী এবং সরস, স্নেহযুক্ত, সারবান এবং প্রীতিকর ।
  2. রাজস আহার : অতি কটু, অতি অম্ল, অতি লবণাক্ত, অতি উষ্ণ, তীক্ষ্ণ, বিদাহী এবং দুঃখ, শোক ও রোগ-উৎপাদক ।
  3. তামস আহার : যে খাদ্য বহু পূর্বে পক্ক, যাহার রস শুষ্ক হইয়া গিয়াছে, যা হা দুর্গন্ধ, পর্যুষিত (বাসি) উচ্ছিষ্ট ও অপবিত্র ।

আহার-শুদ্ধি 
সর্বপ্রকার সাধনপক্ষেই, বিশেষতঃ ভক্তিমার্গে, আহারশুদ্ধির বিশেষ প্রাধান্য দেওয়া হয় । 'আহার শুদ্ধ হইলে চিত্ত শুদ্ধ হয়, চিত্ত শুদ্ধ হইলে সেই শুদ্ধ চিত্তে সর্বদা ঈশ্বরের স্মৃতি অব্যাহত থাকে' [ছান্দোগ্য ৭|২৬] ।
(1) শ্রীমৎ রামানুজাচার্যের মতে আহার = খাদ্য (food) । তাঁহার মতে খাদ্যের ত্রিবিধ দোষ পরিহার করা কর্তব্য । (i) জাতিদোষ অর্থাৎ খাদ্যের প্রকৃতিগত দোষ - যেমন মদ্য, মাংস, রশুন, পেঁয়াজ ইত্যাদি উত্তেজক খাদ্য; (ii) আশ্রয় দোষ - অর্থাৎ যে ব্যক্তির নিকট হইতে খাদ্য গ্রহণ করা যায়, তাহার দোষে খাদ্যে যে দোষ জন্মে - যেমন অশুচি, অতিকৃপণ, আসুর-স্বভাব, কুৎসিত-রোগাক্রান্ত খাদ্যবিক্রেতা, দাতা, পাচক বা পরিবেশনকারী প্রভৃতি; (iii) নিমিত্ত দোষ - অর্থাৎ খাদ্যে ধুলি, ময়লা, কেশ, মুখের লালা ইত্যাদি অপবিত্র দ্রব্যের সংস্পর্শ ।
(2) শ্রীমৎ শঙ্করাচার্যের মতে আহার = ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়জ্ঞান অর্থাৎ যাহা গ্রহণ করা যায় তাহাই আহার । তাঁহার মতে আহারশুদ্ধি অর্থ রাগ, দ্বেষ, মোহ এই ত্রিবিধ দোষবর্জিত হইয়া ইন্দ্রিয়ের দ্বারা বিষয়গ্রহণ ।
(3) স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন - "এই দুইটি ব্যাখ্যা আপাতবিরোধী বলিয়া বোধ হইলেও উভয়টিই সত্য ও প্রয়োজনীয় । সূক্ষ শরীর বা মনের সংযম, মাংস-পিণ্ডময় স্থূল শরীরের সংযম হইতে উচ্চতর কার্য বটে, কিন্তু সূক্ষের সংযম করিতে হইলে অগ্রে স্থূলের সংযম করা বিশেষ আবশ্যক । সুতরাং ইহা যুক্তিসিদ্ধ বোধ হইতেছে যে, খাদ্যাখাদ্যের বিচার মনের স্থিরতারূপ উচ্চাবস্থা লাভের জন্য বিশেষ আবশ্যক । নতুবা সহজে এই স্থিরিতা লাভ করা যায় না । কিন্তু আজকাল আমাদের অনেক সম্প্রদায়ে এই আহারাদির বিচারের এত বাড়াবাড়ি, এত অর্থহীন নিয়মের বাঁধাবাধি, এই বিষয়ে এত গোঁড়ামি যে, তাঁহারা যেন ধর্মটিকে রান্নাঘরের ভিতর পুরিয়াছেন । এইরূপ ধর্ম এক বিশেষ প্রকার খাঁটি জড়বাদ মাত্র । উহা জ্ঞান নহে, ভক্তিও নহে, কর্মও নহে ।" [ভক্তির সাধন, ভক্তিযোগ, স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, চতুর্থ খণ্ড, পৃঃ ৪০-৪১]


(১১) ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে শ্রীকৃষ্ণ এইরূপ সাত্ত্বিক যজ্ঞ করিতেই উপদেশ দিয়াছিলেন এবং তিনিও কর্তব্যানুরোধে নিষ্কামভাবে উহা সম্পন্ন করিয়াছিলেন । যুধিষ্ঠির বলিয়াছিলেন - "রাজপুত্রি, আমি কর্মফলান্বেষী হইয়া কোন কর্ম করি না; দান করিতে হয় তাই দান করি, যজ্ঞ করিতে হয় তাই যজ্ঞ করি; ধর্মাচরণের বিনিময়ে যে ফল চাহে, সে ধর্মবণিক, ধর্মকে সে পণ্যদ্রব্য করিয়াছে । সে হীন, জঘন্য ।" [মভাঃ বনপর্ব ৩১|২৫] 

(১৫) অপ্রিয় সত্য বলা অনুচিত - মনু ৪|১৩৮ । অপ্রিয় সত্য ও হিত্যবাক্য বলার ও শোনার লোক অতি বিরল - মহাভারতে বিদুরবাক্য । 

(১৮) সৎকার = সাধুকার অর্থাৎ এই ব্যক্তি বড় সাধু, তপস্বী - এইরূপ প্রশংসা-বাক্যাদি । মান = মানন অর্থাৎ প্রত্যুত্থান (আসিতে দেখিয়া উঠিয়া দাঁড়ান), অভিবাদন প্রভৃতি দ্বারা সম্মান প্রদর্শন । পূজা = পাদ প্রক্ষালন, আসনাদি দান, ভোজন করান ইত্যাদি ।
 

(১৮) এইরূপ তপস্যায় আত্মোন্নতি বা পারলৌকিক কোন স্থায়ী ফল হয় না, কেবল ইহলোকে ক্ষণস্থায়ী প্রতিষ্ঠা লাভ হইতে পারে । কিন্তু সেইরূপ প্রতিষ্ঠা লাভও যে হইবে তাহারও নিশ্চয়তা নাই । এই জন্য ইহাকে অনিত্য ও অধ্রুব বলা হইয়াছে । 

(২০) সাত্ত্বিক দান
সাত্ত্বিক দানের তিনটি লক্ষণ - (1) ফলাকাঙ্ক্ষা না করিয়া নিষ্কাম কর্তব্য-বুদ্ধিতে দান, (2) অনুপকারী ব্যক্তিকে দান (যে পূর্বে উপকার করেনি অথবা পরেও প্রত্যুপকার করিবে না তাহাকে দান নচেৎ উহা আদান-প্রদান হইয়া যায়), (3) উপযুক্ত দেশ, কাল ও পাত্র বিবেচনা করিয়া দান ।

