শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার চতুর্দশ অধ্যায়ের মাহাত্ম্য
(শ্রীতারাকান্ত দেবশর্মা)*
মহাদেব কহিলেন
ভবানি ! ভবমুক্তির জন্য অতঃপর গীতার চতুর্দশাধ্যায় বর্ণন করিতেছি, হে সুস্মিতে ! অবধারণ কর । ১
মেদিনী মধ্যে মনোহর বিশাল কাশ্মীরমণ্ডল বিদ্যমান, উহা সরস্বতীর রাজধানী । বাগ্দেবী তত্রত্য জনগণকে ব্রহ্মলোক প্রদান করিয়া থাকেন । সেখানে হংসাসনা সাবিত্রী সরস্বতীর সেবাভিলাষিণী হইয়া হংসপক্ষপুটে কুঙ্কুম লইয়া তদীয় পাদপদ্মে নিক্ষেপ করেন তাহাতে ইহার দশদিক্ উদ্ভাসিত হয়, এবং সরস্বতীর প্রসাদে নিমেষমাত্রে তত্রত্য জনগণের দেবভাষা উন্মেষিত হইয়া থাকে । কাশ্মীরমণ্ডল এমনই কুঙ্কুমবহুল যে, প্রভাতে গৃহাঙ্গণে যে সকল কুঙ্কুমরজ পড়িয়া থাকে, তাহাতে সর্বত্র অরুণিত হইয়া যায়; এমন কি সূর্য্যচন্দ্রমণ্ডল পর্য্যন্তও অরুণিত হয় । ২-৬
এই কাশ্মীরমণ্ডলে তেজোরাশি নরেশ্বর শৌর্য্যবর্মা বাস করিতেন, তাঁহার উদ্যত উজ্জ্বল শরজালে শত্রুমণ্ডল বিখণ্ডিত হইত । তৎকালে সিংহল দ্বীপে সিংহপরাক্রম বিক্রমবেতাল নামে কলাবিদ্যানিধি জনৈক রাজা ছিলেন । নিজ নিজ রাজ্যজাত প্রচুর উপহারপরম্পরা প্রদান দ্বারা ক্রমে এই উভয় ভূপতি মধ্যে পরস্পর মৈত্রীবন্ধন হইল । ৭-৯
একদা রাজা শৌর্য্যবর্মা প্রেমবশে প্রভূত উপহার প্রদান করিয়াছিলেন, তন্মধ্যে দুইটী কুক্কুরী ছিল । রাজা বিক্রমবেতাল কুক্কুরীযুগল অবলোকন করিয়া মত্ত মাতঙ্গ, তুরঙ্গ ও মণিভুষিত চামর প্রভৃতি প্রভূত উপহার শৌর্য্যবর্মাকে প্রদান করিলেন । এক সময়ে মৃগয়াকৌতুকে উৎসুক বিক্রমবেতাল শিবিকারোহণে চারু চামর দ্বারা বীজিত হইয়া গমন করিলেন; কুক্কুরীযুগল স্বর্ণশ্রৃঙ্খলে আবদ্ধ হইয়া তাঁহার সহিত গমন করিল এবং মহাড়ম্বরে ডিণ্ডিম প্রভৃতি বাদ্য হইতে লাগিল । রাজকুমারগণও পৃথক্ পৃথক্ বাহনে বাহিত হইয়া রাজার সহিত গমন করিয়াছিলেন । ১০-১৩
তাঁহারা পরস্পর পণবদ্ধ হইয়া শশামিষের অনুসন্ধিৎসু হইলেন । তৎকালে রাজকুমারগণের মধ্যে এক মহা কোলাহল উপস্থিত হইল । রাজা সমানবয়স্ক রাজকুমারগণের মধ্যে একজনের সহিত বহুমূল্যপণে আবদ্ধ হইয়া সকৌতুকে মৃগয়াক্রীড়া করিতেছিলেন, কুক্কুরীদ্বয়ের মধ্যে একটী রাজার নিকট ও অপরটী রাজকুমারের নিকট রহিল । ১৪-১৫
