Tuesday, August 5, 2014

শ্রীমদ্ভগবদ্‌গীতা : একাদশ অধ্যায় – বিশ্বরূপদর্শনযোগ (Gita : Chapter 11)

|||||||||১০|১১|১২|১৩|১৪|১৫|১৬|১৭|১৮
 (স্বামী জগদীশ্বরানন্দ)*
 
['আমি একাংশমাত্র দ্বারা সমস্ত জগৎ ব্যাপ্ত করিয়া আছি' - পূর্বাধ্যায়ের শেষ শ্লোকে ভগবানের এই উক্তি শ্রবণপূর্বক তাঁহার জগদাত্মক ঈশ্বরীয় বিশ্বরূপ সাক্ষাত করিতে ইচ্ছা করিয়া -]

অর্জুন বলিলেন -
হে ভগবন্‌, আমার প্রতি অনুগ্রহ করিয়া অতিগুহ্য পুরুষার্থপ্রদ আত্মানাত্ম-বিবেকবিষয়ক যে অধ্যাত্ম-তত্ত্ব আপনি বলিলেন, তাহার দ্বারা আমার এই (আত্মার কর্তৃত্বাদিশূন্য স্বরূপের আবরক) মোহ দূর হইয়াছে । ১

হে পদ্মপলাশলোচন, ভূতগণের উৎপত্তি ও প্রলয় আপনা হইতে হয় এবং আপনার নিরুপাধিক ও সোপাধিক সর্বাত্মত্বাদিরূপ অক্ষয় মাহাত্ম্য বিস্তৃতভাবেই আপনার নিকট শ্রবণ করিলাম । ২

হে পরমেশ্বর, আপনি যে আত্মতত্ত্ব বলিয়াছেন, তাহা যথার্থ । তথাপি হে পুরুষোত্তম, আপনার জ্ঞান, ঐশ্বর্য, শক্তি, বল, বীর্য ও তেজঃ সমন্বিত ঈশ্বরীয় বিশ্বরূপ সাক্ষাৎ করিতে আমি ইচ্ছা করি । ৩

হে প্রভো, যদি আমি সেই বিশ্বরূপ দেখিবার যোগ্য হই, তাহা হইলে হে যোগেশ্বর, আমাকে আপনার অব্যয় জগদাত্মরূপ দেখান । ৪

শ্রীভগবান্‌ বলিলেন -
হে পার্থ, নানা বর্ণ ও নানা আকৃতি-বিশিষ্ট শত শত এবং সহস্র সহস্র আমার বিভিন্ন দিব্যমূর্তি দর্শন কর । ৫

হে ভারত, দ্বাদশ আদিত্য, অষ্ট বসু, একাদশ রুদ্র, অশ্বিনীকুমারদ্বয় এবং ঊনপঞ্চাশ বায়ূ দর্শন কর এবং বহু অদৃষ্টপূর্ব অদ্ভূত বস্তুও আমার বিশ্বরূপে দর্শন কর । ৬

হে অর্জুন, আমার এই বিরাট শরীরে অবয়বরূপে একত্র অবস্থিত সমগ্র স্থাবরজঙ্গমাত্মক বিশ্ব এবং অন্য যাহা কিছু দেখিতে ইচ্ছা কর, তাহা আজ দর্শন কর । ৭

তুমি নিজের প্রাকৃত স্থূল চক্ষু দ্বারা আমার বিশ্বরূপ দর্শন করিতে সমর্থ হইবে না । তোমাকে অপ্রাকৃত জ্ঞানচক্ষু দিতেছি । উহার দ্বারা আমার অঘটনঘটনসামর্থ্যরূপ যোগ-শক্তি দর্শন কর । ৮

সঞ্জয় বলিলেন -
হে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র মহান্‌ যোগেশ্বর ভগবান্‌ শ্রীকৃষ্ণ এইরূপ বলিয়া অর্জুনকে নিজের অলৌকিক বিশ্বরূপ দেখাইলেন । ৯

সেই বিশ্বরূপ অনেক মুখ ও অনেক নেত্র-যুক্ত, অনেক অদ্ভূত আকৃতি ও অসংখ্য দিব্য-অলঙ্কার-বিশিষ্ট এবং অনেক উদ্যত দিব্য আয়ুধে সজ্জিত । ১০

