Monday, August 17, 2015

শ্রীশ্রীগীতামাহাত্ম্যম্‌ (Padmapuran-10)


শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার দশম অধ্যায়ের মাহাত্ম্য

(শ্রীতারাকান্ত দেবশর্মা)*

দেবী বলিলেন
হে সর্বেশ্বর ! আপনি সর্বজ্ঞ, সকলের চৈতন্য এবং বাক্যগুরু, হে শিব ! আপনি আমার মান্য; আপনাকে আপনি (আমি ?) যে দর্শন করিতে পারিতেছি, ইহাতেই আমি ধন্য ! আপনি এই যে গীতার পূত পরমাধ্যায় মাহাত্ম্য নিরূপিত করিলেন, ইহা অনেক বিস্ময়কর মধুর কথাময় । হে দেবেশ ! ইহা শ্রবণ করিয়া আমার আকাঙ্ক্ষার নিবৃত্তি হইতেছে না । হে বৃষধ্বজ ! আমার শ্রবণোৎকণ্ঠা অকুণ্ঠভাবে বর্ধিত হইতেছে । গীতা জ্ঞানের মহাসাগর, তথাপি মুনিগণ দশমাধ্যায়কে প্রধান কহিয়াছেন, তদ্বিষয়ে আমার শ্রুতিও সজীব আছে; তথাপি আপনি সেই শ্রেষ্ঠ দশমাধ্যায় উপষ্টন্ত করিয়া কথাপরম্পরা আমাকে উপদেশ করুন । ১-৫

মহাদেব বলিলেন
হে সুশ্রোণি ! শ্রবণ কর । পাবনী পরম কথা গীতাগাথা অখিল প্রভাবের সীমাস্বরূপা, স্বর্গ দুর্গারোহণের দুর্লভ সোপান ।

পূর্বে কাশী পুরীতে পুণ্যকীর্তিপরায়ণ প্রশান্তচেতা ধীরধী নামে বিখ্যাত জনৈক বিপ্র বাস করিতেন । তিনি জিতেন্দ্রিয়তাবলে নিত্য নিবৃত্তিনিরত, হিংসা কার্কশ্য ও সাহসাদি দোষে নির্যূক্ত, নন্দী যেরূপ আমার প্রতি ভক্তিমান, তদ্রূপ আমার ভক্ত এবং সর্ব শাস্ত্রবিৎ নিগমসাগরের পারদর্শী ছিলেন । তাহার চিত্ত ধ্যানাধীন ও মন অন্তরাত্মায় নিমগ্ন থাকিত এবং তত্ত্বসমূহ চক্ষুর সমক্ষে ভাসমান হইত । একদা দ্বিজ ধ্যানাবসানে উত্থিত হইয়া কিছুদূর গমন করিলে আমি প্রীতিভরে দৌড়াইয়া গিয়া তাঁহার করে কর প্রদান করিলাম । ইহাতে তাঁহার সমাধিভঙ্গ হইল না, তিনি কিঞ্চিৎ চমৎকৃত হইয়া পুনরায় আচমনপূর্বক ঘনানন্দময় নয়নদ্বয় নাসাগ্রে ন্যস্ত করিয়া নিদ্রিতের ন্যায় অবস্থান করিতে লাগিলেন । ৬-১১

হে বিশালাক্ষি ! তৎকালে ভৃঙ্গিরিটি নামক জনৈক শিবানুচর নিশাযোগে বিশাল দ্বারদেহলী উপাধান করিয়া নিঃশঙ্ক মনে শয়ান ছিল । সে এই ব্যাপার প্রত্যক্ষ করিয়া আমার পাদ পদ্মে প্রণামপূর্বক আমাকে জিজ্ঞাসা করিল, - ১২-১৩

ভৃঙ্গিরিটি জিজ্ঞাসা করিল
এই ব্যক্তি কি করিয়া আপনার দর্শন লাভ করিল ? এই মহাত্মা এমন কি তপস্যা, হোম কিংবা জপ করিয়াছে যে, আপনি প্রতি পদে ইহাকে করাবলম্বন প্রদান করিতেছেন ? কেন এই ব্যক্তি কাশীপুরের বাহিরে যাইতে অভিলাষ করে না ? কেন যদৃচ্ছাক্রমে কাশীর সীমা লঙ্ঘন করিয়া গমন করে না ? এবং কেনই বা পার্শ্ববর্তী দেহীগণের প্রতি দৃষ্টিনিক্ষেপ করে না ? আপনি আমার প্রভু, আপনার মুখে আমি ইহার কারণ জানিতে ইচ্ছা করি । ইহা যদি আমার নিকট বলার উপযুক্ত হয়; আর আমি যদি অনুগ্রহের পাত্র হই, তবে বলুন । ১৩-১৭

