Monday, April 13, 2015

শ্রীশ্রীগীতামাহাত্ম্যম্‌ (Padmapuran-1)


শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার প্রথম অধ্যায়ের মাহাত্ম্য

(শ্রীতারাকান্ত দেবশর্মা)*

পার্বতী কহিলেন -
হে ভগবন্‌, সর্বতত্ত্বজ্ঞ ! আপনার প্রসাদে আমি লোকনিস্তারক নানাবিধ শ্রীবিষ্ণুধর্ম শ্রবণ করিলাম । ১

এক্ষণে আমি গীতামাহাত্ম্য শুনিতে ইচ্ছা করি । হে দেবেশ ! গীতামাহাত্ম্য শ্রবণে হরিভক্তি বর্দ্ধিত হইয়া থাকে, অতএব আমি যদি বাস্তবিকই আপনার প্রিয় হই, তবে আমার নিকট উহা অধুনা প্রকাশ করিয়া বলুন । ২

ঈশ্বর কহিলেন -
অতসী-পুষ্প-সঙ্কাশ, গরুড়ধ্বজ, অচ্যুত মহাবিষ্ণু শেষশয্যায় শয়ন করিলে, আমরা তাঁহার উপাসনা করিতেছিলাম । ৩

একদা লোকানন্দদায়িনী লক্ষী রম্যাসনে সুখাসীন মুরারির নিকট জিজ্ঞাসা করিলেন, - ৪

লক্ষ্মীদেবী কহিলেন -
ভগবন্‌ ! আপনি কি কারণে উদাসীনের ন্যায় যেন জগতে স্বীয় ঐশ্বর্য্য স্থাপন করিবার নিমিত্তই ক্ষীরসাগরে শয়ন করিয়া রহিয়াছেন ? ৫

লক্ষ্মীদেবীর এই জ্ঞানগর্বিত বাক্য শ্রবণ করিয়া মুরারি বিস্ময়স্মের নয়নে মধুর বাক্যে বলিলেন, - ৬

ঈশ্বর কহিলেন -
হে সুমুখি ! আমি নিদ্রালু নহি । তত্ত্বানুবর্তিনী অন্তর্নিমগ্ন দৃষ্টি দ্বারা আমি স্বীয় মাহেশ্বরী বপু দর্শন করিতেছি । ৭

হে দেবি ! কুশাগ্রীয় বুদ্ধি দ্বারা যোগিগণ চরম মিমাংসা করিয়া হৃদয়াভ্যন্তরে যে বেদসার বস্তু অবলোকন করেন, ৮

তাহা অক্ষর, জ্যোতিঃস্বরূপ, অনাময়, অখণ্ডানন্দসন্দোহকর, দ্বৈতাদ্বৈতবর্জিত আত্মরূপ । ৯

এই জগদ্‌বৃত্তি তাঁহারই আশ্রিত; আমিও তাঁহাকে অনুভূতিগোচর করিতেছি । এই চরাচর জগত্তত্ব তাঁহা অতীত কিছুই নহে । ১০

বিচক্ষণ দ্বৈপায়ন বেদশাস্ত্র-সাগর আলোড়নপূর্বক বহুবার দেখিয়া শুনিয়া গীতাশাস্ত্র প্রকটন করিয়াছেন । ১১

হে দেবেশি ! উহা অবলম্বন করিয়া আমি মহানন্দে আনন্দীকৃত-মানসে দুগ্ধাব্ধিমধ্যে নিদ্রালুর-ন্যায় প্রতিভাত হইতেছি । ১২

মুরারির এই আনন্দযুক্ত স্বল্প বাক্য শ্রবণ করিয়া হর্ষোৎফুল্ল-বিলোলাক্ষী লক্ষ্মী কহিলেন, - ১৩

হে হৃষিকেশ ! আপনি যোগিগণের নিত্য ধ্যেয় । অতএব আপনার নিকট হইতেই পরম তত্ত্ব শ্রবণে আমার কৌতুহল হইয়াছে । ১৪

হে অচ্যুত ! আপনি চরাচর লোকের কর্তা, হর্তা ও স্বয়ম্প্রভুরূপে অবস্থিত, ইহা ভিন্ন আপনার যদি অন্য কোন তাত্ত্বিকরূপ থাকে, তাহা আমাকে বুঝাইয়া বলুন । ১৫

