[২য় হইতে ১০ম অধ্যায় পর্যন্ত নির্বিশেষ নিরুপাধি পরমাত্মা অক্ষর ব্রহ্মের উপাসনা এবং সর্বজ্ঞ সর্বশক্তিমান্ পরমেশ্বরের উপাসনা কথিত হইয়াছে । বিশ্বরূপাধ্যায়ে উপাসনার নিমিত্ত আপনার ঈশ্বরীয় আদ্য সমস্ত জগদাত্ম বিশ্বরূপ অনুগ্রহপূর্বক অর্জুনকে দেখাইয়া তাঁহাকে 'মৎকর্মকৃৎ' ইত্যাদি হইতে বলিয়াছেন । এই উভয় প্রকার উপাসনার কোন্টি বিশিষ্টতর ইহা জানিতে ইচ্ছা করিয়া -]
অর্জুন জিজ্ঞাসা করিলেন -
হে ভগবান্ এইভাবে নিরন্তর ভগবৎকর্মাদিতে নিযুক্ত হইয়া যে-সকল অনন্যশরণ ভক্ত সমাহিতচিত্তে আপনার উপাসনা করেন এবং যাঁহারা সমস্ত বাসনা ও কর্ম পরিত্যাগপূর্বক সর্বোপাধিরহিত ইন্দ্রিয়াতীত অক্ষর ব্রহ্মের উপাসনা করেন, এই উভয়ের মধ্যে কাহারা শ্রেষ্ঠ যোগী ? ১
হে ভগবান্ এইভাবে নিরন্তর ভগবৎকর্মাদিতে নিযুক্ত হইয়া যে-সকল অনন্যশরণ ভক্ত সমাহিতচিত্তে আপনার উপাসনা করেন এবং যাঁহারা সমস্ত বাসনা ও কর্ম পরিত্যাগপূর্বক সর্বোপাধিরহিত ইন্দ্রিয়াতীত অক্ষর ব্রহ্মের উপাসনা করেন, এই উভয়ের মধ্যে কাহারা শ্রেষ্ঠ যোগী ? ১
শ্রীভগবান্ বলিলেন -
পরমেশ্বরের ভজন দ্বারাই জীবের উদ্ধার হয় - এই বিশ্বাস দৃঢ় করিয়া যাঁহারা আমার বিশ্বরূপে মনোনিবেশপূর্বক মচ্চিত্ত হইয়া অহোরাত্র অতিবাহিত করেন, তাঁহারাই আমার মতে শ্রেষ্ঠ যোগী । ২
পরমেশ্বরের ভজন দ্বারাই জীবের উদ্ধার হয় - এই বিশ্বাস দৃঢ় করিয়া যাঁহারা আমার বিশ্বরূপে মনোনিবেশপূর্বক মচ্চিত্ত হইয়া অহোরাত্র অতিবাহিত করেন, তাঁহারাই আমার মতে শ্রেষ্ঠ যোগী । ২
কিন্তু যাঁহারা সর্বদা ইষ্ট-ও অনিষ্ট-প্রাপ্তিতে রাগ-ও দ্বেষরহিত, সকল প্রাণীর কল্যাণে নিযূক্ত এবং ইন্দ্রিয়সংযমী, যাঁহারা শব্দাদিপ্রমাণ দ্বারা অপ্রতিপাদ্য, প্রত্যক্ষাদি প্রমাণের অগোচর, সর্বব্যাপী মনের অতীত, কূটস্থ (মায়াধিষ্ঠান) অচ্যুতস্বরূপ এবং শাশ্বত নির্গুণ ব্রহ্মের উপাসনা করেন, তাঁহারা আমাকেই প্রাপ্ত হন । ৩-৪
যাঁহাদের চিত্ত নির্গুণ নিরাকার ব্রহ্মে অভিনিবিষ্ট, তাঁহাদিগকে সিদ্ধিলাভের জন্য ভগবৎকর্মাদিপরায়ণ সগুণ উপাসক অপেক্ষা অধিকতর ক্লেশ পাইতে হয়; কারণ নির্গুণ ব্রহ্মে নিষ্ঠালাভ করা দেহাভিমানী ব্যক্তিগণের পক্ষে অতিশয় কষ্টকর । ৫
