Sunday, July 27, 2014

শ্রীমদ্ভগবদ্‌গীতা : চতুর্থ অধ্যায় – জ্ঞানযোগ (Gita : Chapter 4)

|||৪||||||১০|১১|১২|১৩|১৪|১৫|১৬|১৭|১৮
 (স্বামী জগদীশ্বরানন্দ)*
 
শ্রীভগবান্‌ বলিলেন -
পূর্বাধ্যায়ে উক্ত নিষ্ঠাদ্বয়াত্মক এই অব্যয়যোগ আমি সূর্যকে বলিয়াছিলাম; সূর্য স্বীয় পুত্র মনুকে এবং মনু তৎপুত্র ইক্ষ্বাকুকে ইহা বলিয়াছিলেন । ১

হে পরন্তপ, ক্ষত্রিয়-পরম্পরাগত এই যোগ রাজর্ষিগণ বিদিত হইয়াছিলেন । ইহলোকে এই যোগ কালক্রমে বিনষ্ট হইয়াছে, অর্থাৎ ইহার সম্প্রদায় বিচ্ছিন্ন হইয়াছে । ২

তুমি আমার ভক্ত ও সখা । এইজন্য তোমাকে আজ এই পুরাতন যোগই বলিলাম; কারণ ইহা অতি গূঢ় রহস্য । ৩

অর্জুন বলিলেন -
আপনার জন্ম অনেক পরে এবং সূর্যের জন্ম বহু পূর্বে হইয়াছিল । আপনি সৃষ্টির প্রারম্ভে সূর্যকে এই যোগ বলিয়াছিলেন, তাহা কিরূপে বুঝিব ? ৪

শ্রীভগবান্‌ বলিলেন -
হে পরন্তপ অর্জুন, আমার ও তোমার বহু জন্ম অতীত হইয়াছে। আমি সেই সকল জানি; কিন্তু তুমি তৎসমুদয় বিস্মৃত হইয়াছ । ৫

[ধর্মাধর্মাতীত নিত্য ঈশ্বরের জন্ম কিরূপে সম্ভব ?]

আমি জন্মরহিত, অলুপ্তজ্ঞানশক্তি-স্বভাব এবং ব্রহ্মাদি স্থাবর পর্যন্ত সর্বভূতের ঈশ্বর হইয়াও সমস্ত জগৎ যাহার বশীভূত আমার সেই ত্রিগুণাত্মিকা শক্তিকে আশ্রয় করিয়া স্বীয় মায়া দ্বারা যেন দেহধারণ করি । ৬
যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত ।
অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম ।। ৭
পরিত্রাণায় সাধূনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম ।
ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে ।। ৮

হে ভারত, যখন প্রাণিগণের অভ্যুদয় ও নিঃশ্রেয়সের কারণ বর্ণাশ্রমাদি ধর্মের অধঃপতন ও অধর্মের অভ্যুত্থান হয়, তখন আমি স্বীয় মায়াবলে যেন দেহবান হই, যেন জাত হই । ৭

সাধুদিগের রক্ষার জন্য, দুষ্টদিগের বিনাশের জন্য এবং ধর্মসংস্থাপনের জন্য আমি যুগে যুগে নরাদিরূপে অবতীর্ণ হই । ৮

হে অর্জুন, যিনি আমার এই প্রকার অলৌকিক মায়িক জন্ম ও সাধুপরিত্রাণাদি অপ্রাকৃত কর্ম তত্ত্বতঃ জানেন, তিনি আমাকেই লাভ করেন এবং দেহান্তে আর পুনর্জন্ম প্রাপ্ত হন না । ৯

আসক্তিরহিত, ভয়শূন্য ও ক্রোধবর্জিত, মদ্গতচিত্ত ও আমারই শরণাগত (কেবল জ্ঞাননিষ্ঠ) বহু ব্যাক্তি জ্ঞানরূপ তপস্যা দ্বারা পরা শুদ্ধি লাভ করিয়া ব্রহ্মভাব (মোক্ষ) প্রাপ্ত হইয়াছেন । ১০

[আপনি কাহাকেও মোক্ষ দেন, কাহাকেও দেন না - এই পক্ষপাতিত্ব কি আপনার আছে? না, তাহা নহে ।]

