Monday, August 18, 2014

শ্রীমদ্ভগবদ্‌গীতা : অষ্টাদশ অধ্যায় – মোক্ষযোগ (Gita : Chapter 18)

|||||||||১০|১১|১২|১৩|১৪|১৫|১৬|১৭|১৮
 (স্বামী জগদীশ্বরানন্দ)*
 
[এই অধ্যায়ে সমস্ত গীতাশাস্ত্রার্থের উপসংহারপূর্বক সমগ্র বেদার্থ বলা হইতেছে ।]

অর্জুন বলিলেন -
হে মহাবাহো, হে হৃষিকেশ, হে কেশিনিষূদন, আমি সন্ন্যাস-শব্দের ও ত্যাগ-শব্দের তত্ত্ব (অর্থ) পৃথকভাবে জানিতে ইচ্ছা করি । ১

শ্রীভগবান্‌ বলিলেন -
স্বর্গাদি ফলপ্রদ অশ্বমেধাদি কাম্য কর্মের পরিত্যাগকেই (অনুষ্ঠানকেই) পণ্ডিতগণের কেহ কেহ সন্ন্যাস বলিয়া জানেন । যে সকল নিত্য বা নৈমিত্তিক কর্ম অনুষ্ঠিত হইয়া থাকে, তাহাদের যে ফল অনুষ্ঠাতার হইবার সম্ভাবনা আছে, সেই ফলের আকাঙ্ক্ষা-পরিত্যাগকে জ্ঞানিগণ ত্যাগ বলিয়া থাকেন । ২

[ত্যাগ ও সন্ন্যাস শব্দের 'পরিত্যাগ'রূপ যে অর্থ, তাহা একই; ঘট ও পট শব্দের অর্থের ন্যায় বিভিন্ন নহে । এই অভিপ্রায়ে বলিতেছেন -]

সাংখ্যবাদিগণ বলেন - কর্মমাত্রই বন্ধনের কারণ । অতএব সকলেরই সর্ব কর্ম ত্যাগ করা উচিত । কিন্তু মীমাংসকগণ বলেন - যজ্ঞ, দান ও তপস্যারূপ বিহিত কর্ম কাহারও পক্ষে ত্যাগ করা উচিত নয় । কারণ, বিহিত কর্মত্যাগে প্রত্যবায় হয় । ৩

হে ভরতশ্রেষ্ঠ, সেই ত্যাগ ও সন্ন্যাসরূপ বিকল্প বিষয়ে আমার সিদ্ধান্ত শ্রবণ কর । হে পুরুষব্যাঘ্র, ত্যাগ-ও সন্ন্যাস-শব্দবাচ্য যে অর্থ, তাহা তামসাদিভেদে শাস্ত্রে ত্রিবিধ কথিত হইয়াছে । ৪

যজ্ঞ-দান-ও তপস্যারূপ কর্ম ত্যাগ করা উচিত নয় । এই সকল কর্ম করাই উচিত । কারণ, ইহারা ফলাকাঙ্ক্ষাত্যাগী মনীষিগণের চিত্তশুদ্ধিকারক । ৫

হে পার্থ, ফলকামনাপূর্বক অনুষ্ঠিত যজ্ঞাদি কর্মবন্ধনের কারণ হইলেও আসক্তি ও ফলকামনা ত্যাগ করিয়া এই সকল কর্ম অবশ্য কর্তব্য । ইহাই আমার নিশ্চিত ও উত্তম মত । ৬

অবশ্যকর্তব্য নিত্যকর্ম ত্যাগ করা উচিত নয় । কারণ, নিত্যকর্ম চিত্তশুদ্ধিকর । অজ্ঞানবশতঃ নিত্যকর্ম ত্যাগ করাকে তামস ত্যাগ বলে । ৭

কর্ম দুঃখকর মনে করিয়া যিনি দৈহিক ক্লেশের ভয়ে কর্ম ত্যাগ করেন - তিনি এই রাজসিক ত্যাগ করিয়া জ্ঞানসংযুক্ত সর্বকর্মত্যাগের মোক্ষফল লাভ করিতে পারেন না । ৮

হে অর্জুন, কর্তৃত্বাভিনিবেশরূপ আসক্তি ও ফলকামনা ত্যাগ করিয়া কেবল কর্তব্যবোধে যে বিহিত কর্ম অনুষ্ঠিত হয়, কর্মাসক্তি ও কর্মফলের সেই ত্যাগকে সাত্ত্বিক ত্যাগ বলে । ৯

কর্মে আসক্তি ও কর্মফল ত্যাগপূর্বক নিষ্কাম কর্মের অনুষ্ঠাতা যখন আত্মা ও অনাত্মার বিবেকের কারণ যে সত্ত্বগুণ, তদ্‌যুক্ত হইয়া আত্মজ্ঞান লাভ করেন এবং অবিদ্যাকৃত সর্বসংশয় হইতে মুক্ত হন, অর্থাৎ আত্মস্বরূপে অবস্থানই মুক্তির একমাত্র উপায় - এইরূপ নিশ্চয়বুদ্ধি লাভ করেন, তখন তিনি কাম্য কর্মে দ্বেষ করেন না ও নিত্যকর্মে আসক্ত হন না । ১০

যেহেতু দেহাভিমানী ব্যক্তিগণ নিঃশেষরূপে সকল কর্ম ত্যাগ করিতে পারেন না, সেই জন্য যিনি কর্মফলে বাসনা ত্যাগ করেন, তিনি ত্যাগী বলিয়া কথিত হন । ১১

ধর্মাধর্মরূপ কর্মের দেবাদিজন্মরূপ ইষ্ট, পশ্বাদিজন্মরূপ অনিষ্ট ও মানবজন্মরূপ মিশ্র - এই তিন প্রকার ফল দেহাভিমানী আত্মজ্ঞানহীনদিগেরই হইয়া থাকে । কিন্তু দেহাত্মবুদ্ধিরহিত জ্ঞানীদিগের কোন কর্মফল ভোগ করিতে হয় না । ১২