হে পার্থ, কিন্তু যাঁহারা সমস্ত কর্ম আমাতে সমর্পণপূর্বক 'আমিই পরম পুরুষার্থরূপে উপাস্য' - এইভাবে মৎপরায়ণ হইয়া অনন্য যোগের দ্বারা আমার উপাসনা ও ধ্যান করেন, মদ্গতচিত্ত সেই সকল ভক্তকে মৃত্যুময় সংসারসাগর হইতে আমি অচিরে উদ্ধার করি । ৬-৭
অতএব আমাতেই তুমি মন সমাহিত কর, আমাতেই বুদ্ধি নিবিষ্ট কর । এইরূপ করিলে দেহান্তে তুমি নিশ্চয়ই মৎস্বরূপে স্থিতিলাভ করিবে, ইহাতে কোন সন্দেহ নাই । ৮
হে ধনঞ্জয়, যদি তুমি আমাতে স্থিরভাবে চিত্ত সমাহিত করিতে না পার, তাহা হইলে অভ্যাস-যোগের দ্বারা আমাকে লাভ করিতে যত্ন কর । ৯
যদি তুমি এই প্রকার অভ্যাস করিতে সমর্থ না হও, তবে ভগবৎপ্রীতিকর কর্মে একনিষ্ঠ হও । কারণ আমার কর্ম করিতে করিতেই তুমি ক্রমে সিদ্ধিলাভ করিবে । ১০
আর যদি ইহাও করিতে অক্ষম হও, তবে ইন্দ্রিয়সংযম-পূর্বক আমাতে সর্বকর্ম-সমর্পণরূপ যোগ আশ্রয় করিয়া সর্বপ্রকার কর্মের ফলত্যাগ কর । ১১
অবিবেকপূর্বক অভ্যাস অপেক্ষা শ্রুতি ও যুক্তি দ্বারা আত্মনিশ্চয় উৎকৃষ্ট । এই প্রকার আত্মনিশ্চয় অপেক্ষা জ্ঞানপূর্বক ধ্যান শ্রেষ্ঠ । জ্ঞানপূর্বক ধ্যান হইতে কর্মফলত্যাগ শ্রেষ্ঠ । কর্মফলত্যাগের অব্যবহিত পরেই সহেতুক সংসার নিবৃত্তিরূপ পরম শান্তিলাভ হয় । ১২
যিনি সকল প্রাণীর প্রতি দ্বেষহীন, মিত্রভাবাপন্ন, দয়ালু, মমত্ববুদ্ধিশূন্য, নিরহংকার, সুখে আসক্তি ও দুঃখে দ্বেষবর্জিত, ক্ষমাশীল, সর্বদা সন্তুষ্ট, সদা সমাহিতচিত্ত, সদা সংযতস্বভাব, সদা তত্ত্ববিষয়ে দৃঢ়নিশ্চয় এবং যাঁহার মন ও বুদ্ধি সর্বদা আমাতে অর্পিত, তিনি আমার প্রিয় ভক্ত । ১৩-১৪
যিনি কাহাকেও উদ্বিগ্ন করেন না, যিনি কাহারও দ্বারা উদ্বিগ্ন হন না এবং যিনি হর্ষ ও বিষাদ, ভয় ও উদ্বেগ হইতে মুক্ত, তিনি আমার প্রিয় ভক্ত । ১৫
যিনি নিঃস্পৃহ, বাহ্যাভ্যন্তর শুচি, দক্ষ, পক্ষপাতশূন্য, ভয়হীন এবং সকাম কর্মের অনুষ্ঠান-ত্যাগী, তিনি আমার প্রিয় ভক্ত । ১৬
যিনি ইষ্টপ্রাপ্তিতে হৃষ্ট হন না, অনিষ্টপ্রাপ্তিতে দ্বেষ করেন না, প্রিয়বিয়োগে শোক করেন না, অপ্রাপ্ত ইষ্টবস্তু আকাঙ্ক্ষা করেন না এবং শুভাশুভ সকল কর্ম পরিত্যাগ করিয়াছেন, তিনি আমার প্রিয় ভক্ত । ১৭
যিনি আসক্তিহীন এবং শত্রু ও মিত্রে সমবুদ্ধি, যিনি সম্মানে ও অপমানে অবিচলিত, যিনি শীতোষ্ণজনিত সুখে ও দুঃখে নির্বিকার, পরমাত্মাতে স্থিরবুদ্ধি, প্রশংসায় হর্ষ ও নিন্দায় বিষাদশূন্য সুতরাং সংযতবাক্, সর্বাবস্থায় যৎকিঞ্চিৎ-লাভে সন্তুষ্ট এবং নির্দিষ্টবাসস্থানহীন তিনি আমার প্রিয় ভক্ত । ১৮-১৯