যিনি যে প্রকারে (মোক্ষ, জ্ঞান, কাম্য বস্তু, অথবা আর্তি-নিবারণের জন্য) আমার উপাসনা করেন, আমি (সর্বফলদাতা পরমেশ্বর) তাঁহাকে সেই ফলপ্রদান দ্বারাই অনুগৃহীত করি, অর্থাৎ সকামকে তাঁহার কাম্য ফল এবং নিষ্কামকে মুক্তি প্রদান করি । হে পার্থ, বর্ণাশ্রমাদি-ধর্মনিষ্ঠ মনুষ্যগণ সকল প্রকারে আমার পথের অনুসরণ করেন । যাঁহারা যে প্রকারে ইন্দ্রাদি দেবতার উপাসনা করেন, তাঁহারা সেই সকল প্রকারে সর্বাত্মক, সর্বাবস্থ আমারই মোক্ষমার্গের অনুবর্তন করেন; কারণ আমিই ইন্দ্রাদি সর্বদেবরূপধারী । ১১

তবে শ্রৌত ও স্মার্ত কর্মের ফল কামনা করিয়া অনেকে ইহলোকে ইন্দ্রাদি দেবতার পূজা করেন, কিন্তু মুক্তির জন্য সাক্ষাৎভাবে আমার শরণাগত হন না । কারণ, মনুষ্যলোকে কাম্য কর্মের ফল শীঘ্র লাভ হয় । ১২

[তাঁহারা আমারই কর্মাত্মক মার্গের অনুবর্তন করেন; কারণ] সত্ত্বাদিগুণ ও শমাদি কর্মের বিভাগ অনুসারে আমি ব্রাহ্মণাদি চারিবর্ণের সৃষ্টি করিয়াছি । আমি মায়িক ব্যবহারে চতুর্বর্ণের সৃষ্টিকর্তা হইলেও আমাকে পরমার্থদৃষ্টিতে অব্যয় অকর্তা ও অসংসারী বলিয়া জানিও । ১৩

অতএব আমার অহংকার এবং কর্মফলে আকাঙ্ক্ষা না থাকায় কোন কর্ম আমাকে বদ্ধ করিতে পারে না । এইরূপে যিনি আমাকে পরমাত্মা হইতে অভিন্ন এবং কর্তৃত্বরহিত ও কর্মফলে স্পৃহাশূন্য বলিয়া জানেন, তিনি কর্ম দ্বারা কখনও আবদ্ধ হন না; কর্ম তাঁহার জন্মান্তরের আরম্ভক হয় না। কর্ম যে আমার বন্ধনের কারণ হয় না তাহা বলাই বাহুল্য । ১৪

‘আমি অকর্তা, অভোক্তা ও কর্মফলে নিঃস্পৃহ’ - এই রূপ আমাকে জানিয়া জনকাদি পূর্বতন মুমুক্ষুগণও নিষ্কাম কর্ম করিয়াছিলেন । যেহেতু প্রাচীনগণ পূর্বকালে নিষ্কাম কর্মের অনুষ্ঠান করিয়াছিলেন, অতএব তুমিও নিষ্কাম কর্ম কর, কর্মত্যাগ করিও না । ১৫

কর্ম কি এবং অকর্ম (কর্মের অভাব) কি - এই বিষয়ে পণ্ডিতগণও ভ্রান্ত হন । অতএব যাহা জানিলে সংসাররূপ অশুভ হইতে মুক্ত হইবে, সেই কর্ম ও অকর্ম তোমাকে বলিব । ১৬

শাস্ত্রবিহিত কর্মের, নিষিদ্ধ কর্মের ও অকর্মের তত্ত্ব অবগত হওয়া আবশ্যক । কারণ শাস্ত্রবিহিত কর্ম, অকর্ম ও নিষিদ্ধ কর্মের স্বরূপ (তত্ত্ব) অত্যন্ত দুর্জ্ঞেয় । ১৭

যিনি কর্মে অকর্ম ও অকর্মে কর্ম দর্শন করেন, তিনি মনুষ্যগণের মধ্যে জ্ঞানী ও যোগযুক্ত এবং সর্ব কর্মের কর্তা । ইহাই কর্ম ও অকর্মের বোদ্ধব্য রহস্য । এই জ্ঞানে মুক্তি লাভ হয় । ১৮