(3a) উপযুক্ত দেশের উদাহরণ - যে গ্রামে বিশুদ্ধ পানীয় জলের অভাব, তথায়ই পুষ্করিণী প্রতিষ্ঠায় জলদানের ফল হয়, বড় শহরে উহার কোন প্রয়োজন নাই । প্রাচীন টীকাকারগণদের সঙ্কীর্ণ মতে কুরুক্ষেত্রাদি পুণ্যক্ষেত্র ।

(3b) উপযুক্ত কালের উদাহরণ  - কলেরার প্রাদুর্ভাবমাত্রেই ঔষধ দানের ব্যবস্থা করা বিধেয়, পূর্বে বা পরে উহাতে অর্থব্যয় করা নিষ্ফল । প্রাচীন টীকাকারগণদের সঙ্কীর্ণ মতে সংক্রান্তি গ্রহণাদি পুণ্যকাল ।

(3c) উপযুক্ত পাত্রের উদাহরণ  - অভাবগ্রস্থ বিপন্ন ব্যক্তিকেই দান করিতে হয়, অর্থশালীকে দান করা নিষ্ফল । প্রাচীন টীকাকারগণদের সঙ্কীর্ণ মতে বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ (শঙ্কর) ।

কিন্তু আধুনিকগণ এইরূপ সঙ্কীর্ণ অর্থ অনুমোদন করেন না । যেমন মনস্বী বঙ্কিমচন্দ্র লিখিয়াছেন - "সর্বনাশ ! আমি যদি স্বদেশে বসিয়া (অর্থাৎ পুণ্যক্ষেত্রাদিতে নয়) ১লা হইতে ২৯শে তারিখের মধ্যে (অর্থাৎ সংক্রান্তিতে নয়) কোন দিনে অতি দীনদুঃখী, পীড়ায় কাতর একজন মুচি বা ডোমকে (অর্থাৎ ব্রাহ্মণকে নয়) কিছু দান করি, তবে সে দান ভগবদভিপ্রেত দান হইল না ! এইরূপে কখন কখন ভাষ্যকারদিগের বিচারে অতি উন্নত, উদার ও সার্বভৈমিক যে ধর্ম তাহা অতি সঙ্কীর্ণ এবং অনুদার উপধর্মে পরিণত হইয়াছে । ইহারা যাহা বলেন তাহা ভগবদ্বাক্যে নাই, স্মৃতিশাস্ত্রে আছে । কিন্তু বিনা বিচারে ঋষিদিগের বাক্যসকল মস্তকের উপর এতকাল বহন করিয়া এই বিশৃঙ্খলা, অধর্ম ও দুর্দশায় আসিয়া পড়িয়াছি । এখন আর বিনা বিচারে বহন কর্তব্য নহে ।" [ধর্ম্মতত্ত্ব (অনুশীলন), বঙ্কিম রচনাসমগ্র]

প্রকৃত পক্ষে এ বিষয়ে ঋষিশাস্ত্রের কোনরূপ অনুদারতা নাই । শাস্ত্রের মর্ম বুঝিবার বা বুঝাইবার ত্রুটিতে আমাদের দুর্দশা । শাস্ত্রে দীনদুঃখী, আর্ত, পীড়িত, অভ্যাগত (visitor), এমন কি পশুপক্ষী, বৃক্ষলতাদির পর্যন্ত ধারণ-পোষণের ব্যবস্থা আছে । সর্বভূতের রক্ষাই গার্হস্থ্য ধর্ম, ইহাই শাস্ত্রের অনুশাসন । তবে বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণকে দান সর্বশ্রেষ্ঠ দান বলিয়া উল্লিখিত কারণ তাঁহারা হিন্দু-সমাজের প্রতিষ্ঠা ও বর্ণাশ্রম ধর্মাদির ব্যবস্থা করিয়াও অর্থাগমের যাবতীয় কর্মেই (যেমন রাজত্ব, প্রভুত্ব, কৃষি, শিল্প, বাণিজ্যাদি) অন্য জাতির অধিকার দিয়াছেন । নিজেরা উঞ্ছবৃত্তি বা অযাচিত দানের (প্রতিগ্রহ) উপর নির্ভর করিয়া সামান্য গ্রাসাচ্ছাদনে সন্তুষ্ট থাকিয়া সমাজে ধর্ম (যজন-যাজন) ও জ্ঞান (অধ্যয়ন, অধ্যাপনা) বিস্তারের ভার লইয়াছেন । ঈদৃশ পরার্থপর ত্যাগী ব্রাহ্মণজাতির রক্ষাকল্পে শাস্ত্রের যে সকল ব্যবস্থা তাহা সম্পূর্ণ যুক্তিসঙ্গত ও সমাজরক্ষার অনুকূল । আবার, বেদজ্ঞানহীন নিরগ্নি (অর্থাৎ স্বধর্ম পালনে পরাঙ্মুখ) দ্বিজবন্ধুদিগকে দান করিলে নিরয়গামী (condemned to hell) হইতে হয়, শাস্ত্রে এমন কঠোর অনুশাসনও রহিয়াছে । সুতরাং ঋষিশাস্ত্রের অনুদারতা বা পক্ষপাতিতা কোথাও নাই ।

গ্রহণাদি সময়ে বা পুণ্যক্ষেত্রাদিতে লোকের সাত্ত্বিক ভাব বৃদ্ধি হওয়ারই সম্ভাবনা থাকে, এই হেতু সেই কাল বা স্থান-দানাদি কর্মে প্রশস্ত বলিয়া বিবেচিত হইয়া থাকিবে, কেননা দানাদি কর্ম সাত্ত্বিক শ্রদ্ধার সহিত নিষ্পন্ন না হইলে নিষ্ফল হয় [গীতা ১৭|২৮] । কিন্তু কাল পরিবর্তনে ব্রাহ্মণজাতির ব্রাহ্মণত্ব বা তীর্থক্ষেত্রাদির মাহাত্ম্য যদি লোপ পায় এবং তদ্দরুণ লোকের ভক্তিশ্রদ্ধার যদি ব্যত্যয় ঘটে, তবে এই সকল বিধি-ব্যবস্থার কোন মূল্য থাকে না, তাহা বলাই বাহুল্য । সে স্থলে শাস্ত্রের প্রকৃত মর্ম ও উদ্দেশ্য বুঝিইয়া তদনুসারে কর্তব্যাকর্তব্য নির্ণয় করাই শ্রেয়কল্প; সংস্কারবশতঃ প্রাণহীন অনুষ্ঠান লইয়া বসিয়া থাকিলে ক্রমশঃ অধোগতি সুনিশ্চিত ।
 

