শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার একাদশ অধ্যায়ের মাহাত্ম্য
(শ্রীতারাকান্ত দেবশর্মা)*
পার্বতী বলিলেন
হে ঈশান ! এই ইতিহাস অত্যুত্তম ও অশেষ শ্রেয় সাধন; হে করুণাপূর্ণ ! ইহা শ্রবণ করিয়া আমার শ্রবণেচ্ছা বর্ধিত হইতেছে । হে প্রভো ! আপনি বক্তাদিগের বরেণ্য, হে বিরুপাক্ষ ! গীতার একাদশাধ্যায়-মাহাত্ম্যের কথাপরম্পরা কীর্তন করুন । ১-২
মহাদেব বলিলেন
হে কান্তে ! গীতাবর্ণন-বিষয়িণী কথা শ্রবণ কর । গীতার বিশ্বরূপ-নামক একাদশাধ্যায়-মাহাত্ম্য অতিপাবন, হে বিশালাক্ষি ! গীতার একাদশ অধ্যায়ের মাহাত্ম্যকথা কহিতে আমি সমর্থ নহি । এ বিষয়ে সহস্র কথা আছে, তন্মধ্যে আমি একটী কথা কহিতেছি । ৩-৪
প্রণীতার তটে মেঘঙ্কর নামক এক বিখ্যাত নগর বিদ্যমান, ঐ নগর গরিমার আধারস্বরূপ, তুঙ্গ প্রাকার, গোপুর, বিশাল আশ্রম ও শালা এবং সুবর্ণস্তম্ভবিভূষিত । শ্রীমান্, সুখী, শান্ত, সদাচার ও জিতেন্দ্রিয় জনগণ কর্তৃক উহা অধ্যুষিত । উহা রচনাপারিপাট্যে মনোহর এবং প্রদীপ্ত স্বর্ণখচিত মণিস্তম্ভ আপণ ও চত্বর দ্বারা শোভাকর । ঐ নগর পতাকাকিঙ্কিণীর ক্বণধ্বনিতে নিয়ত কলস্বরময় । নগরের দিগন্তর বেদাধ্যয়ন-ঘোষে মুখরিত, তুর্য্য-সংঘোষে বিশাল আকাশমণ্ডল সমাকীর্ণ এবং ঐ নগর পতাকা-পল্লবোত্থিত বাত দ্বারা বীজিত । মনোজ্ঞ রমণীগণের নূপুরধ্বনি, বল্লরী ও বেণূগীত এবং অশ্বগণের হ্রেষা-রবে তত্রত্য রাজপথের বিশাল দ্বারদেশ শোভিত হইতেছে এবং দিক্পালগণের পুরবৎ লক্ষিত হইতেছে । ৫-১১
তথায় মুর্তিমান্ পরম ব্রহ্ম জগজ্জীবন জগৎনয়ন জগৎপতি শার্ঙ্গধর বিরাজ করিতেছেন । তিনি আকারগৌরবে গৌরবান্বিত এবং পদ্মালয়ার নয়নপদ্ম দ্বারা ত্রিবিক্রম । সেই মেঘশ্যামল কমলদ্যুতি বামন বিগ্রহের বক্ষ শ্রীবৎসচিহ্নিত এবং পদ্ম ও বনমাল্য দ্বারা ভূষিত । তিনি অনেক ভূষণোপেত সরত্ন রত্নাকরের ন্যায় বিরাজিত এবং চঞ্চল চপলান্বিত ঘনমেঘের ন্যায় প্রতিভাত । তাঁহার মুকুটে পরম পুরুষ শার্ঙ্গধর বিরাজিত, তাঁহাকে দর্শন করিয়া জীব জন্ম-সংসারবন্ধন হইতে মুক্ত হয় । ১২-১৫
ঐ পুরে মেখলা নামে এক মহাতীর্থ বিদ্যমান, মানবগণ ঐ মেখলা তীর্থে স্নান করিয়া নিত্য বৈষ্ণবপদ প্রাপ্ত হয় । মেখলা তীর্থে মানব কৃপার্ণব জগৎপতি নরসিংহকে অবলোকন করিয়া সপ্তজন্মকৃত ঘোর দুষ্কৃত হইতে মুক্ত হয় । যে নর মেখলায় গণপতিকে দর্শন করে, সে সর্বদা দুস্তর বিঘ্ন হইতেও উত্তীর্ণ হইয়া থাকে । ১৬-১৮
সেই মেঘঙ্কর নগরে ব্রহ্মচর্য্যরত, দান্ত, নির্মম, নিরহঙ্কার ও বেদশাস্ত্রবিশারদ সুনন্দ নামে বিখ্যাত জনৈক ব্রাহ্মণসত্তম ছিলেন । হে প্রিয়ে ! জিতেন্দ্রিয় বাসুদেবপরায়ণ সুনন্দ, দেব শার্ঙ্গধরের পার্শ্বে বিশ্বরূপপ্রদর্শক গীতার একাদশ অধ্যায় পাঠ করিয়া অধ্যায়মাহাত্ম্যে ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করিয়াছিল । সুনন্দ একমাত্র পরমানন্দসন্দোহই শ্লাঘ্য মনে করিত এবং সংবিৎসমাধি যোগে ইন্দ্রিয়গণকে অন্তর্মুখ করিয়া নিশ্চলা স্থিতি অবলম্বনে জীবন্মুক্ত রূপে সতত অবস্থিত হইত । ১৮-২৩
