Sunday, August 17, 2014

শ্রীমদ্ভগবদ্‌গীতা : ষোড়শ অধ্যায় – দৈবাসুরসম্পদবিভাগযোগ (Gita : Chapter 16)

|||||||||১০|১১|১২|১৩|১৪|১৫|১৬|১৭|১৮
 (স্বামী জগদীশ্বরানন্দ)*
 
[নবম অধ্যায়ে সূচিত দৈবী, আসুরী ও রাক্ষসী নামক প্রকৃতিত্রয়ের বিস্তৃত ব্যাখ্যার জন্য এই অধ্যায় আরম্ভ হইতেছে । দৈবী প্রকৃতি মোক্ষ সম্পাদন করে এবং আসুরী ও রাক্ষসী প্রকৃতি বন্ধন সৃষ্টি করে । অতএব দৈবী প্রকৃতি গ্রহণ ও অপর প্রকৃতিদ্বয় পরিবর্জনের জন্য ] -

শ্রীভগবান্‌ বলিলেন -
হে অর্জুন, যাঁহারা দৈবী (সাত্ত্বিকী) অবস্থালাভের যোগ্য হইয়া জন্মগ্রহণ করিয়াছেন, তাঁহাদের ভয়শূন্যতা, ব্যবহারকালে পরবঞ্চন- ও মিথ্যাকথন-বর্জন, জ্ঞান ও যোগে নিষ্ঠা, সামর্থ্যানুসারে দান, বাহ্যেন্দ্রিয়ের সংযম, যজ্ঞ (বেদবিহিত অগ্নিহোত্রাদি এবং স্মৃতিশাস্ত্র-বিহিত পঞ্চবিধ যজ্ঞ), স্বাধ্যায় (বেদপাঠ, ব্রহ্মযজ্ঞাদি), তপস্যা, সরলতা, অহিংসা, সত্য, ক্রোধহীনতা, ত্যাগ, শান্তি, পরদোষ প্রকাশ না করা, দীনে দয়া, লোভরাহিত্য, মৃদুতা, অসৎ চিন্তা ও অসৎ কর্মে লজ্জা, অচপলতা, তেজ, ক্ষমা, ধৈর্য, বাহ্যাভ্যন্তর শৌচ, অবৈরভাব, অনভিমান - এই ছাব্বিশটি সদ্‌গুণ লাভ হয় । ১-৩

হে পার্থ, যাহারা আসুরী অবস্থালাভের যোগ্য হইয়া জন্মগ্রহণ করিয়াছে, তাহাদের মধ্যে ধর্মধ্বজিত্ব, ধন ও স্বজননিমিত্ত দর্প, অহঙ্কার, ক্রোধ, বাক্যে ও ব্যবহারে কর্কশভাব ও কর্তব্যাকর্তব্য বিষয়ে অবিবেক - এই সকল (ভাবী অকল্যাণের কারণ) আসুরী সম্পদ্‌ আবির্ভূত হয় । ৪

দৈবী সম্পদ্‌ সংসার-বন্ধন হইতে মুক্তির হেতু এবং আসুরী সম্পদ্‌ সংসার-বন্ধনের কারণ । হে পাণ্ডব, শোক করিও না । তুমি দৈবী সম্পদের যোগ্য হইয়াই জন্মগ্রহণ করিয়াছ । ৫

হে পার্থ, এই জগতে দেবস্বভাব ও অসুরস্বভাব - এই দুই প্রকার মানুষ সৃষ্ট হইয়াছে । দেবস্বভাবসম্পন্ন মানুষের কথা বিস্তৃতভাবে বলিয়াছি । এখন অসুরস্বভাববিশিষ্ট মানুষের কথা আমার নিকট শ্রবণ কর । ৬

অসুরস্বভাব ব্যক্তিগণ ধর্মবিষয়ে প্রবৃত্ত এবং অধর্মবিষয় হইতে নিবৃত্ত হইতে জানে না; তাহাদের শৌচ নাই, সদাচার নাই এবং সত্যও নাই । ৭