(২৬) সদ্ভাব = থাকার ভাব বা অস্ত্যর্থে ।

(২৭) ওঁ তৎ সৎ (স্ফোট) - এই তিনটি ব্রহ্মবাচক । তিনটির পৃথক্‌ও ব্যবহার হয়, এক সঙ্গেও ব্রহ্ম নির্দেশার্থ ব্যবহৃত হয় । ওঁ (অ-উ-ম্‌) বা প্রণব বা শব্দব্রহ্ম বা স্ফোটরূপী ওঙ্কার হইতেই জগতের সৃষ্টি । " 'ওঁ' - গূঢ়াক্ষররূপী বৈদিক মন্ত্র; 'তৎ' - তাহা অর্থাৎ দৃশ্য জগতের অতীত দূরবর্তী অনির্বাচ্য তত্ত্ব; 'সৎ' - চক্ষুর সম্মুখস্থ দৃশ্য জগৎ । এই তিন মিলিয়া সমস্তই ব্রহ্ম, ইহাই এই সঙ্কল্পের অর্থ ।" - লোকমান্য তিলক । এ স্থলে বলা হইতেছে যে - 'ওঁ তৎ সৎ' এই ব্রহ্মনির্দেশ হইতে ব্রাহ্মণাদি কর্তা, করণরূপ বেদ এবং কর্মরূপ যজ্ঞ সৃষ্টি হইয়াছে । ইহারই নাম শব্দব্রহ্মবাদ । এই ওঙ্কারই জগতের অভিব্যক্তির আদি কারণ শব্দব্রহ্ম । ইহার নাম স্ফোট । স্ফোট হইতে কিরূপে জগতের সৃষ্টি হইল তাহা শ্রীমদ্ভাগবতে বর্ণিত আছে [ভা | ১২|৬|৩৩-৩৭] :-
১) সমাধিমগ্ন ব্রহ্মার হৃদাকাশ হইতে প্রথমত নাদ উৎপন্ন হইল;
২) নাদ হইতে ত্রিমাত্রা ওঙ্কার উৎপন্ন হইল যাহা সমস্ত বৈদিক মন্ত্রোপনিষদের বীজস্বরূপ;
৩) অব্যক্ত ওঙ্কারের অকার, উকার, মকার এই তিন বর্ণ প্রকাশ পাইল;
৪) এই তিন বর্ণ হইতে ক্রমশ সত্ত্বাদি গুণ, ঋগাদি বেদ, ভূর্ভুবাদি লোক অর্থাৎ জগৎপ্রপঞ্চ সৃষ্ট হইল ।

কর্মে ব্রহ্মনির্দেশ :
পূর্বে বলা হইয়াছে, ব্রহ্মবাচক স্ফোটরূপী ওঙ্কার হইতেই জগতের সৃষ্টি । জগতের ধারণ-পোষণের জন্য যজ্ঞসৃষ্টি । যজ্ঞ-শব্দে ব্যাপক অর্থে চাতুর্বর্ণ্যের আচরণীয় সমস্ত কর্ম বুঝায় । এই যজ্ঞ-কর্মের ব্যবস্থাই বেদে আছে এবং যজ্ঞরক্ষার ভার প্রধানত ব্রাহ্মণের উপর । ব্রাহ্মণ, বেদ ও যজ্ঞ পরব্রহ্ম হইতেই উৎপন্ন হইয়াছে; সুতরাং ব্রহ্মবাচক 'ওঁ তৎ সৎ' এই সঙ্কল্পই সমগ্র সৃষ্টির মূল । যজ্ঞ বা কর্মদ্বারাই সৃষ্টিরক্ষা হয়, সুতরাং 'ওঁ তৎ সৎ' এই সঙ্কল্পদ্বারাই সমস্ত কর্ম করিতে হয় । ইহার স্থূল মর্ম এই যে, সর্বকর্মই পরমাত্মাকে স্মরণ করিয়া ঈশ্বরার্পণ-বুদ্ধিতে করিবে অর্থাৎ কর্মকে ব্রহ্মকর্মে পরিণত করিবে, তাহা ত্যাগ করিবে না ।

___________________________
*Hard Copy Source:

"Sri Gita" or "Srimadbhagabadgeeta" by Gitashastri Jagadish Chandra Ghosh & Anil Chandra Ghosh. 26th Edition - June 1997 (1st Edition, 1925 from Dhaka now in Bangladesh). Published by Subhadra Dey (Ghosh), Presidency Library, 15 Bankim Chatterjee Street, Kolkata-700073. Printed by Web Impressions Pvt.Ltd., 34/2 Beadon Street, Kolkata-700006.


Online Reference:
1)"Dharma-tatta" by Sri Bankim Chandra Chattopadhyay. Bankim Rachanabali. Unicode compliant electronic edition provided by Society for Natural Language Technology Research.

2)"Bhaktir Sadhan" in Bhaktiyoga by Swami Vivekananda. Swamiji's Vani & Rachana. Volume-4, pp.40-41Unicode compliant electronic edition provided by Society for Natural Language Technology Research.


Disclaimer: This site is not officially related to Presidency LibraryKolkataThis is a personal, non-commercial, research-oriented effort of a novice religious wanderer.
এটি আধ্যাত্মিক পথের এক অর্বাচীন পথিকের ব্যক্তিগত, অবাণিজ্যিক, গবেষণা-ধর্মী প্রয়াস মাত্র ।

[Digitised by scanning (if required) and then by typing mostly in Notepad using Unicode Bengali "Siyam Rupali" font and Avro Phonetic Keyboard for transliteration. Uploaded by rk]


<Previous--Contents--Next>

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা : ষোড়শ অধ্যায় - দৈবাসুর-সম্পদ্‌-বিভাগযোগ (16-Jagadishchandra)


|||||||||১০|১১|১২|১৩|১৪|১৫|১৬|১৭|১৮
(গীতাশাস্ত্রী জগদীশচন্দ্র ঘোষ)*

শ্রীভগবান্‌ বললেন -
নির্ভীকতা, চিত্তসূদ্ধি, আত্মজ্ঞাননিষ্ঠা ও কর্মযোগে তৎপরতা, দান, বাহ্যেন্দ্রিয় সংযম, যজ্ঞ, শাস্ত্র-অধ্যয়ন, তপঃ, সরলতা, অহিংসা, সত্য, অক্রোধ, ত্যাগ, শান্তি, পরনিন্দাবরজন, জীবে দয়া, লোভহীনতা, মৃদুতা (অক্রৌর্য), কু-কর্মে লজ্জা, অচাঞ্চল্য, তেজস্বিতা, ক্ষমা, ধৃতি, শৌচ, দ্রোহ বা হিংসা না করা, অনভিমান, - হে ভারত, এই সকল গুণ দৈবী সম্পদ্‌ অভিমুখে জাত পুরুষের হইয়া থাকে । ১,২,৩ (অর্থাৎ যাঁহারা পূর্বজন্মের কর্মফলে দৈবী সম্পদ্‌ ভোগার্থ জন্মগ্রহণ করেন তাঁহাদেরই এই সকল সাত্ত্বিক গুণ জন্মিয়া থাকে) ।

