Thursday, August 14, 2014

শ্রীমদ্ভগবদ্‌গীতা : ত্রয়োদশ অধ্যায় – ক্ষেত্রক্ষেত্রজ্ঞবিভাগযোগ (Gita : Chapter 13)

|||||||||১০|১১|১২|১৩|১৪|১৫|১৬|১৭|১৮
 (স্বামী জগদীশ্বরানন্দ)*
 
অর্জুন কহিলেন -
হে কেশব, প্রকৃতি ও পুরুষ, ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রজ্ঞ, জ্ঞান ও জ্ঞেয় - এই সকল আমি জানিতে ইচ্ছা করি । ১

[ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রজ্ঞরূপ প্রকৃতিদ্বয় দ্বারা ঈশ্বর জগতের উৎপত্তি, স্থিতি ও প্রলয় করেন - ইহা সপ্তম অধ্যায়ে সূচিত হইয়াছে । এই প্রকৃতিদ্বয়-নিরূপণ দ্বারা তদ্বিশিষ্ট ঈশ্বরের স্বরূপ নির্ধারণের জন্য এই অধ্যায় আরম্ভ হইতেছে । যে তত্ত্বজ্ঞানযুক্ত হইয়া ধর্মাচরণ দ্বারা শ্রীভগবানের প্রিয় হওয়া সম্ভব, সেই তত্ত্বজ্ঞান নির্ণয়ের জন্য বর্তমান অধ্যায়ের প্রারম্ভ ।]

শ্রীভগবান্‌ বলিলেন -
হে অর্জুন, এই ভোগায়তন শরীররূপী (প্রত্যক্ষাদি প্রমাণের দ্বারা উপলভ্যমান) দৃশ্যটিকে ক্ষেত্র বলা হয় । যিনি এই শরীরকে জানেন অর্থাৎ স্বাভাবিক বা ঔপদেশিক জ্ঞানের বিষয় করেন, ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রজ্ঞবিদ্‌গণ তাঁহাকে ক্ষেত্রজ্ঞ বলেন । ২

হে অর্জুন, সকল ক্ষেত্রের দ্রষ্টা ক্ষেত্রজ্ঞ এক । ক্ষেত্রজ্ঞ ক্ষেত্র হইতে পৃথক । আমাকে সেই ক্ষেত্রজ্ঞ বলিয়া জানিবে । ব্রহ্মাদি-স্থাবরান্ত সর্বদেহই প্রকৃতির পরিণাম । এক ক্ষেত্রজ্ঞ দেহাদি উপাধি দ্বারা প্রবিভক্তের ন্যায় প্রতীয়মান হন । তাঁহাকে সর্বোপাধিবিবর্জিত, সদসদাদি সমস্ত শব্দ ও প্রত্যয়ের অগোচর 'আমি' বলিয়া জানিবে । কারণ ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রজ্ঞের এই প্রকার জ্ঞানই আমার মতে প্রকৃত জ্ঞান । ৩

সেই ক্ষেত্র যাহা ও যে প্রকার, যাদৃশ ধর্মযুক্ত, যেরূপ বিকারযুক্ত, যাহা হইতে যেভাবে উৎপন্ন হয় এবং সেই ক্ষেত্রজ্ঞ স্বরূপতঃ যাহা ও যেরূপ উপাধিকৃত শক্তিশালী তাহা সংক্ষেপে আমার নিকট শ্রবণ কর । ৪

এই ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রজ্ঞের যাথাত্ম্য বশিষ্ঠাদি ঋষিগণ বহু প্রকারে বর্ণনা করিয়াছেন । ঋগাদি বেদচতুষ্টয়ের নানা শাখাতেও এই তত্ত্ব বিবিধ ছন্দের দ্বারা বিভিন্নভাবে গীত হইয়াছে এবং যুক্তিযুক্ত ও ব্রহ্মস্বরূপ-প্রতিপাদক বেদবাক্যসমূহ দ্বারা এই তত্ত্ব অসন্দিগ্ধভাবে নির্ণীত হইয়াছে । ৫

