Tuesday, April 14, 2015

শ্রীশ্রীগীতামাহাত্ম্যম্‌ (Padmapuran-2)


শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ের মাহাত্ম্য

(শ্রীতারাকান্ত দেবশর্মা)*

শ্রীভগবান্‌ কহিলেন -
অয়ি ইন্দিরে ! গীতার আদ্য অধ্যায়ের এই উত্তম আখ্যান কীর্তন করিলাম, এক্ষণে অন্যান্য অধ্যায়গুলিরও মাহাত্ম্য শ্রবণ কর । ১

দক্ষিণদিকে পুরন্দর নামে এক পুরী আছে । তথায় বেদবাদী ব্রাহ্মণগণের বংশে দেবশর্মা নামে এক শ্রীমান্‌ ব্রাহ্মণ ছিলেন । ২

তিনি অতিথিপূজক, বেদশাস্ত্রবিশারদ, যজ্ঞাহরণকর্তা ও তাপসগণের প্রীতিভাজন । ৩

দেবগণ চিরদিন তাঁহার কার্য্যে তর্পিত এবং হুতবহ হব্যহোমে আপ্যায়িত হইয়াছিলেন । কিন্তু সেই ধর্মাত্মা দেবশর্মা ঐকান্তিকী শান্তি কিছুতেই প্রাপ্ত হইলেন না । ৪

তিনি নিঃশ্রেয়স-জিজ্ঞাসু হইয়া অনুদিন সত্যসঙ্কল্প তাপসগণের বহু প্রকারে সেবা করিতে লাগিলেন । ৫

এইরূপ করিতে করিতে তাঁহার বহুকাল অতবাহিত হইল । তৎকালে ভূতলে এক মুক্তকর্মা পুরুষ প্রাদুর্ভূত হইয়াছিলেন । ৬

তিনি অনুভূত-নিরাকাঙ্ক্ষী নাসাগ্রন্যস্তদৃষ্টি, শান্তচেত এবং পরব্রহ্মধ্যানে আনন্দনির্ভর ছিলেন । ৭

বিদ্বান্‌ দেবশর্মা প্রযতচিত্তে তদীয় পাদযুগলে প্রণত হইয়া একদা তাঁহার যথাবিধি আতিথ্যসৎকার করিলেন । ৮

অনন্তর সেই শুদ্ধভাবতুষ্ট তাপসের নিকট প্রণত দেবশর্মা স্বীয় নির্বাণস্থিতি জিজ্ঞাসা করিলেন । ৯

তখন সেই আত্মজ্ঞ তাপস পুরনামক পুরে অবস্থিত মিত্রবান্‌ নামক এক অজাপালের নিকট গিয়া তাহাকে উপদেশ লইতে বলিলেন । ১০

দেবশর্মা তৎকালে তদীয় পদে বন্দনা করিয়া সেই সমৃদ্ধ পুরে আগমন করিলেন এবং উক্ত পুরীয় উত্তরভাগে এক বিশাল বন অবলোকন করিলেন । ১১

ঐ বন পবনান্দোলিত কুসুমরাশির সৌরভে আমোদিত এবং উন্মত্ত মধুব্রতকুলের গীতঝঙ্কারে উহার সর্বদিক্‌ মুখরিত । ১২

ঐ বনের নদীতীরস্থ শিলাতলে মিত্রবান্‌ সমাসীন রহিয়াছেন । দেবশর্মা সানন্দচিত্তে স্তিমিতনেত্রে তাঁহাকে দর্শন করিলেন । ১৩

ঐ বনে পরস্পর বিরোধী জন্তুগণ স্বাভাবিক বৈরিতা পরিত্যাগ করিয়া মিলিত রহিয়াছে । ১৪

মৃগযুথ সকল প্রশান্তভাবে অবস্থান করিতেছে । মিত্রবান্‌ কৃপানুবিদ্ধ মনোজ্ঞ দৃষ্টিপাতে ভূতলে যেন অমৃতধারা সিঞ্চন করিতেন । ১৫

দেবশর্মা এহেন উপদেষ্টার নিকট বিনীত ভাবে উৎকণ্ঠিত ও প্রীতচিত্তে কিঞ্চিৎ আনম্র মস্তকে উপস্থিত হইলে মিত্রবান্‌ তাঁহাকে সৎকার করিলেন । ১৬

অনন্তর বিদ্বান্‌ দেবশর্মা অনন্যমনে মিত্রবান্‌কে পূজা করিলেন এবং তাঁহার ধ্যানকালের অবসান হইলে তিনি সমাহিত ভাবে তাঁহাকে জিজ্ঞাসিলেন । ১৭