হে মহাবাহো, কর্মকাণ্ডের অন্তরূপ বেদান্তে সর্বকর্ম সম্পাদনের এই পাঁচটি কারণ নিরূপিত হইয়াছে । এইগুলি আমার নিকট অবগত হও । ১৩

শরীর, অহঙ্কার এবং বুদ্ধি ও মন সহ সকল ইন্দ্রিয় (পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয় ও পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয়), প্রাণাদির বিবিধ কার্য এবং চক্ষুরাদি ইন্দ্রিয়ের আদিত্যাদি অধিষ্ঠাত্রী দেবতা - এই পাঁচটি সর্বকর্মের কারণ । ১৪

শরীর, মন ও বাক্য দ্বারা মানুষ যে সৎ বা অসৎ কর্ম করে, সেই সমস্ত কর্মেরই কারণ এই পাঁচটি । ১৫

যেহেতু দেহাদি পাঁচটি কারণের দ্বারাই কায়িক, বাচিক ও মানসিক সমস্ত কর্ম সম্পাদিত হয়, সেইজন্য যিনি শুদ্ধ অকর্তা আত্মাকে অসংস্কৃত বুদ্ধিহেতু অধিষ্ঠানাদি পঞ্চ কারণ দ্বারা ক্রিয়মাণ কর্মের কর্তা বলিয়া মনে করেন, সেই ভ্রান্তবুদ্ধি ব্যক্তি সম্যগ্‌-দর্শী নহেন, অর্থাৎ আত্মতত্ত্ব বা কর্মতত্ত্ব অবগত নহেন । ১৬

আমি কর্ত্তা এই অভিমান যাঁহার নাই এবং যাঁহার বুদ্ধি কর্মফলে লিপ্ত হয় না, তিনি জগতের সমস্ত প্রাণী হত্যা করিলেও হত্যাকারী হন না, বা হত্যাক্রিয়ার ফলে আবদ্ধ হন না । ১৭

জ্ঞান, জ্ঞেয় ও জ্ঞাতা সকল ক্রিয়ার ত্রিবিধ প্রবর্তক । কারণ, এই তিনটি একত্র হইলেই সকল ক্রিয়া আরম্ভ হয় । এবং করণ (ইন্দ্রিয়), কর্ম (ক্রিয়া) ও কর্তা (করণের প্রযোক্তা) - এই তিনটিতে সর্বক্রিয়া সংগৃহীত, সমবেত । অতএব আত্মা কোন কর্মের প্রবর্তক বা আশ্রয় নহেন । ১৮

[ক্রিয়া, কারক ও ফল সব ত্রিগুণাত্মকই । অতএব গুণানুসারে তাহাদের ভেদ ত্রিবিধই । ইহা নির্দিষ্ট হইতেছে ।]

কপিলের সাংখ্য-শাস্ত্রে জ্ঞান, কর্ম (ক্রিয়া) ও কর্তা - সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ এই ত্রিগুণভেদে তিন প্রকারই কথিত হইয়াছে । সেই সকল ও ত্রিগুণকৃত তাহাদের ভেদসমূহ যথাযথরূপে শ্রবণ কর । ১৯

যে জ্ঞান দ্বারা অব্যক্ত হইতে স্থাবর পর্যন্ত বহুধা বিভক্ত সর্বভূতে এক অবিভক্ত অক্ষর আত্মবস্তু দৃষ্ট হন, সেই অদ্বৈত আত্মদর্শনরূপ সম্যক্‌ জ্ঞানকে সাত্ত্বিক জ্ঞান বলে । ২০

কিন্তু যে জ্ঞান দ্বারা প্রতিদেহে পৃথগ্‌ভাবে অবস্থিত সকল প্রাণি-শরীরে পরস্পর বিলক্ষণ (সুখদুঃখাদিবৈলক্ষণ্যবশতঃ) ভিন্ন ভিন্ন আত্মার দর্শন হয়, তাহা রাজসিক জ্ঞান বলিয়া জানিবে । ২১

যে জ্ঞান দ্বারা কোন একটি দেহে বা প্রতিমাতে সম্পূর্ণ আত্মা বা ঈশ্বর আছেন - এইরূপ অভিনিবেশ হয়, সেই অযৌক্তিক, অযথার্থ এবং তুচ্ছ জ্ঞানকে তামসিক জ্ঞান বলে । ২২

ফলাভিলাষরহিত ব্যক্তি রাগ বা দ্বেষ বর্জনপূর্বক আসক্তিশূন্য হইয়া যাগ, দান ও হোমাদিরূপ যে নিত্যকর্ম করেন, তাহাকে সাত্ত্বিক কর্ম বলে । ২৩

এবং ফলকামনা বা অহঙ্কারযুক্ত হইয়া বহু কষ্টসাধ্য যে যাগাদি কর্মের অনুষ্ঠান করা হয়, সেই সকল কর্ম রাজসিক বলিয়া কথিত হয় । ২৪

ভাবী শুভাশুভ ফল, ধনক্ষয় বা শক্তিক্ষয়, পরপীড়া ও স্বসামর্থ্য বিচার না করিয়া অবিবেকবশতঃ যে যাগাদি কর্ম করা হয়, তাহা তামসিক বলিয়া উক্ত হয় । ২৫

ফলে অনাসক্ত, কর্তৃত্বাভিমানরহিত, ধৃতিশীল ও উদ্যমযুক্ত, ক্রিয়মাণ কর্মের সিদ্ধিতে হর্ষহীন বা অসিদ্ধিতে বিষাদশূন্য কর্তা সাত্ত্বিক বলিয়া কথিত হন । ২৬

বাসনাকুল-চিত্ত, কর্মফলাকাঙ্ক্ষী, পরদ্রব্যে লোভী এবং তীর্থাদিতে স্বীয়দ্রব্যদানে অনিচ্ছুক, পরপীড়ক, বাহ্যান্তর-শৌচহীন, ইষ্টপ্রাপ্তিতে হর্ষযুক্ত এবং অনিষ্টপ্রাপ্তিতে ও ইষ্টবিয়োগে শোকযুক্ত কর্তা রাজসিক বলিয়া কথিত হন । ২৭

