Sunday, July 27, 2014

শ্রীমদ্ভগবদ্‌গীতা : ষষ্ঠ অধ্যায় – ধ্যানযোগ (Gita : Chapter 6)

|||||৬||||১০|১১|১২|১৩|১৪|১৫|১৬|১৭|১৮
 (স্বামী জগদীশ্বরানন্দ)*
 
শ্রীভগবান্‌ বলিলেন -
কর্মফলের আশা না করিয়া যিনি কর্তব্য (অগ্নিহোত্রাদি) নিত্যকর্ম করেন, তিনিও সন্ন্যাসী, তিনিও কর্মযোগী । অগ্নিহোত্রাদি শ্রৌত ও তপোদানাদি স্মার্ত কর্ম যিনি ত্যাগ করিয়াছেন, কেবল তিনিই সন্ন্যাসী বা যোগী নন । ১

হে পাণ্ডব, শাস্ত্র যাহাকে সর্বকর্ম ও তাহার ফলত্যাগরূপ সন্ন্যাস বলেন, নিষ্কামকর্মানুষ্ঠানরূপ যোগকে তুমি সেই সিন্ন্যাস বলিয়াই জানিবে । কারণ, সংকল্পশূন্য না হইলে (কর্মফলের বাসনা ত্যাগ না করিলে) কেহ কর্মযোগী হইতে পারে না । ২

যিনি কর্মফলত্যাগী ও ধ্যানযোগে আরোহণ করিতে ইচ্ছুক, অর্থাৎ ধ্যানযোগে অনারূঢ় (ধ্যানযোগে অবস্থানে অশক্ত), তাঁহার পক্ষে নিষ্কাম কর্মানুষ্ঠানই উৎকৃষ্ট সাধন । সেই নিষ্কাম কর্মী যখন যোগারূঢ় হন, তখন সর্বকর্ম হইতে নিবৃত্তিই তাঁহার যোগারূঢ়ত্বের সাধন হয় । অর্থাৎ যেমন যেমন তিনি কর্ম হইতে উপরত হন, তেমন তেমন তাঁহার চিত্ত সমাহিত হয় এবং তিনি শীঘ্র যোগারূঢ় হন । ৩

যখন চিত্ত-সমাধান-অভ্যাসকারী যোগী ঐহিক ও পারত্রিক বিষয়ে সকল সংকল্প ত্যাগ করিয়া শব্দস্পর্শাদি ইন্দ্রিয়ভোগ্য বিষয়ে ও নিত্যনৈমিত্তিকাদি কর্মে প্রয়োজনাভাবে কর্তব্যবুদ্ধিশূন্য হন, তখন তাহাকে যোগারূঢ় বলা হয় । ৪

মানুষ বিবেকযুক্ত মন দ্বারা (আত্মনা) আপনিই আপনাকে সংসার হইতে উদ্ধার করিবে (যোগারুঢ় করিবে); কখনো নিজেকে বিষয়াসক্ত করিবে না । কারণ, শুদ্ধ মনই মানুষের প্রকৃত হিতকারী, মুক্তির হেতু এবং বিষয়াসক্ত মনই মানুষের পরম শত্রু, বন্ধনের কারণ । ৫

যে বিবেকযুক্ত মন দ্বারা দেহেন্দ্রিয়াদি বশীভূত হইয়াছে, সেই সংযত মনই আত্মার বন্ধু, কারণ উচ্ছৃঙ্খল প্রবৃত্তি রহিত হইয়া সেই মনই মুক্তির সহায়ক হয় । কিন্তু অজিতেন্দ্রিয় ব্যক্তির বিবেকশূন্য মন উচ্ছৃঙ্খল প্রবৃত্তিবশে শত্রুর ন্যায় স্বীয় অনিষ্টসাধনে প্রবৃত্ত হয় । ৬

ব্রহ্ম জিতেন্দ্রিয় ও প্রশান্ত যোগারূঢ় ব্যক্তির সাক্ষাৎ আত্মভাবে বর্তমান থাকেন । এইরূপ জীবন্মুক্ত ব্যক্তি শীত ও উষ্ণে, সুখ ও দুঃখে এবং সম্মান ও অপমানে অবিচলিত । ৭