দেবশর্মা কহিলেন -
আমি আত্মস্বরূপ অবগত হইতে ইচ্ছা করিয়াছি । অতএব এহেন মনোরথ বিষয়ে আমার যাহাতে সিদ্ধি লাভ হয়, আপনি এরূপ উপায় আমাকে উপদেশ করুন । ১৮


শ্রীভগবান্‌ কহিলেন -
তখন মিত্রবান্‌ কিয়ৎকাল চিন্তা করিয়া কহিলেন - ১৯

মিত্রবান্‌ কহিলেন -
হে বিদ্বন্‌ ! এ বিষয়ে আমি এক পুরাবৃত্ত বলিতেছি, তুমি তাহা অবধারণ কর । গোদাবরীতীরে প্রতিষ্ঠান নামে এক পুরী আছে । তথায় মনীষিগণের বংশে দুর্দম নামে এক রাজা ছিলেন । ২০

তাঁহার বংশে বিক্রম নামে এক রাজা জন্মগ্রহণ করেন । তিনি উদরম্ভর হইয়া প্রত্যহ দান-প্রতিগ্রহ করিতেন । ২১

কালে কালপাশে বদ্ধ হইয়া বিক্রম যমালয়ে নীত হইলেন । সে স্থানে নিরয়সমূহে তিনি বিবিধ যাতনা অনুভব করেন । ২২

পরে দ্বিজাতিগণের কোন এক দুর্বৃত্তকুলে জন্মগ্রহণ করিলেন । জন্মান্তরানুবর্তিনী বিদ্যা তাঁহার অধিগত হইল । ২৩

কিন্তু তিনি এক অধম কুলজাত দুর্দ্ধর্ষ কন্যার পাণিপীড়ন করিলেন । কালক্রমে ঐ কন্যা শৈশব অতিক্রম করিয়া যৌবনে পদার্পণ করিল । ২৪

যৌবনাবস্থায় সে পীনস্তনী, সুশ্রোণি ও মদবিহ্বলনয়না হইয়া দুর্বৃত্ত পতির দুর্ব্যবহার সহ্য করিতে পারিল না । পরপুরুষদিগকে নিজপতি করিবার তাহার বাসনা হইল । ২৫

একদা তদীয় পতি বৃত্তি আহরণার্থ পুরী হইতে বহির্গত হইলে পর সেই দুষ্টাও পুরী হইতে বহির্গত হইল এবং কোন এক চণ্ডালের সহিত দীর্ঘকাল রমণ করিল । ২৬

তাহাতে তার গর্ভ সঞ্চার হইল । সে গর্ভে এক কন্যা জন্ম গ্রহণ করিল । ব্রাহ্মণের পূর্বপাপপ্রসঙ্গেই ঐ চণ্ডালসঙ্গতা নারী তাঁহার ভার্য্যা হইয়াছিল । ২৭

ঐ নারী বৃদ্ধ হইয়া কালক্রমে ডাকিনী হইল । কুসঙ্গে দুষ্টনারীপ্রসঙ্গে তাহার কুমতি জন্মিয়াছিল । ২৮

সে শোণিতস্বাদ-লালসায় ব্যাধিত ব্যাধকে ভক্ষণ করিলে জনগণ তাহাকে বহিষ্কৃত করিয়া দিল । সে ঘোর বিপিনে ভ্রমণ করিতে লাগিল । ২৯

জীবহিংসা প্রভাবে দারুণ নরকনিচয় ভোগের পর সেই ব্যাধ ব্যাঘ্র হইয়া জন্মিল । ৩০

সেই দুষ্টা ডাকিনী কালবশে মৃত্যুগ্রস্ত হইয়া দারুণ নানা নরকভোগান্তে আমার গৃহে অজা হইয়া জন্মিল । ৩১

আমি তাহাকে এবং অন্যান্য অজাদিগকে পালন করিতাম । একদা বনাভ্যন্তরে এক বিশ্বগ্রাসোদ্যত দ্বীপীকে দর্শন করিলাম । ৩২

আমি সেই দ্বীপীকে আসিতে দেখিয়া মরণভয়ে অজাযুথ পরিত্যাগপূর্বক পলায়ন করিলাম । ৩৩

সেই দ্বীপী পূর্ববৈর অনুস্মরণ করিয়া ধাবিত হইল । আমার সেই গৃহপালিত অজা তখন সত্বর সরিৎসমীপে তৎসমীপে প্রয়াণ করিল । ৩৪

