শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার সপ্তম অধ্যায়ের মাহাত্ম্য
(শ্রীতারাকান্ত দেবশর্মা)*
শ্রীভগবান বলিলেন
অনন্তর তোমার নিকট গীতার সপ্তমাধ্যায়মাহাত্ম্য কীর্তন করিব, যাহা শ্রবণ করিয়া তোমার কর্ণদ্বয় সুধাপূর্ণ হইবে । ১
পাটলিপুত্র নামে উত্তুঙ্গ গোপুরপরিবৃত এক দুর্গ আছে, তথায় শঙ্কুকর্ণ নামে এক জনৈক দয়ার্ণব দ্বিজ বাস করেন । ২
তিনি বৈশ্যবৃত্তি অবলম্বন করিয়া বহু ধন অর্জন করিয়াছিলেন । শঙ্কুকর্ণ পিতৃতর্পণ বা দেবপূজা করিতেন না । ৩
তিনি ধনার্জনের সুযোগ করিবার জন্য রাজাদিগকেই স্বীয় গৃহে ভোজন করাইতেন । ৪
শঙ্কুকর্ণ চতুর্থবার শুভদারপরিগ্রহের জন্য নিজ পুত্র ও বন্ধুগণ সহ একদা প্রস্থান করিলেন । তিনি যাইতে যাইতে নিদাঘ নিশায়, নিদ্রাক্রান্ত হইয়া শয়ন করিলে কোথা হইতে এক সর্প আসিয়া তাহার বাহুমূলে দংশন করিল । দষ্টমাত্রেই তাঁহার আত্মা নিশ্চেষ্ট হইল, মণিমন্ত্রমহৌষধে কোন কার্য্য হইল না, কিয়ৎকালান্তে তিনি পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হইলেন । ৪-৬
অনন্তর তাহার পুত্রেরা পিচুমর্দল ও ডাল দ্বারা তদীয় দেহ অবগুণ্ঠিত করিয়া তরুস্কন্ধে আরোপণপূর্বক গৃহে আগমন করিল । ৭-৮
অতঃপর বহুকাল পরে শঙ্কুকর্ণ সরীসৃপ হইয়া জন্মগ্রহণ করিল । তনুত্যাগকালে তাহার হৃদয়ে যে বাসনা নিবদ্ধ ছিল, এ জন্মেও তাহা স্মরণ হইতে লাগিল । সরীসৃপ ভাবিল, - গৃহের বহির্ভাগে যেস্থানে আমার কোটিসংখ্যক ধন স্থাপিত রহিয়াছে, আমি আমার পূর্বজন্মের আত্মজগণকে বঞ্চিত করিয়া এখানে তাহা আনয়ন করিব । ৮-১০
এদিকে তদীয় তনয়গণ পরম শ্রদ্ধান্বিত হইয়া প্রেত পিতার উদ্দেশে নারায়ণ-বলি প্রদান করিল । ১০
অনন্তর একদা সর্পজন্মপীড়িত পিতা সুতগণের স্বপ্নপথে পতিত হইয়া তাহাদের সম্মুখে মনোবৃত্তি জ্ঞাপন করিল । পুত্রেরা পরদিন প্রভাতে গাত্রোত্থান করিয়া বিস্ময়ে বিমোহিত হইল, তাহারা পরস্পর স্বপ্নবিবরণ বলাবলি করিয়া তাহাদের কর্তব্য স্থির করিল । ১১-১২
সেই সকল নিরঙ্কুশ কুমারগণের মধ্যে পিতৃস্নেহ নিবন্ধন কোন পুত্র পিতার উদ্ধার ইচ্ছা করিল, অন্য কেহ ধনলোভে তাহাকে নিহত করিতে চেষ্টা করিল, পিতৃস্নেহরসে মোহিতমানস অপর কেহ সেই সর্পকে সাক্ষাৎ পিতা মনে করিয়া শোকে কেবল রোদন করিতে লাগিল । ১৩-১৫
কিন্তু তন্মধ্য হইতে মধ্যমপুত্র সহোদরগণকে বঞ্চিত করিয়া কোন এক ছলে নিজালয়ে গমন করিল । গৃহে গিয়া গুণশালিনী গৃহিণীকে ডাকিয়া লইয়া এবং স্বয়ং কুদ্দাল করে লইয়া সর্পরূপী পিতার আবাসস্থানে উপস্থিত হইল । কোন্ স্থানে ধন অবস্থিত, সে তাহা জানিত না, ক্রমে বল্মীকস্তূপ-চিহ্নে তাহা তত্ত্বতঃ নিশ্চয় করিয়া লইল । অনন্তর লোভবুদ্ধি মধ্যম পুত্র স্তূপস্থানে উপস্থিত হইয়া সর্পের বধার্থ কুদ্দাল দ্বারা স্বয়ং বাল্মীক খননে প্রবৃত্ত হইল । তাহার পত্নী সেই মৃত্তিকা তুলিয়া লইয়া অন্যত্র ফেলাইয়া দিতে লাগিল । ১৫-১৮
অনন্তর নিখন্যমান সেই বাল্মীক হইতে এক অত্যুগ্র অহি উত্থিত হইল, তাহার বদন হইতে অতিদুঃসহ গণ্ডূষ গণ্ডূষ গরল নির্গত হইতে লাগিল এবং সেই ফণী ফুৎকারমারুত দ্বারা বক্ষ্যমাণ বাক্য সকল বলিতে লাগিল । ১৯-২০