শ্রীভগবান্‌ কহিলেন -

হে দেবি ! এই যে দেহ দেখিতেছ ইহা তাত্ত্বিক নহে, মায়াময়; এই দেহ সৃষ্টি স্থিতি ও ধ্বংস ক্রিয়াসমূহে উপবৃংহিত । ১৬

ইহা ভিন্ন আমার অন্য যে আত্মরূপ, তাহা দ্বৈতাদ্বৈতবর্জিত, ভাবাভাববিরহিত ও আদ্যন্তহীন । ১৭

এরূপ শুদ্ধ সংবিৎপ্রভাদ্বারাই জ্ঞেয়, পরমানন্দৈকসুন্দর, আমার এই আত্মৈকগম্য ঐশ্বর রূপই গীতাশাস্ত্রে কীর্তিত । ১৮

লক্ষ্মীদেবী অমিততেজা মুরারির এই বাক্য শ্রবণ করিয়া পরস্পর বিরোধী বাক্যসমূহে সন্দেহাকূল হইয়া কহিলেন, - ১৯

আপনি স্বয়ং যদি অবাঙ্মনগোচর পরমানন্দ, তবে গীতা আপনাকে কিরূপে বোধিত করে ? আমার এই সংশয় আপনি ছেদন করুন । ২০

প্রভু মুরারি লক্ষ্মীর এই যুক্ত বাক্য শ্রবণ করিয়া আত্মানুগামিনী দৃষ্টিস্বরূপা গীতা ইতিহাসপূরঃসর বুঝাইতে লাগিলেন । ২১

ঈশ্বর কহিলেন -
হে পরেশানি ! আমি আত্মা পর অপর ভেদে দ্বিবিধ । পর সাক্ষী নির্গুণ, নিষ্কল, শিব স্বরূপ । ২২

আর অপর স্থুল-সূক্ষ্মরূপং ভেদে দ্বিবিধ, - অহস্পদবাচ্য জীবাখ্য পঞ্চবক্ত্র এবং অহংপদবাচ্য পরমাখ্যরূপ মহেশ্বর । ২৩

পঞ্চবক্ত্র এবং মহেশ্বরও যাহার অভ্যাসাধীন, গীতার বাক্যদ্বারা সেই সংসারবিষয়াত্মক মায়ার দৃঢ় বন্ধন ছিন্ন হইয়া যায় । ২৪

তখন এই পরাপর ভেদজ্ঞান উপলব্ধি করিয়া ভব-ভীরুগণ প্রবুদ্ধ হইয়া থাকে । ২৫

লক্ষ্মী দেবী তাঁহার সেই বাক্য শ্রবণ করিয়া গীতাসার-মহোদধির অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ-সংস্থানের বিষয় জিজ্ঞাসা করিলেন । মুরারি তাঁহাকে সেতিহাস গীতামাহাত্ম্য বলিতে লাগিলেন । ২৬

শ্রীভগবান্‌ কহিলেন -
হে সুশ্রোণি ! আমি গীতার আত্মসংস্থান কথা কহিতেছি, শ্রবণ কর । ২৭

গীতার পঞ্চাধ্যায় পঞ্চ বক্ত্র বলিয়া জানিবে । উহার দশাধ্যায় দশভুজ, একাধ্যায় উদর এবং দুই অধ্যায় পদাম্বুজ । ২৮

এইরূপে অষ্টাদশাধ্যায়া গীতাকে বাঙ্ময়ী ঐশ্বরী মূর্তি জানিবে । ইহা জানিবামাত্র মহাপাতকনাশ হয় । ২৯

যে সুমেধা ব্যক্তি ইহার অধ্যায়, অধ্যায়ার্দ্ধ, শ্লোক, শ্লোকার্দ্ধ বা তদর্দ্ধ অভ্যাস করেন, তিনি সুশর্মার ন্যায় মুক্ত হইয়া থাকেন । ৩০

শ্রীভগবান্‌ কহিলেন -

হে দেব ! সুশর্মা কে ? তিনি কোন্‌ জাতি ? কি প্রকার ? কি কারণে কিরূপে তাঁহার মুক্তি হইল ? ৩১

