[যাহারা শাস্ত্রবিধি জানিয়াও ঐ সকল লঙ্ঘনপূর্বক স্বেচ্ছাচারী হইয়া অযথাবিধি দেবতাদির পূজা করে, তাহারা সিদ্ধিলাভে অসমর্থ, ইহা পূর্বাধ্যায়ে বলা হইয়াছে । কিন্তু যাহারা আলস্য বা ঔদাস্য-বশতঃ শ্রুতি, স্মৃতি প্রভৃতি শাস্ত্রের বিধি ও নিষেধ জানিতে প্রযত্ন না করিয়া বৃদ্ধ-ব্যবহারাদি (প্রাচীন প্রথাদি) দর্শনপূর্বক বা আচার-পরম্পরার বশবর্তী হইয়া আস্তিক্যবুদ্ধির সহিত দেবতা-পূজাদিতে প্রবৃত্ত হয়, কেবল তাহাদেরই বিষয় এখানে বলা হইতেছে ।]
অর্জুন জিজ্ঞাসা করিলেন -
হে ভগবান্, যাহারা শাস্ত্রীয় বিধান পরিত্যাগ করিয়া আস্তিক্যবুদ্ধিপূর্বক দেবাদির পূজা করে, তাহাদের সেই নিষ্ঠা সাত্ত্বিকী, রাজসী অথবা তামসী ? ১
হে ভগবান্, যাহারা শাস্ত্রীয় বিধান পরিত্যাগ করিয়া আস্তিক্যবুদ্ধিপূর্বক দেবাদির পূজা করে, তাহাদের সেই নিষ্ঠা সাত্ত্বিকী, রাজসী অথবা তামসী ? ১
শ্রীভগবান্ বলিলেন -
দেবাদিপূজাবিষয়ক সাত্ত্বিকী, যক্ষ-রাক্ষসাদিপূজাবিষয়ক রাজসী এবং ভূতপ্রেতাদিপূজাবিষয়ক তামসী - মানুষের এই তিন প্রকার শ্রদ্ধা জন্মে । এই শ্রদ্ধা জন্মান্তরকৃত ধর্মাদিসংস্কার হইতে জাত হয় । সুতরাং জীবের ত্রিবিধ স্বভাব হইতে জাত শ্রদ্ধাও তিন প্রকার । ইহার বিষয় শ্রবণ কর । ২
দেবাদিপূজাবিষয়ক সাত্ত্বিকী, যক্ষ-রাক্ষসাদিপূজাবিষয়ক রাজসী এবং ভূতপ্রেতাদিপূজাবিষয়ক তামসী - মানুষের এই তিন প্রকার শ্রদ্ধা জন্মে । এই শ্রদ্ধা জন্মান্তরকৃত ধর্মাদিসংস্কার হইতে জাত হয় । সুতরাং জীবের ত্রিবিধ স্বভাব হইতে জাত শ্রদ্ধাও তিন প্রকার । ইহার বিষয় শ্রবণ কর । ২
হে অর্জুন, সকল মানুষের শ্রদ্ধা সাত্ত্বিকাদি সংস্কারযুক্ত অন্তঃকরণের অনুরূপ তিন প্রকার হইয়া থাকে । মানুষ শ্রদ্ধাময়, কারণ যিনি যেরূপ শ্রদ্ধাযুক্ত, তিনি সেইরূপই হন । সাত্ত্বিকী, রাজসী এবং তামসী শ্রদ্ধাভেদে মানুষ, সাত্ত্বিক, রাজসিক ও তামসিক হয় । ৩
সাত্ত্বিক ব্যক্তিগণ দেবগণের পূজা করেন, রাজসিক ব্যক্তিগণ যক্ষ ও রাক্ষসগণের পূজা করেন এবং তামসিক ব্যক্তিগণ ভূত প্রেতাদির পূজা করেন । ৪