পঞ্চ সূক্ষ্ম মহাভূত, মহাভূতের কারণ অহঙ্কার, অহঙ্কারের কারণ বুদ্ধি, বুদ্ধির কারণ মূলা প্রকৃতি (অব্যাকৃত ব্রহ্মশক্তি), দশ ইন্দ্রিয় ও মন, ইন্দ্রিয়ের পঞ্চ বিষয় স্থূল পঞ্চভূত এবং ইচ্ছা, দ্বেষ, সুখ, দুঃখ, দেহ-সংঘাত ও দেহ-সংঘাতে অভিব্যক্ত চেতনা ও ধৃতি (তপ্ত লৌহপিণ্ডে প্রকাশিত অগ্নির ন্যায় দেহেন্দ্রিয়াদিসংঘাতে অভিব্যক্ত আত্মচৈতন্যের আভাস দ্বারা ব্যাপ্ত অন্তঃকরণ-বৃত্তি) - এই সকল বিকারযুক্ত ক্ষেত্র সংক্ষেপে বর্ণিত হইল । ৬-৭

[শ্রীভগবান্‌ এখন জ্ঞেয় শুদ্ধ ক্ষেত্রজ্ঞের লক্ষণ বলিবেন ।]

উৎকর্ষ সত্ত্বেও আত্মশ্লাঘারাহিত্য, দম্ভশূন্যতা, প্রাণিপীড়নে অনিচ্ছা, ক্ষমা, সরলতা, গুরুসেবা, বহিরন্তঃশৌচ, মোক্ষমার্গে স্থিরতা, স্বাভাবিক প্রবৃত্তিকে সংযত করিয়া সন্মার্গে পরিচালনা, ইন্দ্রিয়ভোগ্য বস্তুতে বিরক্তি, অভিমানশূন্যতা; জন্ম, মৃত্যু, জরা ও ব্যাধিরূপ দুঃখে পুনঃপুনঃ দোষদর্শন, বিষয়ে অনাসক্তি, স্ত্রী, পুত্র ও গৃহাদিতে মমত্বাভাব, শুভাশুভপ্রাপ্তিতে সদা চিত্তের সাম্যভাব, ভগবান্‌ই একমাত্র গতি - এই নিশ্চিত বুদ্ধির দ্বারা আমাতে অচলা ভক্তি, নির্জন বাস, প্রাকৃত জনের সংসর্গত্যাগ, আত্মানাত্মবিবেক, জ্ঞানে নিষ্ঠা ও তত্ত্বজ্ঞানার্থদর্শন - এইগুলি আত্মজ্ঞানের সাধন বলিয়া কথিত হয় । ইহার বিপরীত মানিত্ব ও দাম্ভিকতাদি অজ্ঞান বলিয়া জ্ঞেয় এবং সংসারপ্রবৃত্তির কারণ বলিয়া পরিহার্য । ৮-১২

হে অর্জুন, যাহা জ্ঞাতব্য, যাহা জানিয়া অমৃতত্ব (মোক্ষ) লাভ হয়, তাহা তোমাকে বলিব । তিনি আদিহীন পরব্রহ্ম । তিনি সৎশব্দ ও সৎপ্রত্যয়ের অগোচর এবং অসৎশব্দ ও অসৎ প্রত্যয়েরও অগোচর । কারণ ইন্দ্রিয়গোচর বস্তুই সৎ বা অসৎ শব্দ প্রত্যয়ের গোচর হয়; কিন্তু ব্রহ্ম ইন্দ্রিয়াতীত । ১৩

তিনি (পরব্রহ্ম) সমগ্র বিশ্বকে ব্যাপ্ত করিয়া বিরাজিত আছেন । সকল শরীরের হস্ত ও পদ, চক্ষু ও কর্ণ, মস্তক ও মুখ তাঁহার হস্ত ও পদ, চক্ষু ও কর্ণ এবং মস্তক ও মুখ । ১৪

