শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার পঞ্চম অধ্যায়ের মাহাত্ম্য
(শ্রীতারাকান্ত দেবশর্মা)*
শ্রীভগবান্ কহিলেন -
হে দেবি ! অধুনা গীতার পঞ্চমাধ্যায়ের লোকপূজিত মাহাত্ম্য সংক্ষেপে বলিতেছি, তুমি অবহিত হইয়া শ্রবণ কর । ১
ভদ্রদেশের পুরুকুৎসপুরে পিঙ্গল নামে এক ব্রাহ্মণ ছিলেন । তিনি শ্রুতবেদবাদিগণের নির্মল কুলে জন্মগ্রহণ করেন । ২
কিন্তু কুলোচিত শাস্ত্র এবং বেদ সমস্তই পরিত্যাগপূর্বক মুরজাদি বাদ্য বাদনে ব্যপৃত হইয়া তৌর্য্যত্রিক ব্যাপারেই তিনি মনোনিবেশ করিয়াছিলেন । ৩
নৃত্যে গীতে এবং বাদ্যে পরিশ্রম করায় কিয়ৎকাল মধ্যেই সেই সেই বিষয়ে তাঁহার পরম প্রসিদ্ধি লাভ হয়, তিনি রাজভবনে প্রবেশ করেন । ৪
পিঙ্গল দ্বিজ প্রথমে রাজার সহিত বাস করিতে ছিলেন, পরে পরস্ত্রী আহরণ করিয়া অনন্যমনে ভোগ করিতে লাগিলেন । ৫
অনন্তর তিনি গর্বিত ও সূচক হইয়া নিরঙ্কুশভাবে নিরন্তর নির্জনে নরপতির নিকট পরছিদ্র পরিব্যক্ত করিতে লাগিলেন । ৬
তাঁহার অরুণা নামে এক হীনকুলোৎপন্না ভার্য্যা ছিল । সে কামুক জন অন্বেষণ করিয়া তৎসহ বিহার করিয়া বেড়াইত । ৭-৮
ক্রমে তাহার পতি পিঙ্গলকে সে স্বীয় কামাচারের অন্তরায়স্বরূপ মনে করিয়া একদা নিশীথে নিজালয়ে তদীয় মস্তকছেদনপূর্বক ভূগর্তে পুতিয়া রাখিল । ৮-৯
পিঙ্গল প্রাণবিযুক্ত হইয়া যমালয়ে উপনীত হইলেন এবং ক্রমে দুর্জয় নরকনিচয় ভোগ করিয়া এক বিজন বনে গৃধ্র হইয়া জন্মগ্রহণ করিলেন । ৯-১০
পিঙ্গলা ভগন্দর রোগে আক্রান্ত হইয়া স্বীয় বরতনু পরিত্যাগপূর্বক ঘোর নরকজালে জড়িত হইল এবং নরক-ভোগান্তে অরণ্যে এক শুকী হইয়া জন্মগ্রহণ করিল । ১০-১১
শুকী ইতস্ততঃ সঞ্চরণ করিয়া ফলসমূহ গ্রহণ করিতে অভিলাষিণী হইলে গৃধ্র বৈরানুস্মরণ করিয়া তীক্ষ্ণ নখরাঘাতে তাহাকে বিদারণ করিল । ১১-১২
অনন্তর শুকী এক জলপূর্ণ নৃকপালে নিপতিত হইলে গৃধ্র তাহার প্রতি ধাবিত হইল । তখন জালিকেরা গৃধ্রকে নিহত করিল । শুকীও নৃকপালজলে প্রাণ হারাইল । ক্রূরতর গৃধ্রেরও মৃত দেহ সেই জলে নিমগ্ন হইল । ১২-১৪
তখন যমকিণকরগণ কর্তৃক নীত হইয়া তাহারা উভয়েই প্রেতলোকে প্রয়াণ করিল এবং পূর্বকৃত দুষ্কৃত কর্ম স্মরণ করিয়া তাহারা ভীত হইয়া পড়িল । ১৪
অনন্তর যম তাহাদের নিন্দিত কর্ম অবলোকন করিয়া স্থির করিলেন, ইহারা অকস্মাৎ নৃকপালে স্নান করিয়া মৃত্যুমুখে পতিত হওয়ায় ইহাদের যথেষ্ট সুকৃতিসঞ্চয় হইয়াছে । ১৫