কারণ যে যোগী শাস্ত্রজ্ঞান ও তত্ত্বানুভূতিতে পরিতৃপ্ত, যিনি শীতোষ্ণাদি দ্বন্দ্বে নির্বিকার ও জিতেন্দ্রিয় এবং যিনি মৃৎখণ্ড, প্রস্তর ও সুবর্ণে সমদর্শী (হেয়-উপাদেয়-বুদ্ধিশূন্য), তিনি যোগারূঢ় বলিয়া কথিত হন । ৮

সুহৃৎ, মিত্র, শত্রু, উদাসীন, দ্বেষ্য, বন্ধু, সদাচারী ও পাপীতে যাঁহার সমবুদ্ধি (ব্রহ্মবুদ্ধি) সুদৃঢ় হইয়াছে, তিনিই যোগারূঢ় । ৯

[যোগারূঢ়-অবস্থা-প্রাপ্তির উপায় বর্ণনা করিতেছেন - ]

নির্জন স্থানে যোগী একাকি (নিঃসঙ্গ), নিরাকাঙ্ক্ষ ও পরিগ্রশূন্য হইয়া দেহ ও মন সংযমপূর্বক অন্তঃকরণ সতত সমাহিত করিবেন । ১০

স্বভাবতঃ বা সংস্কারতঃ শুদ্ধ (ও বিবিক্ত) স্থানে যোগী প্রথমে কুশ, তদুপরি যথাক্রমে মৃগচর্ম ও বস্ত্রদ্বারা রচিত নাতি উচ্চ বা নাতি নিম্ন স্বীয় স্থির আসন স্থাপন করিবেন । ১১

যোগী সেই আসনে বসিয়া বাহ্য ও অন্তরিন্দ্রিয়ের কার্য সংযমপূর্বক চিত্তশুদ্ধির জন্য একাগ্র মনে যোগাভ্যাস করিবেন । ১২

মেরুদণ্ড, গ্রীবা ও মস্তক সরল ও নিশ্চলভাবে ধারণপূর্বক স্থির হইয়া এবং কোন দিকে না তাকাইয়া স্বীয় নাসিকাগ্রে দৃষ্টি নিবদ্ধ করিবেন । ১৩

প্রশান্তচিত্ত, ভয়রহিত, ব্রহ্মচর্য পালন ও গুরুসেবাদি ব্রতে স্থিত, মদ্গতচিত্ত ও মৎপরায়ণ যোগী মন একাগ্র করিয়া নিত্য ধ্যানাভ্যাস করিবেন । ১৪

[যোগের ফল বলিতেছেন - ] যোগী এইরূপে সদা সংযতভাবে মন সমাহিত করিয়া আমার স্বরূপভূত মোক্ষপ্রদ পরম শান্তি প্রাপ্ত হন । ১৫

অতিভোজির, একান্ত অনাহারীর, অত্যন্ত নিদ্রালুর এবং অতি অনিদ্রা-অভ্যাসীর ধ্যান হয় না । ১৬

যিনি পরিমিত আহার ও বিহার করেন এবং মন্ত্রজপ শাস্ত্রপাঠাদি কর্মে পরিমিত প্রচেষ্টা করেন, যাঁহার নিদ্রা ও জাগরণ নিয়মিত (কালে ও পরিমাণে নির্দিষ্ট), তাঁহার ধ্যান সংসারদুঃখের নাশক হয় । ১৭

[ভগবান্‌ সম্প্রজ্ঞাত সমাধির বর্ণনা করিতেছেন ।]

যখন যোগী সকল কামনা হইতে মুক্ত হন এবং তাঁহার চিত্ত বাহ্য চিন্তা পরিত্যাগপুর্বক বৃত্তিরহিত হইয়া আত্মাতে অবস্থান করে, তখন তাঁহার (সম্প্রজ্ঞাত) সমাধি হয় । ১৮

বায়ুবর্জিত স্থানে অবস্থিত দীপশিখা যেমন কম্পিত হয় না, চিত্তবৃত্তির নিরোধ-অভ্যাসকারী যোগীর একাগ্রীভূত চিত্তেরও সেই উপমা জানিবে, অর্থাৎ যোগীর নিরুদ্ধ চিত্ত সবিকল্প সমাধিতে সেইরূপ নিষ্কম্প দীপশিখার ন্যায় নিশ্চলভাবে অবস্থিত থাকে । ১৯

