Wednesday, July 23, 2014

শ্রীমদ্ভগবদ্‌গীতা : প্রথম অধ্যায় – অর্জুনবিষাদযোগ (Gita : Chapter 1)

১|||||||||১০|১১|১২|১৩|১৪|১৫|১৬|১৭|১৮
(স্বামী জগদীশ্বরানন্দ)*
 
ধৃতরাষ্ট্র জিজ্ঞাসা করিলেন
“হে সঞ্জয়, পুণ্যভূমি কুরুক্ষেত্রে দুর্যোধনাদি আমার পুত্রগণ এবং যুধিষ্ঠিরাদি পাণ্ডবগণ যুদ্ধার্থে সমবেত হইয়া কি করিল ?” ১

জন্মান্ধ কুরুরাজ ধৃতরাষ্ট্রের অমাত্য সঞ্জয় কহিলেন -
তখন রাজা দুর্যোধন পাণ্ডবসৈন্যসমূহকে ব্যূহাকারে অবস্থিত দেখিয়া আচার্য দ্রোণের নিকট গমনপূর্বক এই কথা বলিলেন । ২

হে আচার্য, আপনার বুদ্ধিমান শিষ্য দ্রুপদপুত্র ধৃষ্টদ্যুম্ন এই ব্যূহ রচনা করিয়াছেন । আপনি পাণ্ডবগণের এই বিপুল সৈন্যসমাবেশ দর্শন করুন । ৩

এই পাণ্ডবসেনার মধ্যে যুদ্ধে ভীম ও অর্জুনের সমকক্ষ সাত্যকি, মৎস্যরাজ বিরাট, মহাযোদ্ধা দ্রুপদ, শিশুপালের পুত্র ধৃষ্টকেতু, যদুবংশীয় বীর চেকিতান, মহাবীর কাশীরাজ, পুরুজিৎ, রাজা কুন্তিভোজ, নরশ্রেষ্ঠ শৈব্য, পাঞ্চালদেশীয় রাজা পরাক্রমশালী যুধামন্যু ও মহাশক্তিমান্‌উত্তমৌজা, সুভদ্রার পুত্র অভিমন্যু, দ্রৌপদীর (প্রতিবিন্ধ্যাদি) পঞ্চপুত্র এবং অন্যান্য মহাধনুর্ধর বীরপুরুষগণ আছেন । ইঁহারা সকলেই মহারথ । ৪-৬

হে বিপ্রবর, আমাদের পক্ষে যে সকল বিশিষ্ট যোদ্ধা ও সেনাপতি আছেন তাঁহাদিগকে অবগত হউন । আপনার অবগতির জন্য তাঁহাদের নাম বলিতেছি । ৭

আমাদের পক্ষে আপনি (দ্রোণাচার্য), ভীষ্ম, কর্ণ, সমরজিৎ কৃপ, অশ্বত্থামা, আমার কনিষ্ঠ ভ্রাতা বিকর্ণ, সোমদত্তপুত্র ভূরিশ্রবা ও সিন্ধুরাজ জয়দ্রথ আছেন । ৮

আমার জন্য প্রাণ দান করিতে কৃতসঙ্কল্প অন্যান্য অনেক বীর আছেন । ইঁহারা সকলেই শস্ত্রনিক্ষেপে সুদক্ষ ও যুদ্ধনিপুণ । ৯

হে আচার্য, পিতামহ ভীষ্ম কর্তৃক সুরক্ষিত আমাদের সৈন্যবল অপরিমিত; কিন্তু ভীম কর্তৃক পরিচালিত পাণ্ডবসৈন্য পরিমিত । ১০

এক্ষণে আপনারা সকলেই সৈন্যব্যূহসমূহের প্রবেশদ্বারে স্ব স্ব স্থানে অবস্থিত হইয়া পিতামহ ভীষ্মকেই সর্বপ্রকারে রক্ষা করুন । ১১

কুরুকুলের প্রতাপশালী প্রবৃদ্ধ পিতামহ ভীষ্ম উচ্চ সিংহনাদপূর্বক শঙ্খধ্বনি করিতে লাগিলেন এবং তৎসঙ্গে দুর্যোধনের হৃদয় হর্ষপূর্ণ হইয়া উঠিল । ১২

অনন্তর অসংখ্য শঙ্খ, ভেরী, ঢাক, মৃদঙ্গ ও রণশিঙ্গা বাজিয়া উঠিল । সেই রণবাদ্য ভয়াবহ হইল । ১৩