দম্ভ ও অহঙ্কারযুক্ত এবং কামনা ও আসক্তিকৃত-বলান্বিত হইয়া যে অবিবেকিগণ দেহস্থ ইন্দ্রিয়সমূহকে এবং বুদ্ধির সাক্ষীভূত আত্মস্বরূপ আমাকে ক্লিষ্ট করিয়া (অর্থাৎ আমার শাসন অতিক্রম করিয়া) শাস্ত্রবিরুদ্ধ এবং নিজের ও অপরের পীড়াপ্রদ তপস্যার অনুষ্ঠান করে, তাহাদিগকে আসুরিকবুদ্ধিবিশিষ্ট বলিয়া জানিবে । ৫-৬
পূর্বোক্ত তিন প্রকার লোকের আহারও সত্ত্বাদি গুণভেদে তিন প্রকার প্রিয় । সেইরূপ যজ্ঞ, দান ও তপস্যা ত্রিগুণানুসারে তিন প্রকার । ইহাদের প্রভেদ শ্রবণ কর । ৭
[আহার, যজ্ঞ, তপস্যা ও দানের সাত্ত্বিক রূপ গ্রহণের জন্য এবং রাজস ও তামস রূপ বর্জনের জন্য এই বিভাগ প্রদর্শিত হইল ।]
যে-সকল আহার আয়ু, উদ্যম, বল, আরোগ্য, সুখ ও প্রীতি বৃদ্ধি করে, এবং সরস, স্নিগ্ধ ও পুষ্টিকর এবং মনোরম সেইগুলি সাত্ত্বিক ব্যক্তিগণের প্রিয় হয় । ৮
যে-সকল আহার দুঃখ, শোক ও রোগ সৃষ্টি করে এবং অতি তিক্ত, অতি অম্ল, অতি লবণাক্ত, অতি উষ্ণ, অতি তিক্ষ্ণ, অতি শুষ্ক এবং অতি প্রদাহকর সেইগুলি রাজসিকগণের প্রিয় হয় । ৯
মন্দপক্ক, রসহীন, দুর্গন্ধময়, বাসী, উচ্ছিষ্ট ও যজ্ঞে নিষিদ্ধ আহার তামসিক ব্যক্তিগণের প্রিয় হয় । ১০
যজ্ঞ করাই কর্তব্য এইভাবে মন স্থির করিয়া ফলাকাঙ্ক্ষাবিহীন ব্যক্তি শাস্ত্রবিহিত যে যজ্ঞ করেন, তাহাই সাত্ত্বিক যজ্ঞ । ১১
হে অর্জুন, স্বর্গাদি ফল কামনা করিয়া দম্ভপ্রকাশের জন্যই যে যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয়, তাহাকে রাজসিক যজ্ঞ বলিয়া জানিবে । ১২
শাস্ত্রবিধিবর্জিত, অন্নদানশূন্য, মন্ত্রহীন, দক্ষিণাবিহীন, শ্রদ্ধারহিত যজ্ঞকে তামসিক যজ্ঞ বলা হয় । ১৩
দেবতা, ব্রাহ্মণ, গুরুজন ও প্রাজ্ঞজনের পূজা এবং শৌচ, সরলতা, ব্রহ্মচর্য ও অহিংসা - এইগুলিকে কায়িক তপস্যা বলে । ১৪
অনুদ্বেগকর, সত্য, প্রিয় ও হিতকর বাক্য এবং বেদাদি শাস্ত্রপাঠকে বাচিক তপস্যা বলে । ১৫
মনের প্রসন্নতা, সৌম্যভাব, বাক্সংযম, মনের নিরোধ, ব্যবহারকালে ছলনারাহিত্য (মন ও মুখ এক করা) - এই সকলকে মানসিক তপস্যা বলে । ১৬
ফলাকাঙ্ক্ষাবিহীন, সমাহিত ব্যক্তিগণ পরম শ্রদ্ধাসহকারে পূর্বোক্ত কায়িক, বাচিক ও মানসিক যে তপস্যা করেন, তাহাকে সাত্ত্বিক তপস্যা বলে । ১৭
সৎকার, সম্মান ও পূজা পাইবার আশায় দম্ভের সহিত যে তপস্যা করা হয়, ইহলোকে কদাচিৎ ফলপ্রদ সুতরাং অনিশ্চিত, সেই তপস্যাকে রাজসিক তপস্যা বলে । ১৮
