Saturday, September 5, 2015

শ্রীশ্রীগীতামাহাত্ম্যম্‌ (Padmapuran-16)


শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার ষোড়শ অধ্যায়ের মাহাত্ম্য

(শ্রীতারাকান্ত দেবশর্মা)*

মহাদেব কহিলেন
হে হরিণনয়নে ! হর্ষে তোমার উৎকণ্ঠা হইয়াছে, অতএব অতঃপর ষোড়শাধ্যায়-গৌরব বর্ণন করিতেছি, শ্রবণ কর । ১

গুর্জর মণ্ডলে সৌরাষ্ট্রিক নামক নগর বিদ্যমান, তথায় দ্বিতীয় চন্দ্রের ন্যায় খড়্গবাহু নামে এক নৃপতি ছিলেন । ভূপতি খড়্গবাহু সুরভিগর্ভ কুমুদমালামোদিত গুর্জর মণ্ডলে বাস করিতেন, তাঁহাকে দেখিয়া মনে হইত যেন - হরি রমার সহিত জলধি মধ্যে সুস্থ শয়ান রহিয়াছেন । বৈরিকৃত শ্বাসসমীরণে তদীয় নির্মল কীর্তি সর্বত্র সমাকীর্ণ হইয়াছিল, কিন্তু মনে হইত যেন - তাঁহার কর্পূরধবল কীর্তিকণা তারকাচ্ছলে নভোমণ্ডলে উদিত হইয়া রহিয়াছে । তাঁহার অসিধারারূপ তীর্থতোয়ে তদীয় শত্রু নৃপতিগণ স্নান করিয়া স্বর্গগমন করিলেও মনে হইত যেন, অমররমণীগণ দ্বারা বিমোহিত হইয়াই স্বর্গ হইতে প্রত্যাবর্তন করিতেছে না । ২-৫

এবম্ভূত বিভূতিসম্পন্ন ভূপতি খড়্গবাহুর অরিমর্দন নামে এক উদ্ধত দন্তী ছিল, তাহার যে মদধারা ক্ষরিত হইত, তাহাতে মধুপমণ্ডল পতিত হইয়া গুঞ্জন করিত । তাহার কপোল ফলক হইতে যে মদজল নির্গত হইত তাহা দেখিয়া মনে হইত, যেন, অঞ্জন পর্বতের নির্ঝরধারা পতিত হইতেছে । চন্দ্রকিরণের ন্যায় যে সকল উজ্জ্বল চামর তাহার অঙ্গে শোভা পাইত, ঐ সকল চামর কাননপথে পতিত জ্যোৎস্নার ন্যায় অনুমিত হইত । সন্ধ্যাকালীন মেঘসম্পর্কে আকাশমণ্ডল যেরূপ লোহিত বর্ণে শোভিত হয়, কুম্ভসিন্দুরে রঞ্জিত ঐ করিবরও তদ্রূপ শোভা পাইয়াছিল । ৬-৯

একদা ঐ করী বলপূর্বক সুদৃঢ় লৌহস্তম্ভ ভঞ্জনপূর্বক বন্ধনীনিগড় হইতে নির্মুক্ত হইয়া নিশাযোগে নির্গত হয় । গজপালেরা তখন তাহাকে তীক্ষ্ণমুখ অঙ্কুশাঘাত ও তাহার পার্ষ্ণিদেশে বেণুদণ্ড দ্বারা তাড়িত করিতে লাগিল; কিন্তু ক্রুদ্ধ করী তাহা কিছুমাত্র গ্রাহ্য করিল না, সে গজশালা ভাঙ্গিয়া ফেলিল । অনন্তর রাজা এই কৌতুকময় ব্যাপার শ্রবণে করিকলাকুশল কুমারগণের সহিত তথায় উপস্থিত হইয়া দেখিলেন, - সেই মহাবল মাতঙ্গ উদ্ভট বিক্রমে সকলকে মোহিত করিয়া গজশালা ভাঙ্গিয়া ফেলিয়াছে; পৌরগণ দূরে থাকিয়া সেই মহাভীম মাতঙ্গকে অবলোকন করিতেছে, ভয়াকুল পুরবাসীরা অন্য কার্য্য হইতে নিবৃত্ত হইয়া কেবল শিশুরক্ষায় ব্যস্ত রহিয়াছে, পলায়নপরায়ণ পৌরগণ দ্বারা পথ রুদ্ধ হইয়া গিয়াছে এবং সেই করীর দানধারাশীকরের উগ্রগন্ধে দিঙ্মণ্ডল বাসিত হইয়াছে । ১০-১৬