উক্ত বিশ্বরূপ দিব্যমাল্যে ও দিব্য বস্ত্রে ভূষিত, দিব্য গন্ধ দ্বারা অনুলিপ্ত, অত্যন্ত আশ্চর্যজনক, জ্যোতির্ময়, অনন্ত ও সর্বত্র মুখবিশিষ্ট । ১১

যদি আকাশে সহস্র সূর্যের প্রভা যুগপৎ সমুদিত হয়, তাহা হইলে সেই দীপ্তি বিশ্বরূপের প্রভার কিঞ্চিৎ তুল্য হইতে পারে । ১২

তখন অর্জুন সেই দেবদেবের বিরাট শরীরে দেব, পিতৃ, মনুষ্যাদি নানাভাবে বিভক্ত সমগ্র জগৎ অবয়বরূপে একত্র অবস্থিত দেখিলেন । ১৩

অর্জুন সেই বিশ্বরূপ দর্শন করিয়া আশ্চার্যান্বিত ও রোমাঞ্চিত হইলেন এবং অবনত মস্তকে বিশ্বরূপধারী ভগবান্‌কে প্রণাম করিয়া করজোড়ে বলিলেন - ১৪

অর্জুন বলিলেন -
হে দেব, আপনার এই বিশ্বরূপে সমস্ত দেবতা, চরাচর জগৎ, বশিষ্ঠাদি ঋষিগণ, বাসুকি প্রভৃতি সর্পসমূহ ও পৃথিবীপদ্মের মেরুকর্ণিকাসনে অবস্থিত সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মাকে দেখিতেছি । ১৫

হে বিশ্বেশ্বর, সর্বত্র বহু বাহু, বহু উদর, বহু মুখ ও বহু নেত্র-বিশিষ্ট আপনার বিরাট মূর্তি দেখিতেছি । হে বিশ্বরূপ, আমি আপনার আদি, মধ্য ও অন্ত দেখিতেছি না । ১৬

কিরীট, গদা ও চক্রধারী, সর্বত্র দীপ্তিমান, তেজঃপুঞ্জস্বরূপ, দুর্নিরীক্ষ্য, প্রদীপ্ত অগ্নি ও সূর্যের ন্যায় প্রভাবিশিষ্ট এবং অপ্রমেয়স্বরূপ আপনাকে আমি সর্বত্র দেখিতেছি । ১৭

আপনি পরব্রহ্ম এবং একমাত্র জ্ঞাতব্য । আপনি বিশ্বের পরম আশ্রয় ও সনাতন ধর্মের রক্ষক । আপনি সনাতন পরমাত্মা - ইহাই আমার অভিমত । ১৮

আমি দেখিতেছি, আপনার আদি, মধ্য ও অন্ত নাই; আপনি অনন্তশক্তিশালী ও অসংখ্যবাহুবিশিষ্ট; চন্দ্র ও সূর্য আপনার নেত্র; আপনার মুখমণ্ডলে প্রদীপ্ত অগ্নির জ্যোতিঃ এবং আপনি স্বীয় তেজে সমস্ত জগৎ সন্তপ্ত করিতেছেন । ১৯

হে ভগবন্‌, স্বর্গ ও মর্ত্যের মধ্যবর্তী অন্তরীক্ষ এবং দশ দিক্‌ আপনি পরিব্যাপ্ত করিয়া আছেন । আপনার এই অদ্ভূত উগ্র বিশ্বরূপ দেখিয়া ত্রিলোক অতিশয় ভীত হইতেছে । ২০

[কুরুক্ষেত্রযুদ্ধে জয়পরাজয়বিষয়ে অর্জুনের আশঙ্কা শ্রীভগবান্‌ দূর করিতেছেন -]

শ্রীকৃষ্ণলীলায় ভূভারহরণার্থ ধরাতলে অবতীর্ণ ঐ যুধ্যমান মনুষ্যদেহধারী বসু আদি দেবতাগণ আপনাতেই প্রবেশ করিতেছেন । কেহ কেহ ভীত হইয়া করজোড়ে আপনার গুণগান করিতেছেন এবং মহর্ষি ও সিদ্ধগণ 'জগতের কল্যাণ হউক' বলিয়া প্রচুর স্তুতিবাক্য দ্বারা আপনার স্তব করিতেছেন । ২১