যাঁহার সমস্ত কর্মপ্রচেষ্টা কাম ও (তৎকারণ) সংকল্পরহিত এবং যাঁহার শুভাশুভ কর্ম (কর্মে অকর্ম ও অকর্মে কর্মদর্শনরূপ) জ্ঞানাগ্নি দ্বারা দগ্ধ হইয়াছে, তাঁহাকে জ্ঞানিগণ প্রকৃত পণ্ডিত বলিয়া থাকেন । ১৯

[সম্যক আত্মদর্শন দ্বারা যদিও সাধনের সহিত কর্ম পরিত্যাগ হইয়াই থাকে, তথাপি লোকসংগ্রহাদি কোন নিমিত্তবশতঃ কর্মত্যাগ অসম্ভব হইলে] যিনি উক্ত জ্ঞান দ্বারা কর্মফলাসক্তি বর্জনপূর্বক সর্বদা ইন্দ্রিয়বিষয়ে আকাঙ্ক্ষাশূন্য, সদাতৃপ্ত ও নিরবলম্বন থাকেন, তিনি জনকাদির ন্যায় পূর্ববৎ কর্মে প্রবৃত্ত হইয়াও আত্মার নৈষ্কর্ম্যদর্শনহেতু কোন কর্ম করেন না । ২০

যিনি নিষ্কাম ও সকল প্রকার ভোগ্যবস্তুত্যাগী এবং যাঁহার অন্তঃকরণ ও দেহেন্দ্রিয় সংযত, তিনি জ্ঞান দ্বারা কর্তৃত্বাভিমানশূন্য হইয়া শরীরধারণের উপযোগী কর্ম মাত্র করেন; কিন্তু তাহাতে পাপপুণ্যভাগী হন না । এইরূপে জ্ঞাননিষ্ঠ সন্ন্যাসীই মুক্ত হন । ২১

যিনি যদৃচ্ছালাভে পরিতুষ্ট, শীতোষ্ণাদি দ্বন্দ্ব দ্বারা পীড়িত হইলেও অবিষণ্ণচিত্ত, মাৎসর্যহীন (নির্বৈর) ও লাভালাভে হর্ষবিষাদরহিত, তিনি শরীরধারণের উপযোগী কর্ম করিলেও সেই কর্মে বদ্ধ হন না । ২২

আসক্তিশূন্য, ধর্মাধর্ম ও কর্তৃত্ব-ভোক্তৃত্বাদির বন্ধন হইতে বিমুক্ত ও ব্রহ্মজ্ঞাননিষ্ঠ ব্যক্তি দ্বারা যজ্ঞার্থ কর্ম অনুষ্ঠিত হইলেও তাহার সমগ্র কর্ম বিনষ্ট হয় অর্থাৎ ফলপ্রসব করে না । ২৩

কারণ, ব্রহ্মবিৎ হবনীয় দ্রব্যের অর্পণকে, ঘৃতকে, হোমাগ্নিকে, আহুতিদানের কর্তাকে এবং হোমক্রিয়াকে ব্রহ্মরূপে দর্শন করেন । তাঁহার দৃষ্টিতে ব্রহ্মরূপ কর্মে সমাহিতচিত্ত ব্যক্তির প্রাপ্তব্য ফলও ব্রহ্ম । ২৪

অন্য যোগিগণ দেবতাপূজারূপ যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেন । আর কেহ কেহ নির্বিশেষ ব্রহ্মরূপ অগ্নিতে জীবাত্মাকে নির্বিশেষ ব্রহ্মরূপে আহুতি প্রদান করেন, অর্থাৎ সোপাধিক জীবাত্মাকে নিরুপাধিক পরমাত্মারূপে দর্শন করেন । ২৫

অন্য কোন কোন যোগী কর্ণাদি ইন্দ্রিয়সকলকে সংযম-অগ্নিতে আহুতি দেন অর্থাৎ ইন্দ্রিয়সংযম করেন । অপর কোন কোন যোগী শব্দাদি বিষয়সমূহ ইন্দ্রিয়রূপ অগ্নিতে আহুতি দেন (অর্থাৎ শ্রোত্রাদি দ্বারা শাস্ত্রবিহিত বিষয়গ্রহণকে হোম মনে করেন) । ২৬