হে পার্থ, দম্ভ, দর্প, অভিমান, ক্রোধ, নিষ্ঠুরতা এবং অজ্ঞান আসুরী সম্পদ্‌-অভিমুখে জাত ব্যক্তি প্রাপ্ত হয় অর্থাৎ এই সকল রাজসিক এবং তামসিক প্রকৃতির লোকের ধর্ম । ৪

দৈবী সম্পদ্‌ মোক্ষের হেতু এবং আসুরী সম্পদ্‌ সংসার-বন্ধনের কারণ হয় । হে পাণ্ডব, শোক করিও না; কারণ তুমি দৈবী সম্পদ্‌ অভিমুখে জন্মিয়াছ । ৫

হে পার্থ, এ জগতে দৈব ও আসুর এই দুই প্রকার প্রাণীর সৃষ্টি হয় । দৈবী প্রকৃতির বর্ণনা সবিস্তার করিয়াছি, এক্ষণে আসুরী প্রকৃতির কথা আমার নিকট শ্রবণ কর । ৬

আসুরভাবাপন্ন ব্যক্তিগণ জানে না যে, ধর্মে প্রবৃত্তিই বা কি আর অধর্ম হইতে নিবৃত্তিই বা কি, অর্থাৎ তাহাদের ধর্মাধর্ম, কর্তব্যাকর্তব্য জ্ঞান নাই । অতএব তাহাদের মধ্যে শৌচ, সদাচার বা সত্য কিছুই নাই । ৭

এই আসুর প্রকৃতির লোকেরা বলিয়া থাকে যে, এই জগতে সত্য বলিয়া কোন পদার্থ নাই, সকলই অসত্য; জগতে ধর্মাধর্মেরও কোন ব্যবস্থা নাই এবং ধর্মাধর্মের ব্যবস্থাপক ঈশ্বর বলিয়াও কোন বস্তু নাই । ইহা কেবল স্ত্রী-পুরুষের অন্যোন্যসংযোগে জাত (কামসম্ভূত) । স্ত্রী-পুরুষের কামই ইহার একমাত্র কারণ, ইহার অন্য কারণ নাই । ৮

পূর্বোক্ত দৃষ্টি (নিরীশ্বরবাদীদিগের মত) অবলম্বন করিয়া বিকৃতমতি, অল্পবুদ্ধি ক্রূরকর্মা ব্যক্তিগণ অহিতাচরণে প্রবৃত্ত হয়; তাহারা জগতের বিনাশের জন্যই জন্মগ্রহণ করিয়া থাকে । ৯

যাহা কখনও পূর্ণ হইবার নহে, এইরূপ কামনার বশীভূত হইয়া দম্ভ, অভিমান ও গর্বে মত্ত হইয়া, তন্ত্রমন্ত্রাদি দ্বারা স্ত্রী-রত্নাদি প্রাপ্ত হইব, অবিবেকবশতঃ এইরূপ দুরাশার বশবর্তী হইয়া অশুচিব্রত অবলম্বন করতঃ তাহারা কর্মে (ক্ষুদ্র দেবতাদির উপাসনায়) প্রবৃত্ত হইয়া থাকে । ১০

মৃত্যুকাল পর্যন্ত অপরিমেয় বিষয়-চিন্তা আশ্রয় করিয়া (যাবজ্জীবন নিরন্তর বিষয়চিন্তাপরায়ণ হইয়া) বিষয়ভোগনিরত এই সকল ব্যক্তি নিশ্চয় করে যে, কামোপভোগই পরম পুরুষার্থ, এতদ্ব্যতীত জীবনের অন্য লক্ষ্য নাই, সুতরাং ইহারা শত শত আশাপাশে বদ্ধ এবং কামক্রোধপরায়ণ হইয়া অসৎ মার্গ অবলম্বনপূর্বক অর্থ-সংগ্রহে সচেষ্ট হয় । ১১,১২

অদ্য আমার এই লাভ হইল, পরে এই ইষ্টবস্তু পাইব, এই ধন আমার আছে, এই ধন আমার পরে হইবে, এই শত্রুকে আমি পরাজিত করিয়াছি, অন্যান্যকেও হত করিব; আমি সকলের প্রভু, আমিই সকল ভোগের অধিকারী, আমি কৃতকৃত্য, আমি বলবান্‌, আমি সুখী, আমি ধনবান্‌, আমি কুলীন, আমার তুল্য আর কে আছে ? আমি যজ্ঞ করিব, দান করিব, মজা করিব - এই প্রকার অজ্ঞানে বিমূঢ়, বিবিধ বিষয়-চিন্তায় বিভ্রান্তচিত্ত, মোহজালে জড়িত, বিষয়ভোগে আসক্ত ব্যক্তিগণ অপবিত্র নরকে পতিত হয় । ১৩-১৬

আত্মশ্লাঘাযুক্ত, অবিনয়ী, ধনমানের গর্বে বিমূঢ় সেই আসুর প্রকৃতির ব্যক্তিগণ দম্ভ প্রকাশ করিয়া অবিধিপূর্বক নামমাত্র যজ্ঞ করে । ১৭

সাধুগণের অসূয়াকারী সেই সকল ব্যক্তি অহঙ্কার, বল, দর্প, কাম ও ক্রোধের বশীভূত হইয়া স্বদেহে ও পরদেহে অবস্থিত আত্মরূপী আমাকে দ্বেষ করিয়া থাকে । ১৮

এইরূপ দ্বেষপরবশ, ক্রুরমতি, নরাধম, আসুরপুরুষগণকে আমি সংসারে (ব্যাঘ্র-সর্পাদি) আসুরী যোনিতে পুনঃ পুনঃ নিক্ষেপ করিয়া থাকি । ১৯

হে কৌন্তেয়, এই সকল মূঢ় ব্যক্তি জন্মে জন্মে আসুরী যোনি প্রাপ্ত হয় এবং আমাকে না পাইয়া শেষে আরও অধোগতি (কৃমিকীটাদি যোনি) প্রাপ্ত হয় । ২০

কাম, ক্রোধ এবং লোভ - এই তিনটি নরকের দ্বারস্বরূপ, ইহারা আত্মার বিনাশের মূল (জীবের অধোগতির কারণ) । সুতরাং এই তিনটিকে ত্যাগ করিবে । ২১