রুদ্রগণ ও আদিত্যগণ, সাধ্য নামক দেবগণ ও বসুগণ, বিশ্ব নামক দেবতাগণ, অশ্বিনীকুমারদ্বয়, মরুদ্‌গণ ও পিতৃগণ এবং হাহা হূহূ প্রভৃতি গন্ধর্ব, কুবের প্রভৃতি যক্ষ, বিরোচন প্রভৃতি অসুর ও কপিকাদি সিদ্ধগণ সকলেই বিস্মিত হইয়া আপনার বিশ্বরূপ দর্শন করিতেছেন । ২২

হে মহাবাহো, বহু মুখ, বহু চক্ষু, বহু বাহু, বহু ঊরু, বহু চরণ ও বহু উদর-বিশিষ্ট এবং অসংখ্য বৃহৎ দন্ত দ্বারা ভীষণ আপনার বিরাট বিগ্রহ দেখিয়া সর্ব প্রাণী অত্যন্ত ভীত হইয়াছে এবং আমিও অতিশয় ভীত হইয়াছি । ২৩

হে ভগবান্‌ আপনার আকাশস্পর্শী তেজোময়, নানাবর্ণযুক্ত ও বিস্ফারিত মুখমণ্ডল এবং উজ্জ্বল বিশাল চক্ষু দেখিয়া আমার হৃদয় ব্যথিত হইয়াছে এবং আমি ধৈর্য ও শান্তি পাইতেছি না । ২৪

হে দেবেশ, দীর্ঘ দন্ত দ্বারা বিকৃত ও প্রলয়াগ্নিতুল্য আপনার মুখসকল দেখিয়া আমার দিগ্‌ভ্রম হইতেছে এবং আমি শান্তি পাইতেছি না । হে জগন্নিবাস, আপনি আমার প্রতি প্রসন্ন হউন । ২৫

রাজন্যবর্গ সহ ঐ ধার্তরাষ্ট্রগণ এবং মৎপক্ষীয় ধৃষ্টদ্যুম্ন প্রভৃতি প্রধান যোদ্ধাগণ, ভীষ্ম, দ্রোণ ও কর্ণের সহিত আপনার দংষ্ট্রাকরাল ভীষণ মুখগহ্বরে দ্রুতবেগে প্রবেশ করিতেছেন । মুখপ্রবিষ্টদিগের মধ্যে কেহ কেহ চূর্ণিতমস্তক হইয়া ভক্ষিত মাংসখণ্ডসমূহের ন্যায় আপনার দন্তসন্ধিস্থলে সংলগ্ন হইতেছেন, দেখিতেছি । ২৬-২৭

যেমন নদীসমূহের বহু জলস্রোত সমুদ্রাভিমুখে প্রবাহিত হইয়া দ্রুতবেগে সমুদ্রে বিলীন হয়, সেরূপ এই বীরপুরুষগণ আপনার সর্বত্র প্রজ্বলন্ত মুখবিবরে প্রবেশ করিতেছেন । ২৮

যেমন পতঙ্গগণ দ্রুতগতিতে ধাবিত হইয়া মরণের জন্যই জ্বলন্ত অগ্নিতে প্রবেশ করে, সেইরূপ এই লোকসকলও মৃত্যুর নিমিত্ত অতিবেগে আপনার মুখগহ্বরসমূহে প্রবেশ করিতেছেন । ২৯

হে ভগবান্‌, আপনি আপনার জ্বলন্ত মুখসমূহ দ্বারা দুর্যোধনাদি সকল লোককে গ্রাস করিয়া সর্বদিকে ভক্ষণ করিতেছেন । আপনার তীব্র প্রভা সমগ্র জগৎকে তেজোরাশি দ্বারা পূর্ণ করিয়া সন্তপ্ত করিতেছে । ৩০

উগ্রমূর্তি আপনি কে, আমাকে বলুন । আপনাকে প্রণাম করি । হে দেবশ্রেষ্ঠ, প্রসন্ন হউন । আদি পুরুষ আপনাকে আমি জানিতে ইচ্ছা করি । কারণ আপনার প্রচেষ্টার উদ্দেশ্য আমি বুঝিতে পারিতেছি না । ৩১