আত্মাতে সংযমরূপ বিবেক-বিজ্ঞান প্রদীপ্ত যে যোগাগ্নি তাহাতে অপর যোগিগণ সকল ইন্দ্রিয়কর্ম এবং প্রাণাদি দশ বায়ুর কার্য আহুতি দেন (লয় করেন) । ২৭

অন্য কেহ কেহ দ্রব্যদানরূপ যজ্ঞ করেন । কেহ কেহ তপোরূপ যজ্ঞ এবং কেহ কেহ প্রাণায়াম ও প্রত্যাহারাদি যোগরূপ যজ্ঞ করেন । অপর কোন কোন দৃঢ়ব্রত যত্নশীল যোগী বেদাভ্যাস (শাস্ত্রপাঠ) ও শাস্ত্রার্থনিশ্চয়রূপ যজ্ঞের অনুষ্ঠান করিয়া থাকেন । ২৮

অন্যান্য যোগী অপানবায়ুতে প্রাণবায়ু (পূরক প্রাণায়াম) এবং প্রাণবায়ুতে অপানবায়ু আহুতি দিয়া (রেচকনামক প্রাণায়াম করিয়া) প্রাণ ও অপানবায়ুর গতি রোধপূর্বক কুম্ভকরূপ প্রাণায়াম করেন । ২৯

অপর কোন কোন যোগী আহার-সংযমপূর্বক প্রাণবায়ুসমূহে অন্যান্য প্রাণবায়ু আহুতি দেন অর্থাৎ যে যে প্রাণবায়ু জয় করেন, সেই সেই প্রাণবায়ুতে অন্যান্য প্রাণবায়ু হোম করেন । এই সকল যজ্ঞের জ্ঞাতা ও কর্তা যজ্ঞ দ্বারা পাপমুক্ত হন । ৩০

যথোক্ত যজ্ঞসমূহ সম্পাদনপূর্বক অন্তে বিহিত অমৃত নামক অন্ন যাঁহারা শাস্ত্রবিধি অনুসারে ভোজন করেন, তাঁহারা সনাতন ব্রহ্ম প্রাপ্ত হন । হে কুরুশ্রেষ্ঠ, যজ্ঞহীন ব্যক্তির ইহলোকই নাই, সর্ব-লোকাতীত আত্মজ্ঞান লাভ তো দূরের কথা । ৩১

বেদমুখে এইরূপ বহুবিধ যজ্ঞ ব্যাখ্যাত হইয়াছে । সেই সকলকে কায়িক, বাচনিক ও মানসিক কর্মজাত বলিয়া জানিবে । “আত্মা নিষ্ক্রিয়; আমি সেই উদাসীন আত্মা, এই সকল ব্যাপার আমার নহে” - এইরূপ আত্মজ্ঞান হইলে শুভাশুভরূপ সংসার হইতে মুক্ত হইবে । আত্মজ্ঞ পুরূষ নৈষ্কর্ম্য-সিদ্ধ । ৩২

হে পরন্তপ, সংসার-ফলারম্ভক দ্রব্যসাধ্য যজ্ঞ অপেক্ষা মোক্ষদায়ক জ্ঞান-যজ্ঞ শ্রেষ্ঠ । কারণ হে পার্থ, অগ্নিহোত্রাদি যজ্ঞ এবং সমস্ত শ্রৌত ও স্মার্ত যজ্ঞোপাসনাদি ব্রহ্মজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত হয় । ৩৩

যে বিধি দ্বারা সেই জ্ঞান প্রাপ্ত হওয়া যায়, তাহা বলিতেছি, অবগত হও । প্রণিপাত, সশ্রদ্ধ জিজ্ঞাসা ও গুরুসেবা দ্বারা প্রসন্ন হইয়া তত্ত্বদর্শী জ্ঞানী তোমাকে সেই ব্রহ্মজ্ঞান উপদেশ করিবেন । ৩৪