শ্রীভগবান্‌ কহিলেন -

সুশর্মা দুর্মেধা এবং পাপাত্মাদিগের সীমাস্বরূপ ছিল । অনাত্মজ্ঞ ক্রূরকর্মা বিপ্রগণের বংশে তাহার জন্ম হয় । ৩২

ধ্যান, জপ, হোম বা অতিথিপূজা কিছুই সে করিত না; কেবল বিষয়সমূহেই আসক্ত ছিল । ৩৩

সুশর্মা কৃষিকর্মরত নিত্য পর্ণজীবী সুরাপ্রিয় ও মাংসোপহারী হইয়া দীর্ঘকাল অতিবাহিত করিল । ৩৪

একদা পর্ণরাশি আনয়নার্থ সুশর্মা ঋষিবাটিকায় পরিভ্রমণ করিতে থাকিলে, এক কালসর্প তাহাকে দংশন করে । ৩৫

মূঢ়বুদ্ধি তাহাতেই মৃত্যুগ্রস্ত হইয়া নরকে পরিভ্রমণ করিতে লাগিল । নরকভোগান্তে পুনরায় সে মর্তলোকে আসিয়া এক বলীবর্দ হইল । ৩৬

এক পঙ্গু ব্যক্তি উহার প্রভু হইয়াছিল, সে স্বীয় জীবিকার জন্য উহাকে ক্রয় করিয়া লয় । বৃষ পঙ্গু প্রভুকে পৃষ্ঠে লইয়া কষ্টেসৃষ্টে সাত আট বৎসর কাটাইয়া দেয় । ৩৭

একদা পঙ্গু বৃষকে বহুকাল ধরিয়া দ্রুতবেগে নানাস্থানে ঘুরাইল । তাহাতে বৃষ সহসা ভূপতিত হইয়া মুর্চ্ছাগত হইল । ৩৮

বৃষ বিকলাঙ্গ ও বিবৃত্তাক্ষ হইয়া ফেনরাশি উদ্‌গিরণ করিতে থাকিল । স্বীয় কর্মফলে তাহার জীবন প্রাপ্তি বা মৃত্যু কিছুই হইল না । ৩৯

তথায় কৌতুক-দার্শনার্থ বহু জনসমাগম ঘটিল । তন্মধ্য হইতে কোন সুকৃতী ব্যক্তি বৃষের মঙ্গলার্থ তাহাকে পুণ্য দান করিলেন । ৪০

এইরূপ স্ব স্ব কর্ম স্মরণ করিয়া তখন অনেকেই তাহাকে পুণ্যদান করিল । সেই লোকসমবায়ের অনুবর্তিনী এক গণিকা তথায় অবস্থান করিতেছিল । ৪১

সে তাহার নিজ পুণ্য কিছু আছে কি না, জানিত না । সে তাহা না জানিয়াই বৃষের উদ্দেশে কিঞ্চিৎ পুণ্য দান করিল । অনন্তর যম-কিঙ্করেরা বৃষকে যমপুরে লইয়া গেল । ৪২

কিন্তু গণিকা তাহাকে যে পুণ্য দিয়াছিল, তাহারই ফলে সে পুণ্যবান্‌ শ্রেণীতে পরিগণিত হইয়া সেস্থান হইতে মোচিত হইল । অনন্তর ভূলোকে কুলশীলসম্পন্ন দ্বিজাতিগণের গৃহে তাহার জন্ম হইল । ৪৩

এ জন্মে বিপ্ররূপে নিজের অতীত জন্মস্মৃতি অক্ষুণ্ণ রহিল । অনেক দিন পরে বিপ্র স্বীয় অজ্ঞাননাশন মঙ্গল জিজ্ঞাসু হইয়া সেই গণিকার নিকট গমন করিলেন এবং তৎপ্রদত্ত পুণ্যের কথা উল্লেখ করিয়া জিজ্ঞাসা করিল । ৪৪

গণিকা উত্তর করিল, পঞ্জরস্থ শুক আমাকে পুণ্যকথা বলে, সে নিত্যই উহা পাঠ করিয়া থাকে । ৪৫

তাহাতেই আমি পূতচিত্ত হইয়া সেই পুণ্য দান করিয়াছিলাম । তখন বিপ্র এবং গণিকা উভয়েই শুকের নিকট জিজ্ঞাসা করিলে শুক পুণ্যকথা ব্যাখ্যানে উদ্যত হইল । সে নিজে জাতি স্মরণ করিয়া এক প্রাচীন আখ্যায়িকা কীর্তন করিতে লাগিল । ৪৬