শ্রীভগবান্‌ বলিলেন -
আমি লোকক্ষয়কারী প্রবৃদ্ধ কাল । বর্তমানে লোকসংহার করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছি । তুমি যুদ্ধ না করিলেও বিপক্ষদলে যে বীরগণ আছেন, তাঁহারা কেহই জীবিত থাকিবেন না । ৩২

অতএব, তুমি যুদ্ধার্থ উত্থিত হও ও যশ লাভ কর এবং শত্রুবর্গকে পরাজিত করিয়া নিষ্কন্টক রাজ্য ভোগ কর । আমার দ্বারা ইহারা পূর্বেই নিহত হইয়াছে । হে সব্যসাচী, তুমি নিমিত্তমাত্র হও । ৩৩

ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ, জয়দ্রথ এবং অন্যান্য বীর যোদ্ধাকে আমি পূর্বেই নিহত করিয়াছি; সেই মৃতদিগকেই তুমি বধ কর । ভীত হইও না; তুমি যুদ্ধে শত্রুদিগকে নিশ্চয়ই জয় করিবে, অতএব যুদ্ধ কর । ৩৪

[এই স্থানে সঞ্জয়বাক্যের তাৎপর্য এই যে, দ্রোণাদির মৃত্যু অনিবার্য জানিয়া এবং দ্রোণাদির মৃত্যু হইলে দুর্যোধনাদিরও জীবনের আশা করা বৃথা - ইহা জানিয়াও অখণ্ডনীয় ভবিতব্যতাবশতঃ ধৃতরাষ্ট্র সন্ধি করিতে ইচ্ছুক হইলেন না ।]

সঞ্জয় বলিলেন -
ভগবান্‌ শ্রীকৃষ্ণের এই বাক্যশ্রবণে অত্যন্ত ভীত হইয়া কম্পিতকলেবরে কৃতাঞ্জলিপুটে প্রণামপূর্বক গদ্‌গদভাবে অর্জুন বলিলেন - ৩৫

অর্জুন বলিলেন -
হে হৃষিকেশ, আপনার মাহাত্ম্যকীর্তনে সমস্ত জগৎ প্রহৃষ্ট ও আপনার প্রতি অনুরক্ত হয় । কারণ আপনি সর্বাত্মা ও সর্বভূতের সুহৃৎ । রাক্ষসগণ ভীত হইয়া নানাদিকে পলায়ন করিতেছে এবং সিদ্ধগণ আপনাকে নমস্কার করিতেছেন । এই সমস্তই যুক্তিযুক্ত । ৩৬

হে মহাত্মা, হে অনন্ত, হে দেবেশ, হে জগন্নিবাস, আপনি ব্রহ্মারও গুরু এবং আদি কারণ । আপনাকে সকলে কেন নমস্কার করিবেন না ? যাহা ব্যক্ত ও যাহা অব্যক্ত তাহা আপনি এবং এই উভয়ের অতীত (বেদান্তপ্রসিদ্ধ) যে অক্ষর ব্রহ্ম তাহাও আপনি । আপনি ভিন্ন ত্রিভুবনে অন্য কিছুই নাই । ৩৭

হে অনন্তরূপ, আপনি আদিদেব ও অনাদি পুরুষ এবং বিশ্বের পরম প্রলয়স্থান । যাহা কিছু বেদ্য, তৎসমূহের বেদিতা আপনি । যাহা কিছু বেদ্য, তাহাও আপনি । আপনি পরম ধাম এবং আপনিই জগৎকে পরিব্যাপ্ত করিয়া আছেন । ৩৮

আপনি বায়ু, যম, অগ্নি, বরুণ ও চন্দ্র । আপনি কশ্যপাদি প্রজাপতিরূপ লোকপিতা এবং পিতামহ ব্রহ্মারও জনক । আপনাকে সহস্রবার নমস্কার করি । আপনাকে পুনরায় নমস্কার করি । আবার আপনাকে পুনঃপুনঃ নমস্কার করি । ৩৯

হে সর্বাত্মা, আপনাকে সম্মুখে নমস্কার করিতেছি, আপনাকে পশ্চাতে নমস্কার করিতেছি, আপনাকে সকল দিক হইতেই নমস্কার করিতেছি । হে অনন্তবীর্য, আপনি অসীম বিক্রমশালী । আপনি সমগ্র বিশ্বকে ব্যাপিয়া আছেন, অতএব আপনি সর্বস্বরূপ । আপনি ভিন্ন অন্য কিছুরই স্বতন্ত্র সত্তা নাই । ৪০