বিষয়-বিক্ষিপ্ত-চিত্তহেতু অসমাহিত, বালকবৎ অত্যন্ত অসংস্কৃতবুদ্ধি, অনম্র, বঞ্চক, স্বার্থবশতঃ পরবৃত্তিচ্ছেদনকারী, কর্তব্যে প্রবৃত্তিহীন, সদা অবসন্নস্বভাব ও দীর্ঘসূত্রী কর্তা তামস বলিয়া কথিত হন । ২৮

হে ধনঞ্জয়, সত্ত্ব, রজঃ ও তমোগুণানুসারে বুদ্ধি ও ধৃতির তিন প্রকার ভেদ পৃথক্‌ পৃথগ্‌ভাবে নিঃশেষে বলিতেছি শ্রবণ কর । ২৯

হে পার্থ, প্রবৃত্তিমার্গ ও নিবৃত্তিমার্গ, কর্তব্য (বিহিত কর্ম) ও অকর্তব্য (নিষিদ্ধ কর্ম), ভয়ের কারণ - সংসারপ্রসূ অজ্ঞান এবং অভয়ের কারণ - সংসারনাশক জ্ঞান, সহেতুক বন্ধন এবং সহেতুক মোক্ষ - এই সকল বিষয় যে বুদ্ধির দ্বারা জানা যায়, তাহা সাত্ত্বিক বুদ্ধি । ৩০

হে পার্থ, যে বুদ্ধি দ্বারা শাস্ত্রবিহিত ও শাস্ত্রনিষিদ্ধ কর্ম এবং কর্তব্য ও অকর্তব্য যথাযথরূপে (সম্পূর্ণ নির্ণয়পূর্বক, নিঃসন্দেহরূপে) জানিতে পারা যায় না, তাহা রাজসিক বুদ্ধি । ৩১

হে পার্থ, যে বুদ্ধি তমোগুণে আচ্ছন্ন হইয়া অধর্মকে ধর্ম মনে করে এবং সকল বিষয় বিপরীতভাবে বোঝে তাহা তামসিক বুদ্ধি । ৩২

হে পার্থ, ব্রহ্মে নিত্যসমাধি-অনুগতা ধৃতি দ্বারা মন, প্রাণ ও ইন্দ্রিয়ের ক্রিয়াসমূহ শাস্ত্রমার্গে বিধৃত হয়, ইহাই যোগের দ্বারা ধৃতি । এই প্রকার ধৃতিই সাত্ত্বিকী । ৩৩

হে পার্থ, মনুষ্য যে ধৃতি দ্বারা ধর্ম, অর্থ ও কামকে নিত্য কর্তব্যরূপে অবধারণ করে এবং উক্ত ধর্মাদিসম্পাদনকালে কর্তৃত্বাদি-অভিনিবেশপূর্বক ফলাকাঙ্ক্ষী হয়, তাহা রাজসিক ধৃতি । ৩৪

হে পার্থ, দুর্বুদ্ধি ব্যক্তি যে ধৃতি দ্বারা নিদ্রা, ভয়, প্রিয়বিয়োগনিমিত্ত শোক, অবসাদ ও মদ পরিত্যাগ করে না, তাহাদিগকে ধারণ করিয়া থাকে, তাহা তামসিক ধৃতি । ৩৫

[গুণভেদে ক্রিয়া ও কারক ত্রিবিধ বলিয়া এখন তাহাদের ফলের (সুখের) তিন প্রকার ভেদ বলিতেছেন -]

হে অর্জুন, এখন আমার নিকট ত্রিবিধ সুখের বিষয় শ্রবণ কর । যে সুখের দীর্ঘ অভ্যাস (অনুশীলন) দ্বারা মানুষ প্রীত ও পরিতৃপ্ত হয় এবং যে সুখ প্রাপ্ত হইলে সব দুঃখ হইতে সম্যগ্‌রূপে মুক্ত হয় । ৩৬

এবং যে সুখ প্রথমে বিষতুল্য দুঃখাত্মক (জ্ঞান, বৈরাগ্য, ধ্যান ও সমাধি দ্বারা লভ্য বলিয়া প্রথমে অত্যন্ত পরিশ্রমসাধ্য ও দুঃখকর) কিন্তু শেষে (জ্ঞান ও বৈরাগ্যাদির পরিপাকে) অমৃততুল্য প্রীতিকর, আত্মনিষ্ঠ বুদ্ধির নির্মলতা হইতে উৎপন্ন, সেই সুখ সাত্ত্বিক সুখ বলিয়া কথিত হয় । ৩৭

শব্দাদি বিষয় ও শ্রোত্রাদি ইন্দ্রিয়ের সংযোগ হইতে যে সুখ উৎপন্ন হয়, তাহা প্রথমে অমৃতবৎ, কিন্তু পরিশেষে (বল, বীর্য, রূপ, প্রজ্ঞা, মেধা, ধন ও উৎসাহ নষ্ট করে বলিয়া) বিষতুল্য । সেই সুখ রাজসিক সুখ বলিয়া কথিত হয় । ৩৮

যে সুখ প্রথমে ও পরিণামে সৎ ও অসতের কারণ বুদ্ধির বিবেকশক্তি বিনাশ করে এবং যাহা নিদ্রা, আলস্য ও অনবধানতা হইতে উৎপন্ন হয়, তাহা তামসিক সুখ বলিয়া কথিত । ৩৯

পৃথিবীতে বা স্বর্গে এমন কোন প্রাণী (মনুষ্য বা দেবতা) বা বস্তু নাই, যাহা এই প্রকৃতিজাত ও বন্ধনের কারণ ত্রিগুণ হইতে মুক্ত । ৪০

[ক্রিয়া, কারক ও ফলরূপ সমস্ত সংসার ত্রিগুণাত্মক, অবিদ্যা-পরিকল্পিত ও অনর্থের কারণ । সংসার ত্রিগুণাত্মক, অতএব অনাদি বলিয়া সংসারের অনিবৃত্তির আশঙ্কা হইতে পারে । এইজন্য তাহার নিবৃত্তির উপায় বলিতেছেন এবং সর্ববেদার্থসার গীতাশাস্ত্রের উপসংহার করিতেছেন । পুরুষার্থকামীদের অনুষ্ঠেয় সমস্ত বেদ ও স্মৃতি-শাস্ত্রের অর্থ এখন প্রদর্শিত হইতেছে ।]