সে ভয় ও বৈর পরিহার করিয়া অবাধে উপস্থিত হইল । তৎকালে সেই দ্বীপীও মাৎসর্য্য পরিহারপূর্বক নিশ্চেষ্ট ভাবে রহিল । ৩৫

অজা কহিল -
অনন্তর অজা তাহাকে তথাবিধ অবলোকন করিয়া বলিতে লাগিল, - "হে দ্বীপিন্‌ ! তুমি অভীপ্সিত মাংস তুলিয়া লইয়া সাদরে ভক্ষণ কর । ৩৬

এরূপ বুদ্ধি তো তোমার হইতে পারে না । তুমি কেন বৈর বুদ্ধি পরিত্যাগ করিতেছ ?" ৩৭

মাৎসর্য্যহীন দ্বীপী তখন (অজার) ঐ কথা শ্রবণ করিয়া কহিল, - "এ স্থানে আসিবার পর আমার দ্বেষ গিয়াছে, ক্ষুধা পিপাসা দুরীভূত হইয়াছে । তাই তুমি সমীপস্থ হইলেও তোমাকে আমি খাইতে ইচ্ছা করি না ।" ৩৮

দ্বীপী এই কথা কহিলে অজা পুনরায় বলিল, - "আমি কেন এমন নির্ভয় হইলাম, ইহার কারণ কি ? যদি তুমি জানিয়া থাক তবে বল ।" ৩৯

অজার এই কথা শুনিয়া দ্বীপী পুনর্বার বলিল, - "আমি এ সম্বন্ধে কিছুই জানি না । এই সম্মুখস্থ মহাপুরুষকে গিয়া জিজ্ঞাসা করি ।" এই বলিয়া তাহার উভয়েই নির্গত হইল । ৪০

আমাকে আসিয়া এ বিষয় জিজ্ঞাসা করিল । আমি এই প্রশ্নে অত্যন্ত বিস্ময়াপন্ন হইলাম এবং উভয়ের সহিতই এক বানরেশ্বরের নিকট গিয়া তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম । ৪১

কপিবর কহিলেন -
কপিবর মৎকর্তৃক পৃষ্ট হইয়া সাদরে কহিল, - হে অজাপাল ! এ বিষয়ে এক পুরাতন বৃত্তান্ত শ্রবণ কর । ৪২

ঐ সম্মুখে বনাভ্যন্তরে এক মহৎ আয়তন অবলোকন কর । এখানে ব্রহ্মা কর্তৃক এক শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে । ৪৩

সুকর্মা নামে এক মেধাবী তাপস বনকুসুম আহরণ করিয়া সুরপূজ্য শিবের পূজোপাসনা করেন । ৪৪

স্নপনান্তে নদীজলে তিনি কেবল এইরূপ কর্ম লইয়াই বাস করিতেছিলেন । বহুকাল পরে তাঁহার নিকট এক অতিথি আসিল । ৪৫

তিনি তাঁহাকে ফলাহার প্রদান করিলেন । তাঁহার কৃত আতিথ্যে প্রীত হইয়া অতিথি বলিলেন, - ৪৬

অতিথি সুকর্মাকে বলিলেন -
তুমি কেন এই কর্মমূলক ফল ভোগ করিয়া রহিয়াছ ? কেবল গতানুগতিক বৃত্তি দ্বারা কি ফলই বা তুমি ইচ্ছা করিয়াছ ? ৪৭

সেই আত্মজ্ঞ অতিথি প্রীত হইয়া এই কথা কহিলে সুকর্মা তখন স্পষ্ট প্রত্যুত্তরে উত্তম আত্মহিত কথা কহিলেন । ৪৮

সুকর্মা বলিলেন -
হে বিদ্বন্‌ ! আমি তত্ত্বতঃ এই কর্মফল বুঝি না । কেবল জ্ঞানার্থ পরম দেব শম্ভুকে আমি সেবা করিতেছি । ৪৯

এই সেবার পরিণাম ফল আমার অবিদিত । যদি আমায় অনুগ্রহ বিতরণ করেন, তবে আত্মমনোরথ ব্যক্ত করুন । ৫০

তাহার সেই সত্য বাক্য শ্রবণ করিয়া তপোধন প্রীত হইলেন এবং শিলাতলে গীতার দ্বিতীয় অধ্যায় লিখিয়া দিলেন । ৫১