তৎকালে এক শশক ঘন লতাবলীসমাকুল স্থানের দিকে অতিবেগে ধাবিত হইয়াছিল, রাজা দোলা হইতে অবতরণ করিয়া সেই শশকের পশ্চাতে তাঁহার কুক্কুরীকে ছাড়িয়া দিলেন । এদিকে রাজার প্রিয়পাত্র রাজকুমারও সেই শশকের পশ্চাতে তাঁহার কুক্কুরীকে সেই ঘনলতাকুঞ্জের উল্লেখপূর্বক পরিত্যাগ করিলেন । উহারা এমনই বিষম বেগে শশকের পশ্চাদ্ধাবন করিল যে, তাহাদের গতি লক্ষ্য হইল না । তখন শশকও এমনই বেগে ধাবিত হইয়াছিল যে বোধ হইল যেন সে আকাশেই যাইতেছে । ১৬-১৮
ক্রমে অতি শ্রমবশে শশক একটা মহাগর্তে পতিত হইল, তাই কুক্কুরী তাহাকে ধরিতে পারিল না । অনন্তর রাজার কুক্কুরী ক্রুদ্ধা হইয়া বেগে ধাবমান সেই শশককে আক্রমণ করিল, শশক ফেন বমন করিতে লাগিল । অতঃপর শশক কোনরূপে লম্ফপ্রদানপূর্বক স্খলিত গতিতে কিছুদূর গমন করিল । ইত্যবসরে যেমন রাজকুমারের কুক্কুরী আসিয়া শশকের কন্ধরদেশ কামড়াইয়া ধরিল, অমনি রাজকুমারগণ আমাদের জয় হইয়াছে বলিয়া উচ্চ চীৎকার করিয়া উঠিলেন । তাঁহাদের কোলাহলে তদীয় কুক্কুরী শঙ্কিত হইয়া পড়িল তাই শশক সেই কুক্কুরীর মুখ হইতে মুক্ত হইল, কিন্তু কুক্কুরীদংষ্ট্রাক্ষত হইতে রুধিরধারা পড়িতে লাগিল । শশক সত্বর গমনে কোন মর্মর ভূভাগে গিয়া লুকাইয়া রহিল । ঘনরোষাবিষ্টা রাজকুক্কুরী ভূভাগের গন্ধ গ্রহণ করিতে করিতে তথায় যাইয়া শশককে দেখিয়া ফেলিল । শশক কুক্কুরী কর্তৃক দৃষ্ট হইবামাত্র অতিত্রস্ত হইয়া হস্তমাত্র অগ্রসর হইল । ১৯-২৪
শশক যেখানে উপস্থিত হইল উহা বৎস নামক জনৈক জিতেন্দ্রিয় দ্বিজের আশ্রম । ঐ আশ্রম কর্পূর-কদলী-সমাকুল ও উহার সন্নিহিত পর্বতের গুহাগৃহে বরাহ ও ব্যাঘ্রগণ বাস করে । তথায় প্রফুল্ল কেতকী কুসুমের পরাগরাশি দেহে মাখিয়া এবং চোলীকপোলফলকসমূহ চুম্বন করিয়া সমীরণ প্রবাহমাণ হয় । সে স্থানে বিশুদ্ধ হরিণগণ তরুচ্ছায়ায় বিশ্রাম করে, বৃক্ষ হইতে নারিকেল ফল সকল স্বয়ং ভূতলে পতিত হয়, শাখামৃগগণ পক্ক আম্র ফল দ্বারা পরম তৃপ্তি পায়, সিংহসমূহ করিশাবকগণের সহিত ক্রীড়া করে এবং সর্প সকল ময়ূরগণের সহিত নির্ভয়ে খেলা করিয়া থাকে । এবম্ভূত আশ্রম মধ্যে থাকিয়া শান্ত দ্বিজ বৎস অহর্নিশ গীতার চতুর্দশাধ্যায় জপ করিতেন । ২৫-২৯
তথায় তদীয় শিষ্য যে জল দ্বারা পাদপদ্ম বিধৌত করিতেন সেই জলে যে স্থান কর্দমাক্ত হইয়াছিল, অল্পাবশিষ্টজীবনে শশক মুহুর্মুহু শ্বাস পরিত্যাগ করিতে করিতে গিয়া সেই কর্দমে পতিত হইল । অতঃপর শশক কর্দমসম্পর্ক মাত্র সংসার হইতে উত্তীর্ণ হইল, সে দিব্য বিমানে আরুঢ় হইয়া স্বর্গে গমন করিল । শুনীর অঙ্গেও অল্পবিস্তর কর্দম লিপ্ত হইয়াছিল, তাহাতেই তাহার ক্ষুধা ও পিপাসাপীড়া দূরীভূত হইল, সেও শুনীরূপ পরিত্যাগ করিয়া অমরনারীপরিশোভিত গন্ধর্বগণবিভিষিত দিব্য বিমানারোহণে অমরপুরে প্রস্থান করিল । ৩০-৩৩