হে কৌন্তেয়, নরকের দ্বারস্বরূপ এই তিনটি হইতে মুক্ত হইলে মানুষ আপনার কল্যাণ সাধনপূর্বক পরমগতি প্রাপ্ত হয় । ২২

যে ব্যক্তি শাস্ত্রবিধি ত্যাগ করিয়া স্বেচ্ছাচারী হইয়া কর্মে প্রবৃত্ত হয়, সে সিদ্ধি লাভ করিতে পারে না, তাহার শান্তি-সুখও হয় না, মোক্ষলাভও হয় না । ২৩

অতএব কর্তব্য-অকর্তব্য নির্ধারণে শাস্ত্রই তোমার প্রমাণ, সুতরাং তুমি শাস্ত্রোক্ত ব্যবস্থা জানিয়া (ইহায়) যথাধিকার কর্ম করিতে প্রবৃত্ত হও । ২৪

___________________________

(১-৩) আসুরিক প্রকৃতির লোক তাঁহাকে চিনে না, সুতরাং অবজ্ঞা করে; দৈবী বা সাত্ত্বিক প্রকৃতির লোক তাঁহাকে ভক্তি করে [৯|১১-১৩] । এই উভয় প্রকৃতির বিস্তারিত বর্ণনা এই অধ্যায়ে করা হইতেছে এবং আসুরী প্রকৃতির কিরূপে সংশোধন হয় তাহাও উপদেশ দেওয়া হইয়াছে । 
(৮) অথবা মতান্তরে, জগতের শাস্ত্রোক্ত কোন সৃষ্টি-পরম্পরা নাই । জগতের সকল পদার্থই মনুষ্যের কামনা-বাসনা তৃপ্ত করিবার জন্য । তাহাদের অন্য কোনও উপযোগ নাই । 
(১৭) এই সকল বিবেকহীন ব্যক্তি, বুদ্ধিভ্রংশকারী তামসী ও রাজসী প্রকৃতির বশে, আমাকে অবজ্ঞা করিয়া থাকে । উহাদের আশা ব্যর্থ, কর্ম নিষ্ফল, জ্ঞান নিরর্থক এবং চিত্ত বিক্ষিপ্ত । [৯|১২]

(১৮) আমি অন্তর্যামিরূপে সকলের মধ্যেই আছি, কিন্তু দম্ভবশে আমার অন্তর্যামিত্ব অস্বীকার করিয়া স্বদেহস্থিত আমাকে দ্বেষ করে এবং প্রাণি-হিংসাদি দ্বারা অন্য দেহেও আমাকে দ্বেষ করিয়া থাকে । 
(২৩) সিদ্ধি = পুরুষার্থ প্রাপ্তির যোগ্যতা (শঙ্কর); তত্ত্বজ্ঞান (শ্রীধর) ।

(২৪) শাস্ত্র = শ্রুতি-স্মৃতি-পুরাণাদি । ধর্মশাস্ত্র = কর্তব্যাকর্তব্য নির্ণায়ক শাস্ত্র; আধুনিকগণ ইহাকে নীতিশাস্ত্র বলেন । কিন্তু সংস্কৃত সাহিত্যে নীতিশাস্ত্র বলিতে কেবল রাজনীতিই বুঝায় । উহা ধর্মশাস্ত্রেরই অন্তর্গত ।

(২৪) ইহ = কর্মাধিকারে বর্তমান থাকিয়া (শ্রীধর); এই লোকে (তিলক); এই কর্মাধিকার-ভূমিতে অর্থাৎ ভারতবর্ষে (শঙ্কর) । ভারতবর্ষ কর্মভূমি, মোক্ষ সাধনার শ্রেষ্ঠ স্থান, দেবগণও এস্থানে জন্মগ্রহণ বাঞ্ছা করেন [বৃহন্নারদীয় পুরাণ ৩|৪৯-৫৬, ৬৯-৭৯; অপিচ, ভাগবত ৫|১৯-২৭] ।
___________________________
*Hard Copy Source:

"Sri Gita" or "Srimadbhagabadgeeta" by Gitashastri Jagadish Chandra Ghosh & Anil Chandra Ghosh. 26th Edition - June 1997 (1st Edition, 1925 from Dhaka now in Bangladesh). Published by Subhadra Dey (Ghosh), Presidency Library, 15 Bankim Chatterjee Street, Kolkata-700073. Printed by Web Impressions Pvt.Ltd., 34/2 Beadon Street, Kolkata-700006.



Disclaimer: This site is not officially related to Presidency LibraryKolkataThis is a personal, non-commercial, research-oriented effort of a novice religious wanderer.
এটি আধ্যাত্মিক পথের এক অর্বাচীন পথিকের ব্যক্তিগত, অবাণিজ্যিক, গবেষণা-ধর্মী প্রয়াস মাত্র ।

[Digitised by scanning (if required) and then by typing mostly in Notepad using Unicode Bengali "Siyam Rupali" font and Avro Phonetic Keyboard for transliteration. Uploaded by rk]


<Previous--Contents--Next>

Friday, March 13, 2015

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা : পঞ্চদশ অধ্যায় - পুরুষোত্তমযোগ (15-Jagadishchandra)


|||||||||১০|১১|১২|১৩|১৪|১৫|১৬|১৭|১৮
(গীতাশাস্ত্রী জগদীশচন্দ্র ঘোষ)*

শ্রীভগবান্‌ বললেন -
(বেদবিদ্‌গণ) বলিয়া থাকেন যে, (সংসাররূপ) অশ্বত্থের মূল ঊর্দ্ধদিকে এবং শাখাসমূহ অধোগামী; উহা অবিনাশী; বেদসমূহ উহার পত্রস্বরূপ; যিনি এই অশ্বত্থকে জানেন তিনিই বেদবিৎ । ১

সত্ত্বাদিগুণের দ্বারা বিশেষরূপে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত, বিষয়রূপ তরুণপল্লব-বিশিষ্ট উহার শাখাসকল অধোভাগে ও ঊর্ধ্বভাগে বিস্তৃত; উহার (বাসনারূপ) মূলসহ মনুষ্যলোকে অধোভাগে বিস্তৃত রহিয়াছে । ঐ মূলসমূহ ধর্মাধর্মরূপ কর্মের কারণ বা প্রসূতি । ২

এ সংসারে স্থিত জীবগণ সংসার-বৃক্ষের পূর্বোক্ত ঊর্দ্ধমূলাদি রূপ উপলব্ধি করিতে পারে না । সেইরূপ আদি, অন্ত এবং স্থিতিও উপলব্ধি করিতে পারে না । এই সুদৃঢ়মূল অশ্বত্থবৃক্ষকে তীব্র বৈরাগ্যরূপ শস্ত্রদ্বারা ছেদন করিয়া তৎপর যাঁহাকে প্রাপ্ত হইলে আর পুনর্জন্ম হয় না, যাঁহা হইতে এই সংসার-প্রবৃত্তির বিস্তার হইয়াছে, 'আমি সেই আদি পুরুষের শরণ লইতেছি' এই বলিয়া তাঁহার অন্বেষণ করিতে হইবে । ৩,৪