তাহার পর বহু শ্বেতাশ্বযুক্ত এক মহারথে অবস্থিত মাধব (শ্রীকৃষ্ণ) এবং অর্জুনও দিব্য শঙ্খদ্বয় বাজাইলেন । ১৪

হৃষীকেশ (শ্রীকৃষ্ণ) পাঞ্চজন্য নামক শঙ্খ, ধনঞ্জয় (অর্জুন) দেবদত্ত নামক শঙ্খ এবং ঘোরকর্মা ভীম পৌণ্ড্র নামক মহাশঙ্খ বাজাইলেন । ১৫

কুন্তীপুত্র রাজা যুধিষ্ঠির অনন্তবিজয় নামক শঙ্খ এবং নকুল ও সহদেব যথাক্রমে সুঘোষ ও মণিপুষ্পক নামক শঙ্খদ্বয় বাজাইলেন । ১৬

হে পৃথ্বীপতি ধৃতরাষ্ট্র, মহাধনুর্ধর কাশীরাজ, মহারথ শিখণ্ডী ও ধৃষ্টদ্যুম্ন, রাজা বিরাট, অপরাজিত সাত্যকি, রাজা দ্রুপদ, দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্র এবং মহাবীর অভিমন্যু স্ব স্ব শঙ্খ পৃথক্‌ভাবে বাজাইলেন । ১৭-১৮

সেই তুমুল শঙ্খধ্বনি ধৃতরাষ্ট্রপুত্র দুর্যোধনাদির হৃদয় বিদীর্ণ করিয়া আকাশ ও পৃথিবী প্রতিধ্বনিত করিল । ১৯

হে মহীপতি, তখন কপিধ্বজ (বানর চিহ্নিত পতাকাযুক্ত) রথারূঢ় অর্জুন ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রগণকে যুদ্ধার্থে অবস্থিত দেখিয়া শস্ত্র-নিক্ষেপে উদ্যত হইয়া ধনু উত্তোলনপূর্বক শ্রীকৃষ্ণকে এই কথা বলিলেন । ২০

অর্জুন বলিলেন -
“যাবৎ যুদ্ধার্থ অবস্থিত ইহাদিগকে আমি নিরীক্ষণ করি ও এই মহারণে আমাকে কাহাদের সহিত যূদ্ধ করিতে হইবে তাহা নির্ণয় করি এবং দুর্বুদ্ধি দুর্যোধনের হিতকামী যে-সকল বীরপুরুষ যুদ্ধ করিবার জন্য এখানে উপস্থিত হইয়াছেন তাঁহাদিগকে পর্যবেক্ষণ করি, তাবৎ অচ্যুত (হে শ্রীকৃষ্ণ), উভয়পক্ষীয় সেনাদলের মধ্যে আমার রথ স্থাপন করুন ।” ২১-২৩

সঞ্জয় বলিলেন -
ভারত (রাজা দুষ্মন্তের পুত্র ভরতের বংশধর, হে ধৃতরাষ্ট্র), গুড়াকেশ (জিতনিদ্র) অর্জুন শ্রীকৃষ্ণকে এইরূপ বলিলে শ্রীকৃষ্ণ উভয় সেনার মধ্যে এবং ভীষ্ম, দ্রোণ ও অন্যান্য মহীপতিগণের সম্মুখে উত্তম রথ স্থাপন করিয়া বলিলেন -

শ্রীকৃষ্ণ বলিলেন -
“হে পার্থ, যুদ্ধার্থ সমবেত কৌরবগণকে অবলোকন কর ।” ২৪-২৫

সেখানে পার্থ উভয় সেনাদলের মধ্যে ভূরিশ্রবাদি পিতৃব্যগণ, ভীষ্মাদি পিতামহগণ, দ্রোণাদি আচার্যগণ, শল্যাদি মাতুলগণ, ভীমদুর্যোধনাদি ভ্রাতৃগণ, লক্ষণাদি পুত্রগণ, পৌত্রগণ, অশ্বত্থামাদি বন্ধুগণ, দ্রুপদাদি শ্বশুরগণ এবং কৃতবর্মাদি সুহৃদগণকে অবস্থিত দেখিলেন । ২৬

অর্জুন সেই বন্ধুগণকে যুদ্ধক্ষেত্রে অবস্থিত দেখিয়া অতিশয় করুণাবিষ্ট হইয়া দুঃখ করিতে করিতে এই বাক্য বলিলেন । ২৭