ভৃঙ্গিরিটির এই প্রশ্ন শ্রবণ করিয়া আমি উত্তর করিলাম
আমি একদা কৈলাসের পুন্নগকাননে অবস্থান করিতেছিলাম । এ কাননে খেচরকামিনীগণ নৃত্য করিতেছিল, কানন কুসুমস্তবকে পূর্ণ ছিল । কাননের নানাদিক্‌ কলকণ্ঠ, কোকিলকুলের কলালাপে সমাকুল এবং গরুত্মান্‌ ও দাত্যূহসমূহের সুমধুর স্বরে মুখরিত হইয়াছিল । উহাতে যে তত্রত্য দারুময় ঘটীযন্ত্র হইতে জলবিন্দু সকল উহার নানা স্থানে নিক্ষিপ্ত হইতেছিল । এবং কাননের প্রান্তস্থিত ললিত কদলীকন্দনিচয় কাননের সীমা জ্ঞাপন করিয়া দিত । ঐ কাননে কস্তূরী-হরিণ বিচরণ করিত, কিন্নরগণের মোহনস্বর সমুত্থিত হইত এবং উহার কোন কোন স্থান রোমন্থকালীন মন্থরাপাঙ্গ মৃগগণের সেব্য হইত । ঐ শুকসঙ্কুল কাননে হংসগণ শোভন গতি বিলাসাদি দ্বারা শুক সমাজে পাণ্ডিত্য প্রদর্শন করিত, অনিল দ্বারা বিলোড়িত হইয়া তরুরন্ধ্র হইতে আহ্লাদজনক শব্দ সমুত্থিত হইত । মধুকরেরা মাধবী পুষ্পের নির্য্যাস-সীধু পান করিয়া মত্ত হইত, উন্মীলিত ত্রিবলী পুষ্পগুচ্ছের সৌরভে বনভূমি আমোদিত হইয়া যাইত, ফুল্ল বকুল ফুলের কুসুমামোদে মত্ত মধুকরেরা মন্থরগতিতে পুষ্পে পতিত হইত । এবংবিধ কাননমধ্যে সুধাকরসমুদভূত অমৃত দ্বারা ক্ষালিত ক্ষিতিতলে এক বেদীতে অধ্যাসীন হইয়া আমি ক্ষণকালের জন্য অবস্থিত ছিলাম । ১৭-২৫

তৎকালে ঊর্দ্ধমুখ মহাশাখিসমূহের এক মহাসংঘর্ষ উপস্থিত হইল, তাহাদের উদ্গত শাখাসমূহ ভাঙ্গিয়া পড়িতে লাগিল । অচল সকল চঞ্চল হইল, প্রচণ্ড পবন বহিতে লাগিল । ইহার পরেই গিরিগুহা বিঘোষিত করিয়া এক মহাশব্দ উত্থিত হইল । অতঃপর গগনগহ্বর হইতে এক পক্ষী অবতরণ করিল । ঐ পক্ষী শারদ নীরদনিভ, কিম্বা যেন অঞ্জনপুঞ্জ । তমোরাশিসম ঐ পক্ষী ছিন্নপক্ষ পর্বতের ন্যায় পতিত হইল এবং পদদ্বয় দ্বারা ক্ষিতি অবলম্বন করিয়া আমাকে প্রণাম করিল । ঐ পক্ষী অম্লান পদ্ম আনিয়া আমার পাদদ্বয়ে প্রদান করিল এবং সুস্পষ্ট বাক্য উচ্চারণ করিয়া আমার স্তব করিতে লাগিল । ২৫-২৯