আপনার এই জগদাকার রূপের মাহাত্ম্য না জানিয়া প্রমাদহেতু বা প্রণয়বশতঃ আপনাকে সখা ভাবিয়া হে কৃষ্ণ, হে যাদব, হে সখে, এইরূপ অবিনয়ে সম্বোধন করিয়া যাহা বলিয়াছি । ৪১

এবং হে অচ্যুত, বিহার, শয়ন, আসন ও ভোজনকালে আপনার সাক্ষাতে বা অসাক্ষাতে, একাকী বা বন্ধুজনসমক্ষে পরিহাসচ্ছলে আপনাকে যে অসম্মান বা অমর্যাদা করিয়াছি, হে অপ্রমেয়, আপনার নিকট অজ্জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করি । ৪২

হে অমিতপ্রভাব, আপনি এই চরাচর জগতের স্রষ্ঠা, পূজা, গুরু এবং গুরুরও গুরু । অতএব, ত্রিভুবনে আপনার সমান আর কেহ নাই । ত্রিভুবনে আপনার অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ অন্য কে হইতে পারে ? ৪৩

হে পরমপূজ্যদেব, সেই হেতু আপনাকে দণ্ডবৎ প্রণাম করিয়া আপনার প্রসন্নতা প্রার্থনা করিতেছি । পিতা যেমন পুত্রের, সখা যেমন সখার, প্রিয় যেমন প্রিয়ার অপরাধ ক্ষমা করেন, আপনিও তদ্রুপ আমার অপরাধ ক্ষমা করুন । ৪৪

হে দেব, যাহা পূর্বে আমি দর্শন করি নাই বা অন্য কেহ দর্শন করে নাই, আপনার সেই বিশ্বরূপ দেখিয়া আমি আনন্দিত হইয়াছি । আমার মন ভয়ে ব্যথিত হইয়াছে । হে দেবেশ, হে জগন্নিবাস, আমার অতি প্রিয় আপনার সেই পূর্বরূপই আমাকে দেখান । আমার প্রতি প্রসন্ন হউন । ৪৫

হে সহস্রবাহো, আমি আপনাকে পূর্ববৎ সেই কিরীট, গদা ও চক্রধারিরূপে দেখিতে ইচ্ছা করি । হে বিশ্বমূর্তি, এখন আপনি আপনার সেই চতুর্ভুজমূর্তি ধারণ করুন । ৪৬ 

শ্রীভগবান্‌ বলিলেন -
হে অর্জুন, তোমার প্রতি প্রসন্ন হইয়া স্বীয় ঈশ্বরীয় যোগপ্রভাবে আমার তেজোময়, সমগ্র, অন্তশূন্য এবং আদিভূত ও উত্তম বিশ্বরূপ তোমাকে দেখাইলাম । তুমি ভিন্ন অন্য কেহ পূর্বে এই রূপ দর্শন করে নাই । ৪৭

হে কুরুশ্রেষ্ঠ, মনুষ্যলোকে চতুর্বেদাধ্যয়ন বা যজ্ঞবিজ্ঞান দ্বারা বা দানের দ্বারা বা অগ্নিহোত্রাদি শ্রৌত কর্মের দ্বারা বা চান্দ্রায়ণাদি কঠোর তপস্যা দ্বারাও আমার এই বিশ্বরূপ কেহ দেখিতে পায় নাই । একমাত্র তুমিই ইহা দর্শন করিলে । ৪৮

আমার এই ভয়ঙ্কর বিশ্বরূপ দেখিয়া তুমি ব্যথিত ও বিমূঢ় হইও না । ভয় ত্যাগ করিয়া প্রসন্নচিত্তে আমার এই সেই চতুর্ভুজ শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্মধর পূর্বরূপ দর্শন কর । ৪৯

সঞ্জয় বলিলেন -
শ্রীভগবান্‌ অর্জুনকে এইরূপ বলিয়া বসুদেবগৃহে জাত স্বকীয় চতুর্ভুজ রূপ তাঁহাকে দেখাইলেন এবং পুনরায় সৌম্যমূর্তি ধারণ করিয়া ভীত অর্জুনকে আশ্বস্ত করিলেন । ৫০

