শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার চতুর্থ অধ্যায়ের মাহাত্ম্য
(শ্রীতারাকান্ত দেবশর্মা)*
শ্রীভগবান্ কহিলেন -
অধুনা গীতার চতুর্থ অধ্যায়ের মাহাত্ম্য বলিতেছি, শ্রবণ কর । ইহা দ্বারাই কন্যাদ্বয় বদরীত্ব বিসর্জন করিয়া স্বর্গে গিয়াছিল । ১
লক্ষ্মীদেবী কহিলেন -
কন্যাদ্বয় বদরীত্ব বিসর্জন করিয়া কিরূপে স্বর্গে গেল ? তাহারা পূর্বে কোথায় ছিল ? এবং কিরূপেই বা মুখ্যত্ব প্রাপ্ত হইল ? ইহা আমি জানিতে ইচ্ছা করি । হে নাথ ! আপনি ইহা বলুন । এই পরম কথা শ্রবণ করিয়া আমি তৃপ্তিশেষ প্রাপ্ত হইতেছি না । ২-৩
শ্রীভগবান্ কহিলেন -
ভাগীরথীতীরে বারাণসী নামে এক পুরী আছে । তথায় বিশ্বেশ্বর মন্দিরে ভরত নামে এক জিতেন্দ্রিয় ব্যক্তি নিত্য আত্মরত হইয়া সাদরে চতুর্থ অধ্যায় জপ করিতেন । অদুষ্টাত্মা ভরত এই অভ্যাস হেতু দ্বন্দ্বাভিভূত ছিলেন না । ৪-৫
কোন এক সময় তপোধন ভরত ক্রীড়া করিতে করিতে উপান্তবর্তী দেবগণকে দেখিবার জন্য নগরের বাহিরে গমন করিলেন । ৬
সেখানে গিয়া তিনি দুইটি বদরীবৃক্ষের মূলে বিশ্রাম করিতে থাকিলে উক্ত দুইটি বৃক্ষ হইতে দুইটি ফল পতিত হইল । ভরত তাহার একটি ধারণপূর্বক অন্যটি পদ দ্বারা আলম্বন করিয়া প্রস্থান করিলেন । তপস্বী চলিয়া গেলে, তখন বদরীবৃক্ষদ্বয় পাঁচ সাত দিনের মধ্যেই শুষ্ক এবং নিষ্পত্রশাখ হইল । ৭-৮
অনন্তর কোন ব্রাহ্মণের গৃহে সেই বদরীদ্বয় কন্যাদ্বয়রূপে উৎপন্ন হইল । কন্যাদ্বয় বৃদ্ধি পাইয়া সপ্তবর্ষ বয়ঃক্রম কালে একদা ক্রীড়াবসানে দূরদেশ হইতে এক যতিকে আসিতে দেখিল । তখন তাহারা সেই যতির চরণযুগল ধারণ করিয়া সূনৃত বাক্যে বলিল, - ৯-১০
কন্যাদ্বয় কহিল -
হে মুনে ! আপনার প্রসাদেই আমরা উভয়ে মোচিত হইয়াছি । আমরা বদরীভাব পরিত্যাগ করিয়া মনুষ্যত্ব প্রাপ্ত হইয়াছি । ১১
যতি বলিলেন -
সেই মুনি বিস্ময়াপন্ন হইয়া প্রত্যুত্তরে বলিলেন - বৎসে ! কবে তোমরা কোন্ হেতু প্রসঙ্গে মৎকর্তৃক মোচিত হইয়াছ ? তোমাদের বদরীভাবের হেতু কি বল, আমি তাহার কিছুই জানিনা । ১২-১৩
তখন কন্যাদ্বয় আপনাদের বদরীভাবের হেতু এবং সেই দুস্ত্যজভাব হইতে আপনাদের মোচনের কারণ ব্যক্ত করিতে লাগিল । ১৩-১৪
কন্যাদ্বয় কহিল -
গোদাবরীতীরে নরগণের পুণ্যপ্রদ এক তীর্থ আছে । ঐ তীর্থ "ছিন্নপাপ" নামে বিখ্যাত । উহার প্রভাবে নরগণ চরম উৎকর্ষ প্রাপ্ত হইয়া থাকে । ১৪-১৫