পক্ষী বলিল
হে চিদানন্দ দেব ! আপনার জয় হউক । হে সুধাসিন্ধো ! হে জগৎপ্রভো ! আপনার অনন্ত বিগ্রহ সদা সদ্‌ভাবনায় উৎফুল্ল, অদ্বৈত বাসনা বুদ্ধি দ্বারা আপনি মলত্রয়বিবর্জিত । আপনি জিতেন্দ্রিয়ের অধীন এবং সমাধি দ্বারা আপনাকে প্রাপ্ত হওয়া যায় । আপনি নিরুপাধি, বিনির্মুক্ত, নিরাকার ও নিরাময়, সীমাহীন, নিরহঙ্কার, নিরাবরণ ও নির্গুণ । হে প্রবীণ ! আপনার চরণকমল শারণাগতের ত্রাতা, আপনি ভয়ানক ভুজঙ্গমাল্য অঙ্গে ধারণ করেন এবং নয়নবহ্নিশিখা দ্বারা আপনি মদনকে দাহন করিয়াছিলেন । হে মহাবিভো ! আপনি কুঠার দ্বারা দৈত্যেন্দ্রগণকে বিদারণ করিয়া গ্রাস করেন, ত্রিপুরপ্রমদাগণের ললাটলগ্ন নিন্দূররজঃ মার্জনা করিয়া থাকেন এবং আপনি কাত্যায়নীর উত্তম কুচকমলের কুঙ্কুম দ্বারা অর্চিত হন । হে জ্ঞানরূপিন ! আপনি প্রমাণাতীত, আপনাকে নমস্কার; আপনি প্রমাণরূপা, চৈতন্যনাথ ও ত্রৈলক্যরূপী, আপনাকে নমস্কার । শ্রেষ্ঠ যোগিজন আপনার যে চরণাম্বূজ চুম্বন করেন এবং যাহা অপার ভব পারাবারের অদ্ভুত তরণোপায়, আমি আপনার সেই পদারবিন্দের বন্দনা করি । আপনার স্তব করিতে বাচস্পতিও অক্ষম । সহস্রবদন নাগবর বাসুকিরও চাতুরী চলে না; আর হে মহাদেব ! কোথায় আমার মত অল্পমতি পক্ষী তোমার স্তবে প্রবৃত্ত ! ২৯-৩৮

আমি সেই পতত্রিকৃত এইরূপ স্তোত্র শুনিয়া তাহাকে কহিলাম
হে বিহঙ্গম ! তুমি কে ? কোথা হইতে আসিয়াছ ? তোমার শরীর হংসসদৃশ, বর্ণ কাককান্তি, তুমি কি উদ্দেশ্যে এখানে আসিয়াছ ? তাহা বল । ৩৮-৪০

বাগ্‌বিশারদ বিহঙ্গম এইরূপে মৎকর্তৃক অভিহিত হইয়া বিনয়াবনত মস্তকে মৃদুবাক্যে বলিল
হে দেবেশ ধূর্জটে ! আমাকে স্বায়ম্ভুর ব্রহ্মার হংস বলিয়া বিদিত হউন; হে বিভো ! আমি যে কর্ম করিয়া সম্প্রতি কৃষ্ণতা প্রাপ্ত হইয়াছি, যদি জিজ্ঞাসা করিলেন, তবে বলিতেছি, শ্রবণ করুন । ৪১-৪২

আমি মানস সরোবর হইতে পৃথিবীতে আসিয়া এইরূপ সঙ্কট প্রাপ্ত হইয়াছি । আমি সৌরাষ্ট্র নগরের সমীপস্থ কোন সরোবরে আগমন করিয়াছিলাম, এ সরোবরে বালশশাঙ্ক ও শঙ্খের ন্যয় ধবল বহু কমল প্রস্ফুটিত হইয়াছিল ।  আমি বলপূর্বক ঐ সকল কমল লইয়া সত্বর আকাশপথে উড্ডীন হইয়াছিলাম, তার পর আমি সহসা আকাশ হইতে ভূতলে পতিত হইলাম । অনন্তর আমি নিরতিশয় মোহাচ্ছন্ন ও বিকলেন্দ্রিয় হইলাম, মোহহেতু আমার দেহ কম্পিত হইতে লাগিল । অতঃপর শীতল সমীরণ সংস্পর্শে আমার চৈতন্য হইল, আমি আমার পতনের হেতু বুঝিতে পারিলাম না । তারপর আমি মনে আলোচনা করিলাম - অহো ! আজ আমার এ কি বিপদ্‌ উপস্থিত হইল, আমি কেন পতিত হইলাম, আমার পক্ককর্পুরধবলকায় কেন কালিমা প্রাপ্ত হইল ? আমি যেমন এইরূপ আলোচনা করিয়া বিস্ময়াবিষ্ট হৃদয়ে বিচরণ করিতে লাগিলাম । ৪৩-৪৮

অমনি সেই সরোবর হইতে উত্থিত বক্ষ্যমাণ বাণী শ্রবণ করিলাম - হে হংস ! উত্থিত হও, তোমার পতন ও কৃষ্ণতাপ্রাপ্তির কারণ বলিতেছি । ৪৯