অহি কহিল
তুমি কে ? কি জন্য এখানে আসিয়াছ ? কেনবা গর্ত খনন করিতেছ ? হে মূঢ় ! কে তোমাকে পাঠাইয়াছে ? তাহা আমার নিকট বল ? ২১
পুত্র কহিল
আমি আপনার পুত্র, আমার নাম শিব, রজনীযীগে স্বপ্নদঈশনে বিস্মিত হইয়াছিলাম, তাই ধনগ্রহণে কৌতুকী হইয়া এখানে আগমন করিয়াছি । ২২
মহাদেব বলিলেন
ফণী পুত্রের এই লোকবিগর্হিত বাণী শ্রবণে উচ্চশ্বাস পরিত্যাগ করত স্পষ্ট বাক্যে বলিতে আরম্ভ করিল । ২৩
সর্প কহিল
আমি পূর্বজন্মের কর্মবশে সর্প হইয়াছি, যদি তুমি আমার পুত্র হও, তবে আমার বন্ধন হইতে সত্বর আমাকে পরিত্রাণ কর । ২৪
পুত্র কহিল
আমি সকলকে পরিত্যাগ করিয়া রজনীতে এখানে আগমন করিয়াছি, কি করিলে আপনার মুক্তি হইবে ? তাহা আমার নিকট ব্যক্ত করুন । ২৫
পিতা বলিলেন
গীতার অমৃতময় সপ্তমাধ্যায় ব্যতীত তীর্থ, দান, তপস্যা কিংবা যজ্ঞও আমাকে উদ্ধার করিতে সর্বথা সমর্থ নহে । হে পুত্র ! একমাত্র ঐ গীতাধ্যায় জীবের জরা ও মৃত্যুক্লেশ নিরাকরণের কারণ । হে পুত্র ! আমার শ্রাদ্ধদিনে গীতার সপ্তমাধ্যায়পাঠকারী দ্বিজকে শ্রদ্ধার সহিত ভোজন করাইবে, তবেই আমার নিঃসমগশয় মুক্তি হইবে । হে বৎস ! অন্যান্য বেদবেদাঙ্গপারগ বপ্রগণকেও পরম শ্রদ্ধাসহকারে যথাশক্তি ভোজন করাইও । ২৯
অনন্তর পুত্রগণ শ্রদ্ধাসহকারে ভুজগযোনিজাত জনকের এবংবিধ বাক্য শ্রবণ করিয়া তিনি যাহা আদেশ করিয়াছিলেন, তদপেক্ষা অধিক কার্য্য করিল । ৩০
অনন্তর শঙ্কুকর্ণ সর্পদেহ পরিত্যাগ করিয়া শ্রীমান হইলেন, তিনি পুত্রগণকে সেই বিত্ত বিভাগ করিয়া দিয়া দিব্যদেহ আশ্রয় করিলেন । ৩১
পিতা যে কোটিসংখ্যক ধন বিভাগ করিয়া দিয়াছিলেন, পুত্রগণ তাহা দ্বারা পরমানন্দ প্রাপ্ত হইল । সেই সাধুবৃত্তি ধার্মিক পুত্র সকল বাপী, কূপ, সরোবর, যজ্ঞ ও প্রাসাদপ্রতিষ্ঠা প্রভৃতি কার্য্যে বহু ধন ব্যয় করিয়া বহু অন্নশালা নির্মাণ করিয়া দিল । ৩২-৩৩
তাহারা উক্ত ষড়্বিধ কার্য্য ইষ্টতম জানিয়া নির্বাণে দৃষ্টিনিক্ষেপ করিল এবং সপ্তমাধ্যায় পাঠ করিতে করিতে মুক্তিভাগী হইল । ৩৪
[পদ্মপুরাণ, উত্তর খণ্ড, ১৮১ অধ্যায়]
_________________________________________
চলিত বাংলায় সারাংশ
একদা পাটলিপুত্র শহরে শঙ্কুকর্ণ নামে এক ব্রাহ্মণ বাস করত । সে ব্রাহ্মণ ধর্ম ত্যাগ করে ব্যবসা করে প্রভূত সম্পত্তি করেছিল । সে এত ধনী হয়েছিল যে রাজাও তার গৃহে ভোজন করতেন । কিন্তু কৃপণ শঙ্কুকর্ণ তার সঞ্চিত অর্থ কোন ভাল কাজে ব্যবহার না করে মাটির নীচে পুঁতে রেখেছিল ।
চতুর্থবার বিবাহের অভিপ্রায়ে যাত্রার সময় এক স্থানে রাতে বিশ্রাম নেওয়ার সময় সর্পদংশনে তার মৃত্যু হয় । মৃত্যুর পর সে একটি প্রেত-সর্প হয়ে তার পুঁতে রাখা গুপ্তধন পাহারা দিত । পাহারা দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে একদিন রাত্রিতে স্বপ্নে তার ছেলেদের দেখা দিয়ে তাকে উদ্ধার করতে বলল । পরদিন সকালে তার ছেলেরা পরস্পর সেই স্বপ্ন বৃত্তান্ত বলাবলি করল । এক লোভী ছেলে কোদাল নিয়ে গুপ্তধনের আশায় খুঁজতে খুঁজতে সাপের গর্তটিকে খুঁড়তে শুরু করল । অচিরেই এক ভয়ঙ্কর সর্প বেরিয়ে এসে বলল, "হে মূর্খ, কে তুমি ? কেন এখানে খুঁড়ছ ?"