তথায় সত্যতপা নামে এক তাপস ঘোর তপস্যা করিয়াছিলেন । তিনি দারুণ নিদাঘে দীপ্ত অনল রাশির মধ্যগত হইয়া, বর্ষায় বর্ষাজলধারায় সিক্তমস্তক হইয়া এবং শিশিরে জল মধ্যে বাস করত কণ্টকিত দেহ ধারণ করিয়া নিয়ত বিশুদ্ধভাবে তপস্যা করিতেছিলেন । ১৫-১৭
সুতপা পরম নির্বৃতি প্রাপ্ত হইয়া আত্মাতেই মতি স্থাপন করিয়াছিলেন । সদা ফলধারী ঘনচ্ছায়াযুত শাখিসমূহে এবং মাৎসর্য্যহীন জন্তুবর্গে পরম প্রীতি স্থাপন করিয়া তপোধন ফলানুসন্ধানার্থ বিজ্ঞতার সহিত তপস্যা করিতে থাকিলে স্বয়ং ব্রহ্মাও ইহার নিকট জিজ্ঞাসার নিমিত্ত অহরহ উপস্থিত হইতে লাগিলেন । ব্রহ্মা অনুদিন অনুগত হইলেও তিনি সঙ্কোচহীন হইয়া তপোময় রহিলেন । তাঁহার তপস্যা আত্মধ্যানেই অনুগত হইয়া বৃদ্ধি পাইতে লাগিল । ১৮-২১
তখন পুরন্দর সুতপাকে সমৃদ্ধ আত্মপদ লাভে বিমুক্তকল্প মনে করিয়া ভীত হইলেন এবং তপোব্যাপারে শতশত বিঘ্ন উৎপাদন করিতে লাগিলেন । ২১-২২
তিনি অপ্সরাগণের মধ্য হইতে আমাদের উভয়কে আহ্বান করিয়া এইরূপ আদেশ করিলেন যে, তোমরা দুইজনে গিয়া ঐ তপোধনের তপোবিঘ্ন আচরণ কর । ঐ তপস্বী আমাকে স্বীয় পদ হইতে ভ্রংশিত করিয়া আমার রাজ্যভোগে অভিলাষী হইয়াছে । ২২-২৩
ইন্দ্রের সম্মুখস্থ আমরা তাঁহার ঐরূপ আদেশ পাইয়া গোদাবরীতীরে গমন করিলাম যেথায় সেই মুনি অবস্থান করিতেছিলেন । ২৪
সেথায় আমরা গম্ভীর-মৃদুল মৃদঙ্গ এবং কলবাদী বেণুরব সহ কলগীত আরম্ভ করিয়া দিলাম । আমাদের সঙ্গে আরও অনেক কৃশাঙ্গী কামিনী ছিল । ২৫
আমরা বিপুল নিতম্ব ও ঘন পীনপয়োধর বহন করিতেছিলাম । আমাদের মুখপদ্ম গর্বোৎফুল্ল, অলকাবলী কিঞ্চিৎ আকুঞ্চিত, এবং স্কন্ধ মণিকুণ্ডলযুগলে সংঘৃষ্ট হইতেছিল । আমাদের নয়ন পুণ্ডরীকবৎ উজ্জ্বল এবং মধ্যদেশ ক্ষীণ ছিল । আমরা সমপদ ও সুবৃত্ত ঊরুযুগল ধারণ করিতেছিলাম । ২৬-২৭
তৎকালে সুর-তাল-লয়ানুসারে আমরা যৌবনভরে নৃত্য করিতে লাগিলাম, ভাবানুগামিনী সমগ্র গতি দেখাইলাম । ২৮
ধীরে ধীরে নৃত্য আরম্ভ করিলাম । পরে সেই নৃত্যবেগ শনৈঃ শনৈঃ বর্ধিত হইয়া দিক্চক্র শব্দায়মান করিয়া তুলিল । অনন্তর অঙ্গ-হারবেগে সুরভি শীতল বায়ু বহিল, তাহাতে আমাদের বক্ষোবস্ত্র ঈষদুচ্ছ্বসিত হওয়ায় আমরা স্ব স্ব পয়োধরযুগল প্রদর্শন করিতে লাগিলাম । ২৮-৩০
আমাদের প্রগল্ভ গতি মদনোদ্দীপন করিয়া দিল । তাহাতে অবিকৃতাত্মা মুনির কোপৎপাদন হইল । ৩১
মুনির শাপ -