হে পরন্তপ, প্রকৃতিজাত (স্বভাবজাত) ত্রিগুণানুসারেই ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শূদ্রেরও কর্মসমূহ পৃথক্‌ পৃথগ্‌রূপে বিভক্ত হইয়াছে । ৪১

বাহ্যেন্দ্রিয় ও অন্তরিন্দ্রিয়ের সংযম, কায়িক, বাচিক ও মানসিক তপস্যা; অন্তর্বহিঃ শৌচ, ক্ষমা, সরলতা, শাস্ত্রজ্ঞান ও তত্ত্বানুভূতি এবং শাস্ত্রে ও ভগবানে বিশ্বাস - এই সকল ব্রাহ্মণের স্বভাবজাত কর্ম । ৪২

পরাক্রম, তেজ, ধৃতি, কর্মকুশলতা, যুদ্ধে অপরাঙ্মুখতা, দানে মুক্তহস্ততা ও শাসনক্ষমতা - এইগুলি ক্ষত্রিয়ের স্বভাবজাত (স্বভাবজ সত্ত্বমিশ্র রজোগুণ দ্বারা প্রবিভক্ত) কর্ম । ৪৩

কৃষি, গোরক্ষা ও বাণিজ্য বৈশ্যের স্বভাবজাত (স্বভাবজ তমোমিশ্র রজোগুণ দ্বারা প্রবিভক্ত) কর্ম । পরিচর্যা শূদ্রদিগের স্বভাবজাত (রজোমিশ্র তমোগুণের দ্বারা প্রবিভক্ত) কর্ম । ৪৪

[ব্রাহ্মণাদি জাতিবিহিত এই সকল কর্ম সম্যগ্‌রূপে অনুষ্ঠিত হইলে স্বভাবতঃ স্বর্গরূপ ফলপ্রাপ্তি হয় । কিন্তু স্ব স্ব কর্ম নিষ্কামভাবে অনুষ্ঠিত হইলে কি প্রকারে সিদ্ধিপ্রাপ্তি হয়, তাহাই বলিতেছেন -]

মানুষ নিজ নিজ বর্ণ ও আশ্রমের কর্মে নিরত হইয়া জ্ঞাননিষ্ঠাযোগ্যতারূপ সিদ্ধিলাভ করে । স্বীয় কর্মে তৎপর মানুষ কিরূপে সিদ্ধিলাভ করে তাহা শ্রবণ কর । ৪৫

যে সর্বান্তর্যামী পরমেশ্বর হইতে প্রাণিগণের উৎপত্তি বা কর্মচেষ্টা, যিনি এই সমগ্র বিশ্বে ব্যাপ্ত আছেন, তাঁহাকে মানুষ স্বীয় বর্ণাশ্রমের কর্ম দ্বারা অর্চনা করিয়া সিদ্ধিলাভ করে । ৪৬

অতএব, স্বীয় বর্ণ ও আশ্রমবিহিত ধর্ম অঙ্গহীনভাবে অনুষ্ঠিত হইলেও সম্যগ্‌রূপে অনুষ্ঠিত পরধর্ম অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ । কারণ, স্বভাবনিয়ত (স্বভাবজ) কর্ম করিলে মানুষ পাপভাগী হয় না । ৪৭

হে কুন্তীপুত্র, দোষযুক্ত হইলেও জন্মনির্দিষ্ট কর্ম (স্বধর্ম) ত্যাগ করা উচিত নয় । কারণ, অগ্নি যেমন ধুমে আচ্ছন্ন হয়, সেইরূপ স্বধর্ম বা পরধর্ম সকল কর্মই ত্রিগুণাত্মক বলিয়া দোষযুক্ত হয় । ৪৮

সকল বিষয়ে অনাসক্ত, সংযতচিত্ত এবং দেহ ও জীবনে ভোগস্পৃহাশূন্য আত্মজ্ঞ ব্যক্তি সম্যগ্‌দর্শন (ব্রহ্মজ্ঞানলাভ) দ্বারা বা তৎপূর্বক সর্বকর্মসন্ন্যাসের দ্বারা নিষ্ক্রিয় আত্মস্বরূপে অবস্থানরূপ (পূর্বোক্ত কর্মজাত সিদ্ধি অপেক্ষা বিলক্ষণ) প্রকৃষ্ট সিদ্ধি (সদ্যোমুক্তি) লাভ করেন । ৪৯

[এখন গীতার নানাস্থানে বর্ণিত জ্ঞাননিষ্ঠার উপসংহারপূর্বক স্বকর্ম দ্বারা ঈশ্বরার্চনজনিত সিদ্ধিপ্রাপ্ত উৎপন্নাত্মবিবেকজ্ঞান ব্যক্তির কেবল আত্মজ্ঞাননিষ্ঠারূপ নৈষ্কর্ম্যসিদ্ধি ক্রমে হয়, ইহা বলা হইতেছে ।]

হে কৌন্তেয়, এইরূপ সিদ্ধিপ্রাপ্ত ব্যক্তির (ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য বা শুদ্রের) জ্ঞাননিষ্ঠাক্রমে ব্রহ্মজ্ঞানের পরমনিষ্ঠা বা পরিসমাপ্তিরূপ ব্রহ্মপ্রাপ্তি হয় । জ্ঞাননিষ্ঠার উক্ত প্রাপ্তিক্রম সংক্ষেপে আমার নিকট শ্রবণ কর । ৫০

আত্মাকে ব্রহ্মরূপে নিশ্চয়পূর্বক সংশয়-ও বিপর্যয়শূন্য বুদ্ধিযুক্ত হইয়া, ধৈর্যের সহিত শরীর ও ইন্দ্রিয় বশীভূত করিয়া, শরীর স্থিতির জন্য মাত্র যাহা প্রয়োজন তদ্‌ব্যতিরিক্ত শব্দাদি বিষয় পরিত্যাগপূর্বক, শরীরস্থিতির উপযোগী বিষয়েও আসক্তি ও দ্বেষ বর্জন করিয়া - ৫১