ইহা স্থির করিয়া তিনি তাহাদিগকে অভীপ্সিত লোকগমনে অনুমোদন করিলেন । তখন সেই মহাপাতকযুক্ত দুর্ধর্ষচিত্ত পতিপত্নি গৃধ্র ও শুকী নিজেদের দুষ্কৃত স্মরণে বিস্ময়াপন্ন হইয়া যমসমীপে আগমনপূর্বক বিনীতভাবে তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিল, "আমরা পূর্বে অতি গর্হিত দুষ্কৃত সঞ্চয় করিয়াছিলাম । আমাদের ন্যায় পাপীর এই সকল ঈপ্সিত লোকলাভের হেতু কি ? তাহা আমাদিগকে বলুন ।" ১৬-১৮
যম বলিলেন -
তাহারা এই কথা কহিলে, বৈবস্বত তাহাদিগকে বলিলেন - পূর্বে গঙ্গাতটে বটু নামে এক উত্তম ব্রহ্মবিৎ ব্রাহ্মণ ছিলেন । ১৯
তিনি নির্জনে বাস করিতেন, কোন কিছুতেই তাঁহার মমত্ব বুদ্ধি ছিল না; তিনি শান্ত, বীতরাগ ও মাৎসর্য্যহীন হইয়া সর্বদা গীতার পঞ্চমাধ্যায় পাঠ করিতেন । গীতা পাঠজনিত পুণ্যে পূতাত্মা হইয়া তিনি সনাতন ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করিয়াছিলেন । ২০-২১
তাঁহার পঠিত পঞ্চমাধ্যায় শ্রবণ করিয়া এক পাপিষ্ঠ তনুত্যাগ করিয়াছিল । গীতার মাহাত্ম্যে সে ভাবিতাত্মা ও নির্মলীকৃত-কলেবর হয় । তাঁহার কপালজলে তোমাদের তনুত্যাগ হওয়ায় তোমরা পবিত্র হইয়াছ । ২১-২২
অতএব তোমরা মনোরথপথস্থিত লোকে গমন কর । তোমরা গীতার পঞ্চমাধ্যায়মাহাত্ম্যে পবিত্রিত হইয়াছ । ২৩
এইরূপে যম কর্তৃক বোধিত ও মুদিত হইয়া তাহারা ব্যোমযানারোহণে বৈষ্ণব পদ প্রাপ্ত হইল । ২৪
[পদ্মপুরাণ, উত্তর খণ্ড, ১৭৯ অধ্যায়]
_________________________________________
চলিত বাংলায় সারাংশ
ভদ্রদেশের পুরুকুৎসপুরে পিঙ্গল নামে এক ব্রাহ্মণ বাস করতেন । বাল্যকালে অধ্যয়নে তার কোন আগ্রহই ছিল না । যৌবনে পদার্পণ করে সে ব্রাহ্মণের বৃত্তি পরিত্যাগ করে বাদ্যযন্ত্র ও নৃত্য-গীত শিক্ষা শুরু করে । ধীরে ধীরে এই সকল বিদ্যায় সে এত বিখ্যাত হল যে স্বয়ং রাজা তার প্রাসাদে বাস করার জন্য তাকে আমন্ত্রণ জানালেন । সেখানে বাস করে সে পাপী জীবনে আরও বেশী লিপ্ত হতে লাগল । সে পরস্ত্রী ও মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ল । রাজার সঙ্গে যতই তার হৃদ্যতা বাড়তে লাগল, ততই সে তার পদগৌরবে গর্বিত হল । গোপনে রাজার কাছে অন্যের সমালোচনা করে সে বিশেষ আমোদ পেত ।
পিঙ্গলের স্ত্রী অরুণা খুবই কামুকী এবং বহু পুরুষের সঙ্গ-সুখ উপভোগে আসক্তা ছিল । তার এই যথেচ্ছ ব্যভিচারে স্বামী বাধা দেওয়ায় একদিন গভীর রাত্রে অরুণা পিঙ্গলার মাথা কেটে হত্যা করে দেহটি বাগানে পুঁতে ফেলে ।
মৃত্যুর পর পিঙ্গল ঘোর নরকে পতিত হয় এবং বহু বছর যন্ত্রণা ভোগ করার পর সে শকুন হয়ে জন্মায় । আর দুশ্চরিত্রা অরুণা বহু পুরুষের সংসর্গে অচিরেই যৌনরোগের শিকার হয়ে কুশ্রী ও কদাকার হয়ে পড়ে । মৃত্যুর পর দীর্ঘকাল নরক যন্ত্রণা ভোগের পর সে একটি স্ত্রী তোতাপাখি হয়ে জন্মাল ।