অনন্তর সেই বিপ্রকে তাহা পাঠ ও অভ্যাসের নিমিত্ত আদেশ দিয়া বলিলেন, হে বিপ্র ! ইহাতেই তোমার মনোরথ সিদ্ধ হইবে । ৫২

ধীমান্‌ অতিথি এই বলিয়া তাঁহার সমক্ষেই অন্তর্ধান করিলেন । বিপ্র তাঁহার সেই আদেশে বিস্ময়াপন্ন হইয়া নিরন্তর তাহা পাঠ ও অভ্যাস করিতে লাগিলেন । ৫৩

অনন্তর দীর্ঘকাল পরে তাঁহার আত্মপ্রসাদ জন্মিল । তিনি সেই প্রশান্ত তপোবনের যত্র তত্র বিচরণ করিতে লাগিলেন । ৫৪

দ্বন্দ্বপীড়া, ক্ষুৎপিপাসা বা ভয় কিছুই তাঁহার রহিল না । জানিয়া রাখিবে, গীতার দ্বিতীয়াধ্যায় পাঠনিরত সেই ব্রাহ্মণের তপস্যাবলেই এই সকল ঘটিল । ৫৫

মিত্রবান্‌ কহিলেন -
কপিবর উল্লিখিত পরম কথার অবতারণা করিয়া আমায় এইরূপ কহিলে আমি তাঁহার অনুজ্ঞা লইয়া ছাগী ও ব্যাঘ্রসহ প্রস্থান করিলাম । ৫৬

সেইস্থানে গিয়া শিলাতলে লিখিত গীতার দ্বিতীয় অধ্যায় দেখিলাম ও পাঠ করিলাম । উঁহা আবৃত্তি করায় আমার উত্তম তপঃসিদ্ধি লাভ হইল । ৫৭

অতএব হে কল্যাণ । আপনিও নিত্য ঐ অধ্যায় আবৃত্তি করুন । ইহাতেই আপনার মুক্তি অদূরবর্তিনী হইবে । ৫৮

দেবশর্মা মিত্রবান্‌ কর্তৃক এইরূপ আদিষ্ট হইয়া প্রণতিপূর্বক তাঁহার অর্চনা করিয়া পুনরায় পুরন্দরপুরে প্রয়াণ করিলেন । ৫৯

সেখানে কোন দেবালয়ে জনৈক আত্মজ্ঞ পুরুষকে প্রাপ্ত হইয়া উক্ত বিবরণ নিবেদনান্তে দ্বিতীয় অধ্যায় পাঠ করিলেন । ৬০

আত্মজ্ঞ পুরুষের শিক্ষায় পূতচিত্ত হইয়া দেবশর্মা সাদরে দ্বিতীয় অধ্যায় পাঠ করত উচ্চ নিরবদ্য পরম পদ প্রাপ্ত হইলেন । ৬১


শ্রীভগবান্‌ কহিলেন -
এই আমি দ্বিতীয় অধ্যায়ের আখ্যান কীর্তন করিলাম । অয়ি ইন্দিরে ! এইরূপ তৃতীয় অধ্যায়ের মাহাত্ম্য বলিতেছি । ৬২
[পদ্মপুরাণ, উত্তর খণ্ড, ১৭৬ অধ্যায়]
_________________________________________

চলিত বাংলায় সারাংশ


কোন এক সময়ে দক্ষিণ দেশের পাণ্ডারপুর শহরে দেবশ্যাম নামে এক পণ্ডিত ব্রাহ্মণ বাস করতেন । তিনি সব রকম হোমকার্য সম্পাদন করে, আতিথেয়তা পালন করে সকল দেব-দেবীকে তুষ্ট করতেন । কিন্তু তার মনে একান্ত শান্তি ছিল না । আত্মার সঙ্গে পরমাত্মার সম্পর্কিত জ্ঞান লাভে তাঁর বাসনা ছিল । শেষের দিকে, তিনি অনেক যোগী ও তপস্বীদের আমন্ত্রণ করে, তাঁদের সঠিক সেবা যত্ন করে তাঁদের কাছে পরম-তত্ত্ব সম্বন্ধে জানতে চাইতেন । এইভাবেই তাঁর জীবনের বহু সময় কেটে গেল ।