নির্জন স্থানে অবস্থান ও পরিমিত আহার করিয়া বাক্য, শরীর ও মন সংযত করিয়া, নিত্য (নিরবিচ্ছিন্ন তৈলধারাবৎ) ধ্যাননিষ্ঠা (আত্মস্বরূপচিন্তা) ও যোগপরায়ণ (আত্মবিষয়ে মনের একাগ্রীকরণ) হইয়া দৈহিক ও পারত্রিক সকল বিষয়ে বৈরাগ্য অবলম্বন করিয়া - ৫২

দেহেন্দ্রিয়াদিতে আত্মবুদ্ধি, কামরাগাদিযুক্ত বল, দর্প, কাম, ক্রোধ ও পরিগ্রহ (শরীরধারণপ্রসঙ্গে অথবা ধর্মানুষ্ঠানের জন্য অন্য দ্বারা আনীত সকল বস্তু) ত্যাগ করিয়া দেহে ও জীবনে মমতাবর্জিত এবং চিত্তবিক্ষেপশূন্য যতি এই জীবনেই ব্রহ্মজ্ঞানলাভে সমর্থ হন । ৫৩

এইক্রমে ব্রহ্মভূত ও অন্তরাত্মাতে আবির্ভূত আনন্দ প্রাপ্ত হইয়া যতি কোন বিষয়ে শোক করেন না এবং কিছুই আকাঙ্ক্ষাও করেন না । তিনি সর্বভূতের সুখ ও দুঃখ নিজের সুখ ও দুঃখের ন্যায় দর্শন করেন । এইরূপ জ্ঞাননিষ্ঠ ব্যক্তি মদ্বিষয়ক জ্ঞানরূপ উত্তম ভক্তিলাভ করেন । ৫৪

উক্ত জ্ঞানলক্ষণা ভক্তি দ্বারা তিনি আমাকে জানেন যে, আমি উপাধিকৃত ভেদবিশিষ্ট এবং স্বরূপতঃ নিরুপাধি, অদ্বিতীয় চৈতন্যমাত্র উত্তম পুরুষ । আমার এই তত্ত্ব অবগত হইবামাত্রই তিনি আমাতে প্রবেশ করেন । ৫৫

[পূর্বে বলা হইয়াছে যে, স্বকর্ম দ্বারা ভগবানের অর্চনা করিলে সিদ্ধিলাভ হয় । এখানে সেই ভগবদ্ভক্তিযোগের উপসংহার করা হইতেছে ।]

সকল প্রকার "আমি, আমার" ভাব আমাতে অর্পণ করিলে সর্বদা সমস্ত কর্ম করিয়াও ভক্ত আমার অনুগ্রহে সনাতন অক্ষয়স্থান প্রাপ্ত হন । ৫৬

বিবেকবুদ্ধি দ্বারা ঐহিক ও পারত্রিক সমস্ত কর্ম আমাতে সমর্পণপূর্বক মৎপরায়ণ হও এবং সিদ্ধিতে ও অসিদ্ধিতে হর্ষবিষাদশূন্যরূপ বুদ্ধিযোগ অবলম্বনপূর্বক আমাতে সর্বদা চিত্ত সমাহিত কর । ৫৭

আমাতে চিত্ত অর্পণ করিলে আমার অনুগ্রহে তুমি দুস্তর সংসার ও তাহার কারণসমূহ অতিক্রম করিবে । আর যদি তুমি পাণ্ডিত্যাভিমানবশতঃ; আমার কথা না শোন, তাহা হইলে তুমি পুরুষার্থের অযোগ্য হইবে । ৫৮

অহংকারকে আশ্রয় করিয়া 'যুদ্ধ করিব না' এইরূপ যাহা মনে করিতেছ, তোমার এই নিশ্চয় ভ্রমমূলক । কারণ, তোমার ক্ষাত্র স্বভাবই তোমাকে যুদ্ধে নিযুক্ত করিবে । ৫৯

হে কৌন্তেয়, অজ্ঞানবশতঃ যাহা করিতে ইচ্ছা করিতেছ না, স্বভাবজাত স্বীয় ক্ষত্রিয়োচিত কর্মে আবদ্ধ হইয়া অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাহা করিবে । ৬০

হে অর্জুন, অন্তর্যামী নারায়ণ সর্বজীবের হৃদয়ে অধিষ্ঠিত হইয়া সর্বভূতকে যন্ত্রারূঢ় পুত্তলিকার ন্যায় মায়া দ্বারা চালিত করিতেছেন । ৬১

হে ভারত, সংসারার্তিনাশের জন্য তুমি চিন্তা, বাক্য ও কর্মের দ্বারা সর্বতোভাবে তাঁহারই শরণাগত হও । তাঁহার প্রসাদে তুমি পরম শান্তি ও শাশ্বত পদ লাভ করিবে । ৬২

আমি সর্বজ্ঞ ঈশ্বর । আমি তোমার নিকট গুহ্য হইতে গুহ্যতর গীতাশাস্ত্ররূপ পরম জ্ঞান বলিলাম । তুমি ইহা নিঃশেষরূপে বিচার করিয়া যাহা ইচ্ছা হয় তাহাই অনুষ্ঠান কর । ৬৩

তুমি সর্বদা আমার অত্যন্ত প্রিয় । এইজন্য তোমার হিতকর, সর্বাপেক্ষা গুহ্য এবং সর্বহিতের শ্রেষ্ঠ আমার উৎকৃষ্ট বাক্য পূর্বে অনেকবার বলা হইলেও পুনরায় বলিতেছি । ইহার দ্বারা তোমার পরমপুরুষার্থ লাভ হইবে । সুতরাং ইহা শ্রবণ কর । ৬৪