[ভগবান্‌ অসম্প্রজ্ঞাত সমাধির বর্ণনা করিতেছেন ।]

যে অবস্থায় ধ্যানাভ্যাস দ্বারা চিত্ত সর্ববৃত্তিশূন্য হয় এবং যে অবস্থায় শুদ্ধ অন্তঃকরণ দ্বারা পরম চৈতন্য জ্যোতিঃস্বরূপ আত্মাকে উপলব্ধি করিয়া যোগী প্রত্যগাত্মাতেই পরিতুষ্ট হন । ২০

যে অবস্থায় আত্মাকারা বুদ্ধি দ্বারা গ্রাহ্য ও ইন্দ্রিয়গোচরাতীত অর্থাৎ অবিষয়জনিত ব্রহ্মানন্দরূপ পরমসুখ যোগী অনুভব করেন, এবং যাহাতে অবস্থিত হইলে আত্মস্বরূপে সংস্থিতি হইতে বিন্দুমাত্র বিচলিত হন না, - ২১

যাহা লাভ করিয়া যোগী অন্য লাভ তদপেক্ষা অধিক মনে করেন না এবং যে আত্মতত্ত্বে অবস্থিত হইয়া শস্ত্রনিপাতাদিরূপ মহাদুঃখেও বিচলিত হন না (অপরিপক্ক যোগে দুঃখ অসহ্য হয়), - ২২

নিখিল দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃতিরূপ সেই আত্মস্থিতিকে (ব্রাহ্মী-স্থিতিকে) অসম্প্রজ্ঞাত সমাধি বলিয়া জানিবে । নির্বেদশূন্য চিত্তে অধ্যবসায় সহকারে এই সমাধি অভ্যাস করা উচিত । ২৩

সংকল্পজাত সমস্ত কামনা নিঃশেষে ত্যাগ করিয়া মনের দ্বারাই ইন্দ্রিয়সমূহকে সকল বিষয় হইতে নিবৃত করিয়া, - ২৪

ধৈর্যযুক্ত বুদ্ধি দ্বারা মনকে ধীরে ধীরে উপরত করিবে এবং আত্মাতে মনকে বিলীন করিয়া অন্য কিছুই চিন্তা করিবে না । ইহাই অসম্প্রজ্ঞাত সমাধির অন্তরঙ্গ সাধন । ২৫

সমাধিসাধনে প্রবৃত্ত যোগী চঞ্চল ও অস্থির মন যে যে বিষয়ে ধাবিত হয় সেই সেই বিষয় হইতে নিবৃত্ত করিয়া ইহাকে আত্মাতেই স্থির করিবেন । ২৬

প্রশান্তচিত্ত, মোহাদি ক্লেশরূপ রজোবৃত্তিশূন্য, নিষ্পাপ ও ব্রহ্মভাব-প্রাপ্ত যোগীই পরম সুখ লাভ করেন । ২৭

এইরূপে মনকে সদা যোগমুক্ত করিয়া নিষ্পাপ যোগী অনায়াসে ব্রহ্ম হইতে অভিন্ন আত্যন্তিকি শান্তি লাভ করেন । ২৮

[সমাধির ফলে সংসারদুঃখনাশক ব্রহ্মৈকত্ব-দর্শন হয় । ইহাই বর্ণিত হইতেছে - ]

সমাধিমান পুরুষ সর্বভূতে ব্রহ্মদর্শী হইয়া স্বীয় আত্মাকে ব্রহ্মাদিস্থাবরান্ত সর্বভূতে এবং সর্বভূতকে স্বীয় আত্মাতে দর্শন করেন । ২৯

[আত্মৈকত্ব-দর্শনের ফল শ্রীভগবান্‌ বলিতেছেন - ]

যিনি সর্বভূতে সকলের আত্মা আমাকে এবং সর্বাত্মা আমাতে ব্রহ্মাদি সর্বভূতকে দর্শন করেন, তাঁহার ও আমার একাত্মতা হেতু আমি তাঁহার অদৃশ্য হই না এবং তিনিও আমার অদৃশ্য (পরোক্ষ) হন না । ৩০