যাঁহাদের অভিমান ও মোহ নাই, যাঁহারা সংসার-আসক্তি জয় করিয়াছেন, যাঁহারা আত্মতত্ত্বে নিষ্ঠাবান্‌, যাঁহাদের কামনা নিবৃত্ত হইয়াছে, যাঁহারা সুখদুঃখ-সংজ্ঞক দ্বন্দ্ব হইতে মুক্ত, তাদৃশ বিবেকী পুরুষগণ সেই অব্যয় পদ প্রাপ্ত হন । ৫

যে পদ প্রাপ্ত হইলে সাধক আর সংসারে প্রত্যাবর্তন করেন না, যে পদ সূর্য, চন্দ্র বা অগ্নি প্রকাশ করিতে পারে না, তাহাই আমার পরম স্বরূপ । ৬

আমারই সনাতন অংশ জীব হইয়া প্রকৃতিতে অবস্থিত মন ও পাঁচ ইন্দ্রিয়কে সংসারে অর্থাৎ কর্মভূমিতে আকর্ষণ করিয়া থাকেন । ৭

যেমন বায়ু, পুষ্পাদি হইতে গন্ধবিশিষ্ট সূক্ষ কণাসমূহ লইয়া যায় তদ্রূপ যখন জীব এক দেহ পরিত্যাগ করিয়া অন্য দেহে প্রবেশ করেন, তখন এই সকলকে (এই পঞ্চ ইন্দ্রিয় ও মনকে) সঙ্গে করিয়া লইয়া যান । ৮

জীবাত্মা কর্ণ, চক্ষু, ত্বক্‌, রসনা, নাসিকা এবং মনকে আশ্রয় করিয়া শব্দাদি বিষয়সকল ভোগ করিয়া থাকেন । ৯

জীব কিরূপে সত্ত্বাদি গুণসংযুক্ত হইয়া দেহে অবস্থিত থাকিয়া বিষয়সমূহ ভোগ করেন, অথবা কিরূপে দেহ হইতে উৎক্রান্ত হন, তাহা অজ্ঞ ব্যক্তিগণ দেখিতে পান না, কিন্তু জ্ঞানিগণ জ্ঞাননেত্রে দর্শন করিয়া থাকেন । ১০

সাধনে যত্নশীল যোগিগণ আপনাতে অবস্থিত এই আত্মাকে দর্শন করিয়া থাকেন, কিন্তু যাহারা অজিতেন্দ্রিয় ও অবিবেকী তাহারা যত্ন করিলেও ইঁহাকে দেখিতে পায় না । ১১

যে তেজ সূর্যে থাকিয়া সমস্ত জগৎ উদ্ভাসিত করে এবং যে তেজ চন্দ্রমা ও অগ্নিতে আছে, তাহা আমারই তেজ জানিবে । ১২

আমি পৃথিবীতে অনুপ্রবিষ্ট হইয়া স্বকীয় বলের দ্বারা ভূতগণকে ধারণ করিয়া আছি । আমি অমৃতরসযুক্ত চন্দ্ররূপ ধারণ করিয়া ব্রীহি যবাদি ওষধিগণকে পরিপুষ্ট করিয়া থাকি । ১৩

আমি বৈশ্বানর (জঠরাগ্নি) রূপে প্রাণিগণের দেহে অবস্থান করি এবং প্রাণ ও অপান বায়ুর সহিত মিলিয়া চর্ব্য চূষ্যাদি চতুর্বিধ খাদ্য পরিপাক করি । ১৪

আমি অন্তর্যামিরূপে সকল প্রাণীর হৃদয়ে অধিষ্ঠিত আছি, আমা হইতেই প্রাণিগণের স্মৃতি ও জ্ঞান উৎপন্ন হইয়া থাকে এবং আমা হইতেই স্মৃতি ও জ্ঞানের বিলোপও সাধিত হয়; আমিই বেদসমূহের একমাত্র জ্ঞাতব্য, আমিই আচার্যরূপে বেদান্তের অর্থ-প্রকাশক এবং আমিই বুদ্ধিতে অধিষ্ঠিত থাকিয়া বেদার্থ পরিজ্ঞাত হই । ১৫

ক্ষর ও অক্ষর দুই পুরুষ ইহলোকে প্রসিদ্ধ আছে । তন্মধ্যে সর্বভূত ক্ষর পুরুষ এবং কূটস্থ অক্ষর পুরুষ বলিয়া কথিত হন । ১৬

অন্য এক উত্তম পুরুষ পরমাত্মা বলিয়া কথিত হন । তিনি লোকত্রয়ে প্রবিষ্ট হইয়া সকলকে পালন করিতেছেন, তিনি অব্যয়, তিনি ঈশ্বর । ১৭

যেহেতু আমি ক্ষরের অতীত এবং অক্ষর হইতেও উত্তম, সেই হেতু আমি লোক-ব্যবহারে এবং বেদে পুরুষোত্তম বলিয়া খ্যাত । ১৮

হে ভারত, যিনি মোহমুক্ত হইয়া এই ভাবে আমাকে পুরুষোত্তম বলিয়া জানিতে পারেন, তিনি সর্বজ্ঞ হন এবং সর্বতোভাবে আমাকে ভজনা করেন । ১৯

হে নিষ্পাপ, আমি এই অতি গুহ্যকথা তোমাকে কহিলাম । যে কেহ ইহা জানিলে জ্ঞানী ও কৃতকৃত্য হয় । (অতএব তুমিও যে কৃতার্থ হইবে তাহাতে সন্দেহ কি ?) ২০
___________________________