তুমি আমাতে চিত্ত স্থির কর । আমার ভজনশীল ও পূজনশীল হও এবং আমাকে নমস্কার কর । তুমি আমার অত্যন্ত প্রিয় । এইজন্য আমি সত্য প্রতিজ্ঞা করিতেছি যে এইরূপেই তুমি আমাকে প্রাপ্ত হইবে । ৬৫

[কর্মযোগনিষ্ঠার পরম রহস্যের (ভগবৎশরণতার) উপদেশ উপসংহার করিয়া সন্ন্যাসের ফল সর্ববেদান্তবিহিত সম্যগ্‌দর্শন বলিতেছেন -]

সকল ধর্মাধর্মের অনুষ্ঠান পরিত্যাগপূর্বক গর্ভ, জন্ম, জরা ও মৃত্যুবর্জিত পরমেশ্বররূপ একমাত্র আমার শরণাগত হও । আমা হইতে অতিরিক্ত কোন বস্তুই নাই, এইরূপ দৃঢ়নিশ্চয় হইয়া আমাকে সদা স্মরণ কর । তুমি এইরূপ নিশ্চিতবুদ্ধিযুক্ত ও স্মরণশীল হইলে তোমার নিকট আমি স্বাত্মভাব প্রকটিত করিয়া সকল ধর্মাধর্ম বন্ধনরূপ পাপ হইতে তোমাকে মুক্ত করিব । অতএব, শোক করিও না । ৬৬

[শ্রীভগবান্‌ শাস্ত্র-সম্প্রদায়ের বিধি বলিতেছেন -]

সংসার-নিবৃত্তির জন্য তোমাকে উপদিষ্ট এই গীতাশাস্ত্র তপস্যাহীন ব্যক্তিকে বলিবে না । তপস্বী হইলেও গুরু ও ঈশ্বরে ভক্তিরহিত ব্যক্তিকে কখনও ইহা বলিবে না । ভক্ত ও তপস্বী হইলেও শ্রবণেচ্ছু না হইলে ইহা কাহাকেও বলিবে না । আমি ভগবান্‌ বাসুদেব । আমাকে প্রাকৃত মানুষ মনে করিয়া আত্মপ্রশংসাদি দোষ আমাতে অধ্যারোপপূর্বক অজ্ঞানবশতঃ যিনি আমার ঈশ্বরত্বে (অবতারত্বে) অবিশ্বাসী, তাঁহাকেও উহা বলিবে না । কেবলমাত্র ভগবানে অসূয়াশূন্য, তপস্বী, ভক্ত ও শুশ্রূষু ব্যক্তিকেই এই গীতাশাস্ত্র বলিবে । ৬৭

এই গীতা পাঠ ও ব্যাখ্যা দ্বারা আমি ভগবানের শুশ্রূষা করিতেছি - এই জ্ঞানে যিনি এই পরম গুহ্য গীতাশাস্ত্র আমার ভক্তের নিকট পাঠ ও ব্যাখ্যা করিবেন, তিনি পরা ভক্তি লাভ করিয়া আমাকে প্রাপ্ত হইবেনই, ইহাতে সন্দেহ নাই । ৬৮

মনুষ্যগণের মধ্যে গীতাব্যাখ্যাতা অপেক্ষা আমার অধিক প্রিয় এ জগতে কেহ নাই এবং আর কেহ হইবেও না । ৬৯

এবং যে ব্যক্তি আমাদের উভয়ের এই ধর্মজনক সংবাদরূপ গ্রন্থ অধ্যয়ন করিবেন, তাঁহার সেই জ্ঞানযজ্ঞের দ্বারা আমি পূজিত হইব, ইহা নিশ্চয় জানিবে । ৭০

যিনি শ্রদ্ধালু অসূয়াশূন্য হইয়া অর্থবোধ না হইলেও এই গীতা শ্রবণ করেন, তিনিও পাপমুক্ত হইয়া অগ্নিহোত্রাদি পুণ্যকারিগণের প্রাপ্য পুণ্যলোক লাভ করেন । ৭১

[শিষ্যের শাস্ত্রার্থগ্রহণ হইয়াছে কি না জানিতে ইচ্ছা করিয়া শ্রীভগবান্‌ জিজ্ঞাসা করিতেছেন । অভিপ্রায় এই যে, না বুঝিয়া থাকিলে পুনর্বার বুঝাইবেন । পুনঃপুনঃ যত্ন করিয়াও শিষ্যকে কৃতার্থ করা উচিত, এই আচার্যধর্ম এখানে প্রদর্শিত হইতেছে ।]

হে পার্থ, তুমি কি একাগ্রচিত্তে এই গীতাশাস্ত্র শুনিয়াছ ? হে ধনঞ্জয়, এই শ্রবণের ফলে তোমার অজ্ঞানজনিত মোহ কি বিনষ্ট হইয়াছে ? ৭২

[ভগবদনুগ্রহজনিত স্বকীয় কৃতার্থতা জ্ঞাপনার্থ] অর্জুন বলিলেন - হে অচ্যুত, আপনার প্রসাদে আমার মোহ ও অজ্ঞান নষ্ট হইয়াছে এবং পরমাত্মবিষয়ক ধ্রুবা স্মৃতি লাভ হইয়াছে । আমি নিঃসংশয় হইয়া অবস্থিত, এখন আপনার উপদেশ পালন করিব; আমার অন্য কোন কর্তব্য নাই । ৭৩

সঞ্জয় বলিলেন -
আমি এইরূপে ভগবান্‌ বাসুদেব ও অর্জুনের এই রোমাঞ্চকর অদ্ভুত কথোপকথন শ্রবণ করিলাম । ৭৪

আমি ব্যাস-প্রসাদে লব্ধ দিব্যচক্ষু দ্বারা এই পরম গুহ্য যোগ যোগেশ্বর স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণের মুখ হইতে সাক্ষাৎ (পরম্পরারূপে নহে) শ্রবণ করিয়াছি । ৭৫

হে রাজা ধৃতরাষ্ট্র, শ্রীকৃষ্ণার্জুনের এই পুণ্য অদ্ভুত কথোপকথন পুনঃপুনঃ স্মরণ করিয়া আমি মুহুর্মূহুঃ রোমাঞ্চিত ও আনন্দিত হইতেছি । ৭৬