যিনি সর্বভূতে প্রত্যগাত্মরূপে অবস্থিত আমাকে স্বীয় আত্মরূপে অভেদজ্ঞানে ভজনা করেন, অর্থাৎ আমিই সেই - এইরূপ অপরোক্ষানুভব করেন, সেই যোগী যে কোন অবস্থায় বিদ্যমান থাকিয়াও আমাতেই অবস্থিত করেন; তাঁহার মোক্ষের প্রতিবন্ধক কিছুই হইতে পারে না । ৩১

হে অর্জুন, যিনি সকল ভূতের সুখ ও দুঃখকে নিজের সুখ ও দুঃখ বলিয়া অনুভব করেন, আমার মতে তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ যোগী । ৩২

অর্জুন বলিলেন -
হে মধুসূদন, সম্যগ্‌দর্শনরূপ যে সমত্বযোগ আপনি ব্যাখ্যা করিলেন, আমার মনের চঞ্চল স্বভাববশতঃ আমি ইহার নিশ্চল স্থিতি দেখিতে পাইতেছি না । ৩৩

হে কৃষ্ণ, মন অতি চঞ্চল, প্রবল এবং শরীর ও ইন্দ্রিয়াদির বিক্ষেপ-উৎপাদক । ইহাকে বিষয়বাসনা হইতে নিবৃত্ত করা অতিশয় কঠিন । সেইজন্য উহার নিরোধ আকাশস্থ বায়ুকে পাত্রবিশেষে আবদ্ধ করার ন্যায় দুঃসাধ্য মনে করি । ৩৪

শ্রীভগবান্‌ বলিলেন -
হে মহাবাহো, মন যে দুর্নিরোধ ও চঞ্চল তাহাতে কোন সন্দেহ নাই । কিন্তু হে কৌন্তেয়, ধ্যানাভ্যাস এবং ঐহিক ও পারলৌকিক বিষয়ভোগে বিতৃষ্ণা সাধন দ্বারা ইহাকে সংযত করা যায় । ৩৫

অসংযত ব্যক্তির পক্ষে সমাধি দুষ্প্রাপ্য - ইহা আমার অভিমত । কিন্তু পুনঃ পুনঃ যত্নশীল ও জিতেন্দ্রিয় ব্যক্তি ধ্যানাভ্যাস ও বৈরাগ্যসাধন দ্বারা এই সমাধি লাভ করিতে পারেন । ৩৬

অর্জুন জিজ্ঞাসা করিলেন -
হে কৃষ্ণ, শ্রদ্ধাবান্‌ সম্যক্‌ যত্নহীন যোগচ্যুত যোগী যোগে সিদ্ধিলাভ না করিলে কোন্‌ মার্গে গমন করেন ? ৩৭

হে কৃষ্ণ, ব্রহ্মপ্রাপ্তির পথে কর্মমার্গ ও ধ্যানমার্গ হইতে বিভ্রষ্ট, বিমূঢ় ও নিরাশ্রয় যোগী সংচ্ছিন্ন মেঘখণ্ডের ন্যায় কি বিনষ্ট হন ? ৩৮

হে কৃষ্ণ, আমার এই সংশয় নিঃশেষে দূর করিতে একমাত্র আপনিই সমর্থ । কারণ আপনি ভিন্ন অন্য কোনও ঋষি বা দেবতা আমার এই সংশয় দূর করিতে পারিবেন না । ৩৯

শ্রীভগবান্‌ বলিলেন -
হে পার্থ, বৈদিক কর্মত্যাগ করা সত্ত্বেও যোগভ্রষ্ট ব্যক্তি ইহলোকে পতিত বা নিন্দিত হন না, পরলোকেও নিকৃষ্ট শরীর প্রাপ্ত হন না। হে বৎস, ইহার কারণ, কল্যাণকারীর কখনও অধোগতি হয় না । ৪০