তখন স্বকন্ধর নামক মেধাবী দ্বিজশিষ্য হাসিলেন এবং তিনি তির্য্যক্দ্বয়ের পুর্বজন্মের বৈরকারণ বিচার করিয়া বিস্মিত হইলেন । ৩৪
এই ব্যাপারে রাজারও বিস্ময়ে নয়ন প্রফুল্ল হইল । সেই অদ্বিতীয় বিনয়সাগর রাজা পরম ভক্তিভরে প্রণাম করিয়া তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন - "হে বিপ্র ! হীন শুনী ও শশকশাবক স্বর্গে গমন করিল, আমার নিকট এতদ্বিষয়ক কথা কীর্তন করুন ।" ৩৫-৩৬
শিষ্য কহিলেন
এই বনে বৎস নামক জনৈক জিতেন্দ্রিয় দ্বিজ আছেন; তিনি নিরন্তর গীতার চতুর্দশাধ্যায় জপ করেন । হে ভূপাল ! আমি তাঁহার ব্রহ্মবিদ্যাবিশারদ শিষ্য । হে নৃপ ! আমিও প্রত্যহ গীতার চতুর্দশাধ্যায় জপ করিয়া থাকি । হে ভূপতে ! আমার পাদপদ্মপ্রক্ষালিত জলে শরীর বিলুণ্ঠিত করিয়া শুনী শশকসহ স্বর্গে গমন করিয়াছে । ৩৭-৩৯
রাজা জিজ্ঞাসিলেন
হে দ্বিজোত্তম ! আপনি হাসিলেন কেন ? আমার মনে হয়, ইহার কোন কারণ থাকিবে, তাই আমি এ বিষয়ে শ্রদ্ধাযুক্ত হইয়াছি । ৪০
শিষ্য উত্তর করিলেন
মহারাষ্ট্রদেশে প্রত্যুদক নামে এক মহানগর আছে, সেখানে ধূর্তাগ্রণী কেশব নামক জনৈক দ্বিজ বাস করতেন । তাহার পত্নীর নাম বিলোভনা, বিলোভনা ব্যভিচারিণী । একদা কেশব আজন্মের বৈর বিচারপূর্বক ক্রুদ্ধ হইয়া বিলোভনাকে বধ করে এবং সেই নারীবধপাতকে কেশব শশক হইয়া জন্ম লয় । আর ব্যভিচার পাপে বিলোভনা শুনী হইয়া জন্মগ্রহণ করে । উহারা বহুধা যোন্যন্তর পরিগ্রহ করিলেও পূর্বজন্মাভ্যস্ত বৈর ভাব পরিত্যাগ করে নাই । ৪১-৪৪
অনন্তর ভূপাল বিক্রমবেতাল এই সকল শুনিয়া শ্রদ্ধান্বিত হইলেন । তিনি সমগ্র গীতা অভ্যাস করিয়া পরম গতি প্রাপ্ত হইলেন । ৪৫
[পদ্মপুরাণ, উত্তর খণ্ড, ১৮৮ অধ্যায়]
_________________________________________
চলিত বাংলায় সারাংশ
সিংহলদ্বীপে বিক্রম-বেতাল নামে এক রাজা ছিলেন । একদিন বনে মৃগয়া করার সময় এক খরগোশের পেছনে তিনি তার শিকারী কুকুরী লেলিয়ে দেন । কুকুরের তাড়া খেয়ে খরগোশটি ঊর্দ্ধশ্বাসে যেন উড়তে উড়তে এক সুন্দর, শান্ত আশ্রমে এসে পৌছল । সেখানে হরিণেরা গাছের ছায়ায় সুখে বসে আছে । ব্যাঘ্র শিশুরা হস্তিশাবকদের সাথে খেলা করছে, আর সাপেরা ময়ুরের গায়ের ওপর দিয়ে চলাফেরা করছে ।