শুক কহিল -
পুরাকালে আমি এক বিদ্বান্‌ ব্রাহ্মণ ছিলাম । ৪৭

পাণ্ডিত্যগর্বে মোহিত হইয়া রাগদ্বেষবশতঃ গুণবান্‌ বিদ্বান্‌ জনে মাৎসর্য্য প্রকাশ করিতাম । যথাকালে আমার মৃত্যু হইল । আমি নিন্দিত লোক প্রাপ্ত হইলাম । কীরকুলে আমার জন্ম হইল । কালধর্মক্রমে আমি দুষ্কর্মা হইলাম । পিতা-মাতা আমায় পরিত্যাগ করিলেন । ৪৮

গ্রীষ্মকালের প্রতপ্ত পথে আমি পতিত হইয়াছিলাম । ঋষিপুঙ্গবেরা দয়াপরবশ হইয়া আমাকে আনয়ন করেন এবং মহদ্‌জনের আশ্রয়স্থল আশ্রমে পঞ্জর মধ্যে রাখিয়া দেন । ৪৯

আশ্রমে ঋষিকুমারগণ গীতার আদ্য অধ্যায় সাদরে আবৃত্তি করিতেন । ঋষিকুমারগণের মুখে তাহা শ্রবণ করিয়া আমিও বারংবার তাহা পাঠ করিতাম । ৫০

ইতিমধ্যে এক চৌর্য্যব্যবসায়ী ব্যাধ আমাকে আশ্রম হইতে চুরি করিয়া লইয়া তৎকালে বিক্রয় করিল । এই আমার পূর্ববৃত্তান্ত বলিলাম । ৫১

শ্রীভগবান্‌ কহিলেন -

এই প্রথম অধ্যায় অভ্যাস করিয়াই শুক পাপাপনোদন করিয়াছিল । সেই দ্বিজোত্তম ইহা শ্রবণেই পূতচিত্ত হইয়া মুক্তি পাইয়াছিলেন । ৫২

এইরূপে তাহারা সকলেই পরস্পর আলাপ ও গীতামাহাত্ম্যের প্রশংসা করিয়া নিরন্তর উহা পাঠ করত স্বীয় গৃহেই মুক্তিলাভ করিয়াছিলেন । ৫৩

অতএব গীতার প্রথম অধ্যায় যিনি পাঠ, শ্রবণ, স্মরণ ও অভ্যাস করেন, তাঁহার পক্ষে ভবসাগর কখনই দুর্লঙ্ঘ্য হইবার নহে । ৫৪

[পদ্মপুরাণ, উত্তর খণ্ড, ১৭৫ অধ্যায়]
_________________________________________

চলিত বাংলায় সারাংশ


ভগবান বিষ্ণু বললেন -
প্রিয়ে লক্ষী, আমার সেবায় যার প্রবণতা আছে, সে'ই আমার বহুবিধ কর্মশক্তি এবং কিভাবে এই জন্ম-মৃত্যুর বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে বিশুদ্ধ বুদ্ধি দ্বারা আমার নিত্য প্রকৃতি সম্বন্ধে জানা যায় তা উপলব্ধি করতে পারে । শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় এই দিব্যজ্ঞানের কথা বিশদভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে ।

লক্ষীদেবী বললেন -
হে প্রিয় প্রভু, আপনি নিজেই যদি আপনার কর্মশক্তিতে বিস্ময়াভিভূত এবং সেই শক্তির পরমাপ করতে সদাই সচেষ্ট, তাহলে ভগবদ্গীতার পক্ষে আপনার সেই অসীম শক্তির পরিমাপ করা কিভাবে সম্ভব এবং কিভাবে সেই সব অতিক্রম করে আপনার চিন্ময় প্রকৃতি লাভ করা যাবে ?