কুপিত মুনি হস্তে জল লইয়া আমাদিগকে অভিশাপ দিয়া বলিলেন, "তোরা জাহ্নবীতীরে বদরীত্ব প্রাপ্ত হইবি ।" ৩২
অপ্সরাদ্বয়ের ক্ষমা প্রার্থনা -
এইরূপ অভিশাপের পর আমরা বিনীতভাবে তাঁহাকে প্রসাদিত করিলাম, বলিলাম, "আমরা পরাধীনভাবে যে দুষ্কর্ম করিয়াছি, তাহা আপনি ক্ষমা করুন ।" ৩৩
তখন সেই পুণ্যাত্মা মুনি ভরত দ্বিজের আগমন পর্যন্তই আমাদের শাপমোক্ষণ নিশ্চিতরূপে নির্দেশ করিয়া দিলেন । ৩৪
পরে মর্ত্যে আমাদের জন্ম হইল এবং অতীত জন্মের স্মৃতি অক্ষুণ্ণ রহিল । অনন্তর বদরীভূত মাদৃশ ব্যক্তির আন্তকে আপনি আগমন করিলেন এবং গীতার চতুর্থাধ্যায় স্মরণকারী আপনা কর্তৃক আমরা নিষ্কৃতি লাভ করিলাম । অতএব আপনাকে আমরা প্রণাম করিতেছি । ৩৫-৩৬
আমরা যে কেবল শাপ হইতে মুক্ত হইলাম, তাহা নহে; এই ঘোর সংসার হইতেও আপনা কর্তৃক আমরা মোচিত হইলাম । ৩৭
শ্রীভগবান্ কহিলেন -
সেই কন্যাদ্বয় কর্তৃক এইরূপ উক্ত ও পূজিত হইয়া মুনি অতি প্রীতমনে তাহাদের নিকট বিদায় লইয়া যথাস্থানে প্রস্থান করিলেন । ঐ কন্যাদ্বয় তখন হইতে নিত্য শ্রদ্ধার সহিত গীতার চতুর্থ অধ্যায় জপ করিতে লাগিলেন । ৩৮
[পদ্মপুরাণ, উত্তর খণ্ড, ১৭৮ অধ্যায়]
_________________________________________
চলিত বাংলায় সারাংশ
বারাণসীর গঙ্গাতীরে বিশ্বনাথ মন্দিরে "ভরত" নামে এক সাধু পরম ভক্তির সঙ্গে প্রতিদিন শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার চতুর্থ অধ্যায় পাঠ করতেন । পূর্বে তীর্থযাত্রার সময় তিনি একবার দুটি বদরী (কুল) গাছের তলায় বিশ্রাম করেছিলেন । তিনি সেই স্থান ত্যাগ করার পর পাঁচ-ছয় দিনের মধ্যেই গাছ দুটি শুকিয়ে মরে যায় । গাছগুলির আত্মা দুটি এক ধার্মিক ব্রাহ্মণের দুই কন্যা রূপে জন্ম নিল । কন্যা দুটি সতেরো বছর বয়সে বারাণসীতে যখন তীর্থযাত্রায় গিয়েছিল তখন ভরত মুনির সঙ্গে তাদের দেখা হয় । তারা ভরতের পায়ে পড়ে কৃতার্থ হয়ে জানাল "হে মহামুনি ভরত, আপনার কৃপাতেই আমরা বৃক্ষ-রূপ থেকে মুক্তি পেয়েছি ।" ভরত তাদের কথা শুনে অবাক হয়ে বললেন "প্রিয় কন্যারা, তোমাদের সব কথা আমাকে খুলে বল, কারণ এ সম্মন্ধে আমি কিছুই জানি না ।"
তখন কন্যাদ্বয় বলল - গোদাবরী নদী তীরে "ছিন্নপাপ" নামে এক অতি পবিত্র স্থানে "সত্যতপা" নামে এক ঋষি একদা ঘোর তপস্যা করছিলেন । তার কঠোর কৃচ্ছ্রসাধনে দেবরাজ ইন্দ্র ভীত হলেন । ইন্দ্র আশঙ্কা করলেন এই তপস্বী তাঁর তপবলে একদিন তাকেই স্বর্গের রাজপদ থেকে উচ্ছেদ করবেন । সেইসময় আমরা ইন্দ্রের রাজসভায় আমরা অপ্সরা ছিলাম । ইন্দ্র আমাদেরকে মুনির তপস্যা ভঙ্গ করার নির্দেশ দিলেন ।