যে-সকল মৎপরায়ণ ভক্ত এই মোক্ষদায়ক ধর্ম উক্তপ্রকারে শ্রদ্ধাসম্পন্ন হইয়া সাধন করেন, তাঁহারাই আমার অতীব প্রিয় । ২০
ভগবান্ ব্যাসকৃত লক্ষশ্লোকী শ্রীমহাভারতের ভীষ্মপর্বের অন্তর্গত শ্রীমদ্ভগবদ্গীতারূপ উপনিষদে ব্রহ্মবিদ্যাবিষয়ক যোগশাস্ত্রে শ্রীকৃষ্ণার্জুন-সংবাদে ভক্তিযোগ নামক দ্বাদশ অধ্যায় সমাপ্ত ।
_________________________________________
৩) কূট = মায়া, রাশি, গিরিশৃঙ্গ
কূটস্থ = মায়াপ্রপঞ্চের অধিষ্ঠাণরূপে স্থিত, গিরিশৃঙ্গবৎ নিশ্চলভাবে অবস্থিত, প্রস্তরতুল্য নির্বিকার
উপাসনা = শাস্ত্রানুযায়ী উপাস্য বস্তুকে চিত্তের বিষয়ীকরণের দ্বারা তাঁহার সমীপস্থ হইয়া তৈলধারার ন্যায় প্রত্যয়প্রবাহে দীর্ঘকাল অবস্থিতির নাম ।
৫) দেহাভিমানী = স্থূল ও সূক্ষ্ম দেহে যাঁহার অভিমান অর্থাৎ 'আমি'-বুদ্ধি আছে, যাঁহার দেহে আত্মবুদ্ধি
৬) ভগবানের সগুণ জগদাত্মরূপ অথবা তাঁহার শ্রীকৃষ্ণ, রাঘব, নরসিংহাদি দ্বিভুজ, চতুর্ভুজ প্রভৃতি রূপ । - [শ্রীমধুসূদন সরস্বতী] । এইরূপ উপাসকগণ বহু শ্রবণাদিরূপ অধিকতর ক্লেশ ব্যতীতই ভগবদ্দত্ত জ্ঞান দ্বারা জন্মমৃত্যুরূপ সংসৃতি হইতে মুক্ত হন ।
৯) অভ্যাস = সকল বিষয় হইতে চিত্তকে সমাহৃত করিয়া কোন দেবতার মানসমূর্তি বা প্রতিমাদি একমাত্র অবলম্বনে উহাতে পুনঃপুনঃ স্থাপনের নাম । নারদ যুধিষ্ঠিরকে বলিয়াছিলেন - "রাজন্, যে কোন উপায়ে হউক শ্রীকৃষ্ণে মনোনিবেশ করা উচিত ।" - [ভাগবত, ৭|১|৩১]
১০) ভগবৎপ্রীতিকর কর্ম = একাদশী, উপবাস, ব্রতচর্যা, পূজা ও ইষ্টনামজপাদি
১২) অবিবেকপূর্বক অভ্যাস = জ্ঞানার্থ শ্রবণাভ্যাস বা নিশ্চয়পূর্বক ধ্যানাভ্যাস । - [আনন্দগিরি]
কর্মফলত্যাগ : শ্রীভগবান্ এখানে অবশ্য কর্তব্য কর্মের ফলত্যাগের প্রশংসা করিতেছেন । শ্রৌত ও স্মার্ত কর্মের ফলরূপ সর্বকামনাত্যাগের অনন্তরই জ্ঞাননিষ্ঠের শান্তিলাভ প্রসিদ্ধ । - [কঠ উপঃ, ২|৩|১৪] উক্ত কামনাত্যাগের সহিত কর্মফলত্যাগের সাদৃশ্যবশতঃ সর্বকর্মফলত্যাগের এই স্তুতি । কামনাত্যাগ ও কর্মফলত্যাগ, উভয়ই ত্যাগ - এই সাদৃশ্য ।
১৫) যিনি প্রাণিমাত্রকে উদ্বেগ না দিয়া সকরুণ পিতার ন্যায় পুত্রবৎ সকলকে অবলোকন করেন, সেই শুদ্ধচিত্ত ও প্রেমযুক্ত ভক্তের প্রতি ভগবান্ শীঘ্র প্রসন্ন হন । - [মহাভারত]