তৎকালে জনৈক দ্বিজ সরোবর হইতে স্নান করিয়া গীতার ষোড়শাধ্যায়ের কতিপয় শ্লোক পাঠ করিতে করিতে সেই পথে আসিতেছিলেন; গজরক্ষী ও পৌরগণ তাঁহাকে সে পথে আসিতে অনেক নিষেধ করিলেও তিনি তাহা মানিলেন না, পরন্তু ফুৎকারদ্বারা গজভীত বিচলিত পথিকগণকে আবরণপূর্বক অপসারিত করিয়া চলিয়া গেলেন । তৎকালে ঐ দ্বিজ গজের এতই সন্নিহিত হইয়াছিলেন যে, তাহার মদজল তদীয় গাত্র স্পর্শ করিয়াছিল, কিন্তু ইহাতেও তিনি নির্বিঘ্নে গমন করিতে পারিয়াছিলেন । ১৭-১৯

অনন্তর এই ব্যাপার দর্শনে পৌরগণ ও রাজার মনে এক বাক্যাতীত মহাবিস্ময় উপস্থিত হইল । ফুল্লরাজীবলোচন রাজা বাহন হইতে অবতরণ করিয়া দ্বিজকে আহ্বানপূর্বক জিজ্ঞাসা করিলেন । ১৯-২২

রাজা বলিলেন
হে বিপ্র ! আজ আপনি এক অলৌকিক মহাকাণ্ডের অনুষ্ঠান করিয়াছেন; আপনি কি করিয়া কৃতান্তকল্প এই করীর নিকট হইতে আত্মরক্ষা করিলেন ? হে প্রভো ! আপনি কোন্‌ দেবের অর্চনা করেন ? কি মন্ত্র জপ করেন ? এবং আপনার কোন্‌ সিদ্ধি আছে ? হে দ্বিজ ! তাহা প্রকাশ করুন । ২৩-২৪

দ্বিজ বলিলেন
হে রাজন্‌ ! আমি প্রতিদিন গীতার ষোড়শাধ্যায়ের কতিপয় শ্লোক পাঠ করিয়া থাকি, তাহাতেই আমার সকল সিদ্ধি হইয়া থাকে । ২৫

দ্বিজবাক্যশ্রবণানন্তর রাজা গজ ও তজ্জনিত কৌতুহল-রস পরিত্যাগপূর্বক দ্বিজকে লইয়া নিজ মন্দিরে আগমন করিলেন; তার পর শুভ মুহূর্ত দেখিয়া লক্ষসংখ্যক সুবর্ণ প্রদানে দ্বিজসত্তমের সন্তোষ সাধন করিয়া তাঁহারই নিকট গীতামন্ত্রে উপদিষ্ট হইলেন । ২৬-২৮

অনন্তর তিনি সৎকারপূর্বক সকৌতুকে গীতার ষোড়শাধ্যায়ের কতিপয় শ্লোক সম্যক্‌ অভ্যাস করিয়া একদা সৈনিকগণ সহ বাহনারোহণে পুর হইতে নির্গমনপূর্বক গজশালায় আগমন করিলেন । রাজা গজশালায় আসিয়া সেই মত্তমাতঙ্গকে বন্ধনমুক্ত করিলেন, তিনি স্পষ্টবাক্যে রাজ্যসৌখ্যে অনাদর করিয়া ও জীবনকে তৃণের মত মনে করিয়া গজের অগ্রে উপস্থিত হইলেন । গীতামন্ত্রবিশ্বাসী সাহসিকাগ্রণী রাজা নিজ করে সেই মদমত্ত নিরঙ্কুশ করীর গণ্ড কণ্ডূয়ন করিয়া দিলেন । তিনি রাহুর গ্রাস হইতে চন্দ্রের ন্যায়, কালবদন হইতে ধার্মিকের ন্যায় এবং ধুর্তের কবল হইতে সাধুর ন্যায় সেই গজের নিকট হইতে নির্বিঘ্নে নির্গত হইয়া আসিলেন । ২৯-৩৩

অনন্তর রাজা স্বনগরে আগমনপূর্বক নিজ কুমারকে রাজ্যে অভিষিক্ত করিয়া গীতা-ষোড়শাধ্যায় পাঠে পরম গতি প্রাপ্ত হইলেন । ৩৩-৩৪