নির্দেশ মত আমরা মুনির সামনে উদ্দীপক নৃত্য-গীত শুরু করে দিলাম । নৃত্যরত অবস্থায়ই আমাদের গাত্রবাস শিথিল হয়ে আমাদের কুচযুগল অনাবৃত হল । ক্রুদ্ধ হয়ে মুনি তখন আমাদের বদরী গাছ হবার অভিশাপ দিলেন ।
অভিশাপ পেয়ে আমরা মুনির চরণে ক্ষমা প্রার্থনা করে বললাম - "আমরা দেবরাজ ইন্দ্রের আজ্ঞাবাহী দাসী বই কিছুই নই ।" আমাদের আত্ম-সমর্পিত ভাব দেখে মুনিবর তুষ্ট হলেন এবং বললেন ভরত মুনির সংস্পর্শেই আমাদের শাপমুক্তি হবে । আমরা পূর্ব জন্মের কথা স্মরণ করতে সক্ষম হব বলে তিনি আমাদের আশীর্বাদও করলেন ।
হে ভরত মহারাজ, আমরা যখন গাছ হয়ে গঙ্গাতীরে ছিলাম তখন আপনি আমাদের নীচে বিশ্রাম করেছিলেন এবং শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার চতুর্থ অধ্যায় পাঠ করেছিলেন । আপনার সেই পাঠ শুনেই আমরা বৃক্ষ-জীবন থেকে মুক্ত হয়ে ভক্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছি, এবং এই জড় জগতের সকল ভোগবাসনাও হারিয়ে ফেলেছি ।
ভগবদ্গীতার চতুর্থ অধ্যায় যে পাঠ বা শ্রবণ করবে, সকল ভোগবাসনা থেকে তার মুক্তি হবে - এটাই হল এই অধ্যায়ের মাহাত্ম্য ।
_________________________________________
*Hard Copy Source:
"Padmapuran, Uttarkhanda (Bengali)" by Veda Vyas, translated by Sri Tarakanta Debasharrma, Krishnadas Shastri and Sriramdas Shastri, edited by Pandit Panchanan Tarkaratna. Bangabasi-Electro-machine edition, 1915. Published & printed by Sri Natabar Chakraborty for Bangabasi Karyalay, 38/2 Bhabanicharan Datta Street, Kolkata. First Nababharat Edition, 2013 (with identical page layout). Nababharat Publishers, 72 D, Mahatma Gandhi Road, Kolkata-700009. 1062p.
Hard Copy Reference:
"Srimadvagabadgeeta Mahatmya (Bengali)" compiled by Sri Sanatangopal Das Brahmachari. 6th Edition, 2014 (First Edition 2005). Printed & published by Bhaktivedanta Book Trust, Mayapur-741313, Nadia, West Bengal, India. © 2014 by Bhaktivedanta Book Trust.
Sanskrit Source
English Translation
No comments:
Post a Comment