একদা বৃহস্পতি সিংহরাশিতে গমন করিলে মহাযোগী সুনন্দ গোদাবরী-তীর্থযাত্রার উপক্রম করিল । সে প্রথম দিনে উত্তম বিরজতীর্থে গমন করিয়া সেই বিরজজলে বারবার নিমজ্জন ও নাভিমাত্র জলে অবস্থান করিয়া জগদ্ধাত্রী কমলার দর্শন ও অর্চনা করিল । অনন্তর সর্বকামফলদা সেই মহামায়ার পূজান্তে তারাতীর্থে স্নান করিয়া কপিলাসঙ্গমে উপনীত হইল । ২৩-২৬
তারপর সুনন্দ অষ্ট তীর্থে গমন ও তথায় পিতৃতর্পণ করিয়া কুমারীশ শিবকে প্রণামপূর্বক কপিলাদ্বারে উপস্থিত হইল এবং তথায় নিমজ্জিত হইয়া পূর্বজন্মকৃত দুরিত ক্ষালন করিল । সুনন্দ এই স্থানে মধুসূদনকে স্তব পূজা ও প্রণাম করিয়া এক রজনী জাগরণপূর্বক দ্বিজগণ সহ প্রভাতে নরসিংহবনে গমন করিল । ২৭-২৯
নরসিংহবনে রামদিঘিকা ও প্রহ্লাদপূজিত সাক্ষাৎ নরসিংহ বিরাজিত । সুনন্দ দেবদেবেশ নরসিংহকে দর্শন, ভক্তিপূর্বক পূজা ও তথায় সেই দিন অবস্থান করিয়া অম্বিকাপুরে উপনীত হইল । ২৯-৩০
অম্বিকা দেবী ভক্তগণের প্রতি অনুগ্রহ করিয়া এইস্থানে বাস করেন এবং মানবগণের অখিল অভিলষিত প্রদান করিয়া থাকেন । সুনন্দ পুষ্প, গন্ধ, অনুলেপন, বিবিধ উপহার, স্তোত্র, প্রণাম দ্বারা ভক্তিভরে অম্বিকার পূজা করিয়া সে স্থান হইতে কণ্ঠস্থান নামক পুরে উপস্থিত হইল । ৩১-৩৩
এই কণ্ঠস্থানে মহাদ্যুতি পরমা শক্তি মহালক্ষী বিদ্যমানা; মহালক্ষী সুধাধবলিতা, ভাস্করমণ্ডলের ন্যায় দ্যুতিশালিনী । সংসারতাপচ্ছেদনকরী, পদ্ম ও পীযুষবাহিনী এবং যোগিরাজের হৃদয়সরোজের রাজহংস-দ্বারা সেবিতা । মুনীশ্বর সুনন্দ সেই অনাহতমহানাদময়ী, অদ্বয়রূপিনী, অভিলষিতদায়িনী মহালক্ষীকে ভক্তিযুক্ত হৃদয়ে আরাধনা করিয়া বিপ্রগণসমন্বিত বিবাহমণ্ডপপুরে গমন করিল । ৩৩-৩৭
সুনন্দ বিবাহমণ্ডপে উপনীত হইয়া প্রতিগৃহদ্বারে বাসস্থান প্রার্থনা করিল, কিন্তু কোন গৃহেই বাসস্থান প্রাপ্ত হইল না । জনৈক গ্রামপাল তাহাকে এক বিশাল বাসমন্দির দেখাইয়া দিল, সুনন্দ সঙ্গিসহ সেই মন্দির মধ্যে প্রবেশ করিয়া বাস করিল । অনন্তর বিমল প্রভাতকালে দ্বিজসত্তম সুনন্দ দেখিল, সে বাসগৃহের বাহিরে অবস্থান করিতেছে, তাহার সঙ্গী পথিকগণ যদৃচ্ছাক্রমে কোথায় চলিয়া গিয়াছে । ৩৭-৪০
গ্রামপাল সেই পথ দিয়া যাইতেছিল, সে সুনন্দকে সন্দর্শন করিয়া কহিল