সমস্ত অন্তরিন্দ্রিয়ের ও বহিরিন্দ্রিয়ের কার্যসমূহের দ্বারা তিনি অবভাসিত (প্রকাশিত) হন । তিনি ইন্দ্রিয়কার্যে লিপ্ত আছেন এইরূপ প্রতীত হইলেও বস্তুতঃ তিনি কোন ইন্দ্রিয়ব্যাপারে ব্যাপৃত নহেন । কারণ তিনি সকল ইন্দ্রিয়বিহীন । তিনি সমস্ত সংশ্লেষরহিত । তথাপি মরুভূমি যেমন, মৃগতৃষ্ণিকার আস্পদ, সেইরূপ তিনি সর্বভূতের আশ্রয় । তিনি ত্রিগুণরহিত, অথচ তিনি মায়া দ্বারা ত্রিগুণের পরিণাম সুখ, দুঃখ ও মোহের উপলব্ধা । ১৫ 

তিনি চরাচর সর্বভূতের অন্তরে ও বাহিরে এবং স্থাবর ও জঙ্গম দেহসমূহে বিরাজিত । [তিনি এই সমস্তের অধিষ্ঠান, এই সমস্ত তাঁহাতে কল্পিত ।] অতি সূক্ষ বলিয়া তিনি অবিজ্ঞেয় । তিনি অ-জ্ঞানীর অজ্ঞাত বলিয়া অতিদূরে এবং আত্ম-স্বরূপে জ্ঞাত বলিয়া জ্ঞানীর অতি নিকটে । ১৬

ব্রহ্ম অপরিচ্ছিন্ন হইয়াও সর্বভূতে বিভক্তরূপে প্রতীত হন । রজ্জু যেরূপ কল্পিত সর্পাদির সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয়ের কারণ, সেইরূপ তিনি সর্বভূতের পালক, সংহারক ও স্রষ্টা । ১৭

[ব্রহ্ম সদা সর্বত্র বিদ্যমান থাকিলেও অনুপলব্ধিবশতঃ কেহ কেহ তাঁহার তমঃস্বভাবতা আশঙ্কা করেন । সেই আশঙ্কা দূরীকরণার্থ শ্রীভগবান্‌ বলিতেছেন - ]

ব্রহ্ম আদিত্যাদি জ্যোতিসমূহেরও জ্যোতিঃ এবং অজ্ঞানরূপ অন্ধকারের দ্বারা অসংস্পৃষ্ট । জ্ঞান, জ্ঞেয় এবং জ্ঞানগম্যরূপে তিনি সকলের হৃদয়ে অধিষ্ঠিত আছেন । ১৮

এইরূপে ক্ষেত্র, জ্ঞান এবং জ্ঞেয় সংক্ষেপে বলা হইল । আমার ভক্ত ক্ষেত্র, জ্ঞান এবং জ্ঞেয়ের যথার্থ তত্ত্ব অবগত হইয়া ব্রহ্মভাবলাভে সমর্থ হন । ১৯

প্রকৃতি ও পুরুষ উভয়কেই অনাদি বলিয়া জানিবে । বুদ্ধাদি দেহেন্দ্রিয় পর্যন্ত বিকারসমূহ এবং সুখ-দুঃখ ও মোহাত্মক গুণসমূহ ত্রিগুণাত্মক প্রকৃতি হইতেই উৎপন্ন বলিয়া জানিবে । ২০

প্রকৃতি কার্য এবং করণের উৎপত্তির কারণ এবং পুরুষ (জীব) সুখ ও দুঃখসমূহের উপলব্ধির কারণ বলিয়া কথিত হন । ২১

পুরুষ (ভোক্তা, ক্ষেত্রজ্ঞ) প্রকৃতিতে অবস্থিত হইয়া সুখ-দুঃখ-কার্য-করণরূপে পরিণত ও মোহাকারে অভিব্যক্ত প্রকৃতির গুণসমূহ ভোগ করেন । এই সকল গুণেতে আত্মভাবই পুরুষের দেবাদি সৎ জন্ম ও পশ্বাদি অসৎ জন্ম ও সদসদ্‌যোনিরূপ মনুষ্য-জন্ম-গ্রহণের প্রধান কারণ । ২২