হে মহারাজ, ভগবান্‌ শ্রীকৃষ্ণের সেই অত্যদ্ভুত বিশ্বরূপ বারবার স্মরণ করিয়া আমার মহাবিস্ময় হইতেছে এবং আমি পুনঃপুনঃ হৃষ্ট হইতেছি । ৭৭

যে পক্ষে ভগবান্‌ শ্রীকৃষ্ণ এবং গাণ্ডীবধারী অর্জুন, সেই পাণ্ডব পক্ষে রাজ্যশ্রী, বিজয়, অভ্যুদয় ও অব্যভিচারিণী নীতি বিরাজ করে, ইহা আমার নিশ্চিত অভিমত । ৭৮

ভগবান্ ব্যাসকৃত লক্ষশ্লোকী শ্রীমহাভারতের ভীষ্মপর্বের অন্তর্গত শ্রীমদ্ভগবদ্গীতারূপ উপনিষদে ব্রহ্মবিদ্যাবিষয়ক যোগশাস্ত্রে শ্রীকৃষ্ণার্জুন-সংবাদে মোক্ষযোগ নামক অষ্টাদশ অধ্যায় সমাপ্ত ।
_________________________________________


৬) আসক্তি ও ফলাকাঙ্ক্ষা পরিত্যাগপূর্বক মুমুক্ষু ব্যক্তি নিত্যকর্ম করিলে এই সমস্ত কর্ম চিত্তশুদ্ধিকর হয়, বন্ধনের কারণ হয় না ।

৭) নিত্যকর্ম অবশ্য কর্তব্য - ইহা না জানাই অজ্ঞান ।

১০) মেধা = আত্মজ্ঞানলক্ষণা প্রজ্ঞা
দ্বেষ : দেহোৎপত্ত দ্বারা কাম্য কর্ম সংসারের কারণ হয় । অতএব, ইহা দ্বারা আমার কি লাভ হইবে - এইরূপে দ্বেষ করেন না ।
আসক্ত : চিত্তশুদ্ধি ও জ্ঞানোৎপত্তি দ্বারা নিত্যকর্ম মোক্ষের কারণ বলিয়া তাহাতেও আসক্ত (প্রীতিযুক্ত) হন না । 

১১) কর্মফলের অনুষ্ঠাতা কর্মফলে বাসনা ত্যাগ করিয়া ক্রমে জ্ঞাননিষ্ঠা প্রাপ্ত হন । এই শ্লোকটি অজ্ঞানীর কর্মফলত্যাগের স্তুতির জন্য; জ্ঞানীর সর্বকর্ম-সন্ন্যাসের নিষেধক নহে ।

১৬) ভ্রান্তবুদ্ধি ব্যক্তি আত্মাকে ক্রিয়মান কর্মের কর্তা বলিয়া মনে করেন : যেমন তৈমিরিক রোগী এক চন্দ্রকে অনেক বলিয়া দেখেন, যেমন গতিশীল মেঘের মধ্যে চন্দ্রকে লোকে গতিমান মনে করে, বা যেমন ভ্রান্ত ব্যক্তি স্বয়ং বাহনে বসিয়া অন্য বাহনের গতিকালে নিজেকে গতিমান বিবেচনা করেন, সেইরূপ ।

১৭) অভিমান : অবিদ্যা দ্বারা আত্মাতে কল্পিত অধিষ্ঠানাদিই সরবকর্মের কারক । লৌকিক দৃষ্টিতে তিনি হন্তা, কিন্তু পারমার্থিক দৃষ্টিতে তিনি হন্তা নহেন ।

পারমার্থিক দৃষ্টি = 'আমি কর্তা নহি', 'আমি তাহাদের ব্যাপারের সাক্ষিস্বরূপ শুদ্ধ নিষ্ক্রিয় আত্মা' - এই প্রকার দর্শন ।
লৌকিক দৃষ্টি = দেহাদিতে আত্মবুদ্ধিযুক্ত ব্যক্তির দৃষ্টি ।

১৯) সাংখ্যদর্শন গুণবিষয়ে প্রমাণ । এই জন্য এখানে সাংখ্যের মত উদাহৃত হইল ।

২০) সাত্ত্বিক জ্ঞান সংসার-উচ্ছেদের কারণ । রাজসিক ও তামসিক জ্ঞান সংসারনিবৃত্তির কারণ নহে । অতএব সাত্ত্বিক গ্রহণ এবং রাজসিক ও তামসিক বর্জন, ইহাই ভগবানের অভিপ্রায় ।

২২) তামসিক জ্ঞান : এই দেহে সম্পূর্ণ আত্মা আছেন, আত্মা দেহ-পরিমাণমাত্র এবং এই প্রতিমাতে সম্পূর্ণ ঈশ্বর আছেন, ঈশ্বর বিগ্রহপরিমাণ, ইহার বাহিরে নাই - এইরূপ জ্ঞান ।

তুচ্ছ : এই তামসিক জ্ঞানের ফল অল্প বা বিষয় অল্প ।

২৪) অহঙ্কার : আমার সমান শ্রোত্রিয় অন্য কেহ নাই ।

২৫) স্বসামর্থ্য : এই কর্ম করিতে আমি সমর্থ কি না, ইহা বিচার না করিয়া ।

২৮) দীর্ঘসূত্রী = অদ্যকর্তব্য এক মাসেও যিনি করেন না
 
৩৫) মদ : বিষয়-সেবাকে উত্তম মনে করা ।

৩৭) নির্মলতা = জলবৎ স্বচ্ছতা
 
৪০) প্রকৃতিজাত : সত্ত্ব, রজঃ ও তমোগুণের সাম্যাবস্থাই প্রকৃতি । এই গুণত্রয় সৃষ্টিকালে বৈষম্যাবস্থা প্রাপ্ত হয়, তখন তাহাদিগকে প্রকৃতি হইতে জাত বলা হয় ।
 