বৎস ! তুমি দীর্ঘায়ু, পুণ্যশীল, সুভ্গগণের অগ্রণী এবং তোমাতে কোনও লোকোত্তর প্রভাব বিদ্যমান । তোমার সঙ্গীরা কোথায় গেল ? কি করিয়া গৃহের বাহির হইল ? দেখ তাই বলিতেছি - হে মুনিশার্দুল ! তোমার তুল্য তপস্বী এখানে কাহাকেও দেখি না; তুমি কি কোন মহামন্ত্র জান অথবা কোন অলৌকিক বিদ্যা অবলম্বন করিয়াছ ? কোন দেবের করুণায় তোমার এই লোকাতীত শক্তি অর্জিত হইয়াছে ? অতএব হে বিপ্রবর ! তুমি করুণা করিয়া এই গ্রামে বাস কর । হে ভগবন্ ! আমি তোমার যাবদীয় শুশ্রূষা সম্পন্ন করিব । ৪১-৪৬
গ্রামপাল এইরূপ বলিয়া মুনীশ্বরকে সেই গ্রামে বাস করাইল এবং প্রতিদিন ভক্তিভরে তাহার শুশ্রূষা করিতে লাগিল । অনন্তর সাত আট দিন অতীত হইলে একদা গ্রামপাল প্রভাতে সুনন্দসমীপে আগমনপূর্বক অত্যন্ত দুঃখে রোদন করিতে লাগিল । ৪৬-৪৮
গ্রামপাল বলিল
আমি ভাগ্যহীন, আজ নিশাযোগে জাজ্বল্যমানদংষ্ট্র জনৈক রাক্ষস আমার গুণবান্ ভক্ত তনয়কে ভক্ষণ করিয়াছে । ৪৮
গ্রামপাল এইরূপ বলিলে সংযমী সুনন্দ তাহাকে কহিল
বল, কোথায় সেই রাক্ষস এবং কেনই বা তোমার পুত্রকে ভক্ষণ করিল ? ৪৯
গ্রামপাল বলিল
সেই ঘোর পুরুষাশী নিশাচর নগর মধ্যে অবস্থান করিতেছে, সে নিত্য আসিয়া নগর মধ্যে নরগণকে ভক্ষণ করিত । একদা নগরবাসী সকলে মিলিত হইয়া তাহাকে কহিল, - হে রাক্ষস ! আমাদিগকে রক্ষা কর, আমরা তোমার আহারের ব্যবস্থা করিয়া দিব । এই নগরের গ্রামপাল এই ভবনে যে সকল পথিকগণকে আনয়ন করে, তাহারা রাত্রে ঐ গৃহে শয়ন করিয়া থাকে, হে রাক্ষস ! তুমি তাহাদিগকে ভক্ষণ করিবে । তাহারা নিজ নিজ প্রাণরক্ষার্থ রাক্ষসের এইরূপ ভক্ষণ ব্যবস্থা করিয়া দিল । তুমি সঙ্গী পথিকগণের সহিত এই গৃহে সুপ্ত ছিলে, রাক্ষস তোমার সঙ্গীদিগকে ভক্ষণ করিয়াছে । হে দ্বজোত্তম ! তুমি মুক্ত হইয়াছ; আপনার এই অলৌকিক প্রভাব যে কিরূপ তাহা আপনিই জানেন । ৫০-৫৫
আজ আমার তনয়ের জনৈক মিত্র সেই সকল পথিকের সহিত আগমন করিয়াছিল, সে যে আমার পুত্রের মিত্র, আমি তাহা জানিতাম না । তাই অন্যান্য পথিকের সহিত তাহাকে ঐ গৃহে প্রবেশ করাইয়াছিলাম । অনন্তর রাত্রিতে আমার পুত্র এই ঘটনা জানিতে পারিয়া তাহার উদ্ধারার্থ আসিয়া সেও ঐ গৃহে প্রবেশ করে ও রাক্ষস কর্তৃক ভক্ষিত হয় । ৫৬-৫৭
আমি দুঃখিত হইয়া প্রভাতে সেই নিশাচরকে কহিলাম
রে দুষ্টাত্মন্ ! তুই রাত্রিতে আমার পুত্রকেও ভক্ষণ করিয়াছিস্ ! হে নিশাচর ! আমার তনয় তোমার উদরগত হইয়াছে, ইহার বাঁচিবার যদি কোনও উপায় থাকে, তাহা আমাকে বল । ৫৮-৫৯
রাক্ষস কহিল
পথিকগণের সহিত তোমার পুত্র আমার উদরে প্রবেশ করিয়াছে, ইহা আমি জানিতাম না, তাই তাহাকে ভক্ষণ করিয়াছি । এখন যে উপায়ে সে জীবিত থাকিয়া আমার কুক্ষিমধ্যে রক্ষিত হয়, তাহার এক উপায় আছে, এ উপায় পদ্মযোনি ব্রহ্মা নির্দিষ্ট করিয়া রাখিয়াছেন । যদি কোন দ্বিজ নিরন্তর গীতার একাদশ অধ্যায় পাঠ করেন, তবে তৎপ্রভাবে আমার মুক্তি ও মৃতের পুনঃ প্রাণপ্রাপ্তি হইবে । ৬০-৬২
গ্রামপাল কহিল