[বর্তমান অধ্যায়োক্ত ক্ষেত্রজ্ঞ ও ঈশ্বরের একত্বজ্ঞান মোক্ষের হেতু । তাহা সাক্ষাৎ নির্দেশের জন্য পরবর্তী শ্লোক ।]

যিনি দেহ, ইন্দ্রিয়, মন, বুদ্ধি প্রভৃতির সাক্ষী বলিয়া এবং অনুমোদনকর্তা, ভর্তা, ভোক্তা, মহেশ্বর, পরমাত্মরূপেতে শ্রুতিতে উক্ত হন, সেই পুরুষোত্তমই এই দেহে বর্তমান আছেন, অর্থাৎ উপলব্ধ হন । ২৩

যিনি পুরুষকে (ব্রহ্মকে) সাক্ষাৎ আত্মভাবে জানেন ও সকল বিকারের সহিত অবিদ্যারূপ প্রকৃতিকে মিথ্যা বলিয়া জানেন, যে কোন অবস্থায় বিদ্যমান হইয়াও তিনি পুনর্বার জন্মগ্রহণ করেন না । ২৪

কেহ কেহ ধ্যানের দ্বারা শুদ্ধ অন্তঃকরণ সহায়ে বুদ্ধিতে সাক্ষীভূত প্রত্যক্‌চৈতন্যকে দর্শন করেন । অন্য কেহ কেহ জ্ঞানযোগ দ্বারা এবং অপর কেহ কেহ কর্মযোগ দ্বারা আত্মদর্শন করেন । ২৫

অপর কেহ কেহ এইরূপে আত্মাকে জানিতে না পারিয়া আচার্যের নিকট উপদেশ গ্রহণপূর্বক উপাসনা করেন । তাঁহারাও গুরুদত্ত উপদেশ নিষ্ঠার সহিত সাধন করিয়া এই মৃত্যুময় সংসার অতিক্রম করেন । ২৬

হে অর্জুন, যাহা কিছু স্থাবর ও জঙ্গম পদার্থ উৎপন্ন হয়, সেই সকলই ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রজ্ঞের সংযোগে উৎপন্ন হয়, জানিবে । ২৭

যিনি বিনাশশীল, সর্বভূতে নির্বিশেষভাবে অবস্থিত অবিনাশী পরমাত্মাকে দর্শন করেন, তিনিই সম্যগ্‌দর্শী । ২৮

সেই সমদর্শী সর্বত্র নির্বিশেষরূপে অবস্থিত পরমাত্মাকে দর্শন করেন বলিয়া নিজে নিজেকে হিংসা করেন না । সেই হেতু তিনি পরম গতি প্রাপ্ত হন । ২৯

কায়মনোবাক্য দ্বারা কৃত সকল কর্ম প্রকৃতি দ্বারাই সর্বপ্রকারে সম্পাদিত এবং আত্মাকে সর্বোপাধিবিবর্জিত বলিয়া যিনি দর্শন করেন, তিনিই সম্যগ্‌দর্শী । ৩০

যখন তিনি পৃথক্‌ পৃথক্‌ ভূতসমূহকে আত্মাতেই একত্র অবস্থিত দর্শন করেন এবং সেই আত্মা হইতেই ভূতসকলের বিকাশ উপলব্ধি করেন, তখন তিনি ব্রহ্মস্বরূপ হন । ৩১

হে কৌন্তেয়, এই পরমাত্মা অনাদি ও নির্গুণ বলিয়া অব্যয় । সেই হেতু তিনি শরীরসমূহে অবস্থিত হইলেও কোন কর্ম করেন না । সুতরাং কখনও কোন কর্মফলে লিপ্ত হন না । ৩২