হে পাণ্ডব, আমার দ্বারা উপদিষ্ট জ্ঞান লাভ করিলে তুমি আর এইরূপ মোহগ্রস্ত হইবে না; কারণ একবার ব্রহ্মজ্ঞান লাভ হইলে পুনরায় অজ্ঞান আসে না । সেই জ্ঞান দ্বারা তুমি ব্রহ্মা হইতে স্থাবর পর্যন্ত ভূতসমূহকে স্বীয় আত্মাতে (প্রত্যগাত্মাতে) এবং আমাতে (পরমেশ্বরে, পরব্রহ্মে) দেখিতে পাইবে । ৩৫

যদি তুমি সকল পাপী হইতে অধিক পাপিষ্ঠ হও, তথাপি এই জ্ঞানের পোত দ্বারা সমূদয় ধর্মাধর্মরূপ সংসার-সাগর উত্তীর্ণ হইবে, ব্রহ্মজ্ঞানের এইরূপ মাহাত্ম্য । ৩৬

হে অর্জুন, যেমন প্রজ্বলিত অগ্নি কাষ্ঠরাশিকে ভস্মীভূত করে, সেইরূপ ব্রহ্মজ্ঞানাগ্নি সমস্ত শুভাশুভ কর্ম ভস্মসাৎ করে । ব্রহ্মজ্ঞানাগ্নির দ্বারা বিদগ্ধ হইলে কোন কর্মই ফল প্রসব করিতে পারে না । ৩৭

ব্রহ্মজ্ঞান অজ্ঞান-নাশক ও অত্যন্ত শুদ্ধিকর । ইহার তুল্য পবিত্র বস্তু ইহলোকে বা পরলোকে আর কিছু নাই । দীর্ঘকাল প্রযত্ন দ্বারা কর্মযোগে চিত্ত শুদ্ধ হইলে মূমুক্ষু স্বীয় আত্মাতে সেই ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করেন । ৩৮

গুরুবাক্যে ও বেদান্তোপদেশে বিশ্বাসী, জ্ঞাননিষ্ঠ ও জিতেন্দ্রিয় মূমুক্ষু অবশ্যই ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করেন । তিনি ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করিয়া জন্মান্তরগ্রহণ বা লোকান্তরগমন না করিয়াই শাশ্বতী শান্তি বা মোক্ষ প্রাপ্ত হন । ৩৯

অজ্ঞ, শাস্ত্রে শ্রদ্ধাহীন, (জ্ঞান ও কর্মের অনুষ্ঠানবিষয়ে) সন্দিগ্ধচিত্ত ব্যক্তি পরমার্থের অযোগ্য হয় । সন্দিগ্ধচিত্ত ব্যক্তির ইহলোকও নাই, পরলোকও নাই এবং ঐহিক সুখও নাই । ৪০

স্বীয় আত্মাকে ব্রহ্মরূপে দর্শন দ্বারা যাঁহার সংশয় ছিন্ন এবং ধর্মাধর্মত্যাগ হইয়াছে, সেই আত্মবান্‌ অপ্রমত্ত ব্যক্তিকে দৃষ্ট কর্মরাশি আবদ্ধ করিতে পারে না, অর্থাৎ তাঁহার কর্ম নিষ্কাম বলিয়া অনিষ্ট, ইষ্ট বা মিশ্র কোন প্রকার ফল উৎপন্ন করেনা । ৪১

[নিষ্কাম কর্মযোগ দ্বারা ক্রমে যোগী সংশয়শূন্য ও মুক্ত হন । এই যোগ জ্ঞানসাধন ও কর্মানুষ্ঠানের ফলবিষয়ে সংশয় বিনাশ করে ।]

অতএব হে ভারত, অজ্ঞানজাত বুদ্ধিস্থিত, আত্মবিষয়ক এই সংশয়কে জ্ঞানরূপ অসি দ্বারা ছেদন করিয়া ব্রহ্মদর্শনের শ্রেষ্ঠ মার্গ নিষ্কাম কর্মযোগ অবলম্বন কর এবং যুদ্ধার্থ উত্থিত হও । ৪২

ভগবান্‌ ব্যাসকৃত লক্ষশ্লোকী শ্রীমহাভারতের ভীষ্মপর্বের অন্তর্গত শ্রীমদ্ভগবদ্গীতারূপ উপনিষদে ব্রহ্মবিদ্যাবিষয়ক যোগশাস্ত্রে শ্রীকৃষ্ণার্জুনসংবাদে জ্ঞানযোগনামক চতুর্থ অধ্যায় সমাপ্ত ।
_________________________________________