গীতার একাদশ অধ্যায়ের এইরূপ অদ্ভুত সামর্থ্য কি করিয়া জানিব ? হে বিপ্র ! আমি এইরূপ জিজ্ঞাসা করিলে নিশাচর উত্তর করিল, ৬৩-৬৪
রাক্ষস কহিল
পূর্বকালে কোন এক গৃধ্র আকাশপথে যাইতেছিল, তাহার তুণ্ডাগ্র হইতে একখণ্ড অস্থি কোন জলাশয়ের জলে পতিত হয় । জনৈক জ্ঞানীশ্বর সেই জলাশয়কে মহাতীর্থ মনে করিয়া তথায় আগমনপূর্বক পিতৃতর্পণ করেন । তত্রত্য জনগণ তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করে - বলুন, ইহা কিরূপে তীর্থ হইল ? মুনি বলেন, - এই যে অস্থিখণ্ড জলাশয়ে পতিত হইয়াছে, ইহা জনৈক দ্বিজের । এই দ্বিজ একাদশ অধ্যায় পাঠ করিতেন । তিনি মৈনী থাকিতেন । একদা তিনি পথিমধ্যে চৌর কর্তৃক নিহত হন । তারপর গৃধ্রবদন হইতে তদীয় অস্থি এই জলে পতিত হয়, তাই এই মহাপাতকনাশন তীর্থের উৎপত্তি হইয়াছে । তারপর মানবগণ সেই জলাশয়ে স্নান করিয়া নিষ্পাপ হইয়া পরম পদপ্রাপ্ত হইল । ৬৪-৭০
গীতার একাদশ অধ্যায়মাহাত্ম্যে আমার মুক্তি ও পথিকগণেরও জীবনপ্রাপ্তি হইবে । আমি যে একজন বিপ্রকে উদ্গিরণ করিব, যিনি এখানে বর্তমান থাকিবেন, সে দ্বিজেন্দ্র নিরন্তর গীতার একাদশ অধ্যায় জপ করিয়া থাকেন । তিনি যদি গীতাধ্যায়-মন্ত্রে সপ্তবারাভিমন্ত্রিত জল আমার উপর নিক্ষেপ করেন, তবে নিঃসংশয় আমার শাপমুক্তি হইবে । ৭১-৭৩
গ্রামপাল কহিল
হে বিপ্র ! আমি সেই নিশাচর কর্তৃক এইরূপ উপদিষ্ট হইয়া আপনার নিকট আগমন করিয়াছি । ৭৩
বিপ্র বলিলেন
হে গ্রামপাল ! কি পাপে সে রাক্ষস হইয়াছে ? কেনই বা সে রাত্রিতে গৃহমধ্যে নিদ্রিত নরগণকে ভক্ষণ করে ? ৭৪
গ্রামপাল কহিল
পূর্বকালে এই গ্রামে জনৈক কৃষিবল বিপ্র বাস করিতেন, তিনি একদা ধান্য-ক্ষেত্রের কেদাররক্ষায় নিরতিশয় নিযুক্ত ছিলেন । তখন ঐ ক্ষেত্রের অনতিদূরে এক মহাগৃধ্র একজন পথিককে ভক্ষণ করিতেছিল । ক্ষেত্রের বহু দূরে জনৈক তাপস ছিলেন, তিনি পথিকের রক্ষার্থ দূর হইতে যত্ন করিয়া কৃতকার্য্য হইলেন না, গৃধ্র পথিককে ভক্ষণ করিয়া আকাশপথে প্রস্থান করিল । ৭৫-৭৭
অনন্তর তাপস কোপবশে সেই কৃষিবলকে বলিলেন
রে কঠোরমতি দুর্বুদ্ধি নির্গুণ হতজীবিত হালিক ! তোকে ধিক্ তুই কুক্ষিম্ভরি, তাই পরত্রাণে পরাঙ্মুখ । সামর্থ্য সত্ত্বে যে ব্যক্তি চৌর, দংষ্ট্রী, সর্প, অরি, অগ্নি, বিষ, জল, গৃধ্র, রাক্ষস, ভূত ও বেতালাদি কর্তৃক হন্যমান জন্তুগণের রক্ষায় উপেক্ষা করে, তাহার সেই বধপাতক হইয়া থাকে । যে শক্তিমান্ মানব চৌরাদি দ্বারা আক্রান্ত বিপ্রকে মুক্ত করে না, সে ঘোর নরকে গমন করিয়া পুনরায় ব্যাঘ্র হইয়া জন্মগ্রহণ করে । রক্ষার কথা কি কহিব, যে ব্যক্তি বিপিনে গৃধ্র-ব্যাঘ্র-পীড়িত নিহন্যমানকে "ছাড়িয়া দে, ছাড়িয়া দে" এইরূপ বলে, সেও পরমাগতি প্রাপ্ত হয় । যাঁহারা ব্যাঘ্র, ব্যাধ ও দুষ্ট নৃপতি কর্তৃক