যেমন সর্বব্যাপী আকাশ পঙ্কাদি সকল পদার্থে অবস্থিত হইয়াও অতি সূক্ষ্ম বলিয়া কোন বস্তুতে লিপ্ত হয় না, তদ্রূপ সকলপ্রকার দেহে থাকিয়াও আত্মা দৈহিক গুণ বা দোষে কখনো লিপ্ত হন না । ৩৩

হে ভারত, যেরূপ একমাত্র সূর্য সমগ্র জগৎকে আলোকিত করেন, সেইরূপ এক পরমাত্মা সমস্ত ক্ষেত্রকে প্রকাশিত করেন । কিন্তু তিনি কখনও প্রকাশ্য ক্ষেত্রের ধর্ম দ্বারা লিপ্ত হন না । ৩৪

যাঁহারা উক্ত প্রকারে ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রজ্ঞের পরস্পর প্রভেদ জানেন এবং ভূতসমূহের অবিদ্যারূপ প্রকৃতির মিথ্যাত্ব জ্ঞানচক্ষুর দ্বারা জ্ঞাত হন, তাঁহারা পরব্রহ্মকে প্রাপ্ত হন (ও পুনর্বার দেহধারণ করেন না) । ৩৫

ভগবান্ ব্যাসকৃত লক্ষশ্লোকী শ্রীমহাভারতের ভীষ্মপর্বের অন্তর্গত শ্রীমদ্ভগবদ্গীতারূপ উপনিষদে ব্রহ্মবিদ্যাবিষয়ক যোগশাস্ত্রে শ্রীকৃষ্ণার্জুন-সংবাদে ক্ষেত্রক্ষেত্রজ্ঞবিভাগযোগ নামক ত্রয়োদশ অধ্যায় সমাপ্ত ।
_________________________________________

১) কোন কোন সংস্করণে এই শ্লোকটি নাই । শঙ্করাচার্যাদি অনেকে এইটি গ্রহণ করেন নাই; কিন্তু কেহ কেহ গ্রহণ করেছেন । গীতার শ্লোকসংখ্যা সাতশত পূর্ণ করিবার জন্য ইহা গ্রহণ করা হইল ।

২) দৃশ্য : প্রত্যক্ষাদি প্রমাণের দ্বারা উপলভ্যমান দৃশ্য অর্থাৎ প্রকৃতি ও তাহার সকল পরিণাম ।

শরীর = পুরুষের ভোগ ও অপবর্গের জন্য ঈশ্বরের ত্রিগুণাত্মিকা প্রকৃতির দেহেন্দ্রিয়-আকারে পরিণত সংঘাত এই শরীর স্থূল ও সুক্ষ্মরূপে দুই প্রকার । দর্শনেন্দ্রিয়, মনোবুদ্ধি ও পঞ্চপ্রাণের সমষ্টি সুক্ষ্মশরীর ।

স্বাভাবিক জ্ঞান : 'আমি মনুষ্য', 'আমার এই শরীর' ।
ঔপদেশিক জ্ঞান : ঘটাদির ন্যায় দৃশ্য বলিয়া স্থূল ও সুক্ষ্ম শরীর আত্মা নহে ।

ক্ষেত্র : দৃশ্য, অনাত্মা । যাহা অবিদ্যা দ্বারা আত্মাকে নাশ করে এবং বিদ্যা দ্বারা আত্মাকে রক্ষা করে ।
ক্ষেত্রজ্ঞ : দ্রষ্টা, আত্মা ।
অবিদ্যা = স্থূল ও সুক্ষ্ম শরীরে আত্মাভিমান
বিদ্যা = আত্মা হইতে শরীর পৃথক এই বিবেক -[ ভাষ্যোৎকর্ষদীপিকা]

৩) সম্যক্‌ জ্ঞান : দৃশ্য ক্ষেত্র আত্মাতে কল্পিত হন এবং যিনি ক্ষেত্রজ্ঞ তিনি পরমেশ্বর হইতে অভিন্ন প্রত্যগাত্মা - এই জ্ঞানই মুক্তির একমাত্র সাধন ।