অর্জুন বলিলেন -

“হে কৃষ্ণ, আত্মীয়বর্গকে যুদ্ধার্থ উপস্থিত দেখিয়া আমার অঙ্গপ্রত্যঙ্গাদি অবসন্ন ও মুখ শুষ্ক হইতেছে । আমার শরীর কম্পিত ও রোমাঞ্চিত হইতেছে । আমার হস্ত হইতে গাণ্ডীব-ধনু খসিয়া পড়িতেছে এবং চর্ম যেন দগ্ধ হইতেছে । ২৮-২৯

হে কেশব, আমি আর স্থির থাকিতে পারিতেছি না; আমার মন যেন ঘূর্ণিত হইতেছে এবং আমি অমঙ্গলসূচক লক্ষণসমূহ দেখিতেছি । ৩০

হে কৃষ্ণ, যুদ্ধে আত্মীয়গণকে হত্যা করিলে মঙ্গল হইবে, ইহা অনুভব করিতেছি না । আমি যুদ্ধে জয়লাভ চাহি না, রাজ্য এবং সুখভোগও কামনা করিনা । ৩১

হে গোবিন্দ, আমাদের রাজ্যে কি প্রয়োজন, আর সুখভোগে বা জীবন-ধারণেই বা কি প্রয়োজন ? কারণ, যাঁহাদের নিমিত্ত রাজ্য, ভোগ ও সুখাদি আমাদের অভিলষিত, সেই আচার্যগণ, পিতৃব্যগণ, পুত্রগণ, পিতামহগণ, মাতুলগণ, শ্বশুরগণ, পৌত্রগণ, শ্যালকগণ ও স্বজনগণই প্রাণ ও ধনাদির আশা পরিত্যাগ করিয়া যুদ্ধে উপস্থিত হইয়াছেন । ৩২-৩৩

হে মধুসূদন, ইহারা আমাদিগকে বধ করিলেও ত্রৈলোক্য-রাজ্যের জন্যও ইহাদিগকে বধ করিতে ইচ্ছা করি না, পৃথিবীমাত্র রাজ্যের জন্য কি কথা ? ৩৪

হে জনার্দন, দুর্যোধনাদি ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রগণকে বধ করিলে আমাদের কি সুখ হইবে ? এই সকল আততায়ীকে হত্যা করিলে আমাদিগকে পাপ আশ্রয় করিবে । ৩৫

অতএব দুর্যোধনাদি ও তাহাদের বান্ধবগণকে আমাদের হত্যা করা উচিত নয় । হে মাধব, স্বজনগণকে হত্যা করিয়া আমরা কিরূপে সুখী হইব ? ৩৬

যদিও ইহারা রাজ্যলোভে অভিভূত হইয়া কুলক্ষয়জনিত দোষ ও মিত্রদ্রোহনিমিত্ত পাপ দেখিতেছে না, (কিন্তু) হে জনার্দন, বংশনাশজনিত দোষ উপলব্ধি করিয়াও আমরা এই পাপ হইতে নিবৃত্ত হইবার উপায় জানিব না কেন ? ৩৭-৩৮

কুলনাশে চিরাচরিত কুলধর্ম অনুষ্ঠাতার অভাবে নষ্ট হয় এবং কুলধর্মলোপে সমগ্র কুল অনাচাররূপ অধর্মে অভিভূত হয় । ৩৯

হে কৃষ্ণ, অধর্মের দ্বারা অভিভূত হইলে কুললক্ষ্মীগণ দুষ্টা হয় । হে বার্ষ্ণেয়, কুলস্ত্রীগণ দুষ্টা হইলে বর্ণসঙ্কর উৎপন্ন হয় । ৪০

কুলের সংমিশ্রণ হইলে কুলনাশকগণ নরকগামী হয় এবং শ্রাদ্ধতর্পণাদি ক্রিয়া লুপ্ত হওয়ায় তাঁহাদের পিতৃপুরুষগণও নরকে পতিত হন । ৪১

এই সকল বর্ণসঙ্করকারক দোষের দ্বারা কুলনাশকগণের সনাতন বর্ণধর্ম, কুলধর্ম ও আশ্রমধর্ম উৎসন্ন হয় । ৪২

হে জনার্দন, যাহাদের কুলধর্ম উৎসন্ন হইয়াছে, তাহাদের নিরন্তর নরকে বাস করিতে হয়, ইহা আমরা শাস্ত্র ও আচার্যের মুখে অবগত আছি । ৪৩

হায় ! আমরা কি মহাপাপ করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছি, যেহেতু আমরা রাজ্যসুখের লোভে স্বজনগণকে হত্যা করিতে উদ্যত । ৪৪