দুরাকাঙ্ক্ষার বশবর্তী হইয়া দেহেন্দ্রিয়কে কষ্ট দিয়া বা অপরের বিনাশের জন্য যে তপস্যা করা হয়, তাহাকে তামসিক তপস্যা বলে । ১৯
'দান করা কর্তব্য' এই ভাবে প্রত্যুপকারের আশা না করিয়া পুণ্য স্থানে, শুভ সময়ে ও উপযুক্ত পাত্রে যে দান করা হয় তাহাকে সাত্ত্বিক দান বলে । ২০
যে দান প্রত্যুপকারের আশায় ও কোন পারলৌকিক ফললাভের উদ্দেশ্যে এবং অনিচ্ছাসত্ত্বেও করা হয়, তাহাকে রাজসিক দান বলে । ২১
অশুচি স্থানে, অশুভ সময়ে ও অযোগ্য পাত্রে অবজ্ঞাপূর্বক ও প্রিয়বচনাদি সৎকাররহিত যে দান করা হয়, তাহাকে তামসিক দান বলে । ২২
[বিহিত যজ্ঞ, দান ও তপস্বাদির অনুষ্ঠানে বৈগুণ্য অবশ্যম্ভাবী বলিয়া তাহার নিরাকরণ ও সাদ্গুণ্য-সম্পাদনের উদ্দেশ্যে বলা হইতেছে -]
'ওঁ তৎ সৎ' এই বাক্য দ্বারা ব্রহ্মের ত্রিবিধ নাম শ্রুতি-নির্দিষ্ট হইয়াছে । এই ত্রিবিধ নির্দেশদ্বারা পুরাকালে যজ্ঞের কর্তা ব্রাহ্মণ, যজ্ঞের কারণ বেদ ও যজ্ঞরূপ ক্রিয়া নির্মিত হইয়াছে । ২৩
এইজন্য 'ওঁ' এই ব্রহ্মবাচক প্রথম শব্দ উচ্চারণ করিয়া বেদবাদিগণ শাস্ত্রবিধান-অনুযায়ী যজ্ঞ-দান-তপস্যাদি কর্ম অনুষ্ঠান করেন । ২৪
'তৎ' এই ব্রহ্মবাচক দ্বিতীয় শব্দ উচ্চারণপূর্বক মুমুক্ষু ব্যক্তিগণ ফলাকাঙ্ক্ষা না করিয়া নানাপ্রকার যজ্ঞতপোদানাদি কর্মের অনুষ্ঠান করেন । ২৫
হে পার্থ, সদ্ভাব ও সাধুভাব সম্পাদনার্থ 'সৎ' এই তৃতীয় ব্রহ্মবাচক শব্দ প্রযুক্ত হয় এবং বিবাহাদি শুভ কর্মেও সৎ-শব্দ ব্যবহৃত হয় । ২৬
যজ্ঞ, তপস্যা ও দানে তৎপরভাবে যে অবস্থিতি (নিষ্ঠা, শ্রদ্ধা) তাহাও সদ্রূপে নির্দিষ্ট হয় এবং ভগবৎপ্রীতির নিমিত্ত যে কর্ম অনুষ্টিত হয়, তাহাও সৎ-নামে অভিহিত হয় । ২৭
[যজ্ঞদানাদি কর্ম অসাত্ত্বিকভাবে, বৈগুণ্যযুক্তরূপে বা অভক্তিপূর্বক কৃত হইলেও ব্রহ্মের নামত্রয় দ্বারা সাত্ত্বিক সগুণ ও সভক্তিক-রূপে পরিণত হয় । অতএব 'ওঁ তৎ সৎ' ব্রহ্মের এই নামত্রয় উচ্চারণপূর্বক যজ্ঞাদি কর্ম প্রবর্তনীয়, ইহাই এই প্রকরণের অর্থ ।]
হে পার্থ, শ্রদ্ধা (আস্তিক্যবুদ্ধি)-শূন্য হইয়া যে যজ্ঞ, যে দান বা তপস্যা অনুষ্ঠিত হয় এবং স্তুতিনমস্কারাদি যাহা কিছু করা হয়, তাহা অসৎ । কারণ, এই সকল যজ্ঞাদি বৈগুণ্যবশতঃ পরলোকে এবং (অযশস্কর বলিয়া) ইহলোকেও নিষ্ফল হয় । ২৮