একদিন তোতাপাখিটি যখন খাবার খুঁজে বেড়াচ্ছিল তাকে দেখে শকুনের পূর্বজন্মের কথা মনে পড়ে গেল । শকুনটি বুঝতে পারল যে এই পাখিটিই গত জন্মে তার ব্যভিচারী স্ত্রী ছিল । সে হিংস্রভাবে তার ধারাল ঠোঁট আর নখ দিয়ে পাখিটিকে ছিন্নভিন্ন করে দিল । ক্ষতবিক্ষত তোতাপাখিটি একটা মানুষের মাথার খুলির মধ্যে জমে থাকা জলে পড়ে গিয়ে মরে গেল । ইতিমধ্যে এক ব্যাধ শকুনটিকে শরবিদ্ধ করলে সেও একইভাবে খুলির জলে পড়ে গিয়ে মরে গেল ।
এরপর যমদূতেরা এসে তাদের যমালয়ে নিয়ে গেল । নিজেদের অতীত পাপ-জীবনের কর্মফলে তাদের কি নিদারুণ নরকযন্ত্রণা ভোগ করতে হবে এই ভেবে তারা আতঙ্কিত হল । কিন্তু তাদের যখন যমরাজের সামনে হাজির করা হল, তখন যমরাজ বললেন, "এখন তোমরা সর্বপাপ মুক্ত হয়েছ । তাই তোমরা বৈকুণ্ঠে যেতে পার ।" অবাক হয়ে পিঙ্গল এবং অরুণা জিজ্ঞাসা করল যে, তাদের মত এমন পাপী কি করে বৈকুণ্ঠে যাবার অধিকার পেল ?
যমরাজ উত্তর দিলেন, "গঙ্গার তীরে বটু নামে ভগবান বিষ্ণুর এক মহান ভক্ত বাস করতেন । তিনি প্রতিদিন ভগবদ্গীতার পঞ্চম অধ্যায় পাঠ করতেন যার ফলে তাঁর দেহ সম্পূর্ণ শুদ্ধ হয় । ঘটনাক্রমে তোমরা তাঁর মাথার খুলির সংস্পর্শে আসার ফলে তোমাদেরও সমস্ত পাপ নাশ হয়ে তোমরা পবিত্র হয়েছ । তাই তোমাদের বৈকুণ্ঠে যাবার অধিকার হয়েছে ।"
ভগবদ্গীতার পঞ্চম অধ্যায় যে পাঠ বা শ্রবণ করবে, যত পাপীই হোক তার বৈকুণ্ঠ প্রাপ্তি হবে - এটাই হল এই অধ্যায়ের মাহাত্ম্য ।
_________________________________________
*Hard Copy Source:
"Padmapuran, Uttarkhanda (Bengali)" by Veda Vyas, translated by Sri Tarakanta Debasharrma, Krishnadas Shastri and Sriramdas Shastri, edited by Pandit Panchanan Tarkaratna. Bangabasi-Electro-machine edition, 1915. Published & printed by Sri Natabar Chakraborty for Bangabasi Karyalay, 38/2 Bhabanicharan Datta Street, Kolkata. First Nababharat Edition, 2013 (with identical page layout). Nababharat Publishers, 72 D, Mahatma Gandhi Road, Kolkata-700009. 1062p.
Hard Copy Reference:
"Srimadvagabadgeeta Mahatmya (Bengali)" compiled by Sri Sanatangopal Das Brahmachari. 6th Edition, 2014 (First Edition 2005). Printed & published by Bhaktivedanta Book Trust, Mayapur-741313, Nadia, West Bengal, India. © 2014 by Bhaktivedanta Book Trust.
Sanskrit Source
English Translation
No comments:
Post a Comment