অনন্তর আমি উত্থিত হইয়া আগমন করিলাম, দেখিলাম, সরোবরের মধ্যস্থানে পঞ্চপদ্মযুতা এক রম্যা পদ্মিনী বিদ্যমান । আমি তাঁহাকে আমার পতন ও কৃষ্ণতাপ্রাপ্তির কারণ জিজ্ঞাসা করিলাম । অনন্তর আমি অন্তরীক্ষে অনেক পুরুষবিগ্রহ সন্দর্শন করিলাম, তাঁহাদের সংখ্যা ছয় অযুত । তাঁহারা ঘনশ্যাম, স্বর্ণবর্ণবসনাবৃত, চতুর্ভুজ, শঙ্খ চক্র গদা ও পদ্মায়ুধ দ্বারা বিচিত্রকান্তি কিরীট হার কেয়ুর ও কুণ্ডলমণ্ডিত । সেই পঞ্চপদ্মযুতা সরোজিনীকে প্রণাম ও প্রদক্ষিণ করিয়া আমার স্বীয় পতন হইতে সমস্ত বৃত্তান্ত জিজ্ঞাসা করিলাম । ৫০-৫৩

পদ্মিনী বলিলেন
হে কলহংস ! তুমি আমাকে লঙ্ঘন করিয়া আকাশপথে গমন করিয়াছিলে, সেই পাতকবশে মহীতলে পতিত হইয়াছ; আর হে পক্ষিরাজ ! সেই পাতকেই তোমার কায় কৃষ্ণতা প্রাপ্ত হইয়াছে । তোমাকে পতিত দেখিয়া আমার হৃদয় দয়াপূর্ণ হইয়াছে, তাই আমি সরোবরের মধ্য-পদ্মে অধ্যুষিত হইয়া তোমায় বলিতেছি । এই পদ্মের সৌরভ আঘ্রাণ করিয়া ষষ্টিসহস্র ভ্রমর স্বর্গে গমন করিয়াছে; আর এই যে তুমি নীলোৎপলতুল্য দ্যুতিশালী লোক সকল অবলোকন করিতেছ ইহাঁরা ইহাঁদের সাত জন্ম পূর্বে মুনিপুত্র ছিলেন এবং এই সরোবরের তীরে সুমহা তপস্যা করেন । ৫৪-৫৮

একদা এক কামিনী এই তপোবন-কাননে আগমন করে, সেই কামিনী চম্পক কুসুমের স্তবক দ্বারা স্তনশোভা বিস্তার করিয়াছিল, এবং চঞ্চল অপাঙ্গনিক্ষেপে অঙ্গকান্তির তরঙ্গপরম্পরা দ্বারা কামরসে অলসতা প্রাপ্ত হইয়াছিল, তাহার নাসিকায় শ্বেতকান্তি মুক্তাফল সংসক্ত ছিল, সেই মুক্তাফলের জ্যোৎস্না তদীয় সহজ স্মিতসংসক্ত হইয়া তাহার অধরোষ্ঠ চুম্বন করিতেছিল । কামিনী কুচদ্বয়ে বীণা বিন্যস্ত করিয়া এই বনে মধুর গান করিল । কামিনীর গান শ্রবণে ঐ মুনিতনয়গণ হরিণের ন্যায় তাহার নিকট উপস্থিত হইয়া সকলেই এককালে তাহাকে দর্শন করিলেন এবং পরস্পর বলাবলি করিতে লাগিলেন - "এই কান্তা আমি প্রথমে দেখিয়াছি, অতএব এ কন্যা আমার হইবে ।" এইরূপ বলাবলির পর সেই ভ্রাতৃগণ মুষ্ট্যামুষ্টি দ্বারা বিষম্‌ রণে প্রবৃত্ত হইলেন, পরস্পর মুষ্টিপ্রহারে তাঁহাদের বক্ষ নিষ্পিষ্ট হইল । তাঁহারা প্রাণ ত্যাগ করিলেন । ৫৯-৬৩

অতঃপর তাঁহারা অনেক ঘোর নরক ভোগান্তে ভূতলে এই সরোবরে সারস হইয়া জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন; তাঁহারা এই সারস জন্মে শ্বাপদ জন্তুগণকে সংহার করিয়া ভক্ষণ করিতেন । পরে বন্যবহ্নি দ্বারা দগ্ধ হইয়া প্রাণত্যাগ করিলেন । ৬৩-৬৪

অনন্তর মাতঙ্গ হইয়া জন্মগ্রহণপূর্বক পান্থগণের প্রাণান্ত করিতেন । তারপর এই বনে বিষজল পান করিয়া যমমন্দিরে গমন করেন । ৬৪-৬৫

অনন্তর তাঁহারা ক্রমে গর্দভ, উষ্ট্র, বানর ও মার্জারাদি জন্মগ্রহণ করেন । তারপর এই সরোবরের মধুকর হইয়া জন্মিলেন এবং আজ আমার গন্ধ আঘ্রাণ করিয়া তাঁহারা বৈষ্ণব পদ প্রাপ্ত হইয়াছেন । ৬৫-৬৬