[পদ্মপুরাণ, উত্তর খণ্ড, ১৯০ অধ্যায়]
_________________________________________

চলিত বাংলায় সারাংশ


গুজরাটের সৌরাষ্ট্র নগরে খড়্গবাহু নামে এক রাজা ছিলেন । অরিমর্দন নামে তার এক ক্ষেপা হাতি ছিল । একদিন হাতিটি ক্ষেপে গিয়ে শিকল ছিঁড়ে হাতিশালা ভাঙ্গতে লাগল, তারপর নগরবাসীদের তাড়া করল । চারিদিকে হুলুস্থুল পড়ে গেল, অনেকে পদপিষ্ট হল । এই বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্যে রাজা দেখলেন একজন ব্রাহ্মণ সরোবর থেকে স্নান করে শান্তভাবে রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসছেন । অনুচ্চকণ্ঠে তিনি গীতার ষোড়শ অধ্যায়ের প্রথম তিনটি শ্লোক জপ করছিলেন, যার প্রথম শব্দটি ছিল 'অভয়ম্‌' । চারিপাশের লোকেদের নিষেধ উপেক্ষা করে তিনি সোজা পাগলা হাতিটির দিকে এগোতে লাগলেন । ব্রাহ্মণকে তার দিকে আসতে দেখেই হাতিটি সমস্ত ক্রোধ হারিয়ে শান্তভাবে শুয়ে পড়ল । ব্রাহ্মণ তার গায়ে ধীরে ধীরে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন ।

কিছুক্ষণ হাতিটিকে আদর করার পর ব্রাহ্মণটি ধীর গননে সেখান থেকে চলে গেলেন । রাজা ও শহরবাসী এই বিস্ময়কর ঘটনা প্রত্যক্ষ করে অবাক হয়ে গেলেন । রাজা ছুটে গিয়ে ব্রাহ্মণের পায়ে পড়ে তার এই বিস্ময়কর শক্তির রহস্য জানতে চাইলেন । উত্তরে ব্রাহ্মণ বললেন, "আমি প্রতিদিন গীতার ষোড়শ অধ্যায়ের কয়েকটি শ্লোক পাঠ করে থাকি ।"

অতঃপর ব্রাহ্মণকে রাজা সমাদরে তার প্রাসাদে নিয়ে এসে একশত স্বর্ণমুদ্রা প্রদান করে এই গীতামন্ত্রের উপদেশ নিলেন । কিছুকাল এই শ্লোকগুলো পাঠ করার পর রাজা খড়্গবাহু একদিন হাতিশালায় গিয়ে নিজের হাতে ক্ষেপা হাতিটিকে মুক্ত করলেন । হাতিটি শান্তভাবে শুয়ে থাকল ও রাজা তার গায়ে হাত বুলিয়ে দিলেন । রাজা রাহুর গ্রাস থেকে চাঁদের মতন, ধুর্তের কবল থেকে সাধুর মতন সেই হাতিটির কাছ থেকে নির্বিঘ্নে বেরিয়ে আসলেন । তারপর তাঁর পুত্রকে রাজ্যে অভিষিক্ত করে গীতার ষোড়শ অধ্যায়ের নিরন্তর পাঠ করে অচিরেই পরম গতি প্রাপ্ত হলেন ।
_________________________________________
*Hard Copy Source:
"Padmapuran, Uttarkhanda (Bengali)" by Veda Vyas, translated by Sri Tarakanta Debasharrma, Krishnadas Shastri and Sriramdas Shastri, edited by Pandit Panchanan Tarkaratna. Bangabasi-Electro-machine edition, 1915. Published & printed by Sri Natabar Chakraborty for Bangabasi Karyalay, 38/2 Bhabanicaran Datta Street, Kolkata. First Nababharat Edition, 2013 (with identical page layout). Nababharat Publishers, 72 D, Mahatma Gandhi Road, Kolkata-700009. 1062p.

Hard Copy Reference:
"Srimadvagabadgeeta Mahatmya (Bengali)compiled by Sri Sanatangopal Das Brahmachari. 6th Edition, 2014 (First Edition 2005)Printed & published by Bhaktivedanta Book Trust, Mayapur-741313, Nadia, West Bengal, India. © 2014 by Bhaktivedanta Book Trust.

Sanskrit Source
English Translation

[Digitised by scanning (if required) and then by typing mostly in Notepad using Unicode Bengali "Siyam Rupali" font and Avro Phonetic Keyboard for transliteration. Uploaded by rk
 
<Previous--Contents--Next>

No comments:

Post a Comment