৫) ব্রহ্মস্বরূপ-প্রতিপাদক বেদবাক্যসমূহ : ব্রহ্মবিষয়ে এই সকল বাক্যই প্রমাণ । - [ব্রহ্মসূত্র, ১|১|৩] । ব্রহ্মসূচক বাক্যসমূহ ব্রহ্মসূত্র দ্বারাই ব্রহ্ম পদ্যতে = জ্ঞাত হন । অতএব ব্রহ্মসূত্ররূপ পদ = ব্রহ্মসূত্রপদ ।

৬) পঞ্চ সূক্ষ মহাভূত : উৎপত্তিকালে সর্বপ্রথমে শব্দগুণবিশিষ্ট আকাশ উৎপন্ন হয়; আকাশ হইতে শব্দ ও স্পর্শগুণবিশিষ্ট বায়ু; বায়ু হইতে শব্দ, স্পর্শ ও রূপগুণবিশিষ্ট তেজ; তেজ হইতে শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রসগুণবিশিষ্ট জল এবং জল হইতে শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস ও গন্ধগুণবিশিষ্ট পৃথিবী উৎপন্ন হয় । ইহাদিগকে সূক্ষ পঞ্চভূত অথবা পঞ্চ তন্মাত্র বলে । ইহারা সূক্ষ বলিয়া ব্যবহারের অযোগ্য ।

পঞ্চ স্থূল ভূত : পরে অর্ধাংশ আকাশ ও অন্য চারি ভূতের প্রত্যেকের এক অষ্টমাংশ একত্রীভূত হইয়া স্থূল বা পঞ্চীকৃত আকাশ নামে অভিহিত হয় । এইরূপ বায়ুর অর্ধাংশ এবং অন্য চারি ভূতের এক অষ্টমাংশ মিলিত হইয়া স্থূল বা পঞ্চীভূত বায়ু হয় । এইরূপে অন্যান্য ভূতও পঞ্চীকৃত হয় । এই প্রকারে সূক্ষ পঞ্চভূত পঞ্চীকৃত বা স্থূল হইয়া ব্যবহারের যোগ্য হয় ।

৭) ইচ্ছাদ্বেষ ইত্যাদিকে বৈশেষিকগণ আত্মধর্ম বলেন । কিন্তু বেদান্তমতে ইহারা ক্ষেত্রধর্ম । ইচ্ছাদ্বেষাদি দ্বারা অন্তঃকরণের সমস্ত ধর্ম গৃহীত হইয়াছে ।

চেতনা : তপ্ত লৌহপিণ্ডে প্রকাশিত অগ্নির ন্যায় দেহেন্দ্রিয়াদিসংঘাতে অভিব্যক্ত আত্মচৈতন্যের আভাস দ্বারা ব্যাপ্ত অন্তঃকরণ-বৃত্তি ।

৮) বহিঃশৌচ = মৃত্তিকা ও জলাদি দ্বারা শরীরের মল অপনয়ন
অন্তঃশৌচ = ভাবশুদ্ধি দ্বারা মনের রাগাদি মল অপনয়ন

১২) তত্ত্বজ্ঞানার্থ দর্শন : ব্রহ্মের যাথাত্ম্য-জ্ঞান = অমানিত্বাদি পূর্ণানুষ্ঠান-পরিপাক-নিমিত্তক তত্ত্বজ্ঞান । তাহার অর্থ = প্রয়োজন = মোক্ষ; তাহার দর্শন = আলোচনা ।
 
১৫) ক্ষেত্র-উপাধিকৃত ধর্ম ক্ষেত্রজ্ঞে মিথ্যা আরোপিত হয় ।

১৬) তিনি এই সমস্তের অধিষ্ঠান; এই সমস্ত তাঁহাতে কল্পিত ।

১৮) জ্যোতিসমূহেরও জ্যোতিঃ : যাঁহার তেজ দ্বারা জ্যোতিষ্মান্‌ হইয়া সূর্য তাপ দেন ।
 