হে পক্ষিরাজ ! আমার ঐশ্বর্য্যের কথা আরও কিছু বলিতেছি, শ্রবণ কর । আমার এই জন্মের পূর্ববর্তী তৃতীয় জন্মে আমি ক্ষিতিতলে জনৈক দ্বিজের পত্নী হইয়াছিলাম, আমার নাম ছিল সরোজবদনা । আমি একমাত্র পাতিব্রত্যপরায়ণা ও গুরুশুশ্রূমারত ছিলাম । একদা আমি এক সারিকাকে বিলম্বিত ভাবে পাঠ করাইতেছিলাম, ইহাতে আমার পতি কুপিত হইয়া আমাকে অভিশাপ প্রদান করিলেন, বলিলেন - রে পাপী ! তুই সারিকা হইবি । ৬৭-৬৯

অতঃপর আমি পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হইয়া সারিকা হইলাম, কিন্তু পূর্বজন্মের পাতিব্রত্যপ্রভাবে আমি মুনিসদনের সারিকা হইয়াছিলাম; কোন এক মুনিকন্যা আমাকে পালন করিতেন । আমার পালক বিপ্র প্রভাতে গীতার দশমাধ্যায় পাঠ করিতেন, আমি সেই গীতার পাপহর বিভূতিযোগ শ্রবণ করিতাম । ৭০-৭১

হে বিহঙ্গম ! আমি কালে সেই সারিকাকলেবর পরিত্যাগ করিয়া গীতার দশমাধ্যায়-শ্রবণমাহাত্ম্যে স্বর্গের অপ্সরা হইয়াছিলাম । আমি পদ্মার প্রিয় সখী পদ্মাবতী নামে বিখ্যাতা ছিলাম । আমি একদা বিমানারোহণে আকাশপথে যাইতে যাইতে এই বিমল কমলমণ্ডিত রম্য সরোবর দর্শন করিয়া যেমন অবতরণপূর্বক জলক্রীড়ায় প্রবৃত্ত হইলাম, অমনি তথায় ঋষি দুর্বাসা সমাগত হইলেন । তিনি আমাকে বিবসনা অবলোকন করিলেন, আমি তাঁহার ভয়ে এই সরোবরে পদ্মিনীরূপ ধারণ করিলাম । দুই হস্ত দ্বারা দুইটী, পাদদ্বয়ে দুইটী ও মুখদ্বারা একটী এই পাঁচটী পদ্ম ধারণ করিয়া আমি পঞ্চপদ্মযুক্তা হইলাম । আমাকে বিবসনা দেখিয়া কোপে মুনিবর দুর্বাসার লোচনযুগল জ্বলিয়া উঠিল, তিনি বলিলেন, - "রে পাপে ! এই বেশে শতবর্ষ এইখানে অবস্থান কর্‌ ।" ঋষি এইরূপ শাপ প্রদান করিয়া ক্ষণকাল মধ্যে অন্তর্ধান করিলেন । ৭২-৭৮

আমি গীতার বিভূতিযোগাধ্যায় শ্রবণ করিয়াছিলাম, তাই আমার পূর্বস্মৃতি বিলুপ্ত হয় নাই । তুমি আমাকে লঙ্ঘন করিবামাত্র ভূতলে পতিত হইয়াছ, হে খগোত্তম ! অদ্য তোমার সমক্ষে আমার শাপনিবৃত্তি হইবে, আমি গীতার উত্তম দশমাধ্যায় কীর্তন করিতেছি, তুমি শ্রবণ কর । ইহা শ্রবণমাত্রে তুমিও আজ মোক্ষ লাভ করিবে । ৭৮-৮০

পদ্মিনী এইরূপ কহিয়া মনোজ্ঞ বাক্যে গীতার দশমাধ্যায় পাঠ করিল । আমি তাহা শ্রবণ করিয়া ও পদ্মিনীপ্রদত্ত পদ্ম লইয়া আসিয়া আপনাকে অর্পণ করিলাম । এইরূপ কহিয়া খগবর কলেবর পরিত্যাগ করিল, এই বৃত্তান্ত যেন এক অদ্ভুত ব্যাপারবৎ প্রতিভাত হইল । ৮১-৮২

ভৃঙ্গিরিটি জিজ্ঞাসা করিল
এই পক্ষিরাজ পূর্বজন্মে কি ছিল ? কি করিয়া ব্রহ্মার হংস হইল ? আপনার সমীপেই বা কেন প্রাণ পরিত্যাগ করিল ? ৮৩