পীড়িতকে বিশেষতঃ গো সম্বন্ধে এইরূপ রক্ষণ-যত্ন করিয়া থাকেন, তাঁহারা তদুপলক্ষে নিহত হইলেও যোগিজনদুর্লভ বিষ্ণুর পরম পদ লাভ করেন । সহস্র অশ্বমেধ এবং শত বাজপের যজ্ঞফলও শরণাগত-ত্রাণ-পুণ্যের ষোড়শাংশের একাংশযোগ্য নহে । ভীতদেহ দীনের রক্ষণে যে ব্যক্তি উপেক্ষা প্রদর্শন করে, পুণ্যবান্ হইলেও সে কালে কুম্ভীপাক নরকে পতিত হয় । রে দুষ্ট ! তুমি গৃধ্র কর্তৃক পথিককে ভক্ষিত হইতে দেখিয়া সামর্থ্য সত্ত্বে নিবারণ কর নাই, তুমি কৃপাহীন, অতএব নিশাচর হইবে । ৭৭-৮৬
মুনির এইরূপ শাপ শ্রবণ করিয়া কম্পিতকলেবর হালিক তাঁহাকে প্রণামপূর্বক করুণ বাক্যে বলিল, - ক্ষেত্ররক্ষার্থ আমার চক্ষু নিবিষ্ট ভাবে ক্ষেত্রে নিক্ষিপ্ত হইয়াছিল, তাই আমার সমীপে গৃধ্র এই ব্যক্তিকে নিহত করিতেছে, ইহা আমি দেখিতে পাই নাই; আমি দীন, অতএব আমার প্রতি আপনার করুণা করা উচিত । ৮৭-৮৮
বিপ্র বলিলেন
যিনি গীতার একাদশাধ্যায় বিদিত আছেন এবং প্রতিদিন জপ করেন, তিনি যদি জল অভিমন্ত্রিত করিয়া তোমার মস্তকে নিক্ষেপ করেন, তবে তোমার সদ্য শাপবিমুক্তি হইবে । ৮৯-৯০
তাপস এই বলিয়া চলিয়া গেলেন, হালিক রাক্ষস হইল । অতএব হে বিপ্রবর ! সত্বর আগমন কর, গীতাধ্যায়মন্ত্রে জল অভিমন্ত্রিত কর এবং স্বহস্তে তীর্থজল লইয়া সেই রাক্ষসের মস্তকে নিক্ষেপ কর । ৯০-৯১
মহাদেব বলিলেন
গ্রামপালের এইরূপ প্রার্থনায় যোগিবর বিপ্র সুনন্দের হৃদয় কারুণ্যে আপ্লুত হইল, তিনি তথাস্তু বলিয়া গ্রামপালের সহিত রাক্ষসসমীপে গমন করিলেন এবং বিশ্বরূপপ্রকাশক একাদশাধ্যায়মন্ত্রে জল অভিমন্ত্রিত করিয়া রাক্ষসের মস্তকে নিক্ষেপ করিলেন । গীতাধ্যায়প্রভাবে রাক্ষসের শাপমোক্ষ হইল, সে রাক্ষস-দেহ পরিত্যাগ করিয়া চতুর্ভূজ হইয়া গেল এবং সে যে সকল পথিককে ভক্ষণ করিয়াছিল তাহাদিগকে উদ্গিরণ করিল । রাক্ষসবদনোদ্গীর্ণ সেই সহস্র সহস্র লোক শঙ্খ্য-চক্র-গদা-পদ্মধর চতুর্বাহু হইয়া প্রত্যেকেই পৃথক্ পৃথক্ বিমানে আরোহণ করিল । ৯২-৯৬
তৎকালে গ্রামপাল রাক্ষসকে বলিল, - হে নিশাচর ! আমার তনয় কে ? তাহাকে দর্শন করাও । ৯৬
গ্রামপাল এইরূপ কহিলে দিব্যধী রাক্ষস বলিল
এই যে তমালশ্যামলদ্যুতি, চতুর্বাহু, মাণিক্যমুকুট ও কুণ্ডলমণ্ডিত, মাল্যধারী, মহাস্কন্ধ, স্বর্ণকেয়ুরভূষিত, রাজীবলোচন, স্নিগ্ধ ও কমলকর, ইহাকে তোমার তনয় বলিয়া বিদিত হও । সম্প্রতি তোমার তনয় দেবত্ব প্রাপ্ত হইয়া দিব্য বিমানে আরোহণ করিয়াছে । ৯৭-৯৯
গ্রামপাল নিশাচরের এবংবিধ বাক্য শ্রবণ ও তনয়ের তথাবিধ অবস্থা অবলোকন করিয়া তাহাকে গৃহে লইয়া যাইবার জন্য যত্ন করিল; ১০০
কিন্তু তনয় তাহাতে হাসিয়া কহিল