ভগবৎপরায়ণ ব্যক্তিগণ কোন বিষয়েই ভীত হন না । - [ভাগবত, ৬|১৭|২৮]
১৬) দক্ষ = উপস্থিত কার্যে তৎক্ষণাৎ যথাযথ প্রতিপত্তি-ও প্রবৃত্তি-যুক্ত
১৮,১৯) ব্রাহ্মণ = যিনি যে-কোন পরিধেয় দ্বারা শরীর আবৃত করেন, যে-কোন খাদ্যদ্রব্য ভোজন করেন এবং যে-কোন স্থানে শয়ন করিয়া রাত্রিযাপন করেন, দেবতাগণ তাঁহাকেই ব্রাহ্মণ বলিয়া থাকেন । - [মহাভারত, শান্তিপর্ব]
২০) ভক্ত : পরমার্থ জ্ঞানলক্ষণা ভক্তিকে যিনি আশ্রয় করিয়াছেন, সেই জ্ঞানী = ভক্তই এখানে উদ্দিষ্ট ।
শ্রদ্ধা = আস্তিক্যবুদ্ধি, ঈশ্বরের অস্তিত্বে দৃঢ় বিশ্বাস । শ্রদ্ধার আবির্ভাবে ধর্মজীবন উজ্জ্বল হয় । শ্রদ্ধার অভাবে ধর্মজীবন অন্ধকার । শ্রদ্ধা সাধনলভ্য । বৈদিক ঋষিগণ শ্রদ্ধার আহ্বান করিতেন ।
সাধন : মুক্ত পুরুষের যাহা স্বাভাবিক ধর্ম, মুমুক্ষুগণের তাহাই যত্নপূর্বক অনুষ্ঠেয় । আত্মজ্ঞান যাঁহার উৎপন্ন হইয়াছে, 'অদ্বেষ্টা' প্রভৃতি গুণ বিনাযত্নে তাঁহার লাভ হয় । সে সকল গুণের সাধন তাঁহাকে করিতে হয় না । সেইগুলি মুমুক্ষুগণের সাধনলভ্য । - [নীলকণ্ঠ]
প্রিয় : প্রিয় শব্দ ভক্ত ও ভগবানের (আত্মিক) অভেদত্ববাচক ।
_________________________________________
*Hard Copy Source:
"Srimadbhagabadgeeta" translated by Swami Jagadeeshwarananda, edited by Swami Jagadananda. 27th Reprint - January, 1997 (1st Edition - 1941), © President, Sriramkrishna Math, Belur. Published by Swami Satyabrotananda, Udbodhan Office, 1 Udbodhan Lane, Bagbazar, Kolkata-700003. Printed by Rama Art Press, 6/30 Dum Dum Road, Kolkata-700030.
Sanskrit Source
English Translation
Disclaimer:
This site is not officially related to Ramakrishna Mission & Math. This is a personal, non-commercial, research-oriented effort of a novice religious wanderer.
এটি আধ্যাত্মিক পথের এক অর্বাচীন পথিকের ব্যক্তিগত, অবাণিজ্যিক, গবেষণা-ধর্মী প্রয়াস মাত্র ।
[Digitised by scanning (if required) and then by typing mostly in Notepad using Unicode Bengali "Siyam Rupali" font and Avro Phonetic Keyboard for transliteration. Uploaded by rk]
No comments:
Post a Comment