(১) সংসারবৃক্ষ (বৈদিক বর্ণনা) - এস্থলে সংসারকে অশ্বত্থ বৃক্ষের সহিত তুলনা করা হইয়াছে । এই সংসারবৃক্ষ ঊর্ধ্বমূল, কেননা পুরুষোত্তম বা পরমাত্মা হইতেই এই বৃক্ষ উৎপন্ন হইয়াছে । এই হেতু ইহাকে ব্রহ্মবৃক্ষও বলা হয় । [কঠ ৬|১, মভাঃ অশ্ব ৩৫|৪৭] । এই বৃক্ষের শাখাস্থানীয় মহত্তত্ত্ব, অহঙ্কার প্রভৃতি পরিণামগুলি ক্রমশঃ অধোগামী, এই হেতু ইহা অধঃশাখ । পুরুষোত্তম বা পরব্রহ্ম হইতে কিরূপে প্রকৃতির বিস্তার হইয়াছে তাহা জ্ঞান-বিজ্ঞান-যোগে বংশবৃক্ষে দ্রষ্টব্য । এই সংসারবৃক্ষ অব্যয়, কারণ ইহা অনাদি কাল হইতে প্রবৃত্ত । বেদত্রয় এই সংসারবৃক্ষের পত্র, কারণ পত্রসমূহ যেমন বৃক্ষের আচ্ছাদনহেতু রক্ষার কারণ, সেইরূপ বেদত্রয়ও ধর্মাধর্ম প্রতিপাদন দ্বারা ছায়ার ন্যায় সর্বজীবের রক্ষক ও আশ্রয়স্বরূপ । এই সংসারবৃক্ষকে যিনি জানেন তিনি বেদজ্ঞ, কারণ সমূল সংসারবৃক্ষকে জানিলে জীব, জগৎ, ব্রহ্ম এই তিনেরই জ্ঞান হয়, আর জানিবার কিছু অবশিষ্ট থাকে না ।
 
(২) সংসারবৃক্ষ (সাংখ্য-দৃষ্টিতে বর্ণনা) - এই সংসার প্রকৃতিরই বিস্তার । সুতরাং ঐ বৃক্ষের শাখাসকল গুণপ্রবৃদ্ধ, অর্থাৎ সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ, এই তিন গুণের দ্বারা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত । শব্দ-স্পরশাদি বিষয়সমূহ উহার প্রবাল বা তরুণপল্লব-স্থানীয় । এই হেতু উহা বিষয়-প্রবাল । উহার শাখাসমূহ ঊর্ধ্ব ও অধোদিকে বিস্তৃত অর্থাৎ কর্মানুসারে জীবসকল অধোদিকে পশ্বাদি যোনিতে এবং ঊর্ধ্ব দিকে দেবাদি যোনিতে প্রাদুর্ভূত হইয়া থাকে । উহার বাসনারূপ মূলসকল কর্মানুবন্ধী অর্থাৎ ধর্মাধর্মরূপ কর্মের প্রসূতি । এই মূলসকল অধোদিকে মনুষ্য-লোকে বিস্তৃত রহিয়াছে, কারণ মনুষ্যগণেরই কর্মাধিকার ও কর্মফল বিশেষরূপে প্রসিদ্ধ । 

(৬) তিনি স্বপ্রকাশ । তাঁহার প্রকাশেই জগৎ প্রকাশিত । জড় পদার্থ চন্দ্র-সূর্যাদি তাঁহাকে প্রকাশ করিবে কিরূপে ? এই শ্লোকটি প্রায় অক্ষরশঃই শ্বেতাশ্বতর ও কঠোপনিষদে আছে । 

(৭) জীব ও ব্রহ্মে ভেদ ও অভেদ - জীব ও ব্রহ্ম এক, না পৃথক্‌ ?

এ সম্বন্ধে নানারূপ মতভেদ লইয়াই দ্বৈতবাদ, অদ্বৈতবাদ, বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ, দ্বৈতাদ্বৈতবাদ প্রভৃতি মতবাদের সৃষ্টি হইয়াছে । গীতার নানাস্থলেই জীবব্রহ্মৈক্যবাদই স্বীকৃত হইয়াছে বলিয়া বোধ হয় । যেমন শ্রীভগবান্‌ বলিতেছেন - "আমিই সর্বভূতাশয়স্থিত আত্মা" [১০|২০], "আমাকে ক্ষেত্রজ্ঞ বলিয়া জানিও" [১৩|২], "আসুরী প্রকৃতির লোক শরীরস্থ আমাকে কষ্ট দেয়" [১৭|৬] । এই সকল স্থলে স্পষ্ট বলা হইয়াছে যে, ভগবান্‌ই দেহে জীবরূপে অবস্থিত আছেন । 'তত্ত্বমসি', 'সোহহং', 'অহং ব্রহ্মাস্মি', 'অয়মাত্মা ব্রহ্ম' - চারি বেদের এই চারিটি মহাবাক্যও এই সত্যই প্রচার করিতেছে যে, জীবই ব্রহ্ম ।

কিন্তু শ্রীভগবান্‌ এও বলিতেছেন - "জীব আমার সনাতন অংশ" [১৫|৭] । এ অংশ কিরূপ ? অদ্বৈতবাদী বলেন - ব্রহ্ম অখণ্ড, অপরিচ্ছিন্ন, নিরবয়ব, অদ্বয় বস্তু, উহার খণ্ডিত অংশ কল্পনা করা যায় না । এ স্থলে 'অংশ' বলিতে মহাকাশের অংশ ঘটাকাশ (ঘটের মধ্যে যে আকাশ আছে) বুঝিতে হইবে । ঘট ভাঙ্গিলে এক অপরিচ্ছিন্ন আকাশই থাকে । জীবেরও দেহোপাধিপশতঃ ব্রহ্ম হইতে পার্থক্য, দেহোপাধিনাশে এক অপরিচ্ছিন্ন ব্রহ্মসত্তাই অবশিষ্ট থাকে ('ব্রহ্মাদ্বয়ং শিষ্যতে') ।

অচিন্ত্য-ভেদাভেদবাদ - এই গৌড়ীয় বৈষ্ণব মতে জীব ও ঈশ্বর উভয়েই চিদ্রূপ - চেতন । এই নিমিত্ত অর্থাৎ জীব ও ব্রহ্মের চেতনাংশের সাদৃশ্যেই উভয়ের একত্ব । যেমন তেজোময় সূর্য হইতে অনন্ত রশ্মি বহির্গত হয়, অথবা অগ্নিপিণ্ড হইতে অগ্নিস্ফুলিঙ্গসমূহ নির্গত হয়, সেইরূপ ব্রহ্ম হইতে জীবসমূহের উৎপত্তি । অগ্নি ভিন্ন স্ফুলিঙ্গের পৃথক্‌ অস্তিত্ব নাই, ব্রহ্ম ভিন্নও জীবের পৃথক্‌ সত্তা নাই । স্ফুলিঙ্গ অগ্নিই বটে, কিন্তু ঠিক অগ্নিও নয়, অগ্নি-কণা । জীব ও ব্রহ্মেও সেইরূপ অভেদ ও ভেদ আছে, জীব ব্রহ্মকণা । 

(৮-১০) জন্মান্তর-রহস্য - জীবের উৎক্রান্তি - সূক্ষ শরীর

প্রশ্ন#1 - আত্মা অকর্তা, উদাসীন, নিত্যমুক্ত । প্রকৃতি বা দেহ-বন্ধনবশতঃই তিনি বদ্ধ হন । মৃত্যুর পর যখন সেই দেহ-বন্ধন চলিয়া যায়, তখনই ত তিনি মুক্ত হইয়া স্ব-স্বরূপ লাভ করিতে পারেন । তখন আর প্রকৃতি থাকে কোথায় ? 