ওই আশ্রমটি ছিল জিতেন্দ্রিয় মুনি বৎসের, যিনি অহর্নিশ গীতার চতুর্দশাধ্যায় জপ করতেন । কাছেই এক জায়গায় তার শিষ্যের নিত্য পা ধোয়ার ফলে মাটি ভিজে কাদা হয়ে গিয়েছিল । দৌড়তে দৌড়তে ক্লান্ত খরগোশটি সেই কাদায় পা পিছলে পড়ে যাওয়া মাত্র সংসার থেকে উত্তীর্ণ হল এবং তখন সে এক দিব্য বিমানে চড়ে স্বর্গে চলে গেল । মুহুর্তকাল পরে খরগোশের খোঁজে কুকুরটা সেখানে আসার পর তারও একই অবস্থা হয় ।
এসব দেখে বৎসের শিষ্যটি হাসতে লাগল । তখন বিস্মিত রাজা বিক্রম-বেতাল তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, "হে ব্রাহ্মণ, হীন যোনি, অজ্ঞান এই খরগোশ ও কুকুরী কি করে স্বর্গ লাভ করল ? আপনি হাসিলেনই বা কেন ?" উত্তরে শিষ্যটি বলল, "হে মহারাজ, মহামুনি বৎসের ব্রহ্মবিদ্যাবিশারদ শিষ্য আমি । আমার গুরুর মত আমিও প্রতিদিন গীতার চতুর্দশাধ্যায় জপ করে থাকি । আমার পা ধোয়ার জলে ভিজে যাওয়া মাটির স্পর্শে ওই খরগোশ ও কুকুরী স্বর্গ লাভ করেছে ।"
শিষ্যটি আরো বলল, "একদা মহারাষ্ট্রের প্রতুধক শহরে কেশব নামে এক ব্রাহ্মণ ছিল । তার পত্নীর নাম ছিল বিলোভনা । বিলোভনা ব্যভিচারিণী ছিল, যার ফলে একদিন রেগে গিয়ে কেশব তাকে হত্যা করে । নারীবধ পাপের ফলে কেশব পরজন্মে খরগোশ হল, আর ব্যভিচার পাপের ফলে বিলোভনা পরজন্মে কুকুরী হল । আমি এই ভেবেই হাসছি যে পূর্বজন্মের শত্রুতা এরা পরের জন্মেও বজায় রেখেছিল ।"
গীতার চতুর্দশাধ্যায়ের এই মাহাত্ম্য শুনে রাজাও তখন তা অভ্যাস করা শুরু করলেন এবং অচিরেই পরম গতি প্রাপ্ত হলেন ।
_________________________________________
*Hard Copy Source:
"Padmapuran, Uttarkhanda (Bengali)" by Veda Vyas, translated by Sri Tarakanta Debasharrma, Krishnadas Shastri and Sriramdas Shastri, edited by Pandit Panchanan Tarkaratna. Bangabasi-Electro-machine edition, 1915. Published & printed by Sri Natabar Chakraborty for Bangabasi Karyalay, 38/2 Bhabanicharan Datta Street, Kolkata. First Nababharat Edition, 2013 (with identical page layout). Nababharat Publishers, 72 D, Mahatma Gandhi Road, Kolkata-700009. 1062p.
Hard Copy Reference:
"Srimadvagabadgeeta Mahatmya (Bengali)" compiled by Sri Sanatangopal Das Brahmachari. 6th Edition, 2014 (First Edition 2005). Printed & published by Bhaktivedanta Book Trust, Mayapur-741313, Nadia, West Bengal, India. © 2014 by Bhaktivedanta Book Trust.
Sanskrit Source
English Translation
No comments:
Post a Comment