পুত্রটি বলল, "আমি তোমার ছেলে । গতরাতে আমি স্বপ্নে দেখেছি এখানেই গুপ্তধন পোঁতা আছে । তাই আমি সেগুলি নিতে এসেছি ।" ছেলের কথা শুনে প্রেত-সর্পটি হাসতে লাগল । পরে বলল, "তুমি যদি আমার ছেলে, তবে কেন আমাকে উদ্ধার করতে এতদিন কোন প্রয়োজনীয় শাস্ত্রীয় আচার-অনুষ্ঠান করনি ?" শেষ জীবনে লোভের বশেই আমি এই সাপের শরীর পেয়েছি, আর তোমরাও সেই একই দিকে অগ্রসর হচ্ছ ।"
পুত্র জিজ্ঞাসা করল, "হে পিতা, কৃপা করে বলুন, কিভাবে আপনি এই নারকীয় অবস্থা থেকে উদ্ধার পাবেন ?" প্রেত-সর্পটি উত্তর করল, "শুধু ভগবদ্গীতার সপ্তম অধ্যায় পাঠ করলেই আমি জন্ম-মৃত্যুর চক্র থেকে উদ্ধার পাব । হে প্রিয় পুত্র, দয়া করে আমার শ্রাদ্ধ-শান্তি কর এবং সেদিন ভগবদ্গীতার সপ্তম অধ্যায় পাঠে অভ্যস্ত এক ব্রাহ্মণকে নিমন্ত্রণ করে পেট পুরে অতি উত্তম খাদ্য খাইয়ে দাও ।"
অন্যান্য ভাইদের সাথে সে পুত্র পিতার নির্দেশ পালন করল এবং ব্রাহ্মণের শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার সপ্তম অধ্যায় পাঠের সাথে সাথে শঙ্কুকর্ণ প্রেত-সর্পের ভয়ঙ্কর দেহ ত্যাগ করে এক দিব্য চতুর্ভুজ মূর্তি ধারণ করল । সে তার পুত্রদের আশীর্বাদ করে গুপ্তধনের সন্ধান দিয়ে বৈকুণ্ঠে চলে গেল ।
তার পুত্ররা সেই সঞ্চিত ধন মন্দির নির্মাণে, কূপ খননে এবং খাদ্য বিতরণে ব্যয় করল । প্রতিদিন তারা শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার সপ্তম অধ্যায় পাঠে মগ্ন হল এবং অচিরেই ভগবান বিষ্ণুর শ্রীপাদপদ্ম লাভ করলেন ।
অতএব যে ব্যক্তি এই বর্ণনা শুনবে সমস্ত পাপপূর্ণ প্রতিক্রিয়া থেকে সে মুক্ত হবে ।
_________________________________________
*Hard Copy Source:
"Padmapuran, Uttarkhanda (Bengali)" by Veda Vyas, translated by Sri Tarakanta Debasharrma, Krishnadas Shastri and Sriramdas Shastri, edited by Pandit Panchanan Tarkaratna. Bangabasi-Electro-machine edition, 1915. Published & printed by Sri Natabar Chakraborty for Bangabasi Karyalay, 38/2 Bhabanicharan Datta Street, Kolkata. First Nababharat Edition, 2013 (with identical page layout). Nababharat Publishers, 72 D, Mahatma Gandhi Road, Kolkata-700009. 1062p.
Hard Copy Reference:
"Srimadvagabadgeeta Mahatmya (Bengali)" compiled by Sri Sanatangopal Das Brahmachari. 6th Edition, 2014 (First Edition 2005). Printed & published by Bhaktivedanta Book Trust, Mayapur-741313, Nadia, West Bengal, India. © 2014 by Bhaktivedanta Book Trust.
Sanskrit Source
English Translation
No comments:
Post a Comment