জ্ঞানগম্য = জ্ঞেয় ব্রহ্ম জ্ঞাত হইলে তাঁহাকে জ্ঞানগম্য বলা হয় ।
 
ব্রহ্মজ্ঞানলাভ অসম্ভব মনে করিয়া যাহারা অবসাদপ্রাপ্ত হইয়াছেন তাঁহাদিগকে বলা হইতেছে যে, জ্ঞান, জ্ঞেয় এবং জ্ঞানগম্য সকলের হৃদয়ে রহিয়াছে । জ্ঞানের অসম্ভাবনা অকর্তব্য । শ্রীরামকৃষ্ণ বলিতেন, "একটি দেশলাইকাঠি জ্বালিলে ঘরের হাজার হাজার বছরের অন্ধকার মুহূর্তমধ্যে অন্তর্হিত হয় ।"
 
১৯) ভক্ত = যাহা দৃষ্ট, শ্রুত ও স্পৃষ্ট বা অন্য প্রকারে অনুভূত হয়, সবই সেই ব্রহ্ম - এই প্রকার বুদ্ধি যাঁহার, তিনিই ভক্ত, তিনিই জ্ঞানী ।

২০) অনাদি : ঈশ্বর অনাদি বলিয়া প্রকৃতিদ্বয়ও অনাদি । কারণ তিনি সর্বদাই এই প্রকৃতিদ্বয়ের সহিত সংযুক্ত আছেন ।
 
২১) কার্য = দেহ; করণ = দেহস্থ ত্রয়োদশ - যথা, দশ ইন্দ্রিয়, মন, বুদ্ধি ও প্রাণ ।

সংসার = কার্য ও করণ এবং সুখ ও দুঃখরূপে পরিণত ভোগ্যা প্রকৃতির সহিত ভোক্তা চেতন পুরুষের অবিদ্যাবশতঃ সংযোগই সংসার ।

২২) কার্য ও করণরূপে পরিণত প্রকৃতিতে আত্মবুদ্ধি করাই প্রকৃতিতে অবস্থিতি

২৩) সাক্ষী : শরীর ও ইন্দ্রিয়াদির ব্যাপারে অব্যাপৃত এবং শরীরেন্দ্রিয়াদি হইতে স্বতন্ত্র ও সামীপ্যবশতঃ তাহাদের ব্যাপারে দ্রষ্ঠা ।

মহেশ্বর : সর্বাত্মক ও স্বতন্ত্র ।

পরমাত্মা : অবিদ্যা দ্বারা প্রত্যগাত্মরূপে কল্পিত দেহাদি হইতে বুদ্ধি পর্যন্ত সকল পদার্থের অন্তরাত্মা ।

২৪) যে কোন অবস্থায় : বিহিত ও নিষিদ্ধ কর্ম করিয়াও । - [আনন্দগিরি]

২৫) ধ্যান = তৈলধারার ন্যায় অবিচ্ছিন্ন ধ্যেয় বস্তুর প্রত্যয়-প্রবাহ

জ্ঞান : সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ গুণ আমার দৃশ্য, আমি ইহাদের দ্রষ্টা (সাক্ষিস্বরূপ) এবং নিত্য-শুদ্ধ-বুদ্ধ-মুক্ত-আত্মা - এই দৃঢ়নিশ্চয় ।
 
২৭) ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রজ্ঞের সংযোগ : রজ্জু, মরুভূমি ও শুক্তি প্রভৃতির বিবেকজ্ঞানের অভাববশতঃ যথাক্রমে সেই সকলে অধ্যারোপিত সর্প, মরীচিকা ও রজতাদির অধ্যাসের ন্যায় ক্ষেত্রক্ষেত্রজ্ঞের বিবেকজ্ঞানের অভাববশতঃ তাহাদের পরস্পর অধ্যাস ।
 