প্রতীকাররহিত ও নিরস্ত্র আমাকে যদি শস্ত্রধারী ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণ যুদ্ধে বধ করেন, তাহাতে আমার অধিকতর কল্যাণ হইবে। আমার পক্ষে জীবনধারণ অপেক্ষা মরণই প্রিয়তর । ৪৫

সঞ্জয় বলিলেন -
অর্জুন এইরূপ বলিয়া ধনুর্বাণ ত্যাগপূর্বক শোকাকুল চিত্তে রথোপরি উপবেশন করিলেন । ৪৬

ভগবান্‌ ব্যাসকৃত লক্ষশ্লোকাত্মক শ্রীমহাভারতের ভীষ্মপর্বের অন্তর্গত শ্রীমদ্ভগবদ্গীতারূপ উপনিষদে ব্রহ্মবিদ্যাবিষয়ক যোগশাস্ত্রে শ্রীকৃষ্ণার্জুনসংবাদে অর্জুনবিষাদযোগ নামক প্রথম অধ্যায় সমাপ্ত ।
_________________________________________


১) কুরুক্ষেত্র = কুরু নামক এক কৌরব রাজার নামানুসারে এই পুণ্যভূমির নাম কুরুক্ষেত্র

৩) ব্যূহ = যুদ্ধক্ষেত্রে সৈন্যস্থাপন, সেনাবিন্যাস

৬) মহারথ = যে বীর দশ হাজার ধনুর্ধরের সহিত একাকি যুদ্ধ করিতে সমর্থ ও শস্ত্রবিদ্যায় প্রবীণ

৮) দ্রোণাচার্য = পাণ্ডবদিগের অস্ত্রাচার্য ও মহর্ষি ভরদ্বাজের পুত্র । ইনি একটি দ্রোণ বা কলসের মধ্যে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন বলে এই নাম প্রাপ্ত হন ।

১৫) ধনঞ্জয় = যিনি দিগ্বিজয় করিয়া কুবেরাদির ধন জয় (লাভ) করিয়াছিলেন
হৃষীকেশ = হৃষীক (ইন্দ্রিয়) + ঈশ (কর্তা) = ইন্দ্রিয়গণের পরিচালক পরমাত্মা
পাঞ্চজন্য = শ্রীকৃষ্ণ কর্তৃক নিহত পঞ্চজনের অস্থিতে এই শঙ্খ নির্মিত

২৪) গুড়াকেশ = গুড়াকা (নিদ্রা) + ঈশ (জেতা), অর্থাৎ যিনি নিদ্রা জয় করিয়াছেন

২৮) কৃষ্ণ = যিনি ভক্তকে আকর্ষণ করেন বা যিনি ভক্তের দুঃখ কর্ষণ (বিনাশ) করেন

৩০) অমঙ্গলসূচক লক্ষণসমূহ = বামনেত্রস্ফুরণাদি (আনন্দগিরি); লোকক্ষয়কারী ভূমিকম্পাদি (নীলকণ্ঠ)

৩৫) আততায়ী = যে ঘরে আগুন দেয়, যে অন্যকে বিষ দেয়, বধার্থ অস্ত্রধারী, ধনাপহারী, ভূমি-অপহারী ও দারাপহারী - এই ছয়জন । অর্থশাস্ত্রানুসারে আততায়ীবধ বিহিত হইলেও ধর্মশাস্ত্রানুসারে আচার্যাদি আততায়ীকে বধ করা নিষিদ্ধ - অর্জুন এইরূপ ভাবিতেছেন ।


_________________________________________

*Hard Copy Source:
"Srimadbhagabadgeeta" translated by Swami Jagadeeshwarananda, edited by Swami Jagadananda. 27th Reprint - January, 1997 (1st Edition - 1941), © President, Sriramkrishna Math, Belur. Published by Swami Satyabrotananda, Udbodhan Office, 1 Udbodhan Lane, Bagbazar, Kolkata-700003. Printed by Rama Art Press, 6/30 Dum Dum Road, Kolkata-700030.

Sanskrit Source
English Translation

Disclaimer:
This site is not officially related to Ramakrishna Mission & Math. This is a personal, non-commercial, research-oriented effort of a novice religious wanderer.
এটি আধ্যাত্মিক পথের এক অর্বাচীন পথিকের ব্যক্তিগত, অবাণিজ্যিক, গবেষণা-ধর্মী প্রয়াস মাত্র ।

[Digitised by scanning (if required) and then by typing mostly in Notepad using Unicode Bengali "Siyam Rupali" font and Avro Phonetic Keyboard for transliteration. Uploaded by rk

No comments:

Post a Comment