১) অব্যয় : কারণ এই যোগ দ্বারা প্রাপ্তব্য মোক্ষ অব্যয়

সপ্তম মনু শ্রাদ্ধদেব - [শ্রীধর স্বামী]

৫) তুমি তৎসমূদয় বিস্মৃত হইয়াছ : কারণ ধর্মাধর্মাদি দ্বারা তোমার জ্ঞানশক্তি সমাবৃত এবং মায়াধীন; কিন্তু আমি নিত্য-শুদ্ধ-বুদ্ধ-মুক্তস্বভাব ও মায়াধীশ বলিয়া আমার জ্ঞানশক্তি সর্বদা অনাবৃত ।

৬) ঈশ্বরের জন্ম বাস্তব নহে, মায়িক । অবতারের আত্মজ্ঞান দিব্য জ্ঞান আজন্ম অলুপ্ত থাকে ।

৯) অবতার মায়ামনুষ্য

১২) মনুষ্যলোকেই বর্ণবিহিত ও আশ্রমবিহিত কর্মে অধিকার আছে, অন্য লোকে নহে ।

১৩) অকর্তা : ঈশ্বরত্ব এবং ঈশ্বরের কর্মও পরমার্থতঃ মায়িক ।

১৭) জন্মমৃত্যুরূপ ও কর্তৃত্বভোক্তৃত্বাদিরূপ সংসার বা সংসৃতি

১৮) তিনি প্রবৃত্তির কর্তা নহেন এবং নিবৃত্তিরও কর্তা নহেন - ইহা যিনি জানেন তিনিই বুদ্ধিমান । আমি কর্ম করি, এইরূপ জ্ঞান ভ্রান্তি । আত্মাতে শরীরেন্দ্রিয়-ব্যাপারে উপরম আরোপ করিয়া আমি (আত্মা) নিষ্কর্মা, সুখী - এই জ্ঞানও মিথ্যা । বর্তমান শ্লোকে এই উভয় প্রকার ভ্রান্তি দূর করা হইয়াছে ।

মৃগতৃষ্ণায় জলের ন্যায় ও শুক্তিকায় রজতের ন্যায় নিষ্ক্রিয় আত্মাতে কর্তৃত্ব ও ভোক্তৃত্ব দর্শন ভ্রান্ত জীবের স্বভাব । নৌকারূঢ় ব্যাক্তি নৌকা চলিতে থাকিলে তটস্থ গতিহীন বৃক্ষসমূহে প্রতিকূল গতি এবং দুরবর্তী গতিশীল বস্তুকে গতিহীন দেখেন । এইরূপ বিপরীত দর্শন মায়িক সংসারের ধর্ম । - [শঙ্করাচার্য]

২০) নিরবলম্বন : ঐহিক ও পারত্রিক অভ্যুদয়বিষয়ে সাধনশূন্য ও দৃষ্টাদৃষ্ট ফলের উপায়রহিত । ঈশ্বর ব্যতীত অন্য কোন অবলম্বন তাঁহার নাই ।

আত্মজ্ঞ অকর্তৃত্বে নিশ্চলভাবে সর্বদা আরূঢ় থাকেন । কিন্তু লোকসংগ্রহাদিরূপ দিব্য দায় না থাকিলে পূর্বোক্ত আত্মবিষয়ক জ্ঞান উৎপন্ন হইলেই সাধনের সহিত কর্মত্যাগ করিয়া জ্ঞাননিষ্ঠ ব্যক্তি মুক্ত হন ।
 
২২) লাভালাভ : শরীরযাত্রানির্বাহের উপযোগী যদৃচ্ছালাভের প্রাপ্তি বা অপ্রাপ্তি ।
ব্রহ্মবিৎ শুধু শরীরস্থিতির জন্য যে কর্ম করেন, তাহাতে বদ্ধ হন না; কারণ তাহার সর্ব কর্ম জ্ঞানাগ্নিদগ্ধ ।
২৩) অগ্র = ফল, অতএব সমগ্র = ফলের সহিত ।
স্মৃতিশাস্ত্রমতে ভোগব্যতীত কর্মক্ষয় হয় না । ইহা ব্রহ্মবিদের পক্ষে প্রযোজ্য নহে । অবশ্য ব্রহ্মজ্ঞকেও প্রারব্ধ ভোগ করিতে হয় ।
 