পূর্বে কতবার তুমি আমার পুত্র হইয়াছ, ঐরূপ আমিও অনেক বার তোমার পুত্র হইয়াছি । ব্রাহ্মণের প্রসাদে সম্প্রতি আমি দেবত্ব প্রাপ্ত হইয়াছি, আমি বৈষ্ণব ধামে গমন করিব । এই দেখ গীতার একাদশাধ্যায়মাহাত্ম্যে সেই নিশাচরও দিব্য চতুর্ভূজরূপ প্রাপ্ত হইয়াছে এবং জনগণের সহিত স্বর্গে গমন করিতেছে । তুমিও এই বিপ্রের নিকট গীতার একাদশাধ্যায় অধ্যয়ন করিয়া অহর্নিশ জপ কর; নিঃসন্দেহ তোমারও এইরূপ গতি হইবে । তাই বলিতেছি - হে তাত ! জনগণের সাধুসঙ্গ সর্বথা সুদুর্লভ, আজ তোমার তাহা সংঘটিত হইয়াছে, অতএব নিজের, অভীপ্সিত সাধন কর । ধন, ভোগ, দান, যজ্ঞ, তপস্যা ও পূর্তকর্মে কি প্রয়োজন ? বিশ্বরূপ গীতাধ্যায় পাঠ ও তাহার শ্রবণ পরম শ্রেয়ঃসাধন । যাহা পূর্ণানন্দ-সন্দোহপ্রাপক ও কৃষ্ণরূপী ব্রহ্মের মুখনির্গত, তাহাই বিষ্ণুর পরম রূপ । এই কৈবল্যরসায়ন কুরুক্ষেত্রে অর্জুন ও তন্মিত্র শ্রীকৃষ্ণের কথাপরম্পরা দ্বারা সমুদ্ভূত এবং ভবভীত জনগণের আধিব্যাধিভয়াপহ । অনেকজন্মদুঃখনাশক এরূপ বস্তু আর নাই, অতএব তুমি ইহা স্মরণ কর । ১০১-১০৮
মহাদেব বলিলেন
গ্রামপালতনয় এইরূপ বলিয়া সঙ্গিগণের সহিত বিষ্ণুর পরম পদে গমন করিল; এদিকে গ্রামপালও সুনন্দের নিকট গীতার একাদশাধ্যায় পাঠ করিল । গীতামাহাত্ম্যপ্রভাবে তাহারা উভয়েই বৈষ্ণবপদ প্রাপ্ত হইল । এই তোমার নিকট গীতার একাদশাধ্যায়মাহাত্ম্য নিরূপিত হইল, ইহা শ্রবণে মহাপাতক ক্ষয় প্রাপ্ত হয় । ১০৯-১১০
[পদ্মপুরাণ, উত্তর খণ্ড, ১৮৫ অধ্যায়]
_________________________________________
চলিত বাংলায় সারাংশ
দেবাদিদেব শিব বললেন
হে পার্বতী, গীতার একাদশ অধ্যায়ের সম্পূর্ণ মাহাত্ম্য বর্ণনা করা সম্ভব নয়, কারণ হাজার হাজার কাহিনী আছে । তার মধ্যে মাত্র একটা কাহিনী আমি তোমাকে এখন বলব ।
প্রণীতা নদীর তীরে মেগাঙ্কর নামে এক বড় শহরে জগদীশ্বরের মন্দির আছে । মন্দিরে ধনুক হাতে স্বয়ং জগদীশ্বর দাঁড়িয়ে আছেন । এই মেগাঙ্করে সুনন্দ নামে এক আজীবন ব্রহ্মচারীব্রত উদ্যাপনকারী এক ব্রাহ্মণ বাস করতেন । জগদীশ্বরের সামনে বসে সুনন্দ গীতার একাদশ অধ্যায় পাঠ করতেন এবং ভগবানের শাশ্বত সনাতনরূপ স্মরণ করতেন । এই ভাবে পাঠের ফলে তিনি তাঁর ইন্দ্রিয়ের ওপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ অর্জন করলেন ।
একদা সেই শুদ্ধাচারী ব্রাহ্মণ গোদাবরী নদীর তীরে তীর্থ ভ্রমণে বেরোলেন । বিরাজ তীর্থ থেকে শুরু করে তিনি সব তীর্থেই স্নান করে অধিষ্ঠিত বিগ্রহ দর্শন করলেন । একদিন তিনি বিবাহ মণ্ডপ শহরে পৌছলেন । সঙ্গীদলকে সাথে নিয়ে তিনি বিশ্রামের স্থান খুঁজতে খুঁজতে শহরের মাঝে একটি ধর্মশালা পেয়ে সেখানেই রাত কাটাতে উঠলেন । সকালে ঘুম থেকে উঠে সুনন্দ দেখলেন তাঁর সাথীরা কেউ নেই । তাদের খুঁজতে গিয়ে নগর অধ্যক্ষের সঙ্গে তাঁর দেখা হলে সে তাঁর পায়ে পড়ে বলল, "হে মহান মুনি, আপনার সাথীরা