একদিন ভ্রমণকালে তিনি দেখলেন এক যোগী তাঁর নাসিকার অগ্রভাগে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে পদ্মাসনে গভীর ধ্যানমগ্ন হয়ে আছেন । দেবশ্যাম বুঝতে পারলেন যে, এই যোগী সম্পূর্ণ শান্তিপ্রিয় এবং জড়বাসনা শূন্য । গভীর শ্রদ্ধা ও সম্মানের সঙ্গে তিনি সেই যোগীর শ্রীচরণে পতিত হয়ে জানতে চাইলেন যে কি করে তিনি পূর্ণ মানসিক শান্তি পাবেন । তখন সেই যোগী দেবশ্যামকে সোপুর গ্রামে গিয়ে ছাগ-পালক মিত্রভানের সঙ্গে দেখা করে তার কাছ থেকে ভগবৎ-উপলব্ধির নির্দেশ গ্রহণ করতে বললেন । এ কথা শুনে দেবশ্যাম সেই যোগীকে পুনঃপুনঃ শ্রদ্ধা নিবেদন করে সোপুরের উদ্দেশে রওনা হলেন ।

সেখানে পৌছে উত্তরদিকে তিনি এক সুন্দর বন দেখতে পেলেন । ওই বনেই একটি ছোট নদীর তীরে পাথরের উপর মিত্রভান ধ্যান-মগ্ন হয়ে বসে ছিলেন । মিত্রভানকে খুব সুন্দর এবং সম্পূর্ণ শান্ত দেখাচ্ছিল । বনে মৃদুমন্দ বাতাস বইছিল এবং চতুর্দিক থেকে সুন্দর সৌরভ নির্গত হচ্ছিল । যত্র-তত্র ছাগলের পাল শান্তিতে ও নির্ভয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল - কয়েকটি ছাগকে বাঘ ও অন্যান্য হিংস্র জন্তুর পাশে উপবিষ্ট অবস্থায় দেখা গেল । এই দৃশ্য দেখে দেবশ্যামের মন শান্ত হল এবং তিনি শ্রদ্ধার সঙ্গে মিত্রভানের পাশে গিয়ে বসলেন ।
কিছুক্ষণ পর মিত্রভানের ধ্যানাবসান হলে দেবশ্যাম তার কাছে আত্মস্বরূপ জানার উপায় জানতে চাইলেন । মুহূর্তকাল গভীর চিন্তা করে মিত্রভান বললেন, 'একদা বহু পূর্বে আমি যখন বনে ছাগ চরাচ্ছিলাম, সেই সময় এক অতি ভয়ঙ্কর বাঘ আমার ছাগলের পালকে আক্রমণ করে । আত্মরক্ষার জন্য সমস্ত ছাগল এদিক-অদিক দৌড়াতে শুরু করে । বাঘের ভয়ে আমিও ছুট দিলাম । কিছু দূর গিয়ে ফিরে তাকিয়ে দেখলাম যে নদীর পারে বাঘটি আমার একটি ছাগকে ধরে ফেলেছে । ঠিক তখনই একটি অদ্ভূত ও আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটে গেল । বাঘটি তার সমস্ত ক্রোধ এবং ছাগলটিকে খাওয়ার ইচ্ছা হারিয়ে ফেলল ।

তখন ছাগটি বাঘকে প্রশ্ন করল, "তুমি তোমার খাদ্য পেয়েও কেন গ্রহণ করছ না ? অবিলম্বে আমাকে হত্যা করে মহা তৃপ্তিতে আমার মাংস খাও । তুমি দ্বিধা করছ কেন ?"
বাঘটি বলল, "প্রিয় ছাগ, এই স্থানে আসার পর আমার সকল ক্রোধ ও ক্ষুধা-তৃষ্ণা অন্তর্হিত হয়েছে ।"
ছাগ বলল, "আমিও বুঝতে পারছি না, কেন আমি এত নির্ভীক ও শান্তি বোধ করছি । এর কারণ তোমার জানা থাকলে দয়া করে আমাকে তা জানাও ।"
বাঘ বলল, "আমিও তা জানিনা । চল, ওই লোকটাকে জিজ্ঞাসা করা যাক ।"

বাঘ ও ছাগের এরূপ কথোপকথন শুনে আমি খুবই অবাক হলাম । এমন সময় তারা আমার কাছে এসে এর কারণ জানতে চাইল । আমি লক্ষ্য করলাম কাছেই গাছের ডালে এক বানর বসে আছে । আমি তখন এই দুজনকে সঙ্গে নিয়ে বানরটির কাছে এর কারণ জানতে চাইলাম ।