যোগভ্রষ্ট ব্যক্তি (অল্পকাল যোগাভ্যাসী) পুণ্যকারিগণের প্রাপ্য ব্রহ্মলোকাদি ঊর্ধ্বলোক লাভ করিয়া তথায় বহু বৎসর বাস করেন। অনন্তর সদাচারসম্পন্ন ধনীর গৃহে জন্মগ্রহণ করেন । ৪১

অথবা, যোগভ্রষ্ট পুরুষ (চিরাভ্যস্ত) জ্ঞানবান্‌ যোগিগণের কুলে জন্মগ্রহণ করেন । ঈদৃশ (দ্বিতীয় প্রকার) জন্ম জগতে অতি দুর্লভ । ৪২

হে কুরুনন্দন, যোগভ্রষ্ট পুরুষ সেই দেহে পূর্ব জন্মের সুকৃতির ফলে মোক্ষপর বুদ্ধি লাভ করিয়া সিদ্ধিলাভের জন্য অধিকতর প্রযত্ন করেন । ৪৩

তিনি (যোগভ্রষ্ট) পূর্বজন্মের অভ্যাসবশে যেন অবশ হইয়াও যোগসাধনে প্রবৃত্ত হন । যোগের স্বরূপ জানিতে ইচ্ছুক হইয়া যোগমার্গে প্রবৃত্ত যোগভ্রষ্টও বেদোক্ত যজ্ঞানুষ্ঠানের ফল অতিক্রম করেন । আর যিনি যোগের স্বরূপ জানিয়া তন্নিষ্ঠ হইয়া যোগাভ্যাস করেন, তাঁহার সাফল্যের নিশ্চয়তা বলাই বাহুল্য । ৪৪

যোগী ইহজন্মে পূর্বজন্মকৃত যত্ন অপেক্ষা অধিকতর যত্ন করিয়া পাপমুক্ত হইয়া পূর্ব পূর্ব জন্মের সাধনসঞ্চিত সংস্কার দ্বারা সিদ্ধিলাভ করিয়া মোক্ষপ্রাপ্ত হন । ৪৫

যোগী কৃচ্ছ্র চান্দ্রায়ণাদি তপোনিষ্ঠ ব্যক্তিগণ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ । শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিতগণ অপেক্ষা এবং অগ্নিহোত্রাদি যজ্ঞপরায়ণ কর্মিগণ অপেক্ষাও যোগী শ্রেষ্ঠ । অতএব হে অর্জুন, তুমি যোগী হও । ৪৬

যিনি শ্রদ্ধার সহিত মদ্গত চিত্তে আমার ভজনা করেন, তিনি দেবতাদিধ্যানপর সকল যোগীর মধ্যে উৎকৃষ্ট, ইহা আমার অভিমত । ৪৭

[এই অধ্যায়ের শেষ শ্লোক দুইটি পরবর্তী (সপ্তম) অধ্যায়ের সূচনা-স্বরূপ ।]

ভগবান্‌ ব্যাসকৃত লক্ষশ্লোকী শ্রীমহাভারতের ভীষ্মপর্বের অন্তর্গত শ্রীমদ্ভগবদ্গীতারূপ উপনিষদে ব্রহ্মবিদ্যাবিষয়ক যোগশাস্ত্রে শ্রীকৃষ্ণার্জুনসংবাদে ধ্যানযোগনামক ষষ্ঠ অধ্যায় সমাপ্ত ।
_________________________________________


১) সন্ন্যাসী = যাঁহার সন্ন্যাস অর্থাৎ কাম্য কর্ম ত্যাগ হইয়াছে
কর্মযোগী : চিত্তবিক্ষেপের কারণ কর্মফল । এই কর্মফলের বাসনা ত্যাগহেতু যাঁহার যোগ = চিত্তসমাধান হইয়াছে ।

২) সন্ন্যাসী যেরূপ কর্ম ও তৎফলত্যাগী, কর্মযোগীও সেইরূপ কর্মযলের বাসনাত্যাগী ।

৩) চিত্তশুদ্ধি দ্বারা ধ্যানযোগপ্রাপ্তির সাধন । কর্মযোগ বহিরঙ্গ সাধন এবং ধ্যানযোগ অন্তরঙ্গ সাধন । বহিরঙ্গ সাধনে সিদ্ধ না হইলে অন্তরঙ্গ সাধনের অধিকার জন্মে না । - [আনন্দগিরি]
আত্মসাক্ষাৎকাররূপ নির্বিকল্প সমাধি পর্যন্ত লাভের সাধন । - [ভাষ্যোৎকর্ষদীপিকা]