কোথায় গিয়েছে তা আমি বলতে পারব না । কিন্তু এটা আমি বুঝেছি যে আপনার মত ভক্ত জগতে দুর্লভ । হে ব্রাহ্মণ, এই শহরে থাকবার জন্য আপনাকে আমি অনুরোধ করছি ।" নগরাধ্যক্ষের এই বিনীত অনুরোধ শুনে তিনি কিছুদিন সেখানে থাকতে মনস্থ করলেন । সুনন্দের সেবায় নগরপাল নিজে নিযুক্ত হলেন । আট দিন পর এক গ্রামবাসী সুনন্দের কাছে এসে কাঁদতে কাঁদতে বলল যে গতরাতে এক রাক্ষস তার ছেলেকে খেয়ে ফেলেছে । সুনন্দ এ বিষয়ে বিশদ জানতে চাওয়ায় সেই গ্রামবাসীটি বলতে শুরু করল ।
গ্রামবাসীর কথা
এই শহরে এক অতি ভয়ঙ্কর রাক্ষস বাস করে । প্রতিদিন সে তার ইচ্ছামত আমাদের ধরে ধরে খেত । একদিন আমরা সবাই মিলে তার কাছে গিয়ে আমাদের না খেতে অনুরোধ করলাম, বিনিময়ে আমরাই তার রোজকার খাদ্যের যোগান দেব বললাম ।
অতএব শহরের মাঝখানে এক সুন্দর ধর্মশালা বানান হল । যে সকল পথিক ওই শহরে আসত তাদের সেই ধর্মশালায় পাঠান হত বিশ্রাম করার জন্য । রাত্রিতে যখন পথিকরা সেখানে ঘুমিয়ে থাকত তখন রাক্ষস এসে তাদের ধরে খেত । এইভাবে আমরা রাক্ষসের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করছি । আপনি আপনার সাথীদের নিয়ে এই ধর্মশালাতেই ছিলেন । রাক্ষসটি কিন্তু আপনার সাথীদের সাথে আপনাকে খায়নি । এর কারণ বলছি শুনুন ।
গতরাতে আমার ছেলের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে আমি না জেনে ওই ধর্মশালায় পাঠিয়েছিলাম । আমার ছেলে এটা জানতে পেরে তার বন্ধুকে ফিরিয়ে আনতে যখন সেখানে গেল, রাক্ষসটি তখন তাকেও খেয়ে ফেলল । আজ সকালে আমি তাই রাক্ষসের কাছে গিয়ে কেন সে আমার ছেলেকে খেয়ে ফেলেছে জানতে চাইলাম । ছেলেকে ফিরে পাওয়ার যদি কোন উপায় থাকে সেটাও তাকে জিজ্ঞাসা করলাম ।
রাক্ষসটি বলল
'তোমার ছেলেও যে ওই ধর্মশালায় প্রবেশ করেছিল আমি তা জানতাম না । এখন তাকে ফিরে পাবার একটি মাত্র উপায় আছে । এইক্ষণে এই শহরে এক ব্রাহ্মণ রয়েছেন যিনি প্রতিদিন গীতার একাদশ অধ্যায় পাঠ করেন যার ফলে তিনি যখন আগে এই ধর্মশালায় উঠেছিলেন তখন আমি তাকে খেতে পারিনি । তিনি যদি এই অধ্যায়টি পাঠ করে আমার শরীরে জল ছিটিয়ে দেন, তাহলে আমি এই রাক্ষসের অভিসপ্ত দেহ থেকে মুক্ত হব ।"
রাক্ষসটির পূর্বকথা
গ্রামবাসীটি জানাল - বহু পূর্বে এখানে এক কৃষক থাকত । একদিন সে যখন মাঠ পাহারা দিচ্ছিল তখন অল্পদূরে এক বিরাট শকুন এক পথচারীকে আক্রমণ করে । সেই সময় একজন যোগীও রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন । তিনি আক্রান্ত পথচারীকে বাঁচাতে দৌড়ে গেলেও ততক্ষণে দেরী হয়ে গেছিল । তখন যোগীপুরুষ কৃষকের উপর ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, "দুষ্ট কৃষক, লোকটিকে এত কাছ থেকে আক্রান্ত হতে দেখেও তুই তাকে বাঁচানোর কোন চেষ্টাই করিসনি । তাই তোকে রাক্ষস হয়ে জন্মাতে অভিশাপ দিচ্ছি ।" কৃষকটি তখন মিনতি করল যে, সারা রাত পাহারা দিয়ে সে খুব ক্লান্ত ছিল, তাই তাকে যেন মুনিবর কৃপা করেন । তখন যোগী বললেন যে কেউ যদি গীতার একাদশ অধ্যায় পাঠ করে তার মাথায় জল ছিটিয়ে দেয়, তাহলেই তার শাপমুক্তি হবে ।