২৪) ব্রহ্মজ্ঞানী লোকসংগ্রহার্থ এইরূপে কর্ম করিলেও তাঁহার কর্ম অকর্মই; কারণ ঐ কর্মের ফলোৎপাদিনী শক্তি ব্রহ্মজ্ঞান দ্বারা বিনষ্ট হয় ।

২৫) ইহাই জ্ঞানযজ্ঞ

২৯) কুম্ভক : মুখ ও নাসিকা দ্বারা বায়ুর বাহিরে গমনই প্রাণগতি ও ভিতরে আসার নাম অপানগতি । এই উভয় গতিরোধই কুম্ভক ।

৩৬) মূমুক্ষুর পক্ষে ধর্ম বা পুণ্যও বন্ধন বলিয়া বিবেচিত হয় ।

৩৭) অতীত অনেক জন্মের সঞ্চিত, ইহজন্মে জ্ঞানোৎপত্তির পূর্বে কৃত এবং জ্ঞান সহ ভাবী সমস্ত কর্ম জ্ঞান দ্বারা বিনষ্ট হয় । কিন্তু প্রারব্ধ কর্ম নষ্ট না হইয়া ভোগ দ্বারা ক্ষয় প্রাপ্ত হয় । - [ব্রহ্মসূত্র, ৪|১|১৩-১৫, ১৯] । 
প্রারব্ধ কর্ম = যে কর্মের ফল এই শরীরে ভোগ করিতে হইবে অর্থাৎ যে কর্ম ফল দিতে আরম্ভ করিয়াছে

৪১) ছিন্ন : কারণরূপী ব্রহ্ম এবং জগদ্‌রূপী ব্রহ্ম যাঁহার দর্শন হয়, তাঁহার হৃদয়গ্রন্থি ভেদ হইয়া যায়, সকল সংশয় ছিন্ন হয় এবং কর্মরাশি ক্ষয়প্রাপ্ত হয় ।

৪২) সাধারণতঃ সংশয়ী পুরুষের সংশয়বিষয়ক বস্তু স্বীয় আত্মা হইতে পৃথক্‌ । যেমন, অন্ধকারে দৃষ্ট শুষ্ক বৃক্ষকে - বৃক্ষ কি পুরুষ - এইরূপ সংশয় হয় । এই প্রকার সংশয় অন্যের জ্ঞান দ্বারা নষ্ট হয়, এই স্থানে সংশয় আত্মবিষয়ক এবং সংশয়বস্তুও স্বীয় আত্মা । সুতরাং শ্বাশ্রয় (আত্মাশ্রয়) সংশয়ের সমুচ্ছেদ স্বাশ্রয়জ্ঞান দ্বারাই সম্ভব, অন্য জ্ঞান দ্বারা নহে । সেই জন্য আত্মবিষয়ক সংশয় আত্মনিশ্চয়রূপ খড়্গ দ্বারা সমুচ্ছেদ্য । এই আত্মনিশ্চয়-লাভ সুকঠিন । - [আনন্দগিরি] 
_________________________________________
*Hard Copy Source:
"Srimadbhagabadgeeta" translated by Swami Jagadeeshwarananda, edited by Swami Jagadananda. 27th Reprint - January, 1997 (1st Edition - 1941), © President, Sriramkrishna Math, Belur. Published by Swami Satyabrotananda, Udbodhan Office, 1 Udbodhan Lane, Bagbazar, Kolkata-700003. Printed by Rama Art Press, 6/30 Dum Dum Road, Kolkata-700030.

Sanskrit Source
English Translation

Disclaimer:
This site is not officially related to Ramakrishna Mission & Math. This is a personal, non-commercial, research-oriented effort of a novice religious wanderer.
এটি আধ্যাত্মিক পথের এক অর্বাচীন পথিকের ব্যক্তিগত, অবাণিজ্যিক, গবেষণা-ধর্মী প্রয়াস মাত্র ।

[Digitised by scanning (if required) and then by typing mostly in Notepad using Unicode Bengali "Siyam Rupali" font and Avro Phonetic Keyboard for transliteration. Uploaded by rk

No comments:

Post a Comment