৪,২৪) সংকল্প = শোভন-অধ্যাস = বিষয়ে মনোরমত্ববুদ্ধি । সর্বসংকল্প-ত্যাগের দ্বারা সকল কাম-ও সকল কর্ম-ত্যাগ সূচিত । - [শাঙ্করভাষ্য] । তাহা হইতে ‘এইটি আমার হউক’ এইরূপ কামনা উৎপন্ন হয় ।

হে কাম, তোমার মূল আমি জানি - সংকল্প হইতে তোমার জন্ম । তোমাকে আর সংকল্প করিব না । তাহা হইলে তুমি সমূলে বিনষ্ট হইবে । সংকল্প-সন্ন্যাসই বৈদিক সন্ন্যাসের চরমাদর্শ । - [মহাভারত, শান্তিপর্ব]
 
৫) আত্মনা : গীতার আত্মা-শব্দটি ভুতাত্মা, জিবাত্মা, পরমাত্মা, প্রত্যগাত্মা প্রভৃতি বহু অর্থে ব্যবহৃত ।

হিতকারী : অন্য বন্ধুগণ স্নেহ প্রীত্যাদি বন্ধন দ্বারা সংসারমুক্তির সহায় না হইয়া প্রতিকূল হয় ।
 
৬) মনই মানুষের বন্ধন ও মুক্তির প্রধান কারণ । বিষয়াসক্ত মন বন্ধনের এবং নির্বিষয় মন মুক্তির কারণ হয় । - [মৈত্রায়ণী উপঃ, ৪|১১]
১১) শুদ্ধস্থানে স্বাধ্যায় (বেদপাঠ) করা উচিত । - [ছান্দোগ্য উপনিষদ]

১২) ভগবান বুদ্ধদেব যোগাসনে বসিবার পূর্ব এইরূপ সুদৃঢ় সঙ্কল্প করিয়াছিলেন - এই আসনে আমার শরীর শুষ্ক হউক; ত্বক, অস্থি ও মাংস ধ্বংস হউক । বহুকল্পদুর্লভ বোধি (জ্ঞান) লাভ না করিয়া এই আসন ত্যাগ করিব না । - [অশ্বঘোষকৃত ‘বুদ্ধচরিত’] । (এইরূপ দৃঢ়সঙ্কল্প করিয়া প্রত্যহ ধ্যানে বসিতে হয়)

১৩) নাসিকাগ্র-দর্শন বিধান হইতেছে না; কেবল অবস্থান নির্দেশ করিতেছেন । কারণ, নাসিকাগ্রে দৃষ্টি স্থির হইলে মন নাসিকাগ্রেই স্থির হইবে; কিন্তু আত্মাতে মন সমাধানই উদ্দেশ্য ।

১৬) অতিভোজী : যোগী ব্যঞ্জন ও অন্ন দ্বারা উদরের অর্ধভাগ ও জলের দ্বারা এক চতুর্থাংশ পূর্ণ করিবেন এবং বায়ুসঞ্চরণের জন্য অবশিষ্ট চতুর্থাংশ শূন্য রাখিবেন ।
 
১৭) নিয়মিত নিদ্রা ও জাগরণ : রাত্রির আদি ও অন্ত ভাগে জাগরণ এবং মধ্যভাগে নিদ্রা ।

২২) আত্মলাভ অপেক্ষা পুরুষার্থভূত লাভ্যান্তর নাই । - [আনন্দগিরি]
২৫,৩৬) সম্প্রজ্ঞাত / সবিকল্প সমাধি : ধ্যানে যখন আত্মাকারা চিত্তবৃত্তি (প্রত্যগাত্মা হইতে) কিঞ্চিৎ পৃথগ্‌ভাবে জ্ঞাত হইলে এই সমাধি হয় ।
অসম্প্রজ্ঞাত / নির্বিকল্প সমাধি : ধ্যেয়াকার চিত্তবৃত্তিই প্রত্যগাত্মাতে বিলীন হইলে এই সমাধি হয়; তখন সকল চিত্তবৃত্তির সম্যক নিরোধ হয় । বৃত্তিশূন্য মনের বিকাররহিত বা বৃত্তিহীন অবস্থিতি - ইহাই যোগিগণের সুপ্রিয় অবস্থা ।