গ্রামবাসীটির কাছে এই ইতিহাস শুনে সুনন্দ তার সঙ্গে রাক্ষসের কাছে গিয়ে যোগীর কথা অনুযায়ী তাকে মুক্ত করে দিলেন । সেই রাক্ষসের সাথে সাথে তার খাওয়া হাজার হাজার লোকেরাও মুক্ত হয়ে দিব্য চতুর্ভূজ মূর্তি লাভ করল এবং এক দিব্য রথে চড়ে বসলেন । তখন গ্রামবাসিটি জানতে চাইল এদের মধ্যে কোনটা তার ছেলে । এতদিন রাক্ষসরূপে থাকা লোকটি হাসতে শুরু করল এবং সেই দিব্য রথে বসে থাকা হাজার হাজার সুপুরুষদের মধ্যে একজনকে দেখিয়ে দিল । গ্রামবাসিটি তার ছেলেকে তার সঙ্গে বাড়ি ফিরে যেতে মিনতি করল । পিতার অনুরোধে ছেলেটি হাসতে হাসতে বলল, "হে মহাশয়, বহুজন্ম ব্যাপী তুমি আমার এবং আমি তোমার পুত্র হয়েছি, কিন্তু এখন এই মহান ভক্ত সুনন্দের কৃপায় জন্ম-মৃত্যুর চক্র থেকে মুক্ত হয়ে এখন আমি আমার প্রকৃত গৃহ বৈকুণ্ঠে যাচ্ছি । মহাশয়, অনুগ্রহ করে সুনন্দের পাদপদ্মে শরণ নিয়ে গীতার একাদশ অধ্যায় শ্রবণ কর । তাহলে তুমিও ভগবান বিষ্ণুর কৃপা পাবে ।"
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধক্ষেত্রে সখা অর্জুনের প্রশ্নের উত্তরে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মুখ থেকে এই অমৃতময় নির্দেশ নির্গত হয়েছিল । এই আলোচনা ও গীতার একাদশ অধ্যায়ের পাঠ শুনে যে কেউ জন্ম-মৃত্যু চক্রের বন্ধন ছিন্ন করতে পারে ।
_________________________________________
*Hard Copy Source:
"Padmapuran, Uttarkhanda (Bengali)" by Veda Vyas, translated by Sri Tarakanta Debasharrma, Krishnadas Shastri and Sriramdas Shastri, edited by Pandit Panchanan Tarkaratna. Bangabasi-Electro-machine edition, 1915. Published & printed by Sri Natabar Chakraborty for Bangabasi Karyalay, 38/2 Bhabanicharan Datta Street, Kolkata. First Nababharat Edition, 2013 (with identical page layout). Nababharat Publishers, 72 D, Mahatma Gandhi Road, Kolkata-700009. 1062p.
Hard Copy Reference:
"Srimadvagabadgeeta Mahatmya (Bengali)" compiled by Sri Sanatangopal Das Brahmachari. 6th Edition, 2014 (First Edition 2005). Printed & published by Bhaktivedanta Book Trust, Mayapur-741313, Nadia, West Bengal, India. © 2014 by Bhaktivedanta Book Trust.
Sanskrit Source
English Translation
No comments:
Post a Comment