অর্জুন বলিলেন -
হে জনার্দন, আপনার এই সৌম্য মানুষরূপ দেখিয়া আমি প্রসন্নচিত্ত ও প্রকৃতিস্থ (সুস্থ) হইলাম । ৫১

শ্রীভগবান্‌ অর্জুনকে বলিলেন -
তুমি আমার যে অতি দুর্লভদর্শন বিশ্বরূপ দেখিলে দেবতাগণও সদা ইহার দর্শনাকাঙ্ক্ষী । ৫২

তুমি আমার যে রূপ দর্শন করিলে এই বিশ্বরূপ বেদপাঠ, চান্দ্রায়ণাদি তপস্যা, গো-সুবর্ণাদিদান বা পূজার দ্বারা দর্শন করা যায় না । ৫৩

হে অর্জুন, কেবলমাত্র অনন্যা ভক্তি দ্বারাই ঈদৃশ আমাকে (শাস্ত্র দ্বারা) জানিতে ও স্বরূপতঃ প্রত্যক্ষ করিতে এবং আমাতে প্রবেশরূপ মোক্ষলাভ করিতে ভক্তগণ সমর্থ হয়, অন্য উপায়ে নহে । ৫৪

হে পাণ্ডব, যে ব্যক্তি মৎকর্মকারী, মন্নিষ্ঠ, মদ্ভক্ত ও আত্মীয়স্বজনাদিতে আসক্তিশূন্য এবং সর্বভূতে, এমন কি অত্যন্ত অপকারীর প্রতিও বৈরভাববিহীন, তিনি আমাকে প্রাপ্ত হন । ৫৫

ভগবান্ ব্যাসকৃত লক্ষশ্লোকী শ্রীমহাভারতের ভীষ্মপর্বের অন্তর্গত শ্রীমদ্ভগবদ্গীতারূপ উপনিষদে ব্রহ্মবিদ্যাবিষয়ক যোগশাস্ত্রে শ্রীকৃষ্ণার্জুনসংবাদে বিশ্বরূপদর্শন নামক একাদশ অধ্যায় সমাপ্ত ।
_________________________________________


১) মোহ : 'আমি ইঁহাদের হন্তা', 'ইঁহারা আমার দ্বারা হত হইবেন' এইরূপ বিপরীত বুদ্ধি

৩৩) সব্যসাচী = যিনি সব্য (বাম হস্ত) দ্বারাও বাণনিক্ষেপে সমর্থ

৪৬) অর্জুন শ্রীকৃষ্ণকে চতুর্ভুজরূপেও দেখিতেন, ইহা প্রতীত হয় । - [শ্রীধরস্বামী ও শ্রীমধুসূদন সরস্বতী]

৫১) চতুর্ভুজ হইলেও মানুষরূপ ইহা প্রতীত হয় । 

৫৪) অনন্যা ভক্তি = যে ভক্তিলাভ হইলে ভগবান্‌ ব্যতীত অন্য কিছু উপলব্ধ হয় না । সর্বত্র ও সর্বদা ঈশ্বরদর্শন হয় । 
_________________________________________

*Hard Copy Source:
"Srimadbhagabadgeeta" translated by Swami Jagadeeshwarananda, edited by Swami Jagadananda. 27th Reprint - January, 1997 (1st Edition - 1941), © President, Sriramkrishna Math, Belur. Published by Swami Satyabrotananda, Udbodhan Office, 1 Udbodhan Lane, Bagbazar, Kolkata-700003. Printed by Rama Art Press, 6/30 Dum Dum Road, Kolkata-700030.

Sanskrit Source
English Translation

Disclaimer:
This site is not officially related to Ramakrishna Mission & Math. This is a personal, non-commercial, research-oriented effort of a novice religious wanderer.
এটি আধ্যাত্মিক পথের এক অর্বাচীন পথিকের ব্যক্তিগত, অবাণিজ্যিক, গবেষণা-ধর্মী প্রয়াস মাত্র ।

[Digitised by scanning (if required) and then by typing mostly in Notepad using Unicode Bengali "Siyam Rupali" font and Avro Phonetic Keyboard for transliteration. Uploaded by rk 

No comments:

Post a Comment