ভগবান বিষ্ণু বললেন -
আমি নিজে ভগবদ্গীতারূপে প্রকাশিত হয়েছি । গীতার প্রথম পাঁচটি অধ্যায় আমার পাঁচটি মস্তক, পরের দশটি অধ্যায় আমার দশটি বাহু এবং ষোড়শ অধ্যায়টি আমার উদর এবং শেষ দুটি অধ্যায় হল আমার চরণ । এইভাবে ভগবদ্গীতার বিগ্রহকে বুঝতে হবে । ভগবদ্গীতা হল সর্ব পাপ-নাশক । কোন বুদ্ধিমান ব্যক্তি যদি প্রতিদিন গীতার একটি অধ্যায় বা একটি শ্লোক, অর্ধশ্লোক বা অন্ততপক্ষে এক চতুর্থাংশ শ্লোকও আবৃত্তি করে, তবে তারও সুশর্মার মতো একই গতি হবে ।

সুশর্মা বৃত্তান্ত :
সুশর্মা একজন অতি দুষ্ট ও খুবই পাপী লোক । সে একটি ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মালেও সেই পরিবারের কারও কোন বৈদিক জ্ঞান ছিল না । অন্যকে আঘাত করেই সে শুধু আনন্দ পেত । সে মদ-মাংস ভক্ষণ করত । সে কখনও বিষ্ণু নাম জপ করত না, কোন দান-ধ্যান বা কোন অতিথি সৎকার করত না । এইভাবে কোনরূপ ধর্ম-কর্ম সম্পাদন না করেই সে জীবন-যাপন করত । জীবিকা নির্বাহের জন্য সে শাক-পাতা সংগ্রহ করে বাজারে বিক্রি করত ।

একদিন সেই নির্বোধ সুশর্মা এক মুনির বাগানে শাক-পাতা সংগ্রহ করতে গিয়ে সর্প-দংশনে মারা যায় । মৃত্যুর পর বিভিন্ন নরকে নিক্ষিপ্ত হয়ে বহুদিন বহু কষ্ট ভোগ করার পর সে একটি ষাঁড়দেহ প্রাপ্ত হয় । একটি খোঁড়া লোক তাকে কিনে নিয়ে প্রায় সাত-আট বছর ধরে ভারী বোঝা বহন করায় । একদিন খোঁড়া লোকটি ষাঁড়টির উপর খুব ভারী বোঝা চাপিয়ে দ্রুত চলতে বাধ্য করায় ষাঁড়টি পড়ে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে গেল । অনেক লোক ঘটনাটি দেখতে জড়ো হল । তাদের মধ্যে একজন ধার্মিক ব্যক্তি ষাঁড়ের জন্য দুঃখ প্রকাশ করে তার কিছু ধর্ম-কর্মের ফল ষাঁড়টিকে দান করলেন । সেই দেখে দাঁড়িয়ে থাকা অন্যান্য লোকেরাও তাদের কিছু পুণ্য ফল ষাঁড়টিকে দান করল । সেই ভিড়ের মধ্যে এক গণিকাও ছিল । সে কখনও কোন পুণ্য কাজ করেছে বলে মনে করতে পারল না । কিন্তু অন্যদের দেখাদেখি সেও, যদি কখনো পুণ্য কর্ম করে থাকে তবে, তার ফল ষাঁড়টিকে অর্পণ করল ।

এরপর ষাঁড়টি মারা গেলে মৃত্যুর দেবতা যমরাজের আলয়ে তাকে নিয়ে আসা হল । সেখানে যমরাজ তাকে জানালেন, "গণিকাটির পুণ্য ফলে তুমি এখন পূর্বকৃত পাপকর্মের প্রতিক্রিয়া থেকে মুক্ত ।" এরপর তার বৈদিক সংস্কৃতি সম্পন্ন ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম হল । পূর্ব জীবনের কথা সে স্মরণ করতে পারত । অনেকদিন পর তার নারকীয় অবস্থা থেকে মুক্তির কারণ সেই গণিকাকে খুঁজে বার করে সে তার পরিচয় প্রদান করে তাকে জিজ্ঞাসা করল, "কি এমন পুণ্য কাজ তুমি করেছিলে যার ফল আমাকে আমার নারকীয় অবস্থা থেকে মুক্তি দিয়েছে ?" গণিকাটি উত্তর করল, " হে মহাশয়, এই খাঁচার মধ্যে একটি তোতাপাখি আছে, সে রোজ কিছু আবৃত্তি করে যা শুনে আমার মন সম্পূর্ণ বিশুদ্ধ হয়েছে । সেই আবৃত্তি শোনার ফল আমি তোমায় দিয়েছি ।" এরপর উভয়েই গেল সেই তোতা পাখিটির আবৃত্তি শোনার জন্য ।