আসুরস্বভাববিশিষ্ট ব্যক্তিগণ বলে, এই জগৎ সত্যশূন্য; ইহা ধর্মাধর্মের ব্যবস্থাহীন । ইহার কর্মফলদাতা ঈশ্বর নাই এবং কামবশতঃ স্ত্রী-পুরুষের সংযোগেই ইহা উৎপন্ন; ইহার উৎপত্তির অদৃষ্ট ধর্মাধর্মাদি অন্য কারণ নাই । ৮

এই লোকায়তিক মত আশ্রয়পূর্বক পারলৌকিক-সাধনচ্যুত ক্রুরকর্মা, অনিষ্টকারী ও অল্পবুদ্ধি আসুরপ্রকৃতি ব্যক্তিগণ জগতের বিনাশের জন্য জন্মগ্রহণ করে । ৯

তাহাদের হৃদয় দুষ্পূরণীয় বাসনায় পূর্ণ । দম্ভ, অভিমান ও মদযুক্ত হইয়া অবিবেকবশতঃ অশুভনিচয় গ্রহণপূর্বক সেই অশুদ্ধব্রত ব্যক্তিগণ দুরদৃষ্ট-উৎপাদক কর্মে প্রবৃত্ত হয় । ১০

কামভোগই জীবনের পরম পুরুষার্থ - এইরূপ নিশ্চয়পূর্বক মৃত্যুকাল পর্যন্ত স্বীয় যোগক্ষেমবিষয়ে অপরিমেয় চিন্তার আশ্রয় গ্রহণ করিয়া অসংখ্য আশাপাশে আবদ্ধ এবং কাম ও ক্রোধের অধীন হইয়া তাহারা বিষয়ভোগের জন্য পরস্বাপহরণাদিরূপ অসদুপায়ে অর্থসংগ্রহের চেষ্টা করে । ১১-১২

'আজ আমার ইহা লাভ হইল', ভবিষ্যতে আমার এই মনোরথ পূর্ণ হইবে', 'এই ধন আমার আছে', 'ভবিষ্যতে এই ধনও লাভ হইবে' । ১৩

'এই দুর্জয় শত্রু আমি নাশ করিয়াছি', 'অন্য তুচ্ছ শত্রুসকলও নাশ করিব', 'আমি সকলের নিগ্রহে সমর্থ', 'আমি ভোগী', 'আমি পুরুষার্থসম্পন্ন, বলবান্‌ ও সুখী' । ১৪

'আমি ধনী ও উচ্চবংশজাত কুলীন', 'আমার সমান আর কে আছে', 'আমি যজ্ঞ করিব, দান করিব, আনন্দ করিব' - এইরূপে অসুরস্বভাব ব্যক্তিগণ অবিবেকমুগ্ধ হয় এবং বহু সংকল্পে বিক্ষিপ্তচিত্ত, মোহজালে জড়িত ও বিষয়ভোগে আসক্ত হইয়া বিন্মুত্রাদিময় রৌরবাদি নরকে পতিত হয় । ১৫-১৬

তাহারা আত্মশ্লাঘাবিশিষ্ট এবং ধননিমিত্ত মান ও স্ফীত হইয়া দম্ভের সহিত শাস্ত্রবিধি লঙ্ঘনপূর্বক নামমাত্র (বিহিত অঙ্গ ও ইতিকর্তব্যত্যশূন্য) যজ্ঞের অনুষ্ঠান করে । ১৭

তাহারা সন্মার্গবর্তীদের গুণে দোষাবিষ্কার করে এবং তাঁহাদের অনুকরণ না করিয়া অহঙ্কার, পরপীড়াদায়ক বল, ধর্মলঙ্ঘনের হেতু দর্প, স্ত্রী প্রভৃতি বিষয়ে কাম ও ক্রোধ সম্যক্‌-রূপে আশ্রয়পূর্বক স্বীয় দেহে ও অপর দেহে (বুদ্ধি ও কর্মের সাক্ষিরূপে) অবস্থিত আমাকে (ঈশ্বরকে) দ্বেষ করে (শ্রুতি ও স্মৃতিরূপ আমার শাসন অতিক্রম করে) । ১৮