তখন ভৃঙ্গিরিটির এই বাক্য শুনিয়া আমি (মহাদেব) উত্তর করিলাম
এই খগরাজ পূর্বজন্মে এক দ্বিজের গৃহে জন্ম লইয়াছিল, ইহার নাম ছিল সুতপা । জিতেন্দ্রিয় ব্রহ্মচারী সুতপা গুরুকুলে বাস করিয়া প্রতিদিন বেদাধ্যয়ন ও ভক্তিপূর্বক গুরুর শুশ্রূষা করিত । সুতপা একদা নিদ্রিত অবস্থায় পাদদ্বারা গুরুর শয্যা স্পর্শ করিয়াছিল, গুরুও সেই শয্যায়ই শয়ান ছিলেন । সেই পাপে সুতপা তির্য্যক্‌যোনি প্রাপ্ত হইল, কিন্তু গুরু-শুশ্রূষাদি কার্য্যের জন্য তাহার স্বর্গে স্থান লাভ ঘটিল । ঐ দ্বিজ পদ্মযোনির হংসমধ্যে জন্মগ্রহণ করিল । এই খগবরের স্বর্গে জন্ম, এখানে মাদৃশ দেবলোকের দর্শন লাভ এবং তারপর পদ্মিনীর মুখে গীতাধ্যায়শ্রবণ - এই সব কারণে অনুত্তম ব্রহ্মজ্ঞান হইয়াছিল । তাই এই খগরাজ পরজন্মে গীতার দশমাধ্যায়মাহাত্ম্যে বিপ্রকুলে জন্মিয়াছে । ৮৪-৮৯

এই দ্বিজ শিশু হইলেও জন্মাভ্যাসবশে ইহার মুখে সর্বদা গীতাধ্যায় সমুল্লসিত হয়; আর তাহারই পরিণাম ফলে এই দ্বিজ সর্বভূতস্থ শঙ্খচক্রধর দেব বিষ্ণুকে সর্বদা দর্শন করে । যে যে সময়ে এই দ্বিজের স্নিগ্ধ দৃষ্টি যাহার যাহার প্রতি পতিত হয়, সুরাপী বা ব্রহ্মঘাতী হইলেও সেই সেই ব্যক্তি মুক্তিলাভ করে । আমি সকলের পরমাত্মস্বরূপ, তাই বিপ্রকে ঐরূপ গুণাবিশিষ্ট জানিয়া এই কাশীপুরীতে আনয়ন করিয়াছি । এই ক্ষেত্র স্বভাবতঃ মুক্তিদ, অত্রত্য মানবগণের মুক্তি করতলস্থ; পরন্তু এই দ্বিজের দৃষ্টিপাতেও অন্য জন্ম হয় না, এইজন্য - ইহাঁর দৃষ্টিতে সাধারণ পাপী মাত্রই মুক্ত হইতে পারে, আর তাদৃশ সম্ভাবনা থাকিলে মুক্তিক্ষেত্রনিচয়ের মাহাত্ম্য লুপ্ত হইতে পারে বলিয়া মুক্তিক্ষেত্র সকলের মাহাত্ম্য রক্ষণার্থ - ইঁহাকে আমি নগর পরিত্যাগ করিয়া বাহিরে যাইতে দিই না । ৮৯-৯৫

এই বিপ্র পূর্বে গীতার দশমাধ্যায়মাহাত্ম্য পাঠ করিয়া সুদুর্লভ তত্ত্বজ্ঞান লাভ করিয়াছিল তাই এক্ষণে এইরূপ জীবন্মুক্তি প্রাপ্ত হইয়াছে । এইজন্য ইহাঁর গমন সময়ে পথমধ্যে আমি হস্ত ধারণ করিয়া থাকি । হে ভৃঙ্গিরিটে ! গীতার দশমাধ্যায় এইরূপ মাহাত্ম্যপূর্ণ । ৯৫-৯৭

এই কথাপরম্পরা ভৃঙ্গিরিটির নিকট যেরূপ কহিয়াছিলাম, সম্প্রতি সেই সর্বপাপপ্রণাশিনী কথা তোমার সমীপে বর্ণন করিলাম । নর অথবা নারী যে কেহ ইহা শ্রবণ করে, তাহার সর্বাশ্রম সেবার ফললাভ হয় । ৯৭-৯৯