৪৫) স্বর্গরূপ ফলপ্রাপ্তি : স্বকর্মনিষ্ঠ বর্ণিগণ ও আশ্রমিগণ মৃত্যুর পর স্বর্গলোকে পুণ্য ফল ভোগ করিয়া অবশিষ্ট সঞ্চিত কর্মের সহিত বিশিষ্ট দেশ, জাতি, কুল, ধর্ম, আয়ু, বিদ্যা, শীল, সম্পদ, সুখ ও মেধা লইয়া জন্মগ্রহণ করেন ।

৪৬) কেবল যে বর্ণাশ্রমের কর্ম দ্বারাই সিদ্ধিলাভ হয়, বর্ণাশ্রমবিহীনদিগের সিদ্ধিলাভ হয় না, এমন নহে । আর্য, অনার্য, স্ত্রীপুরুষ সকলেরই আত্মজ্ঞানে বা ব্রহ্মবিদ্যায় অধিকার আছে । রৈক্ক, বাচক্লবী, সংবর্ত প্রভৃতি বর্ণাশ্রমরহিত হইয়াও সিদ্ধিলাভ করিয়াছিলেন । জন্মান্তর-সঞ্চিত সংস্কার-বিশেষের দ্বারাও সিদ্ধিলাভ হয় । - [গীঃ, ৬|৪৫ ও বেদান্তসূত্র, ৩|৪|৩৬-৩৯]

ধৃতিঃ ক্ষমা দমোহস্তেয়ং শৌচমিন্দ্রিয়নিগ্রহঃ । ধীবিদ্যা সত্যমক্রোধো দশকং ধর্মলক্ষনম্‌ ।।
অর্থাৎ ধৃতি, ক্ষমা, দম, অস্তেয়, শৌচ, ইন্দ্রিয়সংযম, ধী (সম্যগ্‌ জ্ঞান, প্রতিপক্ষ ও সংশয়াদি নিরাকরণ), বিদ্যা (আত্মজ্ঞান), সত্য ও অক্রোধ - এই দশটি সাধারণ ধর্মাচরণের দ্বারা সকলেরই শ্রেয়ঃ লাভ হয় । - [মনুসংহিতা, ৬|৯২, মেধাতিথিকৃত ভাষ্য]

৪৯) প্রকৃষ্ট সিদ্ধি : ইহাই শ্রেষ্ঠ সন্ন্যাসী পরমহংসের অবস্থা বা পরমহংসচর্যা । - [শ্রীধরস্বামী]
   
৫৫)  আমার এই তত্ত্ব অবগত হইবামাত্রই তিনি আমাতে প্রবেশ করেন : এইস্থানে জ্ঞানক্রিয়া ও প্রবেশক্রিয়া একার্থ । দুইয়ের মধ্যে কোন ব্যবধান নাই । -[ভাষ্যোৎকর্ষদীপিকা]

৬১) অন্তর্যামী : 'যিনি পৃথিবীর অন্তরে বর্তমান, পৃথিবীদেবতা যাঁহাকে জানেন না, পৃথিবীদেবতার শরীর যাঁহার শরীর, যিনি পৃথিবীদেবতাদের অন্তরে থাকিয়া পৃথিবীদেবতাকে নিয়মিত করেন, ইনিই অমৃতস্বরূপ অন্তর্যামী তোমার ও সর্বপ্রাণীর আত্মা । - [বৃহ উপঃ, ৩|৭|৩]

৬৬) সর্বধর্ম = বর্ণধর্ম, আশ্রমধর্ম ও সামান্য-ধর্ম প্রভৃতি সকল প্রকার ধর্ম । - [শ্রীমধুসূদন]
অধর্ম (পাপকর্ম) হইতে নিবৃত্ত, উপরত ও সমাহিত এবং প্রশান্তচিত্ত না হইলে কেবল প্রজ্ঞান দ্বারা আত্মজ্ঞান লাভ হয় না । - [কঠ উপঃ,১|২|২৪]
ধর্মাধর্মে অভিমানী ব্যক্তির এই জ্ঞান লাভ হয় না । - [মহাভারত, অশ্বমেধপর্ব, ১৯|৭]
 
৭৩) ধ্রুবা স্মৃতি : অজ্ঞানমোহনাশ ও আত্মস্মৃতিলাভ - ইহাই সর্বশাস্ত্রার্থজ্ঞানের ফল । আহার শুদ্ধ হইলে সত্ত্বশুদ্ধি হয়, সত্ত্বশুদ্ধি হইলে ধ্রুবা স্মৃতি উদিত হয় এবং ধ্রুবা স্মৃতি লাভ হইলে হৃদয়ের সর্বগ্রন্থি ছিন্ন হয় । - [ছান্দোগ্য উপঃ, ৭|২৬|২]
_________________________________________
সপ্তশতশ্লোকময়ী শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার অনুবাদ (স্বামী জগদীশ্বরানন্দ কর্তৃক অনুদিত এবং স্বামী জগদানন্দ কর্তৃক সম্পাদিত) সমাপ্ত ।
ওঁ তৎ সৎ
_________________________________________

*Hard Copy Source:
"Srimadbhagabadgeeta" translated by Swami Jagadeeshwarananda, edited by Swami Jagadananda. 27th Reprint - January, 1997 (1st Edition - 1941), © President, Sriramkrishna Math, Belur. Published by Swami Satyabrotananda, Udbodhan Office, 1 Udbodhan Lane, Bagbazar, Kolkata-700003. Printed by Rama Art Press, 6/30 Dum Dum Road, Kolkata-700030.

Sanskrit Source
English Translation

Disclaimer:
This site is not officially related to Ramakrishna Mission & MathThis is a personal, non-commercial, research-oriented effort of a novice religious wanderer.
এটি আধ্যাত্মিক পথের এক অর্বাচীন পথিকের ব্যক্তিগত, অবাণিজ্যিক, গবেষণা-ধর্মী প্রয়াস মাত্র ।

[Digitised by scanning (if required) and then by typing mostly in Notepad using Unicode Bengali "Siyam Rupali" font and Avro Phonetic Keyboard for transliteration. Uploaded by rk]


<Previous--Contents--Next>

No comments:

Post a Comment