ধর্মাধর্মফল-প্রদাতা আমি সন্মার্গ-দ্বেষপরায়ণ, ক্রূর, অশুভকারী নিকৃষ্ট নরগণকে অধর্মদোষবশতঃ এই নরকরূপ সংসারপথে আসুর যোনিতে পুনঃপুনঃ নিক্ষেপ করি । ১৯

হে অর্জুন, মূঢ়গণ জন্মে জন্মে আসুর জন্ম প্রাপ্ত হয় এবং আমাকে লাভ করা দূরে থাকুক, সন্মার্গ ও ঊর্ধ্বগতি প্রাপ্ত না হইয়া পূর্বজন্মাপেক্ষা আরও নীচযোনি লাভ করে । ২০

[সমস্ত আসুরী সম্পদ্‌ যে তিনটির অন্তর্ভুক্ত, যাহাদের ত্যাগে সমস্ত আসুরী সম্পদ্‌ ত্যাগ হয়, সেই তিনটি বলা হইতেছে ।]

কাম, ক্রোধ এবং লোভ - এই তিনটি নরকের দ্বারস্বরূপ । ইহারা জীবের অধোগতিদায়ক । এই সকল দ্বারে প্রবেশ করিলে মানুষ পুরুষার্থের অযোগ্য হয় । অতএব এই তিনটি বিষবৎ ত্যাগ করা উচিত । ২১

হে কৌন্তেয়, দুঃখমোহাত্মক ও শ্রেয়ঃপ্রবৃত্তির প্রতিবন্ধক এই তিনটি নরকদ্বার হইতে মুক্ত হইলে মানুষ ঈশ্বরারাধনাদিরূপ স্বীয় কল্যাণসাধনে সমর্থ হয় এবং সেই শ্রেয়ঃ অনুষ্ঠানবশতঃ ইহলোকের সুখভোগ ও মনুষ্যজন্মের সার্থকতারূপ শ্রেষ্ঠ গতি (মোক্ষ) লাভ করে । ২২

[এই সকল আসুরী সম্পদ্‌ পরিত্যাগপূর্বক শ্রেয়ঃ আচরণ করা শাস্ত্রনির্দেশ অনুসারেই সম্ভব, অন্যপ্রকারে নহে । অতএব] -

যে কর্তব্যাকর্তব্য-নির্ধারণের কারণ শাস্ত্রীয় বিধি ও নিষেধ উল্লঙ্ঘনপূর্বক স্বেচ্ছাচারী হইয়া বিহিতের আচরণ করে না, অথচ নিষিদ্ধের আচরণ করে, সে চিত্তশুদ্ধিরূপ পুরুষার্থলাভের যোগ্য হয় না । সে ইহলোকে সুখ, পরলোকে স্বর্গ বা মুক্তি লাভ করিতে পারে না । ২৩

অতএব কর্তব্য ও অকর্তব্য নির্ধারণে শাস্ত্রই তোমার জ্ঞাপক (উপদেষ্টা); নিজের বা অন্যের কল্পনাদি নহে । অতএব শাস্ত্রীয় বিধি ও নিষেধের স্বরূপ জানিয়া ইহলোকে তোমার কর্ম করা উচিত, অর্থাৎ নিষিদ্ধ পরিত্যাগপূর্বক বিহিতানুষ্ঠান করা উচিত । ২৪

ভগবান্ ব্যাসকৃত লক্ষশ্লোকী শ্রীমহাভারতের ভীষ্মপর্বের অন্তর্গত শ্রীমদ্ভগবদ্গীতারূপ উপনিষদে ব্রহ্মবিদ্যাবিষয়ক যোগশাস্ত্রে শ্রীকৃষ্ণার্জুন-সংবাদে দৈবাসুরসম্পদবিভাগযোগ নামক ষোড়শ অধ্যায় সমাপ্ত ।
_________________________________________
১) জ্ঞান : আচার্য ও শাস্ত্র হইতে ব্রহ্ম ও আত্মাদি বস্তুর অবগতিই জ্ঞান ।
যোগ : ইন্দ্রিয়সংযমাদি ও একাগ্রতা দ্বারা অবগত বস্তুর সাক্ষাৎকারের প্রচেষ্টাই যোগ ।
ব্যবস্থিতি : এই উভয়ে অবস্থিতি, নিষ্ঠা বা একাগ্রতা ।
 