[পদ্মপুরাণ, উত্তর খণ্ড, ১৮৪ অধ্যায়]
_________________________________________

চলিত বাংলায় সারাংশ


দেবাদিদেব শিব বললেন -
প্রিয়ে পার্বতী, শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার দশম অধ্যায়ের মাহাত্ম্য এবার তোমাকে বলব । কাশীপুরীতে আমার বাহন নন্দীর মতো ধীরবুদ্ধি নামে এক ব্রাহ্মণ ছিল । সে সর্বদাই শান্তিপ্রিয় এবং তার সমস্ত ইন্দ্রিয় ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মহিমায় নিবদ্ধ ছিল । যেখানেই সে যেত, গভীর স্নেহে আমি তাকে অনুসরণ করতাম, যাতে আমি তাকে রক্ষা করতে পারি এবং তার সেবা করতে পারি । এই দেখে আমার নিত্য সেবক ভৃঙ্গীঋদ্ধি আমার কাছে জানতে চাইল - এই মহান ভক্ত কি ধরণের তপশ্চর্যা এবং অন্যান্য ধর্মকর্ম সম্পাদন করেছেন যাতে আপনি স্বয়ং তাঁর সেবা করছেন ?

ভৃঙ্গীঋদ্ধির প্রশ্ন শুনে আমি বললাম - এক সময় কৈলাস পর্বতের পুন্নাগ উদ্যানে চাঁদের আলোয় বসে আছি, এমন সময় ঝড়ো হাওয়া গাছ-পালাকে সশব্দে নাড়িয়ে দিল, চারিদিক ছায়ায় ঢেকে ফেলল । আকাশে কালো মেঘের মত একটা বিশাল পাখি এসে হাজির হল । পাখিটি ভূমিতে অবতরণ করে আমাকে শ্রদ্ধা জানাল এবং একটি সুন্দর পদ্মফুল আমাকে অর্পণ করে আমার স্তুতি করল ।

পাখিটির স্তুতি শোনার পর আমি জানতে চাইলাম, 'কে তুমি এবং কোথা থেকে এসেছ ? দেখতে তুমি রাজহাঁসের মত, কিন্তু তোমার গায়ের রঙ কাকের মত !' পাখিটি তখন বলল, "আমি হলাম ব্রহ্মার বাহন হংস । কেন আমার গায়ের রঙ কালো, তা আপনাকে বলছি ।"

কালো রাজহংসের কথা
সৌরাষ্ট্রের কাছে এক মনোরম সরোবর থেকে এই অত্যাশ্চর্য দিব্য পদ্মটী আনা হয়েছে । সেখানে আমি কিছুকাল বেশ আনন্দেই ছিলাম । কিন্তু একদিন উড়তে উড়তে হঠাৎ করে আমি মাটিতে পড়ে যাই এবং আমার কর্পূরের মত ধবধবে গায়ের রঙ কালো হয়ে গেল । তখনই সরোবরের কেন্দ্রস্থলের পদ্মগুলো থেকে এক সুমধুর কণ্ঠস্বর ভেসে এল । আমি সেদিকে গিয়ে দেখলাম সরোবারে মাঝে পাঁচটি অসাধারণ সুন্দর পদ্মফুল ফুটে আছে । তাদের ভেতর থেকে একজন সুন্দর নারী বেরিয়ে এলেন । তাকে প্রদক্ষিণ করে আমি আমার পতনের কারণ জিজ্ঞাসা করলাম । তিনি বললেন, 'হে কৃষ্ণহংস, তুমি ওড়ার সময় আমাকে অতিক্রম করে ফেলেছিলে, আর সেই দোষে তোমার এই অবস্থা হয়েছে । তোমাকে পড়ে থাকতে দেখে আমার করুণা হয়েছে তাই আমি পদ্ম থেকে বেরিয়ে তোমার সাথে কথা বলছি । আমার (পদ্মের) সৌরভ আঘ্রাণ করে হাজার হাজার ভ্রমর স্বর্গলাভ করেছে । আমার এই সৌরভ আঘ্রাণ করে সাত জন্ম আগে অভিশপ্ত মুনিপুত্ররাও আজ মুক্তি পেল । হে পক্ষিরাজ ! আমার ঐশ্বর্য্যের কথা আরও কিছু বলছি, শোন ।