প্রশ্ন#2 - জীব একদেহে পাপপুণ্যাদি সঞ্চয় করে, জন্মান্তরে অন্য দেহে তাহার ফল ভোগ করে, এই বা কিরূপ ব্যবস্থা ?

উত্তর - সাংখ্যের সৃষ্টিতত্ত্ব অনুসারে শরীর তিনরকম - (1) স্থূলশরীর - পঞ্চ স্থূলভূত (আকাশ, বায়ু, অগ্নি, অপ্‌, পৃথিবী) দ্বারা নির্মিত, চর্মচক্ষে দৃশ্যমান্‌; (2) সূক্ষশরীর বা লিঙ্গ-শরীর - মহত্তত্ত্ব, অহঙ্কার, দশেন্দ্রিয়, মন ও পঞ্চতন্মাত্র (শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধ) দ্বারা গঠিত (মোট ১৮টি সাংখ্যোক্ত তত্ত্ব); জ্ঞানচক্ষুদ্বারা দৃশ্যমান্‌; (3) কারণ-শরীর - সকলের মূল কারণ প্রকৃতি ।


মৃত্যুকালে পঞ্চভূতাত্মক স্থূল শরীরই বিনষ্ট হয়, সূক্ষ শরীর লইয়া জীব উৎক্রমণ করে এবং পূর্ব কর্মানুযায়ী নূতন স্থূল-দেহ ধারণ করিয়া ঐ সূক্ষ শরীর লইয়াই পাপপুণ্যাদি ফলভোগ করে এবং এই কারণেই উহার মন, বুদ্ধি, ধর্মাধর্মাদি সংস্কার অর্থাৎ স্বভাব পূর্বজন্মানুযায়ীই হয় । তবে জন্মগ্রহণ-কালে পিতামাতার দেহ হইতে লিঙ্গ-শরীর যে দ্রব্য আকর্ষণ করিয়া লয় তাহাতে তাহার দেহ-স্বভাবের ন্যূনাধিক ভাবান্তর ঘটিয়া থাকে । সুতরাং, কেবল স্থূল দেহের সংসর্গ লোপ হইলেই জীবের মুক্তি হয় না, সূক্ষ শরীরও যখন লোপ পায়, তখনই জীবের সত্যস্বরূপ প্রতিভাত হয় ।

এস্থলে পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয় ও মনকেই সূক্ষ শরীর বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে [১৫|৯] । দ্রষ্টব্য এই, 'ইন্দ্রিয়' বলিতে চক্ষু-কর্ণাদি স্থূল ইন্দ্রিয়যন্ত্র বুঝায় না, উহা স্থূল দেহের অন্তর্গত - প্রকৃত ইন্দ্রিয় বা ইন্দ্রিয়-শক্তিই সূক্ষ তত্ত্ব । বেদান্তমতে পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয়, পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয়, পঞ্চ প্রাণ এবং বুদ্ধি ও মন (মোট ১৭টি অবয়বে) সূক্ষ শরীর গঠিত । সাংখ্যমতে পঞ্চ প্রাণ একাদশ ইন্দ্রিয়েরই অন্তর্ভূক্ত ।

যোগিগণ সূক্ষদেহ লইয়া স্থূলদেহ হইতে বহির্গত হইয়া অন্য শরীরে প্রবেশ করিতে পারেন (মহাভারতে জনক-সুলভা সংবাদ ইত্যাদি দ্রষ্টব্য) ।

(১৩) শাস্ত্রে এইরূপ বর্ণনা আছে যে, চন্দ্র জলময় ও সর্বরসের আধার এবং চন্দ্রের এই রসাত্মক গুণেই বনস্পতিগণ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় । 

(১৪) দেহ যন্ত্রে এক খণ্ড রুটি ফেলিয়া দিলে উহা রক্তে পরিণত হয় । দেহাভ্যন্তরীণ কি কি প্রক্রিয়াদ্বারা এই পরিপাক-ক্রিয়া সাধিত হয়, তাহা জড়বিজ্ঞান বলিতে পারে । কিন্তু কোন, শক্তিবলে এই কার্য সাধিত হয়, তাহা জড়বিজ্ঞান জানে না । উহা ঐশ্বরিক শক্তি 

(১৫) আত্মচৈতন্য প্রভাবে জীবের স্মৃতি ও জ্ঞানের উদয় হইয়া থাকে এবং যে মোহবশতঃ স্মৃতি ও জ্ঞানের লোপ হয়, সেই মোহও ইহা হইতেই জাত । সমস্ত বেদেই তাঁহাকে জানিতে উপদেশ করেন । বেদব্যাসাদিরূপে তিনিই বেদার্থ-প্রকাশক এবং বেদবেত্তা বা ব্রহ্মবেত্তাও তিনিই, ব্রহ্ম না হইলে ব্রহ্মকে জানা যায় না । 


(১৯) তিনি সর্বজ্ঞ হন - অর্থাৎ আমাকে পুরুষোত্তম বলিয়া জানিলে আর জানিবার কিছু অবশিষ্ট থাকে না, সগুণ-নির্গুণ, সাকার-নিরাকার, দ্বৈতাদ্বৈত ইত্যাদি সংশয় আর তাঁহার উপস্থিত হয় না; তিনি জানেন, আমিই নির্গুণ পরব্রহ্ম, আমিই সগুণ বিশ্বরূপ, আমিই সর্বলোক-মহেশ্বর, আমিই লীলায় অবতার, আমিই হৃদয়ে পরমাত্মা, সুতরাং তিনি সকল ভাবেই আমাকে ভজনা করেন ।
___________________________
*Hard Copy Source:

"Sri Gita" or "Srimadbhagabadgeeta" by Gitashastri Jagadish Chandra Ghosh & Anil Chandra Ghosh. 26th Edition - June 1997 (1st Edition, 1925 from Dhaka now in Bangladesh). Published by Subhadra Dey (Ghosh), Presidency Library, 15 Bankim Chatterjee Street, Kolkata-700073. Printed by Web Impressions Pvt.Ltd., 34/2 Beadon Street, Kolkata-700006.



Disclaimer: This site is not officially related to Presidency LibraryKolkataThis is a personal, non-commercial, research-oriented effort of a novice religious wanderer.
এটি আধ্যাত্মিক পথের এক অর্বাচীন পথিকের ব্যক্তিগত, অবাণিজ্যিক, গবেষণা-ধর্মী প্রয়াস মাত্র ।

[Digitised by scanning (if required) and then by typing mostly in Notepad using Unicode Bengali "Siyam Rupali" font and Avro Phonetic Keyboard for transliteration. Uploaded by rk]


<Previous--Contents--Next>