বানরের কথা :
এই বনে, ঠিক তোমার সামনে একটা খুব বড় মন্দির আছে । ভগবান ব্রহ্মা সেই মন্দিরে একটি শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করেন । বহু পূর্বে সুকাম নামে এক বিদ্বান মুনি এখানে বাস করতেন । তিনি অনেক কঠোর সংযম পালন করেছিলেন । প্রতিদিন তিনি বন থেকে ফুল এবং নদী থেকে জল এনে শিবের পূজা করতেন । এইভাবে অনেকদিন যাওয়ার পর একদিন সেখানে এক মুনির আগমন হল । সুকাম তাঁকে ফল ও জল যথোচিত সৎকার করলে মুনিবর প্রীত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন "কেবল গতানুগতিক কর্ম দ্বারা তুমি কি ফল চাইছ ?"
প্রত্যুত্তরে সুকাম বললেন, "তাত্ত্বিক ভাবে এই কর্মফল আমি বুঝি না । কেবল জ্ঞান লাভের আশায় পরম দেব শম্ভুকে আমি সেবা করছি । এই সেবার পরিণাম ফল আমাকে অনুগ্রহ করে বুঝিয়ে দিন ।"

সুকামের সত্য কথা শুনে মুনিবর যথেষ্ট প্রীত হলেন এবং একটি পাথরে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার দ্বিতীয় অধ্যায় লিখে দিলেন । সুকামকে তিনি সেই শ্লোকগুলি প্রতিদিন পাঠ ও অভ্যাস করতে নির্দেশ দিয়ে বললেন যে, এইভাবেই তোমার অভীষ্ট লাভ হবে । এরপর থেকে সুকাম প্রতিদিন সেই নির্দেশ পালন করতে লাগলেন । শীঘ্রই তিনি পূর্ণ জ্ঞান লাভ করে দ্বন্দ্ব, ক্ষুধা, তৃষ্ণা, ভয় জয় করলেন । এই স্থানে তাঁর সেই কঠোর সংযম ও ভক্তিপূর্ণ ক্রিয়াদি সম্পাদনের জন্য যেই এখানে পদার্পণ করে, তার ক্ষুধা-তৃষ্ণার অনুভব বিদূরিত হয় এবং অবিলম্বে তার পূর্ণ শান্তি লাভ হয় ।

মিত্রভান বললেন -
প্রিয় দেবশ্যাম, বানরটি তার অত্যাশ্চর্য কাহিনী শেষ করার পর আমি সেই বাঘ ও ছাগলের সঙ্গে মন্দিরে গেলাম । সেখানে আমরা পাথরের ওপর লিখিত শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার দ্বিতীয় অধ্যায় দেখলাম ও পাঠ করলাম । এইভাবে আমরাও সিদ্ধি লাভ করতে সক্ষম হলাম । অতএব, তুমিও শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার দ্বিতীয় অধ্যায় আবৃত্তি করতে শুরু কর, শীঘ্রই তোমারও মুক্তি হবে ।

ভগবান বিষ্ণু বললেন -
প্রিয়ে লক্ষী, দেবশ্যাম মিত্রভানের কাছ থেকে জ্ঞান লাভ করে পাণ্ডারপুরে ফিরে গিয়ে তিনি প্রতিদিন দ্বিতীয় অধ্যায় আবৃত্তি করেন । এইভাবেই তিনি আমার পরম পদ লাভ করেছিলেন ।


_________________________________________
*Hard Copy Source:
"Padmapuran, Uttarkhanda (Bengali)" by Veda Vyas, translated by Sri Tarakanta Debasharrma, Krishnadas Shastri and Sriramdas Shastri, edited by Pandit Panchanan Tarkaratna. Bangabasi-Electro-machine edition, 1915. Published & printed by Sri Natabar Chakraborty for Bangabasi Karyalay, 38/2 Bhabanicharan Datta Street, Kolkata. First Nababharat Edition, 2013 (with identical page layout). Nababharat Publishers, 72 D, Mahatma Gandhi Road, Kolkata-700009. 1062p.

Hard Copy Reference:
"Srimadvagabadgeeta Mahatmya (Bengali)compiled by Sri Sanatangopal Das Brahmachari. 6th Edition, 2014 (First Edition 2005)Printed & published by Bhaktivedanta Book Trust, Mayapur-741313, Nadia, West Bengal, India. © 2014 by Bhaktivedanta Book Trust.

Sanskrit Source
English Translation

[Digitised by scanning (if required) and then by typing mostly in Notepad using Unicode Bengali "Siyam Rupali" font and Avro Phonetic Keyboard for transliteration. Uploaded by rk]

<Previous--Contents--Next>

No comments:

Post a Comment