২৯) নিজে নিজেকে হিংসা : অজ্ঞ ব্যক্তির নিকট আত্মা অজ্ঞানাবৃত, তজ্জন্য অনাত্মা দেহকে আত্মরূপে গ্রহণপূর্বক দেহের মৃত্যুতে নিজের মৃত্যু কল্পনা করিয়া অজ্ঞ ব্যক্তি যেন পুনঃপুনঃ হত হন । অধিকন্তু পরমার্থ আত্মস্বরূপ অবিদ্যাচ্ছন্ন থাকায় আত্মা যেন সর্বদা হত হইয়াই আছেন । কারণ তিনি আত্মার বিদ্যমানতার ফল প্রাপ্ত হন না । - [ঈশ উপঃ, ৩]
 
৩১) আত্মা হইতেই ভূতসকলের বিকাশ : আত্মা হইতে প্রাণ, আত্মা হইতে আশা ইত্যাদি ।

ব্রহ্মবিৎ = ব্রহ্ম - [মুণ্ডক উপঃ, ৩|২|৯]

৩২) কোন কর্ম করেন না : ব্রহ্মবিদের ব্রহ্মাত্মভাব এত প্রবল হয় যে, তাঁহার দেহজ্ঞান প্রায়ই থাকে না । শ্রীরামকৃষ্ণদেবের অন্তরঙ্গ শিষ্য স্বামী শিবানন্দ বলিতেন, "মনে হয় যেন আমার দেহধারণ হয় নাই, যেন সংসারে আসি নাই ।"

৩৫) যাঁহারা কথিত প্রকারে ক্ষেত্রের জড়রূপ এবং ক্ষেত্রজ্ঞের চৈতন্যরূপ পরস্পর বিলক্ষণতা, শাস্ত্র ও আচার্যের উপদেশজনিত জ্ঞানচক্ষু দ্বারা অবগত হন এবং পরমার্থ আত্মবিদ্যা দ্বারা মায়ানামক অবিদ্যারূপ (সর্বভূতের) প্রকৃতির মোক্ষ (অভাবগমন, মিথাত্ম) জানিতে পারেন তাঁহারা পরব্রহ্ম প্রাপ্ত হন ও পুনর্বার দেহ ধারণ করেন না । 
'পরস্পরবিলক্ষণ দুই পদার্থ ১)দৃক্‌ ও ২)দৃশ্য আছে ।  দৃক্‌ (দ্রষ্ঠা) ব্রহ্ম; দৃশ্য (জগৎপ্রপঞ্চ) মায়া - উহা সর্ববেদান্তের সারতত্ত্ব ।' - [বিদ্যারণ্য কৃত দৃগ্‌দৃশ্যবিবেক]
দৃক্‌ = চৈতন্যস্বরূপ বিজ্ঞাতা, প্রকাশক ব্রহ্ম; আত্মা
দৃশ্য = জড়, বিষয়, অনাত্মা  
_________________________________________

*Hard Copy Source:
"Srimadbhagabadgeeta" translated by Swami Jagadeeshwarananda, edited by Swami Jagadananda. 27th Reprint - January, 1997 (1st Edition - 1941), © President, Sriramkrishna Math, Belur. Published by Swami Satyabrotananda, Udbodhan Office, 1 Udbodhan Lane, Bagbazar, Kolkata-700003. Printed by Rama Art Press, 6/30 Dum Dum Road, Kolkata-700030.

Sanskrit Source
English Translation

Disclaimer
This site is not officially related to Ramakrishna Mission & MathThis is a personal, non-commercial, research-oriented effort of a novice religious wanderer.
এটি আধ্যাত্মিক পথের এক অর্বাচীন পথিকের ব্যক্তিগত, অবাণিজ্যিক, গবেষণা-ধর্মী প্রয়াস মাত্র ।

[Digitised by scanning (if required) and then by typing mostly in Notepad using Unicode Bengali "Siyam Rupali" font and Avro Phonetic Keyboard for transliteration. Uploaded by rk

No comments:

Post a Comment