অভয়, সত্ত্বসংশুদ্ধি ও জ্ঞানযোগব্যবস্থিতি - এই তিনটি প্রধান দৈবী সম্পদ ।
অভয় - শাস্ত্রোপদেশে সন্দেহরাহিত্য ও তদনুষ্ঠাননিষ্ঠত্ব । তত্ত্ববিচারের দ্বারা ভবভয় দূর করিবে ।
 
পঞ্চবিধ যজ্ঞ = দেব-, ঋষি-, ভূত-, নৃ- ও পিতৃযজ্ঞ ।
বাহ্য শৌচ = জল ও মৃত্তিকাদি দ্বারা শরীর ধৌত ও মার্জনা করা
আভ্যন্তর শৌচ = মন ও বুদ্ধির কলুষতার অভাব
 
৬) প্রজাপতির (ব্রহ্মার) অপত্য দুই প্রকার - দেবগণ ও অসুরগণ । শাস্ত্রজনিত জ্ঞান ও কর্ম দ্বারা প্রভাবিত ইন্দ্রিয়বর্গ দেব এবং স্বাভাবিক (অশাস্ত্রজনিত) এবং ঐহিক জ্ঞান ও কর্ম দ্বারা প্রভাবিত ইন্দ্রিয়বর্গ অসুর ।

১০) দম্ভ : অধার্মিক হইয়াও নিজের ধার্মিকত্বজ্ঞাপন ।
অভিমান : অপূজ্য হইয়াও নিজের পূজ্যত্বের অভিমান ।
মদযুক্ত : নিকৃষ্ট হইয়াও নিজেতে উৎকৃষ্টত্বের আরোপ; সুতরাং মহতের অবজ্ঞা ।
অশুভনিচয় গ্রহণ : অমূক মন্ত্রে বশীকরণ, উচাটন, মারণাদি সম্পাদনরূপ দুরাগ্রহ ।
অশুদ্ধব্রত : অমঙ্গলকর নরকাদিতে পতনের কারণ যাহাদের ব্রত, নিয়ম ।
 
২৪) শাস্ত্র : যাহার দ্বারা ধর্মাধর্ম ও মোক্ষ প্রভৃতি অজ্ঞাত পদার্থের জ্ঞান হয়, তাহাই শাস্ত্র । বেদ ও বেদমূলক স্মৃতি-ইতিহাস-পুরাণাদি শাস্ত্র ।

ইহলোক : মনুষ্যলোকই কর্মাধিকার-ভূমি । লোকান্তরে কর্মাধিকার নাই - [নীলকণ্ঠ]
_________________________________________

*Hard Copy Source:
"Srimadbhagabadgeeta" translated by Swami Jagadeeshwarananda, edited by Swami Jagadananda. 27th Reprint - January, 1997 (1st Edition - 1941), © President, Sriramkrishna Math, Belur. Published by Swami Satyabrotananda, Udbodhan Office, 1 Udbodhan Lane, Bagbazar, Kolkata-700003. Printed by Rama Art Press, 6/30 Dum Dum Road, Kolkata-700030.

Sanskrit Source
English Translation

Disclaimer:
This site is not officially related to Ramakrishna Mission & MathThis is a personal, non-commercial, research-oriented effort of a novice religious wanderer.
এটি আধ্যাত্মিক পথের এক অর্বাচীন পথিকের ব্যক্তিগত, অবাণিজ্যিক, গবেষণা-ধর্মী প্রয়াস মাত্র ।

[Digitised by scanning (if required) and then by typing mostly in Notepad using Unicode Bengali "Siyam Rupali" font and Avro Phonetic Keyboard for transliteration. Uploaded by rk]


<Previous--Contents--Next>

No comments:

Post a Comment