ভগবান্ ব্যাসকৃত লক্ষশ্লোকী শ্রীমহাভারতের ভীষ্মপর্বের অন্তর্গত শ্রীমদ্ভগবদ্গীতারূপ উপনিষদে ব্রহ্মবিদ্যাবিষয়ক যোগশাস্ত্রে শ্রীকৃষ্ণার্জুন-সংবাদে শ্রদ্ধাত্রয়বিভাগযোগ নামক সপ্তদশ অধ্যায় সমাপ্ত ।
_________________________________________
৩) বৈদিক ঋষিগণ এইভাবে শ্রদ্ধাসাধন করিতেন - 'শ্রদ্ধাকে আমরা প্রাতঃকালে আবাহন করি, শ্রদ্ধাকে আমরা মধ্যাহ্নে আবাহন করি । সূর্য যখন অস্ত যান, তখনও আমরা শ্রদ্ধাকে আবাহন করি । হে শ্রদ্ধে, এখন আমাদিগকে শ্রদ্ধাময় কর ।' - [ঋগ্বেদ, ১০|১৫১|৫]
১৩) মন্ত্রহীন : যজ্ঞে উচ্চারিত মন্ত্র শুদ্ধ স্বর ও বর্ণযুক্ত না হইলে যজ্ঞ মন্ত্রহীন হয় ।
১৮) সৎকার = সাধুবাদ = ইনি সাধু, তপস্বী এই প্রকার প্রশংসা ।
মান = মানন = আসিতে দেখিয়া উঠিয়া দাঁড়ান ও অভিবাদন ।
পূজা = পাদপ্রক্ষালন, অর্চনা ও ভোজন করানো, পুজা করা প্রভৃতি ।
১৯) দুরাকাঙ্ক্ষা : অন্যে যে পরিমাণ তপস্যা করিয়াছেন, আমি তদপেক্ষা অধিক করিব - এইরূপ অবিবেক ।
২৬) সদ্ভাব : অবিদ্যমানের বিদ্যমানতার জন্য ! অবিদ্যমান পুত্রের জন্মের জন্য ।
সাধুভাব : অসদ্বৃত্তের সদ্বৃত্ততা লাভের জন্য ।
_________________________________________
*Hard Copy Source:
"Srimadbhagabadgeeta" translated by Swami Jagadeeshwarananda, edited by Swami Jagadananda. 27th Reprint - January, 1997 (1st Edition - 1941), © President, Sriramkrishna Math, Belur. Published by Swami Satyabrotananda, Udbodhan Office, 1 Udbodhan Lane, Bagbazar, Kolkata-700003. Printed by Rama Art Press, 6/30 Dum Dum Road, Kolkata-700030.
Sanskrit Source
English Translation
Disclaimer:
This site is not officially related to Ramakrishna Mission & Math. This is a personal, non-commercial, research-oriented effort of a novice religious wanderer.
এটি আধ্যাত্মিক পথের এক অর্বাচীন পথিকের ব্যক্তিগত, অবাণিজ্যিক, গবেষণা-ধর্মী প্রয়াস মাত্র ।
No comments:
Post a Comment