পদ্মিনীর কথা
তিন জন্ম আগে আমি সরোজবদনা নামে এক পতিপরায়ণা ব্রাহ্মণ পত্নি ছিলাম । একদিন এক পোষা ময়না পাখির দেখাশোনা করতে গিয়ে দেরী হওয়ার ফলে আমার স্বামী রেগে গিয়ে পরের জন্মে ময়না হয়ে জন্মাতে অভিশাপ দিলেন । পরজন্মে আমি ময়না হয়ে জন্মালেও, পূর্বজন্মের পাতিব্রাত্যের জন্য আমি মুনিদের আশ্রমে স্থান পেয়েছিলাম । সেখানে এক মুনিকন্যা আমার দেখাশোনা করত । আমি তার কাছেই প্রতি প্রভাতে গীতার দশম অধ্যায়ের পাঠ শুনতাম । এই শ্রবণমাহাত্ম্যে আমি পরের জন্মে স্বর্গের অপ্সরা হয়েছিলাম এবং পদ্মার প্রিয় সখি পদ্মাবতী নামে বিখ্যাতা ছিলাম । একদিন আকাশপথে ভ্রমণকালে সুন্দর পদ্মফুলে শোভিত এই সরোবর দেখে আকৃষ্ট হয়ে অবতরণ করে জল-কেলি শুরু করলাম । ঠিক তখুনি ঋষি দুর্বাসা ঐখানে এসে আমায় সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় দেখে কুপিত হলেন । আমি তাঁর ভয়ে পদ্মিণী রূপ ধারণ করলাম (পাঁচটি পদ্মফুল = ২ হাত + ২ পা + ১ মুখ) । মুনি দুর্বাসা আমাকে একশ বছর এই রূপে থাকার অভিশাপ দিয়ে চলে গেলেন । আমি গীতার বিভূতিঅধ্যায় শুনেছিলাম, তাই আমার পূর্বস্মৃতি লুপ্ত হয় নি । হে পক্ষিশ্রেষ্ঠ ! আজ তোমার সামনেই আমার শাপনিবৃত্তি হবে; আমি গীতার উত্তম দ্বাদশ অধ্যায় কীর্তন করছি, তুমি শোন । এটি শুনলে তুমিও আজ মোক্ষ লাভ করবে ।

পদ্মিনী এরকম বলে মনোজ্ঞ কথায় গীতার দশম অধ্যায় পাঠ করল । আমি তা শুনে ও পদ্মিনীর দেওয়া পদ্ম নিয়ে এসে আপনাকে অর্পণ করেছি । এই বলেই হংসটি দেহত্যাগ করে ধীরবুদ্ধি নাম নিয়ে এক ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম নিল । বাল্যকাল থেকেই ধীরবুদ্ধি গীতার এই দশম অধ্যায় কীর্তন করত; আর তার ফলেই এই দ্বিজ সর্বভূতস্থিত শঙ্খচক্রধর দেব বিষ্ণুকে সর্বদা দর্শন করেন । এই দ্বিজের স্নিগ্ধ দৃষ্টি যার যার ওপর পড়ে, সে ব্রাহ্মণঘাতীই হোক, বা নেশায় উন্মত্তই হোক তার তার মুক্তি হয়ে যায় ।

শিব বললেন -
আমি সে জন্যই ধীরবুদ্ধিকে কাশীপুরীতে এনেছি । এই ক্ষেত্র স্বভাবতই মুক্তিদায়ক । কিন্তু ধীরবুদ্ধির দৃষ্টিতে সর্বত্র সাধারণ পাপী মাত্রই যদি মুক্তি পেতে থাকে তাহলে মুক্তিক্ষেত্রর মাহাত্ম্য লুপ্ত হতে পারে । তাই আমি ধীরবুদ্ধিকে নগর থেকে বেরোতে দিইনা । হে ভৃঙ্গঋদ্ধি, গীতার দশম অধ্যায়ের মাহাত্ম্যের ফলেই ধীরবুদ্ধি জীবন্মুক্ত হয়েছে, তাই আমি তার সেবা করি, তাকে সব সময় রক্ষা করি ।


_________________________________________
*Hard Copy Source:
"Padmapuran, Uttarkhanda (Bengali)" by Veda Vyas, translated by Sri Tarakanta Debasharrma, Krishnadas Shastri and Sriramdas Shastri, edited by Pandit Panchanan Tarkaratna. Bangabasi-Electro-machine edition, 1915. Published & printed by Sri Natabar Chakraborty for Bangabasi Karyalay, 38/2 Bhabanicharan Datta Street, Kolkata. First Nababharat Edition, 2013 (with identical page layout). Nababharat Publishers, 72 D, Mahatma Gandhi Road, Kolkata-700009. 1062p.

Hard Copy Reference:
"Srimadvagabadgeeta Mahatmya (Bengali)compiled by Sri Sanatangopal Das Brahmachari. 6th Edition, 2014 (First Edition 2005)Printed & published by Bhaktivedanta Book Trust, Mayapur-741313, Nadia, West Bengal, India. © 2014 by Bhaktivedanta Book Trust.

Sanskrit Source
English Translation

[Digitised by scanning (if required) and then by typing mostly in Notepad using Unicode Bengali "Siyam Rupali" font and Avro Phonetic Keyboard for transliteration. Uploaded by rk


<Previous--Contents--Next>

No comments:

Post a Comment