২৬) শব্দাদি বিষয়ের যাথাত্ম্য (ব্রহ্মস্বরূপতা) নিরূপণ করিয়া বৈরাগ্য ভাবনা দ্বারা মনকে আত্মবশে আনিবে । নিদ্রাদিতে লয়শূন্য ও বিষয়াদিতে বিক্ষেপশূন্য হওয়াই আত্মাতে মনের প্রশমন । মন শুদ্ধ হইলে আত্মলীন হয় ।
যখন পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয় শব্দাদি বিষয় ত্যাগপূর্বক মনের সহিত অবস্থান করে এবং বুদ্ধি কোন চেষ্টা করে না, সেই স্থির ইন্দ্রিয়ধারণাকে জ্ঞানিগণ সমাধি বলেন । - [কঠ উপনিষদ, ২|৩|১০-১১]

সমাধি = সকল চিত্তবৃত্তির সম্যক নিরোধ । - [পতঞ্জলি]
  
২৯) যেরূপে এই দেহের আত্মা (সর্বপ্রত্যয়ের সাক্ষী) আমি, সেইরূপ ব্রহ্মাদি স্থাবরান্ত সর্বভূতের আত্মা আমি । আমি বিশ্বব্যাপী শুদ্ধ-বুদ্ধ-মুক্ত আত্মা ।
 
৩২) যেমন আমার সুখ অনুকূল ও আমার দুঃখ প্রতিকূল, তেমনি সকল প্রাণীর সুখ অনুকূল ও দুঃখ প্রতিকূল - ইহা জানিয়া তিনি সকল প্রাণীর সুখ আকাঙ্ক্ষা করেন এবং কোন প্রাণীর দুঃখ ইচ্ছা করেন না । সুতরাং তাঁহার প্রবৃত্তি অন্যের দুঃখের কারণ হয় না; বরং অন্যের দুঃখের নিবৃত্তির কারণ হয় ।
 
৪৭) যিনি শ্রীভগবানের সগুণ বা নির্গুণ স্বরূপ যথোক্ত চিত্তে শ্রদ্ধাপূর্বক অনবরত অনুসন্ধান করেন । তিনি যোগযুক্তগণের মধ্যে সর্বাপেক্ষা যুক্ত (শ্রেষ্ঠ) - ইহাই শ্রীভগবানের অভিপ্রায় ।
 
চিত্ত শুদ্ধ হইলেও ধ্যান ব্যতীত কেবল সন্ন্যাসগ্রহণে মুক্তি হয় না । এইজন্য ষষ্ঠ অধ্যায়ে ভগবান্‌ ধ্যানযোগের বিস্তৃত বর্ণনা দিতেছেন ।
_________________________________________

*Hard Copy Source:
"Srimadbhagabadgeeta" translated by Swami Jagadeeshwarananda, edited by Swami Jagadananda. 27th Reprint - January, 1997 (1st Edition - 1941), © President, Sriramkrishna Math, Belur. Published by Swami Satyabrotananda, Udbodhan Office, 1 Udbodhan Lane, Bagbazar, Kolkata-700003. Printed by Rama Art Press, 6/30 Dum Dum Road, Kolkata-700030.

Sanskrit Source
English Translation

Disclaimer:
This site is not officially related to Ramakrishna Mission & Math. This is a personal, non-commercial, research-oriented effort of a novice religious wanderer.
এটি আধ্যাত্মিক পথের এক অর্বাচীন পথিকের ব্যক্তিগত, অবাণিজ্যিক, গবেষণা-ধর্মী প্রয়াস মাত্র ।

[Digitised by scanning (if required) and then by typing mostly in Notepad using Unicode Bengali "Siyam Rupali" font and Avro Phonetic Keyboard for transliteration. Uploaded by rk 

No comments:

Post a Comment