তোতা পাখির কথা :
পূর্ব জীবনে আমি এক পণ্ডিত ব্রাহ্মণ ছিলাম । কিন্তু অহঙ্কার বশতঃ আমি অন্য সকল পণ্ডিত ব্যক্তিদের বিদ্রুপ করতাম । আমি খুব ঈর্ষাপরায়ণও ছিলাম । মৃত্যুর পর বহু নরকে নিক্ষিপ্ত হয়ে দীর্ঘিকাল যন্ত্রণা ভোগের পর এই পাখি দেহ লাভ করেছি । আমার অতীত পাপ-কাজের জন্য শৈশবেই আমার মাতা-পিতার মৃত্যু হয় । একদিন যখন আমি তপ্ত-বালির উপর অযত্নে পড়ে ছিলাম, তখন কতিপয় ঋষি দয়া করে আমাকে তাঁদের আশ্রমে নিয়ে গিয়ে একটি খাঁচার মধ্যে রেখে দেন । সেখানে ঋষিদের ছেলে-মেয়েরা শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার প্রথম অধ্যায়ের আবৃত্তি শিখছিল । আমিও তাদের সঙ্গে বারবার শ্লোকগুলি আবৃত্তি করা শুরু করলাম । অল্পকাল পরেই এক তস্কর সেখান থেকে আমাকে অপহরণ করে এই ধর্মপরায়ণা মহিলার কাছে বিক্রি করে দেয় ।"

ভগবান বিষ্ণু বলতে লাগলেন -
ভগবদ্গীতার প্রথম অধ্যায় আবৃত্তি করে তোতা-পাখিটি সম্পূর্ণরূপে শুদ্ধ হয়েছিল । আবৃত্তি শুনে সেই গণিকাটিও পূর্ণরূপে পরিশুদ্ধ হয় । আর আবৃত্তি শোনার কিছু পুণ্যফল লাভ করে সুষর্মাও সম্পূর্ণরূপে বিশুদ্ধ হয়ে গেল । কিছুকাল ভগবদ্গীতার প্রথম অধ্যায়ের মাহাত্ম্য আলোচনার পর সুষর্মা নিজগৃহে প্রত্যবর্তন করল এবং তারা তিন জন ব্যক্তিগতভাবে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার প্রথম অধ্যায়ের আবৃত্তিতে রত হল । শীঘ্রই তারা পরম ধাম বৈকুণ্ঠে পৌছে গেল ।

যে কেউ ভগবদ্গীতার প্রথম অধ্যায়ের আবৃত্তিকরণ, শ্রবণ বা অধ্যন করে, অনায়াসেই সে এই জড় দুঃখপূর্ণ ভবসাগর অতিক্রম করে ভগবান কৃষ্ণের শ্রীপাদপদ্ম সেবা লাভ করে ।


_________________________________________
*Hard Copy Source:
"Padmapuran, Uttarkhanda (Bengali)" by Veda Vyas, translated by Sri Tarakanta Debasharrma, Krishnadas Shastri and Sriramdas Shastri, edited by Pandit Panchanan Tarkaratna. Bangabasi-Electro-machine edition, 1915. Published & printed by Sri Natabar Chakraborty for Bangabasi Karyalay, 38/2 Bhabanicharan Datta Street, Kolkata. First Nababharat Edition, 2013 (with identical page layout). Nababharat Publishers, 72 D, Mahatma Gandhi Road, Kolkata-700009. 1062p.

Hard Copy Reference:
"Srimadvagabadgeeta Mahatmya (Bengali)compiled by Sri Sanatangopal Das Brahmachari. 6th Edition, 2014 (First Edition 2005)Printed & published by Bhaktivedanta Book Trust, Mayapur-741313, Nadia, West Bengal, India. © 2014 by Bhaktivedanta Book Trust.

Sanskrit Source
English Translation

[Digitised by scanning (if required) and then by typing mostly in Notepad using Unicode Bengali "Siyam Rupali" font and Avro Phonetic Keyboard for transliteration. Uploaded by rk]

<Previous